প্ৰথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড

নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – ২.১৫

১.১৫

সকালবেলাতে বড়বৌর মনে হল কেউ রাতে ফল-জল খায়নি। সবাই সোনাকে নিয়ে এমন ব্যস্ত ছিল যে, খাবার কথা কারও মনে আসেনি। এখন সোনা ঘুমোচ্ছে। খুব আলগোছে চন্দ্রনাথ তাকে পশ্চিমের ঘরে নিয়ে যাচ্ছেন। এবং শুইয়ে দিচ্ছেন। কাঁথা-বালিশ সব টেনে নেওয়া হচ্ছে পশ্চিমের ঘরে। কপালে হাত দিয়ে দেখল বড়বৌ। মনে হল ওর জ্বরটাও কমে এসেছে। সে পুবের ঘরে গিয়ে দেখল, তেমনি পড়ে আছে সব। কুকুরটা দাওয়ায় শুয়ে আছে। তার মানুষ কোথাও নেই। তাঁকে ওর রাতে খেতে দেওয়া উচিত ছিল। ওর যে এমন মনে হয়নি তা নয়। কিন্তু ভূপেন্দ্রনাথ, চন্দ্রনাথ এবং শচীন্দ্রনাথের মুখচোখ এত বেশি বিষণ্ণ ছিল যে, খাবার কথা বড়বৌ বলতে সাহস পায়নি। ওরা খেতে আসছে না, ওর মানুষ একা-একা বসে খাবে, ওর কেমন স্বার্থপরতার কথা মনে হয়েছিল। একসঙ্গেই খাবে। সোনা হয়তো কিছুক্ষণের ভিতরই স্বাভাবিক হয়ে যাবে, এই আশায়-আশায় সবাই রাত ভোর করে দিয়েছিল।

পাগল মানুষই নেই। কুয়াশা ঘন বলে কোথায় আছে মানুষটা টের পাওয়া যাচ্ছে না। খুব দূরে যখন আজকাল যান না, তখন হয়তো অর্জুন গাছটার নিচে গিয়ে বসে রয়েছেন। তার অনেক কাজ। সে সকাল-সকাল ঘরে ঢুকে সব ফলমূল বের করে দিল। আর একটু বেলা হলে সেই ফলমূল ছেলেদের ভাগ করে দেবে। মনটা কেন যে খচখচ করছে বড়বৌ বুঝতে পারছে না। ভীষণ একটা হাহাকার বাজছে। প্রথমে মনে হয়েছিল, শ্বশুরমশাই মারা গেছেন, এতদিন সে মানুষটাকে সেবা-শুশ্রূষা করেছে, হয়তো এজন্য এমন হবে। কিন্তু পরে মনে হল, এত গভীরে সেই হাহাকার বাজবে কেন! কেমন শূন্য-শূন্য মনে হচ্ছে সব! তিনি কতদিন কাছে থাকেন না, দশ-বার দিন ক্রমান্বয়ে বাইরে-বাইরে ঘুরে বেড়ান, বাড়ি ফিরে এলেই নাপিতবাড়ির হরকুমারকে ডেকে দাড়ি কামানোর ব্যবস্থা করা হয়, প্রতিদিন হরকুমার আসে না, দু’দিন অন্তর-অন্তর তার এ-বাড়ি ঘুরে যাবার কথা, সে না এলে এক মুখ দাড়ি নিয়ে মানুষটা থাকবেন বলে বড়বৌর খারাপ লাগে। গতকাল সে বার বার করে বলেছে, তুমি এ ক’দিন কোথাও যেও না। এ-সময় কোথাও যেতে হয় না। তবু যে মানুষটা কোথায় গেলেন! সে পলটুকে ডেকে তুলল, এই, ওঠতো। যা দেখ উনি আবার কোথায় গেলেন।

মার এতটা উদ্বেগ পলটুর ভালো লাগল না। সে পাশ ফিরে শুল।

—কত বেলা ঘুমাবি! যা না বাবা। দেখ, উনি কোথায় গেলেন। ধরে নিয়ে আয়।

পলটু চোখ বুজে ছিল। মার এই বার বার তাগাদা ওর ভালো লাগছিল না। ঠাকুরদা মারা গেছেন এ ক’দিন ওদের পড়া থেকে ছুটি। সে খুব ঘুমাবে এ ক’দিন। অন্য সময় সকাল হলেই দরজায় শব্দ, পলটু ওঠ। বেলা হয়ে গেছে, গোপাটে যাবি। মাস্টারমশাইর জন্য ওরা ঘুম থেকে কিছুতেই বেলা করে উঠতে পারে না। ওর মনে হয় তখন, মাস্টারমশাই রাতে ঘুমান না। কেবল জেগে থাকেন। যদি ভোর হয়ে যায়, বেলা হয়ে যায় তবে তিনি ওদের নিয়ে গোপাটে যেতে পারবেন না, মটকিলার ডাল ভেঙে দিতে পারবেন না, মাঠে সব প্রাতঃকৃত্যাদির কাজ, যেন তাঁর শুধু ওদের পড়ানোই কাজ নয়, ওদের স্বাস্থ্যবিধি লক্ষ রাখাও তাঁর কাজ। পলটুর মনে হয় তখন, কে যে তাঁকে এ-সব দায়িত্ব দিল, কেন যে তিনি সারা রাত না ঘুমিয়ে ওদের ডেকে তোলার জন্য বসে থাকেন! সে মাস্টারমশাইর ভয়ে কুঁকড়ে থাকে সব সময়। ওর কিছুতেই পড়া মুখস্থ হয় না। সে বার বার পড়েও পড়া মনে রাখতে পারে না। মাস্টারমশাই তাকে খুব মারেন। লালটুকে খুব একটা মারতে পারেন না। একদিন খুব মেরে ছিলেন মাস্টারমশাই।…পড়াশুনা না করলে বড় হয়ে করবি কি? খাবি কি?

লালটু একটু বেয়াড়া ধরনের, জেদি, একগুঁয়ে। সে মার খেয়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলে বলেছিল, আমি তরকারি বেইচা খামু।

সেই থেকে শশীভূষণ যেন লালটুকে আর তেমন মারেন না। বরং তিনি যেন কেমন একটু ওকে সমীহ করতে শুরু করেছেন। পলটু শুয়ে শুয়ে ভাবল, তাকে মারলে সেও একদিন এমন বলে দেবে। কিন্তু সে দেখেছে, পারে না। খুব রেগে গেলে মাস্টারমশাই মারেন। তারপর আবার চুপচাপ মাথা ঠাণ্ডা করে কেমন দুঃখী মানুষের মতো মু। করে রাখেন। বলেন, তোরা বড় হলে এই দেশ বড় হবে। অর্থাৎ যেন শশীভূষণের বলার ইচ্ছা, দেশ মানেই হচ্ছে দেশের মানুষ। তাদের প্রকাশই হচ্ছে দেশের প্রকাশ। স্কুলে পলটু দেখেছে সারাটা সময় মাস্টারমশাই কী ব্যস্ত থাকেন। কোথায় কী হবে, তিনি নানারকম ফুলের গাছ এনে স্কুলের মাঠে লাগিয়েছেন। নানারকম খেলার ব্যবস্থা করেছেন। সবার ছুটি হয়ে গেলেও তাঁর ছুটি হয় না। ওরা তখন স্কুলের মাঠে মাস্টারমশাইর জন্য বসে থাকে।

বড়বৌ আবার ডাকল, কী রে, তুই উঠবি না।

সে বলল, না। আমার ভাল লাগে না।

—দেখ বাবা, উনি এই সকালে কোথায় আবার বের হয়ে গেলেন। একটু উঠে গিয়ে দেখ।

—তুমি দ্যাখ। আমি পারমু না।

বড়বৌ ছেলের মাথার কাছে বসল–সোনার শরীর ভাল না। কত কাজ আমার। তোরা এখন বড় হয়েছিস। ওকে যদি দেখে না রাখিস তবে কে দেখবে?

পলটুর ভারি বিরক্ত লাগছিল। সে সাধারণত মায়ের সঙ্গে আগে শুত না। এই সেদিন থেকে মায়ের পাশে শুচ্ছে। সে শুত ছোটকাকার সঙ্গে। কিন্তু এই দেশে কী যে হল! রাতে নানারকম অত্যাচার এবং অবিচারের ছবি ভেসে উঠলে মা ভয় পান। সারারাত কোনও কোনও দিন ওদের জেগে থাকতে হয়েছে। বর্ষাকালটাই ভীষণ মনে হয়েছিল। শীতকালটা ভালই গেছে। কোথায় কোন অঞ্চলে আবার দাঙ্গা বেধে গেছে। এই গ্রীষ্মে আবার নানা রকমের খবর। এসব কারণেই পলটু মায়ের সঙ্গে থাকছে। মার এমন কথায় সে বলে ফেলল, আর তোমার লগে শুমু না। ছোট কাকার লগে শুমু।

বড়বৌ ভারি কষ্ট পেল ওর কথায়। পলটু খুব একটা জেদি নয়। তবু কেমন যেন সে তার বাবার সম্পর্কে একটা বিরূপ ধারণা পুষে রেখেছে। সে যেন বুঝতে পারে, সে তার মা এবং বাবা এই পরিবারে গলগ্রহ। এবং তার বাবা কত বড় কাজ করতেন। সে এবং মা। কত সুন্দর সে একটা ছবি দেখতে পায় মাঝে মাঝে। বড় শহরে তার মা তার হাত ধরে কোনও একটা বড় রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে। বাবার পরনে প্যান্ট-কোট। বাবা চকচকে জুতো পরেছেন। মাথায় ফেল্ট ক্যাপ। ওর বাবা সাহেব বনে যেতে পারতেন। যেমন সে দেখেছে মুড়াপাড়ার সেই মানুষ, মেজবাবু, যাঁকে সে দেখেছে প্যান্ট-কোট পরলে অন্য মানুষ হয়ে যান। সারা পরিবারে যতই মেজবাবু সম্পর্কে নিন্দা হোক, ভিতরে ভিতরে মেজবাবুকে সবাই কেমন সমীহ করত।

পলটুর ভারি খারাপ লাগে ভাবতে, তার বাবা পাগল। সেজন্য যখনই কোথাও ওর বাবার কথা ওঠে, সে সেখানে থাকে না। কারণ, ভিতরে ভিতরে ওর এই এক কষ্ট। এবং সেইজন্যই বুঝি কোনও পড়া মনে রাখতে পারে না। কেমন এক হীনমন্যতায় সে সব সময় ভোগে। বড়বৌ ওকে দিয়ে কোনও কাজ করাতে পারে না। তখন যদি ধন এসে বলত, পলটু, ওঠ, তোর বাবাকে খুঁজে নিয়ে আয়, পলটু এক লাফে উঠে পড়ত। এবং সে তার বাবাকে খুঁজতে বের হতো।

এসব জেনেও বড়বৌর পলটুকে কেন জানি বার বার বলতে ইচ্ছা হয়, তুই তোর বাবাকে দেখে না রাখলে কে রাখবে? তোর বাবার জন্য কষ্ট হয় না পলটু? তুই আমার একমাত্র ছেলে! তুই আমার দুঃখ বুঝবি না?

মার এমন চোখ-মুখ পলটু সহ্য করতে পারে না। সে ভয়ে তাকাচ্ছে না। যত কষ্ট মার এই চোখে-মুখে। কেমন দুঃখী মুখ নিয়ে মা মাঝে মাঝে তার শিয়রে বসে থাকে। তখন সে আর শুয়ে থাকতে পারে না। বাবাকে সে খুঁজতে বের হয়। কাউকে সে কিছু বলে না। কেউ যদি ওকে জিজ্ঞাসা করে, ঠাকুর তুমি এই জঙ্গলে। অথবা মাঠে। সে বলে, এমনি। সে যে তার বাবাকে খুঁজতে বের হয়েছে কিছুতেই কাউকে বলবে না। বরং সে নিজে, যত জায়গা আছে, যেখানে যেখানে তিনি বসে থাকতে পারেন, সব জায়গায় ভীষণ ছুটোছুটি করেও যখন খুঁজে পায় না, তখন এক অসহ্য অভিমানে একা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবার অলক্ষ্যে কাঁদে। যেন তার বলার ইচ্ছা, বাবা, তুমি এটা বোঝ না কেন, তোমার জন্য মা চোখ-মুখ বুজে সংসারের সব কাজ করে যাচ্ছে। তুমি ভালো হলে আমাদের কোনও দুঃখ থাকত না।

আর সোনা যদি খুঁজতে বের হয় তার পাগল জ্যাঠামশাইকে তখন সে সবাইকে জিজ্ঞাসা করবে, কই গ্যাছে দ্যাখছেন? আমার জ্যাঠামশয়রে দ্যাখেন নাই? সকাল থাইকা বাড়ি নাই।

—না রে ভাই, দ্যাখি নাই।

সোনা লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটে। বাড়ি-বাড়ি সে জিজ্ঞাসা করে বেড়ায়। কখনও কখনও কেউ খবর দেয় তিনি বসে আছেন ট্যাবার পুকুরপাড়ে। তখন সোনা এমন ছুটতে থাকে রোদ মাথায় করে যে কে বলবে এই ছেলে সোনা। ঠাকুরবাড়ির ছোট ছেলে, কোথায় যে এখন যাচ্ছে কেউ টের পাচ্ছে না। কেবল জানে সে যেখানেই যাক, যাচ্ছে পাগল মানুষকে খুঁজে আনতে।

আর যদি পলটু খুঁজতে বের হয় মনে হবে, সে বাড়ি থেকে না বলে না কয়ে বের হয়ে এসেছে। একা একা বনে মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোন উদ্দেশ্য নেই। কেবল কাজে ফাঁকি দেবার জন্য, অথবা পড়াশোনা না করার জন্য সে বাড়ি বাড়ি হেঁটে যাচ্ছে। কেবল একজন মানুষ বুঝতে পারে পলটু যাচ্ছে তার বাবাকে খুঁজতে, সে কিছু বলে না, কেবল খুঁজে বেড়ায়। সে হচ্ছে ঈশম। সে তখন বলবে, কর্তা না জিগাইলে পাইবেন কি কইরা?

—কারে জিগামু?

—যারে সামনে পাইবেন তারেই।

পলটু তখন কোনও জবাব দেয় না। সে তার বাবাকে খুঁজতে বের হয়েছে টের পেলেই সে যেন সকলের কাছে ছোট হয়ে যাবে। পলটুর মুখ দেখলেই তখন টের পাওয়া যায় বাবার জন্য সেও কম দুঃখী নয়। সে কোনও কথা না বলে কেবল হাঁটে। এই মাঠে-ঘাটে সে চুপচাপ বাবাকে খুঁজে বেড়ায়। মাঝে মাঝে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয় তার বাবা ভালো হয়ে গেছেন। তিনি বারদির স্টিমার ঘাটে এসে নেমেছেন। কত লটবহর। মার জন্য ট্রাঙ্ক ভর্তি শাড়ি এনেছেন। ধনকাকীমার জন্য সুন্দর ছাপাশাড়ি, সোনা লালটুর দামি প্যান্ট জুতো এবং সঙ্গে দু’জন দারোয়ান, ওরা পলটুকে কাঁধে তুলে নিয়েছে। সাহেবের ছেলে, ওরা ওকে নিয়ে মাঠের ওপর দিয়ে ছুটছে। অথবা ওর মনে হয় এক রাতে জেগে গেলে সে দেখতে পাবে বাবা বলছেন, আমি কলকাতায় যাচ্ছি চাকরি করতে। তোমরা ভালো হয়ে থেকো। সে, ঈশমদা, সোনা, লালটু সবাই মিলে বাবাকে নদীর চর পার করে দিয়ে আসবে। বাবাকে স্টিমারঘাটে তুলে দিয়ে আসবে। বাবা রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে ওদের বিদায় জানাবেন। স্টিমারটা মাঝগাঙে ভেসে গেলে, বাবাকে যখন আর সে দেখতে পাবে না, তখন সকলের অলক্ষ্যে ওর চোখ ঝাপসা হয়ে আসবে।

মার চোখ-মুখ দেখে পলটু কেমন বিরক্ত হয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়ল। বড়বৌ এখন আর কাউকে বলতে পারে না, বিশেষ করে শচীন্দ্রনাথ অথবা চন্দ্রনাথকে, একবার দেখুন তো মানুষটা এত সাতসকালে যে কোথায় গেলেন! বরং নিজেরই কেমন সঙ্কোচ বোধ হয়। কে তার জন্য এত করবে! পলটু বড় হয়েছে। লালটু বড় হয়েছে। সে এখন ওদের পিছু-পিছু ঘোরে। লালটু জ্যেঠিমার এই দুর্বলতা বোঝে। মাঝে-মাঝে সে তার পরিবর্তে নারকেলের নাড়ু চায়। তিলের নাড়ু, তক্তি এসব চায়। সে কাজের পরিবর্তে এসব না পেলে জ্যাঠামশাইকে খুঁজতে যায় না। সোনাকে সব সময় পাঠানো যায় না। সে ওদের মতো বড় হয়নি। একবার পাঠালে কিছুতেই আর আবিষ্কার না করে ফিরবে না। একবার সারাদিন ঘুরে ওর চোখ-মুখ বসে গিয়েছিল। দুপুরে খোঁজ পড়লে ভয়ে ভয়ে বড়বৌ বলতে পর্যন্ত পারেনি সে তাকে পাঠিয়েছে পাগল মানুষটাকে খুঁজতে। বিকেল হয়ে গেছিল সোনার ফিরতে। তার কি ভয়! ফিরে এলে চুপি চুপি বলেছিল, তুই কিন্তু বলিস না সোনা, তোর জ্যাঠামশাইকে খুঁজতে গিয়েছিলি।

সে বলেছিল, বলব না জ্যেঠিমা।

আর সোনা কেন জানি সেই দিন থেকেই দুটো-একটা মিথ্যা কথা বললে কিছু হয় না এমন ভেবেছিল। বাবা বলেছে তাকে, বিদ্যাসাগরমশাইর মতো হতে হবে। সদা সত্য কথা বলিবে। ওর কেন জানি মনে হয় বিদ্যাসাগরমশাই সারা জীবন সত্য কথা বলেননি। কেউ সারা জীবন সত্য কথা বলে না। ঠাকুরদা সারাজীবন সত্য কথা বলেছিলেন এও তার বিশ্বাস হয় না। সে তো নিজে অনেক কিছুই গোপন করেছে মায়ের কাছে। সে তো কত কিছু শিখে ফেলেছে। মা তার মুখ দেখে কী করে টের পাবেন, মাঝে মাঝে রাতে তার ঘুম ভেঙে যায়। অমলা কমলাকে স্বপ্নে দেখলে ঘুম ভেঙে যায়। শরীরে কেমন যেন একটা কষ্ট হয় তখন। সেকথা মাকে সে বলতে পারেনি। বিদ্যাসাগরমশাই তাঁর মাকে অনেক কিছু বলতে পারেননি। এসব কথা মাকে তো বলা যায় না, মায়ের কাছে এসব গোপন রাখতে হয়। তিনিও গোপন রেখেছিলেন। কেউ সারা জীবন মিথ্যা কথা না বলে থাকতে পারে না। সেও পারবে না। জ্যেঠিমার জন্য মিথ্যা কথা বলে কোনও অনুশোচনা তার হয়নি। বরং একটা কাজের মতো সে কাজ করেছে। মা আজকাল বড় জ্যেঠিমাকে কেন যে অযথা এই নিয়ে হেনস্তা করে। তাকে পাঠালেই মা রাগ করে।

যেন এটা নিয়ম হয়ে গেছে সংসারে, কেউ তো আর বসে নেই। একজন পাগল মানুষের সঙ্গে সবসময় কে আর ঘুরে বেড়াবে! সোনা এসব বোঝে বলেই সে যখন যায় চুপি চুপি বের হয়ে যায়। এমনকি কোনও কোনওদিন সে জ্যেঠিমাকেও বলে যায় না। সে ফিরে এলে নানাভাবে প্রশ্ন করে মা। কোনও জবাব না দিলে ছোটকাকাকে বলে মার খাওয়ায়। সে তখন জ্যেঠিমার মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকে।

বড়বৌ তখন বলল, দ্যাখ, তোর ঠাকুরদার শ্মশানে বসে আছেন কিনা।

পলটু ঘুরে এসে বলল, মা অর্জুন গাছের নিচে নাই।

বড়বৌর ছেলের এমন কথায় কান্না আসছিল। গাছের নিচে নেই, না থাক, অন্য কোথাও হাঁটছেন তিনি। মাঠে নেমে খোঁজ করলেই হবে। কিন্তু পলটুর ভিতরে যে কি রাগ বাপের ওপর সে বোঝে না। কিছুতেই সে বলল না, মা বাবা আর্জুন গাছের নিচে নেই। বলল শুধু নেই। তোর অভিমানের এত কি আছে! আমি সারাজীবন এমন একজন মানুষকে নিয়ে ঘর করলাম, আমার কোনও নালিশ নাই, আর যত নালিশ তোদের। তুই এত স্বার্থপর পলটু?

—তবে দেখ টোডারবাগের বট গাছটার নিচে বসে আছেন কিনা।

সে আবার বের হল। আজ পড়তে হবে না। সে ভেবেছিল, ঘুম থেকে বেলায় উঠবে। বেলায় উঠে ঠাকুরদার শ্মশানের চারপাশটা সাফ করবে। সেখানে ধনকাকা বলেছে একটা তুলসীগাছ লাগাবে। সে এবং বাড়ির আর যারা আছে তাদের নিয়ে একটা বড় তুলসীমঞ্চ করবে। সেখানে রোজ সন্ধ্যায় আলো দেবার কথা। এখন এমন একটা কাজ ফেলে তাকে যেতে হচ্ছে টোডারবাগের বটগাছটার নিচে। সে বলল, এবারই শেষ। আমি আর যেতে পারব না।

কুয়াশা তখন কেটে যাচ্ছিল। ক্রমে হাল্কা রোদ উঠছে। বড়বৌ ঘাটে স্নান করার সময় দেখল পলটু ফিরে আসছে। সে এসে বলল, না নেই।

বড়বৌর ভিতরটা আবার হাহাকার করতে থাকল। সে কিছুতেই যেন স্থির থাকতে পারছে না। বুকের ভিতরটা এমন কেন করছে সে বুঝতে পারছে না।

স্নান সেরে এলে বড়বৌ একটা লালপেড়ে শাড়ি পরল। চুল ভিজা। কপালে এ ক’দিন সিঁদুর দিতে নেই বলে আর আয়নার সামনে দাঁড়াল না। তা ছাড়া অশৌচের সময় আয়নায় মুখ দেখতে নেই। সে, বড়বৌ বলে, তাকে হবিষ্যান্নের আয়োজন করতে হবে। এত করে মানুষটাকে বলেও সে ঘরে রাখতে পারল না। বাসি ফলমূল যা বের করে দিয়েছিল, তা সবাইকে ডেকে ডেকে ভাগ-ভাগ করে দিল। ঘরের এক কোনায় তিনটে কচার ডাল পুঁতে রাখল। কাজগুলি যত সে নিবিষ্ট মনে করবে ভাবছে, অথচ তত পারছে না। ভিতরটা কেবল তার ছটফট করছে। এবং মাঝে মাঝে বুকের ভিতরটা খালি করে শ্বাস নিচ্ছে। মনে হচ্ছিল তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। এমন যে কেন হচ্ছে! সে একবার ঘরের বাইরে এল, দেখল শশীভূষণ লালটু পলটুকে নিয়ে পুকুরপাড়ে যাচ্ছেন। এবং এই ফাঁকে সে একবার ধনবৌর ঘরে ঢুকে কপালে হাত রাখল সোনার। মনে হয় জ্বরটা কমে গেছে। কপালে হাত রাখতেই সোনা চোখ মেলে তাকাল। তারপর তাকিয়ে দেখল, ওর শিয়রে জ্যেঠিমা দাঁড়িয়ে আছেন। জ্যেঠিমার এমন চোখ দেখলেই সোনা টের পায় জ্যাঠামশাই বাড়ি নেই।

সে বলল, আমি ভালো হয়ে নিয়ে আসব।

বড়বৌ বলল, তুই এখন ঘুমো। উনি ঠিক চলে আসবেন। বড়বৌ জানে তিনি চলেও আসতে পারেন। প্রায় সময় তো নিজেই ফিরে আসেন। কোনও কোনওদিন ফিরে না এলেই কষ্ট হয়। আগের চেয়ে তিনি ভালো হয়ে গেছেন। প্রায় তিন সালের ওপর তিনি বাড়ি থেকে বের হয়ে কোথাও দু’একদিনের বেশি থাকেন না। যদি কেউ সেদিন খুঁজে না পায় পরদিন সকালে অথবা দুপুরে তিনি ফিরে আসেন। খুব ক্ষুধা লাগলে আখের দিনে আখ, আনারসের দিনে আনারস মাঠ থেকে তুলে খান। সুতরাং মানুষটাকে কেউ ডেকে না আনলেও যখন ফিরে আসেন, তখন ব্যস্ততার কী আছে এমন ভাবে সংসারের অন্য সবাই। কেবল বড়বৌ জানে যত তার বয়স বাড়ছে, তত এই মানুষের জন্য তার মায়া বেড়ে যাচ্ছে। সে কিছুতেই আজকাল আর দু’দণ্ড চোখের আড়াল করতে পারে না তাঁকে।

কী যে ভুল হয়ে গেল! লজ্জার মাথা খেয়ে কেন যে সে তাকে খেতে দিল না! এখন তো সংসারের সবই ঠিকঠাক হয়ে গেছে, যারা আত্মীয়-স্বজন এসেছে, তারা দু’একবার খবর নিয়েছে, পাগল মানুষ সম্পর্কে, তাদের কোন মায়া-মমতা নেই। এত লোক বাড়িতে অথচ কেউ একবার মুখ ফুটে বলছে না, যাচ্ছি আমি খুঁজে আনতে।

বড়বৌ বলল, কি খাবি সোনা?

—মা বার্লি করতে গেছে।

—তা হলে বার্লি খা।

—ভাল লাগে না জ্যেঠিমা।

—একটা কমলালেবু দেব। পেট ভরে বার্লি খেলে একটা কমলা পাবি।

—সত্যি?

—সত্যি। তুই যা দেখালি কাল! বলতেই সোনা কেমন আবার মুখ কালো করে ফেলল। সে তার দুঃস্বপ্নের ভিতর দেখেছে সেই অশরীরী যেন কার পিছনে কেবল ছুটছে। সে বলল, জ্যেঠিমা, জ্যাঠামশয়কে কেউ খুঁজতে যায় নাই?

—পলটু গিয়েছিল। পায়নি।

—জ্যাঠামশাই কোনদিকে গেছে কেউ দেখে নাই?

—না। খুব কুয়াশা ছিল, কেউ লক্ষ করেনি।

সোনার মনে হল তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যাওয়া উচিত। সে কেমন অবোধ চোখ নিয়ে তাকাল।

বলল, আমি কবে ভাত খামু জ্যেঠিমা?

—জ্বর ছাড়লেই ভাত খাবে।

—এখন কত জ্বর হবে! বলে সে মুখ থেকে চাদরটা সরিয়ে জ্যেঠিমার দিকে তাকাল।

—দাঁড়া দেখছি। বড়বৌ থারমোমিটার বের করল, ঝেড়ে নামালো তারপর বগলের ভিতর দিয়ে সোনার পাশে চুপচাপ বসে থাকল।

সোনা বলল, জ্যেঠিমা, আমি কাল ভাত খাব?

—না। কাল তোমাকে ভাত দেওয়া হবে ন! যদি আজ জ্বর না থাকে, তবে পরশু ভাত পাবে।

—আমার তো কিছু হয়নি। ভয় পেয়ে গেছিলাম।

–কেন এমন ভয় পেলি?

—জানি না। কী যে হল, কী যে দ্যাখলাম শ্মশানে! এ-সব মিথ্যা।

—কী?

—এই যে কাল তুই দেখলি।

—না জ্যেঠিমা সত্যি।

—চোখের ভুল।

—মাস্টারমশায় পর্যন্ত দেখল।

—চোখের ভুল।

—একসঙ্গে দু’জনের চোখের ভুল কী করে হবে?

—হয় বাবা। হয়। দেখি। বলে থারমোমিটার বের করে চোখের ওপর তুলে ধরল। জ্বর এখনও বেশ আছে।

সোনা বলল, কত?

জ্বর বেশ আছে বললে, সোনার মন খারাপ হবে। বড়বৌ এই ভেবে বলল, বেশি নেই। খুব অল্প। মনে হয় বিকেলের দিকে জ্বর রেমিশান হবে।

সোনা জ্বর আছে জেনেই উঠে বসল।—দেখি কত জ্বর।

বড়বৌ ততক্ষণে থারমোমিটার ঝাঁকাতে শুরু করেছে। সে বলল, এই দেখ।

—আটানব্বই তিন পয়েন্ট। সোনা থারমোমিটার দেখতে দেখতে বলল।

আরও বেশি জ্বর। কিন্তু সোনা সঠিক জ্বর দেখতে পেল না। ওর কেমন এখন ভালো লাগছে। কেবল মাথাটা একটু ভারি। সে বলল, আমি আর শোব না। বারান্দায় বসব।

বড়বৌ বারান্দায় একটা ইজিচেয়ার পেতে দিল। ঘরের ভিতর শুয়ে থাকলে কিছু ভালো লাগে না। বারান্দার চারপাশ খোলামেলা, আত্মীয় কুটুমে ভর্তি, পাখ-পাখালিও কম না—সে একা একা শুয়ে থাকলে সব পাখির ডাক আলাদা আলাদা চিনতে পারে। গাছের কোন ডালে অথবা পাতার আড়ালে এবং কত দূরে সব ঘুঘু পাখির ডাক অথবা ডাহুক পাখিরা যে পুকুরের জলে এখন কীটপতঙ্গ খেতে খেতে ডাকছে সে এই বিছানায় শুয়ে থাকলেও তা ধরতে পারে। তার কেবল মনে হচ্ছিল বাইরের পৃথিবীতে অনন্ত সুখ। অযথা তাকে এই বেলা পর্যন্ত জোর করে ঘরের ভিতর আটকে রাখা হয়েছে।

ধনবৌ বারান্দায় এলে বলল, মা আমার জ্বর নাই। জ্বর আমার আটানব্বই তিন পয়েন্ট। জ্যেঠিমা থারমোমিটারে দ্যাখছে।

ধনবৌকে বড়বৌ ইশরায় কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল।

সোনার গায়ে রোদ নেই। টিনের চালে রোদ। সে আজ ভাত খেতে পাবে না। জ্যাঠামশাই বাড়ি নেই। বাবা, মেজ জ্যাঠামশাই দক্ষিণের ঘরে কিসের ফর্দ তৈরি করছেন। ছোটকাকা ঈশমকে পাঠিয়েছেন বড় ঘোষকে ডেকে আনতে। দাদা বড়দা ঠাকুরদার শ্মশানের চারপাশটায় যত আগাছা আছে কেটে ফেলছে। সে এই বারান্দায় বসে সব খবরই পাচ্ছে, সে কেবল এমন দিনে উপবাসী এবং কিছু খেতে পাবে না। সে হাতে একটা হলুদ রঙের কমলা নিয়ে বসে রয়েছে। ছোট বোনটা তার বারান্দায় ফ্রক গায়ে ঘুরছে ফিরছে। দাদার অসুখ এই ছোট্ট মেয়ে কী করে বুঝবে। সে একবার দাদাকে খামচে দিয়ে গেছে। এবং কমলা কেড়ে নিয়ে ছুটছে রান্নাঘরে

তখন পাগল মানুষ ছুটছেন হাসান পীরের দরগায়।

তখনও ফেলু শেখ হাঁটছে।

ক্রমান্বয় এই হাঁটা। কে কোথায় যায়, কী যে করণীয় এই ধরণীতে যেন জানা নেই। আক্রোশের বশে হাঁটা। কার বিবি এখন কার ঘরে। ধরণীতে ফুল ফোটে। মানুষের আহার নিমিত্ত বাঁচা। এই বাঁচার জন্য সংগ্রাম। দান দয়াশীল, ধর্ম বড় বেমাফিক কথাবার্তা। সব নিজের জন্য নিজে করে যাচ্ছ মিঞা। তা মিঞা তুমি একখানা মানুষ বটে! তোমার শরীরে এত দুর্গন্ধ, তবু মিঞা তোমার বাছুরটার নিমিত্ত প্রাণে কষ্ট। কারণ কি? কারণ ধর্ম! কারণ ইজ্জত। তা কী যথার্থই বাছুরটাকে কোরবানী দিয়া আল্লার বেহেস্তে একটু জায়গা করে নিতে চাও!

আর জ্যোৎস্না রাতে এত অন্ধকার কেন! চারপাশে মৃত্যুর বিভীষিকা। আকাশে এক প্রবল প্রতাপান্বিত মোষের মতো কালো মেঘ গর্জাচ্ছে। বিদ্যুতের শিখা আকাশকে মাঝে মাঝে ফালা ফালা করে দিচ্ছে। কড়কড় করে কোথাও বজ্রপাত হল। পাগল মানুষ টের পাচ্ছেন না মৃত্যু তাঁর পিছনে এসে ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে। তিনি পলাশ গাছের নিচে বসে নিভৃতে তখনও কীটসের কবিতা আবৃত্তি করছেন।

বিদ্যুতের আলোয় ওঁর মুখ দেখা যাচ্ছিল। বড় সরল এবং অমায়িক মুখ। সারাদিন কিছু খান নি। গতকাল রাতে হবিষ্যান্ন করার কথা, তা পর্যন্ত করেননি। চোখেমুখে শুকনো একটা ভাব! ম্লান জ্যোৎস্না ছিল প্রথম রাতের দিকে। তিনি, ওরা কেউ আসবে খুঁজতে, এই আশায় বসে থেকে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। এখন জেগে গেছেন। কেউ আসেনি। ঈশান কোণে সেই কালো কঠিন মেঘ সারা আকাশ ছেয়ে ফেলেছে। কোথাও আর বিন্দুমাত্র আলো নেই। আকাশে কোনও নক্ষত্র জ্বলছে না। বিদ্যুৎ চমকালেই ওঁর মুখ দেখা যাচ্ছে। বিষণ্ণ মুখ। কবিতার ভিতর কী যে এক জাদু অথবা বলা যেতে পারে মায়া আছে, যার আবৃত্তিতে সব গভীর দুঃখ ভিতর থেকে মুছে যায়—আহা, এমন সুন্দর সাবলীল এবং ভরাট সৌন্দর্য নিশীথে দেখা যায় না। প্রায় দেবদূতের শামিল তিনি পলাশ গাছের নিচে কুশাসনের ওপর দু’পা ছড়িয়ে বসে রয়েছেন। আকাশের ঘনঘটা দেখে সামান্য হাসছেন। ধরণীর এত উত্তাপ, ক্রমে অঝোরে বৃষ্টিপাত ঘটলে কমে যাবে। তখনই ফেলু দেখে ফেলেছে তাঁকে। এমন একটা সময়ে হাতের কাছে সেই জীব চলে আসবে ফেলু কল্পনাই করতে পারেনি। ফেলুর নিষ্ঠুর মুখ দেখলে আত্মা উবে যাবে। চোখ-মুখ ওর দেখা যাচ্ছে না। চারপাশে এত বেশি গাছপালা এবং অন্ধকার যে তাকে দেখা যাচ্ছে না। কেবল দেখা যচ্ছে একই জায়গায় সরল বৃক্ষের মতো মৃত কাঠে কিছু জোনাকি জ্বলছে নিভছে। সচল জোনাকির একটা মৃত কাঠ মনে হয় ফেলুকে। এখন অন্ধকারে সে ঘোরাফেরা করছে। সে এসেছিল এখানে আকালুর খোঁজে। আকালু কোনও ঝোপজঙ্গলে লুকিয়ে থাকতে পারে, অথবা ওর তো অনেক লোক হাতে। লোকলজ্জার ভয়ে সে এখানে বসে আছে, খাবার দিয়ে যায় কেউ। ফেলু এসেই এমন একজন মানুষকে গাছের নিচে বসে আছে দেখতে পাবে—ভাবতে পারেনি। তার এখানে আসতে আসতে বেশ রাত হয়ে গেছে। কারণ সে নানা বর্ণের ছবি ঝুলিয়ে রেখেছিল শরীরে। সে গ্রামে গ্রামে যত গরিব দুঃখীজন আছে তাদের বলে এসেছে, আমাদের কেউ নাই। আপনেরা সাক্ষী থাকলেন, আকালু আমার বিবিরে নিয়া ভাগছে। আমি খোঁজ পাইলে অর মুণ্ডু ছিড়া ফালামু।

তার যে কোনও কসুর থাকবে না, সে দুঃখী ফেলু, সে এ বাদে আর কিছু জানে না, কবরের সময় তার সব দুঃখের কথা ভেবে যেন সে ইবলিশ কি মানুষ এটা ঠিক করা হয়। কেয়ামতের দিনে অন্তত দুঃখীজনেরা যেন আল্লার কাছে সাক্ষী থাকে—সে ইবলিশ ছিল না, সে মানুষ ছিল। সে তার বিবিকে খুব ভালোবাসত। অভাবে অনটনে বিবিকে সে ভাত দিতে না পারলে কষ্ট পেত। বিবি তার জানের মতো। সেই জান নিয়ে আকালু পালিয়েছে।

সে এখানে এসে ভেবেছিল আকালুকে পাবে। পাবার কথা নয়, কেন আকালু আসবে বনেবাদাড়ে! সে তো সোজা স্টিমারে উঠে চলে গেছে। তার এখন ময়ফেল শহরে। সে কিছুদিন রমনার মাঠে বিবিকে বোরখা পরিয়ে ঘুরাবে। শহর দেখাবে, সদর ঘাটের কামান দেখাবে। সে কেন মরতে আসবে হাসান পীরের দরগায়! কিন্তু হলে হবে কী, ফেলুর এত দুরে যাবার পয়সা নাই। সে শহরে যাবার আগে সব গ্রামগঞ্জ খুঁজে যাবে। যেখানে মানুষ থাকে না, সেখানেও সে যাবে।

তার কারণ এখন ফেলু আর ফেলু নেই। মাথায় তার গণ্ডগোল। কেবল মনে হয়, তার বিবি আর আকালু বনেবাদাড়ে ঘুরে মরছে। বিবি তার আস্ত একটা মুরগি বনে গেছে। আকালু ঝুঁটিয়ালা মোরগ। বনের এক প্রান্ত থেকে মুরগি ডেকে উঠছে, অন্য প্রান্তে মোরগ ডাকছে কক্র অ কো। মাঝখানে বুঝি বসে আছে এই পাগল মানুষ। পাগল মানুষ ফেলুর কাছে এখন আর একটা মোরগ হয়ে গেছে।

পলাশ গাছের অন্ধকারে বোঝাই যাচ্ছে না একজন মানুষ আর একজন মানুষকে হত্যা করার জন্য এগিয়ে আসছে। উত্তেজনায় ফেলুর হাত-পা কাঁপছে। উত্তেজনায় উন্মত্ত ফেলু কী যে করতে যাচ্ছে বুঝতে পারছে না।

পাগল মানুষ দেখলেন অন্ধকারে একটা ইস্পাতের ফলা ভেসে ভেসে এদিকে চলে আসছে। চারপাশ তার জোনাকি। অন্ধকারে কিছুই চেনা যাচ্ছে না। সব কেমন ভুতুড়ে মনে হচ্ছে তাঁর কাছে। তাঁকে ভয় দেখাবার জন্য এসব হচ্ছে। তিনি ভয় পাবেন কেন! তিনি আর সেদিনের মতো ভয় পাবেন না। কাটা মুণ্ড সুতোয় ঝুলিয়ে রেখেছিল ঈশ্বর। তাকে ভয় দেখাবার জন্য তিনি এসব করেছিলেন। ঈশ্বরের কাণ্ডকারখানা বোঝা দুষ্কর। বড় গোজামিলের ব্যাপার। তিনি সেজন্যে মনে মনে হাসলেন। তারপর চোখ বুজে ফের কবিতা আবৃত্তিতে মন দিলেন।

ইস্পাতের ফলাটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তো আসছেই।

একটা ব্যাঙ তখন গর্ত থেকে ক্লপ ফ্লপ করে ডাকল।

একটা কাঠবিড়ালী তখন লাফিয়ে পড়ল মাথায়। কিন্তু মানুষটা বড় নিবিষ্ট কবিতা আবৃত্তিতে। তাঁর এখন কিছু খেয়াল নেই। কাঠবিড়ালীটা তাঁর গা বেয়ে ঘাসের ভিতর নেমে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *