২
জানালা দিয়ে তাকালে মাঠ, রাস্তা, মানুষ, গাড়ি, গাছ, আকাশ–সব একসঙ্গে দেখা যায় না। বেইসমেন্ট ফ্ল্যাটের জানালার ওপারে খণ্ডচিত্র দেখা যায়—চলমান মানুষের পা কিংবা ধাবমান গাড়ির চাকা। জানালার একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে উঁকি দিলে আকাশের একটা টুকরো চোখে ধরা পড়ে।
বাইরে পরিবেশটা কী চমৎকার! ঘন সবুজ ঘাসে-ছাওয়া লন, হাঁটবার জন্য সরু ফুটপাথ, মাঝেমাঝে গাছ, তারপর চওড়া রাস্তা, রাস্তায় ওপাশে লম্বা-লম্বা গাছ। বেশ একটা জঙ্গল-জঙ্গল ভাব। কিন্তু এই সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করতে হলে সাকিনাকে ফ্ল্যাটের বাইরে আসতে হবে। কাজ করার ফাঁকে-ফাঁকে যে বাইরে তাকিয়ে চোখ জুড়িয়ে নেবে, তার উপায় নেই। খণ্ডচিত্রে মন ভরে না। মাঝেমাঝে কেমন একটা
দমবন্ধ-করা ভাব হয়।
প্লেন থেকে নেমে প্রথমে উঠেছিল চাচাশ্বশুরের বাসায়। ডেট্রয়েট থেকে পঁচিশ-ছাব্বিশ মাইল দূরে ফার্মিংটন হিলস শহরে তাঁর বিরাট বাড়ি। চাচাশ্বশুরও ডাক্তার। বিশবছর ধরে এদেশে আছেন, এদেশেরই নাগরিক এখন।
এয়ারপোর্টে রকিবের সঙ্গে তার চাচাতো ভাইবোনেরা গিয়েছিল। চাচা-চাচী বাড়িতে ছিলেন নতুন বউকে বরণ করার জন্য। চাচী রীতিমতো দেশি কায়দায় কুলোয় পান-সুপারি, প্রদীপ ইত্যাদি সাজিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সাকিনার মুখে চিনি দিয়ে তাকে ঘরে তোলেন। চাচাতো ভাইবোনেরা একটা ঘরকে ঠিক বাসরঘরের মতো সাজিয়েছিল। পাঁচমাস আগের ঢাকার বাসররাতের মতোই মনে হয়েছিল সাকিনার। রকিবের তেমনি উদ্দাম ভালবাসা, তেমনি দুরন্ত আবেগে সাকিনাকে আচ্ছন্ন করে দেওয়া!
ওরা সাতদিন ছিল চাচার বাড়িতে। তারপর রকিবের এই বেইসমেন্ট অ্যাপার্টমেন্টে এসে উঠেছে।
চাচার বাড়ি থেকে শুক্রবার রাতের খানা খেয়ে ওরা নিজেদের ফ্ল্যাটে আসে। ঘরে ঢুকে সাকিনা মুগ্ধ হয়ে যায়। এত সুন্দর করে সাজানো বাসাটা! ছোট্ট পাখির নীড়ের মতো। দুটো ছোট শোবার ঘর, বসার-খাবার ঘর একত্রে আর পিচ্চি রান্নাঘর, পিচ্চি বাথরুম। পিচ্চি — কিন্তু রান্নাঘরে চারটে গ্যাসের চুলো, দেশের স্টিল আলমারির মতো বিরাট ফ্রিজ। বাথরুমে বেসিন, কমোডের পাশে বাথটাবটাও রয়েছে। আসবাবপত্র সুন্দর সুরুচিপূর্ণ। পুরো ফ্ল্যাটটা উজ্জ্বল আলোয় ঝলমল করছিল। সাকিনার মন সুখে কানায়-কানায় পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল।
রকিব ডাক্তারি পাশ করে একটা হাসপাতালে রেসিডেন্সি করছে—ঢাকায় যেটাকে ইন্টার্নিশিপ বলে। সাধারণত শনি-রবি দুটো দিন ছুটি সে কখনই ভোগ করতে পারে না। কিন্তু যেহেতু সাকিনা এসেছে, এদেশে নতুন, বাসাতে এই প্রথম একা; সে সহ-রেসিডেন্ট বন্ধুদের ধরে কোনোমতে এই উউক-এন্ডটা খালি করেছে। সাকিনাকে সঙ্গে নিয়ে হেঁটে হেঁটে কাছের দোকানপাটে গিয়ে মাছ, মাংস, সব্জি, রুটি, বিস্কুট, কেক পেস্ট্রি— যা-যা লাগে সব কিনেছে। সাকিনাকে শিখিয়েছে কেমন করে এসব দোকানে জিনিসপত্র কিনতে হয়, কেমন করে কোথায় দাম দিয়ে বেরিয়ে আসতে হয়। বাসায় ফিরে, কী করে চুলো ধরাতে হয়, কিভাবে আভ্ ব্যবহার করতে হয় দেখিয়ে দিয়েছে। উইক-এন্ডের দুটো দিন সে সাকিনাকে রান্নায় সাহায্য করেছে, খাওয়া-দাওয়ার পর থালাবাসন ধুয়ে দিয়েছে। হাসি, কৌতুক, কল-কূজনের ভেতর দুটো দিন হাওয়ায় ভর দিয়ে উড়ে গেছে।
আজ সোমবার সকালে রকিব সাতটাতেই হাসপাতালে চলে গেছে। এই পাখির নীড়ে সাকিনা এখন একা। নীড়টাকে তার খুব বড়, খুব খালি লাগছে। আর ঐ-যে ছাদের ঠিক নিচ থেকে জানালাটা ঝুলে আছে, ঘরের মেঝে থেকে অনেক উঁচুতে, জানালার নিচের কার্নিশটাই তার গলার কাছাকাছি। তার মানে ঘরের এতখানি মাটির নিচে! একেক সময় সাকিনার কেমন যেন বুক-চাপা দম-আটকানো ভাব হচ্ছে। আজ রকিব ফিরলে তাকে জিজ্ঞেস করবে, এ-রকম মাটির নিচের বাসা সে নিয়েছে কেন? রকিব বলেছে, মাঝে মাঝে বাইরে বেরিয়ো, ফুটপাথ ধরে হেঁটো, তবে দেখো চাবি সাথে নিতে ভুলো না। এদেশের দরজাগুলো শুধু খোলবার সময় চাবি লাগে, বন্ধ করার বেলা টেনে দিলেই আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যায়। সুতরাং ঘরে চাবি রেখে বাইরে বেরিয়েছ কি মরেছ। তখন দৌড়াও অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের অফিসে, কেয়ার টেকারের কাছ থেকে ডুপ্লিকেট চাবি আনো —এতসব ঝামেলা।
এখানে আসার পর থেকে রকিব তাকে খালি শেখাচ্ছে। আসার পরেই বা কেন? আসার আগে থেকেও তো। বিয়ের কথা পাকা হয়ে সাতদিনের মধ্যে বিয়ে হল। তার পরপরই রকিবের কথামতো সে ধানমণ্ডির মিসেস টমসনের ইংরেজি কথা বলার ক্লাসে ভর্তি হল। তারটা ছিল ক্রাশ-প্রোগ্রাম। দৈনিক চারঘণ্টা করে ক্লাস, সপ্তাহে ছয়দিন। পাঁচমাস ধরে সমানে চলেছে। এখন বেশ ফড়ফড় করে বলতে পারে। কিন্তু মুশকিল হয়েছে— মিসেস টমসন ছিলেন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। তাঁর কাছে ইংরেজি শিখে এখানে আসার পরে এদেশি লোকের উচ্চারণ সে বুঝতে পারে না। ফলে রকিবের ধারণা হয়েছে, সে ঢাকায় তার ইংরেজি শেখার ব্যাপারে যথেষ্ট মনোযোগী হয়নি। তাই রকিব এখন তাকে আমেরিকান অ্যাকসেন্টে ইংরেজিও শেখাচ্ছে উঠতে বসতে!
ঘড়ির দিকে তাকাল সাকিনা। দুপুর বারোটা। রকিব যখন যায়, তখনো সে বিছানায়। রকিবই তাকে অত সকালে উঠতে বারণ করেছে। নিজেই নিজের ব্রেকফাস্ট বানিয়ে খেয়ে আধ-ঘুমন্ত সাকিনার ঠোঁটে চুমু দিয়ে ‘বাই ডালিং, সি-ইউ’ বলে চলে গেছে। এক্কেবারে পাকা সাহেবি ধরন-ধারণ। সাকিনার দুই ঠোঁট ফাঁক করে একটুকরো হাসি ফুটে উঠল। এমন পাগল! কাল রাত প্রায় দুটো পর্যন্ত তাকে জাগিয়ে রেখেছিল। ঘুমোতে যাবার আগে ঘড়িতে ছটায় অ্যালার্ম দিয়ে বলেছিল, ‘শব্দে ঘুম ভেঙে গেলে আবার ঘুমিয়ো। অত সকালে তোমার ওঠার কোনো দরকার নেই। আমার অভ্যেস আছে রাত ৪টায় শুয়ে ৬টায় ওঠার। তোমার এখন বেশি ঘুম আর রেস্টের দরকার।’ আহা, কী বিবেচনা! রাত দুটো পর্যন্ত জাগাবার বেলা মনে থাকে না?
তার চিরকাল ভোরে ওঠা অভ্যেস। তাই সেও বেশি বেলা পর্যন্ত শুয়ে থাকতে পারেনি! আটটাতেই উঠে পড়েছে। এই প্রথম একা বাসাতে একা-একা নাশতা করা। রোকেয়া হলেও প্রায়-প্রায়ই ঘরে নিজে নাশতা বানিয়ে খেত। কিন্তু সেখানে ঘরে, বারান্দায় সর্বত্র আরো মেয়ে গিজগিজ করত। সেজন্য একা লাগত না। আজকেও খুব একটা খারাপ লাগল না। কেমন নতুন একটা অনুভূতি। সুপুরুষ প্রাণবন্ত স্বামীর প্রেমে, আদরে, আহ্লাদে সারা শরীর-মন আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে— তার নিবিড় উষ্ণ আলিঙ্গনের প্রলেপ এখনো যেন শরীরের পরতে-পরতে লেপ্টে আছে। কেমন এক মধুর আলস্যে শরীর এলিয়ে পড়তে চাইছে, ঘুমঘুম লাগছে। রকিবের দুই হাতের সবল বেস্টনীর স্মৃতি সারাশরীরে অনুভব করতে করতে সাকিনা আবার বিছানায় গিয়ে উপুড় হল। কত কাজ বাকি পড়ে রয়েছে। এখানে এসে তক কেবল আব্বা-মাকে চিঠি দিয়েছে— সংক্ষিপ্ত। চাচার বাসায় থাকার সময়। তার নতুন বাসার নতুন সংসারের সব খুঁটিনাটিসহ বড় চিঠি লিখতে হবে মাকে, বোনকে, মেজো ভাইকে।
ঘুমিয়েই পড়েছিল, হঠাৎ কী একটা শব্দে জেগে গিয়ে দেখে রকিব তার মুখের ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে। সে চমকে উঠে বসতে যেতেই একেবারে রকিবের বুকের ভেতর চলে গেল, রকিব তার ঠোঁটে ঠোঁট ঘষতে ঘষতে অস্ফুটে বলতে লাগল, ‘ঘুমোলে তোমাকে যে কী সুন্দর লাগে।’
তার উষ্ণ ঠোঁটের ভেতর থেকে নিজের মুখটা উদ্ধার করে সাকিনা বলল, ‘কখন এসেছ টেরই পাইনি। কই, বেল তো বাজে নি?’
রকিব হেসে বলল, ‘বেল বাজবে কেন? আমি তো চাবি দিয়ে দরজা খুলেছি। এখানে বেল বাজাবে বাইরের অতিথি, বন্ধুবান্ধব।’
কেন আমি বাসার ভেতর থাকলে তোমার বেল বাজাতে বাধা কোথায়? আমি খুলে দেব।
‘নাহ্, এখানে সে অভ্যেস সেই। স্বামী, স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে— সবার কাছে একটা করে চাবি থাকে, সবাই নিজের চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢোকে।’
‘তার মানে দরজায় ভেতর থেকে ছিটকিনি লাগানো থাকে না। যে-কেউ বাইরে থেকে দরজা খুলে ঘরে ঢুকতে পারে?’ সাকিনা হঠাৎ শিউরে উঠল, ‘মাগো! চোর-চোট্টারা তো অনায়াসে শিক বা কিছু দিয়ে দরজা খুলে ঢুকতে পারে?’
রকিব সাকিনার নাকটা ধরে নাড়িয়ে বলল, ‘ভিতুর ডিম। এদেশে ওরকম ছ্যাচড়া চোর নেই। চোর যা, তা সব বড় বড় জুয়েলথিফ বা ব্যাংক রবার। সেসব কোটি কোটি টাকার ব্যাপার। সাধারণ লোকদের বাড়ি-ঘর খোলা রাখলেও কেউ ঢোকে না, কিছু চুরি করে না।’
‘তা কী করে হয়? সেদিন যে চাচী বললেন ডেট্রয়েটে তাঁর চেনা এক বাঙালির বাসার তালা ভেঙে কালোরা গয়না চুরি করে নিয়ে গেছে।’
‘ওরকম দু-একটা জায়গায় হয়, সেখানে অল্পশিক্ষিত গরিব কালোরা বাস করে। তাছাড়া ঐ বাঙালি মহিলা নিশ্চয় তার বাইশ ক্যারেট নিরেট সোনার বা চুনি-পান্না বসানো জড়োয়া গয়না পরে খুব দেখিয়ে বেড়িয়েছে। জানো তো এদেশের কোনো গয়না আঠার ক্যারেটের বেশি হয় না। বেশির ভাগই চৌদ্দ ক্যারেট। আর আসল মণিমুক্তো ক-জনে পরতে পারে? তাই ওসবের ওপর চোরদের খুব লোভ।’
সাকিনা ভয়-খাওয়া গলায় বলে উঠল, ‘আমার যে এত গয়না
রকিব ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘ শোনো, এই রচেস্টার শহর খুব নিরাপদ, এটা পুরনো অভিজাত এলাকা। এখানে গরিব, কালো, গুণ্ডা বদমাশ নেই। তোমার কোনো ভয় নেই। তা ছাড়া গয়না তো আমি শিগগিরই ব্যাংকের লকারে সব রেখে দেব।’
সাকিনার হঠাৎ কী যেন মনে পড়ল, ‘আচ্ছা, কটা বাজে? তোমার কি এখন ফেরার কথা?’
রকিব দুষ্টু হাসি হাসতে হাসতে সাকিনাকে দুইবাহুর মধ্যে বন্দি করে ফেলল, ‘মোটেই না। আমার ফেরার কথা সেই ছটায়, এখন বাজে দুটো। এক বন্ধুর ডিউটি শেষ, তাকে হাতে-পায়ে ধরে দু-ঘণ্টা আমার জায়গায় রেখে চলে এসেছি।’
সাকিনা খাট থেকে নামতে গেল, ‘চল খাবে—’
‘কী খাবো এখন? লাঞ্চ তো করেছি। তুমি খাওনি?’
‘না, খিদে পায়নি, দেরি করে নাশতা খেয়েছি। তা তুমি যখন বাড়িই আসবে, লাঞ্চ খেতে গেলে কেন?’
‘বারে লাঞ্চের সময় লাঞ্চ খাব না? এখানে সারাদেশে সবাই বারোটা থেকে একটার মধ্যে লাঞ্চ করে। শনিবার অনেক অফিস দুটো পর্যন্ত খোলা থাকে। তারাও বারোটার সময় অফিসে লাঞ্চ সেরে দুটোর সময় বাড়ি ফেরে।’
সাকিনা মৃদু হেসে বলল, ‘আজব দেশ। যাকগে, আমি তো এখনো এদেশের নিয়মে অভ্যস্ত হইনি, আমি দুটো আড়াইটেতেই খাব।’
রকিব তর্জনী উঁচিয়ে বলল, ‘না, কখনই না। এ-রকম অনিয়ম তুমি করতে পারবে না। তুমিও বারোটা-একটাতেই লাঞ্চ সারবে। আস্তেআস্তে এদেশের নিয়মে অভ্যস্ত. হওয়াই ভালো। সেটা স্বাস্থ্যের জন্যও ভালো বটে।’