বসু-বাড়ি – ৩৫

৩৫

১৯৪০-এর ডিসেম্বরে আমার জীবনে যা ঘটল তা ছিল আমার কল্পনার বাইরে। যে-ঘটনা ভারতের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল, তার সঙ্গে আমি জড়িয়ে পড়ব, সে-কথা কি কোনদিন স্বপ্নেও ভাবতে পেরেছিলাম? ইতিহাস নাকি আমাদের না জানিয়েই তার কাজ করে যায়। আমার মতো খড়কুটোও স্রোতের টানে দুর্বার গতিতে ভেসে চলে। পরে মনে হয় কোথায় যেন পৌঁছে গেলাম। 

যাঁরা ইতিহাসপুরুষ তাঁরা যে কেবল বুদ্ধি ও বিশ্লেষণের ভিত্তিতে সবকিছু ঠিক করেন তা নয়, ইনটুইশন বা স্বভাবজাত একটা অনুভূতি তাঁদের থাকে। রাঙাকাকাবাবু ঐ স্বভাবজাত অনুভূতি সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন এবং দেখিয়েছিলেন যে, জগতের ইতিহাসে বড় বড় নেতারা অনেক সময়েই কেবল বুদ্ধির বিচারে নয়, ভিতর থেকে আসা অনুভূতির সাহায্যে অনেক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পরে ঐসব সিদ্ধান্ত ইতিহাসের বিচারে ঠিক বলেই প্রমাণিত হয়েছে। আমার মনে হয় রাঙাকাকাবাবুও কেবল বিচারবুদ্ধি, বিশ্লেষণ ও যুক্তির দ্বারা নয়, অনুভূতির দ্বারাও চালিত হতেন। 

অনেকে আজও জিজ্ঞাসা করেন আমাকেই বা তিনি ডেকে নিলেন কেন। এর উত্তর দেওয়া শক্ত। কতটা সামগ্রিকভাবে বিচার করে বা কতটাই বা কেবল অনুভূতির ভিত্তিতে তিনি ব্যক্তিবিশেষকে কাজের জন্য বেছে নিতেন কে জানে! হতে পারে, আমার অজান্তে অনেক দিন ধরে এর জন্য প্রস্তুতি চলছিল এবং সেজন্যই আমি তাঁর ডাকে সাড়া দিতে পারলাম। তবে প্রথমেই এটা বলে রাখি যে, একটা বিরাট ঐতিহাসিক কর্মযজ্ঞের খুবই ছোট এবং অদৃশ্য যন্ত্র ছিলাম আমি। 

বসুবাড়ির ছেলেমেয়েদের জীবন যে গতানুগতিক ছিল তা ঠিক বলা যায় না। দেশে তখন একটা সর্বাত্মক সংগ্রাম চলছে, আদর্শবাদের ঝড় সারা দেশটাকে তোলপাড় করছে। বাড়ির দুই শ্রেষ্ঠ পুরুষ সেই সংগ্রামের অংশীদার। এ সব-কিছুর খানিকটা ছোঁয়া তো আমাদের গায়ে লাগবেই। ১৯৪০-এর আগেও আমাদের মধ্যে কেউ কেউ নানাভাবে কমবেশি ছাত্র-আন্দোলন, যুব-আন্দোলন বা গণ-আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন। বাড়ির বাইরেও আমরা দেখতে পেতাম, দেশের হাজার হাজার লোক—নারী পুরুষ কিশোর ছাত্র—দেশের কাজে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। কত পরিবার নিঃস্ব হয়েছেন। কত ছেলেমেয়ে পুলিশের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন। জেলে গিয়েছেন। চোখের সামনেই তো কতজনকে প্রাণ বিসর্জন দিতেও দেখলাম। এসবের প্রভাব সামগ্রিকভাবে আমাদের ওপর পড়তে বাধ্য। তবে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির প্রতিক্রিয়া যে একইরকম হবে এমন কোনো কথা নেই। আমার সমসাময়িক অনেক ছাত্র ও যুবককে তো দেখেছি, নানা যুক্তি বা অজুহাত দেখিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে জাতীয় সংগ্রামের স্রোত থেকে নিজেদের আলাদা করে রাখতেন। 

যাই হোক, আমার জীবনের গতি সাধারণ অর্থে গতানুগতিক না হলেও সেই সময় পর্যন্ত এমন কিছু ঘটেনি যেটা সত্যিই অসাধারণ বলা যায়। অসাধারণ বলতে আমি বলছি এমন একটা কিছু যেটা জীবনটাকে ওলটপালট করে দেয় এবং এক নতুনপথে চালিত করে। রাঙাকাকাবাবু তাঁর বিরাট পরিকল্পনায় একটা ছোট্ট কাজের ভার দিয়ে আমার জীবনে সেই অসাধারণত্ব এনে দিলেন। 

ব্যাপারটা শুরু হল খুবই সহজভাবে। রাঙাকাকাবাবুর ব্যক্তিগত পরিচারক করুণা একটা ছুটির দিনে উডবার্ন পার্কের বাড়িতে এসে আমার ঘরে ঢুকে আমাকে বলে গেল ‘কাকাবাবু’ দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর আমাকে একবার দেখা করতে বলেছেন। বাড়ির কাউকে দিয়ে তো বলাতে পারতেন বা টেলিফোনে ডাকতে পারতেন। আমার মা প্রায় রোজই রাঙাকাকাবাবুকে দেখতে যাচ্ছিলেন। মা আমাকে ইতিমধ্যেই বলেছিলেন যে, রাঙাকাকাবাবু আমার দিনের রুটিন সম্বন্ধে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করেন। আমি কখন কলেজে যাই, কখন ফিরি, পড়াশুনার চাপ খুব বেশি কিনা। কলেজের পর খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ি কিনা, সপ্তাহের কোন্ দিনটা হালকা থাকে, ইত্যাদি। মাকে যখন এত কথাই আমার সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করছিলেন, মাকেই তো বলে দিতে পারতেন, আমি যেন তাঁর সঙ্গে দেখা করি। 

আমি বেলা তিনটে নাগাদ এলগিন রোডের বাড়িতে হাজির হলাম। কেন তিনি আমাকে ডেকেছেন এ-বিষয়ে আমার বিশেষ কৌতূহল ছিল না। আমাকে তিনি কী আর এমন কথা বলবেন! তবে তাঁর ঘরে ঢুকতেই মনে হল তিনি যেন আমার জন্যই অপেক্ষা করছেন, ঘরে আর কেউ নেই। স্নান-খাওয়া সেরে তাঁকে বেশ স্নিগ্ধ ও শান্ত দেখাচ্ছিল, যদিও একটু ফ্যাকাসে ও ক্লান্তির ভাবও ছিল। আমি তখনও পর্যন্ত বাবা বা রাঙাকাকাবাবুর সামনে একলা পড়ে গেলে একটু ঘাবড়ে যেতাম, কী জানি যদি কথাবার্তা চালাতে হয়। রাঙাকাকাবাবু যে আমাকে ‘সাইলেন্ট বয়’ নাম দিয়েছিলেন সেটা খুবই যথার্থ ছিল। দূর থেকে তাঁর সঙ্গে হাসি-বিনিময় এবং দু-একটা হ্যাঁ, না, পারি, পারি না, ভাল, মন্দ নয়, হতে পারে—এই ছিল বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে, বিশেষ করে রাঙাকাকাবাবু বা বাবার সঙ্গে আমার কথাবার্তার ধরন। 

বালিশে ঠেসান দিয়ে তিনি খাটে বসে ছিলেন। পাশেই দাদাভাইয়ের পুরনো জমকালো খাট। অভ্যাসমতো আমি দাদাভাইয়ের খাটে বসলাম। তিনি ইশারা করে আমাকে ঘুরে আসতে বললেন এবং তাঁর খাটে তাঁর ডানদিকে হাত চাপড়ে বললেন, এসো, এখানে বোসো। আহ্বানটা ছিল খুবই সহজ ও অন্তরঙ্গ, হুকুম নয়। কিন্তু আমার নাড়ির গতি তো বেড়ে গেল। মুহূর্তের জন্য মনে হল, কী জানি কোনো অন্যায় করে ফেলেছি নাকি, বকুনি-টকুনি কপালে নেই তো! 

শান্ত ও সস্নেহ দৃষ্টিতে আমার দিকে অল্প কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। আমিও শান্ত হয়ে গেলাম, নাড়ির গতি স্বাভাবিক হয়ে গেল। তাঁর চোখ ও চাহনি নিয়ে পরে কত কথাই না শুনেছি, ঐ চোখের টানে কত লোক ঘরবাড়ি ছেড়ে মুক্তি-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। কত আমির ফকির হয়েছেন, কত সংসারী সর্বত্যাগী হয়েছেন। 

বললেন, আমার একটা কাজ করতে পারবে? 

তখন তো ভেবে দেখার সময় পাইনি। গত চল্লিশ বছর ধরে তো বারবার ঐ পাঁচটি কথা নিজেকে বারবার শুনিয়েছি। কত কথা যেন ঐ কয়টি কথার মধ্যে আছে। তাঁর কাজ আমি করব! তিনি নিশ্চয়ই এমন-কিছু আদেশ করবেন না যেটা আমার সাধ্যের বাইরে। তবে এ-প্রশ্ন কেন? কখনও কখনও মনে হয়েছে যেন একটা অনুরোধের সুর ঐ প্রশ্নের মধ্যে ছিল। আসলে কিন্তু তা নয়, আসলে ছিল প্রাণের ডাক। এমন করে তো আগে তিনি কখনও আমাকে কিছু বলেননি। মনে আছে, বহুদিন আগে উডবার্ন পার্কের বাড়িতে একদিন আমাকে একটা ছোট কাজ দিয়েছিলেন—কোথায় যেন গাড়ি পাঠাতে হবে। আমি ভাই-বোনেদের সঙ্গে খেলায় ব্যস্ত থাকায় কথাটা ভুলে গিয়েছিলাম। আমাদের ঘরে এসে মুখ ভার করে বেশ জোর গলায় আমাকে বলেছিলেন, একটা কাজ বললাম করতে পারলে না! এই তো কদিন আগেই মুক্তির পরের দিন বিলেতে আমার এক দাদার কাছে একটা টেলিগ্রামের খসড়া করতে বললেন। একে আমার ইংরেজি জ্ঞান কম, তার উপর তাঁর যা বলার ইচ্ছা সেটা যদি আমার খসড়ায় প্রকাশ না পায়—এই ভেবে আমি গড়িমসি করছিলাম। খসড়া তৈরি হচ্ছে না দেখে আমাকে তো বেশ বকুনির সুরে বললেন, একটা টেলিগ্রামের খসড়াও করে উঠতে পারছ না! নিজের অক্ষমতায় আমি বেশ লজ্জা পেয়েছিলাম। 

পরে বুঝেছিলাম যে, সেইদিন যে ‘আমার একটা কাজ’-এর কথা তিনি বললেন সেটা সম্পূর্ণ এক নতুন অর্থে। একটা কাজের ভার দিয়ে নিয়তি সুভাষচন্দ্র বসুকে আমাদের মধ্যে পাঠিয়েছিলেন। কাজটা ছিল একান্তই তাঁর। তবে সেই কর্মযজ্ঞের চূড়ান্ত মুহূর্তে আমাদের মতো কয়েকটি সাধারণ মানুষকে তিনি ডেকে নিয়েছিলেন। 

১৯৪৪ সালে লাহোর ফোর্টে ইংরাজ সরকারের দুর্ধর্ষ অ্যাডিশনাল হোম সেক্রেটারি রিচার্ড টটেনহ্যাম আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, আচ্ছা, দেশত্যাগের প্রাক্কালে তোমার কাকার সঙ্গে তোমার সম্পর্কটা ঘনিষ্ঠই ছিল, নয় কি? উত্তরে আমি বলেছিলাম, যে-কোনো ভারতীয় পরিবারে কাকা-ভাইপোর সম্পর্ক ঘনিষ্ঠই হয়ে থাকে। উত্তরটা ছিল ভুল। কী জানি কেন, ইংরেজ অফিসারটিরও উত্তরটি ঠিক মনঃপূত হয়নি। আসলে রাঙাকাকাবাবু ১৯৪০-এর ডিসেম্বরে জীবনের জটিল যে প্রান্তে পৌঁছেছিলেন সেখানে কাকা-ভাইপোর সম্পর্কটা হয়ে গিয়েছিল নিতান্তই গৌণ। শুরু হল এক নতুন সম্পর্ক, আত্মিক সহধর্মিতার সম্পর্ক। অতি সহজভাবে আমাকে যে-পথে তিনি ডাক দিলেন, সে-পথের শেষ যে আমি দেখব এমন কোনো প্রতিশ্রুতি সেদিন ছিল না। 

৩৬

আমি তাঁর একটা ‘কাজ’ করতে পারব কিনা এই প্রশ্নের জবাব নানাভাবে দেওয়া যায়। আমি হয়তো বলতে পারতাম, হ্যাঁ, পারব, নিশ্চয়ই পারব। বলুন-না কী করতে হবে? অথবা আমি বলতে পারতাম, চেষ্টা করে দেখতে পারি। অথবা বলা যেত, আগে কাজটা কী বলুন। না জানলে কী করে বলব? আমি কিন্তু বিশেষ কিছু না বলে অস্পষ্ট একটা আওয়াজ করে একটু আলতো মাথা নাড়লাম। রাঙাকাকাবাবু আমার প্রতিক্রিয়াটা নিশ্চয়ই লক্ষ করলেন। বিচলিত না হয়ে একটু সময় নিয়ে দ্বিতীয় প্রশ্নে চলে গেলেন। 

‘তুমি কেমন গাড়ি চালাতে পারো?’ 

আমি কেমন গাড়ি চালাতে পারি এর উত্তর আমার মতো মুখচোরা লাজুক কিশোরের পক্ষে দেওয়া শক্ত। অনেকেই জানতেন যে, আমি ছোট বয়স থেকেই গাড়ি চড়তে ও চালাতে ভালবাসি, প্রায়ই গাড়ি চালাই এবং ভালই চালাই। মা ও বাড়ির অন্যদের আমি এদিক-ওদিক নিয়ে যাই। গাড়ি-চালানোটা আমার কাছে ছিল একটা শখ ও আর্ট। গাড়ির কলকবজা সম্বন্ধে আমার জ্ঞান ছিল অল্প এবং যন্ত্রপাতি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে বেশি উৎসাহ ছিল না। গাড়ির প্রতি আমার এই ঝোঁক দেখে কিছুদিন আগেই বাবা আমার নামে একটা গাড়ি কিনেছিলেন। জার্মান গাড়ি, নাম ‘ওয়াণ্ডারার’–যোগ্য নাম বটে। ওয়াণ্ডারার গাড়িটাও যেন আমাকে পছন্দ করত। গাড়িটির গিয়ার-টিয়ারের ব্যবস্থা একটু আলাদা রকমের ছিল। ড্রাইভার বা অন্য কেউ চালালে ওয়াণ্ডারার গোলমাল করত। সেজন্য অন্য লোকের চালানো বাবার পছন্দ হত না, আমি হাতের কাছে থাকলে আমাকেই চালাতে বলতেন। আমার ছবি তোলার শখ দেখে বাবা পরে আমাকে একটার পর একটা ক্যামেরা কিনে দিয়েছিলেন। আমি আবার স্বভাবের দোষে একটার পর একটা হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমার প্রতি বাবার এ-ধরনের দুর্বলতা দেখে কেউ-কেউ ঠাট্টা করে—হয়ত বা ঈর্ষার রেশও তার মধ্যে ছিল—আমাকে ‘ফেভারিট সান অফ্ শরৎচন্দ্র বোস’ বলতেন। আসলে কিন্তু বাবার কাছে আমি কোনোদিন কিছু চাইনি। যা পেতাম, না চাইতেই পেতাম। 

বিশ্বযুদ্ধের সময় বাবা যখন বন্দী, মা ওয়াণ্ডারার গাড়িটি বিক্রি করে দেন। কিনেছিলেন আমাদের বেশ পরিচিত এক বন্ধু। মুক্তি পাবার কিছুদিন পরে বাবার আর্থিক অবস্থা খানিকটা ভাল হলে আমি ঐতিহাসিক কারণে বাবাকে ফের গাড়িটি কিনে নিতে বলি। আবার ওয়াণ্ডারার গাড়ি আমার হেফাজতে ফিরে আসে। 

ভাগ্যিস একটা গাড়ি ও ক্যামেরা হাতের কাছে থাকত। তা না হলে অনেক অমূল্য অভিজ্ঞতার স্বাদ আমি জীবনে পেতাম না। 

আমি কেমন গাড়ি চালাতে পারি, এর জবাব আমি দিলাম বেশ চাপা গলায় একটু সলজ্জভাবে—এই একরকম ভালই পারি। তার পরেই প্রশ্ন এল—আমি কখনও দূরপাল্লায় গাড়ি চালিয়েছি কি না। জবাবে আমি বলতে বাধ্য হলাম যে, সে-রকম কোনো অভিজ্ঞতা আমার নেই। আমি যখন বললাম যে, দূরপাল্লায় গাড়ি আমি চালাইনি, রাঙাকাকাবাবু বিচলিত হলেন বলে মনে হল না। 

প্রথম প্রশ্নটি যেন ছিল প্রস্তুতিপর্ব। পরে বুঝতে পারি যে ঐ কথাগুলির মধ্যে পরের ঘটনার মূল প্রশ্নগুলি সবই ছিল। কয়েক মিনিটের মধ্যে আমাকে প্রস্তুত করে নিয়েই তিনি আসল কথাটা পেড়ে ফেললেন। বললেন, একদিন রাত্রে তাঁকে গাড়ি করে বেশ কিছুদূর পৌঁছে দিতে হবে, কেউ কিন্তু জানবে না। ‘পারবে?’ 

অনেকে হয়তো মনে করতে পারেন যে, শেষ প্রশ্নটি নিশ্চয়ই আমার মনে তীব্র শিহরণ জাগিয়েছিল কিংবা আমি নিশ্চয়ই খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। আসলে কিন্তু আমার তেমন কিছু হয়নি। আমার একটা চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য আছে, সেটা দোষ বলে ধরে নেওয়া যায়, আবার গুণ বলেও। কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনায় বা খবরে—সেটা দুঃখজনক হোক বা আনন্দের হোক—প্রথম পর্যায়ে আমার বাহ্যিক কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না। আমি দুঃখে মুষড়ে পড়ি না আনন্দেও আত্মহারা হই না, বা হঠাৎ উত্তেজিত হই না। ব্যাপারটা যেন মনের গভীরে চলে যায়, বেশ কিছুদিন পরে তার মানসিক প্রতিক্রিয়া আমি অনুভব করতে আরম্ভ করি। রাঙাকাকাবাবুর আকস্মিক প্রশ্নে আমি শান্তই ছিলাম। 

আমি তাঁকে লুকিয়ে গাড়ি করে কোথাও নিয়ে চলে যাব, কেউ জানবে না! ব্যাপারটা বোধহয় আমার মস্তিষ্কে ঠিক ধরেনি। তাঁর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলাম, যেটা আমি আগে ঠিক পারতাম না। একটু এগোলেন; বললেন, “এ-বাড়িতে কেবল ইলা জানবে।” আরও বললেন, “ইলাকে আমি টেস্ট করে দেখেছি, সে পারবে।” 

কিছুদিন পরে ইলাই আমাকে বলল যে, আমার সম্বন্ধে রাঙাকাকাবাবু তাকে জিজ্ঞাসা করছিলেন এবং সে আমাকেই কাজের ভার দেওয়াটা সমর্থন করেছিল। এলগিন রোডের বাড়ির খুড়তুতো জ্যাঠতুতো ভাইবোনদের মধ্যে ইলার সঙ্গেই আমার সম্পর্কটা ছিল সবচেয়ে নিকট এবং তার সঙ্গে একটা বোঝাপড়ায় আসা ছিল সহজ। সুতরাং ব্যাপারটা এইভাবে শুরু হওয়াতে আমরা দুজনেই খুশি হয়েছিলাম। 

আমাকে সতর্ক করে দিয়ে রাঙাকাকাবাবু বললেন যে, একটা ‘ফুল-প্রুফ’ প্ল্যান আমাদের তৈরি করতে হবে যাতে কেউ ঘুণাক্ষরেও কিছু জানতে না পারে। এই সব কথা মাথায় নিয়ে আমি ধীরেসুস্থে বাড়ি ফিরে এলাম। তিনতলায় নিজের ঘরে গিয়ে রাঙাকাকাবাবুর কথাগুলো মনে-মনে নানা দিক দিয়ে বিশ্লেষণ করতে লাগলাম। বাস্তবিক তিনি কী করতে যাচ্ছেন পুরোপুরি পরিষ্কার হল না। তবে এটা যে একটা সাধারণ রাজনৈতিক লুকোচুরির নয় সেটা বুঝতে দেরি হল না। আমাকে বলেছিলেন যে, আমি যেন ব্যাপারটা খুঁটিয়ে ভেবে দেখে একটা প্ল্যান ছকে নিয়ে পরের দিন সন্ধ্যায় তাঁর সঙ্গে দেখা করি। সেই থেকে শুরু হল রাতের পর রাত গোপনে কথাবার্তা বলা। প্রথম দিনের কয়েকটা প্রশ্নের মধ্যে দিয়ে তিনি একটা অসাধ্য সাধন করলেন। আমার মুখচোরা স্বভাব ও আড়ষ্ট ভাব একেবারে দূর করে দিলেন। কী করে করলেন? আমার মনে হয়, তাঁর যে আমার উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে এটা বুঝিয়ে দিয়ে আমার মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুললেন। একই উপায়ে দেশে ও বিদেশে তিনি কত লোকের আত্মবিশ্বাস এনে দিয়েছেন এবং আমার মতো ক্ষুদ্র ব্যক্তিদের দিয়ে বড় বড় কাজ করিয়েছেন। এর পর থেকে তাঁর সঙ্গে এমন খোলাখুলিভাবে কথাবার্তা আরম্ভ করি যে, আমি নিজেই আশ্চর্য হয়ে যাই। রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে আমার সম্পর্কের এই নতুন অধ্যায় আরম্ভ হবার সঙ্গে সঙ্গে বাবার সঙ্গেও আমার আচরণের ধরনটা বদলে গেল। বাবার সঙ্গেও আমি নানা বিষয়ে খুব খোলাখুলিভাবে কথাবার্তা ও মতবিনিময় আরম্ভ করলাম। যে-কাজে আমি জড়িয়ে পড়লাম, বাবা ও রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে একেবারে একাত্ম হতে না পারলে সে-কাজ করা সম্ভব ছিল না। 

লুকিয়ে বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার প্ল্যান ছাড়াও অন্য কতরকম প্রশ্নও আমার মাথায় ভিড় করে এল। প্রথমত আমি ভাবলাম, আমাকে রাঙাকাকাবাবু ডাকলেন কেন? আমার চেয়ে ভাল গাড়ি চালাতে পারে ও মোটরগাড়ির কলকবজা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল—এমন লোক তো পরিবারের মধ্যে আছে। আবার মনে হল, যদি বাড়ির সকলকে না জানিয়ে কিছু করতে হয়, বাইরের কোনো লোক দিয়ে কাজটা করানো ভাল নয় কি? আরও ভাবলাম, অন্যদের কথা না-হয় বাদই দিলাম, বাবা-মাকে না বলেই আমাকে কাজটা করতে হবে নাকি? অনেক রাত পর্যন্ত চিন্তা করেও এসব প্রশ্নের ঠিক-ঠিক জবাব পেলাম না। শেষ পর্যন্ত নিজেকে বললাম, এ-সব নিয়ে আমার অত মাথা ঘামাবার কী আছে, রাঙাকাকাবাবু সামলাবেন। তার পর এলগিন রোডের বাড়ি থেকে কী করে তাঁকে নিয়ে সকলের অজান্তে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া যায় তার নানারকম সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তা আরম্ভ করলাম। মেডিকেল কলেজের পাঠ্য, অ্যানাটমি, ফিজিওলজি ইত্যাদি কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। 

৩৭

বাড়ি থেকে লুকিয়ে পালাতে হলে কোন্ পথ ও দরজা দিয়ে বেরোনো যাবে, স্বাভাবিকভাবে সেই চিন্তাই মাথায় আসে প্রথমে। কারণ বাড়ির লোকজনকে অন্ধকারে রাখাটাই সমস্যা। ছদ্মবেশ যত ভালই হোক, আত্মীয়-স্বজনদের ক্ষেত্রে তার বিশেষ কোনও মূল্য নেই। বাড়ির কারও যদি একবার সন্দেহের উদ্রেক হয়, তাহলেই মুশকিল। মনে সন্দেহ জাগলে অনেকেই সেটা চেপে রাখতে পারেন না। অন্যদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে দেন। রাঙাকাকাবাবুই আমাকে বলেছিলেন যে, এ-অবস্থায় পড়লে হয় প্ল্যানটা পুরোপুরি বদলাতে হয়, নয় যাঁর মনে সন্দেহ জেগেছে তাঁকে ব্যাপারটা খানিকটা বলে দলে টেনে নিয়ে তাঁর মুখ বন্ধ করতে হয়। আর একটি উপায় হচ্ছে সন্দিহান ব্যক্তিটিকে কোনও অজুহাতে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দেওয়া—যাতে আসল ঘটনাটি ঘটার সময় তিনি কাছাকাছি না থাকেন। এই ধরনের অনেক সূক্ষ্ম প্রশ্ন রাঙাকাকাবাবু আমার সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন এবং বাড়ির ব্যাপারে ও আত্মীয়-স্বজনদের সম্বন্ধে বিশেষ-বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হয়েছিল। 

এলগিন রোডের বাড়িটা উত্তর থেকে দক্ষিণে লম্বা ব্যারাকের মতো। মাঝখানে সারি দিয়ে ঘর, দুপাশে লম্বা খোলা বারান্দা। কোনও ঘর বা ভেতরের দালান বা উঠোন দিয়ে না গিয়ে বাড়ির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলে যাওয়া যায়। তিনটে সিঁড়ি। বাড়ির মাঝামাঝি একতলা থেকে চারতলার ছাদ পর্যন্ত উঠে গেছে পুরনো স্টাইলের ভাল কাঠের সিঁড়ি। দ্বিতীয়টি বাড়ির পেছনের দিকে দোতলা রান্নাবাড়ি থেকে নেমে গেছে। তৃতীয়টি এখন আর নেই। বাড়ির একেবারে দক্ষিণে একটি ছোট্ট চার-ঘরওয়ালা দোতলা বাড়ি ছিল। যদিও বাড়িটি একটি ব্রিজ দিয়ে রান্না-বাড়ির সঙ্গে লাগানো ছিল, সেটির একটা আলাদা সিঁড়িও ছিল। ছোট্ট বাড়িটির কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ায় পরে ওটি ভেঙে ফেলা হয়। যা হোক, কোনও ঘরের কাউকে ব্যস্ত না করে পূব বা পশ্চিমের লম্বা বারান্দা ধরে সোজা এগিয়ে গেলে তিনটে সিঁড়ির যে-কোনও একটায় পৌঁছনো বেশ সহজ ছিল। বাড়ি থেকে বেরোবার পথও তিনটি ছিল বলা যায়। একটা মেন গেট। বাড়ির সামনের দিকেই কোণ ঘেঁষে রাস্তার ওপরেই একটি ছোট দরজা ছিল—পশ্চিমের লম্বা বারান্দার শেষে। আর একটা পথ দরকার পড়লে করে নেওয়া যেত। বাড়ির পেছনের মাঠে সেজোকাকাবাবু সুরেশচন্দ্রের একটা কারখানা ছিল, তার ভেতর দিয়ে। 

এত সুবিধে যখন আছে, পেছনের বারান্দা আছে, পাশের ছোট দরজা আছে, একটু ব্যবস্থা করলে যখন বাড়ির পেছন দিয়েও বেরোনো যায়, গেটের কথা কি কেউ ভাবে? আমিও ভাবিনি। আমি চিন্তা করতে লাগলাম, রাঙাকাকাবাবুকে বোধহয় পশ্চিমের মানে পেছনের বারান্দা দিয়ে সোজা দক্ষিণে চলে যেতে হবে, তারপর রান্না-বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে নেমে একতলার পেছনের বারান্দা দিয়ে উত্তর দিকে ফিরে এসে ছোট দরজা দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়তে হবে। অথবা যদি বাড়ির পেছন দিক দিয়ে বেরোনো স্থির হয়, তাহলে পেছনের ছোট বাড়ির সিঁড়ি ব্যবহার করে মাঠের দিকে যেতে হবে। রাস্তায় হাঁটার জন্য তো ছদ্মবেশ থাকবে। আমি গাড়ি নিয়ে এলগিন রোডেই খানিকটা এগিয়ে পোস্ট অফিসের কাছাকাছি ওঁর জন্য অপেক্ষা করব। কিংবা বাড়ির দক্ষিণদিক দিয়ে এলগিন লেনে এসে তিনি গাড়িতে উঠবেন। এই ধরনের প্ল্যান মাথায় করে আমি রাঙাকাকাবাবুর কাছে হাজির হলাম। দেখা যাক তিনি কী বলেন। 

“কী, ভেবে দেখেছ? কিছু প্ল্যান মাথায় এল?” 

আমি যা বললাম, ধৈর্যের সঙ্গে তিনি শুনলেন। আমি যখন থামি, তিনি তাঁর খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বাঁ হাতের তর্জনী ঠোঁটে ঠেকিয়ে কখনও আমার দিকে চেয়ে কখনও দেওয়ালে দৃষ্টি রেখে ভাবতে থাকেন। তারপর বললেন, “ভাবো, আরও ভাবো। একটু তাড়া আছে। বড়দিনের কাছাকাছি যে-কোনও দিন বেরিয়ে পড়তে হতে পারে।” 

তিনি অন্য দিক থেকে একটা সঙ্কেত আশা করছেন। সেটা পেলেই যাত্রা শুরু করতে হবে। 

রোজ-রোজ দরজা বন্ধ করে রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে কথা বলা স্বাভাবিকভাবেই কারও কারও মনে সন্দেহ বা কৌতূহলের উদ্রেক করল। ইলা এবিষয়ে তাঁকে জানায়। রাঙাকাকাবাবু নিয়মিত রেডিও শুনতেন এবং যুদ্ধের গতি খুব মনোযোগ দিয়ে অনুসরণ করতেন। সেই সময় জার্মানরা ইংরেজদের বেশ নাস্তানাবুদ করছে। শুনে রাঙাকাকাবাবু খুব উৎফুল্ল হতেন, আমরাও হতাম। জেলে থাকতেও তিনি রেডিও শুনতেন, তাঁর সেলে রেডিও দিতে সরকারকে তিনি বাধ্য করেছিলেন। রাঙাকাকাবাবুরই প্রেরণার দেশ-বিদেশের রেডিও শোনা আমারও নেশায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। যাঁরা কৌতূহলী, রাঙাকাকাবাবু তাঁদের বলে দিলেন যে, আমি বিদেশী স্টেশন ভাল ধরতে পারি, সেজন্য এ-ব্যাপারে তিনি আমার সাহায্য নেন। কিন্তু এমন অনেক লোক আছেন, যাঁদের কৌতূহল মিটলেও সন্দেহ যায় না। এমনই একজন ছিলেন আমাদের পালানকাকা। প্রায়ই দেখতাম ঘরের সামনের দরজাটা একটু ঠেলে উঁকি মেরে দেখতেন, রাঙাকাকাবাবু আর আমি কী করছি। দেখে নিয়েই দরজাটা আবার টেনে দিতেন। পালানকাকা খুব সরল প্রকৃতির, কিন্তু বেশ মজার লোক ছিলেন। দাদাভাইয়ের একমাত্র বোনের একমাত্র ছেলে। বাবা-রাঙাকাকাবাবুর একমাত্র পিসিমার বিয়ে হয়েছিল আমাদেরই গ্রামের পাশে রাজপুরের এক ভাল পরিবারে। দাদাভাই কলকাতায় এলে বাবার পিসেমশাই প্রায়ই এলগিন রোডের বাড়িতে দিন কাটিয়ে যেতেন। একতলার বারান্দায় বসে বৃদ্ধ ভদ্রলোক বড় একটা আলবোলা থেকে আরাম করে তামাক খেতেন। চঞ্চলমতি ছেলের গতিবিধি সম্বন্ধে তাঁর খুব চিন্তা হত, কেবলই ‘কোথায় গেল’ ‘কোথায় গেল’ করে হাঁকডাক করতেন। হুঁকোয় টান দিতে-দিতে ঝিমুতে-ঝিমুতে বলতেন, “পালান পালিয়ে গেল, হারান হারিয়ে গেল।” পালানকাকার ভাল নাম ছিল হারানচন্দ্র মিত্র। পালানকাকা কিন্তু ছেলেবেলা থেকেই বসুবাড়িতে মানুষ হয়েছিলেন। প্রথম জীবনে কটকে, পরে কলকাতায়। চাকরি-জীবনেও তিনি হয় এলগিন রোড নয় উডবার্ন পার্কের বাড়িতে থাকতেন। তাঁর স্বাস্থ্য খুব ভাল ছিল। খেলাধুলোয় বেশ পটু ছিলেন। তাছাড়া তিনি খুব ভাল ম্যাসাজ করতে পারতেন। তিনি প্রায়ই রাঙাকাকাবাবুর গা-হাত-পা টিপে দিতেন। আমাদের মতো ছোটদের মন পেতে হলে বলতেন, “তোমার মাথাটা তো ধরেছে মনে হচ্ছে, এসো না একটু টিপে দিই।” 

পালানকাকা ইলাকে বললেন, আমি যে রোজ সন্ধ্যায় ঘর বন্ধ করে রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে আলাদা কথা বলি, সেটা যেন কেমন-কেমন ঠেকছে! শুনে রাঙাকাকাবাবু ঠিক করলেন, পালানকাকাকে কোনওমতে কোথাও চালান করে দিতে হবে। সে-সময় পালানকাকা বেকার। একটা চাকরি জোগাড় করে দেবার জন্য রাঙাকাকাবাবুকে খুব পীড়াপীড়ি করছিলেন। রাঙাকাকাবাবু জামশেদপুরে টাটা কোম্পানির বড়সাহেবের কাছে একটা চিঠি লিখে দিলেন। সেটা নিয়ে পালানকাকাকে জামশেদপুরে গিয়ে ধর্না দিতে বললেন। তাঁকে বোঝালেন, এতদিন বেকার থাকার মতো লজ্জার আর নেই। “চিঠি দিলাম, তুমি টাটানগরে গিয়ে গ্যাঁট হয়ে বোসো, যতদিন না চাকরি হচ্ছে সেখান থেকে নড়বে না।” পালানকাকা গ্যাঁট হয়ে বসেই রইলেন, ইতিমধ্যে আমাদের কাজ সমাধা হয়ে গেল। 

পালানকাকার সরল প্রকৃতির সুযোগ নিয়ে রাঙাকাকাবাবুর অন্তর্ধানের কিছুদিন পরে শত্রুপক্ষ তাঁকে ব্যবহার করতে চেষ্টা করেছিল। ইলাকে পালানকাকা একদিন এসে বললেন, “ওরা বলছে আমাকে বেশ কিছু টাকাপয়সা দেবে, যদি আমি ছোড়দার পালানো সম্বন্ধে কিছু খবর জোগাড় করে দিতে পারি।” বোধহয় ইলা ব্যাপারটা জানে মনে করেই তিনি সোজাসুজি পুলিশের কারসাজি ফাঁস করে দিলেন। 

এলগিন রোডের বাড়িতে লোক অনেক, আত্মীয়-স্বজন ও নানা ধরনের বাইরের লোক ক্রমাগতই আসেন। জীবনযাত্রার ধরন-ধারণ স্বাভাবিকভাবেই নানারকম। তাছাড়া চাকরবাকরের সংখ্যাও কম নয়, তারা সারা বাড়িতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। নতুনকাকাবাবুর একটা বড় অ্যালসেশিয়ন কুকুরও আছে, সে আবার এর-তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, বিশেষ করে রাত্রে। আমি যখন ওই বাড়ি থেকে লুকিয়ে বেরোবার পথ ও উপায় সম্বন্ধে ভাবছি, রাঙাকাকাবাবু তখন সম্পূর্ণ এক ভিন্ন প্ল্যানের ভিত্তিতে আলোচনা আরম্ভ করলেন। বললেন, “এত লোকের মধ্যে এ-বাড়িতে ব্যাপারটা আয়ত্তে রাখা শক্ত। ধরো, এ-বাড়ি থেকে আমি খোলাখুলিভাবেই চলে গেলাম। আমার স্বাস্থ্য যে খারাপ, সে-কথা তো সকলেই জানে। স্বাস্থ্য উদ্ধারের অজুহাতে কোথাও চলে যাই, সেখান থেকে যথাসময়ে উধাও হয়ে যাব। “ 

আবার নতুন করে চিন্তা আরম্ভ হল। 

৩৮

এলগিন রোডের বাড়ি থেকে সরে গিয়ে অন্য কোথাও থেকে অন্তর্ধানের পরিকল্পনা দুভাবে করা যেত। রাঙাকাকাবাবুই এই দুই সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন। প্রথমটা ছিল উডবার্ন পার্কের বাড়িতে চলে যাওয়া। দ্বিতীয়টা ছিল রিষড়ার বাবার বাগানবাড়ি থেকে অন্তর্ধানের ব্যবস্থা করা। রাঙাকাকাবাবু বললেন যে তিনি অনশন করে মুক্তি পেয়েছেন, সুতরাং ওঁর স্বাস্থ্য যে ভাল নয় সেটা সকলেরই জানা। ডাঃ মণি দে-র ডাক্তারি বুলেটিনও খবরের কাগজে বেরিয়েছে, তাতেও তাঁর ভগ্নস্বাস্থ্যের উল্লেখ আছে। প্রচার করে দেওয়া যাক যে, এলগিন রোডের বাড়িতে তিনি একটা ঘরে বন্দী হয়ে আছেন, স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য যথেষ্ট আলো-হাওয়া ও বেড়াবার সুযোগ পাচ্ছেন না। সেজন্য তিনি উডবার্ন পার্কের বাড়ির তিনতলার একটি ঘরে থাকবেন। পাশেই বড় ছাদ, খুব আলো-বাতাস পাবেন, আর বেড়াতেও পারবেন। রিষড়ার বাড়িতে গেলে তো কথাই নেই। সেখানে তো গঙ্গার উপর বাবার একটা সুন্দর বাগানবাড়ি আছে। অসুস্থ লোকের পক্ষে চমৎকার জায়গা। 

আমাকে রাঙাকাকাবাবু বললেন, উডবার্ন পার্কের বাড়ি থেকে সব ব্যবস্থা করতে তো আমার সুবিধাই হওয়া উচিত। রিষড়ার বাড়িতে সাধারণত একটি লোকই থাকে, তাকে কীভাবে আয়ত্তে আনা যায় সেটা ভেবে দেখতে হবে। 

আমি ভাল করে ভেবে দেখলাম। মনে হল রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে দিনকতক খোলাখুলি ভাবে কথাবার্তা বলে আমার বুদ্ধিটা যেন একটু খুলেছে। আমি স্থির সিদ্ধান্তে এলাম যে, প্রথম পর্যায়ে অন্য কোথাও চলে গিয়ে দ্বিতীয় পর্যায়ে অন্তর্ধানের পরিকল্পনা মোটেই সুবিধার হবে না। আমি সোজাসুজি রাঙাকাকাবাবুকে বললাম, সকলেই জানে যে আপনি বেশ অসুস্থ, এই একটি ঘরে থাকেন, এমনকী বারান্দায়ও বেরোন না। বিশেষ করে যে-সব পুলিশের চর আপনার গতিবিধির উপর নজর রাখে এবং বাড়ির আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়, তাদেরও ঐ একই ধারণা। ওদের আচরণ লক্ষ করে আমারও মনে হয়েছে যে, তাদের মধ্যে একটা আত্মসন্তুষ্টির ভাব এসেছে এবং মনে হয় ওরা কাজে একটু ঢিলে দিয়েছে। এই অবস্থায় রাঙাকাকাবাবু যদি সকলকে জানিয়ে অন্য বাড়িতে চলে যান তাহলে সবাই আবার সজাগ ও সতর্ক হয়ে যাবে। পুলিশের দিক থেকে আবার নতুন ব্যবস্থা হবে, ফলে আমাদের অসুবিধাই হবে। তাছাড়া উডবার্ন পার্কের বাড়িতে শৃঙ্খলাটা বেশ কড়া, যে-সব লোকজন বাড়িতে থাকে ও কাজ করে, বিশেষ করে নীচের তলার বেয়ারা, গেটের দরওয়ান ও দুই ড্রাইভার, তারা সকলেই খুবই বিশ্বস্ত ও সতর্ক, সন্দেহজনক গতিবিধি দেখলেই শোরগোল তুলবে। রিষড়ার বাড়িতে অবশ্য লোকজন কম, কিন্তু আমার বিশ্বাস কলকাতার বাইরে রাঙাকাকাবাবু কোথাও গেলেই পুলিশ সেখানে নতুন করে অনেক লোক বসাবে। শেষ পর্যন্ত আমি বললাম, উডবার্ন পার্কের বা রিষড়ার বাড়ি ব্যবহার না করাই ভাল। বলেই মনে হল বোধহয় মাত্রা ছাড়িয়ে গেছি, এতটা মাস্টারি না করলেও হত। কিন্তু রাঙাকাকাবাবু বলে উঠলেন, ঠিক বলেছ, ও-পথে যাওয়া চলবে না। কিছু অসুবিধা থাকলেও এ-বাড়ি থেকেই যাত্রা করার প্ল্যান করতে হবে। 

.

একদিন একটু বেশি কাছে ডেকে রাঙাকাকাবাবু একটা খুব শক্ত প্রশ্ন করলেন, বাবা-মাকে না জানিয়ে কাজটা করতে পারবে? আমি সোজাসুজি উত্তর দিলাম না। স্থির হয়ে কিছুক্ষণ তাঁর দিকে তাকিয়ে থেকে অস্পষ্টভাবে বললাম, ঠিক আছে। 

রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে আলোচনা যখন খুব জোর কদমে চলছে, আমার মনে হল অন্য কয়েকটা ঐতিহাসিক অন্তর্ধানের কাহিনী খুঁটিয়ে দেখে নিলে হয়, কিছু আইডিয়া পাওয়া যেতে পারে। শিবাজির ব্যাপারটা বড়ই পুরনো, বর্তমান যুগের গাড়ি বা অন্যান্য যানবাহন ব্যবহার তো সেখানে নেই। আয়াল্যাণ্ডের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক প্রধান হোতা ডি ভ্যালেরার ইংল্যাণ্ডের লিঙ্কন জেল থেকে পালানোর কাহিনীটা মনে ধরল। যদিও পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রভেদ দুই ক্ষেত্রে যথেষ্ট, আমাদের প্রতিপক্ষ তো একই। ভাগ্যিস ডি ভ্যালেরার জেল থেকে অদৃশ্য হবার ব্যাপারটা পড়ে নিয়েছিলাম। ১৭ই জানুয়ারি রাতে গাড়িতে রাঙাকাকাবাবু ডি ভ্যালেরার এসকেপ সম্বন্ধে জানি কিনা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। ১৯১৯ সালে ডি ভ্যালেরা—যাঁকে তাঁর সংগ্রামসঙ্গীরা ‘ডেঙ্’ বলে ডাকতেন—যে-জেলে বন্দী ছিলেন তার পিছনের দিক দিয়ে একটা ছোট দরজা ছিল। জেলের পাদ্রিসাহেব সেই দরজা দিয়ে যাতায়াত করতেন এবং দরজার চাবিটি তিনি প্রায়ই এদিক-ওদিক ফেলে রাখতেন। ডি ভ্যালেরা মোমবাতির মোম গালিয়ে চাবিটির একটি ছাপ নিয়ে নিলেন। ছাপটির সাহায্যে একটি ক্রিসমাস কার্ডে চাবির একটা নকশা এঁকে ‘ডেভ’-এর এক সাথী কৌতুকের ছলে কয়েকটি ইঙ্গিতপূর্ণ কথা লিখে বাইরে বন্ধুদের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। বাইরে থেকে চাবি তৈরি করে কেকের মধ্যে লুকিয়ে জেলে পাঠানো হল। বার-দুয়েক তো চাবি ঠিক হল না। তৃতীয় বার বাইরে থেকে পাঠানো চাবিটি জেলের মধ্যে এক বন্দী ঘষে-মেজে ঠিক করলেন। ডি ভ্যালেরাকে নিয়ে যাবার জন্য জেলের পিছনের জঙ্গলে যাঁরা লুকিয়ে ছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন আয়াল্যাণ্ডের মুক্তিযুদ্ধের প্রবাদপুরুষ আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির নায়ক মাইকেল কলিনস। সিগন্যাল আদান-প্রদানের পর ডি ভ্যালেরা তো ঠিকমতো ভিতরের দরজাটা খুললেন, এবং বাইরে থেকে তাঁকে দেখা গেল। বাইরের লোহার দরজায় চাবি লাগিয়ে মাইকেল কলিনস চাড় দিতেই কলের ভিতরে চাবিটি গেল ভেঙে। কলিনস মুষড়ে পড়ে বলে উঠলেন, “আই হ্যাভ ব্রোকেন এ কী ইন দি লক, ডেভ।” চমকে উঠে ডি ভ্যালেরা তাঁর হাতের চাবিটি দিয়ে ভিতরের দিক থেকে একটু ঠেলা দিতেই ভাগ্যের জোরে ভাঙা চাবিটি পড়ে গেল। লিঙ্কন শহর পর্যন্ত সকলে হাঁটলেন। পথে কিছু সিপাই-সান্ত্রী ছিল, যেমন আমরাও গাড়ি থেকে পথে কিছু দেখেছিলাম। তাদের সম্ভাষণ করতে করতে তাঁরা এগোলেন। অন্ধকার রাতে মুক্ত বন্দীদের নিয়ে তীরবেগে একটা ট্যাক্সি উধাও হয়ে গেল। 

.

ডি ভ্যালেরার কাহিনী পড়ে আমি একটু চিন্তিতই হয়ে পড়লাম। তাঁর জেল থেকে পালাবার ব্যবস্থাদি করেছিলেন অভিজ্ঞ বিপ্লবীরা। তাও কত রকমের অসুবিধা হয়েছিল। আমি ভাবলাম, আমার মতো ছেলে-ছোকরা দিয়ে কি রাঙাকাকাবাবু এত শক্ত কাজ সামাল দিতে পারবেন! কোথায় মাইকেল কলিনস আর কোথায় আমি! দায়িত্বটা যে কত বড় সেটাই বোঝার ক্ষমতা আছে কিনা কে জানে? যাই হোক, নিজেকে বোঝালাম, যথাসাধ্য করতে হবে। 

১৯৪৮ সালের শেষের দিকে বাবা-মা ও দুই বোনের সঙ্গে ডাবলিনে গিয়েছি। আমার মনের মধ্যে কৌতূহল ও চাপা উত্তেজনা ছাপিয়ে উঠছে। সেখানে দেখতে পাব সেই ডি ভ্যালেরাকে। হয়তো কিছু কথাবার্তা বলারও সুযোগ হবে। ডাবলিনের ‘ডয়েল’ বা পার্লামেন্ট ভবনে ডি ভ্যালেরা বাবাকে অভ্যর্থনা করলেন। বাবার সঙ্গে তাঁর অনেক কথা হল। তিরিশের দশকে রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে ডি ভ্যালেরার কয়েকবারই দেখা হয়েছে। দুই মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে খুবই সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বাবা সপরিবারে তাঁর কাছে যাতায়াতে বসুবাড়ির সঙ্গে ডি ভ্যালেরার সম্পর্কটা আরও গভীর হল। আমি তাঁকে বললাম, “১৯৪৩-এ বাংলার দুর্ভিক্ষের সময় আপনি আয়াল্যাণ্ড থেকে রেড ক্রস মারফত যে-সাহায্য পাঠিয়েছিলেন তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে রাঙাকাকাবাবু আপনাকে উদ্দেশ করে একটা বেতার-ভাষণ দিয়েছিলেন।” শুনে ডি ভ্যালেরা চঞ্চল হয়ে উঠলেন। বললেন, “সুভাষের ঐ ভাষণটি যোগাড় করে অতিঅবশ্য আমাকে পাঠিয়ে দেবে।” সঙ্গে ক্যামেরা ছিল। আলো কম, তবু বেশ কয়েকটি ছবি তুললাম। পরে লণ্ডন থেকে ছবি তৈরি করে তাঁকে পাঠাই এবং একটি ছবি সই করে আমাকে ফেরত দিতে অনুরোধ করি। ডি ভ্যালেরা কালক্ষেপ না করে সানন্দ সম্ভাষণ জানিয়ে আমার অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন। 

১৯৪০-এ বাবার শরীরটা মোটেই ভাল যাচ্ছিল না। রাঙাকাকাবাবু মুক্তি পাবার কিছুদিন পরেই বাবা স্বাস্থ্যের জন্য কালিম্পঙে চলে গেলেন, আইন-ব্যবসায়ে তাঁর প্রিয় শিষ্য সুধীরঞ্জন দাসের অতিথি হয়ে। মনে আছে, দু-তিনবার রাঙাকাকাবাবু বাবার কাছে চিঠি লিখে সরাসরি শিয়ালদা স্টেশনে দার্জিলিঙ মেলে পৌঁছে দিয়েছেন যাতে মাঝপথে কোনো ডাকঘরে পুলিশের লোক সেগুলি খুলে না দেখে। আর কিছুদিন পরে বড়দিনের ছুটিতে বাড়ির আর-সকলকে নিয়ে মা আমার বড় দাদার কাছে ধানবাদ অঞ্চলে বারারি চলে গেলেন। ফলে যখন আমি রাঙাকাকাবাবুর গোপন-যাত্রার জন্য প্রস্তুতি আরম্ভ করলাম তখন উডবার্ন পার্কের বাড়ি খালি। 

৩৯

সব দিক বিবেচনা করে যখন ঠিক হল যে এলগিন রোডের বাড়ি থেকেই যাত্রার ব্যবস্থা করতে হবে, রাঙাকাকাবাবু নতুন করে চিন্তা আরম্ভ করলেন। তবে ঠিক কী উপায়ে বাড়ি থেকে লুকিয়ে যাওয়া হবে সে-বিষয়ে কিছুদিন তিনি পরিষ্কার করে বললেন না। অন্য অনেক ব্যবস্থা করার ছিল, সেগুলি নিয়ে আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। প্রথমত একটা ছদ্মবেশ তো চাই। সেজন্য নিজের কী কাপড়জামা আছে দেখতে চাইলেন। তাঁর গরম কাপড়জামা, বিশেষ করে যেগুলি তিনি আগে ইউরোপে ব্যবহার করেছিলেন সেগুলি উডবার্ন পার্কের বাড়িতে মার কাছে থাকত। তিনি সকলকে বললেন যে, অনেকদিনের জন্য তো তিনি শীঘ্র‍ই জেলে চলে যাবেন, তাঁর কাপড়চোপড়, জিনিসপত্র কোথায় কী আছে দেখে নিতে চান। আমি মাকে বলে উডবার্ন পার্কের বাড়িতে তাঁর যা-কিছু ছিল, তাঁরই পরিচারক রমণীকে দিয়ে এলগিন রোডের বাড়িতে পাঠিয়ে দিলাম। কিছু জামাকাপড় তিনি ফেরতও দিলেন, তার মধ্যে কিছু ছিল যা আমাকে সঙ্গে নিতে হবে। অন্তর্ধানের পর রাঙাকাকাবাবুর কাপড়চোপড় নিয়ে এ-বাড়ি ও-বাড়ি করাটা বাড়ির কারুর কারুর মনে সন্দেহের উদ্রেক করেছিল। 

এরই মধ্যে বেশ একটা কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার ঘটল। রাঙাকাকাবাবু দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে তাঁর অনুগামীদের একটা মিটিং ডাকলেন। মিটিংটা উপলক্ষ মাত্র, আসল কাজটা ছিল উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মিঞা আকবর শাহের সঙ্গে। একদিন সন্ধ্যায় রাঙাকাকাবাবুর ঘরে গিয়ে দেখি একজন পাঠান ভদ্রলোক রয়েছেন। বাড়ির দু-একজনও ছিলেন—আর ছিলেন রাঙাকাকাবাবুর সেক্রেটারি অমূল্য মুখার্জি। আমাকে রাঙাকাকাবাবু বললেন যে, সেই সন্ধ্যায়ই মিঞাসাহেব ফিরবেন। তাঁর রেলের টিকেট কাটা ও বার্থ রিজার্ভ করা হয়নি, সেজন্য অমূল্যবাবুকে তিনি আগেই হাওড়া স্টেশনে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। আমি যেন ওয়াণ্ডারার গাড়িতে করে তাঁকে সময়মতো স্টেশনে পৌঁছে দিই। পথে তিনি হোটেল থেকে তাঁর মালপত্র তুলে নেবেন এবং ধর্মতলায় কিছু কেনাকাটা আছে—তাও সেরে নেবেন। নজর করলাম, রাঙাকাকাবাবুর খাটে একটা মাপবার ফিতে পড়ে ছিল। 

গাড়ি চালাচ্ছিল ড্রাইভার, মিঞা আকবর শাহ ও আমি বসে ছিলাম পিছনের সীটে। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর মিঞাসাহেব ইংরেজিতে কথা আরম্ভ করলেন। বললেন, রাঙাকাকাবাবু তাঁকে বলেছেন যে, তাঁর অন্তর্ধানের ব্যাপারে এদিককার ভার আমার উপর পড়েছে, অন্য প্রান্তের ভার তাঁর নিজের উপর। সব ব্যবস্থা ঠিক হয়ে গেলে তিনি একটা সিগন্যাল পাঠাবেন। প্রথমে মির্জাপুর স্ট্রীটের এক হোটেল থেকে তাঁর মালপত্র তুলে নিলেন। তারপর বললেন ধর্মতলা স্ট্রীটে ওয়াছেল মোল্লার দোকানে নিয়ে যেতে, সেখান থেকে তিনি রাঙাকাকাবাবুর জন্য দু-একটা জিনিস কিনে দেবেন। আমার সঙ্গে ব্যবস্থা হল, তিনি স্টেশনে নামবার সময় ইচ্ছা করে জিনিসগুলো ভুলে গাড়িতে ফেলে যাবেন। ওয়াছেল মোল্লার দোকানে আমরা একসঙ্গেই ঢুকলাম, জিনিস কিনবার জায়গাটা তাঁকে দেখিয়ে দিয়ে আমি দূরে সরে রইলাম। দেখলাম মিঞাসাহেব পায়জামা টুপি নিজের গায়ে লাগিয়ে দেখছেন। যেন নিজের জন্যই কিনছেন। রাঙাকাকাবাবুর জন্য তিনি একজোড়া ঢিলে পায়জামা ও একটি ফেজ ধরনের লোমশ ‘আস্ত্রাখান’ টুপি কিনলেন। তিনিই প্যাকেটটি হাতে করে গাড়িতে উঠলেন। সীটের পেছনে সেটা ফেলে রাখলেন। হাওড়া স্টেশনে পৌঁছেই দেখলাম, অমূল্যবাবু স্টেশনের গাড়িবারান্দায় অপেক্ষা করছেন। রাঙাকাকাবাবু আমাকে আগেই বলে দিয়েছিলেন, আমি যেন স্টেশনে না নামি। চট করে মালপত্র নামিয়ে দিয়ে আমি মিঞাসাহেবকে বিদায় জানিয়ে ড্রাইভারকে বললাম বাড়ি চলুন। কিন্তু কী মুশকিল, স্টেশনের চত্বর ছাড়বার আগেই ড্রাইভার বাবুর নজরে পড়ল, মিঞাসাহেব প্যাকেটটি ফেলে গেছেন। আমাকে বলল, “ দৌড়ে দিয়ে আসব নাকি?” আমি বিরক্তির ভান করে বললাম, “অত হ্যাঙ্গাম আমার পোষাবে না, ভুলে গেছেন তো আমি কী করব, পরে পার্সেল করে পাঠিয়ে দিলেই হবে। তাড়া আছে, বাড়ি চলুন।” বাড়ি ফিরে প্যাকেটটি আমার আলমারিতে বন্ধ করলাম। 

মিঞা আকবর শাহের সঙ্গে কথাবার্তা ও বাজার করবার পর আমি পরিষ্কার বুঝে গেলাম যে, রাঙাকাকাবাবু অসাধারণ বৈপ্লবিক কিছু করতে বিদেশে পাড়ি দেবেন। পরে আমাকে বললেন, আমাকেও বেশ কিছু কেনাকাটা করতে হবে। নিউ মার্কেট থেকে এক জোড়া ফ্যানেলের শার্ট ও ‘মেড্ ইন্‌ ইংল্যাণ্ড’ মার্কা চিরুনি, টুথব্রাশ, টুথপেস্ট, সাবান ইত্যাদি কিনেছিলাম মনে আছে। মজবুত মোটা ধরনের এক জোড়া কাবলি জুতো কিনতে খুব অসুবিধায় পড়েছিলাম। শেষপর্যন্ত মোটামুটি পছন্দসই একজোড়া পেয়েছিলাম। হ্যারিসন রোডের একটা বড় দোকান থেকে একটা মাঝারি মাপের সুটকেশ, একটা অ্যাটাচি কেস ও বিছানার জন্য একটা হোল্ডল কিনলাম। রাঙাকাকাবাবুর কথামতো বাক্সগুলির উপরে কালো কালি দিয়ে M.Z. লিখিয়ে নিয়েছিলাম। ছোট তোশক, বালিশ ইত্যাদি ধর্মতলা স্ট্রীটের একটা দোকান থেকে যোগাড় করলাম। একটা সুবিধা ছিল যে, যখন আমি বাক্সপ্যাঁটরা বিছানা ইত্যাদি কিনছিলাম, উডবার্ন পার্কের বাড়ি তখন খালি। বাড়ির চাকরবাকরেরা যাতে এসব কিছু না দেখে ফেলে সেজন্য দুপুরশো যখন ড্রাইভাররা ছুটি নেয় আর অন্যেরা বিশ্রাম করে,সেই সময় নিজে গাড়ি চালিয়ে বড়সড় জিনিসগুলো সংগ্রহ করেছিলাম। নীচের তলার বেয়ারাটি দুপুরে খাওয়ার পরে সামনের বারান্দায় কুম্ভকর্ণের মতো নিদ্রা যেত। তাকে পাশ কাটিয়ে চুপিসারে সব জিনিসপত্র আমি তিনতলায় নিজের ঘরে নিয়ে ফেললাম। বেশ কিছু আলমারির ভিতরে গেল। বড় বাক্সটি রইল অন্য বাক্সের সঙ্গে খাটের তলায়। 

রাঙাকাকাবাবুর জন্য একটা ভুয়ো ভিজিটিং কার্ড ছাপাতে হবে। এক টুকরো কাগজে পেন্সিলে বড় বড় অক্ষরে যেমন ছাপাতে হবে লিখে দিলেন। বললেন, সম্পূর্ণ অজানা দোকানে যেতে হবে এবং আমার পোশাক চালচলন এমন হওয়া চাই যে, মনে হবে আমি নিজের জন্যই কার্ড ছাপাচ্ছি। নিজের হাতে রাঙাকাকাবাবুর লেখাটা কপি করে নিয়ে এক সন্ধ্যায় স্যুট-টাই ইত্যাদি চাপিয়ে হ্যাট হাতে নিয়ে তো বাড়ি থেকে বেরোচ্ছি। সদর দরজা পেরোতেই ডাঁটিদাদার (রবীন্দ্রকুমার ঘোষ) মুখোমুখি হয়ে গেলাম। তিনি তো ঐ পোশাকে আমাকে কখনও দেখেননি, বাবা তো পাহাড়ে পরবার জন্য ওগুলি করিয়ে দিয়েছিলেন। কী যে করি! যাই হোক, সরলপ্রাণ ডাঁটিদা নিজেই বলে উঠলেন, “বাইরে ডিনার-টিনার আছে বুঝি?” আমতা-আমতা করে আমি বললাম, “এই, মানে, হ্যাঁ, একটা, মানে ডিনার…!” ট্যাক্সি নিয়ে চলে গেলাম রাইটার্স বিল্ডিং-এর পিছনে রাধাবাজারে। যতটা পারি গম্ভীর মেজাজে টানা টানা ইংরেজিতে কার্ডটা অর্ডার দিলাম : 

MOHD. ZIAUDDIN B.A., LI.B.
Travelling Inspector 
The Empire of India Life Insurance Co. Ltd. 
Permanent address:
Civil Lines,
Jubbulpore. 

পরে কার্ড যখন রাঙাকাকাবাবুর হাতে দিলাম, তাঁর তো পছন্দ হয়েছে বলেই মনে হল।

উডবার্ন পার্কে তো দুটো গাড়ি—একটা বড় স্টুডিবেকার প্রেসিডেন্ট যেটা বাবা ব্যবহার করতেন। আর অন্যটা ওয়াণ্ডারার। একদিন রাঙাকাকাবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, কোন গাড়িটা আসল কার্জের জন্য নেওয়া হবে। স্টুডিবেকার খুব জোরদার গাড়ি। চলে খুব ভাল, চালাতেও আরাম। ওয়াণ্ডারার গাড়িটাও ভাল, সব জার্মান জিনিসই যেমন হয়, তবে লম্বা পাড়িতে গোলমাল করবে না তো? মনে হল রাঙাকাকাবাবু প্রথমটায় স্টুডিবেকারের পক্ষেই ছিলেন। কিন্তু আমরা ভেবে দেখলাম, বড় গাড়িটা বড়ই চেনা, রাস্তায় দেখলে অনেকেই বলে ওঠে, ঐ যে শরৎ বোসের গাড়ি বা ঐ যে শরৎ বোস যাচ্ছেন। সুতরাং ওয়াণ্ডারার নেওয়াই শেষ পর্যন্ত ঠিক হল। 

একদিন রাঙাকাকাবাবু আমার ও গাড়ির একসঙ্গে পরীক্ষা নিলেন। বললেন, “সকাল-সকাল বেরিয়ে ওয়াণ্ডারার গাড়ি চালিয়ে রাস্তায় কোথাও না থেমে তুমি বর্ধমান চলে যাও। বর্ধমান রেল-স্টেশনে দুপুরের খাওয়াটা খেয়ে আবার সোজা চলে এসো। এসেই আমাকে বলো, গাড়ি কেমন চলল, তোমারই বা কতটা ক্লান্তি হল।” ফিরে আমি ভাল রিপোর্টই দিলাম। আর-একদিন বললেন, “রিষড়ার বাড়ির লোকটিকে একটু প্রস্তুত করে রাখা যাক, বাড়ির লোকেরাও জানুক যে তুমি কখন কখন রাত্রে বাড়ির বাইরে থাকো।” এক সন্ধ্যায় রিষড়ায় চলে যেতে বললেন। আমি একটু দেরি করে রিষড়ায় পৌঁছে মালিকে বললাম, “আজ রাত হয়ে গেছে, আমি এখানেই থেকে যাব, বিছানাপত্রের ব্যবস্থা করে দাও, কিছু খাবার নিয়ে এসো।” রাঙাকাকাবাবু বলেছিলেন, তাঁকে আরও দূরের কোনো স্টেশনে তুলে দিয়ে ফেরবার সময় আমাকে রিষড়ায় থেকে যেতে হতে পারে। লোককে বলারও সুবিধে হবে যে আমি রিষড়ার বাগানবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *