প্ৰথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড

নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – ১.২৮

১.২৮

এবার ওদের ফেরার পালা। ঈশম সকাল সকাল দুটো রান্না করে খেয়ে নিয়েছে। সে খুব সকালে গোটা নৌকার পাটাতন ধুয়েছে। গলুইতে জল জমে ছিল, সব ফেলে দিয়ে একেবারে নৌকা হালকা করে রেখেছে। পাল যেখান যা সামান্য ছেঁড়া ছিল গতকাল সারাটা দিন সেখানে সযত্নে সুঁচ-সূতা দিয়ে মেরামত করে নিয়েছে। কোনও কারণেই যেন নৌকা চালাতে কষ্ট না হয়। গুণ টানার দড়ি ঠিকঠাক করে সে বসে থাকলে দেখল, মেজকর্তা আসছেন সকলের আগে। মাঝে সোনা লালটু পলটু, পাগল কর্তা, আশ্বিনের কুকুর পিছনে।

এখন স্টিমার ঘাটে খুব ভিড়। যে যার মতো পূজার দিনগুলি গ্রামে কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। এই গ্রাম প্রায় শহরের শামিল। এখানে হাইস্কুল আছে। পোস্ট অফিস আছে। বাজার-হাট, আনন্দময়ীর কালীবাড়ি আর বড় বড় জমিদারদের প্রাসাদ মিলে এক জাঁকজমক এই পূজার ক’টা দিন—তারপর ফের বাবুদের কেউ ঢাকা চলে যান, কলকাতায় যান, গ্রাম থেকে একে একে সবাই চলে গেলে—পুরী খাঁ খাঁ করে।

ভূপেন্দ্রনাথের এমনই মনে হচ্ছিল। ওরা চলে যাচ্ছে। সকাল সকাল ওরা সেদ্ধভাত খেয়ে নিয়েছে। ভূপেন্দ্রনাথ পাড়ে দাঁড়িয়ে ওদের বিদায় দিলেন। যতক্ষণ নৌকাটা শীতলক্ষ্যার বুকে দেখা গেল ততক্ষণ তিনি পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন। ওঁর আর কেন জানি এসময় কাছারিবাড়িতে ফিরতে ইচ্ছা হল না। তিনি হেঁটে হেঁটে কালীবাড়ির দিকে চলে এলেন। ভাবলেন, চুপচাপ তিনি কালীবাড়ির বারান্দায় গিয়ে মাকে দর্শন করবেন! পুরোহিত কালু চক্রবর্তী মাঝে মাঝে এসে নানারকম কুশল সংবাদ নিলে হুঁ হাঁ করবেন। আর বারান্দায় বসে সেই ভাঙা প্রাচীর শ্যাওলাধরা দুর্গের মতো বাড়িটাতে কোনও মন্দিরের সাদৃশ্য খুঁজে পান কি না দেখবেন। কী সাহস মৌলবীসাবের যে, এখানে হাজার লক্ষ মানুষ নিয়ে এসে নামাজ পড়তে চায়? কোরবানী দিতে চায়। এসব করলেই এ অঞ্চলে আগুন জ্বলে উঠবে! তিনি বললেন, মা, তুমি শক্তিদায়িনী। তুমি শক্তি দিও মা। তিনি মনে মনে যেন কোনও ধর্মযুদ্ধের স্বপ্ন দেখছেন। যেন এই মা, আনন্দময়ী, শক্তিদায়িনী মা হাজার হাজার দেবসৈন্য তৈরি করবে শরীর থেকে। এবং অসুর নিধনে উদ্যত হবে। যুগে যুগে মা তুমি মুণ্ডমালাধারিণী।

তারপর ভূপেন্দ্রনাথ মনে মনে হাসলেন। অবজ্ঞায় ওঁর মুখ কুঁচকে উঠল। থানার দারোগা, পুলিশসাহেব সদরের, মায় ম্যাজিস্ট্রেট সব বাবুদের হাতে। একটা তার করে দিলেই স্টিমার বোঝাই করে সৈন্যসামন্ত হাজির হবে। তিনি অবহেলায় মুখ কুঁচকে রাখলেন। ভিতরে ভিতরে তিনি এত বেশি উত্তেজিত যে, হাঁটতে হাঁটতে তিনি নিজের সঙ্গে নিজেই কথা বলছেন। তিনি যেন একটা রণক্ষেত্রের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন।

তখন ঈশম হালে বসে সোনাকে বলল, কি গ কর্তা, মুখ কালা ক্যান?

সোনা মুখ ফিরিয়ে রাখল। যেন ঈশম ওর মুখ দেখতে না পায়।

—আর কি, এইবারে নাও ঘাটে লাগাইয়া দিমু। আপনের মায় ঠিক ঘাটে খাড়াইয়া থাকব। গেলেই আপনারে কোলে তুইলা নিব।

পাগল মানুষ মণীন্দ্রনাথ নৌকার গলুইয়ে বসে আছেন। রোদ মাথার উপর। ঈশম বার বার অনুরোধ করছে ছইয়ের ভিতর বসতে—তিনি বসেননি। একেবারে অচঞ্চল পুরুষ। পদ্মাসন করে বসে আছেন। রোদে মুখ লাল হয়ে গেছে। সোনার এখন এসব ভালো লাগছে না। সে বাড়ি যাচ্ছে! অমলা কমলা এখন কত দূরে। সে বাড়ি গিয়ে মাকে কেমন দেখবে তাও জানে না। কেমন এক পাপবোধে সেই থেকে সে আচ্ছন্ন। অমলা কমলার কান্না, অথবা সেই রাত্রি ওকে যেন আরও বেশি সচেতন করে দিয়েছে। কেউ যেন বলছে, তুমি এটা ভালো করনি সোনা। সে সেজন্য সারাক্ষণ চুপচাপ বসেছিল নৌকায়।

বাড়ির ঘাটে নৌকার শব্দ পেয়েই ধনবৌ ছুটে এসেছিল। বড়বৌ এসেছে। সে খবর পেয়েছে পাগলমানুষ সাঁতার কেটে, কখনও গ্রামের পথে হেঁটে মুড়াপাড়া চলে গেছেন। যেদিন সোনা ফিরবে সেদিন তিনিও ফিরবেন।

সোনা নৌকা থেকে লাফ দিয়ে নেমেই মাকে জড়িয়ে ধরল। এতক্ষণ যে মনটা ভারী ছিল, এখন তা একেবারে হালকা হয়ে গেছে।

বড়বৌ বলল, কি সোনা, মার জন্য কাঁদিসনি ত?

সোনা ঘাড় কাৎ করে না করল।

—ঠিক কেঁদেছিস! তোর চোখমুখ বলছে। কি রে লালটু, সোনা কাঁদেনি?

—না, জ্যেঠিমা।

—তাহলে আর কি, এবার জ্যাঠামশাই-র মতো হয়ে গেলি। যেখানে খুশি চলে যাবি। কারো জন্য মায়া হবে না।

বড়বৌ যেন এ কথায় পাগল মানুষকে সামান্য খোঁচা দিল। আর পাগল মানুষ মণীন্দ্রনাথও যেন সে খোঁচা ধরতে পেরে তাকালেন বড়বৌর দিকে।

বড়বৌ বলল, এস। যেন বলতে চাইল, তুমি কোথাও চলে গেলে আমার ভারী কষ্ট হয়। ভয় হয়। আমার আর কে আছে!

সোনা প্রায় যেন বিশ্ব জয় করে ফিরেছে। তার নূতন অভিজ্ঞতা, হরিণ, ময়ূর এবং বাইস্কোপের বাক্স, এসব তার সকলকে দেখাতে না পারলে অথবা বলতে না পারলে সে মনে মনে শান্তি পাচ্ছে না। প্রথম মালতী পিসিকে সে এসব দেখাবে ভাবল। গোপাটে ফতিমা এলে তাকে দেখাবে ভাবল।

সোনার মনে হল ‘কত দিন পর সে এখানে ফিরে এসেছে, যেন দীর্ঘ দিন এখানে ছিল না। সবাইর সঙ্গে দেখা না করা পর্যন্ত সে স্বস্তি পাচ্ছে না। সে প্রথমে বড়ঘরে ঢুকেই ঠাকুরমা ঠাকুরদাকে প্রণাম করল। তারপর উঠোনে নেমে এলে বড়বৌ বলল, সোনা, জামা প্যান্ট ছেড়ে খেয়ে নাও।

সোনা এসব শুনল না। ওরা সেই কখন খেয়ে বের হয়েছে, সুতরাং খিদে পাবার কথা! ওরা হাত পা ধুয়ে এলেই বড়বৌ খেতে দেবে। কিন্তু কেউ খেতে আসছে না। সোনা দৌড়ে পুকুরপাড়ে চলে গেল। অর্জুন গাছটার নিচে দাঁড়াল। দক্ষিণের ঘরে আবেদালি বসে আছে। ছোটকাকা বাড়ি নেই। পালবাড়ির সুভাষের বাবা নেই। হারান পালের বাড়ি খালি। সোনা অর্জুন গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে সব লক্ষ করল।

শুধু জলে এখন মালতী পিসির পাতিহাঁস সাঁতার কাটছে। সে পুকুরপাড় ধরে কয়েদবেল গাছটার নিচে চলে গেল। এখান থেকে শোভা আবুদের বাড়ি চোখে পড়ে। সে হাঁটুজলে নেমে সোজা ওদের বাড়ি উঠে দেখল নরেন দাস বাড়িতে নেই। সব কেমন খাঁ-খাঁ করছে। শোভা আবু নেই। ওদের মা নেই। এমনকী সে মালতী পিসিকেও দেখতে পেল না। কেবল মনে হল ওদের তাঁতঘরে কেউ বসে তামাক কাটছে।

সোনার কেমন ব্যাপারটা ভুতুড়ে মনে হল। কেউ নেই। সে একা। সূর্য অস্ত গেছে। অথচ বাড়ির পর বাড়ি সে দেখছে খালি পড়ে আছে। ওর কেমন ভয় ধরে গেল। সে তাড়াতাড়ি উঠোন পার হয়ে বাড়ির দিকে ছুটবে ভাবল, আর তখন দেখল মালতী পিসি একটা পিটকিলা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। একা। নির্জনে কার সঙ্গে যেন কথা বলছে।

সে কাছে গেল। অন্যদিন হলে মালতী পিসি ওকে জড়িয়ে ধরত, আদর করত। কিন্তু আজ কেন যে মালতী পিসির চোখ মরা! চুল বাঁধেনি। কেমন রুক্ষ চোখ মুখ। মাঝে মাঝে থুতু ফেলছে। মাঝে মাঝে ঠিক নয়, যেন এক অশুচি ভাব সারাক্ষণ শরীরে—সব সময়ই সে থুতু ফেলে শরীর পবিত্র রাখতে চাইছে। এবং কার সঙ্গে যেন বিড়বিড় করে কথা বলছিল। সোনাকে দেখে আর কথা বলছে না। একেবারে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। সে যে সোনাকে চেনে এমন মনেই হচ্ছে না। সুতরাং সোনা গাছটার নিচে গিয়ে দাঁড়াল। সোনা এসেছিল ওর বাইস্কোপের বাক্স দেখাতে, আর এখন মালতী পিসির এমন চেহারা দেখে সে কথা পর্যন্ত বলতে পারল না। মালতী পিসির কী একটা অসুখ হয়েছে। অসুখ হলে মানুষের চোখ-মুখ এমন হয়। সোনা আর দাঁড়াতে পারল না। সে ছুটে এসে জ্যেঠিমাকে বলল, মালতী পিসি গাছের নিচে…সে বলে শেষ করতে পারল না। জ্যেঠিমা বললেন, ওর কাছে যাবে না। ওকে বিরক্ত করবে না।

সে জ্যেঠিমাকে বলল, ছোটকাকা বাড়ি নাই ক্যান? শোভা, আবু নরেন দাস বাড়ি নাই। পালবাড়ির সুভাষের বাবা নাই। এসব শুনে বড়বৌ এক ফকিরের দরগায় মেলা বসেছে এমন বলেছে। গ্রাম ভেঙে মানুষজন দেখতে গেছে মেলা।

জ্যেঠিমার কথা শুনে সোনার মনে হল এই পৃথিবীতে আবার একটা কিংবদন্তী সৃষ্টি হচ্ছে।

এ এক অলৌকিক ক্রিয়া। কারণ, এক রাতে দুটো ঘটনা ঘটে কি করে! ঘটে না, ঘটতে পারে না। রাতের মাঝামাঝি সময় ফকিরসাবের অলৌকিক আবির্ভাব নরেন দাসের বাড়িতে। সাক্ষাৎ মা-লক্ষ্মী, অথবা জননীর মতো ফকিরসাব মালতীকে রেখে গেলেন। আর আশ্চর্য, দরগার মানুষেরা অথবা যারা ইন্তেকালে এসেছিল কবর দিতে তারা দেখছে, ফকিরসাবের বিবি, লম্ফ জ্বেলে সেই রাতে বসে আছে দরগায়। পাশে কফিনের ভিতর ফকিরসাবের মৃতদেহ। অলৌকিক ঘটনা না ঘটলে এমন হয় না। দশ ক্রোশের ফারাক—নদী-নালার দেশ। জোয়ারের জল কখন আসে যায় কেউ টের পায় না। সেই জলে জলে ফকিরসাবের বিবি দিনমানের পথ মুহূর্তে পাড়ি দিয়েছিল। মানুষের মনে তেমন একটা অবিশ্বাস গড়ে উঠতে পারেনি। গ্রাম-মাঠের জায়গা, নদী-নালার দেশ, খবর পৌঁছাতে সময় লাগল না। নরেন দাস সকলকে ফকিরসাবের অলৌকিক আবির্ভাবের কথা রটিয়ে দিয়েছিল। মধ্যরাতে, আল্লা রহমান রহিম বলে উঁচু লম্বা মানুষের আগমন এবং মৃত্যুর খবর শুনতেই নরেন দাসের মনে হয়েছিল, যোজন দূরে মাথা উঠে গেছে ফকিরসাবের, দুঃখিনী মালতীকে তিনি আলখাল্লার ভিতর থেকে ছোট একটা পুতুলের মতো বের করে দিয়ে নিমেষে হাওয়ায় লীন হয়ে গেছেন। এই ঘটনায় ফকিরসাব রাতারাতি পীর বনে গেলেন। আবার কিংবদন্তী। ধর্মের মতো, অথবা সেই তালপাতার পুঁথির মতো কেবল কিংবদন্তী। বিশ্বাস অবিশ্বাস নিয়ে নিরন্তর বিবদমান দুই সাম্রাজ্য। একপাশে সোনা। মাঠ পার হলে গোপাট, গোপাটের ওপাশে ফতিমা।

ফতিমা এলেই সোনা সেদিন এই সন্ধ্যায় বাইস্কোপের বাক্স তাকে দিয়ে দিল।

—কেডা দিল সোনাবাবু?

—অমলা।

—ক্যান দিল?

—খুব ভালোবাসে আমারে।

ফতিমা অর্জুন গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে চুপচাপ বাবুর মুখ দেখল। তারপর বলল, বাইস্কোপের বাক্স আমার লাগে না।

সোনা বলল, ক্যান লাগে না?

—লাগে না। আমি নিমু না।

সোনা বলল, ক্যান নিবি না?

ফতিমা কথা বলল না। সোনাবাবু মুড়াপাড়া থেকে ফিরে এসেছে শুনেই সে জল ভেঙে চলে এসেছে পুকুরপাড়ে। জল বেশি নেই গোপাটে। পায়ের পাতা ডুবে যায় এমন জল। ফতিমা বাবুর সঙ্গে কথা না বলে শাড়িটা একটু উপরে তুলে, জলে নেমে গেলে সোনা বলল, অমলা বলল, অমলা আমার পিসি হয়।

ফতিমা ঘাড় কাৎ করে তাকাল এবং উঠে এসে বাইস্কোপের বাক্সটার জন্য হাত পাতল।

সোনা দেবার আগে ফতিমাকে বাক্সের খোপে চোখ রাখতে বলল। সে ছবি পাল্টে পাল্টে দেখাচ্ছে। ফতিমা এই ছবিগুলির ভিতর আরব্য রজনীর রহস্যময় জগৎ আবিষ্কার করে কেমন বিমুঢ় হয়ে গেল। যেন এবার ওর চোখ তুলে বলার ইচ্ছা—সোনাবাবু, এতদিন কোথায় ছিলেন। তারপর ওর চোখ মুখ দেখলেই টের পাওয়া যায়, সে বিকেল হলেই পুকুরপাড়ে পেয়ারা গাছটার নিচে এসে দাঁড়িয়ে থাকত। সেই গাছটার নিচ থেকে মাঠের এপারে এই অর্জুন গাছ স্পষ্ট! অর্জুন গাছের নিচে কেউ এসে দাঁড়ালেও স্পষ্ট। কেবল পাটগাছগুলি জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়ে বড় হয়ে গেলে দুটো গাছের নিচই ঢাকা পড়ে যায়। কেউ কাউকে দেখতে পায় না। তখন পেয়ারা গাছের নিচে দাঁড়ালে ওপারে অর্জুনের ছায়ায় কেউ দাঁড়িয়ে আছে কি না বোঝা যায় না। পাট কাটা হলে সব আবার খালি। ফতিমা বিকেলে গাছের নিচে দাঁড়লেই টের পায় সোনাবাবু কোথায়। সে বিকেলে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থেকেছে। অথচ সে বাবুর মুখ দেখতে পায়নি একবারও। কেমন একটা ক্ষোভ অভিমান এতদিন ভিতরে ভিতরে ছিল। বাইস্কোপের বাক্সটা দিতেই অভিমান ওর জল হয়ে গেল।

ফতিমা বলল, নানী কইছে একবার যাইতে।

সোনা বলল, বলবি নানী বলছে যেতে।

—এটা ত বইয়ের ভাষা।

—বইয়ের ভাষার কথা বলতে শিখবি।

—আমার লজ্জা লাগে।

—আমারও। বলে সে হা হা করে হেসে উঠল। অমলা-পিসি জ্যেঠিমার মতো কথা বলে।

আমাকে বলে, সোনা যামু কিরে, যাব বলবি!

—আপনে কি কইলেন?

—কইলাম লজ্জা লাগে।

—আমারও লাগে। বলেই ফতিমা নেমে গেল জলে, তারপর সারা মাঠে জল ছিটিয়ে মাঠের ওপারে উঠে পেয়ারা গাছটার নিচে হাত তুলে দিল। সোনাও হাত তুলে দিল। সিগনাল পেয়ে যে যার গাড়িতে যে যার বাড়িমুখো রওনা দিল।

সোনা দক্ষিণের ঘরে ঢুকে দেখল, অলিমদ্দিও নেই। আবেদালি শুধু বসে রয়েছে। অলিমদ্দি এবং ছোটকাকার ফিরতে দেরি হবে। ফকিরের দরগায় গেছে ওরা। সুতরাং এতবড় বাড়িতে কোনও পুরুষমানুষ থাকবে না, রাতে চোর-ছ্যাঁচোড়ের উপদ্রব, সেজন্য শচীন্দ্রনাথ আবেদালিকে রেখে গেছেন বাড়ি পাহারা দিতে। আবেদালি থাকবে, খাবে এবং বাড়ি পহারা দেবে। সোনা নিজে একটা হ্যারিকেন এনে বৈঠকখানার দাওয়ায় রেখে দিল।

সোনা আবেদালিকে বলল, আপনে গ্যালেন না?

—কোনখানে?

—ফকিরসাবের দরগায়।

—কাইল যামু।

কারণ ঈশম যখন এসে গেছে তখন আর তার থাকবার কথা নয়। সবাই যাবে দরগাতে। সময় পেলেই চলে যাবে।

কোথাও যাবার নাম শুনলে সোনারও যাবার ইচ্ছে হয়। মেলার কথা মনে হলেই সেই সার্কাসের কথা মনে হয়, দুই বাঘের কথা মনে হয়। সে কি ভেবে এবার হ্যারিকেনের উপর ঝুঁকে বসল। আজও পড়া থেকে ওদের ছুটি। কাল থেকে, ঠিক কাল থেকে না, কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা শেষ হলে রাত-দিন জেগে পড়া। স্কুল খুললেই পরীক্ষা। সুতরাং সে একটু সময় পেয়ে আবেদালির মুখ দেখছে।

আবেদালি কেমন নির্জীব মানুষ হয়ে গেছে। জব্বর এখনও নিখোঁজ। আবেদালির শরীর ক্রমে ভেঙে আসছে।

জালালি মরে যাবার পর থেকে দ্বিতীয় পক্ষের বিবিটা আবেদালির অভাব অনটন বুঝতে চায় না। কেবল খাই খাই ভাব। যা রাঁধবে, নিজে একা খাবে, ওকে পেট ভরে খেতে দেবে না। সে এই বাড়িতে আজ রাতে পেট ভরে খেতে পাবে। ওর কাঁচাপাকা দাড়ির ভিতর পেট ভরে খাবার লোভী মুখটা ধরা পড়ছে। কেবল চোখ দেখলে টের পাওয়া যায়, জব্বরটা ওকে বড় ছোট করে দিয়ে গেছে। থানা-পুলিশ হতো, কিন্তু ফকিরসাবের এমন অলৌকিক ক্রিয়াকাণ্ডের পর সবাই সব ভুলে গিয়ে দরগার মেলা নিয়ে মেতে উঠেছে।

আর সব চেয়ে আশ্চর্য এই মালতী। যে রাতে ফিরে এল মালতী, হল্লা করে লোক জড়ো করল না নরেন দাস। চেঁচামেচিতে বোঝা যায় সব—তবু ওর যা কথা তাতে বোঝা যাচ্ছে—ফকিরসাব, আর সাধারণ মানুষ ছিলেন না। ফুসমন্তরে জ্বলে উঠেছিল এক অগ্নিশিখা—শিখার প্রচণ্ড আলোতে ঋষিগণের সহস্র মুখ যেন সারা উঠোনে ভেসে বেড়াচ্ছিল—যেন বলছেন ফকিরসাব, আমার জননীরে কেউ অসতী করে নাই নরেন দাস। তারে তুমি তুলে লও। প্রায় গোটা ব্যাপারটা নরেন দাসের কাছে সীতার বনবাসের মতো মনে হয়েছিল।

মালতী অন্ধকারে চুপচাপ। সে কোনও কথা বলছিল না। পাষাণ প্রতিমার মতো তার শক্ত মুখ চোখ দুটো কেবল জ্বলছিল। তাকে প্রশ্ন করলে কোনও জবাব পাওয়া যাচ্ছে না। সে ক্রমে শক্ত হয়ে যাচ্ছে। সে ক্রমে চুপচাপ, অর্থহীন দৃষ্টি। সে বারান্দায় চিড়িয়াখানার জীবের মতো বসেছিল। পাড়া প্রতিবেশীরা তাকে দেখে যাচ্ছে এবং ভিন্ন ভিন্ন মন্তব্য ছুঁড়ে দিচ্ছে। ফকিরসাবের মতো মানুষ হয় না। আল্লার বান্দা তিনি এমন বলাবলি করছিল।

এভাবে একদিন গেল। দু’দিন গেল। নরেন দাস তার বোনকে কেন জানি আর জলচল করে নিতে পারল না। জাতিতে যবন, এরা মানুষ না, ওরা চুরি করে নিয়ে গেছে, সুতরাং বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, যবনে ছুঁলে ছত্রিশ। সে মালতীর জন্য ঢেঁকিঘরের বারান্দায় একটা খুপরি করে দিল। সেই খুপরিতে ঠিক একটা পাতিহাঁসের মতো মালতী এক সকালে ঢুকে গেল।

আর আশ্চর্য, খুপরি ঘরে এমন এক সুন্দরী বিধবা একা থাকতে সাহস পেয়ে গেল। শরীরে তার আর কি আছে যা মানুষ জোর করে কেড়ে নিতে পারে! সে এতদিন সোহাগে সব লালন করছিল। এবং আকাশে নানারকম নক্ষত্রের ছবি দেখলে তার যার কথা বেশি মনে হতো, সেই রঞ্জিত, যুবক এক, তাকে না বলে চলে গেছে, সে তাকে আর কিছু দিতে পারল না। এই উচ্ছষ্ট শরীরের কথা ভাবলেই ওর মুখে থুতু উঠে আসে। সারাদিন জলে ডুবে থাকতে চায়। জলে নামলেই মনে হয় তার শরীর পবিত্র হয়ে যাচ্ছে। জলে ডুবে গেলে মনে হয়, আহা কি শান্তি মা জননী জাহ্নবীর কোলে! সে ডুবে গেল কি না,তার আঁচল অথবা চুল ভেসে থাকল কি না, কী শীতের রাত, কী গ্রীষ্মের দাবদাহে শুধু তার এমন এক প্ৰশ্ন।

প্রতিবেশী বালকদের এটা একটা খেলা হয়ে গেল। মালতী পিসি কেবল ভোঁস ভোঁস করে একটা উদবিড়ালের মতো ডুবত ভাসত। ওরা পাড়ে দাঁড়িয়ে খেলা করত অথবা ঠাট্টা-তামাশা করত, পিসির আঁচল ভেসে আছে বলত। অথবা চুল, না না চুল না, তোমার পায়ের আঙুল দেখা যাচ্ছে, হাতের আঙুল, তোমার শাড়ি জলের ভিতর বাতাস পেয়ে পাল তুলে দিতে চেয়েছে। তোমার সব ডুবে যায়নি, তুমি কেবল কিছু-না-কিছু নিয়ে জলের উপর ভেসে আছ। এমন যখন বলত বালকেরা, তখন মালতীর কী করুণ মুখ! আমার সব তবে ডোবে না, আমার কিছু-না-কিছু ভাইসা থাকে! দ্যাখ দ্যাখ সোনা, ডুবে আছি কি না দ্যাখ।

সোনা বলত, পিসি, তুমি ডুইবা গ্যাছ।

তারপরই মালতী সারা ঘাটে জল ছিটিয়ে উঠে আসত। চারপাশে শুধু অপবিত্র এক ভাব। সে বালতি থেকে জল ছিটাত আর ঘরের দিকে এগিয়ে যেত। শুচিবাইগ্রস্ত মালতী এভাবে ক্রমে জলে ডুবে থাকতে থাকতে একসময় শ্রীহীন রুক্ষ, এবং পাগলপ্রায় হয়ে গেল। সারারাত অভিমানে চোখ ফেটে জল আসে। চোখে ঘুম থাকে না। সোনা যখনই এসেছে, দেখেছে মালতী পিসি জলে সাঁতার কাটছে। জল থেকে কিছুতেই উঠতে চাইছে না। মুখ বড় করুণ। শরীর থেকে কারা যেন তার প্রাণপাখি নিয়ে পালিয়েছে। নরেন দাস বকে বকে জল থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে।

এভাবে শরৎকালটা কেটে গেল সোনার। শশীভূষণ পূজার ছুটি শেষ হলে চলে আসবেন। হেমন্তের দিনে পড়ার চাপ বেশি। ওকে সকালে এবং রাতে বেশিসময় শশীভূষণ নিজের কাছে পড়ার জন্য বসিয়ে রাখবে। পাগল জ্যাঠামশাই কিছুদিন হল কোথাও যাচ্ছেন না। সোনার ধারণা সে-ই জ্যাঠামশাইকে শান্ত এবং ধীর স্থির করে তুলছে। জ্যাঠামশাই সেই যে হাতি দেখতে গিয়ে ভালো হয়ে যেতে থাকলেন যেন ক্রমে তিনি সেই থেকে ভালো হয়ে যাচ্ছেন। সে মাঝে মঝে জ্যাঠামশাইকে তামাক সেজে দেয়। তামাক খান তিনি। বসে বসে আপন মনে সেই কবিতা আবৃত্তি করেন। স্নানের সময় স্নান, আহারের সময় আহার। রাতে তিনি ওদের পড়ার টেবিলের একপাশে ছোট্ট পড়ুয়ার মতো সরল বাংলা ব্যাকরণ নিয়ে বসে থাকেন। যেন খুব নিবিষ্ট পড়াশোনায়। তিনি কখনও সোনার স্লেট নিয়ে পেনসিলে নানা রকমের প্রজাপতি, অথবা নদীর সাঁকো, কিংবা মাঠের ছবি আঁকেন। কাউকে তিনি আর বিব্রত করেন না। সোনা লক্ষ্মীপূজার জন্য টুনিফুল আনতে গিয়েছিল। জ্যাঠামশাই নৌকা বাইছিলেন। এবং যেখানে এই দুর্লভ টুনিফুল পাওয়া যায় ঠিক সেখানে, তিনি তাকে পৌঁছে দিয়েছিলেন। এইসব জীবনের ভিতর সোনা দেখেছে বড় জ্যেঠিমা খুশি। তিনি সারাদিন সংসারের জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রম করছেন। জ্যাঠামশাই বাড়ি থাকলে, জ্যেঠিমার আর কোনও দুঃখ থাকে না। কপালে বড় গোল করে সিঁদুর, মাথায় লম্বা সিঁদুর, লাল পেড়ে কাপড়, কী ধবধবে এবং সাদা, আর শ্যামলা রঙের জ্যেঠিমাকে কখনও কখনও রামায়ণে বর্ণিত নারী চরিত্রের সঙ্গে তুলনা করতে ইচ্ছা হয়।

এইভাবে কার্তিক পূজার দিন এসে গেল। ফতিমা অর্জুন গাছের নিচে এসে একদিন বলে গেছে, ওর এবার দুটো শ্রীঘট চাই। শ্রীঘটের কথা সে মাকে বলেছে, জ্যেঠিমাকে বলেছে। সে ওদের প্রত্যেকের কাছ থেকে শ্রীঘট নিয়ে রাখবে। এবং কার্তিক পূজার পরদিন ফতিমা এলে দুটো নয়, এবার চারটা দেবে। যেমন অমলা কমলা ওকে নানাবিধ দ্রব্য দিয়ে খুশি রাখতে চেয়েছে, সে তেমনি এই মেয়ে—কী যে মেয়ে, পায়ে মল, নাকে নোলক, ডুরে শাড়ি পরা মেয়ে তার জন্য অপেক্ষায় থাকে—সে তাকে কিছু দিতে পারলেই মহৎ কিছু করে ফেলেছে, এমন ভাবে

আর কার্তিক পূজার দিনই ঘটনাটা ঘটল।

ওরা বিকেলে গেছে মাঠে। সন্ধ্যার সময় চারপাশের জমিগুলিতে আগুন জ্বালানো হয়েছে। ‘ভাল-বুড়াতে’ আগুন দিচ্ছে সবাই। সংসারের যাবতীয় পাপ মুছে, পরিবারের মানুষেরা হেমন্তের মাঠ থেকে পুণ্য তুলে আনতে গেছে। অলক্ষ্মী ফেলে লক্ষ্মী আনতে গেছে সবাই। সোনা লালটু পলটু তিনজন তিনটা ‘ভাল-বুড়াতে’ আগুন দিয়ে এখন মাঠের উপর ছুটছে। ওরা ওদের সবচেয়ে যে জমি ভালো ফসল দেয় সেখানে আগুনের দণ্ডগুলি পুঁতে দিল। তারপর চাই কার্তিক পূজার জন্য সবচেয়ে পুষ্ট ধানের ছড়া। এখন ওরা তিনজন এই হেমন্তের মাঠে সেই পুষ্ট ছড়ার জন্য জমি থেকে জমিতে ক্রমে সোনালি বালির নদীর চর পার হয়ে চলে যাবে। যে যত বড় ছড়া নেবে সে তত বেশি পুণ্য বহন করবে সংসারের জন্য। এভাবে এক প্রতিযোগিতা-সোনা একটা বড় ছড়া কেটে বলল, কি বড়, দ্যাখ দাদা! আর তখন পলটু বলল, কৈ দ্যাখি! দেখে বলল, বড় না ছাই। বলে আরও একটা বড় ছড়া দেখাল। এবং ক্রমে এভাবে ওরা ছড়ার জন্য দূরের মাঠে নেমে গেল। পছন্দ হচ্ছে না। মনে হয় এ জমি পার হয়ে গেলে বড় মিঞার জমি, জমিতে ফসল হয় সবার সেরা, অথবা কোথাও এমন জমি আছে যেখানে তাদের জন্য পুষ্ট ছড়া নিয়ে লক্ষ্মী অপেক্ষা করছেন। ওরা এখন মাঠে মাঠে মা লক্ষ্মীকে খুঁজছে।

ওরা তিনজন এভাবে অনেকদূরে চলে এল। পুষ্ট এবং বড় ধানের ছড়া না নিতে পারলে গৌরব করা যাবে না। বড় জ্যেঠিমা বলবেন ও মা, দ্যাখ ধন, তোর ছেলে কত বড় ছড়া এনেছে! এই মাঠে পুষ্ট ধানের ছড়াটির জন্য ওরা জমি থেকে জমিতে ঘুরছে। আবছা অন্ধকার। হেমন্তের মাঠ বলে সামান্য কুয়াশা। অস্পষ্ট জ্যোৎস্না আকাশে বাতাসে। ওরা নুয়ে একটা করে ধানের ছড়া হাতে নিয়ে দেখছে আর রেখে দিচ্ছে। হাত দিয়ে মাপছে। না, বড় ছোট! প্রায় হাত লম্বা না হলে কার্তিক ঠাকুরের গলায় মালার মতো দোলানো যাবে না।

তখন লণ্ঠন হাতে কারা যেন নদীর পাড়ে পাড়ে হেঁটে এদিকে আসছে। লণ্ঠনের আলো দেখে মনে হল ওরা অনেক দূরে চলে এসেছে। ওদের খেয়ালই ছিল না, ওরা নদীর চর ভেঙে হাইজাদির মাঠে পড়েছে। লণ্ঠনের আলো দেখে ওদের বাড়ি ফেরার কথা মনে হল।

কাছে এলে সোনা দেখল, ফেলু যাচ্ছে। মাথায় বড় একটা ট্রাঙ্ক। ফেলু মাথায় বড় ট্রাঙ্ক নিয়ে চলে যাচ্ছে। পিছনে সামসুদ্দিন। এবং সবার পিছনে ফতিমা। ফতিমা আজ সালোয়ার পরেছে। লম্বা ফুল হাতা ফ্রক সোনালি রঙের। কাল ফতিমার আসার কথা অর্জুন গাছটার নিচে। সে ফতিমার জন্য চারটা শ্রীঘট রেখে দেবে। এ-সময়ে কোথায় যাচ্ছে ফতিমা সেজেগুজে! সে ফতিমাকে দেখেও কিছু বলতে পারল না।

সামসুদ্দিন এত বড় মাঠে ওদের তিনজনকে দেখে কেমন একটু বিস্মিত হল। সে বলল, আপনেরা!

—ধানের ছড়া খুঁজতে আইছি।

সামসুদ্দিনের এতক্ষণে মনে পড়ল আজ কার্তিক পূজা। সবাই বের হয়ে পড়েছে পুষ্ট ধানের ছড়া খুঁজতে মাঠে। সে বলল, পাইছেন নি!

ওরা যা সংগ্রহ করেছিল দেখাল।

সামসুদ্দিন হাসল।—মা-লক্ষ্মী এত ছোট হইব ক্যান। আসেন আমার লগে।

ওরা ফের হাঁটছিল। সোনা কিছুতেই কিছু বলছে না। সে ফতিমার পাশাপাশি হাঁটছে তবু কথা বলছে না। ফতিমাও কিছু বলছে না। সে আর বেশিক্ষণ অভিমান নিয়ে থাকতে পারল না। বলল, তুই ছিরাঘট নিবি না!

—রাইখা দিয়েন। ঢাকা থাইকা আইলে নিমু।

—তুই ঢাকা যাইবি?

—আমরা সবাই ঢাকায় যামু। আমি স্কুলে পড়মু। বাড়িতে নানী একলা থাকব।

সোনা বলল, কৈ তুই আগে কস নাই ত?

—কমু কি! বা’জি সকালে সব কইল।

সোনা জানে ফতিমার বাবা বাড়ি এলে সে কোথাও যায় না। সোনা আবার চুপ করে গেল। ফতিমাও কিছু বলছে না। সে বলল, সোনাবাবু আপনে আমারে চিঠি দিবেন।

—যা! চিঠি দিমু কিরে!

—আপনে কেমন থাকেন জানাইবেন।

—ছোটকাকায় বকব

ফতিমা বলল, বিকেলে আমি কানতে ছিলাম, বা’জি কইল, তুই কান্দস ক্যান? তর আবার কান্দনের কি হইল?

—কিছু হয় নাই কান্দনের?

তখন সামসুদ্দিন বলল, এই দ্যাখেন পুষ্ট ধানের ছড়া। সে বিলের জলে একটা গামছা পরে নেমে গেল। এতবড় ধানের ছড়া কোনখানে খুঁইজা পাইবেন না। এই বলে সে তিনজনের হাতে তিন গুচ্ছ বড় বড় ধানের ছড়া দিয়ে বলল, জলে না নামিলে কেহ শিখে না সাঁতার। কি বলেন কর্তা? লক্ষ্মীরে আনতে গেলে কষ্ট লাগে। এই বলে সে গামছা দিয়ে শরীর মুছে ফেলুকে বলল, তরা হাঁটতে থাক। আমি অগ দিয়া আসি। অরা চিনা বাড়ি উইঠা যাইতে পারব না।

সামসুদ্দিন অর্জুন গাছটা পর্যন্ত এল। পুবের বাড়ি সামনে এবং সেখানে মালতী আছে—জব্বর মালতীকে চুরি করার তালে ছিল, ফকিরসাব ওকে এখানে রেখে গেছেন—এবং জব্বর ওর দলের পাণ্ডা–সুতরাং এই অপরাধের জন্য সে কিছুটা দায়ী, ওকে দেখলে এমন মনে হয়। সামসুদ্দিন ভিতরে ভিতরে এই অসম্মানের জন্য পীড়িত। সে নিজেকে বড় অসহায় বোধ করল। সে নানাভাবে মুসলমান মানুষের ভিতর আত্মপ্রত্যয় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে, যা এতদিন নসিব বলে মেনে আসছিল সবাই, সে তা আঙুলে তুলে দেখিয়ে দিয়েছে—ওটা নসিব নয়। ওটা আপনাদের অসম্মান! আপনারা এতদিন তা গায়ে মাখেননি। কিন্তু জাতির আত্মপ্রত্যয় ফিরিয়ে আনতে গেলে কিছু কঠিন উক্তি তাকে সময়ে অসময়ে করতে হয়েছে। কিন্তু তার বিনিময়ে জব্বরের এমন ইতর কাজ! ভিতরে ভিতরে তার জন্য সে জ্বলে-পুড়ে খাক হচ্ছিল। সহসা গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়া নানা মানুষ নানাভাবে ব্যাখ্যা করবে। সে যাচ্ছে। যেন এখানে থাকলেই ওর মালতীর সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। সে কিছু বলতে পারবে না। সে মাথা নুয়ে অসম্মানের দায়ভাগ কাঁধে তুলে নেবে শুধু। মালতীর সামনে পড়ার ভয়েই বোধহয় সে দেশ ছেড়ে যাচ্ছে। অবশ্য সে হাজিসাবের ছোট ছেলে আকালুকে দলের পাণ্ডা করে দিয়ে গেছে। শহরে, কাজের চাপ বেড়ে গেছে। সে এখন থেকে শহরেই থাকবে।

সামসুদ্দিন আর উঠে আসতে সাহস পেল না। নরেন দাসের বাড়িতে কোনও লম্ফ পর্যন্ত জ্বলছে না। সে একা দাঁড়িয়ে থাকল অর্জুন গাছটার নিচে। যতক্ষণ না ওরা উঠে গিয়ে বলল, আপনে যান, ততক্ষণ সে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বার বার লক্ষ রাখছে নরেন দাসের বাড়িতে লম্ফ জ্বলছে কি না। সে কেমন এখানে ভীতু মানুষের মতো দাঁড়িয়ে আছে। বার বার লম্ফের আলোতে মালতীর মুখ দেখার ইচ্ছা। মালতী, তুই আমার কসুর মাপ কইরা দেইস, এমন বলার ইচ্ছা। সে আবার মাঠের দিকে হেঁটে গেলে গাছের নিচটা কেমন খালি হয়ে গেল।

সোনা বাড়ি উঠে দক্ষিণের ঘরের বারান্দায় দেখল মাস্টারমশাই দাঁড়িয়ে আছেন। শশীভূষণ দেশ থেকে চলে এসেছেন। ওদের দেখেই তিনি বললেন, কী তোমরা অলক্ষ্মী ফেলে লক্ষ্মী এনেছ! দেখাও তো লক্ষ্মীরে।

ওরা ধানের ছড়া আলোতে তুলে দেখল।

—খুব বড় ছড়া দেখছি. কোথায় পেলে?

সোনা তার ছড়াও দেখাল। ওরটা সবার বড় কি-না, না ছোট, সে তার মাস্টারমশাইর কাছ থেকে ছড়া দেখিয়ে তার সার্টিফিকেট চাইল।

শশীভূষণ সোনার ইচ্ছা বুঝতে পেরে বলল, সবার বড় সোনার ছড়া। সোনা সেই-না শুনে ছুটে গেল ভিতরে। মা জ্যেঠিমা কার্তিক পূজার ঘরে নানারকম আলপনা দিয়েছেন। হ্যাজাকের আলো জ্বলছে। জলচৌকিতে কার্তিক ঠাকুর। নিচে সারি সারি শ্রীঘট। ঘটে আতপ চাল, উপরে জলপাই। সে তার ধানের ছড়া মাকে দিল। মা দু’হাতে সোনার হাত থেকে ধানের ছড়া বরণ করে নিলেন।

কিন্তু শশীভূষণকে দেখেই সোনার বুকটা কেঁপে উঠেছিল। সে আর খুব একটা এ পূজায় উৎসাহ পেল না। মাস্টারমশাই বড় কড়া প্রকৃতির লোক। তিনি খুব সকালে উঠবেন। সবার দরজায় গিয়ে ডাকবেন, সোনা ওঠ। লালটু ওঠ। পলটু ওঠ! হাত-মুখ ধুয়ে নে। তিনি সবাইকে ঘুম থেকে তুলে মাঠে নিয়ে যাবেন। প্রাতঃকৃত্যাদি হলে, মটকিলার ডাল দেবেন। দাঁত মাজতে বলবেন। তিনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দাঁত মাজা হলে বলবেন, উঠে এস। তার জন্য আলাদা একটা তক্তপোশ দিয়েছিলেন শচীন্দ্রনাথ। বড় তক্তপোশ। তিনি সেখানে রাজ্যের সব গাছগাছড়া জড়ো করে রেখেছেন। পেটের পীড়া, দাঁত ব্যথা, বাত এবং মাথাধরা এবং অন্যান্য যাবতীয় রোগে তিনি ওষুধ দেবেন। ওরা মুখ ধুয়ে এলেই ভিজা ছোলা দেবেন। গুনে গুনে দেবেন। এবং গুনে গুনে ফ্রিহ্যাণ্ড একসারসাইজ করাবেন। পড়া হলে স্নান। তেল মেখে দেবেন সোনার মাথায়। সকলকে নিয়ে তিনি পুকুরঘাটে সাঁতার কাটবেন। তারপর গরম ভাত, ডাল, বেগুন ভাজা এবং হেঁটে স্কুলে যাওয়া। শশীভূষণ এলেই ওরা একটা নিয়মের ভিতর আবার মানুষ হবে এমন ঠিক থাকে।

এই নিয়মের ভিতর শশীভূষণের যত রাগ লালটুর উপর। লালটুর ডনবৈঠক একশ দশ বার সোনার পঞ্চাশবার। আর পলটুর একশ কুড়িবার। পলটু ঠিক ওঠ-বোস করে কাজ সেরে নেয়। সোনাও। কিন্তু লালটু দেরি করে ওঠ-বস করবে। মাঝে মাঝে উঠতে বসতে ওর প্যান্ট হড়হড় করে নেমে আসে। শশীভূষণ তখন কান ধরে তুলে দেন। এবং চিৎকার করতে থাকেন, ধনবৌদি, ধনবৌদি।

চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ধনবৌ ছুটে এসে দেখতে পায়, লালটু উলঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উঠতে বসতে ওর প্যান্ট খুলে গেছে। প্যান্টে ওর দড়ি নেই।

—এটা কি!

—আমি কি করমু কন! ওর প্যান্টে কিছুতেই ডোর থাকে না।

—আচ্ছা, দেখছি। বলে তিনি পাট দিয়ে বেশ শক্ত করে সুতলি পাকিয়ে ওর প্যান্টে ডোর ভরে দিতেন। লালটু ভয়ে ভয়ে আর প্যান্ট থেকে দড়ি খুলে ফেলত না। লালটু জব্দ এই মাস্টারমশাই-র কাছে।

সোনা শশীভূষণকে দেখলেই এসব মনে করতে পারে।

মনে করতে পারে একটা উড়োজাহাজের কথা। সেই প্রথম এ অঞ্চলের ওপর দিয়ে উড়োজাহাজ উড়ে যাচ্ছে। ঢাকার কাছে কর্মিটোলাতে যুদ্ধের জন্য ঘাঁটি হয়েছে। মেজ-জ্যাঠামশাই বাড়ি এলে যুদ্ধের গল্প করেন। মাঠ থেকে উড়োজাহাজ দেখে সে যখন বাড়ি ফিরছিল তখন রাস্তায় দেখা।

—এই খোকা, শোন!

সে বিদেশী শব্দ শুনেই থমকে দাঁড়িয়েছিল।

—ঠাকুরবাড়ি কোনদিকে?

সে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল।

ছোট করে চুল ছাঁটা মানুষটার। তিনি নবদ্বীপের মানুষ। এখানে তিনি হাইস্কুলে হেডমাস্টার হয়ে এসেছেন। বারদি থেকে হেঁটে এসেছেন বলে হাতে পায়ে ধুলো। সোনা বাড়িটা দেখিয়েই ছুটে হারাণ পালের বাড়ির ভিতর ঢুকে সোজা চলে এসে ছোটকাকাকে খবরটা দিয়েছিল। দিয়েই সে আবার বারবাড়ির উঠোনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল—কতক্ষণে সেই মানুষ পুকুরপাড়ে উঠে আসেন।

শশীভূষণ বাড়িতে ঢুকে বলেছিলেন, এটা তোমাদের বাড়ি?

সে মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিল।

—শচীন্দ্রনাথ তোমার কে হয়?

—কাকা।

—একবার কাকাকে ডাকো দেখি।

ততক্ষণে শচীন্দ্রনাথ বারবাড়ির উঠোনে চলে এসেছেন। ওঁকে দেখেই শশীভূষণ নমস্কার করেছিলেন। বলেছিলেন, এলাম।

—আসেন। শচীন্দ্রনাথ বৈঠককানায় নিয়ে ওঁকে বসিয়ে দিলেন।—এই আপনের ঘর, এই তক্তপোশ। আর এই তিন বালক।

সোনা ততক্ষণে বুঝতে পেরেছিল, ওদের স্কুলের হেডমাস্টারমশাই—যাঁর আসার কথা অনেকদিন থেকে, যিনি বরিশালের কোন অঞ্চলে শিক্ষকতা করতেন সেকেণ্ড মাস্টারের, এখানে হেডমাস্টারের চাকরি পেয়ে চলে এসেছেন। শচীন্দ্রনাথই এ-ব্যাপারে বেশি স্কুলের জন্য খেটেছেন। এবং কথা ছিল হেডমাস্টারমশাই ঠাকুরবাড়িতেই থাকবেন, খাবেন। এবং এই তিন বালকের প্রতি নজর রাখবেন।

শচীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, তোমরা মাস্টারমশাইকে প্রণাম কর।

ওরা সেদিন কে কার আগে প্রণাম করবে—ঠেলেঠুলে প্রণাম করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পায়ে।

প্রথমেই তিনি বলেছিলেন, তোমাদের দাঁত দেখি।

সোনা দাঁত দেখিয়েছিল।

—ভালো করে দাঁত মাজা হয় না। বলে তিনি নিজে হাত পা ধুয়ে আসার সময় একরাশ মটকিলার ডাল কেটে আনলেন। এবং সবাইকে একটা করে দিয়ে—কীভাবে দাঁত মাজতে হয়, দাঁত নিচ থেকে উপরে মাজতে হয়, এই দাঁত মাজা আমরা আদৌ জানি না, দাঁত থেকেই সব রোগের উৎপত্তি এমন বলে তিনি নিজে দাঁত মেজে খাঁটি নমুনা দেখিয়েছিলেন।

সোনা, লালটু, পলটু বাইরে এসে হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ছিল।

সেই মাস্টারমশাই আবার এসে গেছেন। সোনা আর যখন তখন পড়া ফেলে অর্জুন গাছের নিচে ছুটে যেতে পারবে না।

সোনা হ্যারিকেন নিয়ে হাত পা ধুতে ঘাটের দিকে চলে গেল। সে কেমন বিমর্ষ। ফতিমা নেই এবং সে অন্যমনস্ক। অন্যমনস্ক না হলে সে একা ঘাটে হ্যারিকেন নিয়ে হাত পা ধুতে আসতে পারত না। ওর ভয় করত।

সে ঘাটে নেমে গেল। হ্যারিকেনটা তেঁতুলগাছের গোড়ায় রেখেছে। সে পা ধোওয়ার জন্য জলে নামতেই সামনে কি দেখে ভয় পেয়ে গেল. জলের উপর ঠিক মাছরাঙা পাখির মতো এক জোড়া পায়ের পাতা ভাসছে। লাল। যেন সিঁদুর গুলে পায়ের পাতায়, কেউ মা লক্ষ্মীকে জলে ভাসিয়ে গেছে। লক্ষ্মীর পায়ের মতো দু’পা জলে ভাসিয়ে নিচে কেউ ডুবে আছে। সে দেখেই লাফ দিয়ে ছুটে পালাল। হ্যারিকেন পায়ে লেগে পড়ে গেল। সে হাঁপাতে হাঁপাতে দক্ষিণের ঘরে ঢুকে বলতে বলতে কেমন তোতলা বনে গেল।

শশীভূষণ মুহূর্ত আর দেরি করলেন না। শচীন্দ্রনাথ এবং নরেন দাস ছুটে এল। শশীভূষণ জলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। নিচে মনে হল মাথার কাছে একটা শক্ত কিছু লাগছে। তিনি ডুব দিয়ে তুলে আনলে দেখলেন, মালতী। গলায় কলসী বেঁধে জলে ডুবে আত্মহত্যার চেষ্টা। পায়ে আলতা পরেছে। কপালে সিঁদুর আর হাতে গলায় ওর যত গয়না ছিল সব পরে সে জলের নিচে অন্তর্ধান করতে চেয়েছে।

শচীন্দ্রনাথ নাড়ি টিপে বুঝলেন, প্রাণটা ভিতরে এখনও আছে। চোখ দুটো বোজা। মালতী অজ্ঞান হয়ে আছে, গলগল করে জল বমি করছে। ফ্যাকাসে মুখ। কপালে বড় সিঁদুরের ফোঁটা। সিঁথিতে চওড়া সিঁদুর, পায়ে আলতা। চারপাশে যে এত ভিড় শচীন্দ্রনাথ তা লক্ষ করলেন না। তিনি অপলক অভাগিনী মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছেন। ওরা নুন দিয়ে ওর শরীর ধীরে ধীরে ঢেকে দিতে থাকল। মেয়েটা চোখ বুজে এখন নুনের নিচে বুঝি নিভৃতে ঘুম যাচ্ছে। সকাল হলেই জেগে উঠবে। সেই আশায় সকলে আলো জ্বালিয়ে চারপাশে বসে থাকল। সোনা সে রাতে ঘুম যেতে পারল না। শিয়রে সেও জেগে বসেছিল। বার বার রঞ্জিতমামার কথা তার মনে পড়ছে। তার কেন জানি রঞ্জিতমামার ওপর ভীষণ রাগ হচ্ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *