৩
সাকিনা যেদিন ঢাকায় প্লেনে চড়ে, সেদিন ছিল চৌঠা রমজান। দেখতে দেখতে সাতাশ রোজা পার হয়ে গেল। এখানে এই জুন মাসে সূর্য ডোবে রাত সোয়া ন-টা সাড়ে নটায়। এখানে লোকেরা রোজা রাখে কী করে?
‘খুব কম লোকে রাখে। আমি তো আমার চেনাজানা কাউকে রাখতে দেখিনি। কেউ কেউ উইক-এন্ডে রাখে।’
‘এখানে ঈদের নামাজ হয়?’
‘নিশ্চয় হয়। আগে শুধু ডেট্রয়েটে মসজিদ ছিল, আমাদের ঈদের নামাজ পড়তে ওই অতদূরে যেতে হত। এখন কাছেই আরেকটা মসজিদ হয়েছে— ফার্মিংটন শহরে। এটা হয়ে আমাদের খুবই সুবিধে হয়েছে। ফার্মিংটন এলাকাটাও ভালো, খোলামেলা, নতুন গড়ে উঠছে, খুব দামি এলাকা।’
চাচার বাড়িতে ওদের দুজনের ঈদের দাওয়াত—আজই রাত্রে যাবে। এই সপ্তাহ পরেই চাচা মিশিগানের পাট উঠিয়ে শিকাগো চলে যাচ্ছেন—ওখানে একটা হাসপাতালে ভালো অফার পেয়েছেন, আবার প্রাইভেট প্র্যাকটিসও করতে পারবেন। তাই আজ থেকে সাতদিন রকিব-সাকিনা চাচার বাড়িতে কাটাবে।
সাকিনা একটা ছোট স্যুটকেসে কিছু কাপড়-জামা ভরছিল সঙ্গে নিয়ে যাবার জন্য। রকিব এগিয়ে এল, ‘দেখি, কী কী শাড়ি নিলে? নামাজে যাবে কোন্ শাড়িটা পরে?’
সাকিনা অবাক হয়ে বলল, ‘নামাজে মানে?’
‘মানে ঈদের জামাতে, মসজিদে। জানো না, এখানে মেয়েরাও সবাই ঈদের নামাজ পড়তে মসজিদে যায়।’ রকিব সাকিনার শাড়ি হাঁটকাতে হাঁটকাতে একটা সোনালি জরির কাজ-করা ফিরোজা রঙের কাতান বেনারসি তুলে বলল, ‘এইটা পরবে ঈদের দিনে।’
মসজিদে নামাজ পড়তে যাব কাতান পরে?’
‘হ্যাঁগো, তাই সবাই যায় এদেশে। খ্রিস্টানরা যেমন রোববারে গির্জায় যায় তাদের ‘বেস্ট সানডে ড্রেস’টা পরে, এখানে মুসলমান মেয়েরাও তাদের বেস্ট শাড়ি-গয়না পড়ে মসজিদে যায়।’
‘গয়নাও?’ সাকিনা হেসে ফেলল।
‘হ্যাঁ গয়নাও। ওটা না হলে সাজটা পুরো হবে না তো!’
‘আমি নাহয় বিয়ের সাজে নামাজ পড়তে যাব, আমার সঙ্গে ম্যাচ করে শেরোয়ানি পাগড়ি তো তোমার নেই! মা যে ঈদের নাম করে তোমাকে পায়জামা পাঞ্জাবি আর টুপি পাঠিয়েছেন আমার সঙ্গে, তা যে নেহাৎ সাদামাটা।’
‘ছেলেরা সাদামাটাই পরে। তোমার মা যে-রকম কারুকার্য-করা সিল্কের পাঞ্জাবি এবার দিয়েছেন, তা মোটেও সাদামাটা নয়। আর পায়জামা তো পরব না— খুব দামি একটা ম্যাচ-করা প্যান্ট পরব। ইনফ্যাক্ট, তুমি যখন পাঞ্জাবিটা আমাকে দেখালে, তার পরেই একটা ম্যাচিং কালারের প্যান্ট আমি কিনে ফেলেছি। এই দেখ।’
‘তুমি তো কম নও। তলে তলে এত প্ল্যানমাফিক কাজ করা হয়ে গেছে?’
‘না হবার কী আছে? জীবনটা শান-শওকতের সঙ্গে ভোগ করতে হলে প্ল্যান-প্রোগ্রাম তো করতেই হবে।’
দুজনে স্যুটকেসটার সামনে হাঁটু গেড়ে মেঝেতে বসেছিল, রকিব হঠাৎ একটু সামনে এগিয়ে সাকিনার গায়ের ওপর ঝুঁকে পড়ল। সাকিনা তাল সামলাতে না-পেরে পেছনে হেলে, ‘যাহ্, কী হচ্ছে’ বলতে-না-বলতে রকিব তাকে দু-হাতে জড়িয়ে মেঝেয় গড়িয়ে পড়ল। তার ঠোঁটে, গালে, গলায় চুমু দেবার ফাঁকে ফাঁকে বলতে লাগল, ‘তোমাকে ভোগ করব বলেই তো একবছর ধরে কত প্ল্যান করা হয়েছিল, জানো না? আমার মা জননী তোমাকে আমার জীবনের শোভা বানাবার জন্য বিরাট প্ল্যান-প্রোগ্রামের জাল পেতেছিলেন। তার জন্য আমাকে সুলতানপুরে পাঠানো হয়েছিল। অত কষ্ট করে এবড়ো-থেবড়ো ধুলোর রাস্তায় জিপ চালিয়ে সেই গণ্ডগ্রামে গিয়েছিলাম বলেই-না এমন জলপরীকে দেখতে পেলাম। আজকের এই ভোগের পরিপাটি আয়োজনের জন্য আমাকে দশহাজার মাইল দূরে বাংলাদেশে ট্রিপ দিতে হয়েছে।
সাকিনা প্রথমটায় খিলখিল হাসির সঙ্গে এই প্রেমের খেলায় যোগ দিয়েছিল, এখন হঠাৎ রকিবকে ঠেলে উঠে বসে অভিমানী গলাতে বলল, ‘কী তখন থেকে ভোগ-ভোগ করছ! আমি কি শুধু ভোগের বস্তু?’
রকিবও উঠে বসে দুইহাত উলটে বলল, ‘এইরে! আরম্ভ হল তোমার বাংলাদেশী ন্যাকামো। জীবনটা ভোগ ছাড়া আর কী? পবিত্র বিবাহ বন্ধন, সুখী ও সার্থক দাম্পত্য-জীবন, সন্তান-পালন—এসবই তোমার হল গিয়ে মধ্যবিত্ত মনোবৃত্তির প্যাচাল। বলতে পার, দুটো পূর্ণবয়স্ক সুস্থ নরনারীর বিবাহিত জীবনের প্রধান আকর্ষণ কি? যৌন মিলন। ওটা ঠিকমতো না হলে বিবাহিত জীবনের পবিত্রতা বল, সার্থকতা বল, সন্তান পালনের মহান দায়িত্ব বল, সব পানসে হয়ে যেতে বাধ্য।’
সাকিনা হঠাৎ ঘুরে বসল। তার মুখ থমথমে হয়ে উঠেছে। ছি ছি, রকিব এসব কী বলছে? তার দুই কান ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগল।
রকিব থমকে গেল। ‘ঘুরে বসলে যে? খারাপ কী বললাম?’
‘খুব খারাপ কথা বলেছ। খুব খারাপ–
সাকিনাকে কথা শেষ করতে না’ দিয়ে রকিব গলায় জোর এনে বলল, ‘এসব তোমার সংকীর্ণ ধারণা। এগুলো এখন থেকে বদলাবার চেষ্টা কর। এদেশে আমরা তিন-চার বন্ধু একত্র হলে হরদম এ-রকম তর্ক করি। কেউ কিছু মনে করে না। উলটোপালটা কথা বললে কেউ অত সহজে রি-অ্যাক্ট করে না। তোমাকেও এগুলো একটু-একটু করে বুঝতে হবে, শিখতে হবে। রোজ ভালো করে খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন পোড়ো, দেখবে কতরকমের স্বাধীন চিত্ত, যে লোকে করে। যে যা বিশ্বাস করে তা জোর গলায় বলতে ভয় পায় না। নিজের বিশ্বাসমতো কাজেও পেছপা হয় না, তা লোকে যতই নিন্দে করুক।
সাকিনা তীব্রস্বরে বলে উঠল, আমি আসার পর থেকে তুমি খালি আমাকে শেখাচ্ছ। এটা করো, ওটা করো। এরকম ভেবো না, ওরকম পোরো না, এইরকম করে চলো, ওইরকম করে বলো। কেন আমার নিজের কিছু নেই নাকি? আমার ইচ্ছে-অনিচ্ছে, পছন্দ — অপছন্দ—।’ কথা শেষ করতে পারল না, কান্নায় গলা ভেঙে গেল।
রকিব হতভম্ব হয়ে খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইল, তারপর খুব আস্তে সাফিনার কাঁধ ধরে তার দিকে ফিরিয়ে কোমল গলায় বলল, ‘আয়াম সরি। আমি অত ভেবে বলিনি। যাকগে বাদ দাও এখন এসব কথা। এসো, স্যুটকেস গুছিয়ে নিই। বেরুতে দেরি হয়ে যাবে।’