৭
নতুন বাসা দেখে সাকিনার বুকের ভেতর জমাটবাঁধা নিশ্বাসগুলো যেন গলে গলে ঝরে বেরিয়ে গেল। চমৎকার দোতলা বাসা—ফ্ল্যাট নয়, কন্ডোমিনিয়াম। নিচে ড্রয়িং -ডাইনিং, কিচেন——বেশ প্রশস্ত। দোতলায় বড় দুটো বেডরুম, বাথরুম। মাটির নিচের বেইসমেন্টটাও যথেষ্ট ফাঁকা পড়ে আছে। পেছনে একচিলতে বাগানের জমি, সামনে ছোট একটা ঘাসে-ঢাকা লন। দোতলায় মাস্টার-বেডরুমটার সঙ্গে আবার ছোট একটা ঝুলবারান্দাও আছে। বারান্দায় দুটো নাইলনের ফিতের বোনা ফোল্ডিং-চেয়ার পাতা আছে। রকিব বলল, ‘বাড়িঅলা ও দুটো আমাদের দিয়ে গেছে।’
‘নিচের ঘরেও একটা লম্বা সোফা দেখলাম, ওটাও কি বাড়িঅলা দিয়ে গেছে?’
‘হ্যাঁ, ও নতুন বাড়িতে নতুন ফার্নিচার কিনেছে। এ বাড়ির জিনিসপত্র যতটা পেরেছে, বিক্রি করেছে। যেগুলো রয়ে গেছে, আমাদের দিয়ে গেছে।’
‘খুব বড়লোক বুঝি? একটা বাড়ি থাকতে আরেকটা বাড়ি কিনেছে?
‘বড়লোক তো বটেই। তবে মজা কি জানো? এদেশে বাড়ি কিনতে খুব বড়লোক হতে হয় না। এই ধরনের কন্ডোমিনিয়াম জীবনের প্রথম কয়েকবছর চাকরি করার পরেই কেনা যায়। কারণ পুরোটা নগদ টাকা দিয়ে তো কিনতে হয় না। প্রথম চোটে পুরোদামের পঁচিশ পার্সেন্ট নগদ দিয়ে বাকি টাকা বিশ-পঁচিশ বছর ধরে মাসে-মাসে শোধ করতে হয়। আরো মজা কী জানো? বড়লোকরা যে বিরাট বাড়ি কেনে, তারাও ঐ প্রথমে ২০-২৫ পার্সেন্ট নগদ দেয়, বাকি টাকা তারাও ২০-২৫ বছর ধরে মাসে-মাসে শোধ করে। সারাদেশ জুড়ে একই পদ্ধতি।’
কেউ যদি বাড়ি বিক্রি করতে চায়?’
‘যে কিনবে, সেও প্রথমে কিছু হোক নগদ দেবে। তারপর ঐ কিস্তি-সহই কিনবে।’
‘ভারি মজা তো। অথচ আমাদের দেশে দেখ, একটা বাড়ি করতে লোকের সারাজীবনের সঞ্চয় চলে যায়, বাড়ি বানানোর চিন্তায় মাথার চুল পেকে যায়, ব্লাডপ্রেসার হয়ে যায়!’
‘হ্যাঁ, এখানে এই সুবিধে। নিজেদের কষ্ট করে বাড়ি বানাতে হয় না। তৈরী-বাড়ি পাওয়া যায়।’
‘আমরাও তো তাহলে কয়েকবছর পরে কিছু টাকা জমিয়ে এই বাড়িটাই কিনতে পারি।’
রকিব গম্ভীর হয়ে বলল, ‘কন্ডো আমি কিনব না। কিনলে বাড়িই কিনব।’
সে আবার কি? কন্ডো আর বাড়িতে তফাৎ কি?’
‘কন্ডো হল কম-রোজগেরে লোকদের বাসস্থান। কন্ডো যারা কেনে, তারাই টাকা বেশি হলে বিক্রি করে দিয়ে বাড়ি কেনে। বাড়ির আলাদা স্ট্যাটাস। আমি ডাক্তার। আমার টাকা হতে সময় লাগবে না। আমি প্রথম চোটেই বাড়ি কিনব।
সাকিনার ভালো লাগাটা একটু চিড় খেল। কিন্তু নতুন বাসায় আসার আনন্দ সে কিছুতেই নষ্ট হতে দেবে না। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলল—
‘যাই বল, লোকটা কিন্তু ভালো। আমাদের খুব কম ভাড়ায় দিয়েছে। মাত্র পৌণে চারশো ডলারে এত বড় বাড়িটা।’
রকিব একটু চিন্তিত গলায় বলল, ‘বেইসমেন্টে একটু ক্র্যাক আছে এককোণে। বাড়িঅলা বলেই দিয়েছে, মাঝেমধ্যে মেরামত করতে যা লাগবে আমিই যেন খরচ করি, তাই ও এত কম ভাড়ায় দিয়েছে। ও এইসব মেরামতের ঝামেলা-টামেলা করতে পারবে না।’
এ দেশে সব বাড়িতেই বেইসমেন্ট করে। মাটির এত নিচে ঘর, বিষ্টির সময় পানি ঢোকে না?’
‘তার সব ব্যবস্থা আছে, তাছাড়া এদেশে বৃষ্টি হয়ও কম।’
‘হত বাংলাদেশের মতো তোড়ে একশো ইঞ্চি বৃষ্টিপাত, তাহলে আর বেইসমেন্ট বানাতে হত না।’ বলতে বলতে সাকিনা খিলখিল করে হাসল। সে বারান্দাতেই বসে রইল বহুক্ষণ। সামনে রাস্তা, তারপরেই বিরাট একটা মাঠ— ওটার জন্যই এ জায়গাটা এত খোলামেলা লাগে। মাঠ পেরিয়ে ওধারে বড়বড় গাছ। গাছের ফাঁকে ফাঁকে বাড়ির মাথা দেখা যাচ্ছে। পেছনদিকেও বিরাট বিরাট মহীরুহের মতো গাছ। দেখতে খুব ভালো লাগে। এখন বেশির ভাগ গাছই পত্রশূন্য। মাটিতে ঝরাপাতার ডাঁই। মাঝেমাঝে বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝেমাঝে হু হু বাতাস বয়ে যাচ্ছে। আর কিছুদিন পরেই বরফ-পড়া শুরু হবে। সাকিনা শুনেছে কোনো-কোনো বছর এত বরফ পড়ে, মাটির ওপর তিন-চার-ছয় এমনকি দশ-বারো ফুটও বরফ জমে যায়। এই শীতে রচেস্টারের ওই মাটির নিচের ফ্ল্যাটে থাকলেই হয়েছিল আর কী। কোনোদিন সকালে উঠে দেখত মাটির ওপর ছয়-সাতফুট বরফ জমে তাদের গোটা জানালাটাই ঢেকে গেছে। উহ্ মা গো, খুব ভালো সময়ে তারা বাসা বদলাতে পেরেছে। রকিব ডাকল, ‘এই, নিচে এস। চল, বাইরে গিয়ে হাঁটি।’
বেশ কয়েকদিন পরে আজ রোদ উঠেছে। তার ওপর রোববার। ওরা দুজনে নেমে পেছনদিকের দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখে—অনেক বাড়ি থেকেই লোকজন বেরিয়ে হাঁটাহাঁটি করছে। তিন-চারটে ছোট ছেলেমেয়ে দৌড়োদৌড়িও করছে। এক মোটা ভদ্রমহিলার সঙ্গে এক বিরাট কুকুর দেখে সাকিনা হঠাৎ কুঁকড়ে দাঁড়িয়ে গেল। ভদ্রমহিলা হেসে কুকুরটার গলায় বকলস ধরে বলল, ‘ভয় নেই, ও খুব ভালো। আপনাকে কামড়াবে না।’ পাশ দিয়ে যাবার সময় কুকুরটা সাকিনার শাড়ি শুঁকে দিয়ে গেল। ভদ্রমহিলাকে এ-ধরনের পরিস্থিতি বোধহয় প্রায়ই মোকাবেলা করতে হয়। আরেকটু এগোতেই এক ভদ্রলোক হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘হাই! আমার নাম আর্নি। আমি এই বাসাটাতে থাকি। আপনারা গত সপ্তাহে এলেন বুঝি?’
রকিব তার সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিজের নাম বলল, সাকিনাকে পরিচয় করিয়ে দিল। সাকিনা অবাক হল। রচেস্টারে থাকতে এমনটি কখনো ঘটেনি। সত্যি বলতে কী, ওখানকার কোনো ফ্ল্যাটের বাসিন্দার সঙ্গেই তাদের আলাপ-পরিচয় হয়নি। সে খুব খুশি হল এই ভেবে যে, পাড়ার লোকগুলো অত আত্মকেন্দ্ৰিক নয়।
কথায় কথায় জানা গেল, আর্নির আদি দেশ কলাম্বিয়া। সাকিনাও লক্ষ করল এর গায়ের রঙ এদেশি লোকের মতো ফ্যাকাশে-সাদা নয়, মাখনের মতো বাসন্তী-সাদা।
নাকচোখের গড়নেও একটু অন্যরকম ভাব আছে।
আর্নি জিজ্ঞেস করল, ‘আপনারা কি ইন্ডিয়ার লোক?’
রকিব হেসে ফেলল, ‘না, আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি। অবশ্য এই ভুলটা সবাই করে!
‘ব্যাংলাডেশ? আরে, এখানে তো আরেকজন থাকেন ব্যাংলাডেশের। দাঁড়ান, আপনাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।’ আর্নি দুটো বাড়ির পরের একটা বাড়ির দরজায় গিয়ে বেল টিপল। একটি মেয়ে বেরিয়ে এল, আর্নি বলল, ‘ফ্রিডা, সাইফ আছে? এই দেখ এরা দু-জন সাইফের দেশের লোক! এখানে কন্ডো ভাড়া নিয়েছে।’
মেয়েটি ঘরের দিকে মুখ ফিরিয়ে ‘সাইফ সাইফ এখানে এস’ বলে চৌকাঠ থেকে নেমে এল ওদের সামনে। আর্নি পরিচয় করিয়ে দিল— ‘ফ্রিডা, সাইফের বউ।’
সাকিনা লক্ষ করল এ মেয়েটিরও গায়ের রঙ বাসন্তী-সাদা, প্রায় চাঁপাফুলের রঙ। চুল ঘন-বাদামি—প্রায় কালোর পর্যায়ে, এবং চোখের রঙ গাঢ়-বাদামি হলেও ভুরু দুটি অদ্ভুত কুচকুচে কালো। একটু পরেই সাইফ এল, পরিচয় হল। ওখানেই রাস্তার ওপর চমৎকার একটি জটলা জমে উঠল। সাকিনার বুকটা খুব হালকা হয়ে গেল। একই পাড়ায় একটি বাঙালি বাস করে, হোক-না তার স্ত্রী এদেশি, তবুতো বাংলায় কথা বলার জন্য একজন লোক মাত্র পঞ্চাশগজ দূরের বাসাতে রয়েছে।