প্ৰথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড

নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – ২.১২

২.১২

সুতরাং এ অঞ্চলে আবার দুটো খবর কিংবদন্তীর মতো ছড়িয়ে পড়তে থাকল। হাটে মাঠে এখন এ-দুটো খবরই। প্রথম খবর, এ-অঞ্চলের মহিমামণ্ডিত মানুষ দেহরক্ষা করেছেন। দেহরক্ষার আগে তাঁর তিন পুত্রকে সজ্ঞানে বলে গেছেন, শ্রাদ্ধের মলিক হবে ভূপেন্দ্রনাথ। মণীন্দ্রনাথকে তিনি কিছু বলেননি। পাগল ছেলের দিকে শুধু মুহূর্তের জন্য অপলক তাকিয়ে ছিলেন। বলে গেছেন, সে বড়, শ্রাদ্ধের মালিক তারই হবার কথা। কিন্তু পাগল বলে শ্রাদ্ধের মন্ত্র পড়ার পাঠ তিনি ভূপেন্দ্রনাথকে দিয়ে গেছেন। আর বলেছেন, বিষয়সম্পত্তি যা আছে সব তোমাদের। কেবল বড়বৌ এবং মণীন্দ্রনাথ ভরণপোষণ পাবে। পলটু সাবালক হলে তাকে সম্পত্তির উত্তরাধিকার দেওয়া হবে। যতদিন না হচ্ছে ততদিন ভূপেন্দ্রনাথই এদের হয়ে দেখাশোনা করবে। এবং উইলের যাবতীয় মুসাবিদা তিনি তাঁর সিন্দুকে করে রেখে গেছেন। মৃত্যুর পর সেটা বের করে যেন দেখা হয়।

আর খবর ফেলুর বিবির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ফেলুর সারা গায়ে ঘা ফুটে বের হয়েছে। এবং ঘাগুলো আগুনের মতো দপদপ করে জ্বলছে। অন্ধকারে যারাই ওকে দেখেছে তারাই ভয় পেয়ে গেছে। কী হয়ে গেছে ফেলু! চুল খাড়া। দাড়ি শণের মতো, চোখ আরও কোটরাগত। ঘাড়টা মোষের মতো ছিল, এখন কী করুণ চেহারা ফেলুর! সে ঘর থেকে বের হয়ে নানা জায়গায় বিবিকে খুঁজেছে। গোয়ালে থাকতে পারে, না নেই। বাঁশঝাড়ের নিচে থাকতে পারে, তাও নেই। মাঠে নেমে গেল! না নেই, ওর কেন যে মন মানছে না, সে খুঁজে মরছে। এমন নিষ্ঠুর নিয়তি তার, জেনেও সে বিশ্বাস করতে পারেনি। হাজিসাহেবের বাড়িতে সে ঢুকতে পারে না। সে পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে ডাকল, আন্নু। না, কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। কোথাও কোনও বনঝোপে লুকিয়ে থাকতে পারে—হাহা করে হেসে উঠতে পারে—এই আমার মরদ, একটু না দেখলেই চক্ষু অন্ধকার! সে জোরে জোরে ডাকল, আকালুদ্দিন সাহেব আছেন! জবাব নেই। সে চিৎকার করে উঠল, আন্নু আছস! বার বার সে পাগলের মতো এখানে সেখানে ডাকছে, আছস নাকি! আমি ফ্যালা! আমার আর কি থাকল ক দিনি! খোদা, তুই ক। আমি পারি না তর দরবারে আগুন লাগাইতে। আমি কি যে না পারি আল্লা!

এ ভাবে এ-অঞ্চলে সূর্য উঠে গেল আকাশে! হাল- বলদ নিয়ে চাষীরা মাঠে নেমে যাচ্ছে। খর তাপে আবার বসুন্ধরা জ্বলতে থাকল। চারদিক খাঁ খাঁ করছে। বৃষ্টি নেই। এখনও কালবৈশাখী আরম্ভ হল না। নদীর পাড় ধরে কাতারে কাতারে মানুষ আসছে। ওরা খবর পেয়েছে, এক মহিমামণ্ডিত মানুষ ধরাধাম ত্যাগ করেছেন। পুকুরের পাড়ে দাহ করা হবে। মানুষজন সব এখন জড়ো হচ্ছে ক্রমে।

ফেলু আর পারল না। সে কেমন কঠিন এবং শক্ত হয়ে গেল। অঞ্চলের সব মানুষ যখন একজন বুড়ো মানুষের মৃত্যু-সংবাদ শুনে ছুটছে ঠাকুরবাড়ি তখন তার পিয়ারের বিবিকে নিয়ে পালিয়েছে আকালুদ্দিন। মামলা-মোকদ্দমার নাম করে সে শহরে পালিয়েছে। সে আর দেরি করল না। শহরে যাবার আগে এইসব গ্রাম মাঠ খুঁজে যাবে। সে জানে বিবিকে সে আর ঘরে তুলতে পারবে না। বিবি তার না-পাক, আকালু নিকা করে আবার তাকে পাক (পবিত্র) করে নেবে। মিঞা, তুমি আকালু আর আমি ফেলু। আমার বিবিরে নিয়া যাবে কোনে!

প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে শুকনো পাতার মতো অসহায় দেখাচ্ছে ফেলুকে। কেউ সমবেদনা জানাচ্ছে না। ফেলুর এমনই হবে যেন কথা ছিল। তার চেহারা দেখে কেউ কাছে যেতে সাহস পাচ্ছে না। শুধু সে দেখল, হাজিসাহেবের যণ্ডটা এদিকে উঠে আসছে। ওর পথের উপর দাঁড়িয়ে আছে। সে এক হাত সম্বল করে কিছুই করতে পারবে না। সুতরাং সে সাপে-বাঘের খেলার মতো খেলতে খেলতে বাড়িতে উঠে এলে জমিতে যণ্ডটা দাঁড়িয়ে থাকল। ষণ্ডটা ফেলুর বাড়িতে উঠে আসতে ভয় পায়। ফেলু ঘরে ঢুকে বাতা থেকে কোরবানীর চাকুটা বের করে নিল।—মিঞা আকালু, তোমার খোঁজে, বিবির খোঁজে বার হইলাম। ঠিক মহরমের দিনের মতো আবার তরবারি ঘুরামো।

সে সামনে কখনও দেখতে পাচ্ছে যণ্ডটা ওর প্রতিপক্ষ, কখনও আকালু, কখনও পাগল ঠাকুর। সে খোঁচা মারছে হাওয়ায়, দু’পা পিছিয়ে যাচ্ছে, আবার সামনে নেচে নেচে হাত ঘুরিয়ে, সামনে-পিছনে হাত রেখে উঠে বসে, যথার্থ খেলা। সে হাওয়ার সঙ্গে ধর্মযুদ্ধে মেতে গেছে। জমি থেকে ষণ্ডটা উঠানের উপর ফেলুর এমন কাণ্ড দেখে দে ছুট। বিবি পালিয়ে গিয়ে ফেলুকে পাগল করে দিয়েছে, হাতে তার কোরবানীর চাকু। হাওয়ার সঙ্গে সে যুদ্ধে মেতে গেছে।

যারাই ওর বাড়ির পাশ দিয়ে গেল ফেলুর এমন কাণ্ডকারখানায় হাসতে পর্যন্ত সাহস পেল না। হাসলেই সে নেমে এসে পেটে খোঁচা মারবে চাকুতে।—কি মিঞা, কেমন মজা লাগে! বিবি আমার ঘরে নাই বইলা তামাশা দ্যাখতাছ?

কেউ কথা বলেেছ না বলে সে আরও ক্ষেপে যাচ্ছে। ক্ষেপে যাচ্ছে মাছির তাড়নায়। ভনভন করে সব সময় চারপাশে মাছি উড়ছে। সে যেন মৃত পচা জন্তু। হাতের ঘা থেকে সেই পচা দুর্গন্ধ ওকেও মাঝে মাঝে ক্ষেপা ষাঁড়ের মতো করে দেয়। সে তখন কী করবে, ভেবে উঠতে পারে না। কিছুক্ষণ কাফিলা গাছটার নিচে বসে থাকল। আঠার গাছ এটা। খাঁ খাঁ করছে রোদ, আঠা শুকিয়ে গেছে। ওর কোনও হুঁশ নেই। শরীরে যে অজস্র জোনাকি জ্বলছে তা পর্যন্ত তার খেয়াল নেই। সে বসে বসে মাছি তাড়াচ্ছে এখন। কোরবানীর চাকুটা সে আমূল বসিয়ে দিচ্ছে মাটিতে। কখনও তুলে এনে কাফিলা গাছের কাণ্ডে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। এই এক হিংস্র খেলা তার এখন। জাফরি ওর দিকে তাকিয়ে তেমনি জাবর কাটছে। সে জানে, এখন কোথাও ঘাস নেই। তবু কোথাও জাফরির খোঁটা পুঁতে দিয়ে বের হবে। কখন ফিরবে ঠিক কি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *