নিঃসঙ্গ পাইন – ১৮

১৮

জাহানারার ঢাকা ফিরে যাবার দিন ঠিক হয়ে গেছে—অক্টোবরের পাঁচ তারিখ। জামী-ফ্রিডার মন খারাপ, সবচেয়ে বেশি মন খারাপ সাকিনার। সে বারবার করে বলেছে

‘খালাম্মা, আপনি চলে গেলে আমি খুব নিঃসহায় হয়ে যাব।’

জাহানারা চোখ পাকিয়ে বলেছেন : ‘ কেউ কারো জন্য নিঃসহায় হয়ে যায় না। খবরদার এ কথাটা ভুলবে না। আর, কখনো কারো ওপর নির্ভর করবে না, নিজের দু-পায়ে ভর দিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়াবে। তাহলেই দেখবে আর কখনো দুঃখ পাবে না। ‘ তারপর হেসে ফেলে সাকিনার থুতনি নেড়ে দিয়ে বলেছেন : ‘গায়ের জোরে ভালো থাকতে হবে। বুঝেছ?’

এখন একা-একা বসার ঘরের সোফায় বসে উদাস চোখে খেলার মাঠের দিকে তাকিয়ে সাকিনা এইসব কথাই ভাবছিল। গায়ের জোরে ভালো থাকতে হবে। কী উদ্ভট কথা!

পেছনদিকের দরজা খুলে কখন বেটিনা ঘরে ঢুকেছে সাকিনা খেয়াল করেনি। হঠাৎ চমকে উঠল ওর গলা শুনে— ‘এই মেয়ে আবার মন খারাপ করে বসে আছ।’

সাকিনা ওকে দেখে খুশি হল। একা থাকলেই যত চিন্তার ভূতগুলো এসে বুকে চেপে বসে। এখন অন্তত ঘুমোনোর আগে পর্যন্ত সময়টা ভালো কাটবে। বলল, ‘খালাম্মা দেশে ফিরে যাচ্ছেন শিগগির। উনি চলে গেলে আমি খুব একা হয়ে যাব। তাই ভাবছিলাম।’

‘কেউ কারো জন্য একা হয়ে যায় না। এসব মানুষের বিভ্রান্ত বিশ্বাস। নো বডি ইজ ইন্ডিপেনসিবল্ ইন দিস ওয়ার্ল্ড।

সাকিনা তর্কের দিকে এগোল না। বেটিনা খুব তর্ক করতে পারে। অবশ্য ওর সঙ্গে তর্ক করে সাকিনাও মাঝেমাঝে খুব চাঙা হয়ে ওঠে, ওর মাথার ধোঁয়াটে ভাব-ভাবনাগুলো খুব স্পষ্ট আকৃতি পায়। কিন্তু আজ সেটা এড়িয়ে অন্য কথা বলল— ‘আমি আগামীকাল খুব ভোরে ফ্রিডাদের সঙ্গে স্ট্র্যাটফোর্ডে যাচ্ছি। ফিরতে রাত এগারটা হবে। তুমি তোমার বয়ফ্রেন্ডকে সারাদিনের জন্য দাওয়াত করতে পার।’

‘স-ত্যি? তুমি সারাদিন থাকবে না? ওহ্, হাউ নাইস অব ইউ! আমি এক্ষুনি হাওয়ার্ডকে ফোন করে দেখি—ও আবার কাল সকালে গলফের প্রোগ্রাম করে না ফেলে।

ফোন করে বেটিনা হাসিমুখে ফিরে এল, ‘নাহ্, কালকে ওর কোনো প্রোগ্রাম নেই। সকাল দশটাতেই চলে আসবে। স্ট্র্যাটফোর্ডে কেন?’

‘ওখানে প্রতিবছর সামারে আর ফল-এ শেক্সপীয়ারিয়ান ড্রামা-ফেস্টিভ্যাল হয়। ওখানে তিনটে থিয়েটার হল আছে। জুন থেকে অক্টোবর প্রতিসপ্তাহে তিন-চারদিন করে শেক্সপীয়ারের নাটক হয়। ফ্রিডারা প্রতিবছর একদিন যায়। একটা নাটক দেখে আসে। এবার আমাকেও ওদের সঙ্গে যেতে বলেছে।’

বেটিনার মুখ দেখে মনে হল এ বিষয়ে ওর বিশেষ কোনো কৌতূহল নেই। সাকিনা জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কোনোদিন যাওনি?’

বেটিনা কাঁধ ঝাঁকাল—’আমি বিশেষ জানি না এ সম্বন্ধে। দেশের কত জায়গাতে কতরকম ফেস্টিভ্যাল হচ্ছে, সারা বছর লেগেই রয়েছে। যার যেটায় আগ্রহ, সে শুধু সেইটের খবরই রাখে। আমার নেশা হল জ্যাজে। যেখানে জ্যাজের কোনো অনুষ্ঠান—হাওয়ার্ড আর আমাকে সেখানে পাবেই।

‘শোনো, আমার ফোন এলে মেসেজগুলো রাখবে কি দয়া করে?

‘অবশ্যই।’

.

‘কেমন এনজয় করলে শেক্সপীয়ারের ড্রামা?’

‘উহ্! অপূর্ব। শুধুতো নাটকই নয়—এই-যে যাওয়া, দুপুরে পার্কের টেবিলে বসে খাওয়া, আড়াইটের শোতে নাটক দেখে সন্ধেয় একটা রেস্তোরাঁয় ডিনার খাওয়া—সবটা মিলে চমৎকার একটা পিকনিকের মতো। আমার যা ভালো লেগেছে না! কী বলব! আর জায়গাটা যা সুন্দর। থিয়েটার হলগুলো ঘিরে ফুলের বাগান, পার্ক, লেক—কত কী।

‘খুশি হলাম এনজয় করেছ শুনে। ও হ্যাঁ, দুজন মানুষে কাল তোমাকে পাঁচবার ফোন করেছে।’

‘কী রকম? দুজন মানুষে পাঁচবার? নিশ্চয় একেকজনে আড়াইবার করে নয়?

বেটিনা ঘরের ছাদ ফাটিয়ে হো হো করে হাসল, ‘বাহ্, এই তো তোমার সেন্স অব হিউমার বেশ ডেভেলাপ করছে। না, আড়াইবার করে নয়—একজন মাত্র একবার, অন্যজন চারবার। এই-যে কাগজটায় নাম লেখা আছে।’

বেটিনার বাড়ানো কাগজটায় চোখ পড়তে সাকিনার হৃৎপিণ্ড একবার লাফিয়ে উঠেই যেন অকস্মাৎ থেমে গেল। রকিব ফোন করেছিল! এতদিন পরে! পরের চারবার, স্ট্যানলি করেছে। কেউ কোনো মেসেজ রাখেনি।

‘তবে তোমার ঐ রো-কিবও কিন্তু আমাকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করছিল। আমি কে, কবে থেকে আছি, কী করি, এসব। আর ঐযে স্ট্যানলি, ওতো চারবার ফোন করেছে। একবারও কোনো মেসেজ দেয়নি। তোমার ফিরতে রাত এগারটা হবে জেনেও কেন যে বারবার ফোন করছিল, তা বোঝা গেল না। ওকি তোমার বয়ফ্রেন্ড? ঝড়গাঝাঁটি করেছ নাকি?’

সাকিনা ভয়ানকভাবে চমকে সোজা হয়ে উঠে বসল, ‘না, না; কী যে বল! আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই; তা তুমি জানো না? স্ট্যানলিকে তুমি দেখেছ তো। এ বাড়িতে বেড়াতে এসেছে; খোঁজ-খবর নিয়ে চলে গেছে। আমাদের ব্যবহার দেখে তোমার কি মনে হয়েছে স্ট্যানলির সঙ্গে আমার—’

‘না, তা মনে হয়নি! তবে তুমিই বা এত ব্লাশ করছ কেন? এতদিন প্রেম ছিল না, এখন তো হতে পারে।’

সাকিনার মুখ টকটকে হয়ে উঠল, সে ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলল, ‘বেটিনা, আমি মোটেও ব্লাশ করিনি। তোমার অন্যায় কথায় রেগে গেছি। তুমি জানো আমি ওরকম মেয়ে নই। আমার স্বামী আছে—’

বেটিনা অবাক হয়ে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে কাঁধ ঝাঁকিয়ে ঘুরে চলে গেল। সাকিনা মেয়েটাকে সে মাঝেমধ্যে একেবারেই বুঝতে পারে না। ভীষণরকম কমপ্লেক্স আর কনফিউশানে ভুগছে। স্বামী তাকে ছেড়ে অন্য মেয়ের সঙ্গে চলে গেছে। সে স্বামীকে ঘৃণাও করছে, আবার তাকে ভুলতেও পারছে না। স্ট্যানলিকে দেখলেই বোঝা যায়, সাকিনার জন্য জীবনটা পর্যন্ত দিয়ে দিতে একপায়ে খাড়া। অথচ সাকিনা সেটাকে এতটুকু স্বীকৃতি দিতে নারাজ। স্ট্যানলির সঙ্গে সহজ হতে পারলে মেয়েটা কষ্ট কম পেত। জীবনটা এত ছোট, এইরকম কষ্ট পেয়েই যদি বেশিরভাগ সময় কাটিয়ে দেবে, তো আনন্দ পাবে কখন? যাকগে তার কী! সে সাকিনার মনের বিভ্রান্তি ঘোচাতে একটু সাহায্য করতে চেয়েছিল বই তো নয়!

বেটিনা রান্নাঘরে গিয়ে ব্রেকফাস্ট তৈরির উদ্যোগ নিল, সাকিনা আস্তেআস্তে গিয়ে পেছন থেকে তার কাঁধে হাত রাখল—’আয়াম সরি, বেটিনা। তোমার মতো বন্ধুকে আমার এত কড়া কথা বলা উচিত হয়নি। প্লিজ, রাগ কোরো না। বল, রাগ করনি।’

বেটিনা তার মধুর হাসি ঝলকে সাকিনাকে একহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘মোটেই রাগ করিনি। তোমার টেনশানের সময় এইটুকু যদি সহ্য করতে না পারি, তাহলে আর বন্ধু কিসের?’

ব্রেকফাস্ট শেষ হতে-না-হতে স্ট্যানলির ফোন এল! স্ট্যানলি তাকে জানাল মিরান্ডা ডিভোর্সের জন্য উকিলের চিঠি পাঠিয়েছে! সাকিনার বুক ধক করে উঠল। গতকাল রকিব কেন ফোন করেছিল এতদিন পর? কথাটা স্ট্যানলিকে বলতে সে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কিছু আন্দাজ করতে পার, রকিব কী বলার জন্য ফোন করেছিল?’

‘না!’

‘তোমাদের ডিভোর্সের নিয়মকানুন কীরকম জানো কি? তোমাদের বিয়ে তো বাংলাদেশে হয়েছে। এখানকার ডিভোর্স ল’ অনুযায়ী কি এখানে তোমাদের ডিভোর্স হওয়া সম্ভব?’

স্ট্যানলির কথাগুলো, সাকিনার বুকের মধ্যে কেটে বসতে লাগল। তার বুকটা যেন জমে হিম হয়ে যাচ্ছে। সে কোনো মতে দম-চাপা স্বরে বলল, ‘আমি কিচ্ছু জানি না স্ট্যানলি। আমি এ বিষয়ে এখন কোনো কথাও বলতে চাইনে। আগে শুনি রকিব কী বলতে চায়।’

‘তুমি রকিবকে ফোন করে জেেেন নাও না, কেন সে গতকাল ফোন করেছিল।’

‘কখনো আমি তাকে ফোন করব না। তার গরজ থাকলে সেই করবে।’

একটু পরে বেটিনা বলল, ‘আমি গ্রোশারি করতে যাচ্ছি। তুমি যাবে আমার সঙ্গে?’

সাকিনার মনে পড়ল—তারও কাঁচা-বাজার করতে হবে। সাধারণত রোববারে সকালেই সে খাবার-দাবার যা লাগে, কেনাকাটা করে। আজ কিন্তু বেরোতে মন চাইল না। যদি রকিব আবার ফোন ক’রে না পায়? সে বলল, ‘আমার এখন বেরোতে ইচ্ছে করছে না। তুমি কি প্লিজ আমার দু-একটা জিনিস কিনে এনে দেবে?’

বেটিনা হেসে বলল, ‘সিওর। লিস্টি করে দাও।’

রকিবের ফোন এল ঘণ্টা-দুয়েক পরে। সাকিনা ‘হ্যালো’ বলার পর তার প্রথম কথাই হল, ‘মেয়েটা কে? কবে থেকে তোমার সঙ্গে?’

‘তা দিয়ে তোমার দরকার কী? আমার পক্ষে এতবড় বাসার একা ভাড়া টানা কষ্টকর, তাই শেয়ারে থাকার ব্যবস্থা করেছি।’

রকিব খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘ভাবছিলাম একবার মিশিগান যাব। তা বাড়িতে তো লোক বসিয়ে সে রাস্তা বন্ধ করে রেখেছ।’

সাকিনা ভেবেই রেখেছে রকিবকে সে আজ একচোট দেখাবে। সে তীব্রস্বরে বলল, ‘কেন, মিশিগানে মোটেলের অভাব নাকি? তা ছাড়া তুমি কী করে ভাবতে পারলে তোমাকে আবার এ বাড়িতে ঢুকতে দেব?’

‘কেন দেবে না। আমি তো এখনো আইনত তোমার স্বামী।’

‘আইন! কিসের আইন? তুমি যে অন্যের স্ত্রীর সঙ্গে বসবাস করছ—সেটা কোন্ আইনে? মিরান্ডা স্ট্যানলির কাছে ডিভোর্সের নোটিশ পাঠিয়েছে, তুমি কি আমারটা হাতে হাতে দেবার জন্য মিশিগানে আসতে চাচ্ছ?’

এবার রকিবেরও গলা চড়ল, ‘সাকিনা, তোমার খুব বাড় বেড়েছে। স্ট্যানলি তোমাকে এত খবর দেয় কেন? খুব বুঝি মেশামেশি চলছে?

চললে তুমি খুশি হও, না? স্ত্রীর ওপর চরিত্র-দোষ আনার সুবিধে হয়। স্ট্যানলির ওপর রাগ করা কি তোমার সাজে? তুমি তার বউ ভাগিয়ে নিয়ে গেছ, তারই তো তোমাকে খুন করতে চাওয়ার কথা!’

রকিব আরো রেগে বলল, ‘দেখ, ভুলভ্রান্তি মানুষেরই হয়, আমি ফিরে আসার কথা ভাবছিলাম। কিন্তু তোমার এইরকম রণচণ্ডী মনোভাব দেখে বুঝতে পারছি— তোমার ইচ্ছে নেই মিটমাটের।’

রাগে-দুঃখে সাকিনার মাথায় রক্ত চড়ে গেল। মিটমাট করার কী সুন্দর প্রয়াস, কী মোলায়েম ভাষা-ভঙ্গি! সে চিৎকার করে বলল, ‘তোমার লজ্জা করে না উলটো দোষারোপ করতে? ডাণ্ডা বাড়ি মেরে মিটমাটের কথা? আসলে এসব তোমার ছল। তুমি সোজামুখে ডিভোর্সের কথা তুলতে ভয় পাচ্ছ, তাই উলটোপালটা কথা বলে আমার ওপর দোষ চাপিয়ে বাবা-মা-চাচার কাছে ভালোমানুষ সাজতে চাইছ। আমি জানি এক্ষুনি তুমি চাচাকে ফোন করে সাতকাহন লাগাবে। তারপর চাচা আমাকে ফোন করে দোষ দেবেন—আমার একগুঁয়েমির জন্য, আমার বদ-মেজাজের জন্য বিয়েটা টিকল না, সংসারটা ভাঙল। তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি রকিব আহমেদ, যদি বাপের বেটা হও; সোজাসুজি নিজের দোষ স্বীকার করে নিজেই ডিভোর্সটা দাও। অন্তত মিরান্ডার মতো সৎ হও, ভান আর প্রতারণা ছাড়। তুমি তো মিরান্ডারও যোগ্য নও। তার ভেতর অন্তত ভান আর মিথ্যাচার নেই। সে-যে তোমার মতো এমন একটা কুলাঙ্গারকে এখনো ভালোবেসে বিয়ে করতে চাইছে, এইটাই তো আমার কাছে আশ্চর্য ঠেকছে!’ আর পারল না সার্কিনা। ঠকাস করে ফোন রেখে দিয়ে হু হু করে কেঁদে ফেলল।

কেঁদেই চলল অনেকক্ষণ ধরে। তারপর চোখ মুছে ভাবল, ‘এত কাঁদুনি মেয়ে হয়েছি কেন আমি? কাঁদবার কী আছে? এইতো কেমন উচিত কথাগুলো গুছিয়ে বলে দিয়েছি শয়তানটাকে। আমার তো নিজেকে বাহাদুরি দেওয়া উচিত। খুশি হওয়া উচিত এতটা পেরেছি বলে!’

কিন্তু কই? খুশি তো লাগছে না। বুকের ভেতরটা ভেঙে চুরচুর হয়ে যাচ্ছে। এত কষ্ট আছে পৃথিবীতে? এত কষ্ট করে বেঁচে থাকতে পারে মরণশীল মানুষ?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *