৬
চিকিৎসা-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দিকে এত অগ্রসর এই দেশে এ-রকম শিশুমৃত্যুর কথা ভাবাই যায় না। ওকল্যান্ড কাউন্টি মেডিক্যাল এগজামিনারের অফিস থেকে বলা হয়েছে— এ-রকম কারণ-হীন শিশুমৃত্যুকে এসআইডিএস বা সিডস্ অর্থাৎ সাডেন ইনফ্যান্ট ডেথ সিনড্রোম বলা হয়। বাচ্চার কোনো অসুখ-বিসুখ নেই, বাপ-মাও রাগের মাথায় বাচ্চাকে মারধোর করেনি, ভালো বাচ্চা দুধ খাইয়ে ক্রিবে শুইয়ে দিল, পরে দেখা গেল বাচ্চা মরে রয়েছে। ওকল্যান্ড কাউন্টি মেডিক্যাল এগজামিনার অফিসের এক ডাক্তার বলেছিলেন : এ-ধরনের কেইসের কথা গত বিশবছর থেকে জানা যাচ্ছে এবং রেকর্ড করা হচ্ছে। প্রথমে ডাক্তার এবং পুলিশ ভাবত বুঝিবা চাইল্ড-অ্যাবিউজ-এর ফলে মারা গেছে। কিন্তু পোস্ট-মর্টেম করেও সে ধরনের কোনো আলামত মেলেনি। পরে এ-ধরনের অনেক কেইস-এর কথা শোনা যেতে লাগল।
সাকিনা জিজ্ঞেস করেছিল, ‘চাইল্ড-অ্যাবিউজ কী জিনিস?’
রকিব বুঝিয়েছিল, এদেশে শিশুরা শুধুমাত্র বাবা-মার হাতে মানুষ হয়। শিশুর অসুখ-বিসুখের সময় সে কাঁদে, জেদ ধরে বাবা-মাকে রাত জাগায়। কয়েকদিন পরিশ্রম ও রাত জাগার পর অনেক সময় ধৈর্য হারিয়ে বাবা কিংবা মা কেউ বাচ্চাকে আঘাত করে বসে। অনেক সময় আঘাতে বাচ্চা মরেও যায়! তাছাড়া অনেক বাবা-মা হয়তো বেশি মদ খায় বা ড্রাগ খায়, তারাও অনেক সময়
সাকিনা শিউরে উঠে বলেছিল, ‘থাক আর শুনতে চাই না।’
তার মন কিছুতেই প্রবোধ মানছিল না। বাবা-মা ভাই-বোন সবাই চেয়েছিল সাকিনার প্রথম বাচ্চা দেশেই হোক। কিন্তু রকিব প্রবল আপত্তি জানিয়ে লিখেছিল, তাদের বাচ্চা আমেরিকাতেই হবে। কারণ দেখিয়েছিল, দেশের হাসপাতালগুলোতে অব্যবস্থা, অপরিচ্ছন্নতা, ডাক্তারদের হৃদয়হীন উদাসীনতা ইত্যাদি ইত্যাদি। আমেরিকাতে শিশুমৃত্যু নেই বললেই চলে। এখানকার হাসপাতাল অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন, ব্যবস্থা নিখুঁত, ডাক্তাররা নিবেদিতপ্রাণ ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই উন্নত অগ্রসর আমেরিকাতে তার বাচ্চা মারা গেল তার সুন্দর সাজানো নার্সারিতে রেলিংঘেরা বিছানাতে শুয়ে নিঃশব্দে, তাদের অজান্তে। এ দুঃখ সে রাখবে কোথায়? এখন তার মনে হচ্ছে, সেই-বা কেন রকিবের যুক্তি মেনে নিয়ে এদেশে আসতে রাজি হয়েছিল? কেন সে মার কাছে থাকতে চেয়ে রকিবকে বুঝিয়ে লেখেনি? রকিবের সান্নিধ্যে আসার জন্য তার দেহমন এতই আকুল হয়ে উঠেছিল যে ভবিষ্যতের কোনো অসুবিধের কথাই মনে ঠাঁই পায়নি।
এখন বাবা-মা শ্বশুর-শ্বাশুড়ি—ওরাই বা ভাববেন কী? কোনো রোগ-বালাই নয়, কোনো এ্যাকসিডেন্ট নয়, এমনি-এমনিই বিছানায় শুয়ে মরে গেল? নিশ্চয় নাকেমুখে কম্বল চাপা পড়ে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেছে। নিশ্চয় সাকিনা ঠিকমতো বাচ্চার দেখাশোনা করেনি।
রকিবও পড়েছে ফ্যাসাদে। তার নিজের শোকের কথা সে ভুলেই গেছে। তাকে মনোযোগ দিতে হচ্ছে সাকিনার প্রতি। সাকিনা খাচ্ছে না, ঘুমোচ্ছে না, নার্সারিতে রকিংচেয়ারে বসে অনবরত দোল খাচ্ছে আর শূন্য ক্রিবটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার দুইচোখ গর্তে ঢুকে গেছে, চোখের নিচে কালি, চুল আঁচড়ায়নি এ কয়দিন। তার এখনো ধারণা, সুমিত নাকে কম্বল চাপা পড়ে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেছে। ডাক্তাররা-যে পোস্টমর্টেম করে দেখেছেন শ্বাসরোধে মৃত্যু হয়নি, তাও সে বিশ্বাস করেনি। সুমিতকে নিজের কাছে নিয়ে শুলে এ-রকমটি হতে পারত না, রকিব তা করতে দেয়নি, সুমিতের মৃত্যুর জন্য সে যেন প্রকারান্তরে রকিবকেই দায়ী করছে। সাকিনা কখনো মুখ ফুটে একথা বলেনি কিন্তু তার হা-হুতাশ শুনে সেরকমই মনে হচ্ছে। সেটাও রকিবের জন্য কম অস্বস্তির নয়।
রকিব আস্তে করে ওর কাঁধে হাত রেখে মৃদু আদরের স্বরে বলল, ‘চল তো গোসল করে নাও। আমরা বাইরে বেরুব।
সাকিনা ওর দিকে চোখ তুলে তাকাল। রকিব ওর কপালের চুল সরিয়ে বলল, ‘লেকের ধার দিয়ে গাড়িতে ঘুরব। গাছের পাতার রঙ বদলাচ্ছে, দেখবে তোমার ভালো লাগবে।’
আজ কেন জানি, সাকিনা নীরব আপত্তিতে বসে রইল না। উঠে ক্লোজেট থেকে কাপড়-জামা বের করে বাথরুমে ঢুকল। রকিব রান্নাঘরে গেল, এই ফাঁকে তাড়াতাড়ি কয়েকটা স্যান্ডুইচ বানাতে। সাকিনা গোসল করে বেরোলে যদি খাওয়াতে পারে।
লেকের ধার দিয়ে গাড়িতে ঘোরা সাকিনার খুব পছন্দ। পছন্দ চীজ স্যান্ডুইচও রকিব লুচির মতো আকারের হলুদ রঙের চেডার পনির দিয়ে সাকিনার পছন্দের স্যান্ডুইচ বানালো— যদি খায়।
রকিবের আশা পূরণ করে সাকিনা স্যান্ডুইচ খেল। সে একটা যেমন-তেমন নাইলন শাড়ি পরেছে, চুল ভালো করে আঁচড়ায়নি, মুখে দেয়নি কোনো প্রসাধনী। অন্য সময় হলে এ-রকম সাদামাটা বেশে সাকিনাকে নিয়ে বেরোতে রকিব রীতিমতো আপত্তি করত, আজ কিছু বলল না। সে-যে বেরোচ্ছে এই যথেষ্ট।
বেরোবার আগে রকিব সাকিনার একটা শাল বের করে নিল ক্লোজেট থেকে। অক্টোবর মাসে একটু-একটু ঠাণ্ডা, রকিব বেশ কয়েক বছর এদেশে আছে, তার এখনো গরম কাপড় লাগে না। কিন্তু সাকিনা এ-বছরই প্রথম এসেছে গরম দেশ থেকে। তার ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে। শালটা ওর পিঠ ও দুই কাঁধের ওপর দিয়ে ছড়িয়ে একহাতে ওকে আলতো করে ধরে বলল, ‘চল।’
মিশিগান অসংখ্য লোকের জায়গা। কোনো-কোনো এলাকায় কয়েকটা লেক যেন জড়াজড়ি করে গায়ে গা ঠেকিয়ে শুয়ে আছে। বিশেষ করে ব্লুমফিল্ড হিলস, ওয়েস্ট ব্লুমফিল্ড, পন্টিয়াক, এসব এলাকায়। রচেস্টারের কাছাকাছি তেমন লেক নেই, রকিব সোজা গাড়ি চালিয়ে ওয়েস্ট ব্লুমফিল্ড-এ চলে গেল। ওখানে পাইন লেকটা সার্পেন্টাইন—সাপের মতো এঁকেবেঁকে গেছে। লেকের পাড়ের রাস্তা দিয়ে রকিব খুব ধীরেধীরে গাড়ি চালাতে লাগল। বাঁয়ে লেক, ডাইনে সার-সার প্রাইভেট বাড়ি। সামনে অনেকখানি লন নিয়ে বিরাট বাড়িগুলো। লনে এবং রাস্তার পাশে বিরাট বিরাট গাছ। রাস্তাগুলো বেশি চওড়া নয়, অনেকটা প্রাইভেট রোডের মতো, গাড়িটার ভিড় খুব বেশি নয়। তাই আস্তে চালালেও কোনো অসুবিধে নেই।
ডানদিকে তাকিয়ে রকিব বলল, ‘বাড়িগুলো দেখ। কী সুন্দর! ওইরকম একটা বাড়ি জীবনে কোনোদিন আমি কিনবই।’
সাকিনা সায় দিয়ে বলল, ‘সত্যি, খুবই সুন্দর বাড়িগুলো। কোনো-কোনোটায় আবার চওড়া বারান্দা। ওই বারান্দায় বসেই তো সারাদিন লেকের দিকে চেয়ে কাটিয়ে দেয়া যায়।
‘যা অসম্ভব দাম না বাড়িগুলোর! শুনলেও ব্লাডপ্রেশার বেড়ে যায়। এখানে খুব বড়লোকেরা বাস করে। কিন্তু আমি তো ডাক্তার— আমিও একদিন খুব বড়লোক হব, আর এখানকার একটা বাড়ি কিনব।’
সাকিনা টিপ্পনী কাটল, ‘খালি বড়লোক হবার স্বপ্ন।’
রকিব প্রতিবাদে গলা চড়িয়ে বলে উঠল, ‘কেন কেন দোষ কী তাতে? যতই বল না, যাই বল না কেন, টাকা না থাকলে জীবনে কোনো সুখ নেই, সার্থকতা নেই।’
আগে হলে এই নিয়ে সাকিনা তুমুল তর্কে মেতে উঠত, আজ কোনো কথা বলতেও ইচ্ছে হল না। বরং প্রসঙ্গ এড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘এদিকে অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া পাওয়া যায় না?’
‘যায়, তবে খুব কম। আর ভাড়াও তার আকাশ-ছোঁয়া।’
পাইন লেক এঁকেবেঁকে খানিক সামনে গিয়ে যেখানে হঠাৎ বাঁয়ে ঘুরে গেছে, সেখানে ডানদিকে আবার শুরু হয়েছে অর্চার্ড লেক। পাইন লেকের শরীর নদীর মতো, অর্চার্ড লেককে মনে হয় বিশাল একটা পুকুর। রাস্তাটা বাঁয়ে বেঁকে পাইন লেকের পাশাপাশি চলে গেছে, আবার এখান থেকেই আরেকটা রাস্তা বেরিয়ে ডানদিকের অর্চার্ড লেকের গা ঘেঁষে এগিয়ে গেছে। এই তে-মাথার মোড়ে একটা ছোট্ট ঘর——
অৰ্চার্ড লেকে বেড়াবার জন্য বোট ভাড়া নেবার অফিস। এখানে গাড়ির গতি আরো কমিয়ে রকিব জিজ্ঞেস করল, ‘ডাইনে না বাঁয়ে?’
‘বাঁ দিকেই চল। তারপর ঘুরে অর্চার্ড লেকের ওপাশ দিয়ে আবার এদিকে আসা যাবে তো?’
গাড়ির গতি বাঁ দিকে প্রবাহিত করে রকিব বলল, ‘তা যাবে।’ রাস্তাটা অর্চার্ড লেককে বেড় দিয়েছে তো। যদি চাও, ফিরে এসে এখান থেকে বোট ভাড়া করে লেকে খানিকক্ষণ ঘুরতেও পারি।’
আগে ওরা মাঝেমাঝে বোট ভাড়া করে লেকে ঘুরেছে। কিন্তু এখন সাকিনা প্রস্তাবটায় কান দিল না, এখন তার মাথায় অন্য কথা ঘুরছে। তার মনোযোগ আকর্ষণের জন্য রকিব আবার বলল, ‘রাস্তার পাশের গাছগুলো লক্ষ কর— কী রঙের বাহার। লাল, হলুদ, কমলা, বাদামি। এখানে ফল সীজনের যা বাহার না।’
সাকিনা আনমনে জিজ্ঞেস করল, ‘ফল সীজন কেন বলে? পাতার রঙ বদলায় কেন?’
শীতে এইসব গাছের পাতা ঝরে যায়, ঝরে মাটিতে পড়ে তো, তাই বোধহয় ফল বলে। আর ঝরার আগে কেন যে এ-রকম বাহারের রঙ হয়, তা বলতে পারব না।’
‘বিলেতে বলে অটাম। আচ্ছা শোনো, একটা কথা মাথায় ঘুরছে। বলেই ফেলি। এদিকে একটা অ্যাপার্টমেন্ট নিলে হয় না? রচেস্টারের ওই কবরের মতো বাসায় থাকতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। কেন যে বেইসমেন্ট অ্যাপার্টেমেন্ট নিয়েছিলে!’
সাকিনা এর আগেও দু-বার জিজ্ঞেস করেছে। রকিবের জবাবও ছিল— অর্থনৈতিক কারণে। বেইসমেন্ট ফ্ল্যাটগুলো অপেক্ষাকৃত কম ভাড়ায় পাওয়া যায়। সে এখনো রেসিডেন্সি করছে, পুরো ডাক্তার হতে এখনো একবছর দেরি আছে। বছরে বেতন পায় ছাব্বিশ হাজার মাত্র। কিন্তু আজ সে তৈরী-জবাবটা দিতে পারল না। সাকিনার যা মনের অবস্থা। মিনমিন করে বলল, ‘একটু আগে বললামই তো লেকের ধারের ফ্ল্যাটের ভাড়া বড্ড বেশি—’
সাকিনা হঠাৎ স্বরে তীব্রতা এনে বলল, ‘লেকের পাড়ে না হোক, লেকের পাড়াতে তো কম ভাড়ায় থাকতে পারে! আসলে তুমি খোঁজোনি।’
রকিব স্বীকার করল সে খোঁজেনি বটে। তবে সাকিনাও তো তেমন করে বলেনি।
‘বেশ তো আজ বললাম। রচেস্টার আমার একদম ভালো লাগে না। এমন জায়গায় একটা বাসা নাও, যেখান থেকে হেঁটে আমি লেকের ধারে বেড়াতে যেতে পারব।’
‘তা নাহয় নেব। কাল থেকেই খুঁজব। তবে হাঁটবে কেন? দেখ না, তোমাকে শিগগিরই গাড়ি চালানো শেখানোর ব্যবস্থা করছি।’
‘সত্যি?’ একসপ্তাহ পরে এই প্রথম সাকিনার চোখে খুশি ঝিলিক দিল, ঠোঁটে ফুটে উঠল হাসি।
‘সত্যি, একটা ড্রাইভিং-স্কুলে তোমাকে ভর্তি করিয়ে দেব। দেখবে, খুব তাড়াতাড়ি শিখে যাবে। তারপর তোমাকে একটা গাড়ি কিনে দেব।’
‘গাড়ি? আমাকে? অত টাকা পাবে কোথায়?
‘এখানে সেকেন্ডহ্যান্ড গাড়ি বেশ সস্তায় পাওয়া যায়। একটু খোঁজাখুঁজি করলে বাজেটের মধ্যেই ভালো গাড়ি পাওয়া যাবে। তখন তোমার আর একা লাগবে না। নিজেই যখন খুশি, যেখানে খুশি যেতে পারবে।’