নিঃসঙ্গ পাইন – ৯

রকিবের বন্ধুটি ভারি মজার। খুব কথা বলে, হা হা করে হাসে। যেখানে বসে, সেখানকার পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে ফেলে। তার বউটি ঠিক উলটো। লাল চুল, লম্বা পাতলা শরীর নিয়ে ভারি সুন্দরী সে, চোখের দৃষ্টি রহস্যময়, ঠোঁটের কোণে মৃদু মৃদু হাসি কিন্তু কথা বলে খুবই কম।

স্ট্যানলিকে সাকিনার বেশ ভালো লেগে গেল। তার আরো একটা কারণ- স্ট্যানলির উচ্চারণ খুব পরিষ্কার, সাকিনা বেশ বুঝতে পারে। এখন সেও মোটামুটি গড়গড় করে আমেরিকান ইংরেজি বলতে পারে। আগে ভয় ছিল যদি ভুল বলে ফেলে, তাই মুখে কথা আসত না। রকিব বকে-বকে সেটা ঘুচিয়েছে। ‘ভুল হয় হবে, তাতে তোমাকে কেউ কিছু বলবে না, তোমার পণ্ডিতি নিয়েও কারো মাথাব্যথা নেই। এখানকার খোদ আমেরিকানরাই হরদম কত ভুল বলে যাচ্ছে। কে তার তোয়াক্কা করে? এতে একটা ফল হয়েছে। ভুল হোক, যাই হোক, সাকিনা যা বলতে চায়, গড়গড়িয়ে বলতে পারে। সত্যিই, এদেশে এরা ভুল শুনে কেউ হাসে না বা টিটকিরি দেয় না। সাকিনার মনে পড়ে, দেশে থাকতে কোনো অবাঙালির মুখে ভুল বাংলা শুনে লোকে হেসেছে, হেসে হেসে তক্ষুনি বেচারার মুখের ওপর বারেবারে তাকে শুধরে দিয়েছে। এখানে এই ব্যাপারটা নেই। সাকিনা নিজেই বুঝতে পারে, তার বাক্যগঠনে ভয়ানক রকম বেচাল হয়ে যাচ্ছে, তবু এখানকার মানুষে যেন সেটা খেয়ালই করে না। এটা মস্ত একটা স্বস্তি এনে দিয়েছে তার মনে।

খেতে বসে স্ট্যানলি প্রতিটি খাবারের নাম ও রন্ধনপ্রণালী জেনে নিচ্ছিল সাকিনার কাছ থেকে। সাকিনার বাড়িতে এই প্রথম লোকে দাওয়াত খাচ্ছে, তার মধ্যে একজন আবার বাঙালি। সে মনের সুখে রেঁধেছে পোলাও, কোর্মা, কিমাভুনা, মাছের দোপেঁয়াজা, আলু-কপি ভাজি, বেগুনের দোলমা। স্ট্যানলি প্রতিটি পদ আলাদা করে নিয়ে খেল এবং খেতে খেতে সাকিনাকে রেসিপি জিজ্ঞেস করে নিল। রকিব অবাক হয়ে বলল, — রেসিপি জিজ্ঞেস করে তোমার কী লাভ স্ট্যান? তুমি কি এসব নিজে রাঁধতে পারবে কোনোদিন?’

স্ট্যানলির বউ মিরান্ডা মুচকি হেসে বলল, ‘ বোট বিক্রি করার পর ও রান্নাবান্না নিেেয় মেতেছে।’

স্ট্যানলি গলা উঁচু করে বলল, ‘দেড়বছরে আমি বহুত মেক্সিকান রান্না শিখে ফেলেছি স্যানডিয়েগোতে।’

সাকিনা জিজ্ঞেস করল, ‘ বোট বিক্রি করার ব্যাপারটা কী?’

স্ট্যানলি বলল, ‘এখানে আমার নিজের একটা বোট ছিল। মিশিগান লেকের দেশ তো। এখানে বহুত লোকে বোট রাখে। লেকে ঘোরে, ওয়াটার-স্কি করে, বোট-রেস লাগায়। কেন রকিব তোমাকে বলেনি—কতদিন ও আমার সঙ্গে বোটে করে লেকে বেড়িয়েছে।’

সাকিনা হেসে বলল, ‘না, আমি আসার আগে ও এখানে কী করত, কিছুই বলেনি ‘ স্ট্যানলি আর মিরান্ডা দুজনেই যেন একটু বিষম খেল। রকিব হঠাৎ ‘আরে সাইফ আপনি কিছুই নিচ্ছেন না যে, এই যে আর্নি— বাঙালি খাবার কি খেতে পারছেন?’ এসব বলে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সমস্ত ব্যাপারটাই সাকিনার চোখে ঠেকল। কী ব্যাপার? সে খুব সরলভাবেই কথাটা বলেছিল, তার প্রতিক্রিয়া এ-রকম হবে, আশা করেনি। তবে কী—

সাকিনা মাথা ঝাঁকি দিয়ে বলে উঠল, ‘ঝাল বোধহয় বেশি হয়ে গেছে, তাই না? আমরা আবার ঝাল একটু বেশি খাই। তবে আপনাদের জন্য ঝাল কমই দিয়েছি।’

স্ট্যানলি বলল, ‘ কোনো চিন্তা করবেন না, মেক্সিকান খাবার এর চেয়েও ঝাল হয়। উহ্, যা মজা খেতে! ‘

খাওয়া-শেষে সবাই সাকিনাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এলে সে হেসে বলল, ‘আপনারা সবাই ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসলেই আমাকে বেশি সাহায্য করা হবে। আমি ও ঘরেই ডিজার্ট সার্ভ করব।’

স্ট্যানলি উৎসুক চোখ বড়বড় করে জিজ্ঞেস করল, ‘কী ডিজার্ট বানিয়েছেন? আপনাদের দেশের কোনো স্পেশিয়ালিটি নিশ্চয়?’

‘হ্যাঁ, আমাদের দেশের স্পেশাল একটা মিষ্টি, একে বলে পায়েস।’ সাকিনা ফ্রিজ খুলে পায়েসের বাটি বের করতেই স্ট্যানলি সেটার ওপর ঝুঁকে পড়ল। ‘রাইস পুডিং?’ তার কণ্ঠস্বরে হতাশা।

‘না, না, আপনাদের যেটা রাইস পুডিং, সে-রকম বাজে এটা মোটেও নয়। এটা খেজুরগুড় দিয়ে বানানো। খেজুরগুড় খেজুরগাছের রস দিয়ে তৈরি হয়। আপনাদের যেমন মেইপল সিরাপ। সেইরকম রস জ্বাল দিয়ে— এই যে দেখুন— এই রকম পাটালি বানানো হয়। এগুলো ফ্রিজে রাখলে বহুদিন থাকে। খেলে বুঝবেন। আপনাদের রাইস পুডিং থেকে অনেক ভালো।’

সবাই চলে যাবার পর সাকিনার জ্বলজ্বলে মুখের দিকে তাকিয়ে রকিব বলল, ‘কী, খুশি তো? স্ট্যানলি কী চমৎকার ছেলে, তাই না?

‘সত্যি, এ-রকম আমুদে দিল-খোলা লোক এদেশে এসে আর দেখিনি।’

‘আরো দেখবে ওর কত গুণ। বড়লোক বাপের একমাত্র ছেলে, এখানে লেকের ধারে বিরাট বাড়ি, অনেক সম্পত্তি। বাবা মারা গেছে মাস দুই হল, তাই ফিরে এসেছে। ওই এখন সব সম্পত্তির মালিক। বলছিল আবার বোট কিনবে।’

‘ও না ডাক্তার? ডাক্তারি করে সময় পাবে বোট নিয়ে ঘুরতে?’

.

‘আরো না-না। ও কেন ডাক্তার হবে। ওর বউ ডাক্তার। ওদের তো রিয়েল- এস্টেটের বিরাট ব্যবসা। বললাম না—বেজায় বড়লোক। স্ট্যানের হল বোট-রেসের নেশা। দেখবে কেমন হুল্লোড় হবে এবার সামারে। তুমি আর মন খারাপ করে থাকার চান্স পাবে না। স্ট্যান একাই তোমাকে মাতিয়ে রাখবে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *