প্ৰথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড

নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – ১.১৪

১.১৪

জায়গাট বড় নির্জন, পুকুরটা প্রাচীন। মজা দিঘির মতো দাম এবং কচুরিপানায় ঠাসা। পাড়ে পাড়ে কত বিচিত্র গাছগাছালি গভীর বনের সৃষ্টি করেছে। ছোট বড় লতার ঝোপ-পায়ে হাঁটা সামান্য পথ। পথে শুকনো ঘাসপাতা। মাটিতে মরা ডাল, পাখির পালক। বোধ হয় মাথার ওপরে প্রাচীন এক অর্জুনের ডালে পাখিদের রাতের আস্তানা। তার নিচে কত যুগ ধরে, মাছের এবং মানুষের হাড়, গরু-বাছুরের হাড়। পাশেই এক জরদ্‌গবের মতো কড়ুই গাছ। গাছটার ভিতর কত বিচিত্র খোঁদল, ডালপালা নিয়ে প্রায় আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একপাশে সব মৃত গাছের ডাল, ডালে ডালে হাজার হবে শকুন সার সার বসে রয়েছে। ওরা গাছটার নিচে যেতে সাহস পেল না। কিন্তু এইটুকু পথ পার হতে না পারলে ওরা অকালের ফল বকুল ফল খুঁজে পাবে না। বকুল গাছটা বড় নয়, ছোট। ঝোপজঙ্গলে গাছটাকে খুঁজে বের করা কঠিন। গাছটার খোঁজখবর ফতিমাকে জোটন দিয়ে গেছে। আবেদালির দিদি জোটন আবেদালির জন্য একটা মুরগি এনেছিল, মুরগিটা উড়াল দিয়ে চলে গেল হাজিসাহেবের আতাবেড়াতে। আতাবেড়ার পাশে ছোটবিবির সঙ্গে দেখা, জোটনকে ছোটবিবি বলল, মুরগিটা মাঠের দিকে নেমে গেছে। মাঠে নামলেই মনে হল জোটনের, দূরে কি একটা কেবল ছুটছে। বুঝি কুকুর হবে। বেড়াল হতে পারে। মাঠের ওপর দিয়ে অকারণে ছুটে পালাচ্ছে। মাঠে নামতেই হাজিসাহেবের ছোট বেটার সঙ্গে জোটনের দেখা।—ঐ যায়, যায়। দেখা যায়। সব শলাপরামর্শ যেন ঠিক ছিল। ছোট বেটা জোটনকে অকারণ সেই মাঠের দিকে হাত তুলে মুরগির খোঁজে যেতে বলে দিল।

জোটন মুরগিটা চুরি করে এনেছিল আবেদালিকে খাওয়াবে বলে। জোটনের ধারণা এখন সেই মুরগি ফাঁক বুঝে তার গ্রামের দিকে পালাচ্ছে। পোষা মুরগি, বড় সোহাগের মুরগি মৌলবীসাহেবের। আদরের মুরগি মাঠের উপর দিয়ে ছুটে পালাচ্ছে। সে কি ভেবে তাড়াতাড়ি মুরগি ধরার জন্য ছুটতে থাকল। যদি এ মুরগি চলে যায় যদি টের পায় মৌলবীসাব, মুরগি যাবার পথে জোটন চুরি করে নিয়ে গেছে তবে আর রক্ষে থাকবে না। সেই মুরগি যখন দূর থেকে অস্পষ্ট, মনে হচ্ছে কি একটা ট্যাবার পুকুর পাড়ে বনের ভিতর ঢুকে যাচ্ছে, তখন জোটনও না ছুটে পারল না। এত সখ করে, এত কুরশিস করে মুরগিটা ধরে এনেছিল আবেদালিকে খাওয়াবে বলে, এখন হায় সেই মুরগির চৈতন্য উদয়। কি হবে! কি হবে! সুতরাং ছোটা ভালো। মুরগি ধরার জন্য জোটন কাপড় হাঁটুর ওপর তুলে ছুটতে থাকল। ছুটতে ছুটতে ট্যাবার পুকুরের পাড়ে, ভিতরের জঙ্গলে। কিন্তু শেষে আর পথ খুঁজে পাচ্ছিল না। মুরগিটা যদি গাছের ডালে চুপচাপ বসে থাকে, উঁকি দিয়ে দেখতে থাকল।

তখন মুরগির গলা টিপে ধরেছে ছোটবিবি। হাজিসাহেবের ছোটবিবি মুরগি হালাল করে হাতের ভিতর শক্ত করে ধরে রেখেছে। ছেড়ে দিলেই ক্যা-ক্যা করে ডেকে উঠবে। তখন বনে বনে জোটন খুঁজছিল, হায়, মুরগি, তুই কোথায় গেলি! ঝোপে-জঙ্গলে জোটন মুরগি খুঁজতে এসে কপাল থাবড়াতে থাকল। তখন মনে হল ঝুঁটিতে লাল রঙ মুরগির, ঝোপের ভিতর লাল রঙের কি যেন দেখা যায়। সে লোভে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে বনের ভিতর ঢুকে পড়ল। কিন্তু হায় ঢুকে দেখল, গাছের ডালে লাল বকুল ফল। অকালে বকুল ধরেছে গাছটাতে। পাকা ফল দু’চারটে নিচে পড়ে আছে। একটা বিড়াল কি নেড়ি কুকুর এই বাগের ভিতর ঢুকে গেল। আবছা অস্পষ্ট শীতের রোদে দূর থেকে বিড়াল কুকুর না অন্য কোনও জীব ধরা যাচ্ছিল না। জোটন ভেবেছিল, ওর মুরগি পালাচ্ছে। নাকের বদলে নরুন পাবার মতো জোটন মুরগির বদলে বকুল ফল তুলে নিল। সেই ফল এনে সে ফতিমার হাতে দিয়েছে, আর বলেছে সেই আশ্চর্য বকুল ফলের গাছটা বনের ভিতর লুকিয়ে আছে।

গাছটার অনুসন্ধানে এসে সোনার ভয় ধরে গেল। সে বলল, আমার ডর করতাছে ফতিমা।

—ডর কিসের। আইয়েন আপনে। বলে ফতিমা সোনার হাত ধরে কড়ুই গাছটার দিকে তাকাল। বড় বড় শকুন, ওরা নিবিষ্ট মনে বসে আছে। কড়ুই গাছটার দিকে তাকালেই সোনার ভয়টা বাড়ছে। ওরা শকুনের রাজা গৃধিনীকে দেখতে পেল, মগডালে বসে রাজার মতো তাবৎ পৃথিবীর কোথায় কোন মৃত জীব পড়ে আছে বাতাস শুঁকে টের পাবার চেষ্টা করছে। অন্য শকুনগুলি ঠোঁট গুঁজে বোধ হয় ঘুমোচ্ছে। কেউ কেউ হয়তো ঘাড় নিচু করে ওদের একবার দেখে নিল—ছোট ছোট কাঠের পুতুলের মতো মনুষ্যকূলের দুই জীব নিচে দাঁড়িয়ে আছে। শুধু শকুনের রাজা সবসময় জেগে। সে ক্ষুধার জন্য শিকারের খবর দেবে। সে-ই একমাত্র উঁচু মুখে আকাশের অন্য প্রান্তে কী উড়ে যাচ্ছে, কারা উড়ে যাচ্ছে, কত হবে…আর যদি মৃত জীবের গন্ধ ভেসে আসে, সে প্রথম দু’পাখা বাতাসে ছড়িয়ে দেবে, তারপর উড়তে থাকবে আকাশে—প্রায় তখন মনে হয় নির্বাণ লাভের মতো এইসব বড় বড় পাখি কোন এক অদৃশ্য জগতের সন্ধানে উড়ে যাচ্ছে।

কিন্তু রাজা শকুনটা ওড়ার বদলে কেবল উঁকি দিয়ে ওদের দেখছে। ফতিমা, যে ফতিমা, একা গোপাটে ছাগল নিয়ে আসে, যে মাথায় করে সানকিতে নাস্তা নিয়ে যায় জমিতে, যার ভয়ডর একেবারে কম—পাটখেত বড় হলে অথবা নির্জন মাঠের ভিতরে যখন বড় বড় পাটগাছগুলি ফতিমার মাথা পার হয়ে উঁচুতে উঠে যায়, যখন সামনের আলপথ সিঁথির মতো, দু’ধারে পাটগাছ ঘন বনের সৃষ্টি করে রাখে, তেমন পথে কতবার ফতিমা একা একা চলে এসেছে ছাগলটার দড়ি ধরে—সেই ফতিমা পর্যন্ত ভয় পেয়ে গেল। রাজা শকুনটা নিচের দিকে উঁকি দিলে সে লাফ দিয়ে ছুটতে চাইল সোনাবাবুর হাত ধরে।

যেন এই গাছটা গল্পের সেই সদর দেউড়ি—গাছটা রাক্ষস খোক্কসের মতো সদর দেউড়িতে পাহারা দিচ্ছে। সদর দেউড়ি পার হতে পারলেই ফুল-ফল রাজকন্যা মিলে যাবে। ফতিমা সাহসে ভর করে ফুল-ফলের জন্য এবং সেই অত্যাশ্চর্য জগতের জন্য সোনাবাবুকে ঠেলে ঠুলে পাখির পালক, মাছের হাড়, মানুষের হাড়, পাখিদের মলমূত্র অতিক্রম করে বনের ভিতর ঢুকে গেল। ভিতরে বিচিত্র বর্ণের ছোট ছোট পাখি উড়ে বেড়াচ্ছিল। পাখিরা ডাকছিল। প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে। একটা গিরগিটি ক্লপ ক্লপ শব্দ করে ডাল থেকে পাতায় উঠে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকল। জায়গাটা বড় নির্জন, নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে সোনার। কোথাও কোনও মানুষের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। দূরে কে যেন কেবল কাঠ কেটে চলেছে—তার শব্দ ভেসে আসছিল। কান পাতলে ঢাক-ঢোলের শব্দ শোনা যায়। ওরা এমন একটা জায়গায় চলে এসে এই প্রথম পরস্পর অসহায় চোখ তুলে তাকাল।

ফতিমা বলল, সোনাবাবু, আপনেরে ছুইয়া দিছি। বাড়ি গেলে সান করতে হইব।

সোনা মা’র ভয়ে বলল, তুই ছুইলি ক্যান।

—আমি ছুইলাম, না আপনে ছুইলেন। বাঁশিতে নাকচাবিটা আপনে দ্যাখলেন না!

—মায় শুনলে আমারে মারব। সোনার চোখের ওপর সেই দৃশ্যটা এতক্ষণে ভেসে উঠল। সেই বর্ষার মতো। সেই ফতিমার আঁচলে প্রজাপতি বেঁধে দিয়েছিল বলে মা ওকে খুব মেরেছিল। ফতিমার কথায় সোনার যথার্থই ভয় ধরে গেল। বলল, তুই কইস না। আমি তরে ছুইয়া দিছি মায়েরে কইস না।

—আমি কইতে যামু ক্যান!

—কইলে ঠিক মায় আমারে মারব।

—কোনদিন কমু না।

—তিন সত্য!

—তিন সত্য।

সোনা যেন এবার একটু নিশ্চিন্ত হল। ফতিমা না বললে, এ-কথা কেউ আর জানতে পারবে না।

চারিদিকে বড় বড় গাছ। অপরিচিত গাছ। ঝোপ-জঙ্গল লতায়-পাতায় প্রায় কোথাও কোথাও নিবিড় অরণ্য সৃষ্টি করে ফেলেছে। ওরা সেই অরণ্যের ভিতর বকুল গাছটিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। যেন ওরা বলতে চাইছে, বৃক্ষ, তুমি এতদিন কার ছিলে?

বৃক্ষ উত্তর দিল, রাক্ষসের

—এখন কার?

—এখন তোমাদের।

—তবে তুমি আমাদের ফল দাও। বকুল ফল।

ওরা পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। দ্রুত এগুতে পারছে না। চারপাশটায় যেন জঙ্গলের শেষ নেই। কতদূর হেঁটে যাওয়া যেন এই জঙ্গলের ভিতর দিয়ে! শুকনো ঘাসপাতা পায়ের নিচে। কত দীর্ঘদিনের মানুষ-বিবর্জিত জায়গা। ওরা হামাগুড়ি দিয়ে অথবা সন্তর্পণে-কাঁটাগাছ পার হবার জন্য ছোট ছোট লাফ দিচ্ছিল। আর মনে মনে সেই গল্পের মতো বলা, বৃক্ষ তুমি কার ছিলে?

—রাজার ছিলাম।

—এখন কার?

—এখন তোমার?

—তবে ফল দাও। বকুল ফল!

বৃক্ষ কখনও রাজার, কখনও রাক্ষসের। বৃক্ষ, অঃ বৃক্ষ! ওরা বৃক্ষ বৃক্ষ বলে চেঁচাতে থাকল। কোথায় গেলে তুমি বৃক্ষ! ওরা বনের ভিতর হেঁকে ডেকে বেড়াতে থাকল। ওরা কেবল গাছটার অন্বেষণে আছে। মগডালে বসে শকুনেরা চিৎকার করছিল, বনের বিচিত্র সব শব্দ উঠছে। ঘস ঘস—ডালে ডালে পাখিদের কলরব ছিল আর ছিল দুই বালক-বালিকা। ওরা ভয়ে ভয়ে বকুল গাছটার উদ্দেশে হাঁটছে।

আর ঠিক তখন মনে হল বনের ভিতর কে বা কারা হুঁম হুঁম শব্দ করে ক্রমশ ওদের দিকে এগিয়ে আসছে, ঠাকুরমার কাছে শোনা গল্পের সেই ভূত-প্রেত অথবা ডাকিনী-যোগিনীর মতো। ফতিমা ফিফিস্ করে বলল, সোনাবাবু ঐ শোনেন।

সোনা একটা মরা গাছের গুঁড়িতে বসেছিল। ও আর হাঁটতে পারছিল না। পায়ে লাগছিল। পায়ে কাঁটা ফুটেছে। ওর মনে হল এখন এইসব ফেলে খোলা মাঠের ভিতর নেমে যেতে পারলে বড়দা মেজদা ট্যারা হয়ে যাবে। আমারে একটা দে, সোনা বড় ভাল পোলা, দে দে, একটা দে, বলে বড়দা মেজদা ওর চারপাশে ঘুর ঘুর করবে। ফতিমাও বড় শখ করে এই বনের ভিতর পালিয়ে এসেছে ফল নেবে বলে, কিন্তু বনের ভিতর সেই হুম্ হুম্ শব্দটা ক্রমশ এগিয়ে আসছে।

বনের ভিতর ওরা চুপচাপ বসেছিল। ওদের ভিতর আতঙ্ক–এবারে কিছু একটা হয়ে যাবে। ওরা পালাতে গিয়ে ঘন গাছপালার ভিতর ক্রমে আরও হারিয়ে যাচ্ছিল। বনটা যে ভিতরে ভিতরে এত বড় ওদের জানা ফ্লি না। বনের ভিতর ঢুকে গেলেই গাছটা সদর দেউড়ির সেপাইর মতো সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে, এবং ওদের অঞ্জলিতে বকুল ফল ভরে দেবে এমন একটা ধারণা ছিল, কিন্তু হায়! এখন ওরা এত ভিতরে ঢুকে গেছে যে, কোনদিকে গেলে মাঠ এবং পরিচিত পথ মিলে যাবে বুঝতে পারছে না। ফতিমার মুখ-চোখ শুকনো দেখাচ্ছে। বনময় সেই শব্দ কেবল ঘুরে বেড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে এইসব জঙ্গলের ভিতর কে বা কারা সহসা সহসা অট্টহাস্য করছিল। ঠাকুরমার গল্পের মতো যেন কে বা কারা বলছে হাঁউ-মাঁউ-কাউ, মানুষের গন্ধ পাঁউ। ওরা ভয়ে, মৃত্যুভয়ে চোখ বন্ধ করে সামনের ঘাস, শুকনো পাতা, জঙ্গল যা কিছু সামনে পড়ছে সব মাড়িয়ে ছুটছে। অথচ সামনের খোলা মাঠ এখনও দেখা যাচ্ছে না। ওরা শুকনো ডাল, পাখির পালক, গাছ এবং মানুষের হাড় অতিক্রম করে কেবল ছুটতে থাকল। কিন্তু সামনে আর পথ নেই, ফের পিছনের দিকে ছোটা। অথচ সেই এক অট্টহাসি পিছনে ছুটে আসছে তো আসছেই। ডালপালা ঝোপ-জঙ্গল ভেঙে ওদের ধরার জন্য ছুটে আসছে। সূর্যের অমিত তেজের মতো বনের ভিতর সেই এক অট্টহাসি গাছপালা ভেঙে দুম-দাম শব্দ করে তোলপাড় করে বেড়াচ্ছে।

তখন মাঠের ভিতর হুম্-হুম্-হুম্ শব্দ। রাজ-রাজেশ্বর কি জয়! জয়-যজ্ঞেশ্বর কি জয়—কারা যেন মাঠ ভেঙে এমন বলতে বলতে চলে যাচ্ছে। সোনা ভয়ে গাছপাতার ভিতর লুকিয়ে পড়ল। ফতিমাও জঙ্গলের ভিতর মুখ ঢেকে শুয়ে পড়ল। আর মুখ তুলতেই দেখল, ঝোপের ভিতর থেকে খোলা মাঠ দেখা যাচ্ছে। প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশ জনের একটা দল খোলা মাঠের ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। ষোলজন লোক বাঁশের ভিতর কাটা মোষটা ঝুলিয়ে নিয়েছে। চার-পা বাঁধা কাটা মোষটা মরা গরু-বাছুরের মতো ঝুলছে। ঠিক পেটের মাঝখানে বসানো কাটা মোষের মাথাটা। দড়ি দিয়ে মাথাটাকে পেটের ওপর বেঁধে রাখা হয়েছে। মাথাটা চোখ খুলে রেখেছে, কান ঝুলিয়ে রেখেছে। এবং শস্যবিহীন মাঠ দেখতে দেখতে চলে যাচ্ছে। লোকগুলি জয় যজ্ঞেশ্বর কি জয়, রাজ-রাজেশ্বর কি জয় বলতে বলতে নেমে যাচ্ছে। ওরা ঝোপের ভিতর প্রায় যেন শ্বাস বন্ধ করে পড়ে আছে। ভয়ঙ্কর দৃশ্য এখন শুধু চোখের উপর ভাসছে। গলা এত শুকনো যে, ওরা ডাকতে পর্যন্ত পারল না। বলতে পারল না, আমরা ঝোপের ভিতর আটকা পড়েছি। কোনদিকে রাস্তা খুঁজে পাচ্ছি না। আর কিছুক্ষণ এভাবে থাকলে আমরা মরে যাব

লোকগুলি কাটা মোষ নিয়ে চলে যাচ্ছে। পিছনে যারা আসছে, তাদের মাথায় চাল, ডাল। একটা মোষের মাংস খাবার মতো মানুষের জন্য চাল-ডাল-তেল। ওরা শীতলক্ষ্যার পাড় থেকে এসেছে। পূজার প্রসাদ মোষের মাংস ফেলতে নেই তাই এইসব মানুষ এসেছে শীতলক্ষ্যার পাড় থেকে এই কাটা মোষ নিয়ে যেতে। ওরা মোষটা নিয়ে যেন পাল্কি কাঁধে বেহারা যায়—হুঁ-হোম-না, যেন বরের সঙ্গে বধূ যায়—হুঁ-হোম-না, যেন মোষের পেটে কাটা মাথা যায়—হুঁ-হোম-না! বড় কুৎসিত এই দৃশ্য। মুণ্ডবিহীন মোষ পেটে মাথা নিয়ে দুলতে দুলতে যাচ্ছে। বনের ভিতর তখন ডালপালা ভেঙে বেড়াচ্ছে কে? অট্টহাস্য, অট্টহাস্য! মগডালে শকুনের আর্তনাদ, ঝিঁঝিপোকার ডাক এবং সেই দ্রুত ডালপালা ভাঙার শব্দ—ওরা ভয়ে এবার চোখ বুজে ফেলল, কারণ বনের ভিতর পথ করে সেই অট্টহাস্য ওদের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। ওদের দুজনকে শক্ত দুই বাহুতে জড়িয়ে ধরেছে। মাটি থেকে টেনে উপরে তুলে নিচ্ছে। যেন দুই পুতুল। সোনা রুপোর পুতুল। দৈত্যটা দুই কাঁধে দুই সোনা রুপোর পুতুল ফেলে বনের বাইরে বের হয়ে এল। তখন দুই পুতুল প্রাণ পেয়ে ঝলমল করে উঠেছে। দৈত্যটা বুঝি এত আনন্দ আর দু’হাতে সামলাতে পারছিল না। চিৎকার করে উঠল, গ্যাৎচোরেৎশালা।

তখনও মাঠে ঢাক বাজছে, ঢোল বাজছে। বাস্তুপূজা শেষ হলেই পুরীপুজোর মেলা। মেলায় দোকানপত্র যাচ্ছে গোপাট ধরে। বাঁশ কাঁধে মানুষ যাচ্ছে। ত্রিপল মাথায় মানুষ যাচ্ছে। সোনালী বালির নদীর জলে এখন কত সওদাগর নৌকা ভাসাল। বাদাম তুলে খাঁড়ি ধরে ব্রহ্মপুত্রে পড়বে। তারপর ফের বাঁক নিলে সেই প্রকাণ্ড বিল—পাঁচ ক্রোশের মতো বিল রয়েছে। খালের জল বিলে পড়েছে। বিল পার হলেই মেলার প্রাঙ্গণ! বড় কাঠের পুল পার হলে যজ্ঞেশ্বরের মন্দির। মন্দিরের পাশে সারকাসের তাঁবু পড়েছে।

সেই বিলের কথা মনে পড়ছিল পাগল ঠাকুরের। তিনি সোনা এবং ফতিমাকে মাঠে এনে ছেড়ে দিলেন। সোনার সব ভয় উবে গেছে। ফতিমা পর্যন্ত এখন হি-হি করে হাসছে। ওরা বাড়ি ফেরার জন্য দৌড়াতে লাগল। বেলা পড়ে আসছে, শীতের বেলা। সামসুদ্দিন ঢাকা গেছে। আজ ঢাকা থেকে ফেরার কথা। ফতিমা দ্রুত ছুটতে থাকল। ঢাকা থেকে বা’জান কাঁচের চুড়ি কিনে আনবে। ফিরে ফতিমাকে বাড়ি না দেখলে খুব রাগ করবে বাজান। কানের দুল আনবে। মা’র জন্য ডুরে শাড়ি আনবে। বা’জান সময়-অসময় নেই সেই শহরে চলে যায়। দু’চার দিন পর ফের ফিরে আসে! সেই ঢাকা শহরে বড় হলে ফতিমা যাবে! যেতে যেতে তেমন গল্পও করল ফতিমা

সোনা বলল, আমি-অ যামু। বাবায় কইছে বড় হইলে আমারে লইয়া যাইব।

—বা’জী কইছে আমারে সদর ঘাটের কামান দেখাইব।

—বাবায় কইছে আমারেও সদর ঘাটের কামান দেখাইব। রমনার মাঠ দেখাইব। বুড়িগঙ্গার জলে সান করাইব।

—বা’জী কইছে লিখা-পড়া শিখলে মোটরে চড়াইব!

—বাবায় কইছে ফাস্ট হইলে রেলগাড়ি কইরা ঢাকায় নিয়া যাইব।

—রেলগাড়ি ছোট। ছোট গাড়িতে সোনাবাবু যাইব!

—মোটরগাড়ি রেলগাড়ির ছোট।

—হ কইছে? ফতিমা সোনার মুখের সামনে গিয়ে মুখ বাঁকাল।

—কিছু জানস না ছেরি, দিমু এক থাপ্পর।

—দ্যান ত দ্যাখি। থাপ্পর দিবেন! আপনের মায়রে কইয়া মাইর খাওয়ামু না তবে! কমু, সোনাবাবু।

আমারে ছুইয়া দিছে।

—আমি যে তরে ছুইয়া দিছি, তুই কইয়া দিবি!

—তবে মোটরগাড়ি ছোট এডা কন ক্যান!

—আর কমু না।

ফতিমা আর দেরি করল না। এই বাবুটির উপর বিজয়নী হয়ে উল্লাসে ছুটছে। মাথার চুল উড়ছে। কোমর থেকে ডুরে শাড়ি খুলে পড়ছে। ছুটতে ছুটতে কোনওরকমে প্যাঁচ দিচ্ছে কোমরে। কোনওরকমে কাপড় সামলে মল বাজিয়ে ছুটছিল। পায়ে মল, রুপোর মলের ভিতর ছোট লোহার দানা। ফতিমা ছুটছিল আর পায়ের মল বাজছিল ঝম ঝম। ছুটতে ছুটতে দু’বার ফিরে তাকাল পিছনে। এতটুকু নড়ছে না, সেই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ক্ষোভে দুঃখে ভেঙে পড়ছে সোনাবাবু। ফতিমা বিজয়িনীর মতো ঘুরে ফিরে লাফ দিল, হাঁটল, দু’পা এগিয়ে ফের লাফ দিল। ফের ঘুরে ফিরে চরকিবাজির মতো মাঠের ওপর ঘুরছে। যেন এক চঞ্চল খরগোশ কচি ঘাস থেকে এক কামড় খাচ্ছে, দু’কামড় নষ্ট করছে। ফতিমা মাঠের উপর দিয়ে চঞ্চল খরগোশের মতো ছুটছিল। কিন্তু মনে মনে সোনা, যে সোনার শরীরে সব সময় চন্দনের গন্ধ লেগে থাকে, যে সোনাবাবুর মুখ ঘাসের মতো নরম, কচি কলাপাতার মতো যে লাজুক, তেমন মানুষকে মাঠে একা ফেলে যেতে কেমন কষ্ট হচ্ছিল ফতিমার। ফতিমা এবার দাঁড়াল। পিছন ফিরে ডাকল, আইয়েন, আমি খাড়াইছি।

সোনা রাগে এবং ক্ষোভে চিৎকার করে উঠল, না, আমি যামু না।

ফতিমাও গলা ছেড়ে বলল, আপনে না আইলে, আমি-ও যামু না।

দু’জন দু’জমির শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকল। সোনা কিছুতেই নড়ছে না।

ফতিমা ছুটে সোনার নাগালে চলে গেল। চলেন।

—না, আমি যামু না।

—চলেন। না হয় আপনের রেলগাড়িটাই বড়। তারপর ফতিমা আরও কি যেন বলতে চেয়েছিল। বলতে পারল না। অথবা মনের ভিতর হয়তো এমন কথা উঁকি মারতে পারে—মেলায় গেলে আমরা রেলগাড়িতে যাব। বড় গাড়ি না হলে আমরা দু’জনে যাব কি করে! অথচ ফতিমা কথাটা প্রকাশের ভাষা ঠিক খুঁজে পেল না। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল কিছু সময়। তারপর সোনার হাত ধরে বলল, আমারে একটা কারতিক পূজার ছিরাঘট দিবেন?

—দিমু।

—আইয়েন, ইবারে মাঠের ওপর দিয়া ছুটি। ওরা হাত ধরে শীতের রোদে কিছুক্ষণ ছুটে দেখল, পুকুরপাড়ে মালতী। ওরা তাড়াতাড়ি হাত ছেড়ে দিল। হাত ছেড়ে দিয়ে দু’জন দু’দিকে ছুটতে থাকল।

সেই যে ঢাক বাজছিল, ঢোল বাজছিল আর থামছে না। পঞ্চাশটা ঢাকি অনবরত ঘাড় কাৎ করে বাজাচ্ছে তো বাজাচ্ছেই। সরকারদের বাস্তুপূজা অঞ্চলে বিখ্যাত। লোকজনের সীমা সংখ্যা নেই। আত্মীয় কুটুম্ব, গ্রামের নিবাসিগণ, কিছু গরিব প্রজা আর সব মাতব্বর ব্যক্তি লাঠি হাতে ঘোরাফেরা করছিল। পুকুরপাড়ে হাজার মানুষ হবে, দূর দূর গ্রাম থেকে ওরা এসেছে। ধোপা নাপিত নমঃশূদ্র। ওরা পাত পেতে খিচুড়ি খাচ্ছে। আর মাঠের উপর দিয়ে মোষ যাচ্ছে, সেই যেন পাল্কি কাঁধে বেহারা যায়। ওরা মুসলমান গ্রামগুলির পাশ দিয়ে যাবার সময় শিব ঠাকুর কি জয়, রাজ রাজেশ্বর, যজ্ঞেশ্বর কি জয়, এইসব বলছিল। পেটে মাথা নিয়ে মোষ চলেছে। মাঠের ওপর, ঘাসের ওপর বিন্দু বিন্দু রক্ত পড়ছে—ধর্ম আমাদের সনাতন, এত কচি মোষ তল্লাটে বলি হয়না। এত বড় খাঁড়া তল্লাটে আর কার আছে। আর এই ধর্মের মতো পূতঃপবিত্র কী আছে—জয় রাজ রাজেশ্বর, যজ্ঞেশ্বর কি জয়। বিলের পাশ দিয়ে যেতে যেতে মানুষগুলি কাটা মোষ বাঁশে ঝুলিয়ে জয়ধ্বনি করছিল। বিলের গরিব দুঃখী মানুষগুলি যারা শালুক তুলতে এসে জলের ভেতর সাদা হয়ে যাচ্ছে—হাত পা ঠাণ্ডা—এবং শীতে শিথিল হয়ে যাচ্ছে, যারা মাঝে মাঝে পাড়ে বসে রোদ পোহাচ্ছিল, তারা পাড়ের উপর দেখল বিন্দু বিন্দু এক ঝাঁক পাখির মতো মানুষগুলি কাঁধে মোষ নিয়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার কাটা মোষের পেটে মাথাটা হড়কে নিচে পড়ে গেল। এত খাড়া ছিল বিলের পাড় যে পড়বি তো পড় একেবারে সেই গরিব দুঃখীদের পায়ের কাছে। সহসা এমন কাণ্ড! ধড়বিহীন মুণ্ড ওদের পায়ের কাছে পড়ে আছে।

মোষের কাটা মুণ্ড দেখে ওরা তোবা তোবা বলে উঠল। এক কোপে কাটা মুণ্ড ওরা দেখে কেমন গুনাহ করে ফেলল। এত বড় বিলে ওরা দুঃখী মানুষ সব শালুক তুলতে এসে এমন কুৎসিত দৃশ্য দেখে ফেলে চোখে কানে কেমন আঙুল দিল অথবা বুঝি ভয়, এই যে বিল দেখছ, বড় বিল, বিলে কত না কিংবদন্তী, কত না সাপখোপ, অজগর আর কত না জলজ ‘ঘাস জলের ভিতর। লতাপাতা কীট-পতঙ্গ বড় বড় জোঁক নাকে কানে ঢুকে গেলে কে কাকে রক্ষা করে। সুতরাং ওরা মুণ্ডটার দিকে আর তাকাল না। সূর্য অস্ত যাচ্ছে, এবারে ঘরে ফিরতে হয়।

শীতকাল বলে উত্তরের হাওয়া ক্রমশ প্রবল হচ্ছে। আকাশ বড় পরিচ্ছন্ন। মনে হয় এবার পৃথিবী উজাড় করে সব ঠাণ্ডা এই মাটির উপর, এই বিলের উপর নেমে আসবে। এতক্ষণ বিলের জলে সহস্র পাতিল ভেসেছিল, এখন একটিমাত্র পাতিল জলে ভাসছে। জলে একা এক পাতিল ভাসলে বড় ভয়। সেই পাতিলের মানুষটা কোথায় গেল! দ্যাখো দ্যাখো পাতিলের মানুষটা কোথায় গেল!

সূর্য তেমনি অস্ত যাচ্ছিল। শালুক ফুল ফোটে না আর। দূরে সব পদ্মপাতা, পদ্মপাতার পাশে ছোট এক পাতিল একা একা জলে ভেসে বেড়াচ্ছে। মানুষটা কোথায় গেল! পাতিলের মানুষটা! জলের মানুষ সব পাড়ে উঠে এসেছে। যে যার শালুকের পাতিল মাথায় পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখছে—একটা পাতিল বিলের জলে উত্তরে হাওয়ায় ভেসে ভেসে গভীর জলে চলে যাচ্ছে।

কে তখন হাঁকল, দ্যাখো, বিলের জলে পাতিল ভাইস্যা যায়।

কে তখন ফের হাঁকল, দ্যাখো পানির তলে মানুষ ডুইবা যায়।

কিন্তু এক ত্রিকালজ্ঞ বৃদ্ধা, মুখে জরার চিহ্ন, ক্লিষ্ট চেহারা, সে জোর গলায় হাঁকরাতে থাকল, বিল আবার একটা মানুষ কাইরা নিল। সেই বৃদ্ধা নিয়তির মতো দাঁড়িয়ে যেন বলতে চাইল, এটা হবেই। সালের পর সাল বিল ক্ষুধা নিয়ে জেগে থাকে। ফাঁক পেলেই গিলে খায়। কিন্তু মানুষটা কে? কে ডুবে গেল জলে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *