১৯
আবার আরেকটা ফল সীজন এসেছে— গাছে গাছে পাতারা উজ্জ্বল লাল, হলুদ, কমলা, বাদামি রঙে নিজেদের রাঙিয়ে বিবর্ণ হয়ে ঝরে যাবার আগে। সেদিকে চেয়ে সাকিনা গুনগুন করে উঠল, ‘রাঙিয়ে দিয়ে যাও, যাও, যাওগো এবার যাবার আগে—’
ফোন বাজল। সাকিনা বারান্দার চেয়ার থেকে উঠে বেডরুমে এল।
ফোন তুলল, ‘হ্যালো।
স্ট্যানলির গলা—’কী করছ শনিবারে সকালে?’
‘কিছু না। বারান্দায় বসে বসে পাতাদের রঙ বদলানো দেখছি।’
‘গলাটা বেশ খুশিখুশি লাগছে! খুব ভালো মুডে আছ মনে হয়?’
‘হ্যাঁ। কাল রাতে মা’র সঙ্গে ফোনে কথা বলেছি। মা, বাবা, ভাই, বোন সবার সঙ্গে। সবার গলা শুনে মন খুব ভালো। জানো সামনের সামারে মাকে টিকেট পাঠাব। মা এসে তিন-চারমাস বেড়িয়ে যাবেন ঠিক হয়েছে।’
‘বাহ্ খুব ভালো খবর তো! সেলিব্রেট করা দরকার।
সাকিনা হেসে ফেলল, ‘ তোমার স্বভাবটা আর বদলাল না। একটা-কিছু হলেই সেলিব্রেট করার কথা। ‘
‘মন্দটা কী দেখলে? তোমার কোনো প্রোগ্রাম আছে আজ?’
‘আছে, রাত্রে। ফ্রিডাদের বাসায়। জামী ভাই তার স্কুলজীবনের এক বন্ধুর দেখা পেয়েছে হঠাৎ এই মিশিগানে। তাকে খেতে বলেছে। বাঙালির সঙ্গে দেখা হবে, বাংলায় কথা বলব—এই খুশিতেও মুড খুব ভালো।’
‘তুমি তো ভালোই ইংরেজি বল। সত্যি বলতে কী, অনেক আমেরিকানদের চেয়েও তুমি ভালো করে বোঝাতে পার। তা সত্ত্বেও বাংলায় কথা বলার জন্য এত আকুলতা?’
‘ও তুমি বুঝবে না।’
‘তা ছেলেটা কি ম্যারেড? না, ব্যাচিলর?
‘ব্যাচিলর।’
‘ব্যাচিলর! বাহ্; এ তো আরো ভালো খবর।
‘কী আবোলতাবোল বলছ? তোমাদের কি কানু ছাড়া গীত নেই? মানুষের সঙ্গে মানুষ সহজভাবে মিশবে, ভাবের আদান প্রদান করবে, বন্ধুত্ব হবে –
‘ভাবের আদান-প্রদান করতে করতে, বন্ধুত্ব হতে-হতেই প্রেম আসে। আমরা আমেরিকানরা সব ব্যাপারে রিসার্চ করি তো, এ ব্যাপারেও রিসার্চ করে-করে আমরা এই সিদ্ধান্ত পেয়েছি। ফলাফল সর্বত্রই প্রায় একই হয়।’
‘তা যদি হয় তো, দোষের কী। আপন দেশের ছেলে, একই সংস্কৃতির মানুষ।’
দোষ কিছু নেই। শুধু আমার চান্সটা কমে যায়—এই যা।’
‘ফাজলেমি হচ্ছে! তোমার মুখে আগল নেই।’
‘আমরা আমেরিকানরা সবসময় খোলাখুলি কথা বলতে পছন্দ করি। তা যাকগে, তোমার ব্লাইন্ড ডেট তো রাত্রে। এখন কী করছ?’
‘কিছু না। তুমি ইচ্ছে করলে আসতে পার। আমার সঙ্গে লাঞ্চ করতে পার।’
‘আমি এক্ষুনি আসছি।’
.
স্ট্যানলি এল অনেকক্ষণ পরে। তার হাতে পেটমোটা দুটো গ্রোশারি-ব্যাগ। দরজা খুলে দিয়েই অবাক হয়ে সাকিনা বলল, ‘এত কী কিনে এনেছ? সারা হপ্তার গ্রোশারি করেছ মনে হচ্ছে?’
ব্যাগ দুটো খাবারটেবিলে নামিয়ে স্ট্যানলি বলল, ‘আমি আজ একটা নতুন জিনিস বানিয়ে খাওয়াব তোমায়। তাই কিছু উপকরণ কিনে আনলাম।’
‘তুমি বানাবে খাবার জিনিস? জীবনে রান্না করেছ কখনো? তোমার বাড়িতে তো মেইড, কুক—কত কী?
‘এদেশের সব পুরুষকেই রান্না করতে হয় জীবনে কোনো-না-কোনো সময়ে। মেইড, কুক ওসব তো বাবার আমলের। বাবার স্ট্যাটাস-সিম্বল ছিল ওগুলো। আমার ওসব লাগে না।’
‘লাগে না তো রেখেছ কেন এখনো?’
সাকিনার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকল খানিকক্ষণ স্ট্যানলি, ‘কী জানি কেন রেখেছি।’
হঠাৎ যেন সম্বিত ফিরে পেয়ে ব্যাগ থেকে খাবার জিনিসপত্র বের করতে লাগল স্ট্যানলি। ‘তাছাড়া তুমি ভুলে গেছ, স্যানডিয়েগোতে দু-বছর আমি রান্নার হবি নিয়ে মেতে ছিলাম।’
‘স্যানডিয়েগো!’
সাকিনার বুকের চারপাশ দিয়ে ব্যথা চিনচিন করে উঠল। মুখে কালো ছায়া ফেলল সেই ব্যথা। স্ট্যানলি সেটা লক্ষ করে অনুতপ্ত গলায় বলে উঠল, ‘আয়াম সরি। পুরনো কথা মনে করাতে চাইনি।’
সাকিনা মুখ নিচু করে টেবিল থেকে পেঁয়াজ, টমেটো এগুলো নিয়ে কিচেন-কাউন্টারে রাখতে লাগল। স্ট্যানলি হঠাৎ দুইহাতে সাকিনার দুই কাঁধ ধরে তার দিকে ফিরিয়ে বলল, ‘এখনো ভুলতে পারনি?’
সাকিনার দুইচোখে পানি টলটল করে উঠল, ‘না। শুধু মেনে নিয়েছি। মনে মনে ছেড়ে দিয়েছি। তাকে বলেছি ডিভোর্স পেতে যা-যা দরকার কর। দিয়ে দেব। কিন্তু কষ্টের হাত থেকে অব্যাহতি পাওয়া কি এতই সহজ স্ট্যানলি?’
‘তোমার আমার কষ্টের উৎস তো একই সাকিনা; আমরা কি দুজনে মিলে সেটা ভোলার চেষ্টা করতে পারি না?’
‘তাই তো করছি স্ট্যানলি।’
স্ট্যানলির দুইচোখে আলো জ্বলে উঠল, সে সাকিনাকে আকর্ষণ করল তার দিকে। তার ঠোঁট এগিয়ে নিল সাকিনার ঠোঁটের দিকে।
ঘটনার এই আকস্মিক মোড়ের জন্য প্রস্তুত ছিল না সাকিনা। সে হকচকিয়ে দু-পা পিছিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল স্ট্যানলির বাহুবন্ধন থেকে। এলোমেলো কণ্ঠে বলে উঠল, ‘আমি—আমি ঠিক এ কথা মীন করিনি স্ট্যানলি—’
‘তাতে দোষ কী সাকিনা। আমরা দুজনেই পোড় খাওয়া—দুজনেই নিঃসঙ্গ। একে অন্যের সাহচর্যে দুঃখ ভোলার চেষ্টা—’
‘না স্ট্যানলি, আমাকে একটু সময় দাও। আমার মন এখনো ঠিক হয়নি। আমার শেকড়ে এখনো মাটি বসেনি। আমাকে একটু আত্মস্থ হবার সময় দাও স্ট্যানলি। অন দ্য রিবাউন্ড আমি কিছু করতে চাইনে। এক ভ্রান্তি থেকে মুক্তি পেতে-না-পেতে দ্বিতীয় ভ্রান্তিপাশে আমি কিছুতেই পড়ব না স্ট্যানলি। পণ করেছি।’