প্ৰথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড

নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – ১.৩

১.৩

সম্পর্কে জোটন বিবি আবেদালির দিদি হয়।

সেই জোটন শোলার ছোট্ট ঝাঁপটা টেনে ঘর থেকে মুখ বার করল। এখনও ভোর হয়নি। সারা রাত জোটনের চোখে ঘুম নেই। মসজিদে সামু আজান দিচ্ছে, জোটন ঘরে বসে অন্ধকারে ছেঁড়া হোগলা এবং ছেঁড়া কাঁথাটা ভাঁজ করে এক পাশে রেখে দিল। অন্ধকার কাটছে না, সুতরাং ঘরের আসবাবপত্র অস্পষ্ট—শিকাতে দুটো হাঁড়ি, দুটো সরা—দু’দিন থেকে জোটনের ভাত নেই, দু’দিন ধরে জোটন শালুক সিদ্ধ করে খাচ্ছে। সে অন্ধকারে বসে শালুকগুলি খেতে থাকল। শুকনো বলে গলায় আটকাচ্ছে—একটু জল খেল জোটন। আবার দরজা ফাঁক করে যখন আকাশ দেখল—আকাশ পরিষ্কার, মোরগেরা ডাকছে—জোটন দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াল।

মসজিদের ওপাশটায় সূর্য উঠছে। আবেদালি বদনা হাতে মাঠ থেকে উঠে এল। আবেদালির বিবি জালালি পাতা দিয়ে উঠোনের এক কোনায় ভাত রান্না করছে। আবেদালিকে দাওয়ায় বসতে দেখে জোটন বলল, কি রে, মানুষটা ত কাইল আইল না।

না আইলে আমি কি করমু। আবেদালি জোটনের এই ইচ্ছায় বিরক্ত। তিন তিনবারের পর ফের নিকাহের শখ!

দু’দিন না খেয়ে জোটনও ভয়ানক হয়ে উঠেছে। সে আবেদালিকে বলল, দন্দি যাওনের সময় মানুষটার খোঁজ কইরা যাবি। মানুষটা বাইচা আছে, না, মরছে কবি আইয়া!

কমু গ কমু! আবেদালি দেখল জোটনের মুখ ভয়ানক শুকনো। দু’দিন না খেতে পেয়ে জোটনের চোখ কোটরাগত। বলল—তুই দুফরে আমার ঘরে খাইস। আবেদালি এবার জালালির মুখটা দেখল। সূর্য উঠছে বলে রোদের রঙ জালালির খড়খড়ে মুখটা আরও খড়খড়ে করে দিচ্ছে এবং আবেদালির এমত কথায় জালালির মুখটা রাগে ফোটকা মাছের মতো ফুলতে থাকল।—আরে, আরে, করতাছস কি। তর গাল যে ফাইট্টা যাইব!

জোটন বুঝতে পেরে বলল, না রে থাউক। আমার খাওয়নের লগে কি আছে!

আবেদালি বুঝল জোটন খাবে না। সে দেখল, জোটন উঠোন থেকে নেমে যাচ্ছে। জোটন রাস্তায় নেমে গেল এবং সড়ক ধরে হাঁটল না। যেখানে এখনও ধান খেতে জল আছে অথবা খেতের আল জাগছে সেই সব পথ ধরে কী যেন খুঁজতে খুঁজতে চলেছে।

জোটন এই সব নরম মাটির আশ্রয়ে কচ্ছপের ডিম খুঁজছে। এ সময়ে কচ্ছপেরা ডিম পাড়বে মাটির আলে। জোটন এসময়ে এই সব মাটির আশ্রয় থেকে ডিম বের করে পশ্চিমপাড়া উঠে যাবে ভাবল এবং ডিমগুলি দিয়ে বলবে, আমারে এক টুকরি চাইল দিয়েন। সে এক দু’করে বিলের জমির অনেক আল ভাঙতে থাকল। সূর্য বিশ্বাসপাড়ার ফাঁক দিয়ে অনেক উপরে উঠে যাচ্ছে। ধান গাছের শিশির, ঘাসের শিশির, লাই খেতের শিশির সব বিন্দুবৎ হয়ে পড়েছে এবং ইতস্তত রোদের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। মানুষটা গতকাল এল না, সে পুঁটলি বেঁধে বসে ছিল, মৌলভি সাবকে বলা ছিল, সাক্ষী ঠিক ছিল—অথচ মানুষটা এল না। মুশকিলাসান নিয়ে মানুষটা উঠোনে উঠে ডেকেছিল একদিন, এটা আবেদালির বাড়ি না? আবেদালি, জালালি এবং সকলে ফোঁটা নিয়েছিল—জোটনও উঠেছিল, ফোঁটা নিয়েছিল— পীরের দরগায় লোকটা থাকে। উঁচু, লম্বা গোটা গোটা চোখ—নাভির নিচে দাড়ি নেমে গেছে, গায়ে শতচ্ছিন্ন জোব্বা, মাথায় ফেটি এবং গলায় বিচিত্র রকমের মালা-তাবিজ। জোটন ফকির মানুষটার মহব্বতের জন্য প্রথম দর্শনে বিস্মিত এবং শীতের নরম রোদ যেন তাকে গভীর রাত পর্যন্ত আচ্ছন্ন করে রেখেছিল সেদিন।

জোটন আলের ধারে ধারে তীক্ষ্ণ নজর রেখে হাঁটছে। কচ্ছপের ডিম এখানে নেই, সে হাঁটতে থাকল। সে ইতস্তত তাকাল এবং কয়েকগুচ্ছ ধানের ছড়া শামুকে কেটে কাপড়ের নিচে লুকিয়ে ফেলল। ওর পাশ দিয়ে কামলারা অন্য জমিতে উঠে যাচ্ছে—জোটন বসে পড়ল—যেন সে যথার্থই কচ্ছপের ডিম সংগ্রহ করছে। সে উঠছে না। কামলারা অন্য জমিতে এখন ধান কাটছে। জোটন ধান কাটছে না। হাতের ধারালো শামুকটা সে পেটের নিচে গুঁজে রেখেছে। জোটন অন্য জমিতে কামলাগুলিকে দেখার জন্য গোড়ালিতে ভর করে উঁকি দিল—জমিটা কার স্থির করার ইচ্ছায়। দূরে গরুগুলিকে জলে নেমে যেতে দেখল—মানুষটা এল না, সেই মুশকিলাসানের মানুষটা। তেরটি সন্তানের জননী জোটন আবার মা হবার জন্য এই আলে দাঁড়িয়ে কেমন ছটফট করতে থাকল। চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ বছরের রমণী জোটন খোদাকে যেন এই ধানের জমিতে খুঁজছে—খোদার মাশুল উঠছে না গতর থেকে এমন ভাব এখন।

দু’দিন পেটে ভাত নেই—আফশোস। দু’দিন হাইজাদির বিলে গ্রামের অন্য অনেকে দুঃখী ইমানদারদের সঙ্গে শালুক তুলেছে, দুঃখী হলেই ইমানদার হবে, খোদাকে স্মরণ করবে—এমনও একটা বিশ্বাস আছে জোটনের। এই যে এখন জোটন শামুকের ধারালো মুখটা দিয়ে কট করে আর একটা ধানের ছড়া কাটল এবং কোঁচড়ে লুকিয়ে ফেলল—যেন পেটের খিদে ভয়ানক দুঃসহ, খোদার কাছে নিজের গোনাগারের জন্য জোটন মোনাজাত করল—হায়রে খোদা, পেটের জ্বালায় সব হয়। সুতরাং জমির মালিককে যেন বলার ইচ্ছা, ভয় করার কিছু নেই, আর কিছু না হোক, জোটনের ইমান আছে। তোমার শক্ত ধানের ছড়া কাটছি না, আলের উপর যেসব ছড়া নুয়ে আছে শামুকের ধারালো মুখে তাই কেটে নিচ্ছি। হাসিমের বাপ নয়াপাড়ার নিমগাছ অতিক্রম করলে জোটন কট করে আরও একটা ধানের ছড়া কেটে কোঁচড়ে লুকাল। এবং এ-সময় মালতীর কথা মনে হল। নরেন দাসের ছোট বোন মালতী বিধবা হয়ে বাপের বাড়ি ফিরে এসেছে। বিধবা মালতীর টানে জোটন পুবের বাড়ির বোন্না গাছটার ফাঁক দিয়ে নরেন দাসের তাঁতঘর দেখল। তাঁতের শব্দ শুনতে পাচ্ছে—মাকুর শব্দ এবং চরকার শব্দ। জোটন কট করে তার ধানের ছড়া কাটতেই পিছন থেকে কে যেন চিৎকার করে উঠল—এই জুটি, মাথার খুলি ভাইঙ্গা দিমু।

জোটন মুখ ঘুরিয়ে দেখল ঈশম আসছে। সে কাঁচুমাচু হয়ে বলল, না ঈশম ভাই, আমি এহানে কিছু করতাছি না।

—তুমি আসমান দ্যাখতাছ। যা বাড়ি যা। কথা বাড়াইস না।

সুতরাং বাড়ি উঠে যাওয়ার মতো করেই জোটন হাঁটতে থাকল, কিন্তু যেই ঈশম মসজিদের কুয়াতে জল তোলার জন্য বালতি নামাল—জোটন টুক করে আলের পরে বসে গাছের ছায়ায় নিজেকে ঢেকে ফেলল। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে যেতে যেতে দেখল এক জায়গায় হাত লেগে মাটি সরে গেছে এবং সাদা গোল গোল ডিম বের হয়ে পড়ল। জোটন কী খুশি! সব আল্লার মর্জি। জোটন এবার উঠে দাঁড়াল। ইমান এবং মুশকিলাসানের লম্ফটা ওকে উষ্ণ করছে। দূরে দূরে সব ধান কাটা হচ্ছে। ধানের আঁটি বাঁধছে মুনিষেরা, ওরা গাজীর গীত গাইছে। দূরে দূরে গানের স্বর তরঙ্গ, নরেন দাসের বিধবা বোন মালতী এবং গতরাতের নিষ্ফল প্রতীক্ষা জোটনকে কাতর করছে। মালতীর বিয়ে হবে না, বাকি জীবন গতর কোনও মাশুল দেবে না—আল্লা নারাজ হবে। এই গতর মাটির মতো পতিত ফেলে রাখলে গুনাহ্। জোটন এই জন্যই মালতীর জীবনকে, ধর্মকে না-পাক কাফেরের মতো ভাববার ইচ্ছায় শরীরের জড়তা কাটাতে গিয়ে দেখল, বোন্না গাছের নিচে মালতী চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ওর শরীরে সাদা থান ভোরের হাওয়ায় উড়ছে। জোটন মালতীকে দেখে তাড়াতাড়ি সব ক’টা ডিম ভিজা মাটির ভিতর থেকে তুলে আঁচলে বেঁধে ফেলল।

অন্যদিন হলে জোটন মালতীর সঙ্গে অন্তত কিছু কথা বলত। কিন্তু আজ মালতীর এই নিঃসঙ্গতা যথার্থই ওকে গীড়িত করছে। এক অহেতুক অপরাধ-বোধে মালতীর সঙ্গে সে কোনও কথাই বলতে পারল না। জোটন এই পথ ধরেই গেল—অপরিচিতের মতো তামুকের খেতে উঠে গেল। দেখল, মালতী বোন্না গাছ পার হয়ে লটকন গাছের নিচ দিয়ে পুকুরপাড়ে দাঁড়াল এবং হাঁসগুলিকে জলে সাঁতার কাটতে দেখে কোন আনমনা হয়ে গেল।

জোটন আর দাঁড়াল না। এখানে দাঁড়ালে কষ্টটা বাড়বে। তারপর শালুক খেয়ে শরীরে শক্তি পাচ্ছে না। সে তাড়াতাড়ি নরেন দাসের বাড়ি পার হয়ে গ্রামের রাস্তায় হাঁটতে থাকল। বকুল গাছটা অতিক্রম করে ঠাকুরবাড়ির সুপারি বাগান। সে সন্তর্পণে বাগানে ঢুকে গাছতলায় সুপারি খুঁজতে থাকল। সে খুঁজে খুঁজে কোথাও যখন একটাও সুপারি পেল না, সে গাছের মাথার দিকে তাকাল এবং প্রার্থনার ভঙ্গিতে বলল, আল্লা একটা গুয়া দ্যা। সব গাছগুলির মাথায় সুপারি ঘন এবং হলুদ রঙের। হলুদ রঙের এই সুপারির খোসা ছাড়িয়ে একটা পান মুখে দেবার বড় শখ জোটনের। সে দেখল একটা কাঠঠোকরা পাখি এ-গাছ ও-গাছ করছে। আহা রে, আল্লা রে, একটা দ্যা না রে। তখনই বুড়ো ঠাকরুণের গলা শুনতে পেল সে। জোটন চুপচাপ বাগানের পাশে ঘন লটকন গাছের জঙ্গলে নিজেকে লুকিয়ে ফেলল। জোটন অনেক্ষণ এই ঝোপের ভিতর পাখিটার বদান্যতার জন্য বসে থাকল। পাখিটা উড়ছে, জোটন ঝোপের ফাঁক দিয়ে দেখতে দেখতে উত্তেজিত হতে থাকল। পাখিটা সুপারির ওপর এবার ঘন হয়ে বসল, দুটো ঠোকর মারল এবং সঙ্গে সঙ্গে তিন চারটা সুপারি গাছের গোড়ায় ছড়িয়ে পড়ল—য্যান মাণিক্য। যেন জোটনের সমস্ত দিনের ইচ্ছা এখন এই গাছটার ছায়ায় রূপ পাচ্ছে। জোটন চারপাশটা ভালো করে দেখল! পুকুরঘাটে বুড়ো ঠাকরুণ স্নান করছে। সে সব দেখছে, অথচ তাকে কেউ দেখতে পেল না। সে তাড়াতাড়ি গাছটার নিচে ছুটে গেল। সুপারি তিনটা আঁচলে বেঁধে সে হাঁটছে। সে বৈঠকখানা পার হয়ে ঠাকুরবাড়ির ভিতর ঢুকে গেল। ডাকল—বড় মামি আছেন নাকি? বলতে বলতে সে পাছদুয়ারে ঢুকে আঁতুড়ঘরের সামনে দাঁড়াল। বলল, ধনমামি, একবার মানিক রে দ্যাখান। মানিকের লাইগ্যা কাছিমের ডিম আনছি। বড়মামিকে দেখে বলল, কাছিমের ডিম রাইখ্যা এক টুকরি চাইল দ্যান। চাল পেলে বলল, দুইডা পান নিমু বড়মামি

—নে গা। গাছতলায় মেলা পান পইড়া আছে।

জোটন চালগুলি আঁচলে বাঁধল। এবং বড়ঘরের পিছনে ঢুকে আলকুশী লতার কাঁটা ঝোপ পার হয়ে একটা শ্যাওড়া গাছের নিচে দাঁড়াল। পানের লতা গাছটাকে জড়িয়ে আছে, সে দুহাতে যতটা পারল পান কুড়িয়ে নিল, ছিঁড়ে নিল। সে বাড়ির ওপর দিয়ে গেল না। সে আলকুশী লতার ঝোপ ভেঙে মাঠে নেমে গেল। জল-কাদা ভেঙে ফের পুবের বাড়ির পুকুরপাড় ধরে ধান খেতের আলে উঠে যাবার সময় দেখল, মালতী আকাশ দেখছে। জোটন এবার মালতীকে ফেলে চলে যেতে পারল না। সে একটু হেঁটে এসে মালতীর পাশে চুপ করে বসল। ডাকল—মালতী!

মালতী কথা বলল না। মালতী কাঁদল। জোটন মালতীর মুখ দেখতে পাচ্ছে না অথচ বুঝল মালতী চোখের জল ফেলছে। জোটন ফের ডাকল, মালতী কান্দিস না। কাইন্দা কি করবি। সব নসিব মালতী।

জোটন উঠে পড়ল। মেয়েটা শোকে কাঁদছে, কাঁদুক। ওর তিন নম্বর খসমের কথা স্মরণ করতে গিয়ে গলা বেয়ে একটা শোকের কান্না উঠে আসতে থাকল। বেলা বাড়ছে। পেটে প্রচণ্ড খিদে। যে চাল আছে জোটনের দু’ওক্ত হয়ে যাবে। সে হাঁটবার সময় গোপাট থেকে কিছু গিমা শাক সংগ্রহ করল। তারপর আবেদালির ঘর অতিক্রম করে উঠোনে উঠেই তাজ্জব বনে গেল—যে মানুষটা কাল রাতে আসেনি, যে মানুষটার জন্য সে প্রায় সমস্ত রাত জেগে বসে ছিল, সেই মানুষটা ছেঁড়া মাদুরে নামাজের ভঙ্গিতে বসে তফন সেলাই করছেন। নীল কাঁথার মতো ঝোলা, মুশকিলাসানের লম্ফ, ভিন্ন ভিন্ন সব তাবিজের মালা, কুচ ফলের মালা, এবং পুঁতির হার—এই সব বিচিত্র বস্তুর সমন্বয়ে এখন ফকির সাব যেন ঘোড়দৌড়ের পীরের মতো।

জোটন ফকির সাবকে দেখে বলল, সালেমালেকুম।

ফকির সাব এতক্ষণে জোটনকে দেখতে পেলেন এবং বললেন, ওয়ালেকুম সেলাম।

জালালি ঘরের কোণে ঘোমটা টেনে বসে আছে। জোটনেরও ইচ্ছা হল এ সময় বড় ঘোমটা টেনে ছোট ঘরটায় বসে থাকে। কিন্তু খিদমতের অসুবিধা হবে ভেবেই যেন শরমের জন্য দিল খুলে দিতে পারল না। সেই জালালির ঘরে ঢুকে বলল, মানুষটা খাইব, কি যে খাওয়ামু!

জোটনের ফিসফিস কথা ফকির সাব শুনতে পেলেন।—আমার জন্য ভাইবেন না। দুইডা শাক-ভাত কইরা দ্যান। দেখেন, নিশ্চিন্তে ক্যামনে খাইয়া উঠি।

জোটন বলল, জালালি, দুইটা পুঁটির সুঁটকি দ্যা।

জোটন রান্নার জন্য, শোলার-পারা থেকে এক আঁটি শোলা নামিয়ে আনল। ঘরের পিছনে শোলাগুলিকে মড়মড় করে ভাঙল এবং ভাঁজ করে ঘরে ঢুকতে দেখল—ফকির সাব তখনও তফনে তালি মারছেন বসে। বেড়ার ফাঁক দিয়ে জোটন ফকির সাবের প্রশস্ত বুক এবং কব্জি দেখে—গতরে খোদার মাশুল উসুল হতে বেশি সময় নেবে না—সুতরাং সুখী মনে জোটন রান্না করতে বসল। দু’সাল হল গতর বেশরমভাবে প্রায় রাতে বেইমানি করতে চাইছে। রাতে যতবার এমন হতো জোটন ছেঁড়া মাদুরে বসে আল্লাকে স্মরণ করে গতরের এই সব বেওয়ারিশ ইচ্ছাকে তাড়াতে চাইত। তিন তিনবার তালাক পেয়ে জোটন যেন বুঝতে শিখেছে ওর শরীরের খাক মেটাবার শক্তি পুরুষমানুষের ছিল না।—সুতরাং তালাক দিল—বলল, ইবলিশের গতর কেবল খাই-খাই। সে ফের উনুনে কিছু শোলা গুঁজে দিল এবং ফকির সাবের শরীর দেখল বেড়ার ফাঁক দিয়ে। সমস্ত চালটাই সে রান্না করছে। দু’জনের মতো ভাত। সে সুঁটকি মাছ দুটোকে আগুনে পুড়িয়ে নিচ্ছে, সে অনেকগুলো লাল চাঁটগাই লঙ্কা বেঁটে নিচ্ছে পাথরে, বড় বড় দুটো পেঁয়াজ কেটে সুঁটকি দুটোকে মড়মড় করে সানকির এক পাশে গুঁড়ো করে রাখল। তারপর লঙ্কা, পেঁয়াজ, নুন এবং সুঁটকির বর্তা বানাতে গিয়ে জিভে জল এল, এখন সে ইচ্ছা করলে দু’জনের ভাত যেন একা খেয়ে নিতে পারে। কিন্তু বাড়িতে মেহমান—সে তার ক্ষুধাকে নিবৃত্ত করল কিছুক্ষণের জন্য। ভাতের ফ্যানা টগবগ করে ফুটছে। সোঁদা সোঁদা গন্ধ ভাতের। সে ফ্যানটা গেলে একটা সানকিতে যত্ন করে রাখল, নুন মেশাল—সবটা ফ্যান পিছন ফিরে চুকচুক করে গিলতে থাকল—আহাঃ, এতক্ষণে যেন চোখ তার দৃশ্যমান বস্তুগুলিকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, ফকির সাহেবকে পীরের মতো মনে হল—দরগার পীর এই ফকির সাহেব। জোটন নিজের শরীরের দিকে নজর দিয়ে বুঝল, এ শরীরও ভয়ানক শক্তসমর্থ। ফকির সাবকে কাবু করতে খুব একটা আদা নুন লাগবে না। জোটন মনে মনে হাসল। বেড়ার ফাঁক দিয়ে ডাকল, ফকির সাব সান করতে যান। আমার খানা পাকান হইয়া গ্যাছে।

ফকির সাব সব তল্পিতল্পা সঙ্গে নিয়েই ঘাটে গেলেন, এমন কি মুশকিলাসানের আধারটাও। জোটন এই ঘরে বসে কাকের শব্দ পেল, আকাশে রোদ, গাছে এবং শাখাপ্রশাখায় রোদ। জাফরি রঙের ছায়া ঘরের পিছনে। বেত ঝোপে বোলতার চাক—নিচে বোন্না গাছের ঘন জঙ্গল, ফকির সাব হাসিমদের পুকুরে স্নান করতে গেছেন। জোটন বিবি গাজীর গীত ধরল গুনগুন করে। জোটন বিবির স্বপ্ন জাগছে চোখে, বেত ঝোপে বেথুনের মতো এই স্বপ্ন কবে টসটস করে পাকবে…জোটন স্বপ্নের কথা ঠিকঠাক ভাবতে পারছে না…স্বপ্নটা গাজীর গীতে গায়ানদারের হাতের ছড়ি য্যান; চাঁদের মতো মুখ করে চ্যাপ্টা নাকে চোখে জোটনের সকল সুখকে দ্যাখতাছে।

জোটন তাড়াতাড়ি পাশের একটা গর্ত থেকে ডুব দিয়ে এল। চুলের জল ঝেড়ে ভাঙা আয়নায় ডুরে শাড়ি পরে নিজের সুন্দর মুখটি দেখল। উজ্জ্বল দাঁতের পাটি দেখে রাতে পীরের দরগায় সুখের হীরামন পাখির কথা মনে করে কেমন বিহ্বল হতে থাকল।

ফকির সাহেব ছেঁড়া মাদুরে বেশ পরিপাটি করে খেতে বসলেন। ভিজা লুঙ্গি সিম লতার মাচানে শুকোচ্ছে। তিনি খেতে বসে দু’বার আল্লা উচ্চারণ করে আকাশ দেখলেন—আকাশ পরিষ্কার, বড় তকতকে এই উঠোনে ঝকঝকে আকাশের নিচে বসে গবগব করে খেতে পারলেন না। যেমন পরিপাটি করে বসেছেন তেমন ধীরে সুস্থে এক সানকি মোটা ভাত সুঁটকির ভর্তা দিয়ে কিঞ্চিৎ মেখে বেশ তারিয়ে তারিয়ে খেতে থাকলেন। নিচে দুটো-একটা ভাত পড়ছে—তিনি আঙুলের ডগায় তুলে সন্তর্পণে মুখে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন, যেন এই মোটা ভাত ফুরিয়ে গেলে আর পাওয়া যাবে না—আল্লার বড় অমূল্য ধন। সানকির ভাতটা শেষ করতেই দেখলেন, জোটন আর এক সানকি ভাত এনে সামনে রেখেছে। তিনি সে ভাতটাও পরিপাটি করে শেষ করলেন। এবং ভাতের অপেক্ষায় ফের বসে থাকলেন। সহসা আবিষ্কারের ভঙ্গিতে তিনি মাদুরের এবং সানকির সংলগ্ন ভাতটিও আঙুলের চাপে মুখে তুলে দিয়ে বসে থাকলেন। নামাজের ভঙ্গিতে এই বসে থাকা ভাবটুকু সাবের বড় আরামদায়ক। এই সব জোটন ঘরের ভিতর থেকে লক্ষ করে শরমে মরে যাচ্ছে। সে হাঁড়ির ভিতর হাত দিল। শেষ দু’মুঠো ভাত সানকিতে তুলে শেষ ভর্তাটুকু তার কিনারে রেখে মাদুরের উপর রেখে দিল। ফকির সাব বললেন, বস্ হইব। ইবারে আপনে গিয়া খান।

জোটন ঘরের এক কোনায় বসে থাকল। ওর মাথাটা ঘুরছে। সে খুঁটিতে হেলান দিল। কোমর থেকে ডুরে শাড়িটা খসে পড়ছে। আবেদালি নেই, জব্বর নেই, থাকলে বলত, আমার ঘরটা বন্ধক রাইখ্যা এক প্যাট ভাত দ্যা। সে ক্ষুধায় যন্ত্রণায় থাকতে না পেরে গিমা শাকগুলো সিদ্ধ করল এবং খেল। সে কিছু কাঁচাপাকা বেথুন এনে খেল। এ সময়ে উঠোনে গাছের ছায়া দীর্ঘতর হচ্ছে। কাক, শালিকরা প্রায় সকলে ডালে, ঝোপে জঙ্গলে যেন ঝিমোচ্ছে। ফকির সাব ছেঁড়া মাদুরে পড়ে ঘুমোচ্ছেন। জোটন আর বসে থাকতে পারল না। শরীরের জড়তায় সে ডুরে শাড়ির আঁচল পেতে মেঝের ওপর পেট রেখে ঘুমিয়ে পড়ল।

বিকেল বেলাতে যখন উঠানের ওপর দিয়ে পাখিরা ডেকে গেল, যখন সাত-ভাই-চম্পা পাখিরা লাউ মাচানের নিচে কিচমিচ করল অথবা ধানের আঁটি নিয়ে কামলারা সড়কের ওপর কদম দিচ্ছে তখন জোটন ক্লান্ত অবসন্ন শরীরটাকে টেনে টেনে তুলল। ফকির সাব হুঁকা খাচ্ছেন বসে। সব পোঁটলা-পুঁটলি যত্ন করে বাঁধা, যেন তিনি এখন উঠবেন, শুধু হুঁকা খাওয়াটা বাকি। জোটন আর অপেক্ষা করতে পারল না। ঘর থেকেই বলল, ফকির সাব, আমারে লইয়া যাইবেন না?

ফকির সাব ঝোলাঝুলি কাঁধে নিতে নিতে বললেন, আইজ না। অন্যদিন হইব। কোরবান শেখের সিন্নিতে যামু। কবে ফিরমু ঠিক নাই। উঠোন থেকে নেমে যাওয়ার সময় দরজার ফাঁকে জোটনের শীর্ণ মুখে আশ্চর্য বিষাদ ধরতে পেরে উচ্চারণ করলেন, আল্লা রসুল, আহা এই ইচ্ছার সংসারে আমরা কতদূর যাব, আর কতদূর যেতে পারি। ফকির সাহেব ওইমত চিন্তা করলেন। তিনি হাঁটতে হাঁটতে ধরতে পারলেন, জোটনের চোখ দুটো এখনও ওকে অনুসরণ করছে অথবা যেন জোটন দেখল হাঁসের পালক মালতীর শরীরে—ইচ্ছার জল গড়িয়ে পড়ছে অথবা পীরের শরীর গাজীর গীদের গায়ানদারের লাঠি য্যান…হাঁটতাছে…হাঁটতাছে…চাঁদের মতো মুখ করে চ্যাপ্টা চ্যাপ্টা নাকে চোখে জোটনের সকল দুঃখকে দ্যাখতাছে। জোটন এবার ডুকরে কেঁদে উঠল-আল্লা রে, তর দুনিয়ায় আমার লাইগ্যা কেউ বুঝি নাই রে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *