১৭
সাকিনার সঙ্গে একবাসায় থাকার জন্য যে মেয়েটি আসবে, সে নাকি কালো মেয়ে। শুনে সাকিনা প্রথমটা ঘাবড়ে গিয়েছিল। কিন্তু জো আর ফ্রিডা বলল, ও মেয়েকে তারা আগে থেকে চেনে। খুব ভালো মেয়ে। সাকিনার ভয় করার কোনো কারণ নেই। কোনো ঝামেলা হবে না। ফ্রিডা বলল, ‘তোমার দুটো বাড়ির পেেরর বাড়িটাতে যে-এক কালো পরিবার থাকে, দেখনি তাঁরা কত ভদ্র? বেন আর রিভা। ওদের ছেলে অ্যাডেলকে তা সবসময় বাইরে সাইকেল চালাতে দেখ।’
সাকিনা স্বীকার করল, অ্যাডেলের সঙ্গে তার ইতিমধ্যেই বেশ ভাব হয়ে গেছে। খুব মিশুক ছেলেটা। নিজেই সেধে সেধে সবার সঙ্গে আলাপ করে।
বেটিনা প্রথমদিন একাই এল তার লালরঙের বিরাট গাড়িটা চালিয়ে। বুটি থেকে দুটো ঢাউস স্যুটকেস একাই এক-এক ঝটকায় তুলে বের করে দুহাতে দুটো ঝুলিয়ে গটগট করে বাসায় ঢুকল। সাকিনা তাকিয়ে দেখল, কালো হলেও মেয়েটি অপুর্ব শ্রীময়ী। বেশ লম্বা পাতলা ছিপছিপে অথচ পুরন্ত যৌবন-উছলানো শরীর, চুলগুলো সোজা। দুই ভ্রু ঢেকে কানের পাশ দিয়ে ঘাড় পর্যন্ত নেমেছে। গলার স্বর একটু মোটা কিন্তু হাসিটি ভারি মিষ্টি। সে বাসায় ঢুকেই সাকিনার সঙ্গে বেশ ভাব জমিয়ে ফেলল। সাকিনার মন থেকে ভয়, ভীতি, উদ্বেগ দূর হল। সে বেটিনাকে খুব পছন্দ করে ফেলল। মন বলল, এই মেয়ে বাসায় থাকলে তার সময় ভালোই কাটবে। সে বলে উঠল, ‘খেয়াল করেছ তোমার নামের সঙ্গে আমার নামের কেমন মিল? সাকিনা আর বেটিনা?’
বেটিনা হা হা করে হাসল, ‘তাই তো। বেশ ভালোই হল। তাহলে তোমার সঙ্গেও আমার বনবে ভালো
সাকিনা তার আগের মাস্টা- বেডরুমটাই রেখেছে। বেটিনার জন্য একটু ছোট দ্বিতীয় বেডরুমটা। কন্ডোর ভাড়া, গ্যাস, পানি, ইলেকট্রিসিটির খরচ—সব আধাআধি।
‘তোমার গাড়িটা কী বিরাট। এই কন্ডো-কমপ্লেক্সে এত বড় গাড়ি কারো নেই।’
‘জানো না বুঝি, কালোরা সবসময় বিরাট বিরাট গাড়ি কেনে?’
‘তাই নাকি? ওরা বুঝি খুব বড়লোক?’
‘ঠিক উলটো। ওরা গরিব বলে হীনমন্যতায় ভোগে। তাই সুযোগ পেলেই অন্যদিকের খরচ বাঁচিয়ে বিরাট বড় গাড়ি কেনে।’ তারপর একচোখ টিপে যোগ করল, ‘অবশ্য সেকেন্ড হ্যান্ড, থার্ডহ্যান্ড গাড়ি।’
‘বড় গাড়িতে তেল নাকি বেশি খায়?
‘তা খায়। কিন্তু স্ট্যাটাস সিম্বল। ওইটে উঁচু করে রাখার জন্য অন্যদিকে খরচ সংক্ষেপ করতে হয়। সেটা বেশিরভাগই বাড়ি এবং খাওয়া-দাওয়ার ওপর দিয়ে যায়।’
সাকিনা অবাক হল, কী আশ্চর্য দিল-খোলা মেয়েটি। নিজেদের সমাজের দোষ-মন্দকথা সব অকপটে বলে দিচ্ছে। সে ভাবল—আর যারই থাকুক, এর অন্তত হীনমন্যতা রোগ নেই।
‘কিন্তু আমিতো দেখেছি, নিগ্রো মেয়েরা খুব মোটা হয়। খাওয়া সংক্ষেপ করলে মোটা হতে পারে?
বেটিনা হাসতে হাসতে হালকা সুরে বলল, ‘খবরদার, কখনো নিগ্রো বলবে না। বলবে কালো। কা-লো! বুঝেছ?’
সাকিনা খুব বিব্রত হয়ে পড়ল, ‘দুঃখিত। আমি জানতাম না।
‘তাতে কী? আর শোনো, ঐযে মোটা হবার কথা বললে, ব্যালান্সড বা হাই-প্রোটিন খাবারে খরচ বেশি। কিন্তু কম খরচে রুটি, কেক, কুকিজ, ম্যাকারনি, স্প্যাগেটি দিয়ে পেট ভরানো সহজ। তাই কার্বোহাইড্রেট বেশি খেয়ে কালোরা মোটা হয়ে পড়ে। ওটা কিন্তু সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়।
বেটিনা বিছানার ওপর রাখা খোলা সুটকেস থেকে এক-এক করে কাপড় বের করে ক্লোজেটের হ্যাঙারে ঝোলাতে ঝোলাতে কথা বলছে। সাকিনা দরজার কাছ দাঁড়িয়ে কথা শুনছে এবং কথা বলছে।
তুমি কিন্তু মোটা নও। তোমার ফিগারটা দুর্দান্ত সুন্দর।
বেটিনা হাসল, ‘থ্যাংক ইউ ভেরিমাচ। আমি গরিব নই, আমি রেজিস্টার্ড নার্স, প্রচুর পয়সা কামাই করি। হাই-প্রোটিন ডায়েট খাবার সঙ্গতি আমার আছে। গাড়িটাও সেকেন্ডহ্যান্ড নয় কিন্তু। ব্র্যান্ড নিউ।’
সাকিনা এবার ভাবল, মেয়েটা বেশ অহংকারীও বটে। সে বলল, ‘তুমি তো নিজেই একটা বাড়ি ভাড়া করে থাকতে পারতে।’
বেটিনা আবার হাসল, ‘তা পারতাম। তবে বাসা খুঁজতেও সময় লাগে তো। ইতিমধ্যে আমার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ঝগড়া হয়ে গেল কিনা। ওর সঙ্গে ওর বাসাতেই ছিলাম। রাগের মাথায় বেরিয়ে এসে মোটেলে উঠেছিলাম। এমন সময় তোমার এই বাসার খবরটা পেলাম। ভাবলাম আপাতত মন্দ কী?’
‘আপাতত মানে? তুমি শিগগিরই বাসা খুঁজে চলে যাবে নাকি?’
‘না, না, তোমাকে অসুবিধেয় ফেলে হুট করে চলে যার না।’ তারপর মুখটা বিরক্তিতে কুঞ্চিত করে বলল, ‘পুরুষ-মানুষে অরুচি ধরে গেছে, আপাতত কিছুদিন মুক্ত বিহঙ্গের মতো জীবনযাপন করব।’
খালি হয়ে যাওয়া স্যুটকেস বন্ধ করতে-করতে বেটিনা আপন মনে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ‘নো ম্যান, নো ডেটিং। নাথিং অ্যাট অল।’
বেটিনার জীবনবৃত্তান্ত এবং জীবনদর্শন পরিপাক করতে সাকিনার একটু সময় লাগে। এদেশে আসার আগে সে পাশ্চাত্যের সমাজ ও জীবন সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানত না—ঢাকার যে একটা আল্ট্রামডার্ন সমাজের ছেলেমেয়েরা পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে থাকে, তাদের সঙ্গেও তার কখনো যোগাযোগ ঘটেনি। এদেশে এসেও রকিবের পক্ষপুটে থেকে, যাকে বলে ‘কালাচারাল শক’–সেটা সে ঠিক পায়নি। এখন এই মাস দুয়ের মধ্যেই আমেরিকার ‘কালচারাল শক’ তাকে সত্যিসত্যি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করে ফেলছে। এটা চরমে উঠল সপ্তাহ দুয়েক পর। এক বুধবারে বেটিনা বলল, ‘সাকিনা, এই শনিবার সন্ধ্যায় কন্ডোটা একটু ছেড়ে দিতে হবে।’
সাকিনা অবাক হয়ে বলল, ‘তার মানে?’
‘তুমি পাঁচটা থেকে ধরো বারোটা পর্যন্ত বাইরে কোথাও কাটাবে। ঐদিন আমার নতুন বয়ফ্রেন্ডকে বাসায় ডিনারে দাওয়াত করতে চাই।’
সাকিনা হতভম্ব হয়ে বলল, ‘এসব কী বলছ? তোমার বয়ফ্রেন্ডকে দাওয়াত করবে করো। তাতে আমাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে কেন?’
বেটিনা হাসিমুখেই ভুরু দুটো কুঁচকে বলল, ‘তুমি কি কচি খুকি নাকি গো?’ তারপর পরিহাস-তরল গলায় বলল, ‘তুমি যেদিন বাসায় বয়ফ্রেন্ড আনবে, আমিও সেদিন রাত বারোটা পর্যন্ত বাইরে থাকব।’ সাকিনার মাথা ঘুরতে লাগল, সে দিশে না পেয়ে হঠাৎ দরজা খুলে ছুটে বেরিয়ে গেল ফ্রিডাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে।
জাহানারা বাসাতে ছিলেন। সব শুনে বললেন, ‘এত অস্থির হোয়ো না। যে দেশের যা কালচার। এদেশে এসব ডালভাত। ফ্রিডা আসুক। তারপর একটা-কিছু পরামর্শ করা যাবে। তবে মেয়েটা এমনিতে কিন্তু ভালো। সিগারেট খায় না। মদ খায় না। ফ্রিডা, জো বিশেষ করে ঐরকম টিটোট্যালার দেখেই ওকে তোমার বাসায় রাখার বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। মদ-সিগারেট খাওয়া মেয়ে হলে আরো ঝামেলা হতে পারত। বয়ফ্রেন্ড থাকা এদেশে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। ওটা একটু মেনে নিতেই হবে।’
ফ্রিডা ও জো-র মধ্যস্থতায় একটা রফা হল। বেইসমেন্টটা একেবারে খালি পড়ে থাকে। ওটাকে একটা লিভিংরুম বানানো হবে। খরচ যা হবে, বেটিনা-সাকিনা দুজনে হাফ-হাফ দেবে। বেটিনা যখনই বয়ফ্রেন্ড বাসায় আনুক, ডিনার সারার পর ওরা বেইসমেন্টে চলে যাবে। আর এই শনিবারে ফ্রিডা সাকিনাকে দাওয়াত করল ডেট্রয়েটে গ্রিক-টাউনে ডিনার খাওয়ার। দাওয়াটা আসলে ফ্রিডার বাবা-মাই করছেন ফ্রিডা, জামী ও জাহানারাকে। ওঁরা সাকিনাকেও সঙ্গে নিতে বলেছেন। ফ্রিডার আদি দেশ গ্রিস। ওরা মাত্র দুইপুরুষে আমেরিকান। ফ্রিডার দাদা তাঁর যৌবনে গ্রিক-বউসহ এদেশে ইমিগ্রান্ট হয়ে আসেন। ফ্রিডার বাবার জন্ম এদেশে। কিন্তু ফ্রিডার মা তাঁর ষোল বছর বয়সে গ্রিক থেকে আসেন। আসলে ফ্রিডার বাবার সঙ্গে বিয়ে দেবার জন্যই তাঁকে গ্রিক থেকে আনানো হয়। ওদের বাড়িতে এখনো অনেক গ্রিক ধরন-ধারণ আছে। ফ্রিডার মা বাড়িতে বেশিরভাগ সময় গ্রিক-পদ রান্না করেন। ডেট্রয়েটে গ্রিক-টাউনে অনেক গ্রিক-রেস্তোরাঁ আছে। সেখানে ডিনার সারার পর ওরা যাবে নদীর ধারের এথনিক ফেস্টিভ্যাল দেখতে। প্রতিবছর এই সময় ডেট্রয়েটে নদীর ধারে বিশাল লম্বা চওড়া খোলা জায়গাতে বিভিন্ন দেশের ইমিগ্রান্টরা তাদের নিজ দেশীয় শিল্প-সংস্কৃতিমূলক স্টল খোলে। এসব দেখে ফিরতে ফিরতে রাত বারোটা-একটা বেজে যাবেই।
বেটিনা মেয়েটি সত্যিই ভালো। ওর বয়ফ্রেন্ড বাড়িতে আনার ব্যাপারে সাকিনা এইরকম কাণ্ড করলেও মাইন্ড করেনি। বরং এই নিয়ে সাকিনাকে ঠাট্টা করে খেপিয়েছে। সাকিনা হেসে বলে, ‘বা রে! তুমিই বা কেমন। প্রথমে এসেই ঘোষণা দিলে বেশকিছুদিন পুরুষের মুখ দেখবে না। নো ম্যান, নো ডেটিং। তা দু-সপ্তাহ যেতে ‘না’ যেতেই—’
‘বারে, দু’সপ্তাহ কম সময় হল? ও তো অনেক দিন। অতদিন যে ধৈর্য ধরে থাকতে পেরেছি, তোমার তো আমাকে সাধুবাদ দেয়া উচিত।’