প্ৰথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড

নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – ২.৮

২.৮

ঘুম ভাঙতে ঈশমের বেশ বেলা হল। খুব সকালে ঘুম ভাঙার অভ্যাস। আজ বেলা হওয়ায় সে নিজের কাছেই কেমন ছোট হয়ে গেল। খুব সকাল সকাল সে ঠাকুরবাড়ি উঠে যায়। গোয়াল থেকে গরু বের করতে হবে। মাঠে গরু দিয়ে আসতে হবে। গরুর ঘর পরিষ্কার করা, তারপর বাজারে যেতে হতে পারে। তাকে এত বেলা পর্যন্ত না দেখে ছোটকর্তা আবার এদিকে নেমে আসতে পারেন। সে ছইয়ের ভিতর থেকে উঁকি দিল। না, আসছেন না। একটু তামাক খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। ভোরের দিকে এখনও ঠাণ্ডা ভাবটা থাকে। ক’দিন থেকে কুয়াশা পড়ায় সকালের দিকে ঠাণ্ডা ভাবটা কিছুতেই যেতে চায় না।

ঘুম ভাঙার পর আর একটা চিন্তা বেশ ওকে পেয়ে বসেছে। গত রাতে সে কিছু যক্ষ রক্ষ অথবা জিন পরী কিংবা ফেরেস্তা হতে পারে—নাকি প্রথম মানব-মানবী সেই আদম-ইভ! কারা যে সারারাত জমিতে বিহার করে গেল, সে যে এখন কাকে কীভাবে এর ব্যাখ্যা দেবে বুঝতে পারছে না। সে স্বপ্ন দেখছে। না, তা’ কী করে হয়! সে তখন তামাক খাচ্ছিল, খুব কাশি পাচ্ছে বলে তামাক খাচ্ছিল এবং যতক্ষণ ওরা বিহার করেছে ততক্ষণ সে দম বন্ধ করে বসেছিল—তবে সে কী করে স্বপ্ন দেখবে! সে স্পষ্ট মনে করতে পারছে, ভোর রাতের দিকে ওরা নদীর পাড়ে হাঁটতে হাঁটতে অন্তর্ধান করেছে। ছইয়ের ভিতর মানুষ আছে বলেই তার কাছাকাছি ওরা আসেনি।

সে গ্রামে উঠে যাবার সময় দেখল শশীমাস্টার অর্জুন গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে দাঁত মাজছেন। বাড়ির ছেলেরা ওঁর পাশে দাঁড়িয়ে দাঁত মাজছে। ছুটির দিন। স্কুলে যাবার তাড়া নেই। দাঁত মটকিলা ডালে ঘসে ঘসে ফেনা তুলে ফেলেছে। সে ওদের দেখেই বলল, বুঝলেন নি, মাস্টারমশয়, এক তাজ্জব ঘটনা খেতের ভিতর।

—কি তাজ্জব ঘটনা? মুখের ভিতর বোধ হয় ডালের দুটো একটা আঁ। ঢুকে গেছিল। সেগুলি থুথু ফেলার মতো ফেলে দিতে দিতে কথাটা বললেন শশীমাস্টার।

—কি যে কমু আপনেরে! ওড়া যে কার দেবতা, আপনেগ না আমাগ ঠিক ঠাহর করতে পারলাম না।

—কী হয়েছে বল না?

—দুই ফেরেস্তা মাস্টারমশয়।

—ফেরেস্তা।

—ফেরেস্তা না হইলে মনে লয় আপনেগ দুই দেব-দেবী। রাইতের জ্যোৎস্নায় একেবারে পাগল হইয়া গ্যাছে। তরমুজ খেতে সারা রাইত ঘুইরা ফিরা বেড়াইছে।

শশীভূষণ হা হা করে হেসে উঠলেন।—খুব আজগুবি গপপো তুমি যা হোক বললে একটা।

-–কি কাণ্ড! আপনের বিশ্বাস হয় না?

—তুমি কী মিঞা বুড়ো বয়সে আফিং ধরেছ?

—কি যে কন! সে কেমন ছোট হয়ে গেল মাস্টারমশাইর কাছে। সে আর দাঁড়াল না। ভিতরে ভিতরে সে চটে গেছে—তা আপনেরা লেখাপড়া জানেন। আপনেগ কাছে এডা আফিংখোর মানুষের গল্প। তারপর সে হাঁটতে আরম্ভ করল। এ সব মানুষেরা আল্লা যে কত মহান, কী তাঁর বিচিত্র লীলা কিছু বোঝে না। সামান্য মনুষ্যজাতির কী সাধ্য তাঁরে বোঝে—সে খুবই অকিঞ্চিৎকর মানুষকে লীলারহস্য বলতে গিয়েছে। যাঁকে বললে চোখ বড় বড় করে শুনবে তিনি বড়মামি, এ-সংসারের বড়বৌ। সে দেখল বড়মামি স্নান করে তারে কাপড় মেলছেন। চুল থেকে টপটপ করে জল পড়ছে বড়মামির। কাপড় রোদে মেলে দিয়েই চুলে শুকনো গামছা পেঁচিয়ে খোঁপা বাঁধবেন। খোঁপা বাঁধার অপেক্ষাতে সে দাঁড়িয়ে থাকল।

বড়বৌ দেখল আতা বেড়ার পাশে ঈশম দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বলবে, কিছু বলার সময়ই সে চুপচাপ এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকে।—কিছু বলবে আমাকে?

—বড়মামি, কাণ্ড একখানা।

—কী কাণ্ড ঈশম?

ঈশম সব বললে, বড়বৌ বলল, তা হবে। এমন নদী আর তার বালুচর, তরমুজের খেত, আর ঈশমের মতো মানুষ যেখানে আছে—সেখানে ওনারা নামবেন না তো কারা নেমে আসবেন!

—তবে তাই কন! শশীমাস্টার মনে করেন বইয়ের ভিতরই সব লেখা থাকে।

—তা কি থাকে! কত কিছু আছে এ জগতে, যার মানে সামান্য মানুষ কী করে বুঝবে! বইয়ে সব লেখা থাকে না ঈশম। তুমি ঠিকই বলেছ।

—আমি নাকি আফিং খাই বইলা এমন দ্যাখছি। –তোমাকে ঠাট্টা করেছে।

—না মামি, এ-সকল আউল-বাউল নিয়া আমার ঠাট্টা-তামাশা খারাপ লাগে। ওনারা লীলাখেলা করেন। আমি ছইয়ের মধ্যে চুপচাপ বইসা থাকি। কাছে যাই না। কাছে গ্যালে ওনারা রুষ্ট হন! কী, হন কি-না কন!

—তা হয়। এ ছাড়া বড়বৌর আর কিছু বলার ছিল না। সাদা জ্যোৎস্নায় কুয়াশার ভিতর সে বোধ হয় অন্য এক জগতে যথার্থই চলে গেছিল গত রাতে। সেই রহসম্যয় জগতে তাকে আবার নেমে যেতে হবে। না গেলে মানুষটাকে এত কাছে আর জীবনেও পাবে না। জানালা খুলে রাখলে সাদা জ্যোৎস্নায় তার আবার কোনও না কোনওদিন তরমুজের জমিতে নেমে যাবার ইচ্ছা হবেই। সে দেখেছে গত রাতে মানুষটা তার খুব কাছের মানুষ হয়ে গেছিল। আত্মনিগ্রহে আর নিজেকে কোনও কষ্ট দেয়নি! এই আত্মনিগ্রহ থেকে রক্ষার জন্য বড়বৌ সুযোগ এবং সময়ের অপেক্ষায় থাকে। মধ্যরাতে তারা বালির চরে আদম-ইভের মতো ঘোরাফেরা করে। ঈশম ছইয়ের ভিতর তেমনি বসে থাকে। কোনও কোনও দিন ঘুমিয়ে থাকে। কখনও ডঙ্কা বাজায়। কখনও সে আর এক নূতন কিংবদন্তী সৃষ্টির জন্য তামুক খেতে খেতে এই ভিটা জমিতে বড় একটা অশ্বত্থ লাগিয়ে দেবে ভাবে এবং একদিন সে সিন্নি দেবে গাছের নিচে এমনও ভাবল। মনে হয় তার তখন, হাসানপীর অথবা অন্য আউলেরা আসবে গাছের নিচে। ওরা সবাই বলবে আল্লার নামে সিন্নি দে ঈশম। আমরা দুইটা খাই। কারণে অকারণে ঈশম ছইয়ের নিচে শুয়ে থাকলে, মধ্য যামিনীতে এমন সব আধিভৌতিক রহস্যের ভিতর ডুবে যায়।

কিন্তু একবার বড়বৌ ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে গেছে। ওরা দু’জন বালির চরে চুপচাপ বসে মধ্য যামিনীতে গল্প করছে। সেই শৈশবের গল্প। মানুষটা তার শুনছেন কি শুনছেন না সে বুঝতে পারছে না। কখনও দুটো একটা কথা সংগোপনে বলতেন। সেও খুব সহসা সহসা। বলতেন যেমন, বড়বৌ, আমাকে কি দরকার ছিল বাবার মিথ্যা তার করার?

তিনি বলতেন, দেখা হলে আমি কি বলব তাকে। সে তো আবার ফিরে আসবে।

বড়বৌ মনে মনে হাসত। মানুষটার বিশ্বাস এখনও সে কোথাও না কোথাও তার অপেক্ষায় আছে। বড়বৌ তখন কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলত—তুমি যাবে! আমি তোমাকে তাঁর কাছে নিয়ে যাব। কিন্তু কথা দিতে হবে অকারণে তুমি কবিতা আবৃত্তি করতে পারবে না। গ্যাৎচোরেৎশালা বলতে পারবে না! কথা দাও আমাকে, তুমি ভালো হয়ে যাবে। তুমি ভালো হয়ে গেলেই, আমি যে-ভাবে পারি তাঁর কাছে তোমাকে নিয়ে যাব।

তিনি আর তখন কথা বলতে পারতেন না। সারাক্ষণ বড়বৌর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তাঁর বুঝি কখনও কখনও ঘুম এসে যেত। নদীর চরে ঠাণ্ডা হাওয়ায় বড়বৌ জেগে থাকত শিয়রে। মানুষটা এ-ভাবে ঘুমাতে পারলেই ভালো হয়ে যাবেন। সে এক রাতে শিয়রে পাহারা দেবার সময় নিজেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। বালির চরে পাতলা সিল্কের ওপর ওরা দুজন পাশাপাশি শুয়ে ছিল। খুব সকালে মসজিদের আজানে ঘুম ভেঙে গেল তার। সে উঠে দেখল মানুষটার আগেই ঘুম ভেঙে গেছে। তিনি পদ্মাসন করে বসে আছেন। সকাল হয়ে যাচ্ছে তবু ভ্রূক্ষেপ নেই। বড়বৌর খোঁপা খুলে গেছে। উঠেই সে তার খোঁপা বেঁধে মানুষটাকে বলল, তাড়াতাড়ি এস। ভোর হতে বাকি নেই। বড়বৌ প্রতিবেশীদের কাছে ধরা পড়ে যাবে ভয়ে ভোর রাতের অন্ধকারে ছুটছিল। কারণ, আর একটু হলেই ঈশমের কাছে ধরা পড়ে যেত।

পথে মঞ্জুরের সঙ্গে দেখা।—ঠাইরেন, এই সাতসকালে মাঠে!

বড়বৌ বলল, আপনার দাদার কাণ্ড। ভোর রাতে বের হয়ে যাচ্ছেন। ধরে আনলাম নদীর চর থেকে।

সেই থেকে বড়বৌ আর সাহস পায় না। মানুষটা মাঝে মাঝে ঘুমাতে পারলে ভালো হয়ে যাবেন—সেই আশায় মরিয়া বড়বৌ একা একা স্বামীর হাত ধরে অন্ধকারে অথবা ম্লান জ্যোৎস্নায় নেমে যেত। কলঙ্ক রটতে কতক্ষণ। স্বামীর জন্য সে কিছুই ভ্রূক্ষেপ করত না। কিন্তু এখন আর পারে না। কারণ ভালো হওয়ার কোনও লক্ষণই নেই তাঁর। জানালা খোলা থাকলে সে তেমনি দূরের মাঠ দেখতে পায়। কোনওদিন সেই মাঠে তার প্রিয় মানুষ পাগল ঠাকুরকে দেখতে পায়। একা একা মানুষটা আত্মনিগ্রহে চলে যাচ্ছেন। যেন পিতৃসত্য পালনের নিমিত্ত এই আত্মনিগ্রহ। সে জানে, যদি এই মানুষের সঙ্গে নদীর চরে নেমে যাওয়া যেত তবে আর তিনি দূরে যেতেন না। সকাল না হতেই সে তার ঘরের মানুষ ঘরে নিয়ে ফিরতে পারত।

মানুষটার জন্য আর যা হয়, যখন তখন অবোধ মন তার ভার হয়ে যায়। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। রাতে এই মানুষ ফিরে না এলে সে জানালা থেকে কিছুতেই নড়তে চায় না। মনে হয় তার মানুষটা তখন কোন গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছেন।

.

এ-ভাবে জানালায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একদিন রাতে বড়বৌ দেখল মাঠের ও-পাশে কিছু মশাল জ্বলে উঠছে। একটা দুটো করে অনেক ক’টা মশাল। মশালগুলি নদীর পাড়ে পাড়ে অদৃশ্য হতে থাকল। ওরা ধ্বনি দিচ্ছিল, আল্লা-হু-আকবর।

তখন সকলে যে যার মতো ঘর ছেড়ে পালাচ্ছে। ঝোপে-জঙ্গলে আশ্রয় নিচ্ছে। ওরা এ-সব হিন্দুগ্রামে আগুন দেবে বলে উঠে আসতে পারে। বড়বৌ এবং ছোট ছোট শিশুরা, ধনবৌ, গ্রামের নারী এবং শিশুরা যে যার মতো ঝোপে-জঙ্গলে আশ্রয় নিত। বাসনপত্র সব কুয়োতে ফেলে দেওয়া হতো। ছাইগাদার নিচে গয়নার বাক্স। আর হিন্দু যুবকেরা এক সঙ্গে দাঁড়িয়ে গোপাটে ধ্বনি তুলত, বন্দে মাতরম্!

হাজিসাহেবের ছোট ছেলে আকালুর কাণ্ড এসব, সে-ই এখন এসব করাচ্ছে। পাশের গ্রামে উঠে আসতে সাহস পাচ্ছে না। সে দশ-বিশ ক্রোশ দূরে-দূরে কোনও কোনও হিন্দু গ্রামে আগুন দিয়ে ফিরছে। তাকে ধরা যাচ্ছে না। সে আছে বেশ তার মতো। কারণ, ওরা দলে ভারি। শহর থেকে মানুষ আসে। কেউ বলছে ওরা ঢাকা শহরের মানুষ না, ওরা এসেছে কলকাতা থেকে। কেউ কেউ বলছে আকালুর এতে হাত নেই। আরও বড় গোছের নেতা এসব করাচ্ছে।

কী যে হয়ে গেল দেশটাতে!

ঈশম নদীর চরে বসে তামাক খায় আর আবোল তাবোল বকে। মিঞারা খুব যে খোয়াব দ্যাখতাছ! অগ খেদাইবা কোন দ্যাশে। নিজের দ্যাশ ছাইড়া কবে কেডা কোনখানে যায়

তখন সে শুনতে পায় নিশীথে কারা সব চিৎকার করছে নদীর ও-পাড়ে। আল্লা-হু-আকবর ধ্বনি দিচ্ছে। নারায়ে তকদির ধ্বনি উঠছে। এ-পাশের হিন্দু গ্রামে ধ্বনি উঠছে—বন্দে মাতরম্। ভারত মাতা কী জয়! ওপাশে ধ্বনি উঠছে—পাকিস্তান জিন্দাবাদ। তখন ঈশম মাঝখানে বসে হা হা করে হাসে। কার দ্যাশ, কে বা দিবে, কে বা নিবে!

এ দুটো সাল বড় দুঃসময়ের ভিতর কাটছে। যে যার মতো সুপারির শলা শানাচ্ছে। যেন দুঃসময়ের শেষ নেই। আগে পলটু ওর ছোটকাকার সঙ্গে শুত, কিন্তু এখন শোয় সে তার মার সঙ্গে। রাতে মা আজকাল একা শুতে ঘরে ভয় পান। বাবা থাকেন না রাতে। ওর এক ভয়! যখন মুসলমান গ্রামগুলিতে ক্রমে ধ্বনি উঠতে থাকে—নদীর পাড়ে পাড়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে সেই ধ্বনি বড় ভয়াবহ। বুকের রক্ত শুকিয়ে যায়। সবাই কেমন ঘোলা-ঘোলা চোখ মুখ নিয়ে পরস্পরের দিকে তাকায়। দূর দেশের নানা রকম দাঙ্গার খবর আসে। নৃশংস সব ঘটনা ঘটছে কোথাও। কিভাবে যে এটা হচ্ছে কেউ বুঝতে পারছে না। কেবল সামসুদ্দিন জানে—ডাইরেক্‌ট অ্যাকশানের ডাক দেওয়া হয়েছে। সুরাবর্দি সাহেব পরের হুঁকোতে তামাক খাচ্ছে। নদীর জলে মরা গরু-বাছুর ভেসে যায়। গরু-বাছুর না মানুষ কেউ ইচ্ছা করে আর দেখতে যায় না।

ঘোর দুঃসময়ে বড়বৌ যত ভাবে এটা দীর্ঘস্থায়ী নয়, সব ঘোর কেটে যাবে, আবার সব ঠিক হয়ে যাবে, তরমুজ খেতে সাদা জ্যোৎস্না উঠবে—তবু নিশীথে তার প্রাণে ভয়। সে এখন একা আর ঘুম যেতে পারে না। কারণ, আজকাল কী যে হয়েছে তার! সেই যে আছে না এক ষণ্ড, অতিকায় ষণ্ড, নদীর পাড়ে, তরমুজ খেতে, ভিটা জমির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, এক চোখ যে যণ্ডের, কালো রঙ, গলকম্বল তার ধরণীতে লুটায়—চার পা যেন কাঠের আর এত শক্ত এবং এমন বলশালী যে মনে হয় এত দিনের এক সঙ্গে বসবাস মুহূর্তে বিদীর্ণ করে দেবে। সেই যণ্ডের দিকে ভয়ে আর তাকান যাচ্ছে না। সেই দিনের মতো ষণ্ড আবার ক্ষেপে গেছে। সেই যে একদিন আন্নু, মরি-মরি করে প্রাণ বাঁচানো দায়, শিংয়ের গুঁতো মারলে পেট এফোঁড়-ওফোঁড়—কে আর তখন কাকে রক্ষা করে! প্রাণভয়ে আন্নু সে যাত্রা গরম ফ্যান ফেলে দিয়ে আত্মরক্ষা করেছিল।

রক্ষা পেল আন্নু, আর চোখ গেল যণ্ডের। গরম ফ্যান মুখে ঢেলে দিতেই একটা দিক সাফ হয়ে গেল। দগদগে ঘা। ঘায়ের জ্বালায় কী বড় বড় ডাঁসের (প্রকাণ্ড মাছি) জ্বালায় ছুটত বোঝা যেত না। অনবরত মাঠে নিশিদিন লেজ তুলে ছুটছে। বড়-বড় ডাঁস কামড়ে খোদল করে ফেলেছে ঘা। ঘায়ের জ্বালায় ষণ্ড মরে। রাতদুপুরে দিনদুপুরে যণ্ড দৌড়োয় ঘায়ের জ্বালায়, সেই যে বলে না—জ্বালা মরে না জলে, জ্বালা সহে না প্রাণে, জ্বালায় মাসধিককাল মাঠে-মাঠে একবার পুবে আবার পশ্চিমে ছুটছে ষণ্ড। আন্নু যে যণ্ডের মুখ পুড়িয়ে দিয়েছিল, কখনও সে কাউকে ভুলেও বলেনি। কারণ যণ্ড, ধর্মের যণ্ড, হাজিসাহেবের পেয়ারের ধন। ছোট পোলার মোতাবেক মানুষ। সে গোপন রেখেছে। না রেখে তার উপায় ছিল না। সে এই যণ্ডের মুখ না পোড়ালে প্রাণে বাঁচত না, ফেলু মরত, বাছুরটা হাওয়া হয়ে যেত। সে এমন এক বেতমিজ কামকাজ করেই দেখল ষাঁড়টা সুড়-সুড় করে পোষ-মানা জীবের মতো মাঠের দিকে নেমে যাচ্ছে। তারপরই যন্ত্রণায় এবং জ্বালায় মাঠের উপর দিয়ে সেই যে লেজ তুলে ছুটতে থাকল, ছোটার আর বিরাম নেই। তবু ষণ্ড আগে দু’চোখে দেখতে পেত। এখন এই দুঃসময়ে ষণ্ড এক চোখে গিয়ে ঠেকেছে, শালা এক চোখে আর কত দেখতে পাবে! ফলে তার ভয় ফেলুকে, ফেলুর বিবিকে। কেবল ফুঁসে-ফুঁসে মরছে যণ্ড। কী করে যে বাগে পাবে ফেলুকে আর তার সেই আদরের বাগি গরুটাকে। পেলেই লম্বা শিঙে পেটে শূল বসাবে।

ঠিক এই যণ্ডের মতো এক অতিকায় ভয় এই দুঃসময়। বড়বৌ এবং তার পরিবার অর্থাৎ এই হিন্দু-পল্লীতে অতিকায় একচক্ষু দানব ক্রমে বড় হচ্ছে। ক্রমে নিশীথে ঘোরাফেরা করছে তারা। হাত-পা তার নিকষ কালো। এবং ঘন-ঘন উষ্ণ নিঃশ্বাসে যেন সব নিঃশেষ করে দেবে এবার। সে নিশীথে শুয়ে থাকলে টের পায় হাজার হাজার মশালের আলোতেও কেউ সেই দানবকে পুড়িয়ে মারতে পারছে না। একচক্ষু দানবের ভয়ে গোটা দেশ রসাতলে যাচ্ছে।

আল্লা-হু-আকবর ধ্বনি শোনার সঙ্গে সঙ্গে শশীমাস্টার শচী আর যুবা পুরুষেরা উঠে পড়ে বিছানা থেকে। কখনও কখনও ওরা সারা রাত ঘুম যায় না। গ্রাম পাহারা দেয়। আবার কোনও রাতে ওরা অন্ধকারে দরজা খুলতে পর্যন্ত সাহস পায় না। আলো জ্বালে না কেউ। ভয়ে গুটি-গুটি বের হয়ে ডাকে, আপনারা কেউ কিছু শুনতে পাচ্ছেন না! একটা গুম-গুম আওয়াজ উঠছে। মনে হয় না হাজার-হাজার মানুষ অন্ধকরে চুপি-চুপি আপনাদের পুড়িয়ে মারার জন্য ছুটে আসছে। সবাই আর ঘুম যেতে পারে না তখন। জেগে বসে থাকে—কখন আক্রমণ ঘটবে এই আশঙ্কায়।

কী যে হল এই দেশে! মুড়াপাড়ার সেই গণ্ডগোলের পর থেকেই এমন হল! সেদিন যে কী তারিখ ছিল, মনে করতে পারছে না বড়বৌ। সব এখন ভুল হয়ে যাচ্ছে। সকালে উঠেই বড়বৌ পুকুরপাড়ে দেখেছে কারা যায়। সার বেঁধে যায়। লুঙ্গি পরে, মাথায় কালো রঙের ফেজ এবং হাতে সবুজ রঙের নিশান। ওরা ধ্বনি দিতে-দিতে যাচ্ছিল, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। ওদের ভিতর কোনও চেনা মুখ চোখে পড়েনি। কেবল সে ফেলুকে দেখেছে। ফেলু ভাঙা হাত নিয়ে যাচ্ছে। একটা দড়ি ডান হাতে। কোমরে কোরবানির চাকু গোঁজা! আর ওর সাধের বাগি গরুটাকে সে তাড়াতাড়ি হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে—সে মাঝে-মাঝে লেজ মুচড়ে দিচ্ছে। নয়তো যেন একসঙ্গে যাওয়া যাবে না। মিছিলের সঙ্গে তাড়াতাড়ি যেতে না পারলে নামাজ পড়া হবে না।

তার ক’দিন আগে ঢোল বাজছিল নিশিদিন। শচী এসে বাড়িতে খবর দিয়েছেন—হাটে-ঘাটে একটা লোক ঢোল পিটিয়ে যাচ্ছে। লোকটা ঢোল বাজাতে-বাজাতে বলছিল, তার নাম মহম্মদ, ধর্মের নাম পবিত্র ইসলাম। ধর্মকর্ম সব তুইলা নিজেরা কাফের বইনা যাচ্ছেন! এমন বলছিলেন। বলছিলেন, যান দ্যাখেন গিয়া। কালী বাড়ি পার হয়ে, মসজিদে তিনি যে আছেন, থাকেন, কতকাল আছেন টের পান না, খান দান ঘুমান আর কাফের তার কালীবাড়ির পাশে নামাজ পড়তে দিব না কয়। নামাজ না পড়লে গোনাগার হইতে হয়। তারপর সে ড ড ড করে ঢোল বাজাতে-বাজাতে বলে, দীন এলাহি ভরসা। এই সব বলে কী যে বলতে হয় সঠিক সে জানে না, তাকে লিখে দিয়ে গেছে লীগের পাণ্ডা আলি সাহেব। তিনি ভাল ভাল ভাষায় লিখে দিয়ে গেছেন। ঢুলি মুখস্থ করে ব্যাকরণের ধর্ম মানছে না। নিজের মতো করে বলে যাচ্ছে, আর ঢোল বাজাচ্ছে। বলছে, সেই এক গাঁ জমিদারবাবুদের। ফ্রুট বাজে দশমীর দিনে। বাবুদের বাড়ি-বাড়ি হাতি বাঁধা। কিবা বাহার দ্যাখ রে হাতির। হাতি যায় যুদ্ধে। তারপরই সে ফের ঢোলের কাঠি পাল্টাল। বলল, মানুষ যায় যুদ্ধে। ধর্মযুদ্ধে। হাজার-হাজার মানুষ শীতলক্ষ্যার চরে দাঁড়িয়ে ধর্মযুদ্ধের জিগির দিচ্ছিল সেদিন।

হাতিটা এখন আর পীলখানার মাঠে বাঁধা নেই। যুদ্ধের সময় হাতিটাকে সেই যে নিয়ে গিয়েছিল কর্মিটোলা ক্যান্টমেন্টে আর ফিরিয়ে আনতে পারেনি। হাতি যুদ্ধে গিয়ে পাগল হয়ে গেছিল এবং হাতির প্রাণনাশ হতেই জসীম একা-একা ফিরে এসেছিল। সেই জসীম নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে ওদের কাণ্ড-কারখানা দেখে একা-একা বকবক করেছে।

জসীম সকাল থেকেই গাছটার নিচে বসে বসে দেখছে। সেই সকাল থেকে পায়ে হেঁটে, নৌকায় করে হাজার-হাজার মানুষ জড় হচ্ছে চরে। ওরা সেই ভাঙা মতো শ্যাওলাধরা, ভগ্নস্তূপের পাশে হাঁটু মুড়ে নামাজ পড়বে। মিনার অথবা গম্বুজের কোনও চিহ্ন নেই। ভাঙা-ইঁটের সারি-সারি কঙ্কাল। আর অজস্র ঝোপঝাড়। বাজারের দোকানপাট বন্ধ। দু’জন সিপাই কালীবাড়ি ঢোকার রাস্তায় বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে আছে। দলটা লুটপাট আরম্ভ করতে পারে। নামাজ পড়া শেষ হলেই ওরা মশাল জ্বালিয়ে বাজারের সব হিন্দু দোকানগুলিতে আগুন দিতে পারে, বাবুদের বাড়ি-বাড়ি মশাল নিয়ে আক্রমণ করতে পারে। বাড়ির ছাদে-ছাদে তখন সব মানুষ। লোহার সব দরজা বন্ধ। একটা পাখি পর্যন্ত উড়ছে না ভয়ে। কেমন নদী মাঠ চর চারপাশটা থমথম করছে। সে ভূপেন্দ্রনাথকে গতকাল স্টিমারে নারায়ণগঞ্জে যেতে দেখেছে। আজ সকালে স্টিমারে তিনি ফিরে এসেছেন। সঙ্গে এসেছে পুলিশ সাহেব নিজে। এবং এক কুড়ি হবে বন্দুকধারী সিপাই। রূপগঞ্জের দারোগাবাবু বাবুদের কাছারি-বাড়িতে দু’দিন থেকে পাহারা দিচ্ছেন। বাবুদের বৌরা-মেয়েরা শহরে চলে গেছে। ওঁরা পাঠিয়ে দিয়েছেন সবাইকে। যারা জোয়ান, যারা বন্দুক চালাতে জানে এবং লাঠিখেলায় ওস্তাদ সেইসব মানুষ আছে কেবল। ওরা এখন গ্রামটাকে পাহারা দিচ্ছে।

কালীবাড়ি, আর সেই ভাঙা ইট-কাঠের জঙ্গলের চারপাশটায় একশ চুয়াল্লিশ ধারা জারি করা হয়েছে। কোন্ মানুষের সাধ্য সেদিকে এগুবে। এপারে বন্দুক হাতে সিপাই। শীতলক্ষ্যার চরে হাজার-হাজার মানুষ। মাঝখানে সড়ক। ওরা সড়ক অতিক্রম করে নামাজ পড়ার জন্য উঠে আসতে পারে। ভয়ে সিপাইরা বন্দুক উঁচিয়ে রেখেছে। একটা গরু দেখতে পাচ্ছে চরে। কোরবানীর জন্য গরুটাকে বোধ হয় কেউ নিয়ে এসেছে।

ভূপেন্দ্রনাথ এক মুহূর্ত নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না। এত বড় একটা ধর্মযুদ্ধের মোকাবিলা প্রায় বলতে গেলে তাঁকেই সবটা করতে হয়েছে। সাধারণ মনুষ্য তোমরা। তোমাদের ধর্মের নামে ক্ষেপিয়ে দিয়ে পিছনে মাতব্বর মানুষেরা তামাশা দেখছে। আমাদের রক্ত সনাতন। মা করুণাময়ী মায়ের আশ্রয়ে আমরা। আমাদের আবার ভয় কি! তবু এত সব যে আয়োজন সবই মার অশেষ কৃপায়। তাঁর ইচ্ছা না হলে সাধ্য কি সে এত বড় একটা উন্মত্ত জনতার বিরুদ্ধে লড়ে। তিনি বড়বাবুর জন্য একটা দূরবীন কিনেছিলেন। বড়াবাবুর ঘোড়ার মাঠে যাবার অভ্যাস ছিল। তাঁর সেই দূরবীনটা এখন বড় কাজে লাগছে। তিনি এবং বাবুদের যুবক ছেলেরা ছাদে দাঁড়িয়ে আছেন। নিচে বন্দুক হাতে সুন্দর আলি। উপরে ওরা ওদের গুপ্ত স্থান বেছে জায়গা নিয়ে নিয়েছে। ভূপেন্দ্রনাথ গুপ্তপথে সব বাবুদের বাড়ি হেঁটে-হেঁটে আক্রমণের মোকাবিলা করার সব রকমের ফন্দি-ফিকির করে এইমাত্র ছাদে উঠে চরের দিকে তাকাতেই দেখলেন, হাজার হাজার মানুষ চরে গিজগিজ করছে। ও-পাশে তারকবাবুর বৈঠকখানার নিচে সবুজ যে মাঠ, মাঠের পাশে সিপাইরা দাঁড়িয়ে আছে ঠিক পুতুলের মতো। তিনি চরে ফের দূরবীনে দেখতেই তাজ্জব বনে গেলেন। ফেলু এসেছে এই চরে। আর তার হাতের কাছে ওর সেই বাগি গরুটা। গরুটাকে সে এত দূরে টেনে নিয়ে এসেছে। এই গরুর জন্য ফেলুর প্রাণপাত। সে এই গরুটাকে শেষে কোরবানী দিতে নিয়ে এসেছে। তার বড় প্রিয় এই জীব। জীবের জন্য সারাটা শীতকাল এবং হেমন্ত অথবা বর্ষায় কী না কষ্টে ঘাস সংগ্রহ করে আনত!

দূরবীনে চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে গরুটার। নীল চোখ। অবলা জীব এমন মানুষের ভিড়ে পাগল হয়ে গেছে। সেই হাতিটার মতো। ক’জন সিপাই এসেছিল কর্মিটোলা ক্যান্টমেন্ট থেকে। হাতিটাকে যুদ্ধে নিয়ে যাওয়া হবে। যেমন এ অঞ্চলে যত নৌকা ছিল যুদ্ধের জন্য সব ইজারা নিচ্ছে সরকার। হাতিটাকেও ওরা ইজারা নিয়ে নিল। হাতি কেন এসব মানবে। হাতিটাকে কিছুতেই বাগে আনতে পারছিল না। জসীমের উপর ভার তাকে ঘাঁটিতে দিয়ে আসার। জসীমের স্ত্রী বেঁচে ছিল না। মাতৃহীন এক শিশুকে সে বড় করেছে। আর বড় করেছিল যেন এই হাতিকে। সে সারাক্ষণ হাতির সুখদুঃখে নিমজ্জিত। নিজের বলতে সে কিছু জানত না। সে হাতি নিয়ে আর পুত্র ওসমানকে নিয়ে হেমন্তের মাঠে আকাশের নিচে হেঁটে হেঁটে কত দূরদেশে চলে যেত। সেই হাতি ঘাঁটিতে যেতে না যেতেই কেমন পাগলের মতো করতে থাকল। জসীম কিছুতেই ছেড়ে আসতে পারছিল না হতিটাকে। জসীমকে কিছুতেই পিঠ থেকে নামতে দিচ্ছিল না। নেমে গেলে, ফের শুঁড়ে ওকে তুলে পিঠে বসিয়ে দিয়েছে হাতি।

এই গরু নিয়ে এমনি কতদিন দেখছেন ভূপেন্দ্রনাথ, ফেলু ঝোপঝাড়ের ভিতর বসে থাকত। সে চুরি করে কতদিন অন্যের ফসল খাওয়াত। মেরে ওর হাড় ভেঙে দিতে পারে প্রতাপ চন্দের মেজ ছেলে অথবা গৌর সরকারের চাকরটা, সে সব তুচ্ছ করে জীবনপাতে বাগি বাছুরটাকে বড় করে তুলে এখন তাকেই নিয়ে এসেছে কোরবানী দেবে বলে।

ভূপেন্দ্রনাথ চোখ থেকে দূরবীনটা নামিয়ে ছাদের আলসেতে ভর দিলেন। চরের মানুষেরা সহসা সহসা ধ্বনি দিচ্ছে। পাল্টা ধ্বনি দিচ্ছে দীঘির পাড়ে যারা দাঁড়িয়েছিল। তারা সব গ্রামের মানুষ, সবাই এসে দীঘির পাড়ে জড়ো হয়েছে। ছাদের রেলিঙের পাশে পাশে গরম জল ফুটছে, ভাঙা ইঁট জমা করছে এবং বল্লম সড়কি নিয়ে পাহারা। মেয়ে-বৌদের ঠেলে সব মণ্ডপের দালানে, ভিতর বাড়িতে রান্নাবাড়ির পাশে আটকে রাখা হয়েছে। এমনকি ওদের ছাদে পর্যন্ত উঠতে দেওয়া হচ্ছে না। গ্রামের মেয়ে-বৌরা পর্যন্ত আলাদা আলাদা ফ্রন্ট করে দাঙ্গার মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।

এতক্ষণ পর কেমন ভূপেন্দ্রাথ সব দেখে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। ওরা নামাজ পড়তে না পারলে অন্যদিকে হল্লা করবে। লুঠপাট করবে। সুতরাং সবদিক থেকেই যাতে মোকাবেলা করা যায়, করতে না পারলে নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটবে। ঠিক যেমন কোরবানীর পশু দু’চোখ উল্টে থাকে তেমনি সনাতন ধর্ম চোখ উল্টে থাকবে—যা সব আয়োজন, চোখ উল্টে থাকার আর ভয় নেই। যেদিক থেকেই আক্রমণ আসুক তাকে প্রতিহত করার সব সুবন্দোবস্ত আছে ভেবে তিনি রুমালে নিশ্চিন্তে মুখ মুছলেন। আর মনে হল তখনই নদীর চরে একটা অবলা জীব হাম্বা হাম্বা করে ডাকছে। ভূপেন্দ্রনাথের শরীরের ভিতর সব রক্ত এক সঙ্গে টগবগ করে ফুটতে থাকল।

এই নামাজে ফেলু পর্যন্ত এসেছে দশ ক্রোশ পথ হেঁটে। সূর্য এখন নদীর ওপারে অস্ত যাবে। ওরা কী তবে রাতে রাতে উঠে আসবে গ্রামে। দুশ্চিন্তায় ফের ভূপেন্দ্রনাথের মুখটা বেজার হয়ে গেল। বাবুরা সব এখন চণ্ডীমণ্ডপে বসে আছেন। মাঝে মাঝে সব খবর পাঠাতে হচ্ছে। বড়বাবু একবার ছাদে উঠে দূরবীনে সব দেখে গেছেন। এবং কীভাবে ভূপেন্দ্রনাথ এই আক্রমণের মোকাবেলা করছেন দেখে তিনি খুব খুশি হয়েছেন তার ওপর।

দূরবীনে নদীর চর বড় দেখাচ্ছে। নদীর জল শান্ত। কাশবনে কোন ফুল ফুটে নেই। জল খুব নিচে নেমে গেছে। নদীতে একটা নৌকা নেই। যারা নৌকায় এসেছে, তারা নৌকা চরে টেনে তুলে রেখেছে। কালো রঙের সব নৌকা, আর মাথা গিজগিজ করছে। মাথার উপর নিশান উড়ছে এবং হাতের সব সড়কি আসমানের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলছে তারা, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। তখন শঙ্কায় ভূপেন্দ্রনাথের বুকটা কাঁপছে।

ভূপেন্দ্রনাথ দূরবীনেই দেখলেন ফেলু এক হাত সম্বল করেই চলে এসেছে। আর সম্বল তার এক চোখ।

আর ঠিক সেই প্রকাণ্ড যণ্ডের মতো এক চোখ নিয়ে দুই পাড়ে দুই জনতা মোকাবেলায় প্রস্তুত জসীম গাছের নিচে দুই চোখ খুলে রেখেছে। আর দুই চোখ আছে বলেই বিমর্ষ হয়ে যাচ্ছে। যেমন সে বিমর্ষ ছিল, হাতিটাকে ছেড়ে আসার দিন। সে বার বার হাতিটার পিঠ থেকে নেমে এলে হাতিটা তাকে পিঠে বসিয়ে দিতে থাকল। প্ল্যাটুন কমাণ্ডার বললেন, জসীম তুমি এবার নেমেই ছুটে চলে যাবে। হাতির পায়ে শেকল, শেকল বাঁধা বলে হাতি ছুটতে পারবে না।

সে নেমে যেতে পারছিল না। শুঁড় দিয়ে ওকে পিঠে তুলে নিচ্ছিল ফের। সে কত অবলা জীব, জসীম কাছে না থাকলে সে বাঁচবে না এমন আকুল চোখ হাতির। হাতির কষ্ট কমাণ্ডার সাব কি জানবেন! সে এই হাতির জন্য নিজের বিবির কথা ভুলে গেছিল। সে যেদিন তার সন্তানের হাত ধরে বিবিকে মাঠে কবর দিয়ে ফিরছিল, কী তখন অন্ধকার চোখে! কার কাছে রেখে যাবে এই ওসমানকে। ওসমান এখন থেকে কার কাছে থাকবে! ওসমানকে নিয়ে বাবুদের বাড়িতে এসে হাতির পিঠে চড়ে বসল, তার আর বিবির দুঃখ থাকল না। উন্মুক্ত আকাশের নিচে হাতি, সে এবং তার পুত্র ওসমান। ঘাস কাটতে নদীর চরে নেমে গেলে ওসমান থাকত হতিটার কাছে। সে বলত, লক্ষ্মী, তর কাছে থাকল ওসমান। আমি ঘাস কাটতে যাইতাছি।

তখন যত খেলা হাতির এই ওসমানের সঙ্গে। ওসমান হাতিকে ছোট ছোট ডাল এগিয়ে দিত, সে হাতির পায়ে শেকলে প্যাঁচ লেগে গেলে খুলে দিত। অঙ্কুশ চালিয়ে যেখানে ঘাড়ে সামান্য ঘা, সেখানে বড় বড় মাছি উড়ে এসে বসলে খুব কষ্ট হাতির। ওসমান হাতির পিঠে বসে মাছি তাড়াত। বাপ যে মালিশ এনে দিত, সে সারাক্ষণ ঘায়ে মালিশ মেখে দিত। কোনও কোনওদিন সে এইভাবে ঘুমিয়ে পড়ত শানে। অথবা হাতির পেটে পিঠ রেখে শুয়ে থাকত। হাতি অবলা জীব, লক্ষ্মী এবং পয়মন্ত বলে জসীম এসে দেখতে পেত ওসমান হাতির পেটে পিঠ দিয়ে দুপুরে আমগাছের ছায়ায় ঘুম যাচ্ছে। সে তাড়াতাড়ি ছেলেকে ডেকে তুলত। হাতি এবং ওসমান উভয়কে সে নদীর জলে স্নান করিয়ে এনে খেতে দিত দু’জনকে। ওসমানের জন্য চিড়া-গুড়, আর হাতির জন্য কলাগাছ। বিবি মরে গেলে এই হাতিই ছিল প্রায় বিবির মতো। সে সময়ে-অসময়ে ডাকত, লক্ষ্মী। অ লক্ষ্মী তরে দিমু ধান্যদূর্বা, তুই বাঙলাদেশের নদী পার হইয়া আর কোনখানে যাইবি! তুই থাইকা যা আমার লগে। হাতি বুঝি জসীমের বুকের ভিতর যে একটা কোড়াপাখি ডাকছে, শুনতে পেত। শহরে গঞ্জে কত দূরদেশে গিয়েও হাতি কখনও পথ ভুল করত না। একবার জসীমের কি জ্বর! বাবুরা গিয়েছিল বাঘ শিকারে। শিকার শেষে ওরা জয়দেবপুর থেকে ট্রেনে আর জসীম মৃত বাঘ নিয়ে একা। হাতির পিঠে বাঘ, জসীম। জসীমের এমন প্রবল জ্বর যে সে খর রোদে চোখ মেলতে পারছে না। ক্ষণে ক্ষণে জলতেষ্টা পাচ্ছে। বেহুঁশ জসীম। হাতি যেন সব বুঝতে পেরে নদী থেকে জল তুলে দিয়েছিল শুঁড়ে। পয়মন্ত হাতি নদীর পারে জসীমকে নামিয়ে শুঁড়ে জল তুলে এনে মাথায় ঢালল। জসীম চোখ মেলে তাকিয়েছিল। কোথায় যে যাচ্ছে লক্ষ্মী সে টের পাচ্ছে না। সে পিঠের উপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে। অথচ লক্ষ্মীর যেন জানা, সে দ্রুত পা চালিয়ে সোজা পথ চিনে চলে এসেছিল। পথ সে এতটুকু ভুল করেনি।

সেই লক্ষ্মীকে ওরা মেরে ফেলল। জসীম চলে যাচ্ছে আর আসছে না, বুঝি টের পেয়ে গিয়েছিল হাতি। তাকে কিছুতেই পিঠ থেকে নামতে দিচ্ছিল না। সে সোজা নিচে নেমে এসে শুঁড়ে হাত বুলাতে থাকল। আবার সে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেই নিতে আসবে এমন বলল। পাগলামি করলে চলবে কেন। বাবুরা যারা আছে এখানে সবাই ভালোবাসবে তাকে। কেউ কোন কষ্ট দেবে না। এত সব বলেও জসীম পার পেল না। সে একটু দূরে গেলেই হাতি প্রথম শুঁড় তুলে কি দেখল। তারপর জসীম ক্রমে দূরে চলে যেতে থাকল। হাতি শুঁড় তুলে চিৎকার করতে থাকল। যখন আর জসীমকে দেখা গেল না, হাতি শেকল ছিঁড়ে ছুটতে থাকল। সামনে যে প্ল্যাটুন কমাণ্ডার—সে রোকে রোকে বলে এগিয়ে গিয়েছিল। আর দ্যাখে কে, একেবারে হাতির পায়ের তলায়। তখন সোরগোল চারপাশে। সামনে যেসব তাঁবু পড়ছে সব ভেঙে দিচ্ছে। জসীমের কাছে যাবার জন্য সে সব বাধা লোপাট করে এগুচ্ছে। জসীম দূর থেকে দেখল হাতিটা ছুটে আসছে। আর সোরগোল। হাতি পাগল হয়ে গেছে। পর পর তিনজন মানুষকে পায়ের তলায় পিষ্ট করেছে। সুতরাং দুম্ দুম্। হাতির সামনে কাপ্তান দাঁড়িয়ে গুলি ছুঁড়েছিল। জসীমও তখন চিৎকার করতে করতে ছুটে আসছিল-হা আল্লা! সে দেখল তার লক্ষ্মী গুলি খেয়েও পড়ে যায়নি। টলতে টলতে জসীমের পায়ের কাছে এসে হাঁটু মুড়ে শুয়ে পড়ল। কপাল থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়ছে। মুখটা চেনা যাচ্ছে না লক্ষ্মীর। সমস্ত মাথা লাল হয়ে গেছে। মরতে মরতেও লক্ষ্মী, কি যে ভালোবাসা তার, মাঠের মতো অথবা আকাশে পাখি ওড়ার মতো ভালোবাসা। লক্ষ্মী অতিকষ্টে শুঁড়টা বাড়িয়ে দিল। যেন এই শুঁড় বেয়ে জসীম তার পিঠে উঠে বসে। এবং তাকে নিয়ে সেই নদীর পাড়ে সে চলে যায়।

জসীম লক্ষ্মীর মাথার কাছে সেদিন চুপচাপ বসেছিল। কত মানুষ চারপাশে ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল। বড় বড় সাহেবসুবা এল, তাকে নানারকম প্রশ্ন করল, সে কোনও জবাব দিতে পারছিল না। ডিভিশনের তাবৎ মানুষ এসে ওকে দেখে গেছে—এক হাতি আর তার মাহুত, সারাজীবনের সঙ্গী। কবর খোঁড়ার সময় সে শুধু উঠে কবরে নেমে গিয়ে লক্ষ্মীর ঠাঁই হবে কি-না, এই মাটির নিচে না অন্য কোথাও সে তাকে নিয়ে যাবে, কোথায় আর যাবে, পারলে সে তাবৎ এই মনুষ্য কুলের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, বলে আমি তরে নিয়া যামু নদীর পারে। এখানে তরে কবর দিমু না। কিন্তু সে জানে তার ক্ষমতা সামান্য, সে কি আর করতে পারে! সারাদিন সে হাতির মাথার কাছে বসেছিল। মাটি খোঁড়ার শব্দ উঠছে। বুকে এসে শব্দটা ভীষণ তার ধাক্কা মারছে। এই ঝোপের ভিতর বসে জসীম এখন আর এক ধাক্কার ভিতর পড়ে গেল। সে যাবে কার দলে! সে চরে নেমে যাবে, না বাবুদের রক্ষার্থে তাদের বাড়ি উঠে যাবে! পিলখানার ও-পাশের রাস্তায় সে সেই শক্ত মানুষটিকে দেখতে পেল। তিনি যাচ্ছেন মা আনন্দময়ীর বাড়ি। মুণ্ডমালা গলায় মা হাত তুলে আজ অসুরনাশিনী। জসীম বলতে চাইল–ক্যাডা অসুর মা জননী! তখন সে দেখল কোমর থেকে কোরবানের চাকুটা ফেলু শাঁ করে বের করে ধরেছে রোদে। রোদ ইস্পাতের ওপর সহসা এক ঝিলিক খেয়ে গেল। ফেলু কোরবানের চাকুতে সূর্যের আলোকে ধরে নানা বর্ণের প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করতে চাইছে। কী ভয়াবহ! চাকুটা দেখেই বাগি গরুটা লাফ মারছে। গরুটা লাফ মারছে, কী মরণ নাচন নাচছে বোঝা যাচ্ছে না। চারপাশে মানুষের বড্ড ভিড়। সে এখন ইস্পাতের ওপর সূর্যের আলো ধরে রাখতে চাইছে।

ফেলু দেখল, তখনই আকালুদ্দিন ছিক করে পানের পিক ফেলছে। চালে-ডালে এখন খিচুড়ি রান্না হচ্ছে। বড় বড় তামার ডেগে ডাল-চাল সেদ্ধ। যে যার মতো গলা পর্যন্ত খেয়ে নিচ্ছে! নামাজ পড়ার আগে অভুক্ত থাকতে নেই। আকালুদ্দিন কোথা থেকে একটা পান পর্যন্ত সংগ্রহ করে এনেছে। ফেলু বলল, হালার কাওয়া! পান খাইয়া ঠোঁট লাল করছে হালার কাওয়া। সে এবার লক্ষ রাখল ভিড়ের ভিতর আকালুদ্দিন কোনদিকে যায়। যেন আকালুদ্দিন না এলে এই ধর্মযুদ্ধে সে আসত না। সে সব সময় আকালুর উপর কড়া নজর রেখেছে। ধর্মগত প্রাণ তার, নতুবা সে আসত না। পবিত্র ইসলামের জন্য কিছু করা চাই। সে প্রায়ই খোয়াব দেখেছে, এক নির্জন মাঠে, ভাঙা ইট-কাঠের সামনে দাঁড়িয়ে সে নামাজ পড়ছে। ভাঙা ইট-কাঠ এবং গম্বুজ কাবা মসজিদের শামিল। মসজিদের পাশে হিন্দুদের দেব-দেবীরা পাথর হয়ে আছে। ভাঙা হাত-পা নিয়ে ওরা পড়ে আছে। এমনিতেই ঘুম আসে না। কখন আন্নু রাতে চুরি করে মাঠে নেমে যায় এই এক ভয় তার, আর যখনই ঘুম আসে তখন শুধু একটা দৃশ্য চোখে ভাসে—সে একটা জঙ্গলের সামনে সবুজ ঘাসের ওপর বসে নামাজ পড়ছে। বাবুরা ভাঙা মসজিদের চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে রেখেছে। সাতটা মসজিদের খরচ চালায় বাবুরা। তবু তোমরা মিঞা মানুষেরা মা আনন্দময়ীর পাশের এই বনজঙ্গলে নামাজ পড়তে পাবে না।

এ-ভাবেই জিদ বেড়ে গেছে ফেলুর। সে চলে এসেছে। আসার সময় সারাটা পথ সে নজর রেখেছে আকালুর ওপর। হালার কাওয়া—সে আবার সবাইকে ধর্ম যুদ্ধে পাঠিয়ে নিজে একা গাঁয়ে থেকে যেতে পারে। আন্নুর সাথে বড় তার পীরিত, পীরিতের ভয়ে সে সারাটা পথ, এমনকি এখনও সব সময় আকালুকে চোখের উপর রেখেছে। চোখের উপর থেকে আকালু হারিয়ে গেলেই সর্ষে ফুল দেখছে সে। কিন্তু এখন মুখ দেখে মনেই হয় না আকালুকে, সে আন্নুর কথা ভাবছে। ফেলু ভীষণ উত্তেজিত, যেমন সবাই উত্তেজনা নিয়ে এই চরে ঘোরাফেরা করছে এবং নির্দেশের অপেক্ষায় আছে—কখন ওরা সব ভেঙে তছনছ করে দেবে।

অথচ এই চরে ফেলুর কোরবানের চাকুটা রোদে ঝলসে উঠলে সে দেখতে পেয়েছিল—পিলখানার মাঠ পার হয়ে একদল পুলিশ সঙ্গিন উঁচিয়ে আছে। ওর কেন জানি প্রাণের জন্য মায়া হতে লাগল। তবু রক্তে উত্তেজনা। আল্লা সব দেখতে পাচ্ছেন। মাথার ওপর এত বড় ফকির মানুষটা যখন রয়েছেন, তখন আর ডর কিসের! সব বন্দুকের নল থেকে ধোঁয়া বের হবে, কোনওদিন আর গুলি বের হবে না। কারবালা প্রান্তরে হাসান-হোসেনের যুদ্ধ, অথবা এজিদ, কারা যে কী করে! ধর্ম সার জেনে সে তার মন শক্ত করে রাখল এবং এক হাতে বাগি গরুটাকে টেনে রাখল। হালার কাওয়া! গরুটা ভয়ে লেজ তুলে ছুটতে চাইছে। অবালা জীব, সে এ সবের কোনও মানে বুঝতে পারছে না। ফেলু এবার প্রাণের দায়ে হা হা করে হাসছিল।

তখন দু’পক্ষ থেকেই ধ্বনি উঠছে। এক পক্ষ এই যে দেবী আমাদের সনাতন ধর্মের প্রতীক, গলায় মুণ্ডমালা মা জননীর, হাতে খাঁড়া, চোখে বিদ্যুৎ খেলছে—সৃষ্টি, স্থিতি প্রলয়ের দেবী মন্দিরে আছে, থাকেন, কার সাধ্য তাঁরে অপবিত্র করে! তাঁর পাশে এক দল মানুষ নামাজ পড়ে কোরবানী দিয়ে যাবে সে হয় না। রক্তের ভিতর হিন্দু মানুষের হাজার লক্ষ অসুর। ওরা নাচছে টগবগ করে। রক্ত ফুটছে। ওরা চরে একটা গাই গরুর হাম্বা ডাক শুনে স্থির থাকতে পারছে না। হাত তুলে বর্শা নিক্ষেপ করে চিৎকার করে উঠল, বন্দে মাতরম্! মা আনন্দময়ী কী জয়! ভারতমাতা কী জয়!

এভাবে জয়ধ্বনি চরের দু’পাশে। চরে আর পিলখানার মাঠে। দুই দল যুদ্ধের মহড়া দিচ্ছে কালীবাড়ির চারপাশটায় যুবকেরা দাঁড়িয়ে সৈনিকের মতো পাহারা দিচ্ছে। পাশের বনটায় শুধু একশো চুয়াল্লিশ ধারা আর যা আছে নিজেরা রক্ষা করো—কিংবা সবটাই আছে, সীমানা কেউ জানে না। কতদূর পর্যন্ত এর বিস্তার। যেমন কেউ জানে না বস্তুত এই ঝোপে জঙ্গলে আদতে এটা কী, মসজিদ, মন্দির না কোনও বোম্বেটেদের দুর্গ, কী হাজার রূপসী এখানে নেচে গেয়ে গেছে। কেউ সঠিক জানে না অথচ যে যার মতো একে মসজিদ মন্দির বানিয়ে নিচ্ছে। ভিতরে কেউ যেতে পারে না। রাজ্যের শেয়াল খাটাশ এখানে বসবাস করে। রাত্রিবেলা আরতির ঘণ্টা বাজলে গণ্ডায় গণ্ডায় শিয়ালের হুক্‌কা হুয়া। নিশীথে শিবা ভোগ হলে অন্ধকারে একশোটা নীল চোখ জীবের, বনের ভিতর উঁকি দিয়ে থাকে। সুতরাং এই সব মাংসাশী প্রাণী এখন ঝোপের ভিতর থেকে এত মানুষ দেখে বড় তাজ্জব বনে গেছে।

শেয়াল খাটাশের বাস। দিনের বেলা ঢুকতে ভয়। কত সব বিষাক্ত সাপখোপের বসবাস। সূর্যের আলো পর্যন্ত বনের ভিতর ঢুকতে পায় না। এমন সব নিবিড় জঙ্গল। কী যে ছিল এটা! গম্বুজ দেখে মুসলমানেরা ভেবেছে এটা মসজিদ, খিলান দেখে বাবুরা ভেবেছে এটা মন্দির এবং ঐতিহাসিকদের মতে আখড়া, কারণ তার মিনারে নানরকম হলুদ নীল কাচের সন্ধান পেয়েছিল, স্থাপত্যশিল্পে পর্তুগীজদের কাছাকাছি—সুতরাং জলদস্যুদের আখড়া না হয়ে যায় না। এই হাস্যকর অবস্থায় মানুষেরা এখানে এসে ভয়ঙ্কর এক দ্বন্দ্বে পড়ে গেছে। মানুষের জন্য মানুষ, না কোরবানীর জন্য মানুষ বোঝা যাচ্ছে না। কারণ ভাবলে বিশ্বাসই করা যায় না, এই এক হাস্যকর ব্যাপারে এ-দেশে, গৃহযুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে। পারে না হয়তো, কোনওদিনই পারে কিনা তাও ভাবা যায় না—যদি না এর ভিতর আলিসাহেবের হাস্য জেগে উঠত। এই দেখে হিন্দু-মুসলমানে বিদ্বেষ জাগিয়ে দাও। অর্থনৈতিক সংগ্রামের কথা এখন বলা যাবে না। শ্রেণীসংগ্রামের কথা বলা যেত, কিন্তু কিছু উপর তলার মানুষ রয়ে গেছি আমরা, আমাদের তবে কী হবে! তার চেয়ে ভলো ধর্ম জাগরণ! ধর্মের নামে ঢোল বাজিয়ে আখের গুছিয়ে নাও।

সুতরাং ধর্মের নামে ঢোল বাজিয়ে আপাতত আখের গোছানো হচ্ছে। জসীম বসে আছে মাঝখানে। পিলখানার মাঠে। সে হাতির স্নানের সময় হলেই পিলখানার কাটা গাছের গুঁড়িতে এসে বসে থাকে। তার এটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। সে যে রয়েছে পথ থেকে টের পাওয়া যায় না। কেউ তাকে দেখতে পাচ্ছে না। অথচ সে সব দেখতে পাচ্ছে। সে আছে মাঝখানে। সে বসে দুদিকে দু-দল মানুষের লম্ফঝম্ফ দেখছে।

আর দেখছে ঈশম। সে দেখছে সকাল থেকেই হাটুরে মানুষের মতো লোক যাচ্ছে সেই ভাঙা মসজিদে নামাজ পড়বে বলে। সে যায়নি। সে তরমুজ খেতে বসেই নামাজ পড়ছে। নামাজ পড়ছে না চুপচাপ বসে আছে হাঁটু মুড়ে বোঝা দায়। দু’হাত সমান প্রসারিত। পায়ের ওপর ভর দিয়ে বসে থাকা শান্ত মূর্তি এবং লম্বা সাদা দাড়ি, সবুজ রঙের তফন, বিস্তীর্ণ বালুবেলা, সোনালি বালির নদী আর এক পাগল মানুষ কেবল নদীর পাড়ে পাড়ে হেঁটে হেঁটে যান—কোথায় যে যান, কী যে চান মানুষটা! অথচ তিনি না হেঁটে গেলে কেমন খালি খালি লাগে এই মাঠ এবং নদী। এদেশে তিনি এমন হয়ে গেছেন—তিনি না হেঁটে গেলে যেন সূর্য উঠবে না, পাখি ডাকবে না এবং গাছে গাছে ফল ধরবে না, ফুল ফুটবে না। এই পাগল মানুষ আছেন, নিশিদিন তিনি মাঠে মাঠে বনে বনে অথবা বালুবেলাতে পায়ের ছাপ রেখে যান; যেন নিত্য বেড়ে ওঠা ঘাস ফুল পাখির মতো তিনিও এই জন্মভূমির খণ্ড অংশ হয়ে গেছেন। তাঁর এই ক্রমান্বয় হাঁটা, কবিতা আবৃত্তি, বড় বড় চোখে তাকানো, সরল শিশুর মতো ঈশ্বরের পৃথিবীতে বেঁচে থাকো তোমরা, এমন মুখ ঈশমকে কখনও কখনও বড় স্তব্ধ করে রাখে। সে বলল, কর্তা, বাড়ি যান, আসমানের অবস্থা ভাল না।

অথচ দ্যাখো, আকাশ কী নির্মল। অথচ ঈশম এমন কথা কেন যে বলল! ঈশম কী টের পেয়ে গেছে এখানে এবার দাঙ্গা বেধে যেতে পারে! এই নিষ্পাপ মানুষটাকে কেউ হত্যা করতে পারে! সে তার এমন নির্মল আকাশের নিচে বসে পাগল মানুষকে সতর্ক করে দিচ্ছে কেন! আসমানের অবস্থা ভালো না বলছে কেন! ওর ভিতর কী একটা ভয়ঙ্কর আদিম অন্ধ বিবেক বুঝতে পারছে অদৃশ্য এক আকাশের নিচে ভয়ঙ্কর কালো একটা ষণ্ড দিনরাত ফুঁসছে। সুযোগ পেলেই পাগল মানুষটাকে ফালা ফালা করে দেবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *