বসু-বাড়ি – ৩০

৩০

ত্রিপুরী কংগ্রেস ও তারপর ১৯৩৯-এর মে মাসে কলকাতায় নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির বৈঠকের মধ্যে যে সময়টুকু ছিল সেটা আমাদের দেশের পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরের দশকে দেশের ইতিহাসের গতি কী হবে, সেটা সেই সময়ই ঠিক হয়ে গিয়েছিল। বসুবাড়ির সকলকে যেটা আচ্ছন্ন করে রেখেছিল সেটা মূলত ছিল রাঙাকাকাবাবুর শারীরিক অবস্থা এবং সেই সঙ্গে তাঁর ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক জীবনের অনিশ্চয়তা। ন’কাকাবাবু সুধীরচন্দ্রের জামাডোবার বাড়িতে বিশ্রাম, সেবা ও চিকিৎসার ফলে তিনি ধীরে-ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছিলেন। 

গান্ধীজি জামাডোবায় আসতে রাজি না হওয়ায় রাঙাকাকাবাবু কংগ্রেসের মধ্যে বিবাদ মেটাবার জন্যে তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ পত্রালাপ আরম্ভ করলেন। আমাদের দেশের ও বিদেশের ঐতিহাসিকেরা তাঁদের ওইসব ঠিপত্র নিয়ে আজকাল গবেষণা ও আলোচনা করেন। 

ত্রিপুরী কংগ্রেসের নির্দেশ ছিল, রাষ্ট্রপতিকে মহাত্মা গান্ধীজির মতানুসারে ওয়ার্কিং কমিটী গঠন করতে হবে। কিন্তু এ-ব্যাপারে গান্ধীজি কিছুতেই রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে সহযোগিতায় রাজি হলেন না। পণ্ডিত জওহরলাল একবার জামাডোবায় এলেন, কথাবার্তাও হল, কিন্তু কাজ বিশেষ এগুল না। শেষ পর্যন্ত ঠিক হল যে, অল ইণ্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনের দিনকয় আগে গান্ধীজি কলকাতার কাছে সোদপুর আশ্রমে থাকবেন এবং সেই সময় দুজনের মধ্যে মুখোমুখি কথাবার্তা হবে। ওই সময় কংগ্রেসের অন্যান্য নেতাও কলকাতায় আসবেন। তাঁদেরও আলোচনার জন্য পাওয়া যাবে। 

রাঙাকাকাবাবু বেশ সুস্থ হয়েই কলকাতায় ফিরলেন। নিজেই তিনি বলতেন, জীবনে কতবার কত রকম অসুখ যে তাঁর হয়েছে—তার হিসেব নেই। কিন্তু তাঁর সেরে ওঠার ক্ষমতাও ছিল অসাধারণ। আবার দেখা গেল তাঁর বলিষ্ঠ ও উজ্জ্বল চেহারা। 

বাবা তো রাঙাকাকাবাবুকে জামাডোবায় নামিয়ে চলে এসেছিলেন। ত্রিপুরীতে রাজনীতির যে চেহারা তিনি নিজের চোখে দেখে এসেছিলেন সেটা তাঁকে গভীরভাবে আঘাত করেছিল। গান্ধীজিকেও তিনি এ-বিষয়ে বেশ তীব্র ভাষায় চিঠি লিখেছিলেন। এই সূত্রে রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে তাঁর অন্তরের সম্পর্ক সম্বন্ধে কিছু বলি। বাবার নিজের জীবনেও তো অনেক রকমের অভিজ্ঞতা হয়েছিল। অনেক অন্যায়, অবিচার, অসদ্ব্যবহার, ঈর্ষাপ্রসূত শত্রুতা তিনি অবিচলিত চিত্তে সহ্য করেছেন। তা সে আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব বা সহকর্মী, যে-দিক থেকেই আসুক না কেন। কিন্তু নিজের ক্ষেত্রে যা তিনি শান্তভাবে মুচকি হেসে উড়িয়ে দিতে পারতেন, ভাই সুভাষের ক্ষেত্রে তা পারতেন না। 

সুভাষের প্রতি কেউ কোনও অবিচার বা অন্যায় করেছে—এটা যদি তাঁর মনে গেঁথে যেত একবার, তিনি আর অবিচল থাকতে পারতেন না। তীব্র ভাষায় এবং জোরের সঙ্গে তার প্রতিবাদ ও প্রতি-আক্রমণ করতেন। রাঙাকাকাবাবুর প্রতি তাঁর মনের ভাব সম্বন্ধে আমরা দু-একধরনের কথা শুনতাম।—এক, সুভাষকেই তিনি নিজের বড় ছেলের স্থান দিয়েছিলেন, এবং তাঁর দাবি ছিল অনস্বীকার্য। দুই, নিজের ছেলেদের চেয়েও তিনি সুভাষকে বেশি ভালবাসতেন। আমাদের কিন্তু এতে হিংসা হত না, গৌরবই হত। 

পরে, যুদ্ধের সময় রাঙাকাকাবাবুর বিদেশের কার্যকলাপ নিয়ে অনেকে অনেক অপ্রিয় কথা বলেছিলেন, অনেকে তো কুৎসা রটনা করতেও ইতস্তত করেননি। এদের বাবা মনে-মনে কোনদিনও ক্ষমা করতে পারেননি। আমার মনে হয়, এর কারণ ছোট ভাইয়ের প্রতি তাঁর গভীর ভালবাসা। শুধু তাই নয়, রাঙাকাকাবাবুর নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম, রাজনৈতিক প্রতিভা ও অতুলনীয় আত্মত্যাগের তুলনা তিনি সমসাময়িক কোনও ব্যক্তির মধ্যে দেখেননি। বড় ভাই ছোট ভাইকে বুক ফুলিয়ে নেতা বলে স্বীকার করছেন—এ নজির ইতিহাসে আর আছে কি না সন্দেহ! 

১৯৩৯-এর মে মাসে কংগ্রেস কমিটীর অধিবেশনের দিনকয় আগে গান্ধীজি কলকাতায় এলেন এবং সোদপুরের আশ্রমে উঠলেন। গান্ধীজির সঙ্গে রাঙাকাকাবাবুর দীর্ঘ আলোচনা চলতে লাগল, কংগ্রেসের দ্বন্দ্ব মেটাবার জন্য। মনে আছে, রাঙাকাকাবাবু প্রায়ই খুব সকালে উডবার্ন পার্কের বাড়িতে আসতেন। পণ্ডিতজিকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের ‘ওয়াণ্ডারার’ গাড়িতে করে সোদপুর রওনা দিতেন। এই ‘ওয়াণ্ডারার’ গাড়িটিকে অনেক ঐতিহাসিক কাজে লাগানো হয়েছে। নেতাজীর মহানিষ্ক্রমণের আগে ও পরে। আজ নেতাজী ভবনের মিউজিয়ামে গাড়িটি অন্যতম বড় আকর্ষণ। 

গান্ধীজির সঙ্গে অনেক আলোচনা করেও কোনও মীমাংসার সূত্র খুঁজে পাওয়া গেল না। একদিন দেখি, রাঙাকাকাবাবু ও জওহরলাল একটু বেলায় উডবার্ন পার্কের বাড়িতে ফিরে সামনের বারান্দায় গম্ভীর মুখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। যেন গুরুতর কিছু ঘটে গেছে। বেশ কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পরে রাঙাকাকাবাবুই স্তব্ধতা ভাঙলেন। বললেন, “যাও, খাওয়া-দাওয়া করো, আফটার অল, ম্যান মাস্ট লিভ।” 

জওহরলাল উত্তরে শুধু বললেন, “ইয়েস্, ম্যান মাস্ট লিভ।” তার পর দুজনে দুদিকে চলে গেলেন। 

কলকাতার ওয়েলিংটন স্কোয়ারে যখন কংগ্রেসের সভা বসল, তখন সকলেই খুব উৎকণ্ঠিত। রাঙাকাকাবাবু কংগ্রেসের নির্বাচিত সভাপতি, কিন্তু তিনি নিজেই প্রস্তাব করলেন, সরোজিনী নাইডু সভানেত্রী হোন। কারণ, সভাপতি নিজেই এক বিতর্কের বিষয়। মনে আছে, সরোজিনী নাইডু অতি সুন্দর ইংরেজিতে এক আবেগময়ী বক্তৃতা করেছিলেন রাঙাকাকাবাবুকে সভাপতির পদে বহাল থাকতে অনুরোধ জানিয়ে। তাঁর বক্তৃতার পরে অনেকেরই মনে হয়েছিল, ওই ধরনের মর্মস্পর্শী আবেদনের পরে রাঙাকাকাবাবু কী করবেন! 

রাঙাকাকাবাবু কিন্তু সম্পূর্ণ অবিচলিত থেকে ধীরে ও শান্তভাবে তাঁর বিবৃতি পড়লেন। যুক্তির ভিত্তিতে তিনি বুঝিয়ে দিলেন যে, তিনি যখন ত্রিপুরী কংগ্রেসের নির্দেশ অনুসারে চলতে পারছেন না, সভাপতির পদ ত্যাগ করা ছাড়া তাঁর সামনে আর কোনও পথ খোলা নেই। তিনি পদত্যাগের কথা ঘোষণা করার সঙ্গে-সঙ্গে সভায়, বিশেষ করে অভ্যাগতদের মধ্যে, তীব্র আলোড়ন শুরু হল। 

নতুন সভাপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ সভার সমাপ্তি ঘোষণা করার পরে ওয়েলিংটন স্কোয়ারের চারদিকে বিক্ষোভ ফেটে পড়ল। নেতাদের সভার বাইরে বের করা ও যাঁর যাঁর বাসস্থানে পৌঁছে দেওয়া বিরাট এক সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। রাঙাকাকাবাবু স্বেচ্ছাসেবকদের একটা ব্যূহ রচনা করতে বললেন, এবং উত্তেজিত জনতাকে বারবার বলতে লাগলেন যে, বাংলার আতিথেয়তার ঐতিহ্য যেন কোনও মতে ম্লান না হয়। তিনি নিজে স্বেচ্ছাসেবকদের সাহায্যে অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে এক-এক করে আগলে গাড়িতে তুলে দিলেন। 

আমরা ছোটরা কয়েকজন গোলমালের মধ্যে একটু দলছাড়া হয়ে পড়েছিলাম। পাশের একটা গেট দিয়ে কোনওরকমে বেরিয়ে একটা গাড়ি ধরে বেশ দেরিতে বাড়ি পৌঁছলাম। আমরা গুজব শুনেছিলাম যে, পণ্ডিত জওহরলাল নাকি ধস্তাধস্তির ফলে আঘাত পেয়েছেন। তিনি তো আবার আমাদের বাড়িতেই অতিথি। একটু ভয়ে-ভয়েই আমরা বাড়িতে ঢুকলাম। ঢুকতেই পণ্ডিতজির সেক্রেটারি উপাধ্যায়জির সঙ্গে দেখা। তিনি তো একগাল হেসে আমাদের সম্ভাষণ জানালেন। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আমরা তাঁর কাছ থেকে জেনে নিলাম যে, পণ্ডিতজির কোনও আঘাত লাগেনি এবং সুস্থ শরীরেই আছেন। নিশ্চিন্ত হয়ে শুতে গেলাম। 

১৯৩৯-এর মে মাসে দেশের জাতীয় নেতৃত্ব দ্বিধাবিভক্ত হল। গান্ধীজি কংগ্রেসের নেতৃত্ব ফিরে পেলেন। রাঙাকাকাবাবু একলা নিজের পথে চলতে আরম্ভ করলেন। 

৩১

১৯৩৭ সালের কথা। 

রাঙাকাকাবাবু জেল থেকে ছাড়া পাবার কিছুদিন পরে এলগিন রোডের বাড়িতে কংগ্রেসের ও আমাদের জনজীবনের নেতৃস্থানীয় বেশ কিছু লোক একটা সভা করেন। সভায় স্থির হয় যে, সুভাষ কংগ্রেস ফাণ্ড বলে একটা তহবিল খোলা হবে, এবং যথেষ্ট টাকা সংগ্রহ হলে সেটা রাঙাকাকাবাবুর হাতে তুলে দেওয়া হবে। উদ্দেশ্য, রাঙাকাকাবাবুর নেতৃত্বে কলকাতায় একটা কংগ্রেস ভবন গড়ে তোলা। এইভাবেই মহাজাতি সদনের পরিকল্পনা শুরু। ধীরে-ধীরে টাকা তোলার কাজ এগোতে থাকে। ১৯৩৮ সালে রাঙাকাকাবাবু যখন কংগ্রেসের সভাপতি এবং পৌরসভার অলডারম্যান, তখন কলকাতা করপোরেশন এক প্রস্তাব পাশ করে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউর উপর বেশ খানিকটা জমি রাঙাকাকাবাবুর হাতে তুলে দেন। 

জমির ব্যবস্থা হয়ে যাবার পর রাঙাকাকাবাবু তাঁর মনের মতো একটা জাতীয় প্রতিষ্ঠানের পরিকল্পনার কাজে হাত দেন। তাঁর পরিকল্পনা ছিল খুবই বড় ও আধুনিক। তাঁর ইচ্ছা ছিল যে, আমাদের জাতীয় ও জনজীবনের সব দিক দিয়ে বিকাশ ও সমৃদ্ধির জন্য নানা ব্যবস্থা ঐ ভবনে থাকবে। এক কথায় মহাজাতি সদন হবে ভবিষ্যৎ জাতি গঠনের পীঠস্থান। মনে আছে, যুদ্ধের সম্ভাবনা মনে রেখে তিনি পরিকল্পনা করেছিলেন যে, বিমান আক্রমণের সময় আশ্রয় নেবার জন্য ভবনের নীচে বড় ধরনের আধুনিক ‘এয়ার রেড সেলটারও থাকবে। 

যথাসময়ে রাঙাকাকাবাবু তাঁর পরিকল্পনা রবীন্দ্রনাথের কাছে পেশ করলেন। তা ছাড়া, ভবনটির একটি নাম দিতে এবং বাড়িটির ভিত্তিস্থাপন করতে কবিকে অনুরোধ করলেন। ১৯৩৯-এর জানুয়ারির প্রথমেই রাঙাকাকাবাবু শান্তিনিকেতন যান এবং রবীন্দ্রনাথ তাঁকে আম্রকুঞ্জে সংবর্ধনা দেন। তখনও ত্রিপুরী কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচন হয়নি। তীব্র লড়াইয়ের পর এবং গান্ধীজির অমতে রাঙাকাকাবাবু সভাপতি নির্বাচিত হবার পর অনেকেই ভাবতে লাগলেন ঐ অবস্থায় রবীন্দ্রনাথ কী করবেন। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু ইতিমধ্যেই নিজের মন স্থির করে ফেলেছেন। তিনি রাঙাকাকাবাবুকেই সোজাসুজি চিঠি লিখে জানালেন যে, কলকাতার কোনো এক বড় হলে তিনি রাঙাকাকাবাবুকে সংবর্ধনা দেবেন এবং রাষ্ট্রনায়ক রূপে বরণ করবেন। যে-কোনো কারণেই হোক, কবির সেই সভা অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। কিন্তু ঐ উপলক্ষে রাঙাকাকাবাবুকে উদ্দেশ করে রবীন্দ্রনাথ যে “দেশনায়ক” অভিভাষণটি লিখেছিলেন, সেটি অমর হয়ে আছে। 

যাই হোক, শারীরিক দুর্বলতা সত্ত্বেও অগাস্ট মাসে রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় এসে তাঁরই নাম দেওয়া মহাজাতি সদনের ভিত্তিস্থাপন করতে রাজি হলেন। রাঙাকাকাবাবু তখন আর কংগ্রেসের সভাপতি নেই; তিনি তখন বিরোধী পক্ষের নেতা। তবুও রবীন্দ্রনাথ এলেন। 

আমরা বাড়ির প্রায় সকলেই দল বেঁধে বাবা ও রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে মহাজাতি সদনের ভিত্তিস্থাপনের মণ্ডপে পৌঁছলাম। মণ্ডপ ছাপিয়ে বাইরে বিরাট জনতা। রবীন্দ্রনাথ ও সুভাষচন্দ্রকে একসঙ্গে দেখবার সুযোগ কে ছাড়তে চায়? ভলান্টিয়ারদের সাহায্যে অনেক কষ্টে আমরা ভিতরে ঢুকলাম। আমার খুব ইচ্ছা ছবি তোলা। কিন্তু তুলব কি করে? মণ্ডপের ভিতরে আলো কম, ফ্লাশ না হলে তো আমার ক্যামেরায় ছবি উঠবে না। আমাদের বন্ধু আনন্দবাজারের ফোটোগ্রাফার বীরেন সিংহকে বললাম, আপনি ফ্লাস দেবার ঠিক আগে আমাকে ইশারা করবেন, আমি সেই সময় আমার ক্যামেরার শাটার খুলে দেব। বীরেনবাবুর ফ্ল্যাশে আমার ক্যামেরায় এইভাবে কয়েকটি ঐতিহাসিক ছবি উঠে গেল। 

মহাজাতি সদনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ ও রাঙাকাকাবাবুর বক্তৃতা আমাদের ছেলেমেয়েদের অবশ্যপাঠ্য হওয়া উচিত—জাতি হিসাবে আমাদের আদর্শের ধারাবাহিকতা ও লক্ষ্য বোঝবার জন্য। 

এর কিছুদিন আগে উডবার্ন পার্কের বাড়িতে একটা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বৈঠক হয়েছিল। রাঙাকাকাবাবুর ডাকে দেশের নানা দিক থেকে বেশ কয়েকজন নেতা উডবার্ন পার্কের ছোটবাড়ির ছাদে মিলিত হয়েছিলেন। উদ্দেশ্য কংগ্রেসের মধ্যে বামপন্থী একটা বিরোধী পক্ষ গড়ে তোলা। অনেকেই এসেছিলেন। যাঁকে বিশেষ করে মনে আছে তিনি হলেন মাদ্রাজের বর্ষীয়ান নেতা কংগ্রেসের ভূতপূর্ব সভাপতি শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার। বহুদিন আগে দেশবন্ধুর সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। এবার এলেন তাঁরই মন্ত্রশিষ্যকে শক্তি যোগাতে। তাঁকে দেখলেই মনে শ্রদ্ধার ভাব জাগত। এই সভা অনুষ্ঠিত হবার কিছুদিনের মধ্যেই রাঙাকাকাবাবু ফরওয়ার্ড ব্লক গঠনের কথা ঘোষণা করেন। 

১৯৩৯-এর সেপ্টেম্বরে ইউরোপে যুদ্ধ বেধে গেল। আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের গতি ও ধারা বদলে গেল। স্বাভাবিক সময়ে বাক্‌বিতণ্ডা করা, দাবিদাওয়া নিয়ে পথে-ঘাটে আন্দোলন করা, বড় বড় প্রস্তাব পাশ করে শত্রুপক্ষকে যুদ্ধে আহ্বান করা এক কথা; আর যুদ্ধের মধ্যে নিজেদের কর্তব্য ঠিক করে সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যাওয়া সম্পূর্ণ অন্য কথা। প্রায় দু’বছর ধরে রাঙাকাকাবাবু ক্রমাগতই বলছিলেন যে, বিশ্বযুদ্ধ এগিয়ে আসছে, সংগ্রামের জন্য তৈরি হতে হবে। ত্রিপুরী কংগ্রেসে তো সোজাসুজি বলে দিলেন যে, মাস ছয়েক পরে ইউরোপে যুদ্ধ বাধবে। হলও তাই। আরও বলেছিলেন যে, পরাধীন জাতির পক্ষে যুদ্ধবিগ্রহ খুব একটা অবাঞ্ছিত কিছু নয়—ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পুরো সুযোগ নিয়ে স্বাধীনতার জন্য আমাদের চূড়ান্ত সংগ্রাম শুরু করে দিতে হবে। 

সত্যি-সত্যি যুদ্ধ আরম্ভ হবার পর দেখলাম অনেকেই সুর পালটালেন। রাঙাকাকাবাবু কিন্তু একই সুরে একই কথা—সংগ্রামের কথা—বলে চললেন। ফরওয়ার্ড ব্লক গঠনের পর তিনি সারা ভারত পরিক্রমা করেছিলেন, বিপুল জনসমর্থন পেয়েছিলেন, এবং লক্ষ-লক্ষ লোককে নিজের মনের কথা শুনিয়েছিলেন। ফলে তাঁর স্থির বিশ্বাস হয়েছিল যে, ভারতবর্ষ মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে, প্রয়োজন হল যোগ্য নেতৃত্বের, যে-নেতৃত্ব স্বাধীনতার শেষ সংগ্রাম পরিচালনা করবে। 

১৯৩৯ সালের একটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার কথা আমি অনেক পরে, ১৯৬৬ সালে জানতে পারি। শুনতে পেলাম এক চীনা ভদ্রলোক, যিনি ১৯৩৯ সালে কলকাতায় চীন সরকারের কূটনৈতিক প্রতিনিধি ছিলেন, কলকাতায় এসেছেন। নাম হুয়াও চাও চিন! নামটা যেন দলিলপত্রে কোথাও দেখেছি বলে মনে হল। টেলিফোনে যোগাযোগ করে চৌরঙ্গির এক হোটেল থেকে তাঁকে নেতাজী ভবনে ধরে নিয়ে এলাম। নেতাজী ভবনে এসে তিনি খুব খুশি; বললেন, এই ঘরেই তো ১৯৩৯ সালে সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে আমার কথাবার্তা হয়েছিল। রাঙাকাকাবাবু তাঁকে গোপনে ডেকে জানতে চেয়েছিলেন, চীন সরকার তাঁকে আশ্রয় দিতে রাজি হবে কিনা। দেশে থেকে তিনি স্বাধীনতার সংগ্রাম চালাতে পারবেন না, কারণ ইংরেজ সরকার যে-কোনো অজুহাতে যতদিন যুদ্ধ চলবে ততদিন তাঁকে বন্দী করে রাখবে। চীনা ভদ্রলোকটি খোঁজখবর করে রাঙাকাকাবাবুকে জানান যে, সৌজন্যমূলক যাত্রায় কোনো বাধা নেই, তিনি চীনে স্বাগত, কিন্তু রাজনৈতিক কার্যকলাপের সুযোগ চীন সরকার তাঁকে দিতে পারবেন না, কারণ ইংরেজ সরকারের সঙ্গে তাঁদের বন্ধুত্বের চুক্তি রয়েছে। ব্যাপারটা থেকে দুটি শিক্ষা পেলাম। এক, রাঙাকাকাবাবু অনেকদিন থেকেই বিদেশে গিয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করবার কথা ভাবছিলেন। দুই, যে-কোনো সরকারের বিদেশনীতি নিজের জাতীয় স্বার্থে চালিত হয়; রাজনৈতিক আদর্শগত প্রশ্ন সেখানে বড় নয়। ব্রিটিশ সরকারও রাঙাকাকাবাবুকে সেই সময় চীন যাবার জন্য পাসপোর্ট দিতে অস্বীকার করেছিল। 

৩২

স্কুল-কলেজ ফাঁকি দিয়ে সভা-সমিতিতে যাওয়া সাধারণত বাবা-মা পছন্দ করতেন বলে মনে হয় না। তাছাড়া উডবার্ন পার্কের বাড়িতে যে শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা বিরাজ করত, ছাত্রজীবনে হুজুগে মেতে যাওয়া তার সঙ্গে ঠিক খাপ খেত না। তবে এ-সবই সাধারণ ও স্বাভাবিক অবস্থার কথা। অনেকগুলো ব্যতিক্রম তো আমার জীবনেই ঘটেছে। স্কুলজীবনেই তো আইন অমান্য আন্দোলনের সময় রাস্তায় বেরিয়েছি। বাবা তখন জেলে, মা তো সব জেনেও কিছু বলেননি বা সোজাসুজি বারণও করেননি। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়বার সময় ১৯৩৭ সালে আমরা একটা বড়রকমের আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলাম—আন্দামান থেকে আমাদের বিপ্লবী বন্দীদের দেশে ফিরিয়ে আনবার দাবিতে। বাবা তখন বাঙলার আইনসভায় বিরোধীপক্ষের নেতা। বাবারই নেতৃত্বে টাউন-হলে বিরাট প্রতিবাদ-সভা হবে। সব স্কুল-কলেজে ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছে। কলেজগুলোর মধ্যে রাজভক্তদের দুটো শক্ত ঘাঁটি ছিল সেন্ট জেভিয়ার্স ও প্রেসিডেন্সি। এই দুই কলেজের কর্তৃপক্ষ যেমন ভিন্নমতাবলম্বী ছিলেন, ছাত্রদের বড় একটা অংশও ছিল রাজভক্তদের দলে ও জাতীয় আন্দোলনে অনাগ্রহী। সুতরাং ঐ দুই কলেজে ধর্মঘট সফল করবার জন্য আমরা উঠেপড়ে লাগলাম। সেই সময় একটা বড় সুবিধা ছিল যে ছাত্রদের সংগঠন ছিল একটাই এবং ঐক্যবদ্ধ। অনেক তাত্ত্বিক বিষয়ে আমাদের মতামত ভিন্ন হলেও, যে-কোনো জাতীয় প্রশ্নে আমরা সকলে মিলে উঠেপড়ে লাগতাম। 

সেন্ট জেভিয়ার্সে ধর্মঘট সফল হল এবং আমরা মিছিল করে প্রেসিডেন্সিতে গেলাম। আমাদের হানায় প্রেসিডেন্সির দরজাও খুলে গেল। অন্য কলেজের সব ছাত্র তো ছিলই। ছাত্রদের একটা বিরাট মিছিল স্ট্র্যাণ্ড রোড ধরে ঘুরে টাউন হলে যাবার চেষ্টা করল। স্ট্র্যাণ্ড রোডে ঘোড়সওয়ার এক বড় পুলিশের দল ঘোড়া ছুটিয়ে ভীষণ ভাবে বেটন চার্জ করল। আমরা যারা সামনের দিকে ছিলাম, স্ট্র্যাণ্ড রোডের লোহার রেলিং-এ নিজেদের সেঁটে রেখে কোনোক্রমে প্রাণ বাঁচালাম। যাঁরা মাঝামাঝি ছিলেন তাঁদের খুব আঘাত লাগল, আবার অনেককে পুলিশ টেনে টেনে ভ্যানে তুলল। সন্ধ্যার পর পুলিশের চোখ এড়িয়ে টাউনহলে হাজির হলাম। বাবাকে সভায় দূর থেকে দেখলাম। বেশি রাতে হেঁটে বাড়ি ফিরে যা হয়েছিল বাবাকে বললাম। শান্তভাবে শুনে মুচকে হেসে শুতে যেতে বললেন। 

মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা তখন পর্যন্ত বাইরেকার কোনোরকম আন্দোলন থেকে দূরেই থাকত। মেডিকেলে ভর্তি হবার পর দেখলাম যে, সেখানে একটি নতুন অসুবিধার সৃষ্টি হয়েছে। সে-সময়ে বাংলার মুসলিম লীগের রাজত্ব। সরকারের প্ররোচনায় ছাত্রসম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এমনকী ছাত্র ইউনিয়নের আইনকানুনেও ভাগাভাগির নীতি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাছাড়া মিলিটারি থেকে মনোনীত কিছু অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান ছাত্র মেডিকেল কলেজে পড়তে আসত—–নাম ছিল মিলিটারি মেডিকেলস্। ফলে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদের বেশ অসুবিধার মধ্যে কাজ করতে হত। ব্যক্তিগতভাবে আমার একটা সুবিধা ছিল। বাবা ও রাঙাকাকাবাবুর সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চরিত্র এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে তাঁদের সুনাম অন্য সম্প্রদায়ের ছাত্রদের বিশ্বাস ও সমর্থন লাভ করতে আমাকে সাহায্য করেছিল। তাছাড়া সব সম্প্রদায়ের স্বার্থরক্ষার ব্যাপারে আমরাও বাবা ও রাঙাকাকাবাবুর উদার দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করতে চেষ্টা করতাম। ফলে, প্রথমে ছাত্র ইউনিয়নের জেনারেল সেক্রেটারি ও পরে সভাপতি নির্বাচনে আমি সব দিক থেকেই সমর্থন পেয়েছিলাম। 

১৯৩৬ সালে রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে কার্শিয়ঙ-এ থাকার সময় থেকে তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা প্রত্যক্ষভাবে আমাকে প্রভাবিত করতে আরম্ভ করে। সেই সময় অবশ্য অন্য অনেকের মতো সবরকমের রাজনৈতিক বই, কাগজপত্র আমি পড়তাম। ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির ও দলের কার্যকলাপও আমি বেশ মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করতাম। মনে আছে, সেই সময় কিছুদিনের জন্য মানবেন্দ্রনাথ রায়ের লেখা আমার উপর খুবই প্রভাব বিস্তার করেছিল। সবকিছু দেখেশুনে বিচার করে একটা স্বতন্ত্র রাজনৈতিক মতামত গড়ে তুলতে সময় লাগে। নানারকম লেখা পড়ে ও আলোচনা শুনে অপরিণত বয়সে আমি কখনও কখনও রাঙাকাকাবাবুর মত ও পথ সম্বন্ধে বিভ্রান্ত হয়েছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গভীর চিন্তা ও ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের পর সব দ্বিধা ও সংশয় কেটে গেছে। আজও তো দেখি অনেকেই—তাদের মধ্যে বাঙালি ছাত্র ও যুবার সংখ্যা কম নয়—রাঙাকাকাবাবুর আদর্শ পুরোপুরি হৃদয়ঙ্গম করতে পারেননি এবং তাঁর কার্যাবলীর যথেষ্ট মর্যাদা দিতে কুণ্ঠা বোধ করেন। আমি তখন সবেমাত্র ম্যাট্রিক পাস করেছি। বাড়ির একজন রাঙাকাকাবাবুকে বললেন, আমি অন্য কোনো রাজনৈতিক মতবাদের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছি বলে মনে হচ্ছে। রাঙাকাকাবাবু আমার দিকে চেয়ে মুচকে হেসে বললেন, তাতে কী হয়েছে, সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন নিজের পরিণত বয়সে দেখছি,—অন্য অনেকের ক্ষেত্রে কিন্তু সব ঠিক হয়ে যায়নি। 

১৯৩৮ সালে কংগ্রেসের সভাপতি হবার পর একদিন রাঙাকাকাবাবু আমাকে ডেকে বললেন, আমি যেন নিয়মিত মস্কো রেডিও থেকে প্রচারিত খবরাখবর শুনি। যদি কখনও আমাদের দেশের রাজনীতি সম্বন্ধে, বিশেষ করে তাঁর নিজের কার্যকলাপ সম্বন্ধে, তারা কিছু বলে তাহলে আমি যেন নোট করে রাখি। উডবার্ন পার্কে একটা ভাল রেডিও ছিল, তাতে দূরদেশের প্রোগ্রাম ভাল শোনা যেত। আমি তো রাত জেগে ক্রমাগতই শুনতে লাগলাম। বেশি রাতে বাবা যখন কাজ সেরে উপরে উঠতেন, প্রায়ই দেখতেন যে রেডিও বেজে চলেছে আর আমি হয়তো রেডিওতে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে আছি। আমাকে তুলে দিয়ে হেসে বলতেন, এই রে, সুভাষের পাল্লায় পড়েছে! অনেক শুনেও আমি রাঙাকাকাবাবুকে বিশেষ কোনো খবর দিতে পারিনি। কারণ মস্কো রেডিও প্রধানত তাদের নিজেদের খবরই প্রচার করত, আর ক্রমাগতই স্টালিনের মহিমাকীর্তন শুনতে হত। রাঙাকাকাবাবু কেন আমাকে এ-কাজটি দিয়েছিলেন আমি জানি না। তবে আমার দিক থেকে একটা বড় লাভ হল যে নানা দেশের খবরাখবরে আমার বেশ একটা উৎসাহের ভাব জাগল ও বিদেশী রেডিও শোনার অভ্যাসটা স্থায়ী হয়ে দাঁড়াল। 

কংগ্রেসের সভাপতিপদ থেকে ইস্তফা দেবার পর থেকে রাঙাকাকাবাবু ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে স্বাধীনতার প্রশ্নে কোনোরকম আপসের বিরুদ্ধে সারা দেশে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত ঠিক করলেন যে, ১৯৪০-এর মার্চ মাসে যখন বিহারের রামগড়ে কংগ্রেসের পূর্ণ অধিবেশন হবে সেই সময় পাশেই সর্বভারতীয় ভিত্তিতে তিনি আপসবিরোধী সম্মেলন ডাকবেন। বিহারের কৃষকনেতা স্বামী সহজানন্দ ঐ সম্মেলন সংগঠনের ভার নিলেন। আমার খুব ইচ্ছা হল অন্তত একদিনের জন্য রামগড়ে যাই। মেডিকেল কলেজে তখন খুব কাজ। যাই হোক, মাকে চুপিচুপি বলে রেলভাড়া নিয়ে তো রাত্রের ট্রেনে রওনা দিলাম। সকালে রামগড়ে পৌঁছে দেখলাম ভীষণ ঝড়বৃষ্টিতে সবকিছু তছনছ হয়ে গেছে। বাইরেও জল, প্রতিনিধিদের ক্যাম্পেও। রাঙাকাকাবাবুর ক্যাম্পে গিয়ে দেখি, পরিবেশ কর্দমাক্ত। তারই মধ্যে তিনি একটা চারপাইতে বসে কাগজপত্র দেখছেন। শুনলাম সবেমাত্র সব ক্যাম্প ঘুরে কে কেমন আছে দেখে, খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করে নিজের ঘরে ফিরেছেন। আমাকে দেখে গম্ভীরভাবে বললেন, কী, রাতটা থাকা হবে নাকি? আমি আমতা-আমতা করে বললাম, না, রাত্রের ট্রেনে ফিরে যাব, কলেজ চলছে তো। ‘হুঁ’ বলে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থার যা অবশিষ্ট আছে আমাকে জানালেন। আমার মনে হল, আমি রামগড়ে যে গেছি তাতে তিনি খুশি, কিন্তু কেবল একদিনের যাওয়াটা তাঁর পছন্দ হয়নি। 

পাশেই কংগ্রেসের অধিবেশন। হাতে কিছু সময় আছে দেখে কংগ্রেসের এলাকায় গেলাম। কংগ্রেসের পূর্ণ অধিবেশন যেখানে হবার কথা সেটা ছিল বিরাট গোলাকার নিচু জমি, জল জমে সেটা একটা পুকুরে পরিণত হয়েছিল। সুতরাং সেখানে সভা হতে পারেনি। খানিকটা দূরে উঁচু জায়গায় একটা বড় গাছের তলায় মঞ্চ তৈরি করে সভা চলছিল। মৌলানা আজাদ বক্তৃতা করছিলেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের দরুন কংগ্রেস তো ঠিকমতো হতেই পারল না। সংক্ষেপ করে সেই দুপুরেই সমাপ্তি ঘোষণা করা হল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে মেঘ কেটে গেল। বিকেলে যখন আপসবিরোধী সম্মেলনের পূর্ণ অধিবেশন বসবে তখন বেশ সূর্যের আলো। বেশ জমজমাট সভা হল। আমি অভ্যাসমতো বেশ কিছু ছবি তুললাম। 

আপসবিরোধী সম্মেলনের কর্মসূচী অনুযায়ী এপ্রিল মাসে জাতীয় সপ্তাহে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন শুরু হল। সারা দেশে সুভাষ-অনুগামীদের ব্যাপক ধরপাকড় চলতে লাগল। তাঁর নিজের কী হবে আমাদের তখন তাই চিন্তা। 

৩৩

১৯৪০ সালটা ছিল নানা দিক দিয়ে বেশ গোলমেলে বছর। বাবা ও রাঙাকাকাবাবুর রাজনৈতিক জীবনে এমন সব ঘটনা ঘটল যে, বসুবাড়ির সকলের উপরেই কোনো-না-কোনো ভাবে তার প্রভাব পড়ল। আগের বছরে কংগ্রেসের নেতারা ‘শৃঙ্খলা’ ভাঙবার দায়ে রাঙাকাকাবাবুকে দল থেকে প্রায় বের করে দিয়েছিলেন। তখন বাবা বাংলার বিধানসভায় বিরোধী কংগ্রেস দলের নেতা। ক্রমে ক্রমে ·বাবার সঙ্গেও কংগ্রেসের উপরতলার নেতাদের মতভেদ ও তিক্ততা বাড়তে লাগল। শেষ পর্যন্ত ১৯৪০-এর শেষের দিকে বাবাকেও কংগ্রেস হাইকম্যাণ্ড ‘শৃঙ্খলা’ ভাঙার অভিযোগে দলনেতার পদ থেকে সরিয়ে দিলেন। কিন্তু দিলে হবে কী,দলের অধিকাংশ সদস্যই বাবার নেতৃত্ব মেনে নিয়ে কংগ্রেস দল হিসাবেই কাজ চালিয়ে গেলেন। যেমন বাংলার প্রদেশ কংগ্রেসের অধিকাংশ সদস্য রাঙাকাকাবাবুর নেতৃত্বে প্রদেশ কংগ্রেস চালিয়ে যাচ্ছিলেন। যাই হোক, ভাগাভাগির ফলে বাইরে যেমন, বিধানসভাতেও তেমন দুটি কংগ্রেস দল হয়ে গেল। অন্যটির নেতা হলেন কিরণশঙ্কর রায়। 

কিরণবাবু ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে আমাদের পরিবারের বহুদিনের হৃদ্যতা। আমরা ছেলেবেলায় উডবার্ন পার্কের বাড়িতে তাঁদের অনেক দেখেছি। তিরিশের দশকের প্রথমে যখন রাঙাকাকাবাবু বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভাপতি, তখন কিরণশঙ্কর- ছিলেন সেক্রেটারি। কিরণবাবুর চেহারায় বেশ একটা আভিজাত্যের ছাপ ছিল। ওপর থেকে তাঁকে গম্ভীর প্রকৃতির মনে হলেও তিনি খুব রসিক ও হৃদয়বান লোক ছিলেন। শুনেছি তাঁর তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক বুদ্ধির জন্য অনেকে তাঁকে বোস গ্রুপের চাণক্য বলে অভিহিত করতেন। শেষের দিকে রাজনীতির ডামাডোলে অন্য দলে চলে গেলেও বাবার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত প্রীতির সম্পর্ক দেখে অনেকে অবাক হতেন। কিরণবাবুর অকালমৃত্যুর কিছুদিন আগেও রোগে শয্যাশায়ী পুরনো বন্ধুকে বাবা নানা কাজের মধ্যেও দেখতে যেতেন এবং ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বাড়ি ফিরতেন। 

বিধানসভায় বাবার দুজন ঘনিষ্ঠ সহযোগীকে উডবার্ন পার্কে প্রায়ই দেখতে পেতাম। একজন তুলসীচন্দ্র গোস্বামী, অন্যজন সন্তোষকুমার বসু। তুলসীবাবুর মতো সুপুরুষ বড় একটা দেখিনি, তবে তাঁর সম্বন্ধে যেটা বেশি মনে পড়ে, সেটা হল তাঁর শিষ্টাচার। তাঁর ব্যবহারে ও কথাবার্তায় শিক্ষা ও ভদ্রতার যে পরিচয় পাওয়া যেত, তার তুলনা নেই। হয়তো বাবার জরুরি কোনো চিঠি নিয়ে আমি তাঁর বাড়িতে গেছি, তিনি নিজে বেরিয়ে এসে দরজার গোড়ায় পরদা তুলে ধরে সবিনয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন, যতক্ষণ না আমি ঢুকছি। ভাবটা হল যে, এই যুবকটি তাঁর বাড়িতে পদার্পণ করে তাঁকে কৃতার্থ করেছে। তুলসীবাবু হয়তো আমাদের বাড়িতে এসেছেন, বাবার হয়ে আমি তাঁকে অভ্যর্থনা করতে নেমেছি এবং তাঁরই কায়দায় পরদা তুলে ধরে দাঁড়িয়ে আছি। তা কিন্তু হবে না, তিনি মুখ নিচু করে দাঁড়িয়েই আছেন, আমি এগুলে তিনি এগুবেন। তাঁর বক্তৃতার ক্ষমতার কথা তো বলাই বাহুল্য। রাজবন্দীদের মুক্তি দাবি করে তাঁর একটা বক্তৃতা বিধানসভায় শুনেছিলাম, আজও কানে বাজে। 

সন্তোষকুমার বসু আমাদের সকলের সঙ্গে খুব স্বাভাবিকভাবে অন্তরঙ্গ হয়ে গিয়েছিলেন। তিনিও খুব ভাল বক্তা ছিলেন, আর তাঁর গলার জোর ছিল খুব। ১৯৩৭-এ রাঙাকাকাবাবুর অভ্যর্থনাসভায় মাইক খারাপ হয়ে যায়। ডাক পড়ল সন্তোষবাবুর। তিনি শুধু-গলায় সকলকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলেন। বৃদ্ধ বয়সেও নেতাজী রিসার্চ ব্যুরোর কাজে যথাসাধ্য সহায়তা করে গেছেন। তাঁর কাছে লেখা রাঙাকাকাবাবুর অনেকগুলো চিঠি তিনি নেতাজী-ভবনের সংগ্রহশালায় দান করে গেছেন। 

স্কুলজীবনে আমরা আমাদের জ্যাঠাবাবু সতীশচন্দ্র বসুকে দেখতাম কম। কারণ তিনি পাটনায় ব্যারিস্টারি করতেন। তিরিশের দশকের শেষের দিকে তিনি কলকাতায় চলে আসেন এবং এখানকার হাইকোর্টে প্র্যাকটিস আরম্ভ করেন। সেই সময় থেকে আমরা তাঁকে প্রায় রোজই দেখতে পেতাম। উডবার্ন পার্কের দক্ষিণের বারান্দায় বাবার টেবিলের পাশে আর-একটি টেবিলে তিনি প্রায়ই এসে বসতেন। তন্ন-তন্ন করে খবরের কাগজ পড়া তাঁর একটা অভ্যাস ছিল, কোথায় কী হচ্ছে, সবকিছু তাঁর নখের ডগায় থাকত। বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তাঁর খুব ভাল জমত। প্রায় প্রত্যেককেই তিনি বেশ মজার-মজার নাম দিতেন আর ক্রমাগতই ছড়া কাটতেন। ছোটখাটো ফুটফুটে একটি মেয়ের নাম দিলেন ‘বাঘ’, বেশ বড়সড় একটি ছেলের নাম দিলেন ‘ইঁদুর’, ইত্যাদি। আমাদের বাড়িতে মেয়েদের ‘বুড়ি’ বা তার কাছাকাছি নাম দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। এদের বয়স দুশো, তিনশো না চারশো, এই নিয়ে ছোটদের সঙ্গে সরস ও সরব আলোচনা চালাতেন। বন্ধুবান্ধবরাও বাদ যেতেন না। যেমন, কোনো একজনের নাম ছিল অবনী, তার নাম দিলেন লর্ড অ্যালব্যানি। 

১৯২১ সালে রাঙাকাকাবাবু যখন কেমব্রিজে বসে আই. সি. এস থেকে ইস্তফা দিলেন, জ্যাঠাবাবু তখন বিলেতে ছিলেন। জ্যাঠাবাবুকে ইংরেজ কর্তারা ধরেছিলেন। রাঙাকাকাবাবুকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে মত বদলাবার চেষ্টা করতে। তিরিশের দশকের শেষে কলকাতায় ফেরবার পর রাঙাকাকাবাবুর ইচ্ছায় জ্যাঠাবাবু করপোরেশনের কাউন্সিলর হয়েছিলেন। পরে বিধানসভারও সভ্য হন। 

যুদ্ধের সময় বসুবাড়িতে পর পর কয়েকটি মৃত্যু হয়। বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে আসে। জ্যাঠাবাবু এক নিদারুণ শোক পেয়েছিলেন। তাঁর বড় ছেলে ধীরেন্দ্রনাথ—যাঁকে সকলেই গণেশ বলে জানতেন—অকালে মারা যান। 

১৯৪০ সালটি যতই এগোতে লাগল, দেশের রাজনীতিতে রাঙাকাকাবাবু ততই একঘরে হয়ে পড়তে লাগলেন। দক্ষিণপন্থী বা মধ্যপন্থীদের কথা ছেড়েই দিলাম, যাঁরা এখন নিজেদের খুব জোরগলায় বামপন্থী বলে প্রচার করে থাকেন, তাঁরাও কিন্তু সেই সঙ্কটের দিনে রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে ছিলেন না। সংগ্রাম কিন্তু চলছিল। আপোস-বিরোধী সম্মেলনের পর আমরা ধরেই নিয়েছিলাম যে, তিনি যে-কোনো সময় গ্রেপ্তার হতে পারেন। সারা ভারতে তাঁর সহকর্মীদের জেলে পুরে ইংরেজ সরকার রাঙাকাকাবাবুকে মাস তিনেক ছেড়ে রেখে দিল। ইতিমধ্যে তিনি একটা নতুন ধরনের আন্দোলনের ডাক দিলেন। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হেয় করবার জন্য তথাকথিত অন্ধকূপ হত্যার নিদর্শন হিসাবে রাইটার্স বিল্ডিং-এর দক্ষিণ- পশ্চিম কোণে হলওয়েল মনুমেন্ট ছিল। জাতির প্রতি এই অপমানের প্রতিবাদে ও মনুমেন্টটি অপসারণের দাবিতে রাঙাকাকাবাবু সত্যাগ্রহ আন্দোলন করা ঠিক করলেন। তাঁর এই আন্দোলনে হিন্দু ও মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের যুবকদের কাছ থেকে বেশ সাড়া পাওয়া গেল। রাঙাকাকাবাবু ঘোষণা করলেন যে, প্রথম দিন ৩রা জুলাই তিনি সত্যাগ্রহীদের নেতৃত্ব দেবেন। সেই দিনই দুপুরে তিনি গ্রেপ্তার হলেন। 

জুলাই থেকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত তিনি প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দী ছিলেন। সেই সময় কয়েকবার বাড়ির অন্যদের সঙ্গে আমি জেলে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি। তাঁকে খুব প্রফুল্ল দেখাত। জেল-কর্মচারীদের সঙ্গে রসিকতা করে প্রায়ই বলতেন, “কী, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য আর কত দিন?” তার পরেই বলতেন, “না, আপনারা ভয় পাবেন না। আপনারা যেখানে আছেন সেখানেই থাকবেন, আমরা যারা বন্দী আছি বেরিয়ে যাব, অন্য ধরনের বন্দী আসবে।” তখন কেই বা জানত যে, সেই সময় তিনি তাঁর জীবনের কঠিনতম সংকল্প নিতে যাচ্ছেন! 

যেমন মান্দালয় জেলে বহুদিন আগে করেছিলেন, এবারও রাঙাকাকাবাবু স্থির করলেন যে, রাজবন্দীরা জেলে দুর্গাপূজা করবেন। গত্যন্তর না দেখে সরকার রাজি হয়ে গেল। পুজোর সব যোগাড় অবশ্য বাড়ি থেকে দেওয়া হল। বিসর্জনের দিন বিকালে আমরা দল বেঁধে জেল গেট-এ উপস্থিত হলাম। লরি করে প্রতিমা জেল থেকে বের করে আনা হল। লরির পেছন-পেছন রাঙাকাকাবাবু ও অন্য বন্দীরা গেট পর্যন্ত এলেন। প্রতিমা বিসর্জনের ভার বাইরে সমবেত যুবকেরা নিলেন। অভ্যাসমতো আমি ব্যাপারটার কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম। 

গ্রেপ্তারের পর থেকেই তাঁর বিনা বিচারে বেআইনি আটকের বিরুদ্ধে তিনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এর মধ্যে তিনি আবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কেন্দ্রীয় বিধানসভায় নির্বাচিত হলেন, ঢাকা কেন্দ্র থেকে। দুর্গাপূজার পর থেকেই তিনি সরকারকে একটার পর একটা চিঠি লিখতে লাগলেন। শেষপর্যন্ত কোনো সদুত্তর না পেয়ে তাদের জানালেন যে, যদি সরকার তাঁকে মুক্তি না দেয়, তাহলে তিনি আমরণ অনশন করবেন। চিঠিগুলি ইতিহাসের পাতায় গেঁথে রাখার মতো। একটি চিঠিকে তো তিনি নিজেই তাঁর জীবনের বাণী বলে চিহ্নিত করে গেছেন। 

৩৪

কিছু তথ্য আছে যার থেকে মনে হয় যে, ১৯৪০-এর প্রথম দিকে রাঙাকাকাবাবু দেশ ত্যাগ করার উপায় ও সম্ভাবনা সম্বন্ধে খোঁজ-খবর নিচ্ছিলেন। উত্তর-পশ্চিম ভারতে সেই সময় কীতি-কিষান পার্টি বলে একটি দল ছিল। সেই দল সম্ভবত সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে একটা যোগাযোগ গড়ে তুলতে চাইছিল। তাছাড়া, ঐ অঞ্চলে রাঙাকাকাবাবুর নিজের দলের বিশ্বস্ত অনুগামীও বেশ কয়েকজন ছিলেন। এঁদের মধ্যে বেছে-বেছে কয়েকজনকে রাঙাকাকাবাবু তাঁর গোপন বিদেশ-যাত্রার আয়োজনে কাজে লাগাতে চেষ্টা করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত ফল দেখে বোঝাই যায় যে, ঐ প্রাথমিক চেষ্টা বিশেষ কার্যকরী হয়নি। সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে যে কোনো ব্যবস্থাই করা যায়নি সেটা পরের অভিজ্ঞতা থেকে পরিষ্কার হয়ে যায়। 

ব্যাপারটার আর একটা দিকও আছে। মার্চ মাসে আপস-বিরোধী সম্মেলনের পর থেকেই রাঙাকাকাবাবুর অনুগামী ও সহকর্মীদের ব্যাপক ধরপাকড় আরম্ভ হয়ে যায়। তার ওপর আবার তিনি হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণের জন্য আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। ৩ জুলাই তিনি প্রথম সত্যাগ্রহী হবেন বলে ঘোষণাও করলেন। ঐ ঘোষণার পর সরকার আর চুপ করে থাকল না, সেই দিন সকালেই তাঁকে গ্রেপ্তার করল। 

এখন কথা হল, রাঙাকাকাবাবু যখন অন্তর্হিত হওয়ার কথা ভাবছেন তখন তিনি কেন হলওয়েল মনুমেন্ট সত্যাগ্রহের ডাক দিয়ে গ্রেপ্তারের ঝুঁকি নিলেন? এর দুরকম ব্যাখ্যা হতে পারে। প্রথমত, এটা ছিল হয়তো সরকার পক্ষকে ধোঁকা দেওয়ার একটা উপায়! যাতে তারা মনে করে যে, তিনি যখন অন্য ধরনের প্রশ্ন নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছেন, তাঁর অন্য কোনো বৈপ্লবিক কর্মসূচী নেই। দ্বিতীয়ত, রাঙাকাকাবাবু হয়তো ভাবছিলেন যে, সরকার শেষ পর্যন্ত তাকে গ্রেপ্তার করবে না। এরকম চিন্তা করার যুক্তিও ছিল। যুদ্ধ আরম্ভ হবার কিছুদিনের মধ্যেই বাংলার গভর্নমেন্ট সভাসমিতি, মিছিল ইত্যাদির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। রাঙাকাকাবাবু তা অমান্য করে নানা জায়গায় সভা করেন ও যুদ্ধবিরোধী প্রচার করেন। সরকার কিন্তু এটা চুপচাপ হজম করে নেয়। তারপর মে ও জুন মাসে ঢাকায় ও নাগপুরে বড় বড় সম্মেলন করে রাঙাকাকাবাবু খোলাখুলি ভাবে দেশবাসীকে সংগ্রামের পথে আহ্বান করেন। এ-সব দেখেশুনেও সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করতে এগোয়নি। তা ছাড়া হলওয়েল মনুমেন্ট:অপসারণের আন্দোলন এমন একটা ব্যাপার, যাতে মুসলমান সম্প্রদায়ের বেশ সহানুভূতি ছিল। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ দলের কেউ কেউ তাঁর প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন ছিলেন। 

রাঙাকাকাবাবু যাই ভেবে থাকুন না, তিনি বন্দী হলেন। যুদ্ধের মধ্যে যখন সারা জগতে ভাঙাগড়া চলছে তখন জেলের মধ্যে হাত গুটিয়ে বসে থাকা তাঁর মোটেই পছন্দ ছিল না। তাঁর স্থির বিশ্বাস হয়েছিল যে, অদৃষ্টের বিধানে পৃথিবীর ঐ সংকটকালে দেশের মুক্তির জন্য তাঁকে দুঃসাহসিক কিছু করতে হবে। শত্রুপক্ষ তো একদিকে তাঁকে ভারতরক্ষা আইনে বিনা বিচারে বন্দী করল, অন্যদিকে একটি জনসভায় রাজদ্রোহাত্মক বক্তৃতা দেওয়ার জন্য ও ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ পত্রিকায় একটি আপত্তিকর প্রবন্ধ প্রকাশের জন্য দুটি মামলাও রুজু করল। 

মামলার শুনানি আলিপুর কোর্টে হত। প্রেসিডেন্সি জেল থেকে কড়া পুলিস-পাহারায় রাঙাকাকাবাবুকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হত। আমরা দল বেঁধে মামলা শুনতে যেতাম। রাঙাকাকাবাবুর পক্ষের উকিল পুলিসের রিপোর্টারদের জেরা করে বেশ নাস্তানাবুদ করতেন। আমাদের বেশ মজা লাগত। একবার বেশ জোরের সঙ্গে এবং যুক্তির ভিত্তিতে রাঙাকাকাবাবুর পক্ষ থেকে জামিনের আবেদন করা হল। ম্যাজিস্ট্রেট তো আইনমতো জামিন মঞ্জুর করলেন, কিন্তু তারপরেই বললেন, তিনি জামিন দিচ্ছেন কিন্তু সেটা কার্যকরী হবে কি না তা নিয়ে তাঁর যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারণ, অন্য এক আইনের বলে সরকার রাঙাকাকাবাবুকে বিনা বিচারে ধরে রেখেছে। এই দু-মুখো সরকারি নীতির বিরুদ্ধে রাঙাকাকাবাবু লড়াই আরম্ভ করলেন। কেন্দ্রীয় বিধানসভার নির্বাচিত সদস্য হিসেবেও তিনি মুক্তি দাবি করলেন, কিন্তু কোনো ফল হল না। বোঝা গেল, রাঙাকাকাবাবুর প্রতি গভর্নমেন্টের মনোভাব বেশ কঠোর। 

বাবার শরীর সে-সময় ভাল যাচ্ছিল না। রাঙাকাকাবাবু জেলে গেলেই অসুস্থ হতেন কিন্তু বেরিয়ে এসে কিছুদিনের মধ্যে আবার বেশ সবল হয়ে উঠতেন। ১৯৩২ থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত জেলে থাকার সময় বাবার শরীর বেশ ভেঙে যায়। কিন্তু পরে অনেক চেষ্টা করেও বাবা আগের স্বাস্থ্য ফিরে পাননি, যদিও কাজকর্ম তিনি পুরোদমে শেষ পর্যন্ত চালিয়ে গেছেন। অল্প বয়স থেকে তাঁর ডায়াবেটিস রোগ থাকায় এবং জেলে অসুখটা বেড়ে যাওয়ায় তিনি হয়তো কখনোই পুরোপুরি সেরে উঠতে পারেননি। ছুটির সময় বাবা প্রায়ই স্বাস্থ্যকর কোনো জায়গায় কিছুদিন কাটিয়ে আসতেন। অবশ্য কাজ তাঁর পেছন-পেছন দৌড়ত। পুরোপুরি অবসর তিনি কখনোই পেতেন না। ১৯৪০-এর পুজোর ছুটিতে বাবা-মা দেরাদুন যাওয়া স্থির করলেন। তার আগে বাবা মাঝে মাঝে রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে দেখা করতে যেতেন। মা’র কাছে শুনেছি, সেই সময় রাঙাকাকাবাবু বাবাকে বার বার বলতেন, যখন উত্তর ভারতে যাবেন তিনি যেন সীমান্ত প্রদেশের মিঞা আকবর শাহকে ডেকে পাঠান এবং রাশিয়ায় যেতে বলেন। আকবর শাহ ছিলেন রাঙাকাকাবাবুর বিশ্বস্ত অনুগামী, সীমান্ত প্রদেশের ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতা। এর থেকে বোঝা যায় যে, রাঙাকাকাবাবুর ইচ্ছা ছিল নিজের কোনো বিশ্বস্ত রাজনৈতিক সহকারীর মাধ্যমে বিদেশের রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে কথাবার্তা আরম্ভ করা। নরেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তী প্রেসিডেন্সি জেলে রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গী ছিলেন। রাঙাকাকাবাবুর আগেই নরেনবাবুর মুক্তি পাওয়ার একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। নরেনবাবুকে রাঙাকাকাবাবু বলেছিলেন, মুক্তির পর গোপনে বিদেশে (রাশিয়া ও ইউরোপে) চলে যাওয়ার চেষ্টা করতে। ইউরোপের কয়েকজন রাষ্ট্রনায়কের নামে তিনি চিঠি দেবেন বলেছিলেন এবং সেগুলি কীভাবে লুকিয়ে জেলের বাইরে নিয়ে যাওয়া হবে, তাও শিখিয়ে দিয়েছিলেন। এই সূত্রে নরেনবাবু আমাকে বলেছিলেন যে, তাঁর বিদেশে যাওয়ার বিষয়ে আলোচনার সময় রাঙাকাকাবাবু আমার সম্বন্ধে কিছু মন্তব্য করেছিলেন। 

ঠিক কবে রাঙাকাকাবাবু স্থির সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি নিজেই বিদেশে পাড়ি দেবেন সেটা বলা শক্ত। এই কঠিন সিদ্ধান্তের দিকে যে তিনি কয়েক মাস ধরে এগোচ্ছিলেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এটা ধরেই নেওয়া যায় যে, যেদিন তিনি মুক্তির দাবিতে আমরণ অনশনের সঙ্কল্প নিয়েছিলেন, সেদিন তিনি চূড়ান্তভাবে মনস্থির করে ফেলেছিলেন। এত বড় ঝুঁকি আমাদের দেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে কেউ নিয়েছেন বলে আমার জানা নেই। দেরাদুন থেকে ফেরার পর বাবা আবার রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে জেলে দেখা করতে আরম্ভ করলেন। একদিন তো বাবা খুবই চিন্তিত হয়ে বাড়ি ফিরলেন। সরকারপক্ষের বন্ধুভাবাপন্ন ব্যক্তিরা বার বার বলছেন, সুভাষবাবুকে এই মারাত্মক পথ থেকে নিবৃত্ত করুন। কারণ, গভর্নমেন্টের মনোভাব খুবই কঠোর এবং তারা কিছুতেই তাঁকে মুক্তি দেবে না। এদিকে বাবা জানেন যে, রাঙাকাকাবাবুর আমরণ অনশন মানে আমরণ অনশন। তাঁর দাবি স্বীকৃত না হলে কেউ তাঁকে ফেরাতে পারবে না। যাই হোক, রাঙাকাকাবাবু কালীপুজোর দিন অনশন আরম্ভ করলেন। বাড়ির সকলেরই মনের যা অবস্থা—সেটা লিখে বোঝানো শক্ত। 

দিন-সাতেক অনশন চলার পর হঠাৎ এক বিকেলে খবর এল যে, সরকার রাঙাকাকাবাবুকে বিনাশর্তে মুক্তি দিয়েছে। এ-ব্যাপারে ভারত ও বাংলার সরকারের মধ্যে যে-সব চিঠিপত্র বিনিময় হয়েছিল, সেগুলি আমি সম্প্রতি দেখেছি। সেই সময়েই কিন্তু বাবা, রাঙাকাকাবাবু ও বসুবাড়ির এক অকৃত্রিম বন্ধু ভেতরের খবর রাঙাকাকাবাবুকে জানাতেন। তিনি হলেন তখনকার অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের নৃপেন ঘোষ। নৃপেনবাবু সরকার-ঘেঁষা সংবাদ সংস্থায় কাজ করতেন, কিন্তু কোনো গোপন খবর তাঁর গোচরে এলে তিনি বাবা বা রাঙাকাকাবাবুকে গোপনে জানিয়ে যেতেন। বাংলার গভর্নর ও মন্ত্রিসভা হঠাৎ বেশ ভয় পেয়ে গেল। জেলের সুপারিনটেনডেন্ট সাহেবের রিপোর্ট বেশ খারাপ ছিল, এবং তাতে ইঙ্গিতও ছিল যে, অনশন চলার সময় জেলে বন্দীর মৃত্যু মোটেই অসম্ভব নয়। এদিকে ভারত সরকার কোনোমতেই তাঁকে মুক্তি দিতে রাজি নয়। বাংলার সরকার তাঁকে কিছুদিনের জন্য মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় ভারত সরকার ঘোরতর আপত্তি জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন। উত্তরে কলকাতা থেকে ইংরেজ গভর্নর লিখেছিলেন, কোনো চিন্তা কোরো না। আমরা সুভাষ বসুর সঙ্গে, বিড়াল যেমন ইঁদুরের সঙ্গে খেলে, তাই করছি। 

জেলের সুপারিনটেনডেন্ট রাঙাকাকাবাবুর প্রতি খুব শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তিনি বার বার রাঙাকাকাবাবুর কাছে এসে অনশন ভঙ্গ করার অনুরোধ জানাতেন। বলতেন, আপনি বুঝছেন না কেন ‘ইভন এ লাইভ ডংকি ইজ বেটার দ্যান এ ডেড লায়ন’! সুপারিনটেনডেন্টের হাতে ফলের রস খেয়েই রাঙাকাকাবাবু অনশন ভঙ্গ করেন। 

রাঙাকাকাবাবুকে ছেড়ে দিয়েছে শুনেই আমরা এলগিন রোডের বাড়িতে ছুটলাম। শুনলাম অ্যাম্বুলেন্সে করে তাঁকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। আমি গিয়ে দেখলাম নিজের ঘরে তিনি শুয়ে রয়েছেন। বেশ ফ্যাকাশে ও দুর্বল দেখাচ্ছিল তাঁকে, কিন্তু চোখ আগের মতোই উজ্জ্বল। ওঁর গোঁফ জেলে থাকতেই দেখেছিলাম, দেখলাম সেই গোঁফ আরও ঘন হয়েছে। খোঁচা খোঁচা দাড়িও গজিয়েছে। 

অভ্যাসমতো আমি দরজার সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিলাম। ইঙ্গিতে কাছে ডাকলেন। কাছে যেতেই কোনো কথা না বলে আমার হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে চুপ করে রইলেন অনেকক্ষণ। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *