প্ৰথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড

নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – ২.১৩

২.১৩

তখন সোনা উঠোনের চারপাশটায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল। মানুষজন আসছে তো আসছেই। সে কোথাও যেতে পারছে না। তাকে সকলের সঙ্গে ধরে রাখতে হবে। ধরাধরি করে অর্জুন গাছটার নিচে নিয়ে যাবার সময় সেও সবার সঙ্গে একপাশে ঠাকুরদার মৃতদেহ ধারণ করবে। মনজুর কাঠ কাটার তদারক করছে। হাজিসাহেবের বড় বেটা এসেছে। মেজ আসেনি। সে গেছে আকালুর খোঁজে। আকালুর ঘরে বিবি আছে। তিন বাচ্চাকাচ্চা। এ-সব ফেলে সে ফেলুর বিবিটাকে নিয়ে যে কোথায় গায়েব হয়ে গেল! হাজি-সাহেবেরও মন ভালো না। তবু একবার দেখে চলে গেছেন। দীনবন্ধু কাঠ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে পুকুরপাড়ে।

ঠাকুরদার মুখ ঢাকা। ঠাকুমা পায়ের কাছে বসে রয়েছে সেই থেকে। একেবারেই নড়ছে না। জেঠিমার সংসারে যত কাজের চাপ। সকালের দিকে শ্মশানের ঝিল কে কাটবে এই নিয়ে বচসা হয়ে গেছে নরেন দাস এবং আড়াই হাজারের রায়মশাইর সঙ্গে। ঝিল কেটে পুণ্য সঞ্চয় করবে নরেন দাস। কাল থেকেই ছোটকাকার পিছনে পিছনে ঘুরছে। তাকে যেন ঝিলটা কাটতে দেওয়া হয়। নরেন দাসের চোখেমুখে আর কোনও অপমানের চিহ্ন ভেসে নেই। মালতী নিরুদ্দেশে চলে গেছে—গিয়ে তাকে বাঁচিয়েছে। সে আবার নতুনভাবে ফসল ফলাচ্ছে, ঘরের চালে শণ দিয়েছে এবং রাতে তাকে আর জেগে থাকতে হয় না। যা কিছু পাপ অবশিষ্ট আছে ঝিল কাটতে পারলেই শেষ হয়ে যাবে।

সোনা সকাল থেকেই ভীষণ আফসোসে কষ্ট পাচ্ছে। সে ভেবেছিল বসে বসে ঠাকুরদার মৃত্যু দেখবে। কিন্তু তার যা ঘুম, ঠাকুরদাকে বাইরে বের করে আনলে সে দেখল তিনি আবার আগের মতো ভালো হয়ে যাচ্ছেন। ভালো হয়ে যাচ্ছেন বলেই ওর ঘুম পেয়ে গেল। বাবা, মেজ জ্যাঠামশাই পায়ের কাছে ভুলুণ্ঠিত হলেই তিনি কেমন সহসা ভালো হয়ে যাচ্ছিলেন। ভালো হয়ে যাবেন বুঝি, তবে আর বসে থেকে কী হবে! বড় জ্যাঠামশাইও বসে নেই। তিনি আগেই উঠে চলে গিয়েছিলেন, মেজ জ্যাঠামশাইকে ঠাকুরদা শ্রাদ্ধের ভার দিলে তিনি উঠে পুবের ঘরে চলে গেলেন। এবং শুয়ে পড়েছিলেন। সোনাও পাগল জ্যাঠামশাইর শরীরে ঠ্যাঙ তুলে দিয়ে আশ্চর্য গভীর ঘুমে ডুবে গেল। কিন্তু খুব সকালে বড় জ্যেঠিমা ডাকলেন, এই, ওঠ সোনা, তোর জাঠামশাইকে তুলে আন, তোর ঠাকুরদা আর বেঁচে নেই। শুনে ধড়মড় করে সে উঠে বসেছিল। নেমে এসেছিল উঠানে। সবাই কাঁদছে। লণ্ঠনের আলো জ্বলছে চারপাশে। সকাল হয়ে যাচ্ছে। তবু লণ্ঠনগুলি নেভানো হচ্ছে না। ঠাকুরদার মুখ ঢাকা। পাখিরা তেমনি কলরব করছে চারপাশে, কামরাঙা গাছে ফল নেই, তবু ক’টা টিয়াপাখি উড়ে এসে বসেছে। এমন এক আশ্চর্য সকালে যেখানে আবার হাত ধরে নাতিদের নিয়ে সূর্যোদয় দেখার কথা, তিনি কিনা সে সব না করে সোনাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলেন। ওর ভারি ইচ্ছা হচ্ছিল চাদরটা তুলে বুড়ো মানুষটার মুখ দেখে—কী বাসনা আর তাঁর ছিল, কোনও গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে বড় মাঠের ফসল কাটার গান শোনার ইচ্ছা যদি থাকে তবে যেন সে বলবে, এবার আপনি সোজাসুজি সব দেখতে পাবেন ঠাকুরদা। আমাদের মতো উঁকি দিয়ে আর কিছু দেখতে হবে না। বলেই সে চাদরটা তুলে মুখ দেখল। চোখ খোলা। তুলসীপাতা চোখে। ঠাকুরদার প্রাণপাখি তবে চোখ দিয়ে বের হয়েছে। কোথায় আছে সে। কোনও গাছের ডালে বসে মজা দেখছে না তো—বা, বেশ তুমি শুয়ে আছ চিৎপাত হয়ে, আমি গাছের ডালে বসে আছি। পাখি হয়ে বসে আছি। মাঝে মাঝে কোউর্ কোউর্ ডাকছি। সে ভাবল পাখিটা হয়তো নীলবর্ণের পাখি হবে। মহীরাবণের পাতাল-প্রবেশের মতো ঘটনা যদি হয়, সে তো পাখি না হয়ে একটা মাছি হয়ে যেতে পারে। ঠাকুরদার সাদা চাদরে একটাই মাছি এখন উড়ে উড়ে বসছে। সে মাছিটাকে খপ্ করে ধরে ফেলতে চাইল। প্রায় সেই ফেলুর মতো সবই খপ্ করে ধরে ফেলা। কিন্তু মাছির নাগাল পেল না। মাছিটা উড়ে উড়ে কামরাঙা গাছের ও-পাশে অদৃশ্য হয়ে গেল। তারপর ডালে অদ্ভুত একটা পাখি, নীলবর্ণের পাখি। নীলবর্ণ মানেই পবিত্র কিছু। ওর মনে হল তখন গাছের ডালে যে পাখিটা বসে আছে, ওটাই ঠাকুরদার আত্মা। ওটাই ওঁর কামনা-বাসনার ঘর।

পাগল মানুষ দেখলে বলতেন, ওটাই হচ্ছে নীলকণ্ঠ পাখি। সারাজীবন মানুষকে ঘুরিয়ে মারে। কোথাও সে আছে, তুমি ঠিক বুঝতে পারছ না, সে তোমার জন্য গাছের ডালে বাসা বানাচ্ছে, তুমি ভাবছ ঠিকঠাক ঘুরে মরছ, তোমার কেবল ইচ্ছা আশ্বিনের ভোরে জয়ঢাক বাজুক, তুমি সারাজীবন বরণডালা হাতে নিয়ে ঘোরাঘুরি করবে, মনে হবে সামনের মাঠ পার হলেই নদী, নদীর পাড়ে গ্রাম। সব মরীচিকার মতো তোমাকে জন্ম থেকে জীবনের সব ক’টা দিন ঘুরিয়ে মারবে সে।

সোনা তখন দেখল পাগল জ্যাঠামশাইও চাদর তুলে বাপের মরামুখ দেখছেন। তারপর প্রাণটা এখন কোন গাছের ডালে পাখি হয়ে বসে আছে চারপাশে খুঁজছেন।

তখন সবাই ধ্বনি দিল, বল হরি, হরি বোল।

পীতাম্বর মাঝি পায়ের কাছে বসে কাঁদছে।—আপনে জীবন সাঙ্গ কইরা চললেন ঠাকুর। আপনে জীবনে একটা বাদে মিছা কথা কইলেন না।

সবাই বিছানার চারপাশে দাঁড়িয়ে ঠাকুরদাকে তুলে ধরছে। কেমন দুলছে শরীরটা। সব আত্মীয়স্বজন যে যেটুকু পারছে ছুঁয়ে রাখছে। সোনা শিয়রের দিকে আছে। ওরা কাঠবাদাম গাছটা পার হয়ে তেঁতুলতলায় এল। তারপর বড় জাম গাছ, এবং বাঁ দিকে গেলে দুটো খেজুর গাছ পড়বে। দক্ষিণের পাড়ে সেই অর্জুন গাছ। সেখানে ঝিল কাটা শেষ। ওরা গাছটার নিচে ঠাকুরদাকে রেখে চারপাশে ঘিরে বসে থাকল। আশ্চর্য, সোনা দেখছে সেই নীল রঙের পাখিটা আবার এসে অর্জুন গাছটায় বসেছে। সেই ঘরটা নীল, যেখানে অমলা তাকে নিয়ে গিয়েছিল, মায়ের মুখ ব্যথায় নীল, ছোট্ট বোনটা তার তখন জন্ম নিচ্ছে। মার মুখ আর অপবিত্র মনে হয় না। এই পাখিটাও নীল। সে দেখল আকাশ নীল, স্বচ্ছ জল নীল রঙের। এ-পাখি ঠাকুরদার আত্মা না হয়ে যায় না। সে চারপাশে লক্ষ রাখছে পাখিটা কী ভাবে থাকছে। ওর মনে হল ঠাকুরদার চিতা যতক্ষণ না জ্বলবে ততক্ষণ পাখিটা অর্জুনের ডালে বসে থাকবে।

ওর ইচ্ছা হচ্ছিল লালটু পলটুকে সব ঘটনাটা খুলে বলে। দাদা ঐ যে দেখছিস পাখিটা, ওটা ঠাকুরদার আত্মা। চিতা জ্বলে উঠলেই পাখিটা আকাশে উড়ে যাবে।

এত বেশি লোকজন যে সে উঠতে পারছে না। গোপাটের ও-পাশে হাজার লোক কী তারও বেশি হবে। আর পাগল মানুষ মণীন্দ্রনাথ অর্জুন গাছটার কাণ্ডে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন! বাপের মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে আছেন। মুখটা শুকনো, দাঁত নেই। একটা শুকনো কঙ্কালের ওপর চোখ দুটোতে তুলসীপাতা, দুটো মাছি চোখের পিচুটি শুষে খাচ্ছে। সোনা হাত দিয়ে মাছি দুটোকে তাড়িয়ে দিল। এই মৃত চোখ কি বিমর্ষ! মরে গিয়েও ঠাকুরদা দুঃখী মানুষের মতো মুখ করে রেখেছেন। এত যে আয়োজন, এত যে হরিসংকীর্তন এবং ঘি, তেল, বিল্বপত্র, চন্দনের কাঠ—সবই এই মানুষকে দাহ করা হবে বলে! শৈশবে এই মানুষ সোনার মতো নদীর চরে নামতে গিয়ে ভয় পেয়েছেন, যৌবনে এই মানুষ সত্যবাদী যুধিষ্ঠির ছিলেন—বামুনের চক নিলামে উঠেছে। নিলাম ডাকছে পীতাম্বর মাঝি, শুধু সামান্য কথা ঘুরিয়ে বললে এত দামী জমি নিলামে ওঠে না। হস্তান্তর হয় না। তবু অবিচল অটল। অথচ সামান্য এক প্রেম, পলিন নামে এক ইংরেজ যুবতী পুত্রবধূ হয়ে থাকবে—সংসার বড় কঠিন। মিথ্যা তাঁর ধর্ম, মানুষটাকে অযথা মিথ্যায় জড়িয়ে দিল। তাঁর এমন সোনার টুকরো ছেলে পাগল হয়ে গেল। পীতাম্বর মাঝি এ-সব মনে করে হাউ হাউ করে কাঁদছে। সে-ই মিথ্যা দলিল করেছিল, এই মানুষের বিরুদ্ধে।

ঠিক যজ্ঞের হবির মতো এর দেহ এখন। ঠাকুরদাকে একেবারে উলঙ্গ করে দেওয়া হয়েছে। সোনা কেমন ভয়ে তাকাতে পারছে না। হাত-পা কাঠি কাঠি, শক্ত। জ্যেঠিমা ওর হাতে সামান্য তেল দিলেন। সবাই এখন ঠাকুরদার শরীরে তেল মাখিয়ে দিচ্ছে। সবাই ঘড়া করে জল তুলে এনে ঠাকুরদাকে স্নান করিয়ে দিচ্ছে। তাকেও জল আনতে হবে, তেল মাখিয়ে দিয়ে ঠাকুরদাকে স্নান করাতে হবে। অথচ কেন যে সে ভয় পাচ্ছে অথবা মনে হচ্ছে, যেন মানুষটাকে সে আর চেনে না। এ মানুষ তার ঠাকুরদা নয়। সেও কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।

জ্যেঠিমা বললেন, সোনা তেল মেখে দাও। শেষ কাজ। দাঁড়িয়ে থেকো না।

সোনা তবু দাঁড়িয়ে থাকল।

তখন সেই নীলবর্ণের পাখিটা উড়ে উড়ে এসে শিয়রে বসছে। বোধ হয় এটা একটা চড়াই পাখি। চড়াই পাখি নীলবর্ণের হয় না। তবু আকার দেখে তাই মনে হয়। পাগল জ্যাঠামশাই পাখিটাকে দেখছেন। এ-ভাবে যদি কোনওদিন সোনা মরে যায়, সোনার আত্মা পাখি হয়ে যাবে। ওর ভাবতে ভালো লাগছে, পাখিটা ডালে ডালে অথবা এই ঘাসে এবং মাটিতে সারা কাল বেঁচে থাকবে। মানুষের আত্মা বিনষ্ট হয় না। আত্মাটা আবার কারো নিঃশ্বাসের সঙ্গে ভিতরে ঢুকে যাবে। তখন জন্ম হবে আর একটা মানুষের। এভাবে ঠাকুরদা তাদের ভিতর ফের ফিরেও আসতে পারেন। সে তো চিনতে পারবে না—ঠাকুরদা যে ফিরে এসেছেন। সে কীভাবে যে তখন তার ঠাকুরদার সঙ্গে কথা বলবে!

এই মৃত্যু সম্পর্কে সোনা নানাভাবে ভেবে দেখছে—তবু সব ভাবনাগুলির ভিতর ঠাকুরদা যদি আকাশের নক্ষত্র হয়ে থাকে তবে যেন সেই ভালো। সে মনে মনে এখন এমনই চাইছে। সে মনে মনে বলল, পাখি, তুমি আর উড়বে না। এবারে ঠাকুরদার ভিতর অদৃশ্য হয়ে যাও। ঠাকুরদা পৃথিবীতে আর ফিরে আসবেন না। তিনি আকাশের নক্ষত্র হয়ে থাকবেন।

—যা সোনা, দাঁড়িয়ে থাকলি কেন। শশীভূষণ সোনাকে তাড়া লাগালেন। কপালে তেলটা মেখে দে।

সোনা কপালে তেল মেখে দিল। ওর হাতটা যেন শিরশির করে কাঁপছে। অদ্ভুত অনুভূতি। ঠাকুরদার শরীরে প্রাণ নেই। ভাবা যায় না। এ-ভাবে মানুষ মরে যায়! কেমন রুক্ষ এবং কঠিন চামড়া ঠাকুরদার। সে তাড়াতাড়ি এক ঘড়া জল এনে ঢেলে দিল শরীরে। হাতের আঙুল যেন এখনও শিরশির করে কাঁপছে। একজন মরা মানুষকে ছুঁয়ে দিয়ে সে কেমন অপবিত্র হয়ে গেছে। স্নান না করা পর্যন্ত তার শান্তি নেই। অথচ একটা কষ্টও প্রাণে। ঝিল কাটা হয়ে গেছে। দীনবন্ধু এবং মাস্টারমশাই কাঠ সাজিয়ে রাখছে। নানাবর্ণের ছবি এখন। ফুলের পাশে আতপ চাউল, তিল তুলসীপাতা। ঠাকুরদার শরীরে রাশি রাশি ঘি মাখানো হচ্ছে। থেকে থেকে মেজ-জ্যাঠামশাই, বাবা বাবা বলে হতাশ গলায় কেঁদে উঠছেন। কেবল নিষ্ঠুর চোখ-মুখ নিয়ে তাকিয়ে আছেন পাগল জ্যাঠামশাই। তাঁকে জোর করে ধরে আনা হল। তাঁকে জেঠিমা তেল দিলেন হাতে। জল এনে দিলেন। তিনি নিজে কিছুই করতে চাইছেন না। তেল, জল ঢেলে আবার তিনি অর্জুন গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন। পায়ের কাছেই চিতা সাজানো হচ্ছে। তিনি কেমন নিষ্ঠুর চোখমুখ নিয়ে এ-সব দেখছেন। যেন অর্জুন গাছের নিচে আগুন জ্বলে উঠলেই, চিতায় তিনি বাপের সঙ্গে আরোহণ করবেন। জ্যাঠামশাইর চোখমুখ দেখে সোনার ভয় ধরে গেছে প্রাণে। সবার অলক্ষ্যে জ্যাঠামশাই চিতায় ঝাঁপ দিলে কী যে হবে!

কুশ তিল তুলসী মন্ত্রপাঠ তাকে কিছুতেই আজ অন্যমনস্ক করে দিতে পারছে না। সে সবসময় পাগল জ্যাঠামশাইকে চোখে চোখে রাখছে। ঠাকুরদাকে ছুঁয়ে দেবার পর ওর মুখে থুতু জমে যাচ্ছে। সে ঢোক গিলতে পারছে না। অশুচি শরীর নিয়ে সে কিছু গিলে ফেলতে পারে না। সে বার বার তাই থুতু ফেলছে। এবং যেই না মনে হচ্ছে ঠাকুরদাকে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হবে—মাংস পোড়া চামসে গন্ধ বের হবে—আগুন, ধোঁয়া, একটা আস্ত মানুষ পুড়বে, কী ভয়াবহ দৃশ্য—সে সেই সকাল থেকে এই দৃশ্যটা চোখের ওপর কীভাবে যে দেখবে—ঠিক সেই মোষ বলির মতো তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। এখনও সে-সবের কিছুই হচ্ছে না। জ্যেঠিমা পাগল জ্যাঠামশাইকে ধরে এনেছেন ফের। সাতপাক ঘুরে ঘুরে মুখাগ্নি। তারপর সেই দৃশ্য—কি কঠিন এবং নিষ্ঠুর যে মনে হচ্ছে না! সবাই কোলে তুলে নিয়েছেন ঠাকুরদাকে। সে পা ছুঁয়ে রেখেছে মাত্র। সেও সবার সঙ্গে সঙ্গে সাতপাক ঘুরছে। সাতবার প্রদক্ষিণ করছে চিতা। কোলে তুলে ছোট্ট শিশুকে মা যেমন বিছানায় শুইয়ে দেন, তেমনি সবাই ঠাকুরদাকে চিতার কাঠে দক্ষিণের দিকে পা, উত্তরের দিকে মাথা, মুখ মাটির দিকে রেখে উপুর করে শুইয়ে দিল। এবং একটা সাদা কাপড়ে ঢেকে দিল। সে এতক্ষণ কাঁদে নি। তার কাঁদতে ইচ্ছা হয়নি। পাগল জ্যাঠামশাই কাঁদেননি। তিনি এতক্ষণ সব দেখে যাচ্ছেন। কিন্তু যেই না সবাই শুইয়ে দিয়ে সাদা কাপড়ে শরীর ঢেকে দিল, পাটকাঠির আগুন ঝিলে ঢুকিয়ে দিল, পাগল জ্যাঠামশাই আকাশফাটা কান্নায় ভেঙে পড়লেন, বাবা…। সোনাও ঠাকুরদাকে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে কাঁদছে। জ্যাঠামশাইর কান্না দেখে কেউ আর স্থির থাকতে পারেনি। এই চিতার পাশে যত মানুষ দাঁড়িয়ে আছে এমন দৃশ্য দেখে কেউ না কেঁদে পারল না। প্রায় যেন কান্নার রোল পড়ে গেল। আগুন তখন চিতার চারপাশটা গিলে ফেলেছে। কাঠের ফাঁকে ফাঁকে আগুন দাঁত বের করে দিচ্ছে। অর্জুনের ডাল, শাখাপ্রশাখা এমনকি পাতায় আগুনের হল্কা গিয়ে লাগছে। আর পাগল মানুষ তেমনি শিশুর মতো উপুড় হয়ে চিতার পাশে পড়ে কাঁদছেন। ভূপেন্দ্রনাথ, চন্দ্রনাথ, শশীভূষণ ওঁকে ধরে বসে আছেন। পায়ের কাছে সোনা বসে আছে। আগুন ক্রমে দাঁত বের করে চারপাশে হল্কা ছড়াচ্ছে।

মেজ জ্যাঠামশাই চন্দনের কাঠ ফেলে দিলেন কিছু চিতায়। কিছু ধূপ। ঠাকুরদার গলার দু’পাশ দিয়ে আগুন উঠে গেছে। উপুড় করে শোয়ানো শরীর। মুখ দেখা যাচ্ছে না। চামড়া পুড়ে প্রথম কালো হয়ে গেল, তারপর সাদা রঙ। আস্ত মানুষ, এ-ভাবে পুড়ে যাচ্ছে। সোনা মরে গেলে ওর শরীরও সবাই পুড়িয়ে দেবে। সোনা মরে গেলে সবাই ঠিক এ-ভাবে ধরে তুলে দেবে চিতায়। পাগল জ্যাঠামশাই মরে গেলে ঠিক এ-ভাবে আগুন জ্বেলে দেবে তারা। মা মরে গেলে—সে আর ভাবতে পারল না। কেমন এক হতাশা ভাব তার। এবং জীবন সম্পর্কে সে ভীতবিহ্বল হয়ে পড়ল।

পাগল জ্যাঠামশাই এখন গাছের কাণ্ডে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। কিভাবে এক অমৃতময় শরীর যজ্ঞের হবির মতো জ্বলে যাচ্ছে দেখছেন। চামসে মাংসপোড়া গন্ধ বের হচ্ছে। সোনার ভিতর থেকে বমিবমি পাচ্ছে। কিন্তু সে কিছুতেই ওক দিতে পারছে না। ওর ভয় করছে বড়। সে এখন চিতার দিকে তাকাতে পারছে না। কী শরীর কী হয়ে যাচ্ছে! আর আগুন কীভাবে একটা মানুষকে গিলে খাচ্ছে। গাছের নিচে যারা বসে আছে ওরা কীর্তন করছে। ধোঁয়া উঠে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। এঁকেবেঁকে সোনালী বালির নদীর চর পার হয়ে কেমন বহুদূরে ঠাকুরদা অসীমে মিশে যাচ্ছেন!

সোনার মনে হল সে চিতার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে না। বরং পাগল জ্যাঠামশাইকে নিয়ে অন্য কোথাও তার চলে যেতে ইচ্ছা হচ্ছে। কিন্তু ঠাকুরদার শরীর পুড়ে গেলে চিতায় জল ঢেলে দিতে হবে। সে, পাগল জ্যাঠামশাই একসঙ্গে জল ঢেলে দেবে। বরং সে এখন ভাবল, অর্জুন গাছের ও-পাশে গিয়ে দাঁড়াবে। পাগল জ্যাঠামশাইর হাত ধরে থাকবে। কী অপলক তিনি দেখছেন।

বোধ হয় পাগল মানুষ ভাবছিলেন তখন—এই শরীর অমৃতময়, এই শরীরে আমার জন্ম। আপনার রক্ত এ-ভাবে ধারাবাহিকতা রক্ষা করছে। আপনার ধর্ম এভাবে সারা জীবন এবং শতবর্ষ পার হলেও এক অমৃতময় ধ্বনি ভেবে অন্ধকারে পথ হাঁটবে। আমরা কিছুই জানি না। এই যে জগতে, দিন মাস কাল, মৃত্যু এবং সৌর আবর্তন সবই এক নিয়ন্ত্রণের ফলে ঘোষিত হচ্ছে; কত ছোট সেখানে আপনি, আপনার এই কোষাকুষি, তিল তুলসী বিল্বপত্র। বাবা, আমরা বড় বেশি নিজেকে নিয়ে বাঁচি। আমাদের সবকিছু যত তুচ্ছই হোক, তাকে অপরিসীম মূল্যবান মনে করে সংসারের যাবতীয় সত্যকে অস্বীকার করি।

সোনা এখন পাগল জ্যাঠামশাইর হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। জ্যাঠামশাই একবারও ওর দিকে তাকাচ্ছেন না। আগুনের আঁচ ওদের শরীরে এসে সামান্য লাগছে। সোনা হাত ধরে টানছে, একটু দুরে নিয়ে যেতে চাইছে। শশীভূষণ আর একটু আগে দাঁড়িয়ে আছেন। দীনবন্ধু লক্ষ রাখছে সব। বড়বৌ ভূপেন্দ্রনাথকে ডেকে বলেছে, ওঁকে কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেবেন না। সোনাকে বলুন ওঁকে এদিকে নিয়ে আসতে।

শশীভূষণ বললেন, আমি আছি। এখানেই থাকুক। এই শেষ দেখা। কাছে থাকলে ওঁর মন শান্তি পাবে।

কিন্তু ভয়, এমন অপলক তিনি এই আগুনে কী দেখছেন। চোখে এসে প্রতিবিম্ব পড়ছে আগুনের। সোনা দেখল জ্যাঠামশাইর চোখদুটোয় চিতা জ্বলছে আর গাছের নিচে এক চিতা। তিন চিতায় সে, জ্যাঠামশাই এবং ঠাকুরদা ক্রমাগত যেন জ্বলে যাচ্ছেন। সে ভয়ে জ্যাঠামশাইকে টেনে নিয়ে যেতে চাইল।

সোনা ডাকল, জ্যাঠামশয়, জ্যেঠিমা আপনাকে ডাকছে। পাগল মানুষ এবার সোনার দিকে তাকালেন।—ঐ দ্যাখেন জ্যেঠিমা দাঁড়িয়ে আছে।

দূরে জামগাছটার নিচে গ্রামের সব মেয়েরা দাঁড়িয়ে এই বুড়ো মানুষের দাহ দেখছে। সকলেই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। দেখছে মাটি এবং মানুষের এক চিরন্তন ইচ্ছা এভাবে শেষ হয়ে যায়।

পাগল মানুষকে সোনা কিছুতেই সরিয়ে নিতে পারল না। তিনি এখন হাসছেন। তবে আর ভয় নেই। সোনার এখন মনে হল ঠাকুরদার সব অহঙ্কার আগুনে জ্বলে যাচ্ছে। সে জন্য জ্যাঠামশাই হাসছেন। সব পৌরুষ জ্বলে যাচ্ছে, সে-জন্য জ্যাঠামশাই হাসছেন। মিথ্যা ধর্মবোধ জ্বলে যাচ্ছে, সে-জন্য তিনি হাসছেন।

সে বলল, জ্যাঠামশয়, আপনার চক্ষে ঠাকুরদার চিতা জ্বলতাছে।

মণীন্দ্রনাথ সোনার দিকে তাকালেন। যেন বলতে চাইলেন, তুমি নিজের চোখ দেখ সোনা।

সে লালটুকে বলল, দাদা রে, আমার চক্ষে কিছু জ্বলতাছে?

লালটু উঁকি দিল। বলল, হ’! সোনা তর দুই চক্ষুতে ঠাকুরদার চিতার আগুন।

—সত্যি?

—হ রে, সত্যি।

সোনা তাড়াতাড়ি বড়দাকে ডাকল।–দ্যাখি, তর চক্ষু।

চিতার দিকে মুখ করে দাঁড়ালে সবার চোখে, প্রতিবিম্ব সৃষ্টি হচ্ছে। সে বলল, বড় কষ্ট না রে দাদা। আমরা সবাই মইরা যামু। ভাবতে কষ্ট লাগে, না?

তখন শশীভূষণ বললেন, অত কাছে যাবে না। এদিকে সরে এস। মাথা ফুটে ঘিলু ছিটকে আসতে পারে।

—মারেন বাড়ি। শশীভূষণ ভূপেন্দ্রনাথকে বললেন।

—মাথাটা হেলে পড়ে যাচ্ছে। সোনা লালটু সবাই তাড়াতাড়ি দূরে সরে গেল। ভূপেন্দ্রনাথ বাঁশের খোঁচায় মাথাটা ফাটিয়ে দিতেই ভয়ঙ্কর একটা শব্দ হল। সোনা দেখল আগুন ক্রমে কমে আসছে। এখন আছে শুধু সামান্য মাথার খুলি, নাভি এবং কোমরের দিকটা। ভূপেন্দ্রনাথ খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সেটা আগুনে জ্বালিয়ে দিচ্ছেন।

ঠাকুরদার নাভিটা একটা পোড়া ব্যাঙের মতো দেখাচ্ছে। ব্যাঙের লেজ খসে শরীরটা কিম্ভুতকিমাকার হয়ে গেছে। ঠাকুরদার এমন চেহারা দেখে ওর ভারি মজা লাগছিল। সোনা যেমন আয়নায় মুখ দেখে, ঠাকুরদা যদি আয়নায় এখন তেমনি মুখ দেখতে পেতেন।

সে ঠাট্টা করে বলল, বুড়োকর্তা, আয়না দিমু আইনা। আয়নায় যদি নিজের মুখটা দ্যাখেন। সে পলটুকে বলল, বড়দা রে, ঠাকুরদা একবারও ভাবছিলেন শরীরটা ওঁর ব্যাঙের মত হইয়া যাইব?

পলটু ধমক দিল।—খাড়, ধনকাকারে কইতাছি।

সোনা এবার চুপ করে গেল। এমন মহাপার্বণের দিনে সে কী আজেবাজে ঠাট্টা করছে। সে বিধর্মী হয়ে যাচ্ছে কেন! মানুষের জীবন কত ছোট, কত অপরিসীম তুচ্ছ। এই বয়সেই এসব ভাবায় বলে সোনা মাঝে মাঝে এই পৃথিবী বিচরণশীল মানুষের জন্য নয় এমন ভাবে! যুদ্ধের বর্ণনা সে শুনেছে। শশীভূষণ নানাভাবে কোথায় কীভাবে মহাযুদ্ধ হয়েছে, দুর্ভিক্ষ এবং দাঙ্গার কথা বর্ণনা করেছেন। সোনা সে-সব শুনে মাঝে মাঝে এক সুন্দর সুদৃশ্য জগৎ নিজের মনে তৈরি করে নেয়। সেখানে ঈশমদাদা তার কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ মনে হয়। সেই ঈশমদাদাই আজ এমন মহাপার্বণে কাছে আসতে পারছে না। সে দূরে দূরে অপরিচিত মানুষের মতো থাকছে।

তখন ভূপেন্দ্রনাথ অবশিষ্ট নাভিটাও সামান্য একটা টিনের কৌটায় পুরে রেখে মাথায় করে জল নিয়ে এলেন। তখন নদীর চরে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। কী গরম আর এই দাবদাহে মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। এখন বৃষ্টির দরকার। কালবৈশাখীর ঝড়ে আমের কুশি ঝরে পড়বে। বষ্টিপাত না হলে ধরণী শান্ত হবে না। ভূপেন্দ্রনাথ, পাগলঠাকুর মানুষের দিনগত পাপক্ষয়ের পর শান্তি আসুক, এই ভেবে সারাক্ষণ ঘড়া ঘড়া জল এনে চিতার আগুনে ঢেলে দিতে থাকলেন।

জলে চিতা নিভে গেলে ওরা বাড়ি ফিরে গেল। সোনা ফেরার সময় পিছনে তাকাচ্ছে না। জ্যাঠামশাই এক কলসি জল চিতার উপর রেখে পিছন ফিরে কলসি ফুটো করে দিয়েছেন। কেউ আর তাকাচ্ছে না পিছনে। দাহ কাজ সেরে ফিরে যাবার সময় পিছন ফিরে দেখতে নেই। দেখলে পাপ হয় সোনার মনে হল, পিছনে তাকালেই সে তার ঠাকুরদাকে দেখে ফেলবে! তিনি যেন পদ্মাসনে শ্মশানের উপর বসে আছেন। সেখানে আর শ্মশান নেই। সুজলা সুফলা ধরণী। তিনি সেখানে বসে মধুপান করছেন। মৃত্যুর পর মানুষের মধুপান দেখতে নেই। সোনা সেজন্য আর তাকায়নি। তাকালে পাপ হবে সে জানে। অথচ খুব দেখার ইচ্ছা তার। সেই শ্মশানে কী হচ্ছে এখন। সূর্যাস্ত হয়ে গেছে। সন্ধ্যা হলে অস্পষ্ট অন্ধকারে কোনও কুকুর অথবা শেয়াল আসতে পারে। কোনও কুকুর অথবা শেয়াল দেখতে পেলেই বুঝতে পারবে ঠাকুরদা শেয়াল-কুকুরের বেশ ধারণ করে ফিরে এসেছেন। নীলবর্ণের পাখি আর থাকছেন না। কিন্তু সে তাকাতে পারল না ভয়ে। ঠাকুরদা রাগ করতে পারেন তার উপর। তুমি সোনা যা নিয়ম নয়, যা করতে নেই, সে-সব করার বড় শখ তোমার! তুমি তাকালে কেন? আমি আর বড় বটগাছের মাথায় নক্ষত্র হয়ে থাকব না। আমি কিছুই দেখব না তোমাদের। তোমাদের বাগে পেলে ঘাড় মটকে দেব।

সোনা সেজন্য খুব সুবোধ বালকের মতো পিছনে না তাকিয়ে সবার সঙ্গে পুকুরে ডুব দিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিল। এবং অন্ধকার নামলেই ওর কেমন ভয় ধরে গেল। সে দক্ষিণের ঘরে শশীমাস্টারের পাশে গিয়ে বসে থাকল। এমনকি যখন একটা গণ্ডগোল উঠেছিল গোপাটে—ফেলুর শরীরে কী জ্বলছে, ফেলুর ঘা ফুটে এখন আগুনের মতো জ্বলছে নিভছে এবং হাতে তার কোরবানীর চাকু, ভয়ে কেউ কাছে যাচ্ছে না, সে কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে, আবার সে কার গলা যে হ্যাৎ করে কেটে ফেলবে—কেউ বুঝতে পারছে না, বাতাসে যেন সেই নরহত্যার আতঙ্ক চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে, সবাই সাবধান হয়ে যাচ্ছে, ওকে দেখলে গোপাটে আর কেউ নেমে যেতে পারছে না——তখনও সোনা শশীমাস্টারের পাশে বসেছিল।

কেবল নির্ভীক এক যণ্ড। সে চারপা শক্ত করে ভিটাজমিতে দাঁড়িয়ে আছে। কতদূরে ফেলু আছে বাতাসে গন্ধ শুঁকে টের পাচ্ছে।

হাওয়া কেটে রাতের অন্ধকারে হাত তুলে গোপাটে ফেলু ছুটছে। ফেলু গোপাট পার হয়ে এদিকে আসছে। কী তুমি এমন একখানা মানুষ, তোমার চিতার চারপাশে মানুষ ভেঙে পড়েছে। তুমি মশাই মরেও গরব তোমার যায় না। আগুনে চিৎপাত হয়ে শুয়ে থাক আর লোকে দেখে হায় হায় করে, আমি এক ফেলু, বিবি ঘরে নেই, আমার দুঃখে কেউ কাঁদে না। দ্যাখি কি আছে মাটিতে। তুমি কোনখানে আছ, তোমার পাগল ছাওয়ালে আমারে কানা কইরা দিছে। বলেই সে সেই শ্মশানের উপর এসে কেমন উত্তেজনায় কোরবানীর চাকুটা দুলিয়ে দুলিয়ে নৃত্য করতে থাকল।

কেউ দেখে ফেললে ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত কী যে হতো! কেবল শশীমাস্টার জানালায় দাঁড়িয়ে দেখছেন দূরে পুকুরপাড়ে অর্জুনগাছের নিচে একজন মানুষের অবয়ব। তার শরীর থেকে আগুন বের হচ্ছে। শশীমাস্টার বললেন, সোনা আয়। মজা দেখবি। মানুষ মরে কোথাও যায় না। এ পৃথিবীতেই থাকে। শুধু আমরা দেখতে পাই না এই যা। ঐ দ্যাখ।

সোনা জানালায় দাঁড়িয়ে দেখল, সত্যি সেই মহাশ্মশানে তার ঠাকুরদা ফিরে এসেছেন। কী সব অলৌকিক ঘটনা। ওরা দেখল কিছুক্ষণ সেই আত্মা সেখানে ঘোরাঘুরি করে শেষে মাঠের দিকে নেমে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। কালো শরীর বুঝি সেই বিদেহীর। সারা শরীরে আগুন ফুটে ফুটে বের হচ্ছে। অদ্ভুত সব চোখ আগুনের-আতঙ্কে সে আর্তনাদ করে উঠল। তখন শশীমাস্টার বললেন, ভয় পেতে নেই সোনা। আমরা সবাই এভাবে মরে যাব। মরে গিয়ে আবার এখানেই ফিরে আসব।

সোনা কিছু বলতে পারছে না। ওর ভয়ে জ্বর আসছে।

কম্প দিয়ে জ্বর আসছে সোনার। সেই আগুনে পোড়া মানুষটার শরীরে অজস্র আগুনের ফুলকি জ্বলছে নিভছে। সোনা হি হি করে মাঘমাসের শীতের মতো কাঁপছে। সে মাস্টারমশাইর বিছানায় একটা কাঁথা গায়ে শুয়ে পড়ল। মনে হল বুঝি তার পালা। এবার বুঝি সেও ঠাকুরদার মতো মরে যাবে। পোড়া শরীরে আগুন ফুটে বের হবে। জ্বালাযন্ত্রণায় ছটফট করবে সে। সে সবাইকে দেখতে পাবে,তাকে কেউ দেখতে পাবে না। ভয়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। সে কাঁথার ভিতর কেবল ছটফট করছিল।

শশীভূষণ সহসা চিৎকার করে উঠলেন ধনবৌদি, তাড়াতাড়ি আসুন। সোনা কেমন করছে, এসে দেখুন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *