বসু-বাড়ি – ৫

মেয়ে পছন্দ করে সম্বন্ধ পাকাপাকি হবার পরেও বেশ কিছুদিন আমার মা’র বিয়ে আটকে ছিল। কারণ বাড়ির বড় ছেলে আমার জ্যাঠাবাবুর শাস্ত্রীয় মতে সম্বন্ধ পেতে দেরি হচ্ছিল। তোমরা জানো কি না জানি না; বহুদিন কায়স্থ সমাজে কুলীন ও মৌলিক এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে বিয়ে চলত না। প্রায় বারো পুরুষ আগে আমাদের এক নামকরা পূর্বসূরী গোপীনাথ বসু বা পুরন্দর খাঁ ঠিক করেন যে, নিয়মটা কেবল বড় ছেলের বেলায় মানলেই চলবে। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত জ্যাঠাবাবুর ভাল কুলীনের ঘরে সম্বন্ধ পাওয়া গেল এবং বড় ও মেজ ভাইয়ের একই সঙ্গে বিয়ে হল। মা’র বয়স তখন চোদ্দ, আর জ্যাঠাইমার বয়স আরও কম। দুজনেই পরস্পরকে দিদি বলে ডাকতেন, কারণ একজন বয়সে বড়, অন্যজন সম্পর্কে বড়। 

বিয়ে আটকে যাওয়ায় আমার দাদামণি ও দিদিমণি (আমরা দাদামশাই ও দিদিমাকে ঐভাবে ডাকতাম) অস্থির হয়ে পড়লেন। লোকে বলতে লাগল, মফস্বলের কোন্ এক উকিলের ছেলের জন্য অনির্দিষ্ট কাল বসে থাকবে? দাদামণি অক্ষয়কুমার দে দাদাভাই জানকীনাথকে ধরলেন, অন্তত পাকা দেখাটা করে রাখা যাক। দাদাভাই বললেন, আমার মুখের কথাই পাকা, অনুষ্ঠান করে পাকা দেখার কোনো প্রয়োজন নেই। সেই থেকে বাড়ির ছেলেদের বিয়েতে পাকা দেখা উঠে গেল। সকলে একটা শিক্ষাও পেলেন—মুখের কথার দাম যে দেয়, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান তার কাছে বড় নয়। 

মা বিভাবতী ছিলেন উত্তর কলকাতার এক বনেদি পরিবার পটলডাঙার দে-বিশ্বাস বাড়ির মেয়ে। এক বোন, এক ভাই। শুনেছি ছেলেবেলায় বোনের দাপটই ছিল বেশি, আর ভালমানুষ দাদা (আমাদের মামাবাবু) বোনের সব আবদার ও হুকুম মেনে চলতেন। পরিবারটি ছিল বসু-বাড়ির মতো আর একটি বিরাট একান্নবর্তী সংস্থা। কলেজ স্কোয়ারে সংস্কৃত কলেজের উল্টো,দিকে প্রকাণ্ড চকমেলানো বাড়িতে অসংখ্য লোক বাস করতেন। বইয়ের দোকানের দৌলতে তোমরা নিশ্চয়ই শ্যামাচরণ দে স্ট্রীটের নাম শুনেছ। শ্যামাচরণ ছিলেন আমার দাদামণি অক্ষয়কুমারের জ্যাঠামশাই। কলেজ স্কোয়ারে আমাদের মামার বাড়ির বাইরের ঘরটিতে এক বিরাট ফরাস পাতা থাকত ও বড়-বড় তাকিয়া সেখানে গড়াগড়ি দিত। শ্যামাচরণের সময় ঐ বাইরের ঘরে সেইসময়কার অনেক জ্ঞানীগুণী লোক নিয়মিত জমায়েত হতেন এবং আড্ডা দিতেন। তার মধ্যে ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি। পরের জেনারেশনে পটলডাঙ্গার দে-বিশ্বাসরা বেশ কয়টি নামকরা জামাই পেয়েছেন, যেমন শরৎচন্দ্র বসু, রাজশেখর বসু (পরশুরাম) ও নরেন্দ্রকুমার বসু। 

দাদামণি ওকালতি করতেন। ফিটফাট একটি ঘোড়ার গাড়ি চেপে কোর্টে বেরোতেন। তাঁর জীবনীশক্তি ছিল অফুরন্ত এবং সত্যিকারের রসিক লোক ছিলেন তিনি। জীবনের সব ভাল দিকগুলি উপভোগ করতে চাইতেন—সংস্কার-মুক্ত মন ছিল তাঁর। বাড়ির গোঁড়ামি অগ্রাহ্য করে সে সময়কার সেরা সাহেবি রেস্টোরান্ট ফিরপো-পেলিটিতে গিয়ে ভাল মাংস ইত্যাদি খেয়ে আসতেন। বেশ মনে আছে, জীবনে প্রথম সিনেমা দেখেছি দাদামণির সঙ্গে। ভাল চা ও উৎকৃষ্ট লস্যি মানুষকে কী আনন্দ দিতে পারে সেটা দাদামণির মধ্যে দেখেছি। বুড়ো বয়সেও, যখন একটি দাঁতও অবশিষ্ট নেই, নাতি-নাতনিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মাংসের হাড় চিবিয়ে খেতেন। অন্যদিকে আবার ইংরেজি সাহিত্যের প্রতিও ঝোঁক ছিল খুব জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তাঁর হীরো। কলকাতার টাউন হলে “সুরেন বাঁড়ুজ্যে”র ভাল-ভাল বক্তৃতা অনর্গল আমাদের শুনিয়ে যেতেন। 

একমাত্র মেয়ে বিভা ছিল দাদামণির চোখের মণি। শ্বশুরবাড়িতে মেয়েকে দেখতে প্রায়ই কোর্ট-ফেরত উডবার্ন পার্কের বাড়িতে আসতেন। তবে বেশি সময় এক জায়গায় তিনি বসতে পারতেন না। “বিভা, বিভা” বলে হাঁকতে-হাঁকতে ঝড়ের মতো আসতেন, চায়ের কাপ শেষ হতে না হতেই আবার হাঁকতেন, “চললুম” আর সবেগে প্রস্থান করতেন। শুনেছি বিয়ের দিন জামাইকে দেখে প্রথমত দিদিমণি খুব উৎসাহিত হননি। কিন্তু দাদামণি জোরের সঙ্গে বলেছিলেন, জামাই অনেক বড় হবে এবং তাঁর মেয়ে “রাজরানি” হবে। পরে বাবার দুটি লম্বা জেল-বাসের সময় দাদামণি দুঃখ করে মা’কে বলতেন—তাকে তো আমি সত্যিই রাজরানি করে দিয়েছিলুম, তবে এ কী হল! রাজরানি রাজরোষে পড়েছিলেন। 

ছেলেবেলায় দাদামণি ছিলেন আমাদের খেলার সাথী। পরে কলেজের ছাত্র হবার পর মামার বাড়িতে অন্য কারণে দাদামণিই ছিলেন ব্যক্তিগতভাবে আমার প্রধান আকর্ষণ। দিনের পর দিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁর সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলতাম। সুরেন বাঁড়জ্যের পুরনো রাজনীতির গণ্ডি ছাড়িয়ে তিনি খোলা মনে সুভাষচন্দ্রের রাজনীতি ও দেশের বিপ্লবী আন্দোলনের আদর্শ ও ধারা বোঝবার চেষ্টা করতেন। যুদ্ধের সময় বিদেশ থেকে নেতাজির রেডিও-বক্তৃতা তিনি নিয়মিত মন দিয়ে শুনতেন। সুভাষচন্দ্রের সংগ্রামের আহ্বানে সত্তর বছরের বৃদ্ধও উত্তেজিত হয়ে হাতের মুঠো শক্ত করে পায়চারি করতে আরম্ভ করতেন। দিদিমণি সুবালা নাতি-নাতনিদের নিয়ে খানিকটা বাড়াবাড়ি করতেন বলা চলে। তবে আবার বেশ রাশভারী ও অভিমানী মহিলা ছিলেন। আচার-অনুষ্ঠান সম্বন্ধে গোঁড়ামি ছিল যথেষ্ট। সেকালে তাঁর মতো এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে ছোট পরিবার বড় একটা দেখা যেত না। জামাই তো বড়ই ব্যস্ত, দেখা পাওয়াই ভার। সেজন্য আদর-আপ্যায়নের সিংহভাগ নাতি-নাতনিরাই পেত। শেষ জীবনটা ছিল গভীর শোকের। জামাই ও একমাত্র মেয়ের মৃত্যু তাঁকে দেখে যেতে হয়েছিল। 

মামাবাবু অজিতকুমার দে-কে বাদ দিয়ে আমাদের ছেলেবেলা বা ছাত্রজীবনের কথা ভাবতেই পারি না। বাবা সেই সময় দু’বারে আট বছর জেলে ছিলেন। প্রথমবার আমি স্কুলে পড়ি। দ্বিতীয়বার আমি মেডিকেল কলেজের ছাত্র। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। আমার সামান্য জীবনের একটা বড় ঘটনা এই যে, দ্বিতীয়বার আমিও বাবার বন্দী-জীবনের ভাগ পেয়েছিলাম এবং বেশ কিছুদিন জেলবাস করেছিলাম। যাই হোক, আমার মা দু’বারই ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে বেশ বিপাকেই পড়েছিলেন। মামাবাবু – আমরা তাঁকে ডাকতুম মাম বলে—অতি সহজভাবেই আমাদের দেখাশুনোর ভার তুলে নিলেন। তাঁর মনটা ছিল খুব নরম, উগ্রপন্থী রাজনীতি তাঁর জন্য ছিল না। কিন্তু আমাদের পারিবারিক বিপর্যয়ের সময় তাঁর সর্বশক্তি দিয়ে তিনি আমাদের আগলে রেখেছিলেন। 

আমার মনে হয় মামার বাড়ির পারিবারিক শান্তি ও স্বাচ্ছন্দ্যের মূলে ছিলেন বাড়ির বৌমা ও আমাদের মামিমা রেণু বা সুরমা। বাঙালির ঘরে বৌমার প্রকৃত কল্যাণময় রূপ আমি মামিমার মধ্যে দেখেছিলাম। তিনি ছিলেন বঙ্গবাসী কলেজের প্রতিষ্ঠাতা গিরিশচন্দ্র বসুর ছোট মেয়ে। সম্ভ্রান্ত পরিবার। সকলের সেবাযত্ন করাই যেন মামিমার জীবনের ব্রত ছিল। নিজের পরিবারের ও বাইরের ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির ও রুচির লোকেদের তিনি ঠিক সামলে রাখতে পারতেন। মেডিকেল কলেজের ছাত্রজীবনের পুরোটাই আমি মামিমার সহৃদয় আতিথ্য পেয়েছি। মেডিকেল কলেজে ছাত্রদের প্রোগ্রাম সকাল থেকে সন্ধ্যা। মামারবাড়ি কলেজের কাছেই, সুতরাং মামিমার কাছে দুপুরের মাছ-ভাত খাওয়াটা পাকাপাকিভাবে বরাদ্দ। যুদ্ধের সময় গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় রাজবন্দী হয়ে মেডিকেল কলেজের হাসপাতালে কিছুদিন ছিলাম। মামিমার রান্না-করা পথ্য পুলিস-পাহারা পেরিয়ে আমার কাছে পৌঁছে যেত। 

আমি যে যুগে জন্মেছি সেটা ছিল অসহযোগের যুগ। গান্ধীজী তাঁর অহিংসা অসহযোগের মন্ত্র দিয়ে সারা দেশকে মাতিয়ে তুলেছেন। বিদেশী সরকারের সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখা চলবে না, সব ‘বিষয়ে সম্পূর্ণ স্বাবলম্বী হতে হবে। তাঁর প্রভাব থেকে ছেলে-বুড়ো কেউ বাদ পড়েনি। প্রাথমিক স্কুল থেকে আরম্ভ করে ম্যাট্রিক পর্যন্ত আমি ও আমার সমবয়সীরা সেই খাঁটি স্বদেশিয়ানার মধ্যে বড় হয়েছি। আমার মনে হয় বসুবাড়ির যাঁরা কলকাতায় থাকতেন, তাঁদের উপর স্বদেশী আন্দোলনের প্রভাব পড়েছিল বেশি। এর কতকগুলি কারণ ছিল। প্রথমত রাঙাকাকাবাবু সুভাষচন্দ্র তো দেশের ডাকে আই সি এস ত্যাগ করে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের দলে যোগ দিয়েছেন। বাবার সঙ্গে ছিল রাঙাকাকাবাবুর বিশেষ সম্পর্ক। বাবাও অল্পদিনের মধ্যে দেশবন্ধুর এক প্রধান সহযোগী হয়ে উঠলেন। আর বাবা ও রাঙাকাকাবাবু যাই করুন না কেন, তাতেই আমার মায়ের সায় ছিল। সুতরাং বুঝতেই পারছ আমাদের শিশুজীবন ও কৈশোর সব দিক দিয়ে স্বদেশী-প্রভাবিত ছিল। অবশ্য আমি এটা বলছি না যে বসু-বাড়িতে এর ব্যতিক্রম ছিল না। 

গান্ধীজী দেশকে জাগিয়েছিলেন প্রধানত চরকা ও খদ্দরের মাধ্যমে। আমাদের বাড়িতে কোন ব্যাপারেই, ছোটদের বেলাতেও, খদ্দর ছাড়া কিছু চলবে না। সব জামাকাপড়, প্যান্ট, শার্ট, পাঞ্জাবি, বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড়, ধুতি, শাড়ি, গায়ের চাদর, জানালা-দরজার পরদা, সবই খদ্দরের। সেকালে কিন্তু আজকালকার মতো মোলায়েম খদ্দর পাওয়া যেত না। মোটা খদ্দরের কাপড়জামা পরতে হত। বাবা কোর্টের পোশাকও খদ্দরের পরতেন। কোন বিশেষ কারণে সিল্ক পরতে হলে, সেটাও পুরোপুরি দেশী সিল্ক হওয়া চাই। আজও সেজন্য আমাদের কাছে খদ্দর এক বিশেষ ধরনের ঐতিহ্যবাহী পরিধান। আগেই তো বলেছি, বাবা-মা আমাদের নিয়ে পাহাড়ে বেড়াতে যেতেন। সেকালে ভাল গরম কাপড় বেশির ভাগই বিলেত থেকে আসত। খুঁজে পেতে পাঞ্জার বা কাশ্মীরে তৈরি গরম কাপড় যোগাড় করে মা আমাদের গরম কাপড়-জামা বানিয়ে দিতেন। 

খদ্দর পরা ছাড়া বাড়ির যাঁরাই পারতেন চরকাতে বা তকলিতে সুতো কাটতেন। সেই সুতো দিয়ে আবার কাপড় তৈরি করতে দেওয়া হত। যাঁরা এটা পারতেন, তাঁরা বিশেষ গৌরবের অধিকারী হতেন। আমারও মনে আছে খানিকটা বড় হবার পর আমিও তকলিতে অনেক সুতো কেটেছি। তোমরা হয়তো ভাবছ আমি খদ্দর নিয়ে এত কথা বলছি কেন। বড় কথা হল যে, খাদি ও চরকার মাধ্যমেই আমরা আমাদের দেশের নবজাগরণের শরিক হয়েছিলাম। বিলেতি কাপড় পরা বা বিলেতি জিনিস ব্যবহার করা ছোট বয়স থেকেই আমাদের কাছে লজ্জার কথা বলে মনে হত। যাঁরা তা করতেন, তাঁদের আমরা কৃপার চোখে দেখতাম এবং আমাদের হিসাবে তাঁরা ছিলেন বিজাতীয়। 

রাঙাকাকাবাবু ১৯২৪ সালের শেষ থেকে ১৯২৭-এর প্রথম পর্যন্ত বর্মায় বন্দী ছিলেন। ঐ সময় তিনি বাবা-মাকে অসংখ্য চিঠি লিখেছিলেন। অন্যান্য অনেক বিষয়ের মধ্যে খদ্দর, সুতো-কাটা, কাপড়-বোনা সম্বন্ধেও তিনি খোঁজ-খবর নিতেন। এই সূত্রে বহু দিন পরের, ১৯৩৭ সালের একটা কথা মনে পড়ল। ততদিনে খদ্দরের ঝোঁকটা দেশে অনেকটা কমে এসেছে। তাছাড়া অনেক দেশী মিলের কাপড় চালু হয়েছে। রাঙাকাকাবাবু জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন, এলগিন রোডের বাড়িতে দেখা করতে গিয়েছি, গায়ে একটি মিলের কাপড়ের শার্ট। সম্ভাষণের পর বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন এবং শেষে গম্ভীরভাবে বললেন, “কী, খদ্দর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে নাকি?” আমি আমতা-আমতা করলাম। বাড়ি ফিরে মাকে বললাম, পুরোপুরি খদ্দরেই ফিরে যাওয়া যাক। 

আমাকে যখন কিণ্ডারগার্টেনে ভর্তি করা হবে স্থির হল, তখনও পুরোপুরি দেশী কোনো স্কুলে ঐ বিভাগ চালু ছিল না। ভবানীপুরের মেয়েদের স্কুল ডায়োসেশনে আমাকে ভর্তি করা হল। ঐ মিশনারি স্কুলের নীচের কয়েকটি ক্লাসে অল্প সংখ্যায় ছেলেদের নেওয়া হত, এখনও হয় শুনেছি। স্কুলের কর্ত্রী তখন ছিলেন একজন জাঁদরেল মিশনারি মহিলা-ডরোথি ফ্রান্সেস। দেখলেই ভয় করত, ফলে স্কুলের ডিসিপ্লিন ভাল ছিল। শিক্ষয়িত্রীরা কিন্তু বেশির ভাগই বাঙালি ছিলেন এবং আমাদের খুব আদরযত্ন করতেন। কলকাতার বহু অভিজাত হিন্দু, মুসলমান ও খ্রীষ্টান পরিবারের ছেলেমেয়েরা ঐ স্কুলে পড়ত। সাহেবঘেঁষা ও কর্তা-ভজা পরিবারের অবশ্য অভাব ছিল না। তাঁদের জন্য কয়েকটি সাহেবি স্কুল ছিল। 

রাঙাকাকাবাবুকে আমার মা ডাকতেন ‘ছোটদা’। ছোটদা তাঁর মেজবৌদিদিকে ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা সম্বন্ধে নিজের মতামত জানাতেন ও পরামর্শ দিতেন—সে তিনি জেলেই থাকুন বা বিদেশেই থাকুন। শিশুশিক্ষা সম্বন্ধে রাঙাকাকাবাবুর মতামত খুব ব্যাপক, প্রগতিশীল ও বৈজ্ঞানিক ছিল। শিশুমনের যাতে সার্বিক বিকাশ হয় তার ব্যবস্থা করার জন্য রাঙাকাকাবাবু মাকে নানারকম পরামর্শ দিতেন। ডায়োসেশন স্কুলে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য হাতের কাজ, গান-বাজনা, খেলাধুলা ইত্যাদির মোটামুটি ভাল ব্যবস্থাই ছিল। আমার মনে আছে আমি নিজে লেখাপড়ার চেয়ে হাতের কাজে বেশি আগ্রহী ছিলাম এবং ডায়োসেশনে প্রাইজ্‌ যা-কিছু পেতাম তা হাতের কাজের জন্য, লেখাপড়ায় নয়। কিন্তু স্কুলের শিক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে যেতে পারে এই ভেবে রাঙাকাকাবাবুর পরামর্শে বাবা-মা ছবি আঁকা শেখাবার জন্য আমার খুব কম বয়সেই একজন মাস্টারমশাই রেখে দিলেন। আমার দিদি মীরাকেও কিছুদিন পরে ঐ শিক্ষায় আমার সঙ্গী করে দেওয়া হল। আমি কোনদিনও ছবি আঁকায় বিশেষ পারদর্শী হতে পারলাম না, কিন্তু মাস্টারমশাই শ্রীহরেন সেনগুপ্ত আমার মধ্যে শিল্প ও শিল্পকর্ম সম্বন্ধে এমন একটা রুচি ও ধারণার সৃষ্টি করেছিলেন যেটা পরবর্তী জীবনে আমার খুব কাজে লেগেছে। আমাদের মাস্টারমশাইরা যে বাবা-মা’র কল্যাণে সহজেই আমাদের পরিবারভুক্ত হয়ে যেতেন তাই নয়, বাবা ও রাঙাকাকাবাবুর দেশের কাজেও তাঁরা অংশীদার হতেন। যে হরেন সেনগুপ্তমশাই আমার শিশু বয়সের আর্টের শিক্ষক, তিনি বৃদ্ধবয়সে আজও নেতাজীর কাজ করে চলেছেন। আজকের নেতাজী মিউজিয়মের সব তৈলচিত্রই তাঁর আঁকা। 

ছেলেবেলায় অসুখ-বিসুখ তো আমার লেগেই থাকত। মাকে সেজন্য অনেক দুর্ভোগ পোয়াতে হয়েছে। মা হোমিওপ্যাথিক গৃহচিকিৎসার বই হাতের কাছে রাখতেন, আর থাকত একটা কাঠের বাক্সে সুন্দরভাবে সাজানো হোমিওপ্যাথিক ওষুধের ছোটছোট শিশি। হোমিওপ্যাথিক গুলি তো খেতে ভাল, খেয়েছিও অনেক। কবিরাজী চিকিৎসারও বাড়িতে বেশ চলন ছিল। সেকালের শ্রেষ্ঠ কবিরাজ ও দাদাভাইয়ের বিশেষ সুহৃদ শ্যামাদাস বাচস্পতির কথা তো আগেই বলেছি। কবিরাজী ওষুধ তৈরি করতে হাঙ্গামা অনেক এবং সবক্ষেত্রে তা সুস্বাদুও নয়। কিন্তু মা ওষুধ ও রুগির পথ্য হাতে নিয়ে এসে দাঁড়ালে না বলবার উপায় ছিল না। অ্যালোপ্যাথিও চলত পাশাপাশি, কারণ আমাদের নতুনকাকাবাবু সুনীলচন্দ্র ছিলেন বিলেত-ফেরত ডাক্তার। তিনি নিজে তো আছেনই, অন্যান্য অনেক বিশেষজ্ঞ বন্ধুদেরও প্রয়োজনমতো হাজির করতেন। 

বাড়ির অসুখ-বিসুখের ব্যাপারে, বিশেষ করে ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে, রাঙাকাকাবাবুর মতামত ছিল বিজ্ঞানধর্মী। যেমন ধরো, আমার ম্যালেরিয়া হয়েছে এবং ক্রমাগত তেতো কুইনিন মিক্‌সচার গলাধঃকরণ করতে হচ্ছে। রাঙাকাকাবাবু মাকে লিখলেন, কেবল ওষুধ খাওয়ালেই তো চলবে না, রোগের মূল কারণ বের করে তার প্রতিবিধান করতে হবে। বললেন, বাড়িতে মশার বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করুন। দিদির হল টাইফয়েড, রাঙাকাকাবাবু বলে পাঠালেন, বাড়িতে এত সংক্রামক রোগ কেন হয়, এ-বিষয়ে অনুসন্ধান হওয়া দরকার। রাঙাকাকাবাবুর নিজেরও অসুখ-বিসুখ কম করেনি। পরে ১৯৩৬ সালে আমাদের কার্শিয়ঙের বাড়িতে তাঁর সঙ্গে থাকবার সময় দেখেছি, আধাডাক্তারি ও গৃহচিকিৎসার বই পড়ছেন। কিছুদিন আগেই ইউরোপে তাঁর পেটে অপারেশন হয়েছিল। দেখলাম গল ব্লাডার বা পিত্তকোষ সম্বন্ধে অনেক কিছু জানেন। তাঁর প্রায়ই সায়াটিকার ব্যথা হত, শরীরের এই বিশেষ নার্ভ সম্বন্ধে দেখলাম তিনি বেশ ওয়াকিবহাল। নানা রোগের উপসর্গ ও লক্ষণ সম্বন্ধে তাঁর বেশ জ্ঞান থাকায় তাঁর আর একটি সুবিধা হয়েছিল। প্রয়োজন হলে জেলের কর্তৃপক্ষ বা পুলিসকে বেশ ধোঁকা দিতে পারতেন। 

১৯৩৪ সাল। বাবা তখন কার্শিয়ঙে গিধাপাহাড়ে নিজের বাড়িতে অন্তরীণ হয়ে আছেন। হঠাৎ এক সকালে কার্শিয়ঙের বাড়ির চৌকিদার আমাদের কলকাতার ১ নং উডবার্ন পার্কের বাড়িতে এসে উপস্থিত। এসেই মা’র সঙ্গে কিছু গোপন কথাবার্তা। লুকিয়ে এসেছে। বাবা কিছু জরুরি গোপনীয় কাগজপত্র কালু সিংয়ের মারফত পাঠিয়েছেন। মা’র হাতে সেগুলি নিরাপদে সমর্পণ করে কালু সিং হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। 

কালু সিং নেপালি ব্রাহ্মণ। কার্শিয়ঙে যে বিদেশী সাহেবের কাছ থেকে বাবা বাড়িটি কিনেছিলেন, তারও সে চৌকিদার ছিল। বাড়ির সঙ্গে-সঙ্গে সে বাবার চৌকিদার হয়ে গেল। সপরিবারে সে আমাদের বাড়ির এলাকার মধ্যেই থাকত। বাবার প্রতি তার আনুগত্য ছিল সম্পূর্ণ, এবং বাবাও তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতেন। পরে ১৯৩৬ সালে রাঙাকাকাবাবু যখন বাবার মতো কার্শিয়ঙের বাড়িতে অন্তরীণ হন, তখন তাঁর সঙ্গেও কালু সিংয়ের একই রকম সম্পর্ক গড়ে ওঠে। 

প্রথমেই কালু সিংয়ের যে গোপনযাত্রার কথা বললাম, তার বিবরণ পরে শুনেছিলাম। বাবা ঠিক করলেন যে, একটা জরুরি বার্তা পুলিসের চোখ এড়িয়ে মা’র হাতে পৌঁছে দেওয়া দরকার। কালু সিং কাগজপত্র তার জুতার মধ্যে রাখল। তারপর যেন একটু বেড়াতে যাবার ভান করে রাস্তায় নেমে এল। আমাদের বাড়িটা ছিল কার্শিয়ঙ শহর থেকে প্রায় আড়াই মাইল দূরে। বাড়ির কাছ দিয়েই গয়াবাড়ি ও তিনধরিয়া পর্যন্ত একটা পাহাড়ি রাস্তা বা পাকদণ্ডি নেমে গেছে। পাহারাওয়ালারা দেখল কালু সিং নিয়মমাফিক পাকদণ্ডির দিকে একটু ঘোরাফেরা করছে। তাদের অগোচরে সে পাকদণ্ডি ধরে গয়াবাড়ি পৌঁছে গেল। গয়াবাড়ি থেকে পাহাড়ি ছোট ট্রেন ধরে শিলিগুড়ি। তারপর শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং মেলে চেপে সোজা কলকাতা। বাবা ছাড়া আর কেউ জানলেন না যে, কালু সিং কোথায় গেছে। 

আগেই তো বলেছি, বাবা কালু সিংকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতেন। অন্য পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার সময়ও কালু সিংকে আনিয়ে নিতেন। সে হত আমাদের যাত্রার ম্যানেজার আর ছোট ছেলেমেয়েদের ভারও তারই। সে যেমন খুব ডিসিপ্লিনের ভক্ত ছিল এবং আমদের খুব কড়া শাসনে রাখত, তেমনই আমাদের খেলার সাথীও ছিল। বাড়িতে কোনো বিয়ে বা অন্য কোনো বড় অনুষ্ঠান উপলক্ষেও কালু সিং কলকাতায় চলে আসত এবং বাবাও তাকে বিশেষ কোনো দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত হতেন। 

বাবার কাছে শুনেছি, এবং দেখেছিও কার্শিয়ঙে একলা অন্তরীণ থাকার সময় কালু সিং রোজ সন্ধ্যায় বাবার সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প ও নানা বিষয়ে আলোচনা করত। কেবল সাংসারিক কথাবার্তাই নয়। দেশের নানা সমস্যা নিয়ে বাড়ির কর্তা ও চৌকিদারের মধ্যে আলোচনা হত। বাবা নিজেই বলেছেন, অনেক ব্যাপারে কালু সিংয়ের মতামত তিনি মেনে নিতেন। 

রাঙাকাকাবাবুরও ঠিক একই রকম অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ব্রিটিশ সরকারকে কী কী ভাবে বেকায়দায় ফেলা যায়, এরকম বিষয় নিয়েও কালু সিং লামা সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে আলোচনা করত। সে তো ইংরেজি লেখাপড়া শেখেনি, কিন্তু তার বুদ্ধি ও কমনসেন্স ছিল প্রখর, বাবা ও রাঙাকাকাবাবুর পাল্লায় পড়ে সে রাজনীতির অনেকটাই বুঝে ফেলেছিল। ক্রমে-ক্রমে আমাদের প্রকাণ্ড পরিবারের প্রায় সকলকেই সে চিনে ফেলেছিল। আমাকে সে পরে বলত যে, ঐ দুই ভাইকে দেখবার বা জানবার পর, আর কাউকে তার তেমন পছন্দ হত না। 

আগেই তো বলেছি শিশুবয়সে কাশ্মীরে কালু সিং আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিল। হয়তো বা সেজন্যই তার সঙ্গে আমার এক বিশেষ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ছাত্রাবস্থায় আমি বাবা-মা’র মত নিয়ে একলাই কার্শিয়ঙে কালু সিংয়ের হেফাজতে থেকেছি। যে পাহাড়ের গায়ে আমাদের বাড়ি, তার নাম গিধাপাহাড়। কালু সিংয়ের মতে নামটা এসেছিল ‘গৃধ’ বা শকুন থেকে, কারণ পাহাড়ের চূড়োটা ছিল শকুনের মাথার মতো। গিধাপাহাড় ছিল আমাদের, বিশেষ করে আমার, ছেলেবেলার অতি প্রিয় ও আনন্দের জায়গা। সেখানেই আমরা বাবা-মা’কে একসঙ্গে খুব কাছে পেতাম। আর কালু সিংয়ের তদারকিতে সবকিছুই ছোটদের মনের মতো চলত। সেই তো আমাকে প্রথম পাহাড়ে চড়তে শেখায়। বাড়ি থেকে গিধাপাহাড়ের চূড়োটা পর্যন্ত ওঠা ছিল এই শিক্ষার প্রথম ধাপ। তারপর সে আমাকে গিধাপাহাড়ের চেয়ে আরও খানিকটা উঁচু আর একটা পাহাড়ে নিয়ে গেল, যেখান থেকে আমাদের জল আসত। শেষ পর্যন্ত কালু সিং আমাকে পাহাড়-জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে অজানা এক পথে কার্শিয়ঙ স্টেশনে পৌঁছে দিল। মনে আছে যাত্রাটা আমার চিত্তে বেশ শিহরণ জাগিয়েছিল। 

কালু সিংয়ের পারিবারিক জীবন ছিল বড়ই শোকের। তার চার ছেলে একের পর এক মারা যায়। বাবার বিশেষ ইচ্ছা ছিল যে, বুড়ো বয়সে সে যাতে একটু আরামে থাকতে পারে, সেজন্য আলাদা একটু জমিতে তার জন্য ছোট একটি বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেবেন। বাবার অকালমৃত্যুর জন্য সেটা সম্ভব হয়নি। বাবার মৃত্যুর বছর তিনেক পরেই সে মারা যায়। শেষ বিদায়ের দিন-কতক আগে মা’কে ছোট সুন্দর এক চিঠিতে সে তার ‘শেষ সেলাম জানিয়ে গিয়েছিল। 

আমাদের কলকাতা ফ্রন্টে কালু সিংয়ের শাকরেদ ছিল বাবার ড্রাইভার আমেদ। সে কেবল গাড়িই চালাত না, বাড়ির অনেক ম্যানেজারিও তাকে করতে হত। এলগিন রোডের বাড়ি থেকে শুরু করে উডবার্ন পার্কের নতুন বাড়ির অনেক কাজকর্ম আমেদের তদারকিতেই হত। সে ছিল বেনারসের লোক। কিন্তু ছুটিছাটা কমই নিত। গাড়ি সে এত ভাল চালাত যে, অন্য কারুর গাড়িতে উঠলে বাবা অস্বস্তি বোধ করতেন। সেকালে বাড়ির কর্মরত লোকজনেরা কেমন সত্যিই পরিবারের লোক হয়ে যেত এবং তাদের সঙ্গে সকলেরই কেমন আন্তরিক ও প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠত, তার একটা উদাহরণ দিই। বাবা ১৯৩২ থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত রাজবন্দী ছিলেন। সে-সময় মা খুবই অর্থকষ্টে পড়েছিলেন। সংসারের সব খরচ কমাতে হয়েছিল। বড় গাড়ি বিক্রি করে দেওয়া হল। মা আমেদকে ডেকে বললেন, সে বাবার কাছে যে মাইনে পেত, এখন আর অত দেওয়া সম্ভব নয়। ড্রাইভার হিসাবে আমেদের বেশ সুনাম ছিল এবং ভাল মাইনেতে আর-একটা চাকরি সে সহজেই পেতে পারত। মা আমেদকে বললেন, “তোমারও তো সংসার আছে, চলবে কী করে? তুমি ভাল মাইনেতে একটা চাকরি নাও।” আমেদ প্রথমটায় কিছু বলল না, পরে ফিরে এসে বলল, “আপনি যা পারেন দেবেন; যখন পারবেন না দেবেন না। আপনার সংসার যদি চলে তো আমারও চলবে।” 

যদিও তখনও গাড়ি চালাবার বয়স আমার হয়নি, বাবার প্রথম জেলবাসের সময় আমেদ আমাকে লুকিয়ে গাড়ি চালাতে শিখিয়েছিল। অনেক পরে ১৯৪১ সালে রাঙাকাকাবাবুকে কলকাতা থেকে গোপনে গোমো পৌঁছে দেবার সময় আমি আমেদের শিক্ষার সুফল পেয়েছিলাম। বাবাও আমার গাড়ি চালানো পছন্দ করতেন, কারণ আমি আমেদের কায়দায় গাড়ি চালাতাম। 

সেকালে বাড়ির লোকজনেরা নানাভাবে বড় পরিবারের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সঙ্গে মিশে যেত এবং পরিবারের সুখদুঃখের সাথী হত। তাদের বাদ দিয়ে আমরা আমাদের ছেলেবেলার কথা ভাবতেই পারি না। 

দাদাভাই ও মাজননীর আমলের দুজনের কথা খুব শুনেছি এবং পরবর্তীকালে তাদের দেখেছিও। একজন ছিল দাদাভাইয়ের ব্যক্তিগত পরিচারক সুদাম, অন্যটি বসু-বাড়ির পরিচারিকা সারদা। রাঙাকাকাবাবুর প্রতি সারদার মমতার কথা তো বোধ করি তোমরা জানো। 

একটা মজার গল্প বলে আজকের প্রসঙ্গটা শেষ করি। রাঙাকাকাবাবু যখন কংগ্রেসের সভাপতি, তখন তাঁর ব্যক্তিগত এক বেয়ারা ছিল। তার বাড়ি উড়িষ্যায়। সে ছিল যাকে বলে ‘ওয়ান মাস্টার ম্যান’। পণ্ডিত জওহরলালের সঙ্গে রাঙাকাকাবাবু একবার একই ট্রেনে, একই কামরায় যাচ্ছেন। কোনো একটি জায়গায় ট্রেনটি দাঁড়িয়েছে। সিগন্যাল হয়ে গেছে, কিন্তু ট্রেন আর ছাড়ে না। রাষ্ট্রপতির (তখন কংগ্রেস-সভাপতিকে রাষ্ট্রপতি বলা হত) বেয়ারা মহাশয় নেমে এনজিন-ড্রাইভারের কাছে গিয়ে গরম জল দাবি করছে, তার সাহেব দাড়ি কামাবেন বলে। আগে জল দাও, তবে গাড়ি ছাড়ো। তারপরে কামরায় ফিরে জওহরলালকে সেই ভোরবেলায় ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে তুলে বলেছে, “আপনি তাড়াতাড়ি সেরে নিন, আমার সাহেব উঠে বাথরুমে যাবেন তো।” জওহরলাল তো কৌতুক বোধ করলেন, কিন্তু ঘুম থেকে উঠে ব্যাপারটা শুনে সুভাষচন্দ্র খুবই অপ্রস্তুত। 

ঠিক মনে আছে তো, না অনুমান করছি! সেই ১৯২৫ সালের শিশুবয়সের ঘটনা। আমার মনের কোণে একটা ছবি আছে। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ দীর্ঘকায় এক মানুষ আমাদের কার্শিয়ঙের বাড়ির সামনে ধীরে-ধীরে পায়চারি করছেন। পুরনো কাগজপত্র ঘেঁটে দেখছি আমার স্মৃতিভ্রম হয়নি। মান্দালয়ে বন্দী রাঙাকাকাবাবুকে বাবা লিখছেন, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ স্ত্রী বাসন্তী দেবীকে সঙ্গে নিয়ে, দার্জিলিঙে তাঁর মৃত্যুর দিন পনরো আগে, আমাদের কার্শিয়ঙের বাড়িতে একটা দিন কাটিয়ে গিয়েছিলেন। বাবা আরও লিখেছেন বড়ই দুঃখের কথা যে, কার্শিয়ঙে আমাদের বাড়িতে দেশবন্ধুর একটা ছবি তুলে রাখা হয়নি। যাই হোক, দেশবন্ধুর শেষ বাইরে যাওয়া ও থাকা হল আমাদের গিধাপাহাড়ের বাড়িতে। শরৎচন্দ্র বসুর পরিবারের সঙ্গে। 

আরও কিছু মনে আছে ভাসা-ভাসা। আমরা বাবা-মার সঙ্গে গিয়েছি দার্জিলিঙে দেশবন্ধুকে দেখতে। আমরাও একটা দিন কাটিয়ে এসেছিলাম ‘স্টেপ অ্যাসাইড’-এ। ঐ বাড়িতে দেশবন্ধু তাঁর জীবনের শেষ কটা দিন ছিলেন। তোমরা যারা দার্জিলিঙ গেছ, নিশ্চয়ই বাড়িটা দেখেছ। আমাদের বাড়ির একটা প্রথা ছিল, মা যখনই ছেলেমেয়েদের নিয়ে কোনো অসুস্থ বয়োজ্যেষ্ঠকে দেখতে যেতেন, আমাদের বলতেন তাঁর পা টিপে দিতে। এখন মনে হয়, এটা ছিল শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও শুভ কামনার একটা নিদর্শন। আমার স্মৃতিতে আছে রোগশয্যায়-শোয়া দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের আমি পা টিপে দিয়েছিলাম। এই স্মৃতির মধ্যে গভীর এক অনুভূতি আছে, সেটা তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ। 

বড় হয়ে আমরা আর দেশবন্ধুকে দেখিনি। আমরা তাঁকে শেষ দেখে আসার দিনকতক পরেই তিনি দার্জিলিঙে দেহত্যাগ করেন। কলকাতায় তাঁর মরদেহ নিয়ে যে শোকযাত্রা হয়েছিল, তার তুলনা নেই। সারা বঙ্গভূমি যেন পিতৃহারা হয়েছিল। যখনই কলকাতায় কোনো বড় শোভাযাত্রা বা শোকযাত্রা হত, মা আমাদের দেখতে নিয়ে যেতেন। একটা সুবিধামতো জায়গাও ছিল। মাজননীর এক ভাই ও আমাদের লালদাদাবাবু, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, ওয়েলিংটন স্কোয়ারের মোড়ের এক বাড়িতে থাকতেন। তাঁর বাড়ির ছাদ থেকে আমরা দেখতাম। যদিও আমি তখন খুবই ছোট, সেই বিরাট জনসমুদ্রের একটা ছবি আমার মনে গেঁথে আছে। কয়েক বছর পরে যতীন দাসের শবদেহ নিয়ে ও হিজলি জেল-পুলিসের গুলিতে নিহত দুই রাজবন্দীর শেষযাত্রাও ঐ ছাদ থেকেই দেখেছি। এই দুটিই রাঙাকাকাবাবুর নেতৃত্বে হয়েছিল। এই ধরনের জনসমাবেশ আমাদের বেশ প্রভাবিত করত। আমি নিজে মুখচোরা ছিলাম বলে ভিতরের তোলপাড়টা যেন একটু বেশিই হত। 

দেশবন্ধুকে আমরা আর না দেখলেও বাবা ও রাঙাকাকাবাবুর মধ্যে তাঁকে আমরা চিরকালই দেখে এসেছি। তাঁদের উপর দেশবন্ধুর বিরাট প্রভাবের কারণ সম্বন্ধে আমি অনেক চিন্তা করেছি এবং এখনও করি। দেশবন্ধুর কথা বলতে গিয়ে দুজনেই অভিভূত হয়ে পড়তেন। আসল কথা হল দেশবন্ধু তাঁর অনুগামীদের নিবিড়ভাবে ভালবাসতেন, যে-ধরনের ভালবাসা জগতে বিরল। তাছাড়া তাঁর অতুলনীয় ত্যাগের দৃষ্টান্ত তো আছেই। আর আছে তাঁর অসাধারণ রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি ও মেধা। এই সূত্রে একটা কথা বলি। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়—যখন তোমরা জন্মাওনি—অনেক বড়-বড় নেতা ও দেশসেবক পেয়েছি ও দেখেছি। তাঁদের মধ্যে এমন কয়েকজন ছিলেন, যাঁরা কেবল দিতেই এসেছিলেন, কিছু নিতে আসেননি। এই ধরনের ত্যাগধর্মী রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী পৃথিবীতে খুব কমই দেখা যায়। তাই বলছি, নেতৃত্ব খুঁজতে আমাদের বিদেশে-বিভুঁয়ে হাতড়ে বেড়াবার দরকার নেই। 

দেশবন্ধুর মৃত্যুর পর বাবা একদিকে তাঁর স্মৃতিরক্ষার কাজে, অন্যদিকে বাসন্তী দেবী ও তাঁর পরিবারের দেখাশুনোর ব্যাপারে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বাবা দেশবন্ধুকে সি আর বলে উল্লেখ করতেন। পরে দক্ষিণ ভারতের এক নেতাকে অনেকে সি আর বলে অভিহিত করতে আরম্ভ করেন। বাবা এতে বিরক্ত হয়ে বলতেন, সি আর বলতে একজনকে বোঝায়—চিত্তরঞ্জন দাশ, আর-কাউকে ঐ নামে ডাকা ঠিক নয়। দেশবন্ধুর ‘ফরওয়ার্ড’ কাগজ চালাবার ভারটা বিশেষ করে বাবার উপর পড়ে। রাঙাকাকাবাবু তো তখন বর্মায় বন্দী। দেশবন্ধুর মৃত্যুতে তিনি খুবই ভেঙে পড়েছিলেন। বর্মার বন্দীশালা থেকে লেখা তাঁর অনেক চিঠি আছে, বেশির ভাগই বাবাকে লেখা। তোমরা সেগুলি পড়ে দেখো। অনেক কিছু জানতে ও বুঝতে পারবে। 

দেশবন্ধু হঠাৎ চলে গেলেন। কিন্তু যাঁকে রেখে গেলেন, তিনি সারাজীবনের জন্য বসু-বাড়ির পরমাত্মীয় হয়ে রইলেন। আগে থেকেই বাবা ও রাঙাকাকাবাবু বাসন্তী দেবীকে ‘মা’ বলে ডাকতেন। কখন কোন মার কথা বলছেন, এই নিয়ে আমাদের মাঝেমাঝে গোলমাল হয়ে যেত। আমরা ওঁকে ডাকতুম ‘ঠাকুমা’ বলে, এতে কোনো অসুবিধা ছিল না। ১৯২৫ সালে আমাদের শিশুবয়স থেকে শুরু করে আজ থেকে বছর পাঁচেক আগে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত বাসন্তী দেবী বা ঠাকুমা আমাদের অত্যন্ত আপনজন ছিলেন। বসু-বাড়ির সকলকে তিনি চিনতেন ও ভালবাসতেন, তাদের খুঁটিনাটি সব খবর রাখতেন। দেশবন্ধু তো সব কিছুই দেশকে দান করে গেলেন। বাবা ও তাঁর অন্য অনুগামীরা বাসন্তী দেবী ও পরিবারের জন্য একটা বাড়ির ব্যবস্থা করলেন। রাঙাকাকাবাবু ক্রমাগতই জেল থেকে বলে পাঠাতেন, বাবা ও মা যেন নিয়মিত ঠাকুমার দেখাশুনা করেন। বাবা কাজের চাপে যতটা পারতেন না, মা সেটা পূরণ করে দিতেন। মার সঙ্গে সারা জীবন কতবার যে আমরা ছোটরা ঠাকুমার বাড়ি গিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। ঠাকুমার হাতের রান্না অসম্ভব ভাল ছিল। অনেক খেয়েছি। রাঙাকাকাবাবু যখন জেলের বাইরে ও দেশে থাকতেন, কাজের শেষে অনেক রাতে ঠাকুমার বাড়িতে হাজির হতেন, তাঁর হাতের ‘ভাতে-ভাত’ খেতে চাইতেন ও গল্প জুড়ে দিতেন। এতই রাত করতেন যে, রাস্তায় পাহারারত পুলিসের চরেদের বড়ই অসুবিধা হত—বিশেষ করে বর্ষার রাতে। ঠাকুমা রাঙাকাকাবাবুকে বলতেন, অন্তত, ঐ বেচারিদের রেহাই দেবার জন্য বাড়ি ফিরতে। 

রাঙাকাকাবাবু বলতেন, কেন, দেশদ্রোহীরা খানিকটা কষ্ট পাক না! ঠাকুমা প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসতেন, বেশির ভাগই সঙ্গে থাকতেন বিধবা পুত্রবধূ সুজাতা দেবী, যাঁকে আমরা কাকিমা বলে ডাকতাম। আমার বেশ মনে আছে, ছেলেবেলায় উডবার্ন পার্কের বাড়িতে আমার টনসিল অপারেশন হল। জ্ঞান হলে চোখ মেলেই দেখলাম, দুজন আমার মাথার কাছে বসে আছেন। একদিকে আমার মা ও অন্যদিকে ঠাকুমা বাসন্তী দেবী। 

১৯৩২ সালে বাবা যখন প্রথমবার জেলে যান, তখন ঠাকুমা আমাদের জন্য খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। যখনই পারতেন আসতেন। ঐ সময়কার একটা ঘটনার কথা বললে তোমরা বুঝবে। রাঙাকাকাবাবু বর্মা থেকে যখন ফেরেন, তখন একটা সুন্দর বুদ্ধমূর্তি এনেছিলেন। উডবার্ন পার্কের দোতলার দালানে সেটা রাখা হয়েছিল। ঠাকুমা বললেন ঐ বুদ্ধমূর্তি বাড়িতে রাখা চলবে না, এর প্রভাব ভাল নয়, সুভাষ তো সর্বত্যাগী হয়ে গেছেই, সংসারী হয়েও এখন শরৎও সেই পথে গেল, কী জানি এ-পরিবারে আরও কী হয়! তিনি জোর করেই একদিন মূর্তিটি নিয়ে চলে গেলেন ও চিত্তরঞ্জন সেবাসদনের মধ্যে এক মন্দিরে রাখলেন। নেতাজী-ভবনে নেতাজী মিউজিয়ম হবার পর আমি ঠাকুমাকে অনুরোধ করি মূর্তিটি ফিরিয়ে দিতে। এখন সেটি নেতাজী ভবনেই আছে। 

মাজননী সম্বন্ধে ঠাকুমার খুব উঁচু ধারণা ছিল। আমাদের বহুবার গর্বের সঙ্গে বলতেন, “জানিস, তোদের মাজননী কী বলেন! বলেন,আমিই নাকি সুভাষের আসল মা, তিনি নাকি কেবল ধাত্রী! বল তো, কটা মা একথা বলতে পারে, বিশেষ করে সুভাষের মতো ছেলে যার আছে।” 

১৯৩৩-এর গোড়ায় ঠাকুমা আমাদের সঙ্গে জব্বলপুর গিয়েছিলেন, জেলে বাবা ও রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে দেখা করতে। রাঙাকাকাবাবু ইউরোপে চলে যাবেন চিকিৎসার জন্য। বিদায়ের সময় রাঙাকাকাবাবু বেশ খানিকটা কান্নাকাটি করলেন। দেশবন্ধু কেন তাঁকে ‘ক্রাইং ক্যাপ্টেন’ বলতেন বুঝলাম। বাসন্তী দেবী কিন্তু এ-রকম অবস্থায় নিজের আবেগ খুবই সংযত রাখতেন এবং মোটেই কাঁদতেন না। 

অনেকদিন পরের কথা। নেতাজী রিসার্চ ব্যুরো তখন প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। ঠাকুমার কাছে গেলাম, যদি তাঁর কাছে রাঙাকাকাবাবুর চিঠিপত্র কিছু থাকে, দেশবাসীর জন্য আমরা সেগুলি প্রকাশ করতে পারি। খুঁজেপেতে কিছু চিঠি পেলেন। আমাকে বললেন, তিনি চিঠিগুলি আমাকে দিতে পারেন যদি আমি কথা দিই যে, কপি করে আমি সেগুলি তাঁকে ফেরত দেব। আমি কথা দিলাম। কথামতো আমি পরে একদিন তাঁর কাছে চিঠিগুলি ফেরত নিয়ে গেলাম। আমাকে বসালেন, খাওয়ালেন, অনেক গল্পও করলেন। আমি যখন বাড়ি ফিরব বলে উঠে চলে আসছি, আমাকে ফিরে ডাকলেন। চিঠিগুলির বাক্সটি আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, “তুই আচ্ছা বোকা তো, আমি কি সত্যিই চিঠিগুলি ফেরত নেব নাকি?” 

কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরে গেল। 

জব্বলপুর সেন্ট্রাল জেলের সেগ্রিগেশন ব্লকে আমরা দল বেঁধে বাবা ও রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি। ১৯৩৩ সালের গোড়ার কথা। রাঙাকাকাবাবু ইউরোপ চলে যাবেন চিকিৎসার জন্য। আমরা সকলে বাবা ও রাঙাকাকাবাবুকে ঘিরে বসে আছি, হঠাৎ বাবা হাঁক দিলেন, “গিন্নি! গিন্নি!” সকলে অবাক হয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি। মা তো পাশেই বসে আছেন। আসলে বাবা ডাকছেন ধবধবে সাদা খুব সপ্রতিভ একটি পোষা পায়রাকে। 

ঠাকুমা বাসন্তী দেবী রাগের ভান করে বললেন, “শরৎ, এতে আমার ঘোর আপত্তি আছে। আসল গিন্নি পাশে বসে আর তুমি কি না আর কাকে ‘গিন্নি, গিন্নি’ বলে ডাকছ!” খুব একটা হাসির রোল উঠল। বাবা ও রাঙাকাকাবাবু যখন কাজে ডুবে থাকতেন তখন তো কোনোদিকে তাকাবারই সময় থাকত না, পাখি জন্তু-জানোয়ার তো দূরের কথা। জেলে গিয়ে দুজনেরই একটা প্রধান অবলম্বন হত তারা। পশুপাখি ও অন্য কয়েদি সাথীদের নিয়েই যেন তাঁরা সংসার করতেন। 

মান্দালয় জেলে রাঙাকাকাবাবুর সংসারে মুরগি, পায়রা, টিয়াপাখি ইত্যাদির একটা বড় দল ছিল। চৌবাচ্চার ধারে সারি দিয়ে ময়ূরপঙ্খী পায়রার দল জল খেতে বসার দৃশ্যও তাঁকে মুগ্ধ করত। বেড়াল তিনি পছন্দ করতেন না। বিশেষ করে যদি বদ রঙের হয়। তবে শুনেছি পূর্ব এশিয়ায় তাঁর একটা পোষা বাঁদরও ছিল, আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়কের কাঁধে বসে সে নানা রকম খেলা দেখাত। হয়তো বা মন হাল্কা রাখবার ছিল সেটা একটা উপায়। 

জব্বলপুর জেলে আমরা দেখলাম দুই ভাই তো বেশ বড় চিড়িয়াখানা নিয়ে বসে আছেন। পায়রা ও অন্যান্য পাখি ছাড়াও এক পাল খরগোশ রয়েছে। বিচিত্র রঙের। পাখি, খরগোশ ইত্যাদির নাম ধরে রাজবন্দীরা মাঝে-মাঝে ডাকেন আর তারা আমাদের মতো অতিথিদের সম্ভাষণ জানিয়ে যায়। 

রাঙাকাকাবাবু তো ইউরোপ চলে গেলেন। মাস কয়েক পরে বাবাকে কার্শিয়াঙে আমাদের গিধাপাহাড়ের বাড়িতে সরকার অন্তরীণ করল। একদল পায়রা ও খরগোশ কলকাতায় আমাদের উডবার্ন পার্কের বাড়িতে স্থানান্তরিত হল। আমিই তাদের ভার নিলাম বলা যায়। তবে কার্শিয়াঙে গিয়ে বাবার অন্য রকমের শখ হল। নানা জাতের পাহাড়ি কুকুর সংগ্রহ করলেন তিনি। দার্জিলিঙের পুলিসের কর্তা মাঝে-মাঝে বাবার তদারকি করতে আসতেন। সাহেবের সঙ্গে বেড়াতে-বেড়াতে বাবা “কোল্সন্! কোল্সন্!” বলে হাঁকতে লাগলেন, আর সাহেবের মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। একটা ছোটখাট সুন্দর পাহাড়ি কুকুর লাফাতে লাফাতে এগিয়ে এল। কোসন্ সাহেব তখন কলকাতার পুলিস কমিশনার! পরে আবার “কাউন্টেস! কাউন্টেস!” বলে বাবা ডাক দিলেন। খুব লোমশ আহ্লাদী চেহারার একটি কুকুর সানন্দভাবে লেজ নাড়তে নাড়তে এগিয়ে এল। তখন ভারতের বড়লাট-পত্নী ছিলেন কাউন্টেস অব উইলিংডন। 

কুকুরেই গল্পটি শেষ নয়। এক পাহাড়ি কাঠুরে জঙ্গলে কাঠ কাটতে গিয়ে ভাল্লুকের ছানা কুড়িয়ে পেল। আমাদের বাড়িতে এসে সেটি সে বাবার হাতে সঁপে দিয়ে গেল। আমরা যখন তাকে প্রথম দেখলুম সে তখন খুবই ছোট, বোতলে দুধ খায়। আমার কিন্তু বেশ মনে আছে, সেই ছোট অবস্থাতেও ভাল্লুকটি এমন চেপে পা জড়িয়ে ধরত যে ছাড়ানোই দায়! বড় হলে তার জন্য খাঁচা তৈরি হল। বাবার মুক্তির পর খাঁচা-বন্দী অবস্থায় তাকে উডবার্ন পার্কের বাড়িতে আনা হল। কিন্তু তখন সে বেশ হিংস্র হয়ে উঠেছে। পশু-বিশেষজ্ঞরা তাকে বাড়িতে রাখা ভাল মনে করলেন না। সুতরাং বাবা তাকে আলিপুরের চিড়িয়াখানায় উপহার দিলেন। 

এতক্ষণ তো বাবা ও রাঙাকাকাবাবুর জেল-জীবনের হাল্কা দিকটাই বলছিলাম। কিন্তু এ-বিষয়ে আরও অনেক কিছুই বলার আছে। তোমরা তো জানো রাঙাকাকাবাবু বর্মার জেলে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর মুক্তির জন্য যেমন দেশে আন্দোলন চলছিল, তেমনি বাবা ও ইংরেজ সরকারের মধ্যে নানা রকম প্রস্তাব ও পাল্টা প্রস্তাব নিয়ে লেখালেখি চলছিল। 

রাঙাকাকাবাবুর কারা-জীবন বৈচিত্র্যময়। প্রথমবার ১৯২১-২২ সালে তিনি জেলে যান দেশবন্ধুর সঙ্গে, ছিলেন আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে। সবসুদ্ধু এগারো-বারোবার তিনি জেলে গিয়েছেন। শেষবার ১৯৪০ সালে তিনি ছিলেন প্রেসিডেন্সি জেলে। রাজবন্দী হিসাবে তিনি ও বাবা নীতিগত ব্যাপারে ইংরেজ সরকারের সঙ্গে কখনও আপোস করেননি। যেমন রাজনৈতিক জীবনেও তাঁরা যেটা ঠিক পথ বলে মনে করতেন সেটা থেকে কখনও সরে আসতেন না। অবশ্য এই কারণে সরকারের বিরুদ্ধে এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের সঙ্গে কতবার তাঁদের প্রচণ্ড লড়াই করতে হয়েছে, কতবার তাঁরা কোণঠাসাও হয়েছেন। সাধারণভাবে রাঙাকাকাবাবু বলতেন যে, জেলে ইংরেজ অফিসারদের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব দেখালেই কাজ দেয় বেশি। তাছাড়া, আমার মনে হয় যে, জাতির দাসত্ব যেমন তাঁর কাছে অসহ্য ছিল, তেমনি নিজের ব্যক্তিগত বন্দিদশাও তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারতেন না। ফলে, জেলে গেলেই তাঁর শরীর ভেঙে পড়ত। রাজবন্দীদের দাবিদাওয়া নিয়ে তিনি জেলের ভেতরে যে লড়াই চালাতেন তাতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জয়ী হতেন তিনি। জেলে থাকার সময় তিনি দু’বার অনশন করেছিলেন। একবার মান্দালয় জেলে দুর্গাপূজা করার অধিকার ইত্যাদি প্রশ্নে, আর-একবার ১৯৪০ সালে প্রেসিডেন্সি জেলে মুক্তির দাবিতে। দু’বারই শেষ পর্যন্ত সরকারকে তাঁর দাবি মেনে নিতে হয়েছিল। 

তিনি যখন বর্মায় খুবই অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং সরকারি ও বেসরকারি ডাক্তাররা যখন একমত হলেন যে, তাঁর জীবন বিপন্ন তখন ইংরেজ সরকার তাঁর মুক্তি ও চিকিৎসার ব্যাপার নিয়ে নানারকম শর্তের কথা তুলতে লাগলেন। যেমন ভারতের মাটি না ছুঁয়ে তিনি যদি সুইট্‌জারল্যাণ্ড চলে যান তাহলে তাঁরা রাজি। অথবা তিনি যদি কারও সঙ্গে দেখা বা যোগাযোগ না করে আলমোড়ায় অন্তরীণ থাকতে রাজি হন তাহলেও তাঁরা তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে পারেন। এ ধরনের সব শর্তই তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। 

শেষ পর্যন্ত ১৯২৭ সালের গোড়ায় যখন সরকার ঠিক করলেন যে রাঙাকাকাবাবুকে দেশে ফিরিয়ে আনবেন তখনও তাঁরা ঠিক করে বসু-পরিবারকে জানালেন না যে তাঁকে নিয়ে তাঁরা ঠিক কী করতে চান। কলকাতায় তাঁকে ফিরিয়ে এনে গভর্নরের লঞ্চে গঙ্গার বুকে তাঁকে বন্দী করে রাখলেন, যেন তাঁরা তাঁকে নদীর নির্মল বাতাস খাওয়াচ্ছেন। হঠাৎ- দার্জিলিঙ থেকে গভর্নরের আদেশ এল তাঁকে তাঁরা মুক্তি দিচ্ছেন। তার আগেই আমরা গঙ্গার ঘাট থেকে নৌকো করে লঞ্চে গিয়ে দল বেঁধে তাঁর সঙ্গে দেখা করে এসেছি। মুক্তির পর তাঁকে ৩৮/১ এলগিন রোডের বাড়িতে তোলা হল। সেখানেই বাবা-মায়ের সঙ্গে আমরা থাকতাম। সেই প্রথম ডাক্তার বিধান রায়কে দেখলাম। বাড়ির দোরগোড়ায় পা দিলেই জানা যেত ডাক্তার রায় এসেছেন। ভারী গলায় খুব হাঁকডাক করতেন। ডাক্তার রায় ও আমাদের নতুন কাকাবাবু সুনীলচন্দ্র একসঙ্গে রাঙাকাকাবাবুকে দেখতেন। প্রয়োজন-মতো স্যার নীলরতন সরকার ও কবিরাজমশাই শ্যামাদাস বাচস্পতির পরামর্শ নিতেন। 

ওই সময় থেকেই বাড়ির ও রাঙাকাকাবাবুর সব কথা আমার মোটামুটি ভাল মনে আছে। ডাক্তারদের পরামর্শে কিছুদিন পরেই তাঁকে শিলং নিয়ে যাওয়া হল। শিলঙে রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে খেলাধূলা ও গান গাওয়ার গল্প তোমাদের আগেই বলেছি। দাদাভাই, মাজননী এবং বাড়ির অনেকেই সেই সময় শিলঙে গিয়েছিলেন। ১৯২৭ সালে শিলঙে বসু-বাড়ির জমায়েত বেশ একটা বড় ঘটনা। রাঙাকাকাবাবুই ছিলেন জমায়েতের মধ্যমণি। ছেলেমেয়েদের পুরো দলটিই ছিল তাঁর হেফাজতে। কার স্বাস্থ্য ভাল করার জন্য কী-কী করা দরকার তিনি বলে দিতেন। কাকে মোটা করতে হবে,কে বড়ই মোটা সুতরাং খাওয়া কমিয়ে এবং দৌড় করিয়ে রোগা করতে হবে ইত্যাদি। দুঃখের বিষয় আমিই শিলঙে বেশ লম্বা জ্বরে পড়লাম এবং অনেকদিন শয্যাগত ছিলাম। সেই সময় ডাক্তার বিধান রায়ের শিলঙে বাড়ি ছিল এবং তিনিই আমার চিকিৎসা করেন। আমার মনে আছে, যখন পথ্য দেবার সময় হল, ডাক্তার রায় তাঁর ভারী গলায় বললেন, “এখন তোকে আমি সব খেতে দিতে পারি। কী খাবি বল? খাট খাবি? আলমারি খাবি? টেবিল খাবি? চেয়ার খাবি?” কথাগুলি শুনেই আমি বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছিলাম। 

সে সময় জানতাম না জেলে যাওয়া-আসা আমাদের পারিবারিক জীবনের একটা অঙ্গ হয়ে দাঁড়াবে। বাবাকে যে শেষ পর্যন্ত ওই পথেরই যাত্রী হতে হবে, রাঙাকাকাবাবু বোধ করি আগেই বুঝেছিলেন। তিরিশের দশকে মহাত্মা গান্ধী আইন অমান্য আন্দোলনের ডাক দেবার কিছুদিন আগে থেকেই রাঙাকাকাবাবু মাকে মাঝে মাঝে বলতেন বাবাকে যদি দেশের কাজে জেলে যেতে হয়, মা সবকিছু সামলে নিতে পারবেন তো? 

আরও বলতেন, মা যেন নিজেকে মনে-মনে দুঃসময়ের জন্য প্রস্তুত করে রাখেন। আমার মা শেষ পর্যন্ত বাংলার শত শত মায়েদের দুঃখ-দারিদ্র্যের ভাগী হয়েছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *