নিঃসঙ্গ পাইন – ১৪

১৪

ওরা নাসিরের বাড়িতে পৌছে দেখে ওদের আগেই অনেকে এসে গেছেন। নাসির সবাইকে নিয়ে বাইরের বাগানে ছবি তুলছিলেন। জাহানারাকে দেখে সবাই ‘ঈদ মোবারক বুবু, আসুন, আসুন, বলতে বলতে এগিয়ে এলেন। সকলের সঙ্গে কুশল বিনিময় করার পর জাহানারা সাকিনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন সবার- ‘শামু, নাসির, মাদু—এ হল সাকিনা, আমার এক বোনঝি। আর সাকিনা, এই যে আমার তিন ভাই— ডা. নাসিরুল হক, ওর বউ লীনা, ওদের দুই মেয়ে মোনা আর সোনা। এ ডা. শামসুল হক— ডাকি শামু বলে, এর বউ এই যে জোসেফিন অর্থাৎ জো, এদের ছেলে তাসির। আর ও হল ডা. মোশাররফ আহমদ— ওর ডাক নাম মাদু, যেটা ও পছন্দ করে না। ওর বউ ডায়ানা, আমরা ডাকি ডাই।’ জাহানারার পরিচয় করানোর ভঙ্গিতে সবাই খুব হাসলেন, সাকিনার সঙ্গে কুশল বিনিময়ের সঙ্গে সঙ্গে। নাসির বললেন, ‘বুবু আমরা মুভি তুলছি। আপনিও আসুন। এই জামী, এদিকে আয়। ফ্রিডা কই?’

ফ্রিডা তাদের আর সাকিনার খাবারের বাটি রাখতে গিয়েছিল ভেতরে, তক্ষুনি দরজা খুলে বাইরে এসে চেঁচাল, ‘এই যে মামা, আমি এখানে হাজির।

জাহানারা বললেন, ‘নাসির একটা রিকোয়েস্ট, আমার ছবি তুলো না। বুঝতেই পারছ! রোজার ঈদে তো তুলেছ, তখন অপারেশান হয়নি। এখন অপারেশানের পরে

‘ঠিক আছে বুবু, ঠিক আছে। আই আন্ডারস্ট্যান্ড।

সাকিনার কষ্ট হল জাহানারার দিকে চেয়ে। অপারেশানের পর ওঁর মুখের আদল খানিকটা বদলে গেছে। জিভটা একটু বেরিয়ে থাকে, নিচের একটাও দাঁত নেই, কথা জড়ানো, পাশ থেকে দেখলে একশো বছরের বুড়ির মতো দেখায়। যদিও উনার বয়স এখনো ষাট পেরোয়নি।

ফ্রিডা-জামী সাকিনাকে নিয়ে নাসিরের ক্যামেরার সামনে দাঁড়াল। নাসিরের এক বোন, তাঁর স্বামী ও ছেলে রয়েছেন নাসিরের বাড়িতে। একটু পরে শামুর বোন সাজু, তাঁর স্বামী বকুল ও তিন ছেলেমেয়ে— লিজা, তাজ ও রনি এসে পৌঁছোলেন। তাঁদের গাড়ির বুটি থেকে বেরোল বড় একটা ডেকচি, একটা মুখবন্ধ প্লাস্টিকের গামলা, আরো কী কী যেন।

ছবি-টবি তোলা হতে হতে সাতটা বাজল। এবার সবাই ভেতরে চললেন। খাবার সময় হয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগেই। নাসিরের বউ লীনা বাঙালি মেয়ে, শামুর বউ আমেরিকান। মাদুর বউ ব্রিটিশ। কিন্তু আজ ওদের দুজনের পরনেই শাড়ি। কথায় কথায় জানা গেল, সাজুর মেয়ে লিজা এই দুই মামীকে শাড়ি পরতে সাহায্য করেছে।

টেবিলে সবার আনা সবরকম খাবার সাজানো হয়েছে। নাসিরের বাড়িটা বিরাট। অন্য দুই জায়গায় আরো দুটো খাবার-টেবিল পাতা আছে। যে-যার মতো খবার তুলে ইচ্ছেমতো চেয়ারে বসে বা দাঁড়িয়ে খাচ্ছে, ঘুরে-ঘুরে গল্প করছে। জাহানারা একটা টেবিলের সামনে বসে খাচ্ছেন। সাকিনা প্লেট হাতে তাঁর পাশে বসে বলল, আপনার তিনজন ভাই আছেন এখানে, জানতাম না তো? ওদের চেহারার মধ্যে মিল নেই কিন্তু। একেকজন একেকরকম দেখতে।’

জাহানারা হেসে ফেললেন, ‘শোনো বলি। ওরা আমার মায়ের পেটের ভাই নয়, কিন্তু মায়ের পেটের ভাইয়ের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। ১৯৫২ সালে ওরা ঢাকায় মেডিক্যাল কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ত। তখন থেকে ওরা তিনবন্ধু আমাকে বুবু বলে ডাকা শুরু করে। সেই থেকে এই এত বছরে ওরা আমার আপন ভাইয়ের মতোই হয়ে গেছে। ওরা তিনবন্ধুও কিন্তু আপন ভাইয়ের মতোই ঘনিষ্ঠ। শামু প্রথমে একষট্টি সালে এদেশে আসে। নাসির কয়েকবছর এদেশে চাকরি করে আবার দেশে ফিরে যায়। পরে একাত্তর সাল থেকে শামুই কিন্তু একে-একে ওর দুই বন্ধুকে বলে—বুঝিয়ে স্পনসর করে এদেশে আনিয়েছে। নিজের ছোট বোনকেও তাদের পুরো ফ্যামিলিসহ স্পনসর করে আনিয়েছে। ওরা সবাই এখানে না থাকলে জামীকে আমি কিছুতেই এদেশে পাঠাতাম না।

‘তাই তো দেখছি, জামী ভাই কেমন মামা-মামী খালা-খালু পেয়ে গেছে।’

‘সত্যি তাই, ওরা এখানে একটা নিজস্ব পরিবেশ গড়ে তুলেছে। সবাই নিজের নিজের পেশায় খুবই ব্যস্ত থাকে, কিন্তু উৎসবে-পরবে-বিপদে-আপদে সবাই সবার পাশে এসে দাঁড়ায়। এই পরিবেশটা গড়ে তোলার বাহাদুরি কিন্তু শামুর একার।

খাওয়াদাওয়া শেষ হয়েও হতে চায় না। প্রত্যেক বাড়ি থেকে কিছু রান্না করে আনতে বলার ফলে আইটেম অনেক বেশি হয়ে গেছে। মিষ্টি পদও চার-পাঁচ রকমের। সাকিনার জর্দা খেয়ে সবাই খুব প্রশংসা করলেন।

একটি লম্বা, স্বাস্থ্যবতী সুন্দরী তরুণী উদ্বৃত্ত খাবার গুছিয়ে রাখছিল, সাকিনা ফিসফিস করে বলল, ‘উনার সঙ্গে কিন্তু আলাপ হয়নি।’

‘ও হচ্ছে মলি। নাসিরের ছোট ভাই বাদশার বউ। দাঁড়াও, খেয়ে উঠে পরিচয় করিয়ে দেব।’

জাহানারার খেতে অসম্ভব বেশি সময় লাগে। নিচের কোনো দাঁত নেই, চিবিয়ে খেতে পারেন না। নরম পোলাও, মুরগির রান, মাছ, সব্জি সব আঙুলে পিষে ছোট-ছোট লোকমা বানিয়ে গিলে-গিলে খান। সবার দ্বিতীয় দফা সেমাই, ফিরনি, জর্দা, আঙুর, তরমুজ খাওয়া চলছে, উনি এখনো পোলাও খাচ্ছেন।

সাকিনা আবার চুপিচুপি বলল, ‘বিদেশি বউ দুজন, তখন যে পরিচয় করিয়ে দিলেন——কোটা কে, গুলিয়ে ফেলেছি।’

‘ঐ যে সিংকের সামনে দাঁড়িয়ে বাসনের এঁটো চেঁছে ফেলে ডিশ-ওয়াশারে ঢোকাচ্ছে, ও হল জো—শামুর বউ। আর ঐযে ঐদিকে মলিকে খাবার গোছাতে হেল্প করছে; ও হল ডাই—মাদুর বউ। একটা জিনিস খেয়াল রাখবে— জো’র হল লালচে বাদামি চুল, ছোট করে কাটা। ডাইয়ের কালো চুল, খোঁপা বাঁধা। তাহলেই আর গুলিয়ে ফেলবে না।

নাসির এসে টেবিলের পাশে দাঁড়ালেন, ‘বুবু খাচ্ছেন তো ঠিকমতো?’

‘হ্যাঁ ভাই, খুব পেট ভরে খেয়েছি। বেশ নরম ছিল সব রান্না।’

‘নাসির, মলিকে একটু ডাকো না? সাকিনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।’

মলিকে একটা হাঁক পেড়ে নাসির অন্যদিকে চলে গেলেন। মলি এগিয়ে এসে হাসিমুখে বলল, ‘কেমন আছেন বুবু? খেতে পেরেছেন তো?’

‘হ্যাঁ ভাই, খুব ভালো করে খেতে পেরেছি। তোমার মেয়ে কেমন আছে।’

‘মেয়ে এখন কিছুটা ভালো। এই তো তিন-চার দিন হল হাসপাতাল থেকে ফিরেছে।’

‘মলি, আমার এক বোনঝির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দি। এর নাম সাকিনা, আর সাকিনা— মলির পরিচয় তো আগেই দিয়েছি তোমায়।’

আদাব দিয়ে সাকিনা জিজ্ঞেস করল; ‘আপনার মেয়ের কী হয়েছিল? হাসপাতালে কেন?’

মলি কিছু বলার আগে জাহানারাই বললেন, ‘ওর বাচ্চার জন্মের থেকেই হার্টের একটা অসুবিধে আছে। তোমাকে পরে বলব। মাঝে মাঝে হাসপাতালের যেতে হয়।’

জাহানারা চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন, ‘যাই মুখ ধুয়ে আসি।’

মলি সাকিনাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কতদিন হল এসেছেন?’

সাকিনা ভেতরে ভেতরে একটু সিঁটিয়ে গেল, ‘এই তো বছর দেড়েক। আপনার মেয়ের বয়স কত? কী নাম?’

‘ওর নাম জেনিফার। বয়স চার মাস। দেখবেন ওকে? আসুন আমার সঙ্গে।’ যেতে যেতে মলি খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, — জেনিফার হার্টের একটা ডিফেক্ট নিয়ে জন্মেছে। ওর জন্মের চব্বিশঘণ্টার মধ্যে ওর ওপেন হার্টসার্জারি হয়।’

সাকিনা আঁতকে উঠল, ‘বলেন কী?’

‘হ্যাঁ, দুমাস পরে আবার একটা অপারেশান হয়। চারমাসের মধ্যে বেশির ভাগ সময়ই ও হাসপাতালে থেকেছে। ওর সবচেয়ে অসুবিধে হল—ও বুকের দুধ টেনে খেতে পারে না। দু-চার টান দিয়ে হাঁপিয়ে যায়, ঘুমিয়ে পড়ে। অথচ পেটে খাবার না গেলে তো বাঁচবে না। তাই নাকে নল ঢুকিয়ে ওকে দুধ খাওয়াতে হয়।’

সাকিনারই মনে হল, সে নিশ্বাস টানতে পারছে না। এইরকম মারাত্মক অসুস্থ মেয়ে নিয়ে এই মা এমন স্বাভাবিক! হাসিখুশি, প্রশান্ত!

টিভিরুমের মেঝের পুরু গালিচার ওপর জেনিফারকে শুইয়ে নাসিরের দুই মেয়ে ওর দু-পাশে বসে ছিল। বসে ছিল আরো দুটি ছেলেমেয়ে— মলি আলাপ করিয়ে দিল, সাজুর মেয়ে লিজা ও ছেলে তাজ। সাকিনাও হাঁটু মুড়ে একপাশে বসল। কী ছোট রোগা, বিষণ্ন জেনিফার। খুব আস্তে টুকটুক করে হাত-পা নাড়ছে। বুকটা হাপরের মতো ওঠানামা করছে। চোখ দুটো অসম্ভব সুন্দর। সুন্দর আর বিষণ্ন। সাকিনার মনে হল চোখ দুটো যেন বলছে : ওগো, আমার যে কী কষ্ট ভেতরে, তোমরা কেউ বুঝবে না। হঠাৎ তার নিজের চোখ দুটো ভিজে উঠল। সে মনে-মনে একটু সন্ত্রস্ত হয়ে প্রাণপণ চেষ্টায় নিজেকে সামলাল। এইসব সদ্য-পরিচিত লোকের মধ্যে চোখের পানি গড়িয়ে পড়লে কেলেঙ্কারি হবে।

জাহানারা ঘরে ঢুকে বললেন, ‘এই-যে তুমি এখানে? চল, এবার যেতে হয়।’

সাকিনা উঠে দাঁড়াল। মলি লক্ষ করেছিল সাকিনার ভাবান্তর। সেও উঠে দাঁড়িয়ে সাকিনার হাত ধরে বলল, ‘সুযোগ পেলে আসবেন আমাদের বাড়িতে।’

সাকিনা গাঢ়স্বরে বলল, ‘আসব। খালাম্মাকে বলব নিয়ে যেতে।’

‘বুবুকে একদিন বাসায় খেতে ডাকব, ভেবেছি। সেদিন আপনিও আসবেন কিন্তু। এক পাড়াতেই তো থাকেন। বুবুদের সঙ্গেই আসবেন।’

জাহানারা শুনতে পেয়ে বলে উঠলেন, ‘বাচ্চা নিয়ে চব্বিশঘণ্টায় একমুহূর্ত স্বস্তি নেই; এর মধ্যে আবার খাওয়ানোর কথা কেন?’

‘না বুবু’ এ ঝঞ্ঝাট তো থাকবেই, তাই বলে জীবন তো থেমে থাকছে না। সবই চলছে। মাঝে মাঝে এ-বাড়ি ও-বাড়ি না করলে ভালোও তো লাগে না।’

‘তা সত্যি বটে। তোমার সাহসের আর ধৈর্যের আমি প্রশংসা করি মলি।’

লীনা এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন ওদের পাশে। মলির বড় জা। তিনি বললেন, ‘আজকের পার্টির অতগুলো আলুকপি ভাজি স-ব মলি একা করে এনেছে। আবার দুধ-সেমাই ও রেঁধে এনেছে।’

সাকিনা বলল, ‘ওরে বাবা— অতগুলো আলু-কপি চিকন করে কেটে শেষ করাই তো বিষম ব্যাপার। তারপর ভাজতে গিয়ে যেন গলে ঘ্যাট হয়ে না যায়, সেই ভয়টাও কম নয়। আমার তো মনে হয়— আলু-কপি ভাজির চেয়ে কোরমা রান্না বেশি সহজ।’

সবাই হেসে উঠল। জামী আর ফ্রিডা দুজনে দুহাতে কয়েকটা প্লাস্টিকের ঢাকনা-বন্ধ বাটি সাবধানে ধরে দরজার কাছ থেকে বলল, ‘মা, চল।’

সাকিনা বলল, ‘ওগুলো কী?’

‘ছাঁদা।’ জাহানারা হেসে বললেন, ‘খাবার বেশি বাঁচলে সবাইকে ভাগ করে দিয়ে দেওয়া হয়।

জামী বলল, ‘আপনার জন্যও একটা বাটি আছে সাকিনা-আপা।’

দরজার কাছে অনেকেই দাঁড়িয়ে আছেন। সবাই প্রায় যাবার মুখে। সবাই সবার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছে। জাহানারা জো-কে বললেন, ‘তাহলে কাল এগারটার সময় আসছ?’

‘হ্যাঁ বুবু, এগারটায়। দেখা হবে।’

গাড়িতে বসার পর জাহানারা বললেন, ‘সাকিনা, কালকে জো আসবে তোমার একটা চাকরির ব্যাপারে আলাপ করতে। তুমি এগারটার সময় তৈরী থেকো। জো তোমার সঙ্গে কথাবার্তা বলবে। তারপর দরকার হলে কালই তোমাকে নিয়ে ও বেরোতে পারে। ওর এক বন্ধুর ট্র্যাভেল-এজেন্সি আছে। দেখা যাক।

উত্তেজনায় সাকিনার সারা শরীর শিরশির করে। কী এক আবেগে গলা পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। কথা বলতে পারে না। শুধু দুইচোখে কৃতজ্ঞতা উপচিয়ে সে পাশ ফিরে তাকায় জাহানারার দিকে। জাহানারা তার হাতে একটু চাপ দিয়ে বলেন, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *