প্ৰথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড

নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – ১.৬

১.৬

আরও কিছুকাল পরে। সোনা নিবিষ্ট মনে তরমুজ খেতে বসে মাটি খুঁড়ছিল। বেলে মাটি, সুতরাং সে অনেকটা মাটি তুলে ফেলল। সোনালি বালির চর এখন শুকনো। চর পার হলে নদীর জল পাতলা চাদরের মতো, তিরতির করে কাঁপছে। স্বচ্ছ জলে ছোট ছোট মালিনী-মাছ ভেসে বেড়াচ্ছে। সোনা ছোট একটা নারকেলের মালার সাহায্যে জল নিয়ে এল নদী থেকে। ছোট গর্তটা জলে ভরে দিল। যেহেতু নদীতে হাঁটুজল, পার হয় গরু, পার হয় গাড়ি, সেজন্য হাঁটু জলে নেমে একটা মালিনী-মাছ ধরল সোনা। মাছটা অঞ্জলিতে রেখে সে নদী থেকে প্রথমে গর্তটার সামনে এসে দাঁড়াল। জলে মাছটা ছেড়ে খরগোশের মতো মাথা উঁচু করে দিল তরমুজ-পাতার ভিতর থেকে। দেখল, দূরে ছই-এর নিচে বসে ঈশম দাদা তামাক খাচ্ছে। সোনার প্রতি অথবা তরমুজের প্রতি যেন সে লক্ষ রাখছে। সোনা তরমুজ-পাতার আড়ালে নিজেকে আর একটু ঢেকে ফেলল। ছোট-শরীর সোনার। শরীরের রঙ বালির চরের মতো। সোনার পা খালি এবং এটা বসন্তকাল। নদীর চর থেকে বসন্তকালীন হাওয়া উঠে আসছে। বাতাস জোর বইছিল বলে তরমুজের পাতা ফাঁক হয়ে যাচ্ছে। সেজন্য পাতার ফাঁকে সোনার শরীর স্পষ্ট। পাতার ফাঁকে সোনাকে নিবিষ্ট মনে বসে থাকতে দেখে ঈষৎ চিন্তিত হল ঈশম। সে ভাবল—সোনাডা আবার বইসা বইসা তরমুজের লতা উপড়াইতাছে না ত! সে ছই-এর ভিতর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বের হল। ডাকল, সোনা কর্তা কই গ্যালেন?

সোনা তাড়াতাড়ি পাতার ভিতর আরও লুকিয়ে গেল। প্রথমত, সে একা একা বাড়ি থেকে এ জগতে চলে এসেছে, দ্বিতীয়ত, সে একটা গর্ত করে নদী থেকে জল এনে পুকুর তৈরি করছে। পুকুর তৈরি করতে গিয়ে দুটো তরমুজের লতা উঠে এসেছে। এসব অপরাধবোধ ওর মনে কাজ করছে। সে একবার পাতার ফাঁক দিয়ে মাথা উঁচু করে দেখল, ঈশম তাকে খোঁজবার জন্য এদিকেই আসছে। সোনা তাড়াতাড়ি পাতার ফাঁকে মাটির সঙ্গে মিশে হামগুড়ি দিতে থাকল। ঈশম যত ওর দিকে এগিয়ে আসছে তত সে পাতার আড়ালে উপরে উঠে যব খেতের ভিতর ঢুকে গেল এবং চুপচাপ বসে থাকল।

ঈশম যেখানে সোনাকে বসে থাকতে দেখেছিল এখন সেসব জায়গা নির্জন। দুটো তরমুজের লতা উপড়ানো। একটা ছোট গর্তে কিছু জল এবং একটা মালিনী-মাছ ভেসে বেড়াচ্ছে। জলটা ক্রমশ কমে আসছে। মাছটা যেন উঁকি দিয়ে ঈশমকে দেখতে পেয়ে জলের ঘোলাটে অন্ধকারে লুকাল। ঈশম ফের ডাকল, সোনা কর্তা আমার, কই গ্যালেন?

যেখানে নদীর পাড় ক্রমশ উঁচু হয়ে গ্রামের সঙ্গে মিশে গেছে সেখানে যবের খেত, গমের খেত। খেত পার হলে গোপাট। কবিরাজবাড়ি। নীল রঙের ডাকবাকস। এখন যব গম কাটার সময়। কিছু গাঙশালিক যব গম খেতে উড়ছে। ঈশম ফের ডাকল সোনা কর্তা, কই গ্যালেন গ! আমি আপনের লগে পারি! আইয়েন কর্তা, আইলে কান্দে লইয়া নদী পার হমু।

সোনা ডাক শুনতে পেল কিন্তু আড়াল ছেড়ে এতটুকু নড়ল না। ঈশমের সঙ্গে এখন ওর পলান্তি খেলার শখ যেন। সে যব খেতের ভিতর আরও ঘন হয়ে বসল। সে বসে বসে শুকনো ঘাস ছিঁড়তে থাকল। যব গাছ নড়ছিল। ঈশম জমির আল থেকে টের করতে পারছে সব। সে দ্রুত হেঁটে এসে যব খেতে ঢুকে সোনাকে সাপটে ধরল এবং বলল, এহনে যাইবেন কইগ কৰ্তা?

সোনা হাত ছুঁড়ছিল যব খেতের ভিতর। ওর চিৎকারে যব গম খেত থেকে সব গাঙশালিক বিকেলের রোদে উড়ে গেল। ওরা উড়ে উড়ে নদীর চরে নেমে গেল। সোনা বলল, না যামু না। আমারে ছাইড়া দ্যান।

—আপনারে আমি কিছু কইছি? আইয়েন আমার লগে। ছই-এর নিচে বসুম, আসমান দ্যাখমু। বলে, সোনাকে কাঁধে তুলে হাঁটতে থাকল ঈশম

সোনার এখন আর পরাজিত ভাবটুকু নেই। সে কাঁধে পা দোলাতে থাকল। সোনালী বালির নদীতে জল, কিছু নৌকা, কিছু গ্রামের মানুষ দেখল সোনা। বসন্তের বাতাস এখন যব, গম খেতে ঢুকে অদৃশ্য হচ্ছে। নদীর পাড় ধরে যত দূর চোখ গেল শুধু যব গমের পাকা শীষ, কিছু হিজল গাছ এবং তার পাতা গাছের নিচে বিছানো শতরঞ্জের মতো। সোনা বলল, রাইতে আপনের একলা ডর করে না?

—না গ কর্তা! আল্লা ভরসা। ডরে ধরলে আল্লার নাম লই।

—নিশিতে যদি ধইরা লইয়া যায়?

—আমারে নিব না।

—নিব, দেইখেন। নিশিতে ধরলে আপনে ট্যার-অ পাইবেন না।

—আমাকে নিব না। নিশি ব্যাডা আমার মিতা।

—তবে মায় যে কয়, তুমি একলা কোনখানে যাইঅ না সোনা। নিশিতে ধইরা লইয়া যাইব-অ। নিশি নাকি ইচ্ছা করলে মার মত হইতে পারে, আপনের মত হইতে পারে।

—তা হইতে পারে।

—আমি আর কোনখানে যামু না।

—আর যাইয়েন না।

এবার সোনা ঈশমের মুখ দেখার চেষ্টা করল। চারপাশে মাঠ। ওর নানা রকমের ভয়ডরের কথা মনে হল। যবের শীষ ওর শরীরে লাগছে। ওর শরীর চুলকাচ্ছিল। ঈশমের কাঁধ থেকে নেমে সোনা তরমুজ খেতের ভিতর ঢুকে গেল। সে বলল, আমি একলা যামু না বাড়িতে। আপনের লগে যামু ঈশম দাদা। তারপর সে তার প্রিয় মাছটিকে খুঁজতে থাকল। ঈশমকে বলল, আপনে যান ছই-এর ভিতর, আমি পরে আইতাছি। সে একটা তরমুজের ওপর বসে গর্তের ভিতর মাছটাকে খুঁজতে থাকল। জলের নিচে মাছাটা এখন লুকোচুরি খেলছে। সে গ্রামের দিকে তাকাল, বেলা পড়ে আসছে। তরমুজ গাছের ফাঁকে ফাকে রোদ জলের রেখার মতো বেয়ে বেয়ে নামছে। সে দেখল একটা বড় তরমুজ, পাতার উপরে উঠে গেছে। সে দীর্ঘ সময় নদীর জলে সূর্যের আলো পড়তে দেখল। সে দীর্ঘ সময় বড় তরমুজটার ওপর বসে আকাশের ভিন্ন ভিন্ন প্রান্তে মেঘের ছায়া দেখল এবং বিচিত্র রকমের সব পাখিদের গ্রামের দিকে উড়ে যেতে দেখল। ওর এখন উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে না। ঈশম বার বার ছই-এর ভিতর থেকে ডাকছিল। তামাকের গন্ধ এদিকে নেমে আসছে, কিছু বালিহাঁসের শব্দ পেল সোনা, তবু সে উঠল না। সে নিবিষ্ট মনে নদীর চর দেখছে। বড় নির্জন এই অঞ্চলটা। একটা ভালুকের মুখ সে যব গমের খেতে দেখতে পেল। সে তাড়াতাড়ি ছই-এর দিকে হেঁটে যাবার সময়েই মনে করতে পারল ভালুকের মুখটা ছবির বইয়ে দেখা। সুতরাং ভীত হবার মতো কোনও ঘটনাই যেন নেই। ছই-এর ভিতর ঢুকে সোনা বলল, নিশি ব্যাডা আমার-অ মিতা। আমি কেয়রে ডরাই না।

সোনা ছই-এর নিচে ঢুকে কিছুক্ষণ লাফালো। মাচানের নিচে মালসাতে তামাক খাবার জন্য ঈশম আগুন ধরে রেখেছে। ধোঁয়া উঠছিল।—বাইরে আইয়া বসেন, আসমানের নিচে কত সুখ দ্যাখেন। ঈশম বলল।

ঈশম পা ছড়িয়ে বসল। তরমুজ খেতে সোনা ওর কোলে বসে বলল, আমারে যে কইলেন কান্দে কইরা নদী পার করব্যান, কই করল্যান না-ত! দীর্ঘকাল থেকে সোনার নদী পার হবার ইচ্ছা। কিন্তু ঈশম ওর কথায় রা করল না বলে মনে মনে অভিমান হতে থাকল। দূরে দূরে নদীর জল পাতলা চাদরের মতো কাঁপছিল। দু’জন বোরখা গরা বিবিকে দেখল নদীর পাড় ধরে যব গম খেতের ফাঁকে চরে নেমে আসছে। সে এবার যথার্থই ভীত হল। সে এবার ঈশমের কাছে খুব ঘন হয়ে বসল। ঈশম দাদার সেই সব ভূতের গল্প মনে পড়ছে—দু’চোখ সাদা, অন্য কোনও অবয়ব নেই। রাত্রিবেলা মায়ের বর্ণিত সেই সব রাক্ষস খোক্কোসেরা বালির চরে সন্তর্পণে নেমে আসছে যেন! সে খুবই কাতর গলায় বলল, ঈশম দাদা আমি মার কাছে যামু।

—যাইবেন, আমার লগে যাইয়েন।

—না, আমি এখন যামু

দু’জন বোরখা পরা বিবি নদীতে নেমে যাচ্ছে। পিছনে নয়াবাড়ির বড় মিঞা। সে বুঝল বড় মিঞার দুই বিবি। সুতরাং সে হাত তুলে ডাকল, অঃ বড় মিঞা, বড় মি…ঞা। বড় মিঞাকে ধরবার জন্য সে সোনাকে কাঁধে নিয়ে তরমুজ খেত অতিক্রম করতে থাকল।

নদীর পাড় ধরে বড় মিঞা এগিয়ে আসছে। ঈশম এখন বালির চর অতিক্রম করছে। এইসব ঘটনায় সোনা ভীত এবং বিব্রত। সে শুধু বলছে আমি যামু না, মার কাছে যামু। অথচ সে দেখল ঈশমের গলার আওয়াজে সেই অবয়বহীন কালো রঙের বোরখা দুটো পুতুলের মতো স্থির। সে বুঝল, ক্রমশ ওরা পরস্পর পরস্পরের সম্মুখীন হচ্ছে। সে আবার বলল, আমার ডর করতাছে, আমি বাড়ি যামু।

ঈশম বলল, অঃ বড় মিঞা, ইট্টু খাড়ও। তোমার বিবিগ দ্যাখাইয়া লইয়া যাও। বোরখা পইরা যাইতাছে দেইখা সোনা কর্তার ডরে ধরছে।

বড় মিঞার কুৎসিত বীভৎস মুখ; বসন্তের দাগ মুখে, একটা চোখ সাদা এবং মৃত।

সোনা এবার ঈশমকে খুব শক্তভাবে জড়িয়ে ধরল। বলল, আমি দুষ্টামি করমু না। আমারে ছাইড়া দ্যান।

সোনার এমন কথায় বড় মিঞা না হেসে পারল না। বলল, ধনকর্তার পোলা?

—হ! ঈশমও হাসল। ডরান ক্যান। আপনেগ পুরান আমলের চাকর।

এখন সোনালী বালির নদীর জলে সূর্যের শেষ আলো সোনার রাজহাঁসের মতো দেখাচ্ছে। সেই কালো অবয়ব-বিহীন বস্তু দুটো নীরব এবং নিশ্চল, যেন কোনও জাদুকরের মন্ত্রগুণ এই দুই অপরিচিত প্রেতাত্মাকে বেঁধে রেখে ভূতের খেলা দেখাচ্ছে। সোনা ঈশমকে শেষবারের মতো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল—সার্কাসে সিংহের খেলা দেখার মতো এক অযাচিত ভয়, রোমাঞ্চকর সব দৃশ্য। বিসদৃশ অবয়ব- -বিহীন অন্ধকার রঙের বস্তু দুটো এগিয়ে আসছে।

ঈশম বলল, এইবার তোমার দুই লবেজান বিবিরে দ্যাখাও। সোনাকর্তার ডরডা ভাঙাইয়া দ্যাও দ্যাখছ মুখে রা নাই।

চারিদিকে গমের খেত। পাড়ে পাড়ে লটকন গাছ আর তেমনি গাছে গাছে নীলকণ্ঠ পাখিদের মতো শালিকেরা আশ্রয় নিয়েছে। কিচিরমিচির শব্দ। দূরে গাভীর ডাক। সূর্যের আলো তেমনি যেন সোনার রাজহাঁস। সেই আশ্চর্য বিস্ময়মুগ্ধ প্রকৃতির নীরবতার ভিতর বড় মিঞা তার দুই বিবির বোরখা তুলে দিল—আশ্চর্য মুখ এবং পাতলা গড়ন যুবতীদের—বড় মিঞার দুই বিবি—দুগ্‌গা ঠাকুরের মতো মুখ, গড়ন, নাকে নথ এবং পায়ের মলে ঝমঝম শব্দ। সোনার কাতর চোখ দুটো এখন নদীর জলে আঁধার রাতে নৌকার আলো যেন—বিস্ময়ে চকচক করছে।

ছোট বিবি বলল, আইয়েন কর্তা, কোলে আইয়েন। বলে ঈশমের কোল থেকে সোনাকে নিজের কোলে তুলে নিল এবং মুখের কাছে মুখ রেখে বলল, কি দ্যাখতাছেন বড় বড় চক্ষু দিয়া?

সোনা কোনও জবাব দিতে পারল না। সে ছোট বিবির মুখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। ঈশমকে দেখল। ঈশম এখন বড় মিঞার সঙ্গে ফসলের গল্প করছে।

বড় বিবি বলল, কর্তা, চলেন আমাগ লগে।

সোনা চোখমুখ বুজে বলল, না।

সোনা ফের ছোট বিবির মুখের দিকে তাকালে, বলল, আমারে আপনের খুব পছন্দ লাগছে। হা গ বড় মিঞা, সোনা কর্তায় য্যা আমারে নজর দিতাছে। বলে খিলখিল করে হেসে উঠল।

হাসি শুনে ঈশম বলল, তর হাসিডা আগের মতই আছে। সহসা মনে পড়ার ভঙ্গিতে ঈশম বলল, জাবিদা, তর ম্যায় ক্যামন আছে ল?

—ভালই আছে ভাইসাব।

ছোট বিবি সোনার চিবুক ধরে বলল, কর্তা, আমারে নিকা করতে হইলে গালে বড় বড় দাড়ি রাখন লাগব। দাড়ি না হইলে শখ মজাইতে পারবেন না। বড় বড় চক্ষু হইছে, ভারি ভারি নাক মুখ হইছে, নদীর চরের মত শরীরের রঙ হইছে—সব হইছে গ করতা, বড় খুবসুরত হয়েছেন। কিন্তু দাড়ি নাই গ গালে। বলে আড়চোখে বড় মিঞার দিকে তাকাল। বড় মিঞার মৃত চোখটা পর্যন্ত এমন কথায় সজাগ হয়ে উঠল। ছোট বিবির চোখে তখন মানিক জ্বলছিল। হেসে বলল, ডর নাই। এবং সোনাকে বুকের সঙ্গোপনে রেখে ভাবল; আল্লা, সোনা কর্তার মত একডা পোলা দ্যান।

বড় মিঞা বলল, যাই ঈশম ভাই। ব্যালা পইড়া গ্যাছে। ঘরে ফিরতে রাইত হইব। সময় পাইলে যাইয়েন।

ছোট বিবি বলল, ভাইসাব, ন্যান আপনের কর্তারে। বলে ছোট বিবি সোনাকে নিচে নামিয়ে রেখে মুখে বোরখা নামিয়ে দিল। তারপর ওরা চলতে থাকল। ওরা নদীতে নেমে যাচ্ছে। ওরা জল অতিক্ৰম করে ওপারে উঠে গেল। বড় মিঞা আগে, ছোট বিবি বড় বিবির পিছনে এবং সঙ্গে যেন ওদের রোদের ছায়া হেঁটে যাচ্ছে। সোনা ঈশমের হাত ধরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। বড় বিবির প্রতিবিম্ব জলে ভাসছে। ওরা নদীর পাড় ধরে হাঁটছিল—ওরা সরে যাচ্ছে ক্রমশ। সোনার কষ্ট হতে থাকল—বড় বড় চোখ, দুগ্‌গা ঠাকুরের মতো নাকমুখ, নাকে নথ, পায়ে খাড়ু, এখনও ঝমঝম শব্দটা কানে বাজছে। তারপর সেই ছবির ভালুকটা আবার চোখের ওপর ভেসে উঠল। সে ঈশমকে বলল, মায় কইছে আমারে একটা বন্দুক কিনা দিব।

ঈশমও যেন এতক্ষণে কী সব ভাবছিল। বড় বিবির যৌবনকাল অথবা অন্য কোনও প্রিয় ঘটনা ওকে কিছুক্ষণের জন্য অন্যমনস্ক করে রেখেছিল। এবং এও হতে পারে…সূর্য ডুবছে, গাভীসকলের শব্দ এখন শোনা যাচ্ছে না, ঘাস নিয়ে মাঠ থেকে কামলা ফিরছে, সুতরাং ঘরে ফেরার সময় হলেই পঙ্গু বিবির কথা মনে হয়। বড় মিঞার কপালে সুখ, দুই বিবিকে নিয়ে ঘরে ফিরছে। তখন সোনা বলছে, বন্দুকটা দিয়া আমি একটা ভালুক মারমু।

ঈশম এবারও কোন জবাব দিল না। সে সোনার হাত ধরে তরমুজ খেতের ভিতর ঢুকে গেল। কয়েকটি বড় বড় তরমুজ তুলে ছই-এর ভিতর রেখে দিল, তারপর ঝাঁপ বন্ধ করে বলল, লন যাই।

সোনা মাচানের নিচে নেমে বলল, আমারে কান্দে লইয়া নদী পার হইবেন না?

আইজ থাকুক। সন্ধ্য হইয়া আইতাছে, ধনমামি খোঁজাখুঁজি করব। তাড়াতাড়ি লন, বাড়ি যাই।

তরমুজ খেত অতিক্রম করতেই সোনার মনে পড়ল ওর প্রিয় মালিনী-মাছটা একা পড়ে আছে তরমুজের জমিতে। সে বলল, ইট্টু খাড়ন, মাছটারে নদীর জলে ছাইড়া দিয়া আসি।

সোনা লাফ দিয়ে তরমুজের পাতা এবং ফল ডিঙিয়ে গেল। সে খুঁজে খুঁজে নির্দিষ্ট জায়গাটুকু খুঁজে পেল না, তখন হতাশ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকল তরমুজের জমিতে। ঈশম বার বার ডেকেও সাড়া পেল না। কাছে এলে কেমন ভারি গলায় সোনা বলল, মালিনী-মাছটারে পাইতাছি না।

ঈশম সোনার হাত ধরে গর্তটার সামনে নিয়ে দাঁড় করাল। গর্তটাতে এখন জল নেই। মালিনী-মাছটা বালি মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। সোনা গর্তটার পাশে বসল। হাতের তালুতে মাছটাকে রেখে উল্টে পাল্টে যখন যথার্থই বুঝল মাছটা মরে গেছে, কেমন এক শোকার্ত চোখ নিয়ে চারদিকে তখন তাকাতে থাকল। ওর উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে না এখন। মালিনী-মাছের চোখ ওকে পীড়িত করছে অথবা যেন ছোট বিবির মুখ….সে এবার ধীরে ধীরে মাছটাকে বালি মাটিতে শুইয়ে দিল। পাড়ের মাটি দিয়ে শরীর মুখ ঢেকে দিল। এবং একটা ছোট্ট তরমুজ পাতা ছিঁড়ে ওর কবরের ওপর ছাউনির মতো করে রেখে দিল। তারপর ঈশ্বরের কাছে ছোট এই মাছের জন্য প্রার্থনা করার সময় দেখল, যব গম খেতের ফাঁকে বড় মিঞা তার সাদা মৃত চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে। যেন বলছে, হাউ মাউ কাউ মানুষের গন্ধ পাঁউ। অথচ সোনা দেখল সেই এক মাঠ–যব গম খেত, চরের বালিতে তরমুজের ঘন রঙ এবং নদীর জলে অবেলার শেষ রোদ আর নদীর ওপার থেকে বড় নিঃশব্দে সেই একটি মৃত চোখ–মুখে দাড়ি নিয়ে এগিয়ে আসছে। সুতরাং সব ফেলে ঈশমকে ফেলে চরের জমি ভেঙে কেবল ছুটতে থাকল সোনা। কেবল মনে হচ্ছে ওকে নিশিতে পেয়েছে। নিশির ডাকে সে এই সব নির্জন জায়গায় চলে এসেছে। সে ঈশমকে পর্যন্ত গরুর ছানা ভেবে এই অপরচিত জায়গা থেকে পালাতে চাইল। সে ছুটছে—ছুটছে। কিন্তু বেশি দূর ছুটতে পারল না। যব গম খেতের আলে পথ হারিয়ে ফেলল। ওর ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেল। সে জোরে কাঁদতে পারল না পর্যন্ত। সে ভয়ে বিবর্ণ। চারদিকে যব গমের শীষ এবং তার শরীর দেখা যাচ্ছে না।

সে ভয়ে চোখ বুজে যখন পথ খুঁজছিল, যখন যথার্থই অন্ধকার নেমে গেছে মাঠে এবং আশেপাশে শেয়ালেরা ডাকতে আরম্ভ করেছে, তখন ঈশম সোনাকে বুকের কোমল উষ্ণতায় ভরে দিল। বলল, কর্তা, আপনে আমারে ফালাইয়া যাইবেন কই?

এবার চোখ খুলল সোনা। দেখল সেই পরিচিত জায়গা, সেই প্রিয় বকুল গাছ…গাছের ছায়ায় অজস্র বকুল ফুলের গন্ধ। সোনা এবার নির্ভয়ে বলল, আমি কোনখানে যামু না ঈশম দাদা। আপনেরে রাইখা কোনখানে যামু না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *