নিঃসঙ্গ পাইন – ১১

১১

মিশিগানে আবহাওয়ার মতিগতির হদিস পাওয়া মুশকিল। গত কদিন গেল মেঘ আর বৃষ্টি। এদেশে সামারে বৃষ্টি অনাসৃষ্টি ব্যাপার। তবু তাও ঘটল। আজ আবার চারদিক ভাসিয়ে রোদ উঠেছে।

সাকিনা সামনের দরজা খুলে একচিলতে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। তার মনটা খুব ভার। রকিবের সঙ্গে সম্পর্ক কদিন থেক ভালো যাচ্ছে না। তুচ্ছ কারণে কথা কাটাকাটি, রাগারাগি। তার জের হিসেবেই কিনা কে জানে—পরপর তিনদিন তিনরাত অকল্ ডিউটি করছে হাসপাতালে।

দুপাশের দু-তিনটি বাড়ির কয়েকজন তরুণী গৃহিণী তাদের লনের সবুজ ঘাসের নাইলনের ফিতেয়-বোনা লম্বা লাউঞ্জ-চেয়ার পেতে তাতে টানটান হয়ে শুয়ে সান-বেদিং করছে। ফ্যাকাশে সাদা গায়ের চামড়া রৌদ্রে মেলে রেখে সেটাকে বাদামি ট্যান করার হুজুগ এদেশের মেয়েদের মধ্যে প্রচণ্ড। একনজর তাকিয়ে সাকিনা চোখ ফিরিয়ে নিল। এ দৃশ্য এদেশে সামারে যত্রতত্র। তবু এখনো দেখলে সাকিনার লজ্জা লাগে। এরা যে বিকিনিটা পরে রৌদ্রস্নান করে, এ-রকম স্টাইলের বিকিনি সে আগে কোনো ইংরেজি ম্যাগাজিন বা সিনেমায় দেখেনি। বুকে দু-টুকরো ছোট্ট তিনকোণা কাপড় ফিতে দিয়ে আটকানো। নাভিরও অনেক নিচে ঊরুসন্ধির ওপর একটুকরো তিনকোণা কাপড় সরু ফিতে দিয়ে আটকানো। ফ্রিডাকে জিজ্ঞেস করেছিল বিকিনির এই দুর্ভিক্ষ-পীড়িত দৈন্যদশা কবে থেকে হয়েছে। ফ্রিডা হেসে বলেছিল, বছর পাঁচেক থেকে। সাকিনা বলেছিল—কমতে কমতে একদিন নেই হয়ে যাবে না তো?

ফ্রিডার কথা মনে হতেই ভাবল—যাই, খালাম্মার খোঁজ নিয়ে আসি

ফ্রিডার শাশুড়ি জাহানারা ইমাম এসেছেন বেশ কয়েকমাস হল। মহিলার মুখের ভেতর ক্যানসার হয়েছে। প্রথম কয়েক মাস কিমোথেরাপী দেওয়া হয়েছে। তিন-চারদিন আগে হাসপাতালে গেছেন অপারেশানের জন্য।

উনি আসার পর সাকিনার নিঃসঙ্গতা অনেকখানি ঘুচে গেছে। সোম থেকে শুক্রবার—এ-বাড়িতে সাকিনা একা, ও-বাড়িতে উনি একা। কারণ সাইফ, ফ্রিডা দুজনেই চাকরি করে। ফলে দুই অসম-বয়সী মহিলার মধ্যে একটি চমৎকার সখ্য গড়ে উঠেছে। জাহানারা ইমামের সঙ্গে তাঁর পুত্রবধূরও খুব সখ্য। তার জন্য সাকিনা ফ্রিডারও মনের খুব কাছাকাছি চলে গেছে।

ফ্রিডা পেছনের বাগানে কাজ করছিল। বাগান মানে ছয়ফুট বাই দশফুট একটুকরো জমি। প্রত্যেক বাসার পেছনেই এই একই সাইজের বাগান। সামনের ঘাসে-ঢাকা লনে কোনো গাছ লাগানোর নিয়ম নেই। ফুলগাছ যা লাগানোর— এই পেছনের বাগানেই লাগানো চলে। কমবেশি সবাই এই বাগানটুকুতে নানারকম মৌসুমী ফুলের গাছ লাগায়। শীতের বরফ গলে গেলে দেখা যায়, সব বাড়ির গৃহিণীই খুরপি-নিড়ানি হাতে তৎপর হয়ে উঠেছেন। দেখাদেখি সাকিনাও দোকান থেকে কিছু গাছ এনে তার বাগানে লাগিয়েছে। এখানে বাগান করার খুব সুবিধে। দোকানে একেবারে ফুটন্ত ফুলসহ ছোট ছোট গাছ পাওয়া যায় টবে, সেগুলো কিনে এনে লাগিয়ে দিলেই হল। মাঝেমাঝে একটু মাটি খোঁড়াখুড়ি, পাইপে করে পানি দেয়া—ব্যস, বাগান আলো করে ফুল ফুটে থাকে।

বাগানের ছয়ফুট বাই দশফুটের মধ্যে পেছনের দরজার সিঁড়ির কাছে চারফুট বাই চারফুট জায়গাটা আবার পাকা—সেখানে চারটে ছোট সাইজের প্লাস্টিকের লন-চেয়ার পাতা। সাকিনা এসে একটা চেয়ারে বসে পড়ল। ফ্রিডা চোখ তুলে দেখে ‘হাই’ বলে সম্ভাষণ করে খুরপি চালাতেই থাকল। সাকিনা বলল, ‘তোমার শাশুড়ি কেমন আছেন?’

‘ক্রমেই ভালোর দিকে। গতকাল প্লাস্টিকের সিরিঞ্জে করে ফলের রস মুখের ভিতর নিয়ে গিলতে পেরেছেন।’

ফ্রিডার পাশের বাসার রোজ-ও দরজা খুলে বেরিয়ে এসে ফ্রিডাকে তার শাশুড়ির খবর জিজ্ঞেস করলেন। রোজের বয়স পঞ্চান্ন-ষাট হবে, বেশ লম্বা-চওড়া শরীর, এই বয়সেও খুব সুন্দরী। আর ভারি হাসিখুশি, খুব কথা বলেন। পাড়ার সব্বার ভালোমন্দের খোঁজখবর করেন। সাকিনাকে দেখে একগাল হেসে বললেন, ‘এই-যে মেয়ে, কেমন আছ? তোমার স্বামীর রেসিডেন্সি শেষ হল? বোর্ড পরীক্ষা কবে?’

‘সেপ্টেম্বরে। ও ভীষণ ভয় পাচ্ছে এ পরীক্ষা নিয়ে।’

‘হ্যাঁ পরীক্ষাটা খুব কঠিন। এটায় পাশ করলে তবেই তো ডাক্তারি প্র্যাকটিস করার লাইসেন্স পাবে।’

একটু পরে রোজ ভেতরে চলে গেলেন। সাকিনা খানিক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, রকিব ভাবছে ও ক্যালিফোর্নিয়া স্টেটের লাইসেন্সের জন্য পরীক্ষা দেবে। ও লাইসেন্স পেলে আমরা ক্যালিফার্নিয়া চলে যাব।

ফ্রিডা হাতের খুরপি ফেলে সোজা দাঁড়িয়ে গেল, ‘সে কি? মিশিগানের কী দোষ পেল? এখানে ভালো লাগছে না?’

সাকিনা কুণ্ঠিতস্বরে বলল, ‘না, না, মিশিগানের কোনো দোষ নয়। এখানকার শীতকালটা কেন জানি আমার সহ্য হচ্ছে না। ক্যালিফোর্নিয়ায় বরফ পড়ে না—’।

‘কটা শীত তুমি মিশিগানে কাটালে? মাত্র একটাই তো। দু-একটা শীতের পরই দেখবে সব ঠিক হয় গেছে। ক্যালিফোর্নিয়ায় বরফ পড়ে না সত্যি, তবে সেখানে মিশিগানের মতো এমন চারটে চাররকম স্পষ্ট ঋতুও নেই। সারাবছর একঘেয়ে আবহাওয়া ওখানে। আর জীবনযাত্রার খরচ খুব বেশি। দু-একটা বছর কাটলে দেখবে মিশিগানের মতো সুন্দর স্টেট খুব কমই আছ। শীত বরফেরও একটা সৌন্দর্য আছে। তা ছাড়া স্প্রিং, সামার, ফল—তিনটে ঋতুরই আলাদা আলাদা চেহারা। কত বৈচিত্র্য এখানে!’

সাকিনা চুপ করে শুনল। সত্যি কি তার শীতকালে কষ্টের কথা ভেবে রকিব ক্যালিফোর্নিয়া যাবার কথা ভাবছে? কই, সে তো একবারও বলেনি এখানকার শীতে সে থাকতে পারবে না। শীতে যখন কষ্ট হয়েছিল, তখন তো রকিব একবারও বলেনি, বরফ নেই এমন স্টেটে যাবার চেষ্টা করবে? এখন সে যখন সামারে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে, গাড়ি চালানো শিখেছে, সেকেন্ডহ্যান্ড গাড়ি খোঁজা হচ্ছে, তার কোনো একটা চাকরি নেবার বিষয় ভাবা হচ্ছে— তখনই রকিব বলা শুরু করেছে ক্যালিফোর্নিয়ায় গিয়ে বোর্ড পরীক্ষা দেবার কথা। সাকিনার এই বরফ সহ্য হয় না—এ-কথা সাকিনা বলেনি, রকিবই বলতে শুরু করেছে।

‘কী ভাবছ?’ ফ্রিডার প্রশ্নে সাকিনা সম্বিত পেয়ে লাজুক হাসি হাসল, ‘না, তোমার কথার যুক্তিই ভাবছিলাম।’

‘ঠিক বলেছি কি না? এই স্টেটে ফল সীজনের যেমন বাহার, ক্যালিফোর্নিয়ায় তা পাবে না।’

‘ফ্রিডা তুমি মিশিগান খুব ভালোবাস, তাই না?’

‘নিশ্চয়। এখানেই আমার জন্ম, এখানকার স্কুলে পড়েছি, এখানে বেড়ে উঠেছি, বাবা মা ভাই বোন এখানে আছ—’

‘তাই। আমার তো জন্ম, বেড়ে ওঠা, লেখাপড়া, বাবা মা ভাই বোন সব অন্য দেশে। আমার কাছে মিশিগানই বা কী, ক্যালিফোর্নিয়াই বা কী?’

ফ্রিড়া হঠাৎ যেন হোঁচট খেল মনের মধ্যে। তা বটে। তারপর সাকিনার দিক স্থিরদৃষ্টিতে খানিক তাকিয়ে থেকে কোমল স্বরে বলল, ‘সাকিনা, মন যেন ভালো নেই মনে হচ্ছে?’

হঠাৎ সাকিনার দুইচোখ উপচে পানি চলে এল। ফ্রিডা এগিয়ে এসে সাকিনার হাত ধরে ‘এস ঘরে এস’ বলে ওকে উঠিয়ে দরজা খুলে বাসার ভেতরে ঢুকল। সাকিনা জিজ্ঞেস করল, ‘জামী ভাই কোথায়?’

‘ও গেছে হাসপাতালে, ওর মার কাছে। বিকেলের আগে ফিরবে না।’

সাকিনা খানিকক্ষণ থম ধরে বসে রইল, তারপর হঠাৎ দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল। ফ্রিডা খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে তাকে কাঁদতে দিল। সাকিনা একটু সুস্থির হলে খুব নম্র গলায় বলল, ‘যদি ইচ্ছে কর, আমাকে সব বলে একটু হালকা হতে পার।’

সাকিনা চোখ মুছে বলল, ‘কী বলব, বুঝতে পারছি না। বলার মতো কিছুতো নেই। অথচ আমার খুব খারাপ লাগে। খুব একা লাগে, অসহায় লাগে। মনে হচ্ছে রকিব খুব বদলে যাচ্ছে। যদি জিজ্ঞেস কর, কিসে বুঝলে, তাহলে বলতে পারব না। ওকে আজকাল খুব অচেনা লাগে। মনে হয়, যে-লোকটার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল, এ সে লোক নয়। মাঝেমাঝে কী যে হয় ওর, দু-তিনদিন আমার সঙ্গে কথা কয় না, আমাকে ছোঁয় না। তারপর আবার খুব আদর করে—এত বেশিবেশি করে যে আমার ভয় ধরে যায়। মাঝেমাঝে খুব খারাপ ব্যবহার করে, আমার-আত্মীয় স্বজন নিয়ে খারাপ কথা বলে। আমি বুঝি না, বুঝি না ওকে।’ বলতে বলতে আবার কান্নায় ভেঙে পড়ল সাকিনা। ফ্রিডা নীরবে ওর হাত ধরে বসে রইল। খানিকক্ষণ পরে সাকিনা নিজেকে সামলে চোখ মুছে বলল, ‘তোমাকে বোধহয় বিরক্ত করলাম

‘না, না, মোটেই না, আমিই তো তোমাকে বলতে বললাম।’

‘তোমাকে কেন জানি আমার খুব আপন মনে হয়। মায়ের পেটের বোনের মতো মনে হয়।’

‘তাই ভেবো আমাকে। যখনি মন খারাপ করবে, আমাকে বলবে। যখনি কোনো দরকার হবে, আমাকে ডাকবে। একটুও সংকোচ করবে না। ঠিক তো?’

‘ঠিক।

‘এস, একটু আইসক্রিম খাও। স্ট্রবেরি আছে, খাবে?’

‘খাব।

খেতে খেতে সাকিনা বলল, ‘আরো একটা ব্যাপারে আমার খুব খটকা লাগে। এখানে বাঙালি কম নেই, ঈদের সময় মসজিদে গেলে দেখি। তাদের কারো কারো সঙ্গে ওর আগে থেকে পরিচয়ও আছে। অথচ কোনো সময় তাদের বাড়িতে আমাকে নিয়ে বেড়াতে যাবে না বা তাদেরকে কখনো আমাদের বাসায় আসতে বলবে না। তোমরা না থাকলে আমি বোধহয় দমবন্ধ হয়ে মারা যেতাম।’

ফ্রিডা শুধু বলল, ‘রকিবের সঙ্গে আগে আমাদের পরিচয় হয়নি। তাই বুঝতে পারছি না কেন এ-রকম করছে ও। বোধহয় বোর্ড পরীক্ষার দুশ্চিন্তায়। তুমি জানো না, কীরকম কঠিন এই পরীক্ষা। আমার ভাই তো ডাক্তারি পাশ করে রেসিডেন্সি পেতেই হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে। রকিব তবুতো তিনবছরের রেসিডেন্সি ভালোভাবে শেষ করেছে। অত ভেবো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

‘আসলে এ জায়গাটার প্রতি আমার একটা মায়া পড়ে গেছে। রকিব ক্যালিফোর্নিয়া যেতে চাওয়াতে আমিও বোধহয় অচেনা জায়গা বলে ভয় খেয়ে গেছি। তাই বোধহয় এমন পাগলের মতো করলাম।’

ফ্রিডা শুধু হাসল। সাকিনাও তার দিকে চেয়ে হাসল। এতক্ষণে তার মন হালকা হয়ে গেছে। আর ভয় লাগছে না, অসহায়ও লাগছে না। এইতো তার এক বোন রয়েছে, বিপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। খালাম্মা আছেন, যদিও তিনি অসুস্থ, তবু তাকে মায়ের মতো মনে হয়।

সাকিনা মনে মনে স্থির করে ফেলল, সে রকিবকে কিছুতেই ক্যালিফোর্নিয়ায় যেতে দেবে না। এখানেই বোর্ড পরীক্ষা দিতে বলবে। এখানেই থাকতে চায় সাকিনা।

ফ্রিডাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি খালাম্মাকে আজ দেখতে যাবে না?

‘যাব, সাইফ ফিরে এলে আমি যাব।’

‘আমাকে নেবে তোমার সঙ্গে?’

‘নিশ্চয়। যাবার আগে তোমাকে ডেকে নেব।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *