প্ৰথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড

নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – ১.১২

১.১২

ফেলু দাওয়ায় বসে গরজাচ্ছিল। বাঁ হাতে এখন আর একেবারেই শক্তি পাচ্ছে না। হাতটার দিকে তাকালেই ভয়ঙ্কর এক আক্রোশ বুক বেয়ে ওপরে উঠতে থাকে—তুমি ঠাকুর, পাগল ঠাকুর, তোমার পাগলামি ভাইঙ্গা দিমু।

হাতটা ওর বাঁ হাত। কব্জিতে জোর নেই। কালো পোড়া বিশীর্ণ রঙ ধরে আছে কব্জির চামড়াতে। দু’পাশের মাংস ফুলে ফেঁপে আছে, যেন কব্জির দু’পাশে মাংস বেড়ে একটা মোটা গিঁট হয়ে যাচ্ছে। কালো তার বাঁধা। কালো তারে মন্ত্র পড়া সাদা এক কড়ি ঝুলছে। কড়ির গলায় ফুটো করে হাতে বাঁধা সুতো নিয়ে ফেলু কেবল গজরাচ্ছিল। কিছু কাক উড়ছিল উঠোনে, কিছু শালিখ পড়ছিল মাচানে আর বিবি গেছে পশ্চিম পাড়াতে এক শিশি তেল ধার করতে। ফেলু আছে মাছ পাহারায়।

উঠোনের ওপর শীতের রোদ কাফিলা গাছের ডালের ফাঁক দিয়ে নিচে এসে নামছে। এই সামান্য রোদেই ফেলু মাচানে মাছ ছড়িয়ে বসে আছে তারপর আরও সামনে খানা-ডোবা এবং জমি, জমিতে কোনও ফসল হয় না। ছোট্ট একখণ্ড জমি ফেলুর। বাড়ির উত্তরে এই জমি, বাঁশ গাছের ছায়া জমিটাকে বড় অনুর্বর করে রেখেছে।

ওর গলায় কালো তার বাঁধা। গলায় চৌকো রুপোর চাকতি। সব সময় পালোয়ানের মতো চেহারা করে রাখার সখ ফেলুর। ফেলুর যৌবন নেই, কিন্তু এখনও শক্ত ঘাড় গলা দেখলে, ঘাড় গলা হাত দেখলে, তাজ্জব বনে যেতে হয়! মানুষটার মুখ ফসলহীন মাঠের মতো। রুক্ষ, দাবদাহে যেন সবসময় পুড়ে যাচ্ছে। একচোখে তাকালে বুকটা কেঁপে ওঠে। চোখের ভিতর মণি আছে, মণির ভিতর সব সময় নৃশংস এক ভাব। সুখী পায়রা আকাশে উড়তে দেখলেই ধরে ফেলার সখ, দুই পাখা ছিঁড়ে দেবার সখ। এবং ঠ্যাং খোঁড়া করে দিতে পারলে গাজীর গীতের বায়ানদারের মতো চান্দের লাখান মুখখান এমন সব বলতে থাকে।

ফেলু বড় হা-ডু-ডু খেলোয়াড় ছিল। তখন তার দুই হাতের ওপর শত্রু পক্ষের কী আক্রোশ! ঐ হাত যেভাবে পারো ভেঙে দাও। থাবা মারলে ফেলু, সকলে বাঘের মতো ভয় পায়।

চত্বরে খেলা হচ্ছে। গোপালদি বাবুদের দল খেলছে—দশ টাকা আগাম আরও দশ ফেলুর ঐ বাঘের মতো থাবা মচকে দিতে পারলে কিন্তু হায়,কে কার থাবা মচকায়! ফেলু ছুটছে। একবার এ-মাথায় আবার ও-মাথায়। সে খুব দ্রুত ছুটতে ভালোবাসে। দাগের উপর পড়েই সে লাফ দেয়, যেন সে লাফ দিয়ে আসমান ছুঁতে চায়। ঐ ওর কায়দা। শক্ত হাত-পা পেশীতে সূর্যের আলো ঝলমল করত। কালো খাটো প্যান্ট, কালো গেঞ্জি আর রুপোর তাগা গলায়, যেমন লম্বা ফেলু, তেমন কুৎসিত মুখ শরীর-মনে হয় তখন ফেলু জয় মা বলে অথবা আল্লা আল্লা বলে—হা মা ঈশ্বরী বলে ঝাঁপিয়ে পড়বে। দুই পায়ে কাইচি চালাও–ফেলু যে ফেলু সে পর্যন্ত পাহাড়ের মতো মুখ থুবরে পড়বে। তখন ফেলুর কোমরে বসে উল্টোভাবে এমন এক মোচড় দিতে হবে যেন বাঘের থাবা বেড়ালের হয়ে যায়। বাবুদের বায়নার মুখে ছাই দিয়ে যে ফেলু সেই ফেলু। খেলার শেষে টেরটি পাওয়া যায় না, ফেলুর কোথাও শরীর জখম হয়েছে।

সেই ফেলু বসে বসে এখন নিজের হাত দেখছে। কাক তাড়াচ্ছিল এবং ভাঙা হাতের দিকে তাকিয়ে বড়ঠাকুরকে গাল পাড়ছিল—পাগলামির আর জায়গা পাও না ঠাকুর, তোমার পীরগিরি ভাইঙ্গা দিমু। তারপর সে হুঁস করল। একটা কাক ফের এসে ঘরের চালে বসেছে। কাকটা সেই থেকে জ্বালাতন করছে। কাক একটা নয়, অনেক। ধরে ফেলেছে, সে ব্যারামি নাচারি মানুষ। সে ক্রমে পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। গিঁটে গিঁটে ব্যাদনা। হাতির শুঁড় ওর সব শক্তি নিয়ে চলে গেছে। কিন্তু ফেলুর জ্বলন্ত দুই চোখ, বিশেষ করে পোকায় খাওয়া চোখটা এখন বড় বেশি ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছিল। কাকটা বোধ হয় সেই চোখটা দেখতে পায়নি। সে চোখটা দেখাবার জন্য ঘুরে দাঁড়াল। কাকটা উড়ে এসে উঠোনে বসল। চোখটা দেখতে পায়নি। সে এবার তেড়ে গেল। তুমি আমারে পাগল ঠাকুর পাইছ। বলেই সে ডান হাতটা উঁচু করতে গিয়ে দেখল, হাতটা পুরোপুরি নিরাময় হয়নি। বাঁ হাতটা পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। ডান হাতটা নিরাময় হচ্ছে না। বিবি গেছে এক শিশি তেল ধার করতে আর সে ঘরের মাগের মতো বসে আছে মাছ পাহারায়।

বিবির ওপর রাগটা বাড়ছিল। পাটকাঠি নিয়ে হাতে কত আর কাক-শালিখ তাড়ানো যায়। কাক-শালিখ, মাছের লোভে বাজপাখি পর্যন্ত উড়ে আসতে পারে। বাজপাখির কথা মনে আসতেই গৌর সরকারের কথা মনে এসে গেল। হাজিসাহেবের পাঁচনের খোঁচা, সময়ে অসময়ে সেই সন্দেহের পোকা কুরে কুরে খেলে, হাজিসাহেবে পাঁচনের খোঁচা মারেন মইজলা বিবিরে, আর প্রতাপ চন্দের নাভিতে তেল মাখানোর অভ্যাস, অভ্যাসটার কথা মনে আসতেই ফেলু ভাবল—ওরা কাক চিল নয়, ওরা বাজপাখি নয়, ওরা লাল নদীর ঈগল। বড় মাছ বাদে ওরা খায়না।

সব জমি জিরাত ওদের। সুদিনে দুর্দিনে কামলা খাটলে পয়সা। ফেলুকে গৌর সরকার বড় ভয় পায়। সে ফেলুকে ভয় পায় গতর দেখে নয়, এমন গতরের কামলা ওর ঘরে কত বাঁধা আছে। ভয়, ফেলু নাকি যৌবনে অথবা সেদিনও রাতে-বিরেতে কোথায় চলে যেত। দরকার পড়লে সে দশটা টাকার বিনিময়ে দশটা মাথা এনে দিতে পারে—সেই ফেলু কি তাজ্জব, একটা কাক তাড়াতে পারছে না। ফেলু রাগে হতাশায় লুঙ্গিটা ডান হাতে ঝাড়তে থাকল বার বার।

রোদে মাছ শুকানো হচ্ছে। ছোট্ট একটা উঠোন নিয়ে ফেলুর ঘর। একটা পেয়ারা গাছ। নতুন বিবি পুরনো হয়ে গেছে। সাত আট সাল হল সে বিবিকে ধরে এনেছে। বয়স আর কত বিবির, দেড় কুড়ি হবে, কি দু-এক বছর বেশি হতে পারে। কাঁচা যৌবনের ঢল বিবির বড় বেশি। পাড়াময় রসিকতা কত—বিবিটা আলতাফ সাহেবের। কি করে, কে কখন আলতাফ সাহেবের কাটা মাথা পাট খেতে আবিষ্কার করেছিল কেউ জানে না। তারপর বছর পার হয়নি, ফেলু আলতাফ সাহেবের খুবসুরত বিবিকে ঘরে এনে তুলেছে। কেউ রা-টি করেনি। ফেলু বড় দাঙ্গাবাজ মানুষ। ভয়ে বিস্ময়ে কেউ ওকে ঘাঁটাতে সাহস পায় না। সেই ফেলু এখন এক কাক, সামান্য কাকের সঙ্গে পেরে উঠছে না।

মাছ রোদে শুকাচ্ছে। এক ফাঁকে একটা কাক এসে মাছ নিয়ে উড়াল দিল। ক্ষোভে হতাশায় ফেলু কাকটাকে তেড়ে গেল। কোমর থেকে লুঙ্গিটা খুলে গেছে, সে প্রায় উলঙ্গ হয়ে কাকটার পিছনে ছুটতে গিয়ে দেখল, প্রায় সব কাকগুলো ওর মাছের মাচানে বসে মাছ খাচ্ছে। রাগে দুঃখে সে ছেঁড়া তফনটা তুলে আর হাঁটতে পারল না। প্রায় হামাগুড়ি দেবার মতো হেঁটে গিয়ে দেখল, কাক যে সামান্য কাক, সেও বুঝে ফেলেছে ফেলুর আর তাগদ নেই। সে মরা মাছগুলির দিকে নিজের পোকায় খাওয়া চোখটা খুলে দাঁড়িয়ে থাকল। সে নড়তে পারছে না। নড়লে বাকি কয়টা মাছও আর থাকবে না। ওর ডান হাত সম্বল, বিবির ওপর সংসার। মাছের এ-অবস্থা দেখলে বিবি তাকে কুপিয়ে কাটবে। সে মাচানের পাশে বসে মাছগুলিকে ফের ছড়িয়ে রাখল। পুঁটি মাছ, চেলা মাছ। ইতস্তত ছড়িয়ে রাখলে বিবি এসে ধরতে পারবে না, কাকে এসে মাছ নিয়ে গেছে। সামু ফের ঢাকা গেছে, ফিরছে না। সামুর মার কাছ থেকে এক কাঠা ধান এনেছে ধার করে, সেও কী দিয়ে শোধ হবে, কবে, কীভাবে কাজ করতে পারলে শোধ হবে সে বুঝে উঠতে পারছে না। একমাত্র যুবতী বিবি আন্নু সব দেখেশুনে করছে।

আন্নুর ওপর এ সময় তার কেমন মায়া হতে থাকল। সে লুঙ্গিটা তুলে এবার পরল। আন্নু বেগম, বড় মনোরম নাম। কিন্তু আন্নুটার শরীরে এত বেশি তেজ—প্রায় যেন সরকারদের তেজী ঘোড়া-লম্বা মাঠ পেলেই কেবল দৌড়াতে চায়। বড় মাঠে ফেলু এখন আর ঘোড়ায় চড়ে ছুটতে পারে না। কোমরে টান ধরে। সমানে ছুটতে গেলে বড় অবশ অবশ লাগে শরীরটা। আন্নু ক্ষেপে গিয়ে বলে,মরদ আমার! ঠেলে ফেলে দেয় পিঠ থেকে, মাটিতে থুবড়ে পড়ে মুখ হাঁ করে ফেলে ফেলু। তখনই একটা সন্দেহের কোড়া পাখি ফেলুকে কুরে কুরে খায়। সে অতি কষ্টে যেন নদীর চর পার হতে হতে ডাকছে আন্নু, আৰু রে, পাগল ঠাকুর আমারে কানা কইরা দিছে।

ছোট গ্রাম। কয়েক ঘর মুসলমান পরিবার। হাজিসাহেবের বাড়িতে চারটা চার-দুয়ারী নতুন টিনের ঘর আছে। কিছু গাইগরু আছে, বড় দুটো মেলার গরু আছে। তারপর সামুদের কিছু জমি, নয়াপাড়ার মাঠে ওদের কিছু জমি আছে। সম্বৎসর সামুদের ঐ ফসলে চলে যায়। ভাল দু’কানি পাটের জমি থাকলে আর কী লাগে! সামুর মিঞাজানেরা বড় গেরস্থ। সুতরাং অভাবে অনটনে ধান, খৈ, মুড়ি সবই চলে আসে। তারপর আর যারা আছে প্রায় সবাই আল্লার বান্দা। গতরের ওপর নির্ভর। আবেদালির জমি নেই। মনজুর অধিকাংশ জমি ভাগচাষ করে। ঈশম ত শালা! বলে ফেলু একটা খিস্তি করল। পঙ্গু বিবি ঈশমের। সামুদের আতাবেড়া পার হলে হজিসাহেবের গোলাবাড়ি এবং পরে একটা বেতঝোপ আর আতাফলের একটা বড় গাছ, গাছের নিচে ভাঙা কুঁড়েঘর—কোন আদ্যিকাল থেকে বিবিটা সেখানে পড়ে গোঙাচ্ছে। কি কঠিন ব্যাধি! বিবিটাকে সে কোনওদিন ভালোবাসতে পারেনি! ওর একমাত্র সম্বল এক তরমুজ খেত।.. সেই খেতে বসে থাকে মানুষটা। এখন শীতের দিন, এইসব দিন পার হলে গ্রীষ্মের দিন আসবে। তখন যেন ঈশম সওদাগরের মতো। ঠাকুরবাড়ির বান্দা ঈশম তরমুজ বিক্রি করবে, আর সব টাকা তুলে দেবে ছোট ঠাকুরের হাতে। ওর গর্ব সে জমি থেকে ছোট ঠাকুরের হতে কত টাকা তুলে দিতে পারল।

গ্রামের পর গ্রাম অথবা বিস্তীর্ণ মাঠ। মুসলমান গ্রামগুলিতে হাহাকার যেন বেশি। কোনও কোনও গ্রামে হাজিসহেবের মতো ধনী আছেন, তাদের সুখ অন্য ধরনের। ওরা, ওদের ছেলেরা উজানে যায়, পাটের ব্যবসা করে কেউ। মসজিদে ইন্দারা বানিয়ে ওরা সিন্নি ছড়ায়। এইসব দেখে অজ্ঞ ফেলুর বড় ইচ্ছা বড় একটা নাও বানায়। সেই নাও নিয়ে পাটের ব্যবসা করার সখ। পাটের দালাল অথবা ফড়ে হতে পারলে বড় সুখের। যা করে হাজিসাহেব হজ করে আসলেন পৰ্যন্ত।

আর হিন্দু গ্রামগুলির দিকে তাকাও—পুবের বাড়ির নরেন দাস—তার জমি আছে, তাঁতের ব্যবসা আছে। দীনবন্ধুর দুই তাঁত দুই বউ। সুখে আছে লোকটা। আর ঠাকুরবাড়ির মানুষেরা শোনা যায় তল্লাটের বিদ্বান বুদ্ধিমান মানুষ। বড় ঠাকুর পাগল মানুষ। মেজ ঠাকুর, সেজ ঠাকুর দু’দশ ক্রোশ হেঁটে গেলে মুড়াপাড়ার জমিদারদের কাছারিবাড়ির নায়েব গোমস্তা। জমিদারদের বড় বিশ্বাসভাজন লোক। ওদের সচ্ছল সংসার। তারপর পালবাড়ি-জমি আছে ওদের, মিলের কাজ আছে। তারপর মাঝিরা—ওদের বড় বড় গরু। ইচ্ছা করলে ওরা প্রায় মেলায় গরু দৌড়ে বাজি জিতে আসতে পারে। ক্বচিৎ দু’ একবার নয়াপাড়ার মিঞাজানেরা বাজিতে জিতে গেলে—সে যেন মাঝিদেরই বদান্যতা। বারবার কাপ মেডেল নিলে মইনসে কয় কি! ওরা মেলার গরু মাঠে নিয়ে যায়নি বলে মিঞাজানেরা দৌড়ে বাজি জিতে গেল।

শেষে পড়বে কবিরাজ বাড়ি। নীল রঙের ডাক-বাক্স লাল রঙের ঘোড়া আছে বাড়িতে। প্রতাপ মাঝি ধনী লোক, বিশ্বাসপাড়ার মাঠে, ফাউসার মাঠে এবং সুলতানসাদির মাঠে সব সেরা জমিগুলি ওর। শেষে আর দ্যাখো গোঁর সরকার—শালীর সনে পীরিত যার, যে ছন ছাইতে গেলে জলপান করতে দেয় না,  েমানুষ সুদে এবং লালসায় বড় হচ্ছে-অপরের সুখ দুঃখের বোধগম্যি কম—কেবল টাকা টাকা, টাকা পেলে সে নিজের কলিজা পর্যন্ত বিক্রি করতে পারে। ফেলু ভাবতে ভাবতে দাঁত শক্ত করে ফেলল—তোমা-গ মশাইরা জবাই করতে পারলে শান্তি। সে চিৎকার করে উঠল, ঠাকুর, পাগল তুমি! তোমার পাগলামি—সে আর বলতে পারল না, কাকগুলি ওকে অন্যমনস্ক দেখে ফের নেমে এসেছে। সে হুস হুস করতে থাকল। ভারি দুর্দশা তার। বিবিটা এখনও ফিরছে না, কি করছে এতক্ষণ! হাজিসাহেবের ছোট ছেলে কি আন্নুর পেটে হাঁটু রাখতে চায়। সে চিৎকার করে উঠল, হালার কাওয়া আমারে ডরায় না। হালার বিবি আমারে ডরায় না। সে বিবিকে খুন করবে বলে পাগলের মতো হেসে উঠল। সে হাত দুটোর দিকে তাকিয়ে বলল, পোড়া হাত কি ভাল হইব আল্লা! সে বাঁ-হাতটা কোনও রকমে ডান হাতে চোখের সামনে তুলে আনল। দেখল কব্জির চামড়া কুঁচকে গেছে। ফোলা কব্জি, কব্জিতে কানাকড়ি বাঁধা কালো তার ঝুলছে। মনে হয় এই ফেলু ঈশমের বিবির মতো পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। সে উঠোন থেকেই পাগলের মতো চিৎকার করতে থাকল, আন্নু রে, আন্নু।

তখন আবেদালির বিবি জালালি যাচ্ছে বাড়ির নিচ দিয়ে। বাঁশ ঝাড়ের নিচে শীর্ণ জালালিকে দেখে মনে হল বিলে নেমে যাচ্ছে জালালি। এখন গরিব গরবাদের শালুক তুলবার সময়! আশ্বিন-কার্তিকে সামনের সব মাঠ আর অঘ্রান-পৌষে বিলেন জমিতে কট করে ধানের ছড়া শামুকের মুখে কেটে কোঁচড় ভরা যায়। এখন মাঠে কিছু নেই। ফাঁকা মাঠ। যব গমের ফলন হয়নি। এখন শুধু বিলে নেমে যাওয়া শালুকের জন্য। জালালি শালুক তুলতে বিলের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। জালালিকে দেখে বলল, ভাবি, আন্নুরে দ্যাখছেন নি?

জালালি গামছাটা সঙ্গে রেখেছে। মাথায় ওর একটা পাতিল ছিল। পাতিলটার জন্য মুখ দেখা যাচ্ছে না। পাতিলটা মাথায় ছিল বলেই হয়তো ফেলুর কথা ওর কানে যায়নি। অথবা গেলেও অস্পষ্ট। সুতরাং জালালি পাতিলটা মাথা থেকে নামিয়ে এনে বলল, কি কও মিঞা? আমারে কিছু কও নাকি!

—আর কি কমু গ! বলে ফেলু যে ফেলু, সে পর্যন্ত গাইগরুর মতো মুখে নির্বোধের হাসি নিয়ে তাকাল।

—কিছু কইতে চাও?

—আন্নু গেছে এক শিশি তেল আনতে। আইতাছে না।

জালালি বলল, আইব নে। বলে জালালি দাঁড়াল না। সে ফের পাতিলটা মাথায় নিয়ে মাঠে নেমে গেল। বড় মাঠ সামনে। বাঁ পাশে সোনালী বালির নদী, নদীর চর। চর পার হয়ে সোজা উত্তরমুখো হাটলে সেই বিল। ফাওসার বিল। বিলে একবার ঈশমকে কানাওলায় ধরেছিল—এত বড় বিল এ-পরগণাতে কেন, এ-জেলাতে বুঝি আর নেই। একবার বিলের জলে কুমীর ভেসে এসেছিল, বড় এক অজগর সাপ ভেসে উঠেছিল। তারপর এই বিলের নানা রকমের কাছিমের গল্প, গজার মাছের গল্প, এবং রাতে সপ্তডিঙা মধুকরের গল্প কিংবদন্তীর মতো এ-অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে। সেই বিলে জালালি যাচ্ছে শালুক তুলতে। শুধু জালালি নয়, অনেকে, এমন প্রায় হাজার হবে। ওরা শালুক তুলে আনবে। ওরা ভোরে শালুক তুলতে বের হয়ে যাচ্ছে। ফেলু উঠোনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল।

আবেদালি এ সময়ে দেশে চলে আসবে। বর্ষা, শরৎ, হেমন্তে সে গয়না নৌকার মাঝি। শীত, গ্রীষ্ম আর বসন্তে সে হিন্দু পাড়ায় কামলা খাটবে। এই তো গ্রাম—গ্রামে মাত্র সামু মাতব্বর মানুষের মতো চলাফেরা করতে পারছে। যত সামু মাতব্বর মানুষ হয়ে যাচ্ছে, যত হিন্দু যুবকেরা সম্মান দিয়ে কথা বলছে, তত ফেলু সামুর প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। সে যেন সামুর বান্দা হয়ে যাচ্ছে ক্রমে।

যেন এক মানুষ মিলে গেছে সমাজে, মাত্র এক মানুষ, যে এইসব ভদ্র হিন্দু পরিবারের মানুষদের চেয়ে কোনও অংশে কম যায় না। সামু ঢাকা থেকে এলেই ফেলুর ঘুরঘুর করা বেড়ে যায়। সে ওর ভাঙা হাত সম্পর্কে নালিশ দেবার সময় ক্ষোভে-দুঃখে ভেঙে পড়ে। ভিতরে ভিতরে এইসব হিন্দু সুখী পরিবারের বিরুদ্ধে তার আক্রোশ ভয়ঙ্করভাবে পীড়ন করলে সামু যেন মোল্লা-মৌলবীর মতো কিছুটা আসানের কথা শোনাতে পারে। সামুর লীগ পার্টি—জিন্দাবাদ—আমাদের জন্য একটা দেশ চাই। এই দেশে আমাদের ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য একটা জায়গা চাই। তারপরে যে কথা শুনলে ফেলুর ঘুম চলে আসে—একদিন এ-দেশটা দুঃখী মানুষের হয়ে যাবে। ফেলু দুঃখী মানুষ ভাবতে সে প্রায় তার গোটা স্বজাতিকে ভেবে ফেলেছিল। তার জন্য কতরকমের জেহাদ—ধর্মযুদ্ধ চাই। তার জন্য কতরকমের বিপ্লব চাই, সামু বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে পড়ত। আমাদের জন্য দেশ, এই দেশ মাটি ফসল সব আমাদের জন্য হবে। আমাদের সুখের জন্য হবে। অধিকাংশ মানুষ যখন আমরাই এই দেশে বসবাস করছি, তখন এই দেশ আমাদের।

সামু যখন বইয়ের ভাষায় টেনে টেনে কথা বলতে থাকে, তখন মনে হয়, ফেলুর সব ফেলে ঐ এক মানুষের পিছনে থেকে জাতির সেবা করলে কাজটা মোল্লা-মৌলবীর চেয়ে কম ধর্মীয় হবে না। কিন্তু হাত ভেঙে কী হয়ে গেল সে! কাকগুলি মাছের লোভে মাথার ওপর উড়ছে। সে হুস্ করল। বলল, হালার কাওয়া, আমার নাম ফেলু শেখ। সে মাথার উপরে ডান হাতে পাটকাঠিটা ঘোরাতে থাকল।

আর তখনই বাছুরটা হাম্বা করে ডাকল। হাড় বের করা বাছুরটার মুখ দিয়ে ঠাণ্ডায় লাল পড়ছে। বাছুরটার ঠাণ্ডা লেগেছে, শীতে বাছুরটা ফুলে ঢাক হয়ে আছে। রোদে নিয়ে গেলে ফুলে থাকা ভাবটা গরমে কমে যাবে। তা’ছাড়া হাতে একটা কাজ পাওয়া গেল। এত বেলায়ও যখন আন্নু ফিরে এল না, বাছুরটা ক্ষুধায় হাম্বা করছে—ওকে নিয়ে তবে মাঠে নেবে যেতে হয়। খোঁটাতে বেঁধে দিলে কিছু ঘাসপাতা খেতে পাবে। ঘাসপাতা খেলে শক্ত হবে বাছুরটা।

আন্নু আসছে না। কী করা যায়? সে তাড়াতাড়ি ডান হাতে মাছগুলি তুলে ফেলল। ঘরের ভিতর মাছ রেখে ঝাঁপ বন্ধ করে দিল। সে বাছুর নিয়ে গোপাটে নেমে গেল। খোঁটা পুঁতে দিলে দেখল কাতারে কাতারে লোক বিলে শালুক তুলতে যাচ্ছে। সব মুসলমান বিবি, বেওয়া। ওরা এ-অঞ্চলের সব মুসলমান গ্রাম থেকে নেমে যাচ্ছে। আর এই তো সামনে বিশাল বিলেন মাঠ। হাইজাদির সরকাররা পুকুরপাড়ে বাস্তুপূজা করছে। ভেড়া বলি হচ্ছে। ঢাক বাজছে, ঢোল বাজছে।

বাস্তুপূজার জন্য ঠাকুরবাড়ির ছোট ঠাকুর বের হয়ে পড়েছেন। তিনি হিন্দু গ্রামে উঠে সব হিন্দু গেরস্থবাড়িতে বাস্তুপূজার তিল-তুলসী দেবেন। বাস্তুপূজায় ঢাক বাজছে। পূজা-পার্বণে ঘুরে বেড়াবেন, মন্ত্র পড়বেন। ঈশম আজ তাঁর সঙ্গে যাবে না। সে কাল যাবে। চাল কলা এবং তৈজসপত্র সব বোচকা বেঁধে আনবে।

সংরকারদের বাস্তুপূজায় কত মেয়ে-বউ এসেছে নতুন শাড়ি পরে কপালে সিঁদুরের টিপ, হাতে সোনার গহনা, পরনে গরদের শাড়ি আর ওদের কেমন মিষ্টি চেহারা—কী সুন্দর মুখ। একেবারে য্যান হেমন্তে সোনালী বালির নদীর চর। পূজা হচ্ছে, পার্বণ হচ্ছে। কুটুমের মতো ঠাকুরবাড়ির বড়বৌ, ধনবৌ পুকুরপাড়ে নেমে এল। জমির বুকে ছোট কলাগাছ, নিচে ছোট ঘট। ঘটের ওপর নারকেল আর চারধারে সব নৈবেদ্য—যেন ভোজ্যদ্রবের অভাব নেই। তিলা কদমা শীতের যত খাদ্যদ্রব্য সব ওদের আয়ত্তে।

আর কী জ্বালা, জ্বালা নিবারণ হয় না জলে, জালালি জলের দিকে নেমে যাবার জন্য মাঠের ওপাশে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। আর কী জ্বালা, বাছুরটা কিছুতেই ঘাসে মুখ দিচ্ছে না। শীতের ঘাস—শিশিরে ভিজে আছে ঘাস। যতক্ষণ রোদ ভালোভাবে না উঠবে, যতক্ষণ হিম ঘাস থেকে ভালোভাবে না মরে যাবে ততক্ষণ বাছুরটা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে, ঘাসে মুখ দেবে না। সে রাগে দুঃখে বাছুরটা ঘাস খাচ্ছে না বলে পেটে লাথি বসিয়ে দিল। বাছুরটা দু’হাঁটু মুড়ে মুখ থুবড়ে পড়তে পড়তে বেঁচে গেল। কারণ ওর মনে হচ্ছিল বাছুরটা তাড়াতাড়ি ঘাস ক’টা না খেয়ে ফেললে, এক ফাঁকে হাজিসাহেবের খোদাই ষাঁড়টা অথবা গৌর সরকারের দামড়া গরুটা এসে চেটে পুটে এই তাজা ঘাস খেয়ে ফেলবে। এই ঘাস সে যেন মাঠে নেমে আবিষ্কার করে ফেলেছে। তাড়াতাড়ি বাছুরটা ঘাস খেয়ে ফেললে আর কেউ এসে ভাগ বসাতে পারবে না। কিন্তু বলিহারি যাই হালার মাগী আন্নু ভাগে এক বাছুর এনেছে! এমন এক মরা বাছুর যার কপালে সুখ নাই, গায়ে বল নাই, আছে কেবল মল-মূত্র ছড়ানো ছিটানো অথবা ধ্যাবড়ানো। আন্নুর কথা মনে হতেই সে সব ফেলে গাঁয়ের দিকে উঠে যাবে ভাবল। এক শিশি তেল ধার করতে এত দেরি!

দূরে ঢাক বাজছে, ঢোল বাজছে। ওর কানে বড় বেঢপ লাগছে শব্দটা। জালালিকে দেখা যাচ্ছে। অনাহারে জালালি কাতর! এখন ফাওসার বিলে নেমে যাবার জন্য প্রতাপ চন্দের ঘাট পার হচ্ছে। সে, সামনে যেসব জমি আছে, শ্যাওড়া গাছের বন আছে তা অতিক্রম করে বেনেদের পুকুরপাড় ধরে হাঁটছে। সেই এক বিস্তীর্ণ মাঠ, মাঠের সব জমি প্রতাপ চন্দের। সেই সব জমি পার হলে ফওসার খাল। খালের পাড়ে পাড়ে যত জমি পড়বে- পাটের, আখের, এমনকি করলার জমি, সব গৌর সরকারের। তারপর যত জমি, সব হাজিসাহেবের। হাজিসাহেবের তিন বিবি, ছোট বিবির বয়স আর কত—এই এক কুড়ি চার-পাঁচ হবে। হাজিসাহেব ঈদের দিনে তিন বিবি মসজিদে নিয়ে যাবার সময় চারদিকে নজর রাখেন। সতর্ক নজর। কেউ নজর দিয়ে গিলে ফেলল কিনা দেখেন। অন্তরালে কিছু দেখা যায় কিনা, হেই হেডা কি হইছে। নজরে লালসা ক্যান, বলে হয়তো একটা পাঁচনের খোঁচা মারেন মাইজলা বিবিরে। খোঁচা দিয়ে কন, বিবিরে, অঃ সোনার বিবি, পথ দেইখা হাঁট। তখন কেবল কেন জানি মনে হয় ফেলুর, পাঁচনটা কেড়ে নিয়ে এক বাড়ি হালার হালা, হাজির মাথায়। ভাবতে ভাবতে এসব, ফেলুর মাথায় খুন চড়ে যায়, ফেলু স্থির থাকতে পারে না—কেবল কি সব মনে হয়। ফেলু, যে ফেলু কোন মাতব্বর নয়, জলে-জঙ্গলে যে ফেলু মানুষ হয়েছে, যে ফুেলকে উজান থেকে হাজিসাহেব ধরে এনেছিল—উজানি নৌকাতে ধান কাটা সারা হলে, ফেলু হাজিসাহেবের পেটে পিঠে পায়ে রসুন গোটার তেল গরম করে মেখে দিত, সেই ফেলুর কেন জানি বড় সাধ মাঝে মাঝে হাজিসাহেবের মাইজলা বিবিরে একবার বোরখার অন্তরালে উঁকি দিয়া দ্যাখে।

সে গোপাটে দাঁড়িয়ে ছিল। বড় সেই অশ্বত্থ গাছটির নিচে বিচিত্র সব মটকিলা গাছের ঝোপ, পাতাবাহারের জঙ্গল। শীতকাল বলে জঙ্গলের ভিতরটা শুকনো খটখটে। ভিতরে ঢুকে গোসাপের মতো ঝোপের আড়ালে সন্তর্পণে পড়ে থাকলে হয়তো মাইজলা বিবিরে দেখা যাবে—কারণ, ও-পাশটায় হাজিসাহেবের অন্দরের পুকুর। ঝোপের ভিতর থেকে উঁকি দেবার আগে চারপাশটা সে দেখে নিল। বাঁদিকে আবেদালির ঘর, কেউ এখন ঘরে নেই। আমগাছটার নিচে ভাঙা ঘর এখন খালি। উত্তর-দুয়ারী ঘরে সেই কবে জোটন বাস করত, এখন জোটন নেই বলে বর্ষায় বৃষ্টিতে ঝড়ে ঘরটা একেবারে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। কিছু ঝোপজঙ্গল, বেতগাছ আবেদালির বাড়িটাকে সব সময় অন্ধকার করে রাখে। কোনও রকমেই শীতের সূর্য আবেদালির উঠোনে নামতে চায় না।

আর এইসব ঘর উঠোন এবং ঝোপ-জঙ্গল পার হলেই—হাজিসাহেবের আতাবেড়ার ওপাশে তিন বিবির গলা, কাচের চুড়ির মতো জলতরঙ্গ বাজিয়ে চলেছে। কি হাসে! হাসতে হাসতে মনে হয় হালার দুনিয়া গিলা ফ্যালবে। সিঁথিতে বড় লম্বা টান ধানখেতের সাদা আলের মতো। আর ডুরে শাড়ি হাঁটুর নিচে বেশিদূর নামতে চায় না। ঝোপের ভিতর থেকে ফেলু মরিয়া হয়ে এবার উঁকি দিল। হাত পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে, ডান হাতটা কোনওরকমে কাজে লাগছে এখনও, কবে এই হাতটা পঙ্গু হয়ে যাবে—সে প্রায় একটা মরা সাপের মতো ঝোপের ভিতর পড়ে থাকল। ঝোপের পাশ দিয়ে ঘাটের পথ। হাজিসাহেবের অন্দরের পুকুরের পানি কি কালো। পানি দেখলেই বিবি-বৌদের পেটে জ্বালা ধরে। তলপেটটা শিরশির করতে থাকে। কালো পানির টানে চুপি চুপি সময়ে-অসময়ে মাইজলা বিবি ঘাটে নেমে আসে। এলেই খপ করে হাত ধরে ফেলবে, ধরে ঝোপের ভিতর টেনে-ফেলু আর অপেক্ষা করতে পারল না। সে কচ্ছপের মতো এবার গলাটা তুলে ধরল। সে মরা সাপের মতো বেশি সময় শিকারের আশায় ঝোপের ভিতর পড়ে থাকতে পারছে না।

যখন মন খুশিতে উজান বয় না তখন ডাকে আন্নু। আর যখন মন উজানি নদীর মতো মাতাল তখন ডাকে, আন্নু বেগম। পেট পুরে খেতে পারলে ডাকে বেগমসাহেবা। ফেলু বেগমাসাহেবার জন্য পাগল, আর পাগল এই মাইজলা বিবির সুরমাটানা চোখের জন্য। ঘাট থেকে তাড়িয়ে দেবার পর এই অশ্বত্থের ঝোপ ওর মতো নিরালম্ব মানুষের সামান্য আশ্রয়। সে ঝোপের ভিতর একটা মরা গো-সাপের মতো সেই থেকে পড়ে আছে—মাইজলা বিবি এ-পথে এখনও ঘাটে এসে নামছে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *