নিঃসঙ্গ পাইন – ১০

১০

সাকিনা গাড়ি চালানোর পরীক্ষায় পাস করেছে। তার জন্য আজকের এই সেলিব্রেশান। পুরো প্ল্যানটাই স্ট্যানলির। আগের দিনই বলেছিল, ‘তোমরা প্রথমে আমার বাড়িতে এসে ব্রাঞ্চ করবে। তারপর সাকিনা, তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। একটা নতুন জিনিস দেখাব।’

রকিব বলে উঠেছিল, ‘শুধু সাকীর জন্য সারপ্রাইজ? আমি ফেলনা?’

‘না, না, সারপ্রাইজটা সকলের জন্যই। তবে সাকিনা এত তাড়াতাড়ি এক চান্সেই ড্রাইভিং পাস করে ফেলল কিনা, তাই ওর জন্য আমিও সারপ্রাইজটা এগিয়ে আনলাম।’

ব্রাঞ্চ করা সাকিনার ধাতে সয় না। শুক্র-শনি রাত দুটো-তিনটে পর্যন্ত পার্টি হৈ-হুল্লোড় ক’রে লোকে পরদিন এগারটা পর্যন্ত ঘুমোবে, তারপর বারোটার সময় ব্রেকফাস্ট আর লাঞ্চ একত্রে খাবে। যত রাতেই ঘুমোক না কেন, সকালে সাকিনার ঘুম ভাঙবেই। আর ঘুম ভাঙলেই তার খিদে পাবে।

সাকিনা বেরোবার আগে ঠিকই সকালের নাশতা খেয়ে বেরিয়েছিল। ও তো এতদিনে জেনেই গেছে ঐ ব্রাঞ্চ খেতে বসতে বসতে তার দুপুরের খিদে লেগে যাবে।

স্ট্যানলিদের বাড়িটা ক্যাস লেকের ধারে। লেকটা এখানকার বাড়িগুলোর পেছনদিকে। অর্থাৎ রাস্তা থেকে লন পেরিয়ে বাড়িতে উঠে প্রথমে ড্রয়িংরুম। পেছনে লেকে যেতে হলে ঘর-বারান্দা পেরিয়ে তবে যেতে হবে। কিংবা বাড়ির পাশের গা-ঘেঁষা লন পেরিয়ে। পেছনে খানিকটা উঠোন, তারপরই লেক। লেকের ধারে অগভীর পানির ওপর কাঠের তক্তা দিয়ে বানানো একটা আট-দশ ফুট লম্বা পাটাতন- —এরা বলে ‘ডক’। ডকের শেষপ্রান্তে বাঁধা একটা ঝকঝকে নতুন বোট—এটাই স্ট্যানলির সারপ্রাইজ। নতুন বোট কিনে ফেলেছে।

এ-বাড়ির ড্রয়িংরুম ডাইনিংরুম আলাদা। ঘরের সিলিং বেশ উঁচু। পুরনো ধাঁচের বাড়ি কিন্তু পুরনো নয়। স্ট্যানলির বাবার আমলেই তৈরী। আমেরিকানদের একটা নেশা আছে এ্যান্টিক বাড়ি-গাড়ি-আসবাবর প্রতি। তৈরী না পেলে নতুন বাড়িই বানাবে দু-তিনশো বছরের পুরানা স্টাইলে।

বসার ঘরের, খাবার ঘরের আসবাবপত্র এ্যান্টিক ডিজাইনের। ডাইনিংটেবিলের ওপর ঝাড়বাতি ঝুলছে সিলিং থেকে। ইউনিফর্ম-পরা ‘মেইড’ এসে ব্রাঞ্চ সার্ভ করল ওদের। ধোঁয়া-ওঠা গরম প্যানকেক, মেইপল সিরাপ, পানিপোচ করা মোলায়েম ডিম। পোচটাও এত সুন্দর হয়েছে—হলদে কুসুমের চারপাশের সাদা অংশটা একেবারে চুড়ির মতো গোলাকার। সাকিনা অবাক হল, এত গোল হল কী করে।

সারা আমেরিকা জুড়ে শনি-রোববার সকালের ব্রাঞ্চের মেনু হল এই প্যানকেক আর মেইপল সিরাপ। এর সঙ্গে ডিম, সসেজ, স্ট্রবেরি— যার-যা পছন্দ

খাওয়ার পরে স্ট্যানলি নিয়ে গেল তার সারপ্রাইজ দেখাতে। নতুন বোট দেখে সবাই হৈ-হৈ করে উঠল। রকিব একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়ল বোটের ওপর। সাকিনা ডকের উপর দাঁড়িয়ে অবাক চোখে দেখতে লাগল—কী সুন্দর বোট। এ-রকম বোট সে আগে দেখেনি। বোটটার বাইরের চেহারা অন্যসব বোটের মতোই, কিন্তু ভেতরে মোটরগাড়ির সীটের মতো গদিআঁটা সীট। ড্রাইভারের সীটের সামনে মোটরের মতোই স্টিয়ারিং, আরো কী কী সব চকচকে জিনিসপত্র—নিশ্চয় বোটের উপযোগী ক্লাচ, ব্ৰেক, এ্যাকসিলারেটার হবে। বোটের পেছনের সরু জায়গাটাতে ইঞ্জিন। অন্যসব বোটের মতোই এই বোটের মাথাতেও কোনো ছাউনি নেই। বোটের গায়ে স্টেইনলেস স্টিলের অক্ষর দিয়ে লেখা আছে— বার্কলে : জেট-ড্রাইভ।

স্ট্যানলি বোঝাল, ইঞ্জিনটা জেট-পাওয়ার্ড—খুব স্পিডে চলতে পারে। বোটের পেছনে লাগানো একটা হুক দেখিয়ে বলল, ‘এইটেয় শেকল বেঁধে ওয়াটার-স্কি করা যায়। আজ রকিব বোট চালাবে, আমি ওয়াটার-স্কি করব। তোমরা আজ বসে-বসে দেখ। সাকিনা তোমাকে ওয়াটার-স্কি শিখিয়ে দেব। দেখবে, কী মজা লাগে।’

সাকিনা আঁতকে উঠে বলল, ‘ওরে বাবা। ও আমি জীবনেও পারব না। আমি দেশে ‘হাওয়াই-ফাইভ-ও’ সিনেমায় দেখেছি। ভয়ানক রিস্কি ব্যাপার। ‘

স্ট্যানলি হা হা হাসির শব্দে চারপাশ চমকে বলল, ‘মোটেই রিস্কি না। একবার শিখে নিলে দেখবে কীরকম থ্রিলিং। তাই না রকিব?’

রকিব গাল চুলকে বলল, ‘হ্যাঁ থ্রিলিং বটে, তবে ঐ পর্যায়ে যাবার আগে শেখার সময়টা বড়ই কষ্টের। রিস্কিও বটে।

মিরান্ডা মুচকি হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, কতবার যে ডিগবাজি খেয়েছ, তার আর লেখাজোখা নেই।’

সাকিনা হঠাৎ সজাগ হয়ে বলল, ‘কখনকার কথা বলছ? কখন কোথায় ও স্কি শিখত? তুমি ছিলে সে-সময়?’

রকিব বোট থেকে লাফ দিয়ে ডকে এসে বলল, ‘বারে, স্ট্যানের বোট ছিল না আগে? ও আর মিরান্ডা তো এখানেই ছিল ক্যালিফোর্নিয়া যাবার আগে। স্ট্যানের বোটেই তো আমি ওয়াটার-স্কি শিখেছি। উহ্ কী মজাতেই কেটেছে সে দিনগুলো। হঠাৎ বাপের সঙ্গে ঝগড়া করে স্ট্যান স্যানডিয়েগো চলে গেল বলেই না সবকিছুতে ছেদ পড় গেল।

স্ট্যানলি হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠল, ‘চল, চল, সবাই বোটে ওঠো। আমরা অন্তত একচক্কর দিয়ে আসি লেকের ওপর। এখানো কেউ চড়িনি নতুন বোটে। সাকিনা, তুমি আগে ওঠো বোটে। তোমার এত তাড়াতাড়ি গাড়ি চালানো শেখার পুরস্কার এই বোটরাইড।’

বিকেল পর্যন্ত লেকের ওপরেই কেটেছে। স্ট্যানলি আর রকিব পালা করে বোট চালিয়েছে আর স্কি করেছে। সাকিনা, মিরান্ডা পেছনের সীটে বসে দেখেছে আর গল্প করেছে। মিরান্ডাও স্কি করতে পারে কিন্তু স্ট্যানলি-রকিবের অনেক সাধাসাধিতেও আজ রাজি হয়নি।

এখন সন্ধ্যা ছটার সময় ওরা যাচ্ছে ডিনার খেতে—একটা মেক্সিকান রেস্তোরাঁতে। জুন মাসের ঝকঝকে সন্ধ্যা, রোদে চারদিক ভেসে যাচ্ছে। সূর্য ডুববে রাত নটার পরে। সাকিনা হঠাৎ বলে উঠল, ‘স্ট্যানলি’ তোমাদের কী অদ্ভুত অভ্যেস। সন্ধে ৬টা-৭টার মধ্যে ডিনার খাওয়া চাই-ই। তারপর শুতে যাবার আগপর্যন্ত তোমরা কতবার-যে কাজুবাদাম, আইসক্রিম, স্ট্রবেরি, কুকিজ খাও, তার হিসেব নেই। কেন সন্ধে থেকে ঐসব খেয়ে রাত নটার দিকে ডিনার খেতে পার না?’

স্ট্যানলি হেসে বলল, সারাদেশ জুড়ে সবার এই অভ্যেস গড়ে উঠেছে কত বছর ধরে। এখন আর বদলানো সম্ভব নয়। কী জানো, আমরা এখানে সবাই খুব খাটি তো সকাল আটটা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত। দুপুরে দু-একটা হাল্কা স্যান্ডুইচ খাই। তাই কাজ থেকে বাড়ি ফিরেই রাক্ষসের মতো খিদে পায়। তাই সব ফেলে আগে পেট-পুজো করে নেই। পেট ঠাণ্ডা হলে সব ঠাণ্ডা। তারপর গান শোনো, টিভি দেখ, বেড়াতে যাও—যা খুশি কর। কত সুবিধে।

সাকিনা হেসে ফেলল, ‘সব বিষয়েই জবাব তোমার ঠোঁটের আগায়, তাই না স্ট্যানলি?’

স্বল্পভাষিণী মিরান্ডা মুচকি হেসে বলল, ‘সর্ব বিদ্যা বিশারদ!’

‘বেশতো তাহলে তুমি গাছও নিশ্চয় চেন। বল তো—ঐ যে পথের পাশের ঐ গাছটা, ওটার নাম কী?’

কথা শেষ হবার আগে গাড়ির গতিতে গাছ পেরিয়ে গেছে। স্ট্যানলি বলল, ‘গাছ তো দেখতে পেলাম না। কী করে বলব?’

রকিব বলল, ‘সাকীর গাছ চেনার খুব ঝোঁক হয়েছে কয়েক মাস থেকে। সবাইকে জ্বালিয়ে খাচ্ছে কোটা কী গাছ নাম বলার জন্য।’

সাকিনা ঠোঁট উলটে বলল, ‘দোষের কী হল? এদেশে তো দেখি—সবাই একটা-না-একটা হবি নিয়ে আছে। স্ট্যানলি তোমার বোটের নেশা। আমার পড়শি ফ্রিডার হবি পাখি দেখা। আমার নাহয় গাছ চেনার হল। তোমাদের আপত্তি আছে?’

‘মোটেই না’— স্ট্যানলি বলল, ‘কী কী গাছ চিনেছ এ পর্যন্ত?’

‘মেইপল’—

সাকিনার কথা কেটে রকিব বলে উঠল, ‘ওতো আমাদের বাসার সামনেই আছে।’

সাকিনা বিদ্রূপ করে বলল, ‘থাকলে কী হবে? তুমি তো নাম বলতে পার নি। ফ্রিডা বলে দিয়েছে। তুমি এতদিন এদেশে আছ, একটা গাছও চেন না। ‘

মিরান্ডা টিপ্পনী কাটল, ‘চিনবে কী করে? ওর নজর কি কোনোকালে গাছের দিকে ছিল?’

স্ট্যানলি চেঁচিয়ে উঠল, ‘সাকিনা আর কী কী গাছ চিনেছ?’

‘মেইপ্‌ল্‌, এলম্, বার্চ, ফার স্পুস। পাইন তো আগে থেকেই চিনি—’

‘আগে থেকে কী করে চিনলে?’

‘কেন ইংরেজি বইয়ে দেখে। কিন্তু মজা কি জানো? যে ওকগাছের নাম এত বিখ্যাত, সেই ওকগাছই কেউ আমাকে দেখাতে পারল না আজ পর্যন্ত।’

‘কটা লোককে জিজ্ঞেস করেছ এ পর্যন্ত?’‘

সাকিনা স্বীকার করল রকিব ছাড়া আর কাউকে বিশেষ জিজ্ঞেস করা হয়নি। স্ট্যানলি হাসল, ‘তাহলেই দেখ তোমার জ্ঞান অর্জন-পদ্ধতিতে গলদ আছে। এখন থেকে আমাকে জিজ্ঞেস করবে, স-ব গাছ চিনিয়ে দেব।’

গাড়ি যাচ্ছিল লোন-পাইন রোড ধরে। রাস্তার পাশে খানিক দূরে-দূরে সাইনবোর্ডে রাস্তার নাম লেখা। এ-রকম একটা সাইনবোর্ড পার হবার পর সাকিনা বলল, ‘কী অদ্ভুত নাম! লোন-পাইন রোড। মানে, নিঃসঙ্গ একাকী একটি পাইনগাছের রাস্তা। নামটার মধ্যে বেশ একটা উদাস বিষাদের ভাব আছে, তাই না? আচ্ছা রাস্তার নাম এ-রকম রাখা হল কেন? রহস্যটা কী? যে রেখেছিল সে কি কবিতা লিখত?’

স্ট্যানলি গম্ভীর-মুখ করে বলল ‘কী জানি। দেখা হলে জিজ্ঞেস করব। তবে আমার কী মনে হয় জানো? পাইনগাছ সাধারণত পাহাড়ি এলাকায় একজায়গায় অনেকগুলো একসঙ্গে জন্মায়। মনে হয় কেউ কোনো পাহাড় থেকে একটা পাইন-চারা তুলে এনে এই রাস্তার ধারে লাগিয়েছিল। সেই নিঃসঙ্গ, একাকী গাছটার জন্যই হয়তো এ রাস্তাটার এই নাম হয়েছে।’

‘তা হতে পারে। রাস্তাটা তো খুব লম্বা, কোন্ জায়গায় সেই গাছটা জানো কি?’

‘না, এদিকে বিশেষ পাইনগাছ দেখা যায় না।’

‘সত্যি আমিও লক্ষ করেছি, পাইনগাছ একটু যেন কমই এ অঞ্চলে। স্পুস আর ফারগাছই বেশি। ঐতো—ঐতো— আরে ঐতো একটা পাইন গাছ! ইঃ! পার হয়ে এলাম।’

রকিব মৃদু ভৎসনার স্বরে বলল, ‘সাকী তুমি যা চেঁচামেচি করছ, স্ট্যানলি না গাড়ি একসিডেন্ট করে বসে।’

‘আরে না, না, আমার অত কাঁচা হাত নয়। সাকিনা যে এনজয় করছে, এতেই আমি কৃতার্থ। কী চমৎকার কাটল সারাটা দিন, দেখতো! এই দেখ রেস্তোরাঁয় পৌঁছে গেছি। চল খেয়ে নি। পেট ঠাণ্ডা করে তারপর নাহয় ওকগাছের সঙ্গে দেখা করতে বেরোব।’

স্ট্যানলি গাড়ি পার্ক করল টাকোস বেল রেস্তোরাঁর সামনে। নামতে নামতে সাকিনা বলল, ‘আজ আর নয়। খেয়েই সোজা বাড়ি। খুব ক্লান্ত লাগছে।’

স্ট্যানলি অবাক-স্বরে বলল ‘কী কাণ্ড! স্কি করলাম আমরা, আর বসে-বসে ক্লান্ত হলে তুমি! আজব কথা শুনছি!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *