প্ৰথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড

নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – ১.২৫

১.২৫

সেই যে মালতী শুয়ে থাকল আর উঠল না। দিন তিনেক বাদে কিছুটা যেন হুঁশ ফিরেছে। চোখ মেলে তাকিয়েছে। কি যেন বলতে গিয়ে ঠোঁট কেঁপে উঠছে। বলতে পারছে না। আঁচল দিয়ে মালতী নিজের মুখ ঢেকে রেখেছে। যত জোটন মুখ থেকে আঁচল টেনে কথা বলাতে চেয়েছে, তত মালতী মুখের আঁচল তুলে দিয়ে কেমন শক্ত হয়ে পড়ে থাকছে।

মালতীর হুঁশ ফিরলে এই যে জোটন—যার যৌবন নেই শরীরে, যে পীরের দরগায় এসে গেছে এবং যার স্বভাব ছিল পান-সুপারি অথবা সামান্য খুদকুড়ার জন্য মালতীর বাড়ি ধান ভেনে দেওয়া, চিঁড়ে কুটে দেওয়া, সেই জোটনকে দেখে প্রথম মালতীর যেন হাতে আকাশ পাবার মতো অবস্থা। তার উপর কি মনে হতেই মালতী সব ভবিতব্য ভেবে শক্ত হয়ে গেল। এবং এখন মনে হচ্ছে জোটন ওর বড় শত্রু। বনবাদাড়ে সে কোথায় যে পড়ে ছিল মনে করতে পারছে না। কীভাবে এখানে এল তাও মনে করতে পারছে না, কেবল মনে পড়ছে সে হোগলার বনে ঢুকে লুকিয়ে ছিল। তারপর তিন জীব, মনুষ্যকুলের যেন তারা কেউ নয়, তাদের দেখে সে সংজ্ঞা হারিয়েছিল। তারপর এখানে এবং এটা জোটনের কাজ। সে আস্তানাসাবের দরগায় এখন। তাকে ওরা বনবাদাড়ে ফেলে চলে গেছে। এই জোটন ওর এত বড় শত্রুতা কেন করল! বনবাদাড়ে পড়ে থেকে এক সময় মরে গেলে অন্তত এ পোড়ামুখ আর দেখাতে হতো না কাউকে। সে জোটনের কথায় সেজন্য কোন উত্তর দিচ্ছে না।

ফকিরসাব দুধ এনে গাছতলায় বসে আছেন। এই দুধটুকু এখন গরম করে খেতে হবে। মালতীকে স্নান করতে হবে। মালতী হিন্দু বিধবা যুবতী। ভিজা কাপড়ে দুধটুকু গরম করে খেতে হবে। এই মাচান এবং ছই সব কিছুতেই এক অপবিত্র ভাব, মালতী জেগে গেলেই টের পাবে। জোটন ডাকল, ওঠ মালতী, তারপর সে বলতে চাইল, যেন উঠে স্নান করে আসে মালতী। কাঠ, নতুন সরা, দুধ সব ঠিক আছে, যেন গরম করে মালতী দুধটুকু খেয়ে নেয়। দুধটুকু গরম করে দিতে জোটন সাহস পাচ্ছিল না। কারণ হিন্দু বিধবার আচার-নিয়ম অনেক। জোটন সব ঠিক করে রেখেছে। কাঠ, উনুন, নতুন পাতিল সব। যেন বলার ইচ্ছা, এই যে মেয়ে তুমি এতকাল যৌবন বাইন্দা রাখছ, স্বপ্ন দ্যাখছ, সোয়ামির মুখ দেইখা মামদোবাজি খেলা খেলছ—আর এখন কিনা কিছু জান না। অর্থাৎ যেন বলার ইচ্ছা—কি আছে আর, যা হইবার হইছে। এডা ত আর হাড়ি-পাতিল না। এডা তো সোনার অঙ্গ। ছুঁইয়া দিলে জাত যায় না। কার জাত! তোমার না মানুষের? জোটন নানাভাবে মালতীকে বুঝ-প্রবোধ দিচ্ছিল।—ওঠ মালতী, উইঠা খা। দুধ গরম কইরা খা।

মালতী উঠল না। শক্ত হয়ে পড়ে থাকল।

জোটন ফকিরসাবকে বলল, কি করন যায়?

—কি করতে কন?

—নরেন দাসরে একটা খবর দিতে হয়।

—তবে দ্যান।

—আমি দিমু কি কইরা? আমি একলা যাইতে পারি! জোটন ক্ষোভের গলায় বলল।

—এই যে কইলেন, পানিতে নাও ভাসাইলে আপনে লগি বাইবেন। দুগ্‌গা ঠাকুর দ্যাখতে যাইবেন কইলেন।

—তামাশা রাখেন। কি করবেন কন!

—আমি কি কমু?

—যা মনে লয় করেন। বলে জোটন বিরক্ত মুখে ছইয়ের নিচে ঢুকে বলল, ওঠ মালতী। লক্ষ্মী, আমার সোনা। দুধ গরম কইরা খা। তারপরে ল তরে দিয়া আসি।

মালতী এবার বিস্ময়ের চোখে তাকাল।

—তরে দিয়া আমু।

মালতী ধড়ফড় করে উঠে বসল।

—আমি আর ফকিরসাব তর লগে যামু।

মালতী দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে থাকল। এ-পোড়ামুখ নিয়ে সে যাবে কী করে! সে ভিতরে ভিতরে হাহাকারে ডুবে যাচ্ছিল। না, না, আমি কোথায় যাব! কার কাছে যাব! আমি যেদিকে দু’চোখ যায় চলে যাব জোটন। আমি জলে ডুবে মরে যাব।

—কি হইছে তর? কিছু হয় নাই।

এই প্রথম কথা বলল মালতী।—আমি কই যামু?

ফকিরসাব এবার গাছতলা থেকে এলেন।—যাইবেন না তো খাইবেন কি? আমি ফকির মানুষ গাছপাতা খাইয়া বাঁচি, আপনেরে কোন্‌খান থাইকা দুধ ঘি আইনা খাওয়ামু?

মালতী এই মানুষের মুখ দেখে ভয়ে ফের বিবর্ণ হয়ে গেল। পাকা দাড়ি থেকে এখন জল টপটপ করে পড়ছে। ভিজা গামছা পরে বসে আছেন। হাতে গলায় বড় বড় পাথরের মালা। রসুন গোটার তেলে কাজল, সেই কাজলে সুর্মা টেনেছেন ফকিরসাব। জোটন ছইয়ের ভিতর বসে হাসছিল। ফকিরসাব তেড়ে আসার মতো মাচানের কাছে উঠে এলেন। বললেন, ওঠেন কইতাছি। ওঠেন। সান করেন, দুধ গরম কইরা খান। বুড়া মানুষ আমি, পানি ভাইঙা সাঁতার কাইটা দুধ লইয়া আইছি। তাইন এখন খাইবেন না?

মালতী নড়ল না।

ফকিরসাব এবার চোখ গরম করে চোখ লাল করে ভয় দেখালেন মালতীকে।—খাইবেন না আপনে! আপনের চোদ্দ গুষ্ঠি খাইব। বলে, ফকিরসাব আস্ত একটা কাঠ এনে বললেন, ওঠেন। আমি কিন্তু পাগল মানুষ। এহনে সান কইরা দুধ গরম কইরা না খাইলে আগুন লাগাইয়া দিমু।

জোটন ফকিরসাবের কথায় সায় দিল।—আ ল ওঠ তুই। পাগল ক্ষেইপা গেলে রক্ষা নাই। তুই না খাইলে সব ফিরা পাবি। পাইলে আমি তরে খাইতে কইতাম না। ওঠ।

ফকিরসাব বললেন, কার অঙ্গ! অঙ্গ আপনের, সোনার অঙ্গে কালি লাগলে ধুইয়া ফেলান। সোনার অঙ্গে কালি কতক্ষণ লাইগা থাকে! ঠাইরেন, গাঙ্গের পানিতে কত কিছু ভাইসা যায়, কিন্তু ঠাইরেন, মা জননীর কি কিছু হয়? যেন ফকিরসাবের বলার ইচ্ছা, মাগো জননী, নদীতে এঁটো থাকে না, বরফে এঁটো থাকে না। মাগো জননী, আপনেরা নিজের জলে নিজে ধুয়ে যান।

তবু মালতী উঠল না। ছইয়ের নিচে নেমে এল না! মাথা গুঁজে এক কোনায় বসে থাকল। জোটন ফকিরসাবকে বলল, কি করবেন। চোখ মুখ কই গ্যাছে গিয়া। ক’দিন না খাইয়া আছে কে জানে। কিছু ত কয় না।

ফকিরসাব বললেন, যাই একবার। পানি ভাইঙ্গা যাই। বড় মিঞার কোষা নাওটা আনতে পারি কি না দ্যাখি! তারপর চলেন আল্লার নামে তরী ভাসাই।

এক ক্রোশ পথ সাঁতার কাটলে ডাঙায় হাঁটলে সেই দুই-চার ঘর বসতি। পথে যেতে যেতে একবার বমি করলেন ফকিরসাব। এই বর্ষা এলে বড় অনটন ফকিরসাবের। দুই ছাগল, তার দুধ আর শাপলা শালুক। এখন জল সাঁতরে মুশকিলাসান নিয়ে যেতে পারেন না, যা কিছু পান ইন্তেকালের সময়। শাপলা শালুক খেয়ে পেট কেমন ভার হয়ে আছে।

কোষা নৌকা নিয়ে আসতে আসতে বেলা হয়ে গেল। ফরিকসাব কিছু খেলেন না। জোটন এক বদনা পানি ঢক ঢক করে খেল। দুধটুকু সঙ্গে নিল। সরা এবং কাঠ সব তুলে নিল পাটাতনে। একটা মাটির উনুন পর্যন্ত। সব ঠিক করে ফকিরসাব বললেন, ঠাইরেন, মা জননী, ওঠেন আইসা। ছাগল দুটোকে এনে মাচানের নিচে বেঁধে দরজা বন্ধ করে দিলেন।

এবার কিন্তু জোটন মালতীকে তুলতে গিয়ে দেখল, উঠতে পারছে না মালতী। কোমরে ভীষণ ব্যথা। রসুন গোটার তেল এক শিশি নিল সঙ্গে। মালতীকে বলে দিল এটা যেন বাড়িতে মালিশ করে। জোটন মালতীকে শক্ত করে ধরল। মাথা ঘুরে পড়ে যেতে পারে। কি চেহারা হয়ে গেছে! চোখমুখে কালি পড়ে গেছে। সোনার অঙ্গে কে আগুন ধরিয়ে চলে গেল! জোটন ভয়ে এখন মালতীর দিকে তাকাতে পারছে না। যেন আত্মহত্যার কথা ভেবে এই মেয়ে এখন বসে আছে। সুযোগ সুবিধা পেলেই আত্মহত্যার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে।

ভিতরে ভিতরে কষ্ট ফকিরসাবের। ফকির মানুষ বলেই অসুখ বিসুখ থাকতে নেই। জোটন এসে একদিনও মানুষটাকে অসুস্থ দেখেনি। এই সকালে পেটে এমন গণ্ডগোল—কিন্তু কারে বলা যায়? ভিতরে ভিতরে অস্বস্তি হচ্ছে, কি যে এই পেটের ভিতর হচ্ছে জ্বালা মতো এক ভাব, তিনি যেমন অন্য সময়ে লতাপাতার রস খান, তেমনি বনের ভিতর ঢুকে দু’হাতে পাতা কচলে মুখের ভিতর কিছু রস ফেলে দিলেন। এই রস খেলেই শরীরের সব যন্ত্রণা মরে আসবে। ধীরে ধীরে নিরাময় হবেন তিনি।

ফকিরসাব জোটনকে বললেন, আপনে দুধডা না হয় অন্য কিছু মুখে দিয়া লইতে পারতেন। আমার খিদা নাই।

জোটন বলল, কি কইরা খাই কন। মালতী খাইল না। আমি খাই কি কইরা!

ফকিরসাব এবার খোলামেলা জায়গায় মালতীকে ভালো করে দেখলেন। সত্যি ওকে ভালো দেখাচ্ছে না। ফিসফিস করে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে দিলেন, যেন জোটন ওকে ধরে বসে থাকে। লক্ষণ ভালো না! কী যে হবে! কী যে করা! এখন এই যুবতীর মাথা ঠিক নেই। পাগল পাগল চেহারা। যুবতী নারী সতী হলে যা হয়। নদীর পাড়ে ফকিরসাব বালক বয়সে এক নারীর সতী হবার গল্প শুনেছিলেন। গল্পের সেই চোখ-মুখের চেহারা এই মালতীর চোখে মুখে। সারাক্ষণ বসে বসে কেবল আত্মহননের কথা ভাবছে।

জোটন মালতীকে কোষা নৌকার মাঝখানে বসাল। ফকিরসাব মুশকিলাসানের লম্ফ নিলেন সঙ্গে। যখন বের হয়েছেন, দু’চারদিন কি দু’চার হপ্তাও হতে পারে। গাঁয়ে গাঁয়ে লম্ফ নিয়ে ঘোরা যাবে। কোষা নৌকা আনতে গিয়ে বলেছেন ফকিরসাব, যেমন বলে থাকেন, যামু একবার বিবিরে লইয়া, নদী-নালায় কয় রাইত ভাইসা থাকমু, তেমন এবারেও বললেন, লম্ফ নিয়া যাইতেছি পেটে টান পড়ছে বিবির। আর কি য্যান কয়, বিবি কয় বাপের বাড়ি দুগ্‌গা ঠাকুর দ্যাখতে যাইব। তা একবার দ্যাখাইয়া আনি। ফকিরসাব ইচ্ছা করেই মালতীর কোনও খবর কাউকে বলেননি। এমন খবর পেলে লোকজন ছুটে আসত দরগায়। তবে এই দরগাতেই থানা পুলিস আরম্ভ হয়ে যাবে। অথবা নাও হতে পারে। কারণ এখন জাত মান কুল নিয়ে কথা। মালতীর মুখে চোখে সেই জাত মান কুলের কলঙ্ক লেপ্টে আছে অথবা সে এক কলঙ্কিনী যেন—কী যে হয়, কী যে হয়, কী যেন তার কেবল জলে ভেসে যায়। রঞ্জিত, ছোট ঠাকুর, নরেন দাস এবং গ্রামের সকলে ওর চারপাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যেন। এই মেয়ে বনবাসে যাবে। এই মেয়ের জাত মান নেই। কলঙ্কিনী। এমন সব কথা মনে আসছিল মালতীর।

সহসা ফকিরসাব দেখলেন পাটাতনে মালতী অঝোরে কাঁদছে। এটা ভালো। কেঁদেকেটে আকুল হলে মনের সব গ্লানি মরে আসবে। আবার ধরণী সুজলা সুফলা মনে হবে।

মালতী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। যেন মনে মনে রঞ্জিতকে উদ্দেশ করে বলা, ঠাকুর, আমার সব হরণ কইরা নিছে। তোমারে কি দিমু ঠাকুর।

সারারাত শকুনের মতো তাকে নিয়ে কারা যেন কাড়াকাড়ি করেছিল। বোধহয় আকাঙ্ক্ষা সব জলের মতো মরে যাচ্ছিল। কেবল পিচ্ছিল রক্তাক্ত শরীরে কারা যেন সারারাত নৃত্য করে গেছে ভূতের মতো। তিন অমানুষ নরকে ডুব দেবার লোভে পশুর মতো হামলে পড়েছিল—আর সেই অসংখ্য কালো সরীসৃপ সারারাত ওর শরীরের ওপর হেঁটে বেড়াচ্ছিল। যার শেষ নেই, শেষ হবে না। আঁচড়ে কামড়ে, খাবলে খুবলে কোথা থেকে কোথায় যে টানতে টানতে নিয়ে গেল, মালতী এখন কিছুতেই তা মনে করতে পারছে না। কেবল মনে পড়ছে তারা সেই কবরভূমির অন্ধকারে মাংসের লোভে—কোনও শেয়াল যেমন মৃত মানুষের গন্ধে কবরে ঢুকে যায়—ওরা তেমনি পারলে ওর শরীরের ভিতর সদলবলে প্রবেশ করতে চেয়েছিল। মালতী এখন কষ্ট পাচ্ছে। হাত দিতে পারছে না। বসতে পারছে না মালতী। ফুলে ফেঁপে আছে. আর বেহুঁশ শরীরের উপর সেই সব দৃশ্য ভাবতেই গলা থেকে ওক উঠে এল।

ফকিরসাব দেখলেন মালতী ওক দিচ্ছে।

জোটন বলল, না খাইলে বমি হইব না, কন!

মালতী কেবল ওক দিচ্ছে। এখন আর অঝোরে কাঁদছে না। ধানখেতের ভিতর ফকিরসাব লগি মারছেন। লগি মারতে মারতে মাঠের ভিতর নেমে এলেন। সূর্য ক্রমে মাথার উপর উঠে আসছে। গায়ের জোব্বা খুলে নিয়েছেন। কেবল এক নেংটি পরনে ফকিরসাবের। গলায় এবং হাতের কব্জিতে, কনুইতে সেইসব পাথরের মালা তাবিজের শব্দ। এবং মনে হয় যেন এক প্রাচীন পুরুষ, তপোবনে মহর্ষি কণ্বদেব, শকুন্তলাকে নিয়ে রাজার কাছে যাচ্ছেন। যেকোনও ভাবে গ্রামে তাকে পৌঁছে দিতে হবে। ভিতরে ভিতরে হাঁসফাঁস করছেন, কিন্তু কাউকে কিছুতেই বুঝতে দিচ্ছেন না। বেহুশের মতো লগি মারছেন কেবল।

জোটন বলল, মালতী ইট্টু দুধ খা। মালতী, না খাইলে ত তুই মইরা যাইবি

মালতী কিছু বলল না। ওক দিতে দিতে পাটাতনে শুয়ে পড়ল।

এত দূরের পথ লগি মেরে এ বয়সে যে আর পার হওয়া যায় না, মাঠে নেমে যেন তিনি তা ধরতে পারছেন। সোজা পথে পাড়ি দিলেও রাত অনেক হয়ে যাবে। জল নেমে যাচ্ছে। ভাদ্র মাসের শেষ থেকেই জল নামতে শুরু করে। সোজা পথে যাওয়া যাবে না। মাঝে মধ্যে ডাঙা ভেসে আছে। মেঘনাতে পড়ে বাদাম দিলে পথ ঘুরতে হবে বেশি। তিনি বরং সনকান্দার পাশ দিয়ে নৌকা বাইবেন। গড়িপরদির মঠ পার হয়ে নদীতে পড়তে পারলে আর কষ্ট হবে না। জলে উজানি স্রোত মিলে যেতে পারে। তবু ভিতরে ভিতরে কষ্ট। জ্বালা। পাতার রসে পেটের জ্বালা মরছে না। কেমন গলা এবং বুক শুকিয়ে উঠছে।

জোটন বুঝতে পারছিল মানুষটার কষ্ট হচ্ছে। সে তামুক সাজল। মানুষটা তামুক টানলে আবার গতরে শক্তি পাবে। সে ফকিরসাবকে তামাক খেতে দিয়ে নিজেই লগি বাইতে থাকল।

জোটন বলল, মালতী ত দুধ খাইল না। আপনে খান। খাইলে বল পাইবেন। এত দূরের পথ না হইলে যাইবেন কি কইরা!

—না গ বিবি, তা হয় না। বলে ঢক ঢক করে বর্ষার জল তুলে এক গলা খেয়ে ফেললেন।

এই ফকিরসাব এবং জোটন মালতীর জন্য প্রাপণাত করে যাচ্ছে। দরগায় কোন্ অমানুষ ফেলে রেখে গেল মালতীকে, মালতী কিছুই বলছে না, কিছু বললে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। শরীরে অত্যাচারের চিহ্ন ভেসে উঠলে মালতী মাথা ঠিক রাখতে পারছে না। দরগায় এমন একটা কাণ্ড, ফকিরসাব মনে মনে নিজেকে অপরাধী ভাবলেন। তিনি তো রাতে কবরভূমিতে লম্ফ জ্বেলে ঘোরাফেরা করেন, দূরের মানুষেরা কবরভূমিতে সেই আলখাল্লা পরা মানুষের হাতে মুশকিলাসান দেখলে ভয়ে পালায়, আর কোথাকার কোন্ বেজন্মা মানুষ দরগা অপবিত্র করে রেখে গেছে। সব দায় যেন এখন ফকিরসাব আর জোটনের। মানুষ না মরলে, ইন্তেকাল না হলে ফকিরসাবের দাম বাড়ে না। দিনে দিনে তার অন্নাভাব বাড়ছে। দুধটুকু পাটাতনে রেখেছে জোটন। এত পীড়াপীড়িতেও দুধটুকু খাচ্ছে না মালতী। কি দামী আর মহার্ঘ বস্তু এই দুধটুকু। একটু দুধ উপচে পড়লে রাগে হাত-পা কাঁপছে ফকিরসাবের।

প্রথম ফকিরসাব ঘাট চিনতে ভুল করলেন। অনেকদিন তিনি এ অঞ্চলে আসেননি। নবমীর চাঁদ ডুবে গেছে। নিঝুম মনে হচ্ছে। আঁধারে ধানখেতের ভিতর সেই এক কোড়াপাখির ডাক। দূর থেকে—প্রতাপ চন্দের দুর্গোৎসবের ডে-লাইট চোখে পড়ছিল। এখন নাও সোনালী বালির চরে। চর থেকে ফকিরসাব আলো লক্ষ করে এগোচ্ছেন। চোখ-মুখ ঘোলা। হাত পা শিথিল হয়ে আসছে। অন্ধকারে হড়হড় করে বমি উঠে এসেছে। সবার অলক্ষ্যে তিনি বমি করে মুখ ধুলেন। যেন জলে কুলকুচা করছেন এমন শব্দ অন্ধকারে। গাছের ফড়িং ধানের ফড়িং অন্ধকারে উড়ে এসে পড়ছে। প্রতাপ চন্দের ঘাট পার হয়ে এসে নরেন দাসের ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে ফকিরসাব বললেন, আপনেরা নামেন।

মালতী সেই পাটাতনে শুয়েছিল আর ওঠেনি। কোথায় এই নৌকা ভেসে যাচ্ছে, কিসের উদ্দেশ্যে ফকিরসাব নৌকা বাইছেন, জোটন হাল ধরেছে, সে যেন বুঝতে পারছে না। ঘাটে এসে নৌকা ভিড়লেই ওর সংবিৎ ফিরে এল। আরে, এই ত সেই ঘাট! সে এখানে হাঁস ছেড়ে সকালবেলা বসে থাকত। মাথার উপর একটা কদম ফুলের গাছ। গাছে কি অজস্র ফুল ফুটে থাকে বর্ষায়। অথচ এই দু’তিনদিনে তার কাছে এরা সবাই যেন অপরিচিত, সে একটা নতুন দেশে এসে গেছে।

এমন আঁধারে সহসা খবর দেওয়ার একটা বিড়ম্বনা আছে। আজ কতদিন মালতী নিখোঁজ কে জানে। সহসা নেমে নরেন দাসকে ডাকলে সে হাউমাউ করে চিৎকার চেঁচামেচি করতে পারে। মালতীকে দেখলে পাড়ার লোক জড়ো করে ফকিরসাবকেই বেঁধে রাখতে পারে। তুমি তারে পাইলা কোন্‌খানে? আরে মিঞা, মনে মনে তোমার এই খোয়াব আছিল। শেষে উপকার করতে এসে দায়ে অদায়ে ফেঁসে যাওয়া। সুতরাং কাজটা নির্বিঘ্নে করার জন্য গা মুছে ফেললেন ফকিরসাব। মুশকিলাসানের লম্ফ থেকে—যা তিনি অন্য সময় হলে করতেন অর্থাৎ মুখে চোখে তেল কালি মেখে বীভৎস করে ভোলা—এসময়ে তিনি সেই সাজে সাজতে চাইলেন। যেন তিনি এই গ্রামে মালতীকে নিয়ে আসেননি, মুশকিলাসানের লম্ফ নিয়ে এসেছেন। বাড়ি বাড়ি উঠে যাবার মতো আলখাল্লা গায়ে দিয়ে সারা মুখে কালি লেপ্টে দিতেই চোখ দুটো বড় বড় আর লাল দেখাতে থাকল। তিনি এখন যথার্থ আর এ দুনিয়ার মানুষ নন। মালা তাবিজের ভিতর, কালো শতচ্ছিন্ন আলখাল্লার ভিতর, এখন এক হারমাদ মানুষ। হাতের মশালে ইচ্ছা করলে যেন এই গাছপালা, পাখি সব ভস্ম করে দিতে পারেন। অথবা তিনি যেন সেই মানুষ দুরে দূরে হেঁটে যান, হাতে মশাল, কিসের উদ্দেশ্যে তিনি যেন ক্রমাগত হেঁটে যাচ্ছেন। আশমানকে আলো দিচ্ছেন, দু’লাফে ইচ্ছা করলে সমুদ্রে চলে যেতে পারেন। প্রায় এখন এক অলৌকিক মানুষের মতোই টলতে টলতে হাতে লম্ফ নিয়ে দাসের বাড়ির দিকে উঠে যেতে থাকলেন। এখন তাঁকে মনে হয় এক মানুষ, সেই যেন চাঁদবেনের পুত্রবধূ অথবা ঈশা খাঁর সোনাইবিবির মতো এক কিংবদন্তীর মানুষ! নিশুতি রাতে এমন কে গৃহস্থ আছে যার বুক এই মানুষের হাঁকে না কেঁপে ওঠে। তিনি তখন যথার্থই আর মানুষ থাকেন না। রসুলের মতো যেন আকাশ মাটি এবং মাঠের অন্ধকার ভেদ করে উঠে আসেন। কিন্তু ফকিরসাব ভিতরে ভিতরে শক্তি পাচ্ছেন না। চোখে মুখে অন্ধকার দেখছেন। তবু রাতের আঁধারে সকলকে ভয় দেখাবার নিমিত্ত (হাতে পায়ে শক্তি নেই, পেটে যন্ত্রণা হচ্ছে) তিনি কিছুই পরোয়া না করে প্রায় মাটি ফুঁড়ে ওঠার মতো হেঁকে উঠলেন—মুশকিলা সা…ন আসান করে। মনে হল তাঁর যত জোরে হেঁকে ওঠার কথা ছিল, তিনি যেন গলা থেকে তত জোরে হাঁক দিতে পারলেন না। আরও জোরে, এ তল্লাটের সব মানুষের বুক কাঁপিয়ে হাঁক দিতে হয়—আমি এক মানুষ, যার নিবাস আস্তানাসাবের দরগাতে, যার কাম কাজ ইন্তেকালের সময় মোমবাতি জ্বালানো আর গাছের মগডালে আলো জ্বালিয়ে অলৌকিক এক জীবনের ভিতর ঘুরে বেড়ানো। মা জননীরা, জন্ম-মৃত্যুর মতো এই বেঁচে থাকাও অলৌকিক এক ঘটনা আর ঈশ্বরের মতো সুখদুঃখের জীবনে মুশকিলাসান আসান করে মা জননীরা বলে তিনি প্রায় যৌবনকালের মতো বুক চিতিয়ে হাঁটতে চাইলেন। কিন্তু পারলেন না। কিছুটা গিয়েই তিনি কেমন হাঁটু মুড়ে বসে পড়লেন। লম্ফটা তিনি কিছুতেই লাঠির ডগা থেকে নামাচ্ছেন না। ওঁর হাঁটু দুর্বল হলে লাঠি আর লম্ফতে তিনি শক্তি খোঁজেন। তিনি হামাগুড়ি দিতে পারতেন, দিলে ভালো হতো—ওঁর বমিটা বুঝি তবে হড়হড় করে আবার উঠে আসত না। কিন্তু বমিটা হড়হড় করে উঠে এলেই বিবি তাঁর দেখে ফেলবে, ফকির মানুষের আবার ব্যামো কি—তিনি তাড়াতাড়ি আলোটা মাথার উপর তুলে নিয়ে নিচে যে অন্ধকার মিলে গেল সেই অন্ধকারে বমিটা সেরে ফের এগুতে থাকলেন। জল আর শাপলা উঠে আসছে পেট থেকে। আশ্বিনের টানে পচা জল নামছে নদীতে, সেই জলের গন্ধ পর্যন্ত উঠে এল ওকের সঙ্গে।

নরেন দাস দরজা খুলে দেখতে পেল উঠোনের উপর ফকিরসাব। হাতে সেই মুশকিলাসান। উঁচু লম্বা মানুষ। মাথায় পাগড়ি। সাদা চুল, সাদা দাড়ি, মুখ কালো, চোখ লাল। আলোটা গনগন করে মুখের কাছে জ্বলছে। কেমন চোখ ঊর্ধ্বনেত্র। স্থির। বিড়বিড় করে মন্ত্র উচ্চারণের মতো গৃহস্থের মঙ্গলের জন্য নানারকমের বয়াৎ। লাল নীল হলুদ রঙের পাথর গলাতে ঝুলছে। সেসব পাথর চক্‌চক্‌ করছে। শোভা, আবু দরজার বাইরে বের হতে ভয় পাচ্ছে। পিসি নিখোঁজ হবার পর থেকে রাতে কোনও শব্দ হলেই ওরা জেগে যায়। নরেন দাসের চোখে ঘুম নেই। কারা যেন বাড়িটার চারপাশে ফিসফিস করে কথা বলে বেড়াচ্ছে।

নরেন দাস কাছে গেলে একটা কাঠিতে সামান্য কাজল তুলে টিপ দিল কপালে। দাস একটা পয়সা ফেলে দিল লম্ফের ভিতর। মাটির লম্ফ। ছোট ছোট মুখ লম্ফের। এক মুখে আলো, অন্য মুখে কাজল, এবং আর একটা মুখে পয়সা ফেলার ফোকর। নরেন দাস ফোঁটা নেবার জন্য আভারানীকে ডাকল, শোভা আবুকে ডাকল। ওরা ফোঁটা নিয়ে ঘরে ঢুকে গেলে খপ করে অন্ধকারের ভিতরে হাতটা চেপে ধরলেন ফকিরসাব–দাস, আপনের বইনের খোঁজ আছে।

—আমার বইনের খোঁজ!

—আছে। মা লক্ষ্মীকে আমি দরগার মাটিতে পাইছি।

—কি কন আপনে! অবিশ্বাসের ভঙ্গীতে চিৎকার করে উঠতে চাইল দাস।

—হ, পাইছি. মায় আমার বনদেবীর মত আর্তনাদ কইরা ছুটছিল। চিৎকার-বাঁচান বাঁচান। কেডা আছেন আমারে বাঁচান।

—আপনে বাঁচাইলেন!

—বাঁচাইলাম। বলেই আকাশ ফুঁড়ে দিতে চাইলেন যেন হাঁক,—পীর মানুষ দরবেশ মানুষ আমি, এই দ্যাখেন ফুস মন্তরে হাজির মা জননী, আমার সামনে হাজির। জননীরে কেউ অসতী করতে পারে নাই—ফকিরসাব মালতীর জন্যে মিথ্যে কথা বললেন। তারপরই সঙ্গে সঙ্গে ওক উঠে এল। লম্ফ উপরে তুলে দিলেন। নিচে ছায়া ছায়া অন্ধকার। নরেন দাস একটু দূরে দাঁড়িয়ে যেন তামাশা দেখছে। সামনে মালতী নেই। কেউ নেই। সাধু সন্ত পীরের সামনে যেন দানের প্রতীক্ষায় দাস দাঁড়িয়ে আছে এমন একটা ভাব মুখে। পীর সাহেব মুখটা আলখাল্লার ভিতর লুকিয়ে ওক দিয়ে কিসব বার করছেন, টক দুর্গন্ধে সামনে যাওয়া যাচ্ছে না।

এসব দেখে নরেন দাস কেমন হাবা গোবা মানুষ হয়ে গেল। ফকিরসাবের অনেক হিম্মতের গল্প সে শুনেছে। এবার সে এই হিম্মত দেখে বুঝি আশ্চর্য বনে যাবে। যা অবিশ্বাস্য, এই মানুষ বলছে মালতীকে পাওয়া গেছে। সে কেমন বিহ্বলভাবে আবুর মাকে ডাকছে, শুনছ আবুর মা, মালতীরে পাওয়া গেছে। ফকিরসাবের সামনে আছে। তুমি আমি দ্যাখতে পাইতাছি না।

নরেন দাসের চোখমুখ দেখে ফকিরসাব বুঝতে পারলেন ওর হাঁকডাকে কাজ হচ্ছে। রহস্যজনক ভাবে ওরা ফকিরসাবকে দেখছে। যেন মানুষটা এখন এইমাত্র আকাশ থেকে নেমে এসেছেন। উঠোনের উপর দাঁড়িয়ে ওদের ডেকে তুলে বলছেন—এই নাও মালতীরে। দিয়া গেলাম। লম্ফটা এত বেশি জ্বলছে যে মুহূর্তে এই বাড়িময় আগুন ধরে যেতে পারে, সবদিকে আলোতে আলোময়। কেবল পুবের দিকে ঠিক কুলগাছের নিচটা অন্ধকারে ডুবে আছে। ফকিরসাব পিছন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কুলগাছের নিচে অন্ধকারে মালতীকে ধরে জোটন দাঁড়িয়ে আছে।

ফকিরসাব পাওয়া গেছে কথাটাকে বিশ্বাস করানোর জন্য লা ইলাহা ইল্লাল্লার মতো অথবা বিসমিল্লা রহমানে রহিমের মতো বলতে থাকলেন, দাস মায় আমার বনদেবীর মত ছুইটা যায়, কি ত্বরিতে ছুইটা যায়! তখন নদীর জলে স্রোত থাকে না, তখন পাখি বনে কূজন করে না, ময়নামতির হাটে তখন দোকানি লম্ফ জ্বালে না–মায় আমার দাস, ছুইটা গ্যালে গ্রাম মাঠ গাছপালা পাখি সব হায় হায় করতাছিল। দাস, আমি তাইনরে তুইলা আনলাম।

মালতী কুলগাছের অন্ধকার থেকে সব শুনছে। জোটনের ফকিরসাব, মেলাতে বান্নিতে যে মানুষ গাজির গিদের বায়ানদারের মতো হেঁটে বেড়ায়, যে মানুষ পীর দরবেশ বনে যাবার জন্য মেলাময় ঘোড়দৌড়ের বাজিতে ছুটে বেড়ায়, সেই মানুষ অভাগী মালতীর জন্য মিছা কথা কয়।

আভারানী ঘর থেকে গলা বাড়িয়ে বলল, ফকিরসাব, তাইন কোনখানে? সামনে কিছু দ্যাখতে পাই না ফকিরসাব।

—আছে। যদি দোষ না নেন, হাজির করি।

নরেন দাস বলল, মিছা কথা কইবেন না ফকিরসাব। বিশ্বাস হয় না।

—হয়। বলে ফকিরসাব ডাকলেন, মায় কইগ আমার! বেলতলা কুলতলায় মায় আমার যেইখানে থাকেন একবার আবির্ভূতা হন মা। বলে লম্ফের সলতে উসকে দিতেই পেটে আবার কামড়। তলপেট শক্ত হয়ে আসছে। ক্রমে কুঁকড়ে যাচ্ছিলেন ফকিরসাব। কিছুতেই আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেন না। মনে হচ্ছে তাবৎ সংসারের ধর্মাধর্ম এই মুহূর্তে পেটের ভিতর বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তবু কোনও রকমে চোখ তুলে তাকালেন। হাসলেন জোরে। হাত-পা ছুঁড়ে বললেন, আসেন আসেন–‘মা জননী, আসেন। আসমানে থাকেন বাতাসে থাকেন নাইমা আসেন। প্রায় যেন ভোজবাজির খেলা দেখাচ্ছেন ফকিরসাব। এই গভীর রাতে কেউ যখন জেগে নেই তখন ফকিরসাব ভোজবাজির মতো নরেন দাসের উঠোনে খেলা দেখিয়ে দিলেন। প্রতিবেশীরা যে যার ঘরে। দীনবন্ধুর বৌ এবং দীনবন্ধু, ওর দুই ছোট-বড় বৌ টের পেয়েছে, ফকিরসাব মুশকিলাসানের লম্ফ নিয়ে এসেছেন। তখন দেবীর মতো মালতী উঠোনের অন্ধকারে হাজির। আলোটা ঘুরিয়ে দিতেই আভারানী এবং নরেন দাস দেখল, ক্লান্ত মালতী, চোখ বুজে আসছে মালতীর, যেন পড়ে যাবে মাটিতে—ওরা ছুটে গিয়ে ধরে ফেলতেই ফকিরসাব ফুঁ দিয়ে আলো নিভিয়ে দিলেন। সুড়ুৎ করে টপকে কুলগাছ পার হয়ে চলে এলেন ঘাটে। জোটন সঙ্গে সঙ্গে গাবতলা পার হয়ে ঘাটে চলে এল। ফকিরসাব কোনওরকমে বললেন, জলদি নাও ভাসান পানিতে। দেরি করবেন না।

অন্ধকার পাটাতনে মলমূত্রে কাপড় ভেসে যাচ্ছিল। ফকিরসাব কিছু বললেন না জোটনকে। পেট সাফ হয়ে নেমে যাচ্ছে। তারপর কেবল শুধু মল, মূত্রের দেখা নেই। জোটন দুর্গন্ধে বসতে পারছে না। নদীর মুখে নৌকা ছেড়ে দিতে পারলে ভাটি পাওয়া যাবে। ফকিরসাব সেই ভাটিতে নৌকা ছেড়ে দিতে বললেন। আর কিছু বলতে পারছেন না। ওলাওঠাতে এখন প্রাণ সাবাড়ের সময়। স্রোতের মুখে নাও ছেড়ে বসে থাকতে পারলে ভাটি পাওয়া যাবে। শেষরাতের দিকে আলিপুরা গ্রাম পাওয়া যাবে। বাকি ক্রোশের মতো পথ নিশ্চয়ই জোটন রাত শেষ হতে-না-হতে দরগায় টেনে নিয়ে যেতে পারবে। স্রোতে এসে নৌকা পড়তেই ফকিরসাব কিছু কথা বললেন জোটনকে লক্ষ করে—বিবি, আমার প্রাণপাত হইতাছে। আমারে আপনে রাইত থাকতে দরগাতে তুইলা দিয়েন। সকাল হইলে হাউমাউ কইরা কাইন্দেন না। আলিপুরায় খবর দিবেন, ফকিরসাবের রাইতে ইন্তেকাল হইল। যদি কয়, রাত কয়টায়?

জোটন বুঝতে পারছে না কেন এমন বলছেন তিনি। পাটাতনে এখন মানুষটা লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছে। হাত দিতেই বুঝল, আলখাল্লা, জোব্বা সব ভেসে যাচ্ছে। জোটনের ভিতরটা হায় হায় করে উঠল। সে বুক থাবড়ে বলল, রাইত কটায় কমু?

—রাইত দুই প্রহর শেষ না হইতে।

—তখন ত আপনে দাসের বাড়িতে আছিলেন।

—আপনের এত কথায় কাম কি বিবি। বলেই মানুষটার কথা বুঝি একেবারে বন্ধ হয়ে গেল।

জোটন হাউহাউ করে কাঁদতে চাইলে হাত তুলে ইশারায় ডাকলেন কাছে। জোটন মাথা কোলে নিয়ে বসে থাকল। নাও জলের টানে দ্রুত নেমে যাচ্ছে। শুধু হালটা কোনওরকমে এক হাতে ধরে আছে জোটন। অন্য হাতে ধীরে ধীরে জামা-কাপড় ছাড়িয়ে দিচ্ছে। ধুয়ে-পাখলে দিচ্ছে। খালি গায়ে মানুষটা লম্বা এই পাটাতনে হাত দুটো বুকে তুলে অপলক অন্ধকারে কি যেন দেখছেন। কাছে গেলে বললেন, কাইন্দেন না। ভাল না লাগলে দরগায় যাইবেন না। বলতে বলতে ফকিরসাবের গলা বসে আসছে।

অন্ধকারে নদীর জল ধূসর। গ্রামে মাঠে জোনাকি জ্বলছে। জোটনের কেন জানি মানুষটাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা হল। আকাশে কত নক্ষত্র জ্বলছে। অন্ধকারে কত সব নক্ষত্র যেন তাকিয়ে তাকিয়ে ফকিরসাবের ইন্তেকাল দেখছে। এতকাল থেকে এই মানুষ, এক মানুষ—দিন নাই রাইত নাই, মাঠে মাঠে বনে বনে অথবা অনাহারে দিন কাটিয়েছেন, কবে শোনা যায় কোন এক হত্যার দায়ে এই মানুষ তাঁর ঘর ছেড়েছিলেন। বিটি-বেটাদের ছেড়ে, জমি-বাড়ি গোলা এবং পুকুরের পাড়ে পাড়ে অর্জুনগাছ, ধানের গোলাতে পাখি উড়ে বেড়াত, সেই মানুষ খুনের দায় এড়াতে বরিশালের ভোলা অঞ্চল থেকে হেঁটে পাড়ি দিয়েছিলেন। তারপর দীর্ঘদিন সংগোপনে এখানে সেখানে বসবাসের পর—আস্তানাসাবের দরগাতে এক রাতের রাতযাপন। দূর থেকে মানুষেরা এসেছিল কবর দিতে। কবরের কিছু মোমবাতি তিনি তুলে এনে এই বনের ভিতর ঘুরতে ঘুরতে কখন রাজাবাদশার মতো, মনে মনে এক ইচ্ছা পূরণের পালা। দিন যায় রাত যায়, বনের পাখপাখালি এবং গাছপালা বৃদ্ধ মানুষটার কাছে ক্রমে দোসর হয়ে যায়। তিনি একটা কুঁড়েঘর বানিয়ে ফেললেন। রবিশালের কোথায় নিবাস ছিল মনে থাকল না। তিনি একটা মাটির লম্ফ সংগ্রহ করলেন। কিছু হাদিস এবং ধর্মাধর্মের ছোট বড় কথা কী করে যেন গড়গড় করে বলে ফেলতে পারলেন। তারপরে মানুষটা আর খুনী মানুষ থাকলেন না। ফকির মানুষ বনে গেলেন।

এই মানুষের এখন ইন্তেকাল হচ্ছে। জোটন বলল, আপনের ডর নাই। ফকিরসাব আপনে মানুষ আছিলেন না, পীর আছিলেন। এই বলতেই কেমন সাহস এসে গেল তার প্রাণে। এই মানুষকে রাতে রাতে দরগায় হাজির করতে হবে। ঠিক যেখানে বড় নিমগাছটা আছে, উঁচু মতো ভিটা জমি, তার উপর শুইয়ে রাখতে হবে। যারা আউশ ধান কাটতে এদিকে আসবে নৌকা নিয়ে তারা দেখবে জোটন গাছের নিচে এক মরা মানুষ নিয়ে জেগে আছে। কে এই মানুষ!—এই মানুষ ফকিরসাবের। রাইতের বেলা ইন্তেকাল হইল। রাইতে মানুষটা নিজের ভিতর ডুব দিলেন। এই বয়স পর্যন্ত মানুষটার কোন রোগ-শোক জরা ছিল না। শেষ বয়সের এই জরাকে প্রশ্রয় দিতে নেই। কিছুই যেন হয়নি, জোটন তাঁকে ধুয়ে পাখলে একেবারে নতুন মানুষ করে ফেলল। শরীরে কোন মল-মূত্রের গন্ধ থাকতে দিল না। ওলাওঠাতে প্রাণ গেছে বুঝতে দিল না। এইবেলা জোটনের কসম, আপনে পীর বইনা গ্যালেন ফকিরসাব!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *