প্ৰথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড

নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে – ১.১০

১.১০

বড়বৌ পূজার ফুল তুলছিল। শীতকাল। বাগানের ভিতর শীতের সব ফুল ফুটে আছে। খুব ভোরে মালতী স্নান করতে এসেছিল ঘাটে। ঘাটে শীতের কুয়াশা ছিল তখন, ঘাটের সিঁড়িতে রোদ ছিল না। কিরণী আবু পাড়ে বসে ব্রতকথা বলছিল—ওঠ ওঠ সুয্যিঠাকুর ঝিকিমিকি দিয়া…তখন মালতী ঘাটে নেমে গেল। ঘাটে এসে বড়বৌ দেখল, মালতী শীতের ঠাণ্ডায় জলে ডুবে ডুবে স্নান করছে। যেন এই শীত, শীত নয়, মালতী জলের উপর ভেসে যেতে থাকল।

মালতী এক সময় জল থেকে উঠে পড়ল। ভেজা কাপড়ে হিহি করে কাঁপছে। সে বড়বৌকে ভেজা কাপড়েই কিছু ফুল তুলে দেবার অছিলায় অতসী গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকল।

বড়বৌ বলল, তোর এই সাত সকালে স্নান?

মালতী কোনও কথা বলল না। সে ফুলগাছ অথবা ঝোপজঙ্গলের ভিতর উঁকি দিয়ে কি যেন অনুসন্ধান করছে। দেখলে মনে হবে, ওর কিছু হারিয়ে গেছে। সুতরাং মালতীকে বিষণ্ন দেখাচ্ছে। মালতীর পরনে ডুরে শাড়ি-পাতলা। শাড়ি দেখে সেই স্বপ্নটার কথা মনে করতে পারছিল—সেই স্বপ্ন, স্বপ্নে সে মধুমালা সেজে বসেছিল। মালতী ডুরে শাড়ি পরে মধুমালা সেজে বসেছিল। মদনকুমার আসবে, সেই মদনকুমার, যার সখের সীমা ছিল না, যে হাটে বাজারে গেলেই ডুরে শাড়ি কিনতে ভালোবাসতো মালতীর জন্য। স্বপ্নে সেই মানুষ কতদিন পর রাতে ওর কাছে এসেছিল। পাশে বসেছিল। দাঙ্গার কথা বলার সময় মুখ বড় করুণ। তারপর সব ভুলে মানুষটা গল্প করতে করতে ওর মুখ চিবুক টেনে শেষে মালতীকে কোলে নিয়ে ধপাস করে মোটা গদিয়ালা বিছানাতে ফেলে দিয়েছিল। আর কী? আর কী করেছিল স্বপ্নে? স্বপ্নে স্বামীর সঙ্গে সহবাস। সে সহবাসের পর সোজা পুকুরঘাটে স্নান করতে চলে এসেছে। মালতী শরীরের উত্তাপ জলে ভাসিয়ে পাড়ে উঠতেই শুনতে পেল, দক্ষিণের ঘরে এখন কে যেন দুলে দুলে পড়ছে, পাতায় পাতায় পড়ে নিশির শিশির। শীতের সকাল। মাঘমণ্ডলের ব্রতকথা শেষ করে পালেদের দুই মেয়ে পুকুর পাড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছিল। ওরা কবিতার মতো আবৃত্তি করছিল, ওঠ ওঠ সুয্যিঠাকুর ঝিকিমিকি দিয়া, না উঠতে পারি আমি ইয়লের লাগিয়া।

সোনা পড়ছিল, পাতায় পাতায় পড়ে নিশির শিশির।

লালটু পড়ছিল, অ্যাট লাস্ট দি সেফিস জায়েণ্ট কেম্।

পলটু পড়ছিল, এ প্লাস বি হোল স্কোয়্যার…

দক্ষিণের ঘরে তখন পড়ার প্রতিযোগিতা চলছে। ওরা তিনজনই চেঁচিয়ে পড়ছে। বাড়িতে দূরদেশ থেকে দীর্ঘদিন পর বুঝি সেই যুবক ফিরে এসেছে। বোধ হয় এখন উচ্চ স্বরে পড়ে এই বালকেরা কত বেশি পড়ছে এবং কত কঠিন পড়া পড়তে হয়, চেঁচিয়ে মানুষটাকে জানাচ্ছে। মালতী গতকাল সন্ধ্যায় খবর পেয়েছে। কিন্তু সংকোচের জন্য আসতে পারেনি। মানুষটাকে দেখার বড় ইচ্ছা। প্রায় সারা রাত সে যেন মানুষটার জন্য জেগেছিল।

লালটু একই লাইন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়ছে। অ্যাট লাস্ট দি সেফিস্ জায়েন্ট কেম্। সেফিস্ জায়েন্ট। মনে মনে উচ্চারণ করল কথাটা। ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। সেই কবেকার কথা। তখন বিলের জলে কুমীর ভেসে আসেনি, তখন মালতী ফ্রক পরত। একদিন সেই কৈশোরে সেফিস জায়েন্ট লুকোচুরি খেলতে গিয়ে মালতীকে সাপ্টে ধরেছিল। চুমু খেয়েছিল। মালতী রাগে দুঃখে ঠিক রাগে দুঃখে বলা চলে না, কেমন যেন রঞ্জিত ওকে না বলে না কয়ে চুমু খেয়ে—কী একটা ফাজিল কাজ করে ফেলেছে। বলতে হয় কিছু, না বললে, কুমারীর সম্মান থাকে না। বড়বৌকে বলে দেবে এমন ভয় দেখিয়েছিল রঞ্জিতকে। পরদিন ভোরে বাপ-মা মরা সেলফিস্ জায়েন্ট কিছু না বলে কয়ে ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল।

ঠাকুরবাড়ির বড়বৌর পিতৃমাতৃহীন ছোট ভাই-এর খোঁজ-খবর কেউ আর দিতে পারেনি। তারপর কত জল সোনালী বালির নদীতে ভেসে গেল, কত শীত, কত বসন্ত চলে গেল। বিলের জলে যেবার কুমীর ধরা পড়ল—মালতীর সেবারেই বিয়ে। মালতী একদিন চুপি চুপি বলেছিল, বড়বৌদি, রঞ্জিত আপনেরে চিঠি দ্যায় না?

—দ্যায়।

—কি ল্যাখে।

—কিছু লেখে না। শুধু লেখে ভালো আছি।

—ঠিকানা দেয় না।

—ঠিকানা দিতে নেই

—ক্যান?

—দেশের কাজ করে। ঠিকানা দিতে নেই।

শীতের সূর্য উঠতে চায় না। রোদ দিতে চায় না। গাছপালার ছায়ায় বাড়িগুলি ঢেকে থাকে। বুড়ো মানুষেরা রোদের জন্য প্রায় হাহাকার করছিল। ভোরের দিকে তখন খুব অন্ধকার নয়, আবার আলোও নয়—মালতী চুপি চুপি ঘাটে আসার সময় দেখেছিল, অমূল্য তাঁতঘরের পাশে বসে আগুন পোহাচ্ছে। খড়কুটো এনে—শীতের দিন বলে শুকনো পাতা সংগ্রহ করে রেখেছিল অমূল্য। অমূল্য বসে সেই খড়কুটোর ভিতর আগুন জ্বেলে শীত থেকে রক্ষা পেতে চেয়েছিল। আর শোভা, আবু, নরেন দাসের বৌ আগুনের পাশে গোল হয়ে বসেছিল।

মালতী দরজা খুলে বের হবার মুখেই দেখল অমূল্য ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মালতী সোজা উঠানে নেমে এল না। চৌকাঠে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। আগুনের ভিতর থেকে অমূল্যর মুখ ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। স্বপ্নে দেখা মৃত মানুষটার মুখ, চোখে আর ভাসছে না। শুধু অমূল্যর মুখ চোখে ভাসছে। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল এক অশুচি ভাব শরীরের সর্বত্র। শীতে কোথায় অমূল্যের পাশে বসে আগুন পোহাবে, কোথায় শীতের ভিতর উত্তাপ খুঁজবে-তা না করে মালতী ছুটে গেছে পুকুরে। স্বামীর মৃত মুখ মনে করে জলে অধিক সময় ডুব দিয়ে থেকেছে। অমূল্যর মুখ ভুলে থাকার জন্য, পাপ চিন্তা ভুলে থাকার জন্য মালতী শীতের জলে, ঠাণ্ডা হিমের মতো জলে বোধহয় ডুব দিয়েছিল।

সুতরাং স্থলপদ্ম গাছটির পাশে দাঁড়িয়ে মালতী মনে করতে পারল না, সে কোন নির্দিষ্ট কারণে এসে জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। মালতী এখন ঠাকুরঘরে প্রণাম করছে এবং বিড়বিড় করে বকছে। নিজেকে গালাগালি দিচ্ছে। সে ঠাকুরঘরের দরজায় মাথা ঠুকছিল। যেন ভগবানের ইচ্ছা—বিধবা মানুষের যৌবন থাকতে নেই, সুখ থাকতে নেই, ভালোবাসা থাকতে নেই। যৌবন থাকলে পাপ, ভালোবাসা থাকলে পাপ এবং সুখ চাইলে পাপ। মালতী মাথা ঠুকে ঠুকে বলতে চাইল যেন, ভগবান, তুমি আমার পোড়া যৌবন হরণ করে নাও। আমার পোড়া কপাল। ভালোবাসার কপাল থাকলে আমার মানুষ ঘরে থাকত। রায়টে কাটা পড়ত না। স্বপ্নটার কথা কেবল মনে আসছিল মালতীর। কতদিন পর যেন যথার্থই তার কাছে জল চাইতে এসেছিল। কিন্তু সে যতবার জল নিয়ে ওর হাতে দিয়েছে ততবার মানুষটার মুখ বদলে গেছে। মুখটা যেন অমূল্যের। তাঁতঘরে অমূল্য যেমন হেসে হেসে কথা বলে, যেমন খুব সহজে নেকা নেকা কথা বলে—যেন কিছু জানে না অমূল্য, কিছু বোঝে না, দিদি, অ মালতী দিদি, আমার ঘরে জল পাঠাইয়া দ্যান। দিদি, আপনের জন্য বেথুন পাইড়া আনছি, দিদি, জলের তলে শালুক হয়, শালুকের ফল হয়—আপনের জন্য আমি কী না করছি। স্বপ্নে নিজের মানুষটাকে জল দিতে গিয়ে মালতী কেবল সেই অমূল্যকে বিছানার ওপর বসে থাকতে দেখল।

মালতী ঘরে ফিরে কাপড় ছাড়ল, সাদা থান পরল একটা। তাঁতের চাদর গায়ে দিল। ঘরের পাশে পেয়ারা গাছের নিচে মালতী আগুন জ্বালল। আজ ইচ্ছা করেই মালতী অমূল্যর পাশে গিয়ে আগুন পোহাতে বসল না। যেন ওর পাশে আগুন পোহাতে বসলেই শরীরের গ্লানিটা আবার ভেসে উঠবে। সে আবুকে ডেকে আনল, শোভাকে কিছু শুকনো কাঁঠালের ডাল এনে দিতে বলল—শীতের জন্য হাত পা বড় বেশি সাদা দেখাচ্ছে। শীতের ভিতর আদর করে ঠাণ্ডা হাত আবুর গালে ঘষে দিল। হাত গরম করতে চাইলে শোভার গালে হাত রাখে। মেয়েগুলি এই শীতেও কেমন গালগলা গরম করে রেখেছে।

শীতের রোদ লম্বা হয়ে নামছে। বাড়ির নিচে সব জমি, বড় বড় তামাক গাছ সামনের মাঠে। পেছনে সব পেঁয়াজের জমি–পেঁয়াজ, রসুন, আলু, বাঁধাকপি। এবং নরেন দাস জমির জন্য, তাঁতের জন্য সারা মাস খেটে খেটে এই সংসারকে সোজা করে রাখছে! নরেন দাস তার এই সংসারকে বড় বেশি ভালোবেসে সারাক্ষণ মাঠে অথবা তাঁতঘরে কোন-না-কোন কাজের ভিতর ডুবে থাকে। নরেন দাস, পুবের বাড়ির নরেন দাস জমিতে এখন পেঁয়াজের গুঁড়িতে মাটি তুলে দিচ্ছে। মালতী দেখল, এই আগুনের ভিতর থেকে দেখল, নরেন দাস জমির মাটি সোনার মতো হাতে নিয়ে অপলক চেয়ে থাকছে। নরেন দাস মাটির ভিতর কি রস আছে, ফসলের মাটি কি রস দিয়ে গড়া, এই যে সোনার ফসল ঘরে ওঠে কিসের এত পুণ্য এই সংসারে—বোধ হয় নরেন দাস মাটির ভিতর তার রহস্য খুঁজছিল। মাটির সঙ্গে বিড়বিড় করে নরেন দাস তখন কথা বলতে আরম্ভ করে দিয়েছে অথবা গাছগুলির সঙ্গে হতে পারে, কারণ ওর চারদিকে তামাক গাছ, চীনাবাদামের গাছ। কত যত্ন করে জল টেনে নরেন দাস মাটির ভিতর এইসব শস্যকণা পুঁতে দিয়েছিল। এইসব শস্যের জন্য নরেন দাসের বড় ভালোবাসা। প্রতিদিন ভোর হলে নরেন দাস সে তার নিজের জমির ভিতর নেমে আসবে, কিছু না কিছু মাটি গাছের গুঁড়িতে দিতে দিতে গাছের সঙ্গে কথা বলবে, খেতে ভুলে যাবে। জীবনের অন্য সুখ-দুঃখের কথা ভুলে যাবে।

মালতী বড় একটা ঘটি নিল জলের, কিছু মুড়ি, তেল দিয়ে মেখে বড় বড় দুটো পেঁয়াজের টুকরো নিল হাতে, নুন এবং কাঁচা লঙ্কা নিয়ে জমির পাশে নেমে গেল নরেন দাসকে খেতে দিতে। আর আসার সময় দেখল, গ্রামের সব মানুষই এই শীতের সকালে জমি এবং ফসলের ঘ্রাণে মাঠে নেমে যাচ্ছে। ঠাকুরবাড়ির ছোট ঠাকুর নেমে গেল মাঠে, পিছনে ঈশম—ওরা নিশ্চয়ই সোনালী বালির চরে নেমে যাচ্ছে। ঈশম নিশ্চয়ই জমি থেকে জল নেমে যাচ্ছে না বলে চিন্তিত। নিশ্চয়ই ছোট ঠাকুরকে বিশ্বস্ত মানুষ ঈশম জমিতে নিয়ে গিয়ে এই জল নিয়ে কী করা যায়, কীভাবে জল নামিয়ে দেওয়া যায়, চরের বুক থেকে, সেইসব সলাপরামর্শ করবে। তখন গোপাট ধরে বাজারে যাচ্ছিল মনজুর, জব্বর এবং অন্য অনেকে। নয়াপাড়ার বিশ্বাসেরা, হাসিমের বাপ জয়নাল, আবেদালি কেউ যেন বাকি নেই। সকলে ষাঁড় গরু নিয়ে মাঠের রোদে নেমে আসছে। ফেলু শেখ হাজিসাহেবের খোদাই ষাঁড়টাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে মাঠে। এদের এখন শুধু ফসলের জন্য চাষাবাদ আর এই চাষাবাদই মানুষগুলির সব—আশা আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন অথবা ভালোবাসা। আর কী চায় মানুষগুলি? মানুষগুলি তারপর ধর্ম করতে চায়। হিন্দু পাড়াতে তখন যাত্রা নাটক হবে, রাবণ বধের পালাগান, রামায়ণ গান, রাম সেজে আসবে লোকনাথ পাল। মাঝিবাড়ির বড় সামিয়ানার নিচে ঢোলক বাজবে—গ্রামের বুড়োবুড়িরা তখন কেউ ঘরে থাকবে না। এই শীত এলে কবিগান হয় চন্দদের বাড়ি, বড় বড় ডে-লাইট জ্বলবে, মনে হবে তখন গ্রামটা মেলার মতো। পরাপরদির হাট থেকে দোকানপাট তুলে শ্রীশচন্দ্র চলে আসবে। শীত এলেই কতরকমের মেলা বসবে, দূরে দূরে কত মানুষ চলে যাবে, ঘোড়দৌড় হবে, বাজি জেতার জন্য বিশ্বাস পাড়াতে রোজ ঘোড়দৌড়ের মহড়া হচ্ছে।

সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, অমূল্যও তাঁতঘরে মহড়া দিচ্ছে। অথচ এই অমূল্য আগে কত হাবাগোবা ছিল। এই অমূল্য সারাক্ষণ তাঁত বুনে ঘরের বার হলে চোখ তুলে তাকাত না পর্যন্ত। অমূল্য মালতীর বান্দা লোক ছিল। সেই অমূল্য কী করে গত বর্ষায়—ওরা সেই যে অষ্টমীর স্নানে এক সঙ্গে এক নৌকায়, বড় নৌকা, প্রায় তেমাল্লা হবে, পাড়ার বড় পিসি, ধনবৌ, মাঝিবাড়ির কালপাহাড়ের মা, নরেন দাস – প্রায় গ্রামের গোটা লটবহর এক নৌকায় শুয়ে বসে একদিনের পথ নাঙ্গলবন্ধ, নাঙ্গলবন্ধের বান্নিতে মালতী সকলের সঙ্গে স্নান করতে গিয়েছিল। অষ্টমীর স্নানে কত মানুষ, নদীর দু-পাড়ে কত দেব-দেবীর মূর্তি। মাটি দিয়ে গড়া ভৈরব ঠাকুরের বড় নীল রঙের পেটের দিকে তাকিয়ে অমূল্য রসিকতা করেছিল। বড় নদী, দু’পাড়া প্রায় দেখা যায় না নদীর। কত নৌকা এসেছে। কত মানুষ এসেছে স্টিমারে, আর পাপ ঢেলে পুণ্য নিতে দু’পাড়ে তিল ধারণের স্থান ছিল না। মালতীও সকলের সঙ্গে নদীর জলে স্নান করতে নেমেছিল। পাড়ে অমূল্য। পকেটে তামার পয়সা। মালতীর হয়ে ঠাকুরের দক্ষিণা, তিলতুলসী সব সংগ্রহ করে দিচ্ছিল। গোটা মেলাতে সে-ই সারাক্ষণ মালতীকে দেখাশুনা করেছে। সে মালতীকে নিয়ে ঘুরেছে—একটা লক্ষ্মীর পট কিনে দিয়েছিল অমূল্য, মালতীর জন্য পয়সা খরচ করতে পেরে অমূল্য গুনগুন করে এক সময় গান ধরেছিল। পয়সা খরচ করার হকদার হতেই মালতী অমূল্যের জিম্মায় কী করে যেন চলে গেল। অমূল্য মালতীকে এক সময় বলেছিল, দিদি আসেন, সাঁতার দিয়া নদী পার হই।

—নদী পার হইতে তোমার বুঝি ইচ্ছা যায় অমূল্য!

—বড় ইচ্ছা যায়।

—নদীর জলে এক কুম্ভীর ভাইস্যা যায়, তোমার গানটা মনে পড়ে অমূল্য?

অমূল্য বলেছিল, পড়ে।

মালতী ভিড়ের ভিতরে অমূল্যর দিকে অপলক তাকিয়ে বলেছিল, বড় ডর ঐ কুম্ভীরকে।

—কোন ডর নাই মালতী দিদি। এবং ডর নাই বলেই হয়তো অমূল্য সারাটা দিন মালতীকে নিয়ে ঘুরতে পেরেছিল। অষ্টমীর স্নানে মালতীকে আর কেউ এত আদর করে সোহাগ করে মেলা দেখায়নি। শোভা, আবু সঙ্গে ছিল না। নরেন দাস তাঁতের কাপড়ের দোকান খুলে বসেছিল আর সেই থেকে অমূল্য হাবাগোবা থাকল না। বান্দা লোক অমূল্যর খাই খাই সহসা বড় বেশি বেড়ে গেল।

সূর্য এবার গোপাটের ওপাশে উঠে এল। এখন হাতে পায়ে শীতটা জমে নেই। মালতী দেখল হাঁসগুলি গর্তের ভিতর প্যাক প্যাক করছে। মালতী গর্তের মুখ থেকে টিনটা তুলে দিল। হাঁসগুলি গলা বের করে দিল প্রথম। বড় পুরুষ হাঁসটা সকলকে ঠেলে প্রথম বের হয়ে এল। অমূল্য বারদীর হাট থেকে পুরুষ হাঁসটা কিনে দিয়েছে মালতীকে। গত বর্ষায় কোথায় যে তার প্রিয় পুরুষ হাঁসটা হারিয়ে গেল, রাতের অন্ধকারে বিলের মাঠে সে এবং অমূল্য পুরুষ হাঁসটাকে ঝোপে জঙ্গলে খুঁজে খুঁজে পেল না। অন্ধকার রাতে হাঁসটার অন্বেষণে নৌকায় মালতী এবং অমূল্য ধানখেতের ভিতর ঘোরাঘুরি করছিল। সামু নৌকায় গ্রামে ফেরার সময় ওদের দেখে অমূল্যকে বলেছিল, অমূল্য বাড়ি যাও। মালতীকে বলেছিল, আনধাইর রাইতে মাঠে ঘাটে একা ঘুরতে নাই মালতী। বাড়ি যা। হাঁসটা আমি দ্যাখতাছি কই গ্যাল। সামু শেষ পর্যন্ত হাঁসটার খোঁজ দিতে পারেনি, হাঁসটা নিখোঁজ হবার পর থেকেই মালতী বড় ম্রিয়মাণ ছিল। অমূল্যর পুরুষ হাঁসটা নীল, কালো এবং খয়েরী রঙের। কী করে, কত কষ্ট করে এবং সারা হাট ঘুরে মাত্র এই একটা তাজা হাঁস মালতীর জন্য অমূল্য সংগ্রহ করতে পেরেছে, প্রায়ই কথায় কথায় এই হাঁসের জন্য অমূল্যর কী কষ্ট গেছে, অমূল্য কত লোককে একটা ভালো পুরুষ হাঁস মালতী দিদির জন্য বলে রেখেছিল—সময়ে অসময়ে কথাটা শোনাবার চেষ্টা করত। আর এই হাঁস কিনে দেবার পর থেকে অমূল্যর আবদারটা আরও বেড়ে গেল। অমূল্য, তুমি তাঁত বুনে খাও, বিধবার ধম্ম কী বুঝবে! যেন মালতীর বলার ইচ্ছা, বিধবার সম্মান বৈধব্যে, বিধবার শাক অন্নে। তুমি অমূল্য, তাঁতের খটখট শব্দ শুনে দু’কান ভোঁতা করে রেখেছ, নাকে তোমার গন্ধ থাকে না, চোখে তোমার স্বপ্ন ঝোলে—আমি বিধবা মালতী সারাদিন এই সংসার করে, ঘরদোর পরিষ্কার রেখে তোমার তাঁতের নলী ভরে শাক অন্নে আমার ভুরিভোজন। ঢেকুরে আঁশের গন্ধ থাকলে আমার সম্মান বাঁচে না। পুরুষ হাঁসটার মতো বনেবাদাড়ে, জলের ঘাটে অথবা রাতের আঁধারে ঘাড় কামড়ে সুখ পেতে চাও, তাতে আমার সম্মান বাঁচে না। তুমি আমায় ভালোবাসা দাও, শুধু আঁশের আশায় ঘুরলে আমিও একদিন গলা কামড়ে দেব। শুধু আঁশে আমার ভালোবাসা কথা কয় না।

স্বপ্নটা দেখার পর থেকেই কেন জানি অমূল্যর প্রতি নৃশংস ভাবটা আরও বেড়ে গেল। অমূল্য আর জব্বর বড় বেশি ঘুরঘুর করছে। মালতী ভাবল, দাদাকে একদিন সে সব বলে দেবে। কারণ জব্বরও কম যায় না। জব্বরের কথা মনে আসতেই মালতীর মুখটা ঘৃণায় কুঁচকে গেল।

মালতী এখন হাঁস নিয়ে ঘাটে যাচ্ছে। মনে মনে অমূল্য ওর ভিতরে তাঁত বুনছে। একবার এদিক, একবার ওদিক। পুরুষ হাঁসটা অন্য হাঁসগুলিকে জলে নামতে দিচ্ছে না। তার আগেই ঠোঁট কামড়ে ঝগড়া করতে চাইছে। মালতী পুরুষ হাঁসটার কাণ্ড দেখে অন্যদিনের মতো আজও মুখে আঁচল চাপা দিল। ওর ভিতর থেকে এখন আবার সেই দুষ্ট হাসিটা মুখে খেলে গেল। তর সয় না। মালতী হাঁসগুলিকে জলের দিকে নিয়ে যাবার সময় কথাটা বলল। আর এইসব দেখলেই মনটা তাঁতের মাকুর মতো কেবল এদিক ওদিক করতে থাকে। এই একটা ইচ্ছার ভাব থাকে ভিতরে, সাপ্টে ওকে কেউ খেয়ে ফেলুক। কিন্তু ফের কেন জানি মনে হয়, বিধবা মানুষের এই ইচ্ছা ভালো নয়। তখন শুধু স্নানের ইচ্ছা, ডুবে ডুবে শরীর থেকে সব পাপ চিন্তা মুছে দেবার ইচ্ছা। যেন স্নান না করলে জাত যাবে। তারপর আবার মনে হয় বিধবার আবার জাত, বিধবার আবার ছোট বড়—সবল যুবতী মালতী যার অঙ্গে লাবণ্য ঝরে পড়ে—যার মুখ পেঁয়াজের কোমল খোসার মতো নরম আর যার ইচ্ছার ঘরে অমূল্য শুধু একটা বাঁদর—সারাক্ষণ লেজ তুলে বসে আছে, সেই অমূল্যকে স্বপ্নে দেখে মুখ বড় বিস্বাদ লাগছিল।

হাঁসগুলি জলে নেমে গেলে মালতী একবার চারদিকে তাকাল। হাঁসগুলি ডুবে ডুবে স্নান করছে। কেউ নেই কাছে। তামাক খেত পার হলে উঁচু জমি, জব্বর সেখানে হালচাষ করছে। নরেন দাস জমির নিচ থেকে রস তুলে পেঁয়াজ রসুন অথবা চীনাবাদামের শরীর পুষ্ট করার চেষ্টায় আছে। আর যেন কোথাও কোনও দৃশ্য ঝুলে নেই। শুধু ঠাকুরবাড়ির সোনা পড়ছে—পাতায় পাতায় পড়ে নিশির শিশির। লালটু পড়ছে, অ্যাট লাস্ট দি সেফিস্ জায়েন্ট কেম। জব্বর হাল চাষ করছে। মালতীকে দেখতে পেলে জব্বর গাই গরু ফেলে এক্ষুনি ছুটে আসবে—মালতী দিদি, বদনাতে পানি দ্যান। গলাটা শুকাইয়া গ্যাছে মালতী ভাবল, জব্বর এলে সামসুদ্দিনের খবর নেবে। সামু এখন এখানে নেই। ঢাকা গেছে। পাগল ঠাকুর হাতি দিয়ে ওদের জলসা ভেঙে দিয়েছিলেন। ফেলু শেখের হাত ভেঙে দিয়েছেন। তারপর থেকে সামু বুঝি হিন্দুপাড়া আসা ছেড়ে দিয়েছে। ছোট ঠাকুর শচীন্দ্রনাথ একদিন গোপাটে দাঁড়িয়ে সামুর সঙ্গে কি সব কথা বলতে বলতে বচসা করেছিলেন। সেই থেকে সামু আর আসে না। সামুর মেয়েটা মাঝে মাঝে গোপাটে এসে ওদের ছাগল গরুগুলি নিয়ে যায়। বড় নথ নাকে দিয়েছে মেয়েটা। ঠাকুরবাড়ির অর্জুন গাছটার নিচে দাঁড়িয়েছিল। কারও জন্য অপেক্ষা করছিল। মালতী চুপি চুপি হেঁটে গিয়ে বলেছিল, কিরে ফতিমা, তুই!

ফতিমার ছোট চোখ। বড় নথ নাকে। শিশু বয়সের মুখচোখ শুধু লাবণ্যে ভরা। বিনুনী বাঁধা চুল। ফতিমা কিছুক্ষণ মালতীর দিকে তাকিয়ে বলেছিল, পিসি, সোনাবাবুরে দিয়েন। বলে, সে কোঁচড় থেকে দুটো লটকনের থোকা মালতীর হাতে দিয়েছিল।

অসময়ে লটকন ফল! সুতরাং মালতী বিস্মিত

ফতিমা নিজেই বলল, আবেদালি চাচা উজান থাইকা আনছে

মালতীর কেন জানি দু’হাতে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরার ইচ্ছা হয়েছিল। কিন্তু মুসলমানের মেয়ে ছুঁয়ে দিলেই জাত যাবে। সে লটকনের ফল খুব আলগা করে হাতে নিল। সে ফতিমাকে ছুঁল না। শুধু হাসতে হাসতে বলল, সোনাবাবুর লাইগা বড় কষ্টরে তোর। বড় হইলে বাবুর লগে বিয়া দিয়া দিমু।

ছোট মেয়ে। অথচ সামান্য রসিকতা ফতিমাকে কেমন লজ্জিত করেছিল। ফতিমা আর দাঁড়ায় নি। সে গোপাট ধরে ছুটছিল। লজ্জায় হোক অথবা অন্য এক কারণ যেন, মেয়েটাকে গোপাট ধরে ছুটে যেতে সাহায্য করছে। অথবা এত যে গাছগাছালি যার ছায়া সারা গ্রামে এবং মাঠে জড়িয়ে আছে তার ভিতর নিরন্তর এক সুষমা আছে যেন। এই সুষমা, ভালোবাসার সুষমা মেয়েটার সারা অঙ্গে লেপ্টে আছে। হেমন্তের শেষ বিকেল ছিল সেটা। মেয়েটা ক্ৰমে এক সুষমার ভিতর হারিয়ে গেল।

সেই সুষমা মালতীকে দীর্ঘদিন অভিভূত করে রেখেছে। সোনা পড়ছে তখনও—পাতায় পাতায় পড়ে নিশির শিশির। হাঁসগুলি জলে ডুবছিল ভাসছিল। পাড়ে দাঁড়িয়ে মালতী। জলে ওর লম্বা ছায়া, মালতী জলে নিজের মুখ দেখতে পাচ্ছে। এই পাড়ে দাঁড়িয়ে কত কথা মনে হয়, সামুর কথা মনে হয়। রসো এবং বুড়ির কথা মনে হয় আর সেই মানুষের কথা মনে হয়। সে মানুষ কৈশোরে ওকে সাপ্টে চুমু খেয়েছিল তারপর ভয়ে নিরুদ্দিষ্ট। সেই মানুষ গত রাতে এসেছে। এখন আর তেমন ছোট নেই। কথায় কথায় ঝগড়া করবে না। এখন মানুষটা বড় এবং মহৎ। মানুষটা দেশের কাজ করে বেড়াচ্ছে। জেলে ছিল কিছুদিন। সবই এখন কেন জানি গল্পকথার মতো মনে হয়। মালতী জলে আর হাঁস দেখতে পাচ্ছিল না, শুধু মানুষটার শরীর মুখ জলের ওপর ভেসে যেতে দেখছে। এই মানুষটাকে দেখার জন্য কেমন পাগলের মতো ঠাকুরবাড়ির ঘাটে সারাটা সকাল ডুবে ডুবে স্নান করল। বড়বৌর জন্য পূজার ফুল তুলে দিল। এমন কি ঠাকুরঘরের পাশে মানুষটাকে দেখতে পাবে ভেবে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু কোথায়! ফের সেই অমূল্যর মুখ, অমূল্য এবং জব্বর উভয়ে মিলে কেবল যেন ওকে গিলতে আসছে। সে মানুষটার জন্য ঠাকুরঘরের দরজায় অধিক সময় অপেক্ষা করতে পারল না—কেউ দেখে ফেলে এই ভয়ে। এমন কি বড়বৌকে বলতে পারল না, বৌদি, রঞ্জিত নাকি কাইল রাতে আইছে? কারণ, ভালোবাসার সুষমা মালতীর চোখে। মালতী রঞ্জিতকে দেখার জন্য ঘাটের পাড়ে যেসব ঝোপজঙ্গল ছিল সেখানে নিজেকে অদৃশ্য করার ইচ্ছাতে বসে পড়তেই কে যেন বলে উঠল, মালতী, তুমি এখানে একা।

মালতীর বুকটা ধড়াস করে উঠল। সে পিছনের দিকে মুখ ফেরাতেই দেখল রঞ্জিত দাঁড়িয়ে আছে। হাত ধরে আছে সোনা। সব লুকোচুরি এবার বুঝি ফাঁস হয়ে গেল। মালতী প্রথম মাটি থেকে কিছুতেই চোখ তুলতে পারল না, পাতায় পাতায় পড়ে নিশির শিশির—এখন আর কেউ পড়ছে না। সব সহসা বড় চুপ মেরে গেছে। এমন কি কীট-পতঙ্গের আওয়াজ টের পাওয়া যাচ্ছে না। মালতী ভয়ে ভয়ে বলল, হাঁস ছাড়তে আইছি। এই বলে মুখ তুলে তাকাল রঞ্জিতের দিকে। মনে হল এখন কোথাও কিছু চুপ হয়ে নেই। সকল কিছু ডেকে বেড়াচ্ছে, হাঁস-মুরগি,গরু-বাছুর, কাকপক্ষী সকলেই কলরব করছে। ঠিক তখনই মালতী তাঁতঘরে অমূল্যর ঠকঠক তাঁতের শব্দ শুনতে পেল।

রঞ্জিতকে দেখে মালতীর দীর্ঘদিন পর সব ভয় কেটে গেছে। জব্বর অথবা অমূল্য কেউ বুঝি আর তাকে গিলে খেতে পারবে না।

কোথাও যেন তখনও একই স্বরে কে পড়ে আছে—অ্যাট লাস্ট দি সেফিস্ জায়েন্ট কেম। মালতী কান পেতে শোনার সময় রঞ্জিতের দিকে তাকিয়ে সামান্য হাসল। রঞ্জিতও সামান্য না হেসে পারল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *