অধ্যায় ১
সকাল সাতটা পঁয়ত্রিশ।
ইশিগামির জীবনে আরেকটা সাধারণ দিনের শুরু। ঠিক এই সময়টাতেই সে প্রতিদিন বাসা থেকে বের হয়। আজও তার কোন ব্যতিক্রম হলো না। বাসার সামনের রাস্তায় পা রাখার ঠিক আগমুহূর্তে তার চোখ আপনাআপনিই চলে গেলো বিল্ডিঙের সাইকেল স্ট্যান্ডটার দিকে। সবুজ বাইসাইকেলটা আজকেও নেই।
মার্চ মাস এসে পড়লেও শীতের তীব্রতা কমেনি একটুও। ভেতরের হাড়শুদ্ধ কাঁপিয়ে দিচ্ছে। মাথাটা স্কার্ফ দিয়ে ভালোমত পেঁচিয়ে হাটতে শুরু করলো সে। পশ্চিমে বিশ কদম হাটলেই শিনোহাসি রোড। ওটার সামনের মোড় থেকে পুবদিকে গেলে পড়বে এডোগাওয়া আর পশ্চিমদিকে গেলে নিহনবাশি। নিহনবাশির ঠিক আগেই চোখে পড়বে সুমাইদা নদীর ওপর শিনোহাসি সেতু।
বাসা থেকে ইশিগামির কর্মস্থলে পৌছানোর সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত রুটটা হচ্ছে পশ্চিমে। এক প্রাইভেট স্কুলের গণিতের শিক্ষক সে। স্কুলটা সেই চো গার্ডেন পার্কের ঠিক আগেই। তার বাসা থেকে সোয়া মাইলের মত দূর হবে।
হাটতে হাটতে শিনোহাসি ব্রিজের ওপর পৌছে গেলো ইশিগামি। শীতল বাতাসের একটা ঝাপটা এসে লাগলো তার নাকে-মুখে। পরনের কোটটা বাতাসের দমকে উড়তে লাগলো। পকেটে হাত ঢুকিয়ে হাটার গতি বাড়িয়ে দিলো সে।
আকাশটা কেমন যেন গোমড়া হয়ে আছে। সূর্যের দেখা নেই। যতদূর চোখ যায় কেবল ধূসর মেঘ। আর এই ধূসরতার প্রতিফলন যেন সুমাইদা নদীর পানিতেও। কিন্তু অন্যান্য সময়ের চেয়ে আজ আরো বেশি ধোঁয়াশা নদীর ওপর। উজানে একটা ছোট নৌকা হারিয়ে যাচ্ছে দিগন্তে। সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো ইশিগামি।
ব্রিজের আরেক পাশে এসে পাশের সিঁড়িটা দিয়ে নিচে নেমে গেলো। সুমাইদা নদীর পার ধরে হাটা শুরু করলো। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে সেতুর সারি সারি কলাম। নদীর একদম তীরঘেঁষে কংক্রিটের ফুটপাথ তৈরি করে দেয়া আছে পথচারিদের জন্যে। নদীর পাড়ে আগে মাঝে মাঝেই প্রেমিক- প্রেমিকাদের দেখা যেত। নির্জনে কিছুটা সময় কাটাতে এখানে আসত তারা, কিন্তু ইদানিং আর চোখে পড়ে না এই দৃশ্য। এর একটা কারণও আছে অবশ্য। নদীর এপাশটাতে ব্রিজের নিচের দিকে তাকালেই দেখা যাবে সারি সারি কার্ডবোর্ড দিয়ে তৈরি কতগুলো ঘর। নীল রঙের ভিনাইল শিট দিয়ে ঘেরা ওগুলো। স্থানিয়রা এ ধরণের ঘরকে ‘শ্যান্টি’ বলে। এখানেই বাস্তুহারাদের মাথা গোঁজার একমাত্র ঠাই। নদীর পশ্চিম পাশে, একটা এক্সপ্রেসওয়ে ওভারপাসের ছায়ায়। ইশিগামির ধারণা ওভারপাসটা একটু হলেও বৃষ্টি আর তীব্র বাতাসের হাত থেকে বাঁচায় নিচের বাসিন্দাদের। নদীর ওপাশে কিন্তু একটা ঘরও নেই। তাই ইশিগামির ধারণা ভুল হবার সম্ভাবনাও কম। অবশ্য এটা হতে পারে, একবার একজন তেমন কিছু না ভেবেই একটা ঘর তুলেছিল এখানে। এরপর অন্য সবাই তাকে অনুসরণ করে এসে পড়েছে। মানুষ দলবদ্ধভাবেই বাস করতে পছন্দ করে। অসচেতনভাবে হলেও সেটা হয়েই যায়। আর নদীর ওপাশে একা একা থাকার চেয়ে এখানে অনেকের মাঝে থাকাটা কিছুটা হলেও নিরাপদ।
ইশিগামি শ্যান্টিগুলো দেখতে দেখতে হাটতে লাগলো। ওগুলো দেখে মনে হয়, একজন মানুষ খুব কষ্টে মাথা উচু করে দাঁড়াতে পারবে ভেতরে। কিছু কিছু অবশ্য কোমর সমান উচ্চতার। ওগুলোকে দেখে চৌকো বাক্স ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। কোনমতে ঘুমানোর জন্যেই যেন বানানো হয়েছে।
ঘরগুলোর বাইরে কিছু প্লাস্টিকের লন্ড্রি হ্যাঙ্গার দেখা যাচ্ছে। এছাড়াও ছন্নছাড়া মানুষের বসবাসের অন্য কিছু চিহ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এখানে সেখানে। একটা লোককে দেখা গেলো পানির পাশে রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁত ব্রাশ করছে। ইশিগামি আগেও খেয়াল করেছে তাকে। বয়স কমসে কম ষাট হবে। ধূসর চুল লম্বা পনিটেইল করে বাঁধা। মনে হয় না লোকটা কোন কাজ করে, না-হলে এই সময়ে এখানে থাকতো না। কারণ ছোটখাটো যত কায়িক শ্রমের কাজ আছে সব সকাল সকালই শুরু হয়ে যায়। ওগুলোতে কর্মসন্ধানিদের ভিড়ও থাকে প্রচুর। বেকার সংস্থার যে অফিস আছে সেখানেও এ যাবে না। কোন চাকরির সন্ধান পেলেও ইন্টারভিউতেই তাকে বাদ দিয়ে দেবে এই লম্বা চুল দেখে। আর বয়সটাও বাড়তির দিকে।
আরেকজন লোককে তার ঘরের পাশে দেখা গেলো। পা দিয়ে কতগুলো টিনের ক্যান পিষছে সে। ইশিগামি এর নাম দিয়েছে ‘ক্যান- মানব।’ ক্যান-মনবের বয়স পঞ্চাশের আশেপাশে হবে। তার কাপড়চোপড়গুলো অন্যদের তুলনায় বেশ ভালো। একটা সাইকেলও আছে। সাইকেল নিয়ে ক্যান সংগ্রহ করার কাজ অন্যদের তুলনায় একটু ব্যস্তই রাখে তাকে। তার ঘরটা ব্রিজের একদম নিচে, একটা সুবিধাজনক অবস্থানে। এখানকার সবচেয়ে পুরনো বাসিন্দাদের একজন সে।
কার্ডবোর্ডের শ্যান্টিগুলোর একটু দূরে একটা বেঞ্চে এক লোক বসে আছে। তার পরনের কোটটা একসময় নিশ্চয়ই হলুদ রঙের ছিল কিন্তু এখন সেটা দেখে আর বোঝার উপায় নেই। মলিন হয়ে গেছে, জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া। ওটার নিচে আবার একটা সাদা রঙের শার্ট পরে আছে সে। ইশিগামির ধারণা, তার পকেটে খুঁজলে হয়তো একটা টাইও পাওয়া যাবে। তার নাম সে দিয়েছে ইঞ্জিনিয়ার। কারণ কিছুদিন আগে একটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল টেড ম্যাগাজিন গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ছিল সে। বেকার সংস্থাতে হয়তো যেতে পারে, কিন্তু তার আগে তার এই গভীর আত্মসম্মানবোধটা ঝেড়ে ফেলতে হবে। এখনও সে নদীর পাড়ে এভাবে উদ্বাস্তু জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেনি। ঐ নীল রঙের ভিনাইল শিটের ঘরগুলোর বাসিন্দাদের তুলনায় নিজেকে উচ্চপর্যায়ের ভেবে অভ্যস্ত সে। তবুও তাকে এখানেই থাকতে হচ্ছে নিয়তির নির্মম খেলায়।
ইশিগামি সামনের দিকে হাটতে থাকলো। কিয়োসু ব্রিজের একটু আগে এক মহিলার সাথে দেখা হলো তার। তিনটা ছোট জাতের কুকুর নিয়ে হাটতে বের হয়েছেন তিনি। কুকুর তিনটার গলায় আবার তিন রঙের কলার। লাল, সবুজ আর গোলাপি। সে আরো সামনে এগোতে মহিলাও লক্ষ্য করলো তাকে। সুন্দর করে একটা হাসি দিয়ে মাথা নেড়ে বলল, “গুড মর্নিং।”
“গুড মর্নিং,” ইশিগামিও মাথা নেড়ে জবাব দিলো।
“বেশ ঠান্ডা আজকে, তাই না?”
“জি, বেশ ঠান্ডা,” ইশিগামি বলল।
এরপর আর কথা না বাড়িয়ে বিদায় জানিয়ে চলে গেলেন মহিলা।
কিছুদিন আগে ইশিগামি তাকে দেখেছিল একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ হাতে নিয়ে যেতে। কয়েকটা স্যান্ডউইচ ছিল ওটাতে। ওনার সকালের নাশতা হবে হয়তো। তার ধারণা মহিলা একাই থাকেন। এখান থেকে বেশি দূরে নয় তার বাসা। কারণ তার পরনে ছিল ঘরে পরার স্যান্ডেল। ওগুলো পরে
কোনভাবেই গাড়ি চালানো সম্ভব নয়। তার স্বামী হয়তো বেশ কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। এই তিনটা কুকুর নিয়েই একটা অ্যাপার্টমেন্টে বাস করেন তিনি।
কিয়োসু ব্রিজের গোড়ায় এসে ইশিগামি সিঁড়ি বেয়ে উপরে রাস্তায় উঠে গেলো। স্কুলটা ব্রিজের ওপাশেই। কিন্তু ঘুরে বিপরীত দিকে হাটা শুরু করলো সে।
রাস্তার পাশে একটা সাইনবোর্ড, সেখানে লেখা : বেন্টেন-টেই। ওটার নিচে একটা ছোট দোকানে বক্স-লাঞ্চ বিক্রি করা হয়। ইশিগামি কাঁচের দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেলো।
“গুড মর্নিং, আসুন আসুন,” একটা পরিচিত কণ্ঠ অভ্যর্থনা জানালো তাকে। শুনে প্রতিবারই কেমন যেন একটা অনুভূতি হয় ইশিগামির। ইয়াসুকো হানাওকা কাউন্টারের পেছন থেকে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। তার মাথায় একটা সাদা রঙের হ্যাট।
ভেতরে অন্য কোন কাস্টমার না দেখে আরো বেশি ভালো লাগলো ইশিগামির। তারা দু-জন বাদে আর কেউ নেই।
“আমি একটা স্পেশাল লাঞ্চ নেবো।”
“একটা স্পেশাল লাঞ্চ। নিশ্চয়ই,” উৎসাহি গলায় বলল ইয়াসুকো। মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করতে ব্যস্ত ইশিগামি অবশ্য তার চেহারা দেখতে পাচ্ছে না এ মুহূর্তে। তার মনে হচ্ছে কিছু একটা বলা উচিত। হাজার হলেও তারা প্রতিবেশি। পাশাপাশি ফ্ল্যাটেই থাকে। কিন্তু বলার মত কিছুই আসলো না মাথায়।
“আজকে বেশ ঠান্ডা, তাই না?” অবশেষে বলল সে। কিন্তু অন্য একজন কাস্টমার ঠিক এই সময়টাতেই ভেতরে ঢোকায় তার কথাটা ইয়াসুকোর কান অবধি পৌঁছুল না। তার সমস্ত মনোযোগ এখন নতুন কাস্টমারের দিকে।
লাঞ্চের বক্সটা হাতে নিয়ে দোকান থেকে বের হয়ে গেলো ইশিগামি। এবার সোজাসুজি স্কুলের দিকে। বেন্টেন-টেই’তে তার ভ্রমণের আজকের মত এখানেই পরিসমাপ্তি।
X
সকালের কর্মব্যস্ততা এখন একটু কমে এসেছে বেন্টেন-টেই’তে। অন্তত দোকানের সামনের দিকে। পেছনে অবশ্য লাঞ্চ তৈরির কাজ চলছেই। স্থানিয় কিছু কোম্পানিতে দুপুরের খাবার সরবরাহ করতে হয় বারোটার সময়, তাই কাস্টমারদের আসা কমে গেলে ইয়াসুকো পেছনে গেলো একটু হাত লাগাতে।
বেন্টেন-টেই’তে চারজন কর্মচারি। ইয়ানোজাওয়া হচ্ছে ম্যানেজার। তাকে সাহায্য করে তার স্ত্রী সায়োকো। ক্যানকোর কাজ হচ্ছে সাইকেলে করে লাঞ্চ বক্স বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করা। পার্ট-টাইম চাকরি তার। দোকানে আগত কাস্টমারদের সামলায় ইয়াসুকো।
এখানে কাজ করার আগে ইয়াসুকো কিনশিকোর এক নাইটক্লাবে কাজ করতো। সায়োকো ছিল ক্লাবের মেয়েদের প্রধান। ইয়ানোজাওয়া নিয়মিত যাওয়া আসা করতো সেখানে। অবশ্য সায়োকো চাকরি ছেড়ে দেয়ার আগপর্যন্ত তাদের সম্পর্কের কথাটা ইয়াসুকো জানতো না।
“সে এই ক্লাবের কাজ ছেড়ে ভদ্রমহিলাদের মত লাঞ্চশপে কাজ করতে চায় এখন,” ইয়ানোজাওয়া বলেছিল তাকে। “তোমার কি বিশ্বাস হয় এ কথা?”
তারা চলে যাওয়ার পরে অবশ্য ইয়াসুকো শুনেছিল, এরকম একটা লাঞ্চশপ দেয়ার স্বপ্ন তাদের অনেক দিনের। এজন্যেই সায়োকো ক্লাবে চাকরি করতো, টাকা জমাতো সে।
বেন্টেন-টেই খোলার পরে ইয়াসুকো এখানে দু-একবার এসেছিল দেখা করতে ওদের সাথে। ব্যবসা ভালোই চলছিল। এতটাই ভালো যে একবছর পরে তারা তাকে জিজ্ঞেস করে, সে এখানে তাদের সাথে কাজ করতে আগ্রহি কিনা। দু-জনের পক্ষে সামাল দেয়াটা নাকি খুবই কঠিন হয়ে উঠছিল।
“নাইটক্লাবের এই কাজটা তো তুমি সারাজীবন করতে পারবে না, ইয়াসুকো,” সায়োকো তাকে বলেছিল। “তাছাড়া মিশাতোও বড় হচ্ছে। তার মা নাইটক্লাবে কাজ করে এটা তাকে স্কুলের বন্ধুবান্ধবদের কাছে একটু হলেও হেয় করবে, তাই না? অবশ্য এটা সম্পূর্ণ তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।”
মিশাতো হচ্ছে ইয়াসুকোর একমাত্র মেয়ে। পাঁচবছর আগে ইয়াসুকোর দ্বিতীয়বারের মত ডিভোর্স হয়ে যায়। সায়োকো না বললেও এটা সে জানতো, নাইটক্লাবের কাজটা তার পক্ষে আর বেশিদিন করা সম্ভব হবে না, কারণ মিশাতোর ব্যাপারটা ছাড়াও তার নিজের বয়সের কথাটাও লক্ষ্য রাখতে হবে।
একদিনের মধ্যেই সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, কি করবে। ক্লাবও তাকে ধরে রাখতে চায়নি। তার নতুন কাজের জন্যে শুভকামনা জানিয়েই বিদায় দিয়েছিল ওরা। ওখানে অনেকেই জানতো, ভবিষ্যতে তাকে একসময় ক্লাব ছাড়তেই হত।
ইয়াসুকোরা গত বছরের বসন্তের সময় তাদের পুরনো বাসাটা ছেড়ে দিয়ে নতুন বাসায় ওঠে। আর মিশাতোও তখন জুনিয়র হাইস্কুলে ভর্তি হয়। তাদের আগের বাসাটা তার নতুন কর্মস্থল থেকে একটু বেশিই দূরে ছিল। কিন্তু তাকে একদম সময়মতো নতুন কাজের জায়গায় আসতে হয়। সেজন্যে প্রতিদিন সকাল সাড়ে ছটায় রওনা দেয় সবুজ বাইসাইকেলটা করে।
“হাইস্কুলের টিচার ভদ্রলোক কি আবার এসেছিল আজকে?” সায়োকো বিরতির সময় তাকে জিজ্ঞেস করলো।
“সে তো প্রতিদিনই আসে,” ইয়াসুকো কোনকিছু না ভেবেই উত্তর দিলো। একটু পর হাসির শব্দ শুনে সায়োকোর দিকে তাকিয়ে দেখে, সে নিঃশব্দে হাসার চেষ্টা করছে। তবে খুব একটা সফল যে হচ্ছে না তা বোঝাই যাচ্ছে। “কি? এতে এত হাসির কি আছে?”
“আরে, কিছু না। মানে, আমরা সেদিন আলাপ করছিলাম তার ব্যাপারে,” সায়োকো বলল।
“কি আলাপ করছিলে?”
“আমাদের মনে হয় সে তোমাকে পছন্দ করে,” এই বলে সায়োকো আবারো হাসতে লাগলো।
“কি?!” চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে সোজা হয়ে গেলো সে।
“তোমার তো কাল ছুটি ছিল, তাই না? সে কিন্তু কাল আসেনি। তোমার কাছে কি ব্যাপারটা একটু হলেও অদ্ভুত মনে হচ্ছে না, তুমি থাকলে
সে আসে আর না থাকলে আসে না।
“আমার মনে হয় ব্যাপারটা নিছক কাকতালিয় ঘটনা ছাড়া আর কিছু না।”
“কিন্তু আমার কাছে সেরকমটা মনে হয় না,” সায়োকো তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল।
ইয়ানোজাওয়াও মাথা নেড়ে সায় জানালো এবার। “বেশ কয়েকদিন ধরেই কিন্তু এমনটা চলছে। তোমার ছুটির দিনগুলোতে সে আসে না। আমি আগেও ভেবেছি ব্যাপারটা নিয়ে। কিন্তু কালও যখন এলো না তখন আমি একরকম নিশ্চিত হয়ে গেছি।”
“কিন্তু আমার তো নির্ধারিত কোন ছুটির দিন নেই। যেদিন কোন কারণে দোকান বন্ধ থাকে সেদিনগুলোতেই কেবল আমি বাদ দেই।”
“এজন্যেই তো ব্যাপারটা আরো বেশি সন্দেহজনক,” সায়োকো একবার চোখ টিপ দিয়ে বলল। “সে তো তোমার পাশেই থাকে। আমার ধারণা সে তোমাকে প্রতিদিন কাজে বের হবার সময় দেখে। এজন্যেই সে জানে, কোন্ দিনগুলোতে তুমি এখানে আসো না।”
“কিন্তু আমি তো তাকে কোনদিন বের হবার সময় দেখিনি। একবারও না,” ইয়াসুকো মাথা নেড়ে বলল।
“তাহলে হয়তো অন্য কোনও জায়গা থেকে তোমার উপর নজর রাখে সে। জানালা দিয়ে হতে পারে।”
“আমার মনে হয় না তার জানালা দিয়ে আমাদের বাসার দরজাটা দেখা যায়।”
“যাই হোক না কেন, সে যদি তোমার প্রতি আসলেও দূর্বল হয়ে থাকে, তাহলে আজ নয়তো কাল সেটা তোমাকে বলবেই,” ইয়ানোজাওয়া বলল। “আসলে আমাদের দেখার বিষয় হচ্ছে, তোমার জন্যে আমরা একজন নিয়মিত কাস্টমার পেয়েছি। তা সেটা যে কারণেই হোক না কেন। কিনশিকোতে তোমার ট্রেইনিং কিছুটা হলেও কাজে লাগছে।”
ইয়াসুকো একটা শুকনো হাসি দিয়ে বাকি চাটুকু খেয়ে নিলো। মনে মনে স্কুল টিচারটার কথা ভাবছে সে।
তার নাম ইশিগামি। নতুন বাসায় ওঠার দিন তার সাথে একবার পরিচিত হতে গিয়েছিল ওরা। তখনই সে জানতে পারে, ভদ্রলোক একজন হাই-স্কুল টিচার। পেটানো শরীর, চোখগুলো গোলগোল, মুখের তুলনার একটু বেশিই ছোট। চুল খানিকটা পাতলা হয়ে এসেছে। তাই তাকে দেখে পঞ্চাশ বছরের কাছাকাছি বলে মনে হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার বয়স আরো কম হবে। পোশাক আশাক নিয়েও অতটা সচেতন বলে মনে হয়নি তাকে। এই শীতে লাঞ্চ কিনতে আসার সময় ইয়াসুকো তাকে একই কোট পরতে দেখেছে প্রতিবার। আর নিজের কাপড়চোপড় নিজেই ধুয়ে বারান্দায় শুকাতে দেন। ইয়াসুকোর ধারণা, ভদ্রলোক চিরকুমার
সে মনে মনে বের করার চেষ্টা করলো ইশিগামি আসলেও তাকে কোনদিন আকার ইঙ্গিতে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করেছে কিনা। কিন্তু সেরকম কিছু মনে পড়লো না। আসলে ইয়াসুকোর কাছে ইশিগামিকে দেয়ালের একটা ফাঁটলের চেয়ে বেশি কিছু মনে হয় না। অবচেতন মনে সে জানে, ওটা ওখানে আছে। কিন্তু কোনদিন বিশেষভাবে মনোযোগ দেয়ার প্রয়োজনবোধ করেনি।
যতবারই দেখা হয়েছে তাদের প্রতিবারই হালকা কুশল বিনিময় হয়েছে। একবার শুধু অ্যাপার্টমেন্টের ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলাপ হয়েছিল। কিন্তু ওটুকুই। আর কিছু না। ইয়াসুকো আসলে লোকটা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না। এই সেদিন তার বাসার বাইরে পুরনো এক বান্ডিল গণিতের বই দেখে বুঝতে পেরেছে ভদ্রলোক আসলে গণিতের শিক্ষক।
ইয়াসুকো চায় না সে তাকে কোনপ্রকার প্রস্তাব দিক। এটা ভেবে নিজমনেই একবার হেসে উঠলো। ওরকম কিছু করার সময় লোকটার চেহারা কেমন হবে সেটা ভেবে মজাই লাগছে তার।
প্রতিদিনের মতই দুপুরের আগেই বেন্টেন-টেই’তে ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেলো। একটা নাগাদ চলল এরকম। তারপর কাজের চাপ একটু কমতে শুরু করলো।
ক্যাশ রেজিস্টারে হিসেব মিলাচ্ছিল ইয়াসুকো এ সময়ে কাঁচের দরজাটা খুলে কেউ ভেতরে ঢুকলো। “আসুন আসুন,” অভ্যাসবশত কথাটা বলে আগুন্তুকের দিকে তাকিয়েই জমে গেলো সে। কথা আটকে গেলো গলায়।
“বাহ্, সুন্দর দেখাচ্ছে তো তোমাকে,” লোকটা হাসতে হাসতে বলল। কিন্তু ঐ হাসির মধ্যেও যেন অশুভ কিছু একটা আছে।
“তুমি… তুমি আমাকে কিভাবে খুঁজে পেলে?”
“এত অবাক হওয়ার কী আছে? আমার আগের বউ কোথায় কাজ করছে এটা তো আমি চাইলেই খোঁজ নিয়ে বের করতে পারি,” দোকানের চারপাশে নজর বুলাতে বুলাতে বলল লোকটা। হাতদুটো তার কোটের পকেটে ঢোকানো। হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, অন্যসব কাস্টমারদের মতই লাঞ্চ কিনতে এসেছে যেন।
“কিন্তু কেন? এখন কেন?” ইয়াসুকো নিচু কিন্তু তীক্ষ্ণ স্বরে জিজ্ঞেস করলো। সে চায় না ভেতরের কেউ তাদের কথা শুনে ফেলুক।
“এত ভয় পেয়ো না। তোমার সাথে আমার সেই কবে শেষ দেখা হয়েছে বলো তো? একটা হাসি তো দিতে পারতে আমাকে দেখে।”
রাগে ইয়াসুকোর গা জ্বলে উঠলো, “তুমি যদি আমার সাথে এই ফালতু প্যাচাল পারতে এখানে এসে থাকো তবে বলবো, এখনই এখান থেকে বিদেয় হও। সময় বেঁচে যাবে।”
“আসলে আমি এখানে এসেছি একটা কারণে। একটু সাহায্য দরকার আমার। বেরুতে পারবে তুমি?”
“বোকার মত কথা বোলো না। দেখছো না আমি কাজে ব্যস্ত এখন?” কথাটা বলেই ইয়াসুকো পস্তাতে লাগলো। শুনে মনে হচ্ছে, কাজ না থাকলে সে ঠিকই কথা বলতো ওর সাথে।
“তোমার ছুটি হবে কখন?”
“যখনই হোক না কেন, আমি তোমার সাথে কোন কথা বলতে চাই না। দয়া করে এখান থেকে চলে যাও।”
“চলে যাবো?!”
“কি আশা করেছিলে তুমি?”
ইয়াসুকো একজন কাস্টমারের আশায় বাইরে তাকালো, কিন্তু কাউকে দেখা গেলো না দরজার সামনে।
“ঠিক আছে। সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল কিভাবে বাঁকা করতে হয় জানা আছে আমার,” লোকটা বলল।
“কি বলতে চাও তুমি?”
“মানে, আমার বউ যদি আমার সাথে কথা না বলতে চায়, তার মেয়ে তো অবশ্যই বলবে। ওর স্কুল খুব কাছেই, তাই না?”
“ওকথা মাথাতেও এনো না।”
“আমাকে সাহায্য করো, তাহলে আর মেয়েকে ঘাঁটাবো না।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইয়াসুকো বলল, “আমার ছ-টা পর্যন্ত কাজ করতে হবে।”
“সেই সকাল থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত? এতক্ষণ কাজ করতে হয় প্রতিদিন?”
“সেটা তোমার দেখার বিষয় নয়।”
“ঠিক আছে। আমি তাহলে ছ-টার সময় আবার আসবো।”
“না, এখানে না। দোকান থেকে বের হয়ে ডানের রাস্তা ধরে কিছুটা হাটলে একটা রেস্তোরাঁ দেখতে পাবে। ওখানেই থেকো সাড়ে ছটার সময়।”
“ঠিক আছে। এসো কিন্তু, না হলে…”
“আমি আসবো। এখন যাও এখান থেকে।”
“যাচ্ছি যাচ্ছি। এতবার বলতে হবে না,” লোকটা আশেপাশে আরেকবার দেখে বের হয়ে গেলো দোকান থেকে।
সে বের হওয়ামাত্র ইয়াসুকো মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। কেমন যেন বমি বমি লাগছে তার। মনে হচ্ছে বুকের ভেতরে কিছু একটা দলা পাকিয়ে আসছে।
শিনজি টোগাশির সাথে তার বিয়েটা হয়েছিল আট বছর আগে। সেসব কাহিনী আবার মনে পড়ে গেলো তার…
ইয়াসুকো যখন আকাসাকার এক নাইটক্লাবে হোস্টেস হিসেবে কাজ করতো তখন তার সাথে দেখা হয়েছিল প্রথম। টোগাশি নিয়মিত সেখানে যেত। পেশায় একজন বিদেশি গাড়ি বিক্রেতা ছিল সে। ব্যাপক কামাতো আর দেদারসে খরচ করতো। সে খরচের খাতায় ইয়াসুকোর নামও ছিল। তাকে নিয়ে দামি দামি সব রেস্তোরাঁয় যেত, চমৎকার সব উপহার দিত। যখন টোগাশি তাকে প্রোপোজ করেছিল, ইয়াসুকোর নিজেকে প্রিটি ওমেন সিনেমার জুলিয়া রবার্টস বলে মনে হয়েছিল। প্রথম বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর একা একটা মেয়েকে নিয়ে বাস করতে করতে ক্লান্ত হয়ে উঠেছিল সে।
শুরুতে সব ঠিকই ছিল। টোগাশি কামাই ভালোই করতো, তাই ইয়াসুকোকেও আর ক্লাবে কাজ করতে হত না। আর মিশাতোর সাথেও তার কোন সমস্যা ছিল না। মিশাতো তাকে অনেকটা বাবার মতই মনে করতো।
কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই যেন সব ওলট-পালট হয়ে গেলো। টোগাশিকে তার কোম্পানি থেকে বের করে দেয়া হলো ফান্ডের টাকা মেরে দেবার জন্যে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোন মামলা করেনি কোম্পানির পক্ষ থেকে, কারণ তাতে করে তাদের নিজেদের সুনাম নষ্ট হবার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু একটা বিষয় পরিস্কার হয়ে যায় এতে, আকাসাকাতে সে যে টাকা ওড়াতো তা এই চুরি করা পয়সা থেকেই আসতো।
এরপরেই বদলে গেলো টোগাশি। আসলে বদলে গেলো না-বলে বলা উচিত, তার আসল চেহারটা বের হয়ে আসলো। যেদিন সে জুয়া খেলতে বাইরে যেত না সেদিন সারাদিন বাসায়ই শুয়ে থাকতো। ইয়াসুকো কিছু বললেই তার সাথে খারাপ ব্যবহার করা শুরু করতো সে। একপ্রকার বাধ্য হয়েই ইয়াসুকোকে আবার ক্লাবের কাজে ফিরে যেতে হয়। এরপর আরো বেশি করে মদ খাওয়া শুরু করলো টোগাশি। চোখদুটো লাল হয়ে থাকতো সবসময়।
ইয়াসুকো যা কামাই করতো তা তার কাছ থেকে কেড়ে নিত টোগাশি। আর যখন থেকে সে টাকা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করলো, তখন বেতনের দিন ক্লাবে হাজির হয়ে যেত, লুকানোর আগেই তার কাছ থেকে জোর করে নিয়ে নিত টাকাগুলো।
মিশাতোও তার সৎবাবাকে ভয় পাওয়া শুরু করে। একা একা বাসায় থাকতে তার ভালো লাগতো না। এমনকি সে মাঝে মাঝে ইয়াসুকোর ক্লাবে গিয়ে বসে থাকতো, যাতে ঐ লোকটার সাথে সময় কাটাতে না হয় তাকে।
ইয়াসুকো বেশ কয়েকবার টোগাশিকে ডিভোর্সের কথা বললেও সে কানেই তুলতো না সে কথা। সে যখন চাপ দিতে থাকলো ব্যাপারটা নিয়ে তখন তার গায়ে হাত তোলা শুরু করলো টোগাশি। এরকম কয়েক মাস অত্যাচার সহ্য করার পর শেষে আর থাকতে না পেরে একজন আইনজীবির শরণাপন্ন হয় ইয়াসুকো। তারই ক্লাবের এক কাস্টমার এই আইনজীবির খোঁজ দেয়। সেই আইনজীবির সহায়তায় অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে টোগাশির হাত থেকে মুক্তি পায় সে। আর টোগাশিও বুঝতে পেরেছিল, ব্যাপারটা আদালত পর্যন্ত গেলে তারই ক্ষতি হবে, বেশ মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে তাকে।
কিন্তু এই ডিভোর্সের পরেও সমস্যার সমাধান হয়নি। টোগাশি পরের মাসগুলোতেও ইয়াসুকো আর তার মেয়েকে জ্বালাতেই থাকলো। বলতো, নিজেকে বদলানোর চেষ্টা করছে সে, চাকরিও খুঁজছে। ইয়াসুকো যেন আবার তার কাছে ফিরে আসে। একটা সুযোগ দেয়।
ইয়াসুকো জানত এগুলো সবই অভিনয়। কিন্তু এতবার লোকটাকে ওভাবে দেখে একটু মায়াই লাগে তার। কিছু টাকা দেয় তাকে।
সেটা ছিল মস্ত বড় একটা ভুল। টোগাশি একবার যখন টাকার গন্ধ পেয়ে গেলো তখন বার বার আসতে থাকলো। প্রতিবারই এসে অভিনয় করে টাকা চাইতো নির্লোজ্জের মত। আর টাকার পরিমাণটাও বেড়ে যেত প্রতিবার।
বাধ্য হয়ে বেশ কয়েকবার ক্লাব বদলে ফেলতে হয় ইয়াসুকোকে, সেই সাথে বাসাও। আর মিশাতোকেও এক স্কুল থেকে আরেক স্কুলে বদলি করতে হত প্রতিবার। কাজটা একরকম ইচ্ছের বিরুদ্ধেই করতো সে। এরকম করতে করতে এক পর্যায়ে টোগাশির আসা বন্ধ হয়ে যায়। এর এক বছর পর বেন্টেন-টেই তে কাজ নেয় সে। এবার তার মনে হয়েছিল আপদ বোধহয় আসলেও পিছু ছেড়েছে।
ইয়ানোজাওয়াদের কোনভাবেই তার আগের স্বামীর আগমনের কথা জানানো যাবে না। শুধু শুধু চিন্তা করবে তারা। মিশাতোকেও জানানো যাবে না। আর তাকে এ ব্যাপারটা নিশ্চিত করতে হবে, টোগাশি যাতে আর কখনো না ফেরত আসে। একটু পর পর ঘড়ির দিকে সময় দেখতে থাকলো ইয়াসুকো।
সাড়ে ছটার আগ দিয়ে সে দোকান থেকে বের হয়ে রেস্তোরাঁর উদ্দেশ্যে রওনা দিলো, গিয়ে দেখলো টোগাশি আগে থেকেই সেখানে বসে আছে। জানালার পাশে একটা টেবিলে বসে সিগারেট টানছে। সামনে এক কাপ কফি রাখা। ইয়াসুকোও এক কাপ গরম কফির অর্ডার দিয়ে বসে পড়লো টেবিলে। অন্য সময় হলে হালকা কিছু পান করা যেত, কিন্তু আজকের জন্যে এটাই ঠিক আছে। বেশিক্ষণ সময় কাটানোর ইচ্ছে নেই তার।
“তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, খুব তাড়া আছে,” একটা বাঁকা হাসি দিয়ে বলল টোগাশি।
“আমার অনেক কাজ পড়ে আছে। তোমার যদি আসলেও বলার মত কিছু থেকে থাকে তো এখনই বলো।”
“ইয়াসুকো—” এটা বলে তার হাতটা ধরার চেষ্টা করলো টোগাশি। তাড়াতাড়ি সেটা সরিয়ে নিলো সে। “তোমার মেজাজ খারাপ দেখি।”
“কেন খারাপ হবে না? আশা করি একটা ভালো কারণ আছে তোমার এখানে আসার।“
“এতটা ভাব না দেখালেও চলবে। আমাকে দেখে মনে হচ্ছে না হয়তো, কিন্তু আমি ব্যাপারটা নিয়ে বেশ সিরিয়াস।”
“কোন ব্যাপারটা নিয়ে?”
এই সময় ওয়েটার কফি দিয়ে গেলে ইয়াসুকো কাপটা নিয়ে বড় একটা চুমুক দিলো। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বের হয়ে যেতে হবে তাকে।
“তোমাকে তো একা একাই সব সামলাতে হচ্ছে, তাই না?”
“তো? তাতে তোমার কি?”
“একা একজন মহিলার পক্ষে একটা সন্তান লালন-পালন করা বেশ কঠিন, কারণ দিন দিন খরচ বাড়তেই থাকবে। আর ঐ লাঞ্চের দোকানটাতে কাজ করে কতই বা পাও তুমি? ওটা দিয়ে তো আর মিশাতোর ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে পারবে না। আমি চাই তুমি আমাদের ব্যাপারটা নিয়ে আবার ভাবো। আমি বদলে গেছি, আগের মত নেই আর।”
“কি বদলে গেছে? কোন কাজে ঢুকেছো?”
“ঢুকবো। একটার খোঁজ পেয়েছি।”
“কিন্তু এখন তো কিছু করছো না, তাই না?”
“আমি বললাম তো খুব জলদিই শুরু করবো। আগামি মাস থেকে শুরু করার কথা। নতুন একটা কোম্পানি অবশ্য, কিন্তু সবকিছু ঠিকঠাকমত এগুলে তুমি আর তোমার মেয়ে কিন্তু আবার একটা নিশ্চিন্ত জীবনে ফিরে যেতে পারবে।”
“থাক, অনেক হয়েছে। ধন্যবাদ। তুমি যদি আসলেও এত কামাই করো তাহলে সেগুলো খরচ করার মত লোকেরও অভাব হবে না তোমার জীবনে। শুধু আমাদের সাথে আর যোগাযোগ করবে না।“
“ইয়াসুকো, তোমাকে আমার খুবই দরকার। বুঝতে পারছো না কেন?” টোগাশি আবারো হাত বাড়াল তার দিকে। “একদম ছোঁবে না আমাকে,” বলে হাতটা সরিয়ে নিলো ইয়াসুকো। কাপটাতে ধাক্কা লেগে সেটা থেকে অল্প একটু কফি ছলকে পড়লো টেবিলে। টোগাশির হাতেও পড়লো কিছুটা। “আউ” চেঁচিয়ে উঠল সে। সরিয়ে নিলো হাতটা। এবার যখন তাকালো ইয়াসুকোর দিকে তখন সে চোখদুটোতে তীব্র ঘৃণা।
ইয়াসুকোও একই দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো, “তোমার কি মনে হয়? এভাবে এসে মিনমিনিয়ে বলবে আর আমি বিশ্বাস করে নেবো তোমার কথা? তোমাকে হাড়ে হাড়ে চেনা হয়ে গেছে আমার। তোমার কাছে ফিরে যাবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও আমার নেই। তাই ওসব নিয়ে আর চিন্তাও করো না, ঠিক আছে?”
এই বলে উঠে দাঁড়াল সে। টোগাশি চুপচাপ ঠান্ডা চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো। সেটাকে পাত্তা না দিয়ে টেবিলে কফির বিলটা রেখে দরজার দিকে হাটা দিলো ইয়াসুকো।
রেস্তোরাঁ থেকে বের হয়েই সাইকেলটা নিয়ে কোনরকমে সেখান থেকে কেটে পড়লো সে। তার মনে হচ্ছে যেকোন সময়ে টোগাশি তার পিছু পিছু দৌড়ানো শুরু করতে পারে, তাই জোরে জোরে প্যাডেল মারতে শুরু করলো। সোজা কিয়োসুবাশি রোড ধরে ছুটে গেলো সে। এরপর কিয়োসু ব্রিজের পর বামে ঘুরে গেলো।
ইয়াসুকোর যা বলার ছিল তার সবটাই বলে দিয়েছে। কিন্তু তার সন্দেহ আছে টোগাশি এত সহজে পিছু ছাড়বে কিনা। দেখা যাবে সে আবার দোকানে এসে হাজির হয়েছে, কিংবা মিশাতোর স্কুলে। এভাবে একপর্যায়ে তাকে টাকা দিতে বাধ্য হবে সে।
অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে রাতের খাবার তৈরি করা শুরু করলো ইয়াসুকো। অন্যসময় কাজটা করতে ভালোই লাগে তার কিন্তু আজ কোনমতেই স্বাভাবিক হতে পারছে না। মাথায় বারবার টোগাশির ব্যাপারটা ঘুরছে।
মিশাতোরও স্কুল থেকে ফেরার সময় হয়ে গেছে। স্কুলের পর ব্যাডমিন্টন ক্লাবে অনুশীলন করে বাসায় ফিরতে ফিরতে সাতটা বেজে যায় প্রায়।
এ সময় কলিংবেল বেজে উঠলে ইয়াসুকোর ভুরু কুঁচকে গেলো। মিশাতোর কাছে তো চাবি আছে, তাহলে নিশ্চয় অন্য কেউ হবে।
“কে?” দরজা না খুলেই জিজ্ঞেস করলো সে।
কিছুক্ষণ নীরবতার পর জবাব এলো ওপাশ থেকে, “আমি।”
ইয়াসুকোর মুখ হা হয়ে গেলো। টলে উঠলো মাথা। হারামিটা তাদের বাসার ঠিকানা খুঁজে বের করে ফেলেছে। নিশ্চয়ই কোন একদিন কাজ থেকে ফেরার সময় পিছু নিয়েছিল।
টোগাশি আবার দরজায় নক করা শুরু করলো, “খুলছো না কেন?”
দরজার ছিটকানিটা খুলে দিলো সে। কিন্তু একটা চেইন বাঁধা আছে ঠিকই।
চার ইঞ্চির মত ফাঁক হলো দরজাটা কেবল। টোগাশির হাস্যোজ্জ্বল মুখটা দেখার জন্যে ওটুকুই যথেষ্ট।
“কেন এসেছো এখানে? চলে যাও।”
“আমার কথা শেষ হয়নি তখন। না, তোমার বদমেজাজি স্বভাবটা আর গেলো না।”
“আমি তো তোমাকে বলেছি, আমাদের মধ্যে আর কিছু হওয়া সম্ভব নয়।”
“আমার কথাটা শুনবে তো আগে! ভেতরে আসতে দাও।
“না। যাও এখান থেকে।”
“দেখো, যদি ঢুকতে না দাও তাহলে আমি এখানে দাঁড়িয়েই অপেক্ষা করতে থাকবো। মিশাতো এ সময়েই বাড়ি ফেরে। তোমার সাথে কথা না বলতে পারলে ওর সাথে কথা বলবো আমি।”
“ওকে এসবের মধ্যে জড়াবে না একদম।”
“তাহলে ভেতরে আসতে দাও আমাকে।”
“আমি পুলিশে খবর দেবো।”
“দাও। আমি তো কোন অপরাধ করিনি। আমার আগের বউয়ের সাথে দেখা করতে এসেছিমাত্র। পুলিশ এসে আমার পক্ষই নেবে। ‘ম্যাম, আপনার উচিত ওনাকে ভেতরে ঢুকতে দেয়া’-এমনটাই বলবে তারা।”
ইয়াসুকো তার ঠোঁট কামড়ে ধরলো। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, টোগাশি আসলে ঠিক কথাই বলছে। এর আগেও পুলিশ ডেকেছিল সে কিন্তু কোনবারই তাকে সাহায্য করেনি ওরা। তাছাড়া সে চায় না আশেপাশের লোকজনের কানে কিছু যাক। কারণ কোনপ্রকার ঝামেলা হওয়ামাত্র এখান থেকে বের করে দেয়া হবে তাদেরকে।
“ঠিক আছে। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারবে না।”
“আচ্ছা বাবা, আচ্ছা। খোলো তো আগে,” একটা বিজয়ির হাসি দিয়ে বলল টোগাশি।
ইয়াসুকো চেইনটা খুলে দিলে ভেতরে ঢুকে পড়লো সে। জুতো খুলে আশেপাশে তাকাতে লাগলো। ছোট একটা অ্যাপার্টমেন্ট। একটা শোবার ঘর, লিভিংরুম আর রান্নাঘর। দরজার কাছের ঘরটা জাপানিজ কায়দায় তৈরি। মেঝেতে ছয়টা তাতামি ম্যাট বিছানো। ওটার ডানদিকের দরজা দিয়ে রান্নাঘরে ঢোকা যায়। পেছনের দিকে এরকম আরেকটা ঘর আর ছোট একটা বারান্দা আছে।
“খারাপ না বাসাটা। একটু ছোট কিন্তু চলে,” টোগাশি বসতে বসতে মন্তব্য করলো। পা ভাঁজ করে বসেছে সে। ঘরের মাঝখানে একটা কোটাটসু হিটার টেবিল রাখা আছে। “তোমার হিটারটা দেখি বন্ধ করে রেখেছো, সেদিকে ইঙ্গিত করে বলল টোগাশি।
“আমি জানি তুমি এখানে কেন এসেছো। মুখে যা-ই বলো না কেন, শেষ পর্যন্ত কথা সেই একটাই—টাকা চাই তোমার।”
“কি বলতে চাও তুমি?” টোগাশি একটা সিগারেট বের করে মুখে দিতে দিতে বলল। আশেপাশে তাকিয়ে অ্যাশটে খুঁজলো কিন্তু চোখে পড়লো না। অগত্যা উঠে গিয়ে ময়লার বাক্স থেকে একটা ক্যান তুলে নিয়ে আবার বসে পড়লো সে।
“আমি বলতে চাই, তোমার এখানে আসার একমাত্র উদ্দ্যেশ্য হচ্ছে টাকা। টাকা চাই তোমার, তাই না?”
“যদি তুমি ব্যাপারটাকে এভাবেই দেখতে চাও তাহলে আমি আর কথা বাড়াবো না।”
“এক ইয়েনও পাবে না তুমি আমার কাছ থেকে।”
“তাই নাকি?” নাক দিয়ে একটা আওয়াজ করে বলল সে।
“চলে যাও এখান থেকে। আর কখনো আসবে না।”
এই সময় দরজা খুলে মিশাতো ভেতরে ঢুকলো। তার পরনে স্কুলের ইউনিফর্ম। দরজার কাছে একজোড়া জুতো দেখেই থেমে গেলো সে। এরপর ভেতরে তাকিয়ে দেখলো কে এসেছে। সাথে সাথে তার মুখের ভঙ্গি বদলে গেলো। চাপা একটা আতঙ্ক ভর করেছে সেখানে। ব্যাডমিন্টনের র্যাকেটটা হাত থেকে পড়ে গেলো।
“কি খবর মিশাতো? কেমন আছো? অনেক দিন দেখা হয় না তোমার সাথে। বড় হয়ে গেছো দেখছি,” টোগাশি শান্ত স্বরে বলল।
মিশাতো তার মা’র দিকে একবার তাকিয়ে কোন কথা না বলে ভেতরে গিয়ে সোজা তার ঘরে ঢুকে দরজাটা ঠেলে দিলো।
কিছুক্ষণ নীরবতার পর টোগাশি বলল, “আমি জানি না তুমি আমাকে কি মনে করো। কিন্তু এখানে আমি এসেছি যাতে আমাদের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যায়।”
“বলেছি তো, সেটার কোনই ইচ্ছে নেই আমার। তোমারও নিশ্চয়ই এটা মনে হয়নি তোমার প্রস্তাবে আমি হ্যা বলবো। আমাকে বিরক্ত করতেই এসেছো তুমি, আর কিছু না।“
কথাটা একদম জায়গামত গিয়ে লাগলেও কিছু বলল না টোগাশি। রিমোট হাতে নিয়ে টিভি চালু করে দিলো সে। কার্টুনের চ্যানেল ভেসে উঠলো পর্দায়।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রান্নাঘরে চলে গেলো ইয়াসুকো। সিঙ্কের নিচের ড্রয়ার খুলে ওয়ালেটটা বের করলো সে। দুটো দশহাজার ইয়েনের নোট হাতে নিলো।
“এটা নিয়ে বিদায় হও এখান থেকে,” কোটাটসু হিটারটার উপর টাকাগুলো রেখে বলল সে।
“এটা কি? আমি তো ভেবেছিলাম কোন টাকা-পয়সাই দেবে না তুমি আমাকে।”
“এটুকুই পাবে তুমি, আর না।”
“লাগবে না আমার।“
“কিছু না নিয়ে এখান থেকে বিদেয় হবে না তুমি। জানি, আরো টাকা দরকার তোমার। কিন্তু আমাদের অবস্থাও ভালো না এখন।”
টোগাশি একবার নোটগুলোর দিকে তাকিয়ে আবার ইয়াসুকোর মুখের দিকে তাকালো। “ঠিক আছে, যাচ্ছি। আমি কিন্তু চাইনি এগুলো। তুমি নিজে থেকেই দিয়েছো।”
টাকাগুলো নিয়ে পকেটে চালান করে দিলো সে। এরপর সিগারেটটা ক্যানে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল, কিন্তু দরজার দিকে না গিয়ে উল্টোদিকে মিশাতোর ঘরের ভেড়ানো দরজাটা খুলে ফেলল। ভেতর থেকে মেয়েটার চমকে ওঠার আওয়াজ পেলো ইয়াসুকো।
“কি করছো তুমি ওখানে?” চিৎকার করে জানতে চাইলো সে।
“আমি আমার সৎমেয়ের সাথে একটু কথা তো বলতে পারি, নাকি?”
“সে তোমার কিছুই হয় না।”
“তুমি পারোও। আচ্ছা, তাহলে যাচ্ছি আমি। ভালো থেকো মিশাতো,” ভেতর থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই বলল টোগাশি। সে এমনভাবে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে যে, ইয়াসুকো ভেতরের কিছু দেখতে পারছে না।
অবশেষে ফিরে দরজার দিকে রওনা দিলো টোগাশি। “একসময় ওর ফিগার আরো ভালো হবে,” বলল সে।
“কী সব ফালতু কথা বলছো তুমি?”
“ফালতু কথা না। আগামি তিনবছরের মধ্যে ভালো টাকাও কামাতে পারবে। যে কেউ ভাড়া করবে ওকে।’
“বেরিয়ে যাও এক্ষুনি।”
“যাচ্ছি, যাচ্ছি…অন্তত আজকের মত।”
“আর কখনো যাতে তোমার চেহারা না দেখি।”
“সেই কথা তো দিতে পারছি না, ডার্লিং।”
“মুখ সাম—”
“শোনো ইয়াসুকো,” টোগাশি না ঘুরেই বলল, “আমার হাত থেকে কখনোই নিস্তার পাবে না তুমি। কেন জানো? কারণ প্রতিবারই আমার সামনে হার মানতে হবে তোমাকে। প্রতিবার,” এই বলে জুতো পরতে শুরু করলো সে।
নির্বাক হয়ে গেলো ইয়াসুকো। এ সময় পেছন দিক থেকে একটা আওয়াজ কানে গেলো তার। ঘুরে দেখলো মিশাতো দৌড়ে যাচ্ছে তাকে পাশ কাটিয়ে। মাথার উপরে হাত দিয়ে কিছু একটা ধরে রেখেছে। টোগাশির পেছনে চলে গেলো সে। নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখা ছাড়া কিছু করার থাকলো না ইয়াসুকোর। ভয়ার্ত চোখে সে দেখলো মিশাতো তার হাতের জিনিসটা দিয়ে টোগাশির মাথার পেছনে জোরে বাড়ি দিলো। থপ্ করে একটা আওয়াজ হলো শুধু। সঙ্গে সঙ্গে মুখ থুবড়ে মেঝের উপর পড়ে গেলো টোগাশি।