অধ্যায় ৩
“এই যদি হয় তোমার মগজ খাটানোর নমুনা তবে সেটা নিয়ে গবেষণা করার দরকার আছে,” চিকন ফ্রেমের চশমাটা একপাশে সরিয়ে রাখতে রাখতে বলল মানাবু ইউকাওয়া। একবার হাই তুলল অলস ভঙ্গিতে। তার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে চশমাটা আর দরকার পড়বে না।
কথাটা আংশিক সত্যও বটে, কারণ কুসানাগি প্রায় বিশ মিনিট ধরে অসহায়ের মত দাবার বোর্ডের দিকে তাকিয়েই আছে। রাজাকে নিয়ে কোথায় পালাবে সেটা বুঝে উঠতে পারছে না। যেদিকেই যাক না কেন হারতেই হবে তাকে।
“আসলে দাবা খেলতে আমার অতটা ভালো লাগে না, সেটা তো তুমি জানোই,” কুসানাগি আস্তে করে বলল।
“হুহ, আবার শুরু করো না ওসব কথা,” ইউকাওয়া বলল ব্যঙ্গাত্মক সুরে।
“একটা জিনিস বোঝাও আমাকে। প্রতিপক্ষের যে সৈন্যগুলোকে মারলাম সেগুলোকে যদি আবার ব্যবহারই না করতে পারলাম তাহলে লাভ কি?”
“এখন আবার খেলার নিয়ম কানুনকে দোষারোপ করা শুরু করো না। সৈন্যগুলোকে তো মেরেই ফেলেছো তুমি। তা, মরা সৈন্য কি কাজে লাগবে, শুনি?”
“কিন্তু শোগি খেলায় তো এমনটা করা যায়।“
“সেটা শোগি যে লোকটা আবিষ্কার করেছে তার ব্যাপার। শোগিতে সৈন্যদের মেরে ফেলা হয় না, তাদেরকে বন্দি করা হয় মাত্র। এজন্যেই আবার ব্যবহার করতে পারো।”
“দাবা খেলাতেও এমন নিয়ম চালু করা উচিত।”
“এসব খোড়া অজুহাত দেখানো বন্ধ করে যুক্তি দিয়ে নিজের অবস্থার কথা চিন্তা করো। একবারই গুটি চালানোর সুযোগ পাবে তুমি। আর তোমার এমন গুটি কমই আছে এমুহূর্তে যেগুলো নড়াতে পারবে। যা-ই করো না কেন, পরের দানেই কিস্তিমাত হয়ে যাবে।”
“হার মানছি আমি,” কুসানাগি বলল। “দাবা খুব বোরিং খেলা।”
“তোমার জন্যে হতে পারে, আমার জন্যে নয়,” ইউকাওয়া দেয়ালের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল। “বিয়াল্লিশ মিনিট ধরে খেলছি আমরা। আর এর মধ্যে বেশিরভাগ সময়ই তুমি চিন্তা করেছো বসে বসে। তোমার মত একজন লোক নষ্ট করার মত এত সময় পায় কিভাবে? তোমার ঐ রাগি বস্ কিছু বলে না?”
“না, ঐ খুনটার পরে তেমন কিছু হাতে আসেনি এখনও, “ কুসানাগি তার কফির মগের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল। ইউকাওয়া তাকে যে ইন্সট্যান্ট কফি বানিয়ে দিয়েছিল সেটা পুরোপুরি ঠান্ডা সরবত হয়ে গেছে এতক্ষণে।
ইম্পেরিয়াল ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ১৩ নম্বর ল্যাবে এ মুহূর্তে ইউকাওয়া আর কুসানাগি ছাড়া আর কেউ নেই। ছাত্রছাত্রিরা সবাই অন্য ক্লাসে ব্যস্ত এখন। এজন্যেই কুসানাগি এসময়টাতে এসেছে এখানে।
কুসানাগির ফোনটা বেজে উঠলো। ইউকাওয়া তার সাদা ল্যাব কোটটা পরতে পরতে বলল, “তোমার কথা ঠিকই মনে আছে ওদের।”
ফোনের ডিসপ্লেতে নজর বুলিয়েই ভুরু কুঁচকে ফেলল সে। ইউকাওয়া ঠিকই বলেছে। ডিপার্টমেন্ট থেকে এক জুনিয়র ডিটেক্টিভ ফোন দিয়েছে।
X
ক্রাইম-সিনটা টোকিওর পুরনো এডোগাওয়া নদীর পাশেই, পানি শোধনাগার থেকে খুব একটা দূরে নয়। নদীর ওপাশেই চিবা ওয়ার্ড। লাশটা ওদিকে ফেললে কি হত? কুসানাগি কোটের কলারটা উঠিয়ে দিলো ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচার জন্যে।
লাশটা পাওয়া গেছে নদীর পাশের ঢালু জায়গাটাতে। একটা নীল রঙের প্লাস্টিকের শিটে মোড়ানো। সাধারণত ফ্যাক্টরিতে ব্যবহার করা হয় এমন শিট।
একজন বুড়োমত লোক আবিষ্কার করেছে ওটা। সকালে জগিং করতে বেরিয়ে নদীর পাশে নীল শিটে মোড়ানো লাশটা দেখতে পান তিনি। আসলে পর্দা থেকে বের হয়ে থাকা পা’দুটো চোখে পড়ে তার।
“যে লাশটা আবিষ্কার করেছে তার বয়স কত হবে? পঁচাত্তর? এই শীতের দিনেও জগিং করতে বের হয়েছিলেন তিনি! লাশটা দেখার পরে বেচারার কি অবস্থা হয়েছিল কে জানে।”
জুনিয়র ডিটেক্টিভ কিশিতানি সবার আগে ক্রাইম-সিনে এসেছে। সে-ই সবকিছু খুলে বলেছে কুসানাগিকে। এখনও ভুরু কুঁচকে আছে সে। লম্বা কোটটা বাতাসে উড়ছে।
“কিশি, লাশটা দেখেছো তুমি?”
“হ্যা,” মুখ বাঁকিয়ে উত্তর দিলো কিশিতানি। “চিফ আমাকে ভালোমত দেখতে বলেছিলেন লাশটা।”
“কারণ তিনি নিজে দেখতে চান না ওটা।”
“আপনি দেখবেন নাকি একবার?”
“না, তোমার মুখের কথাই যথেষ্ট আমার জন্যে।”
কিশিতানির ভাষ্যমতে লাশটার অবস্থা খুবই সঙ্গিন ছিলো। জামাকাপড় সব খুলে নেয়া হয়েছে, এমনকি মোজাও। চেহারাটা ভারি কিছু দিয়ে আঘাত করে বিকৃত করে দেয়া হয়েছে। চেনার উপায় নেই একদমই। জুনিয়র ডিটেক্টিভের মতে ওটাকে দেখতে ফাঁটা তরমুজের মত দেখাচ্ছে। আর লাশটার আঙুলগুলো পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আঙুলের ছাপ পাবারও কোন আশা নেই।
লাশটা একজন পুরুষ মানুষের। গলার চারপাশে ক্ষত দেখে মনে হয়েছে শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছে। এছাড়া আর কোন আঘাতের চিহ্ন নেই সারা শরীরে।
“আশা করি ফরেনসিক টিম আরো কিছু খুঁজে পাবে,” কুসানাগি পায়চারি করতে করতে বলল। লোকজন তার দিকে তাকিয়ে আছে, না চাইলেও সূত্র খোঁজার ভান করতে হবে তাকে এখন। সত্যি কথা বলতে, প্রমাণ জোগাড়ের ব্যাপারটা সে পুরোপুরিভাবে ক্রাইম-সিন বিশেষজ্ঞদের ওপর ছেড়ে দেয়। তার চোখে তেমন কিছু ধরাও পড়ে না।
“কাছাকাছি একটা সাইকেল পাওয়া গেছে। এরইমধ্যে অবশ্য এডোগাওয়া থানার একজন এসে সেটা নিয়ে গেছে।”
“সাইকেল? নিশ্চয়ই কেউ ফেলে দিয়েছিল ওটা।”
“আসলে, সাইকেলটা নতুনই বলতে গেলে। কেউ ফেলে দিয়েছে বলে মনে হয় না। সাইকেলটার দুটো চাকাই ফাঁটিয়ে দেয়া হয়েছে তারকাটা দিয়ে।”
“ওহ্, ভিক্টিমের হবে তাহলে?”
“বলা মুশকিল। একটা রেজিস্ট্রেশন নম্বর অবশ্য ছিল ওটার গায়ে। মালিককে খুঁজে পাওয়া সম্ভব বোধহয়।”
“আশা করি ওটা ভিক্টিমেরই হবে,” কুসানাগি বলল। “সেটা না-হলে এক্ষেত্রে লাশের পরিচয় খুঁজে পাওয়া মহা ঝামেলার কাজ হবে।”
“কেন?”
“এই ধরণের কেস তোমার জন্যে নতুন, তাই না কিশি?”
কিশিতানি মাথা নাড়লো।
“একটু চিন্তা করো ব্যাপারটা নিয়ে। লোকটার চেহারা আর আঙুলের ছাপ দুটোই নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। তার মানে খুনি চায় না আমরা ভিক্টিমের পরিচয় খুঁজে পাই। অর্থাৎ ব্যাপারটা এরকম দাঁড়াচ্ছে, ভিক্টিমের খোঁজ পেলেই আমরা খুব সহজে খুনির খোঁজও পেয়ে যাবো। প্রশ্ন হচ্ছে, লাশের পরিচয় বের করতে আমাদের কত সময় লাগবে। সেটাই এই কেসে ভাগ্য নির্ধারণ করে দেবে।“
ঠিক এই সময়ে কিশিতানির ফোনটা বেজে উঠলে সেটা ধরে কিছুক্ষণ কথা বলল সে, এরপর কুসানাগির দিকে ঘুরে বলল, “এডোগাওয়া স্টেশনে আমাদের ডাক পড়েছে।”
“যাক, কিছু একটা বের করতে পেরেছে বোধহয়,” এই বলে কিশিতানির কাঁধে আলতো করে একটা চাপড় দিলো কুসানাগি।
X
এডোগাওয়া পুলিশ স্টেশনে তারা পৌঁছে দেখলো, মামিয়া হিটারের পাশে দাঁড়িয়ে হাত গরম করছে। মামিয়া হচ্ছে তাদের অপরাধ তদন্ত বিভাগের প্রধান। কয়েকজন লোক ব্যস্ত ভঙ্গিতে তার পাশে ছোটাছুটি করছে, স্থানিয় হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের লোকজন বোধহয়।
“আজকে কি নিজের গাড়িতে করেই এসেছো নাকি?” কুসানাগিকে ভেতরে ঢুকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো মামিয়া।
“হ্যা। ট্রেন স্টেশন এখান থেকে অনেক দূরে।”
“শহরের এপাশটা চেনো তাহলে?”
“ঠিক চিনি বলবো না, তবে এর আগে বেশ কয়েকবার এসেছি এখানে।”
“তাহলে তো কোন গাইডও দরকার হবে না তোমার। ভালো। কিশিতানিকে নিয়ে এখানে যাও,” একটা কাগজ তার দিকে বাড়িয়ে বলল মামিয়া।
সেটাতে একটা ঠিকানা লেখা আছে। শিনোজাকি, এডোগাওয়া ওয়ার্ডের ঠিকানা। ঠিকানার নিচে একটা নাম লেখা : ইয়োকো ইয়ামাবে।
“কে এটা?”
“ওকে সাইকেলের ব্যাপারটা খুলে বলেছো?” কিশিতানিকে জিজ্ঞেস করলো মামিয়া।
“জি, স্যার।”
“মানে, লাশের কাছাকাছি যে সাইকেলটা পাওয়া গেছে সেটার কথা বলছেন?” চিফের ভচকানো চেহারাটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো কুসানাগি।
“হ্যা, ওটাই। ওটা চুরি যাওয়ার পরে থানায় অভিযোগ করা হয়েছিল। রেজিস্ট্রেশন নম্বর মিলে গেছে। মিস ইয়ামাবে নামের এক মহিলার সাইকেল। আমি ফোন করে নিশ্চিত হয়েছি তিনি বাসাতেই আছেন। গিয়ে দেখো সাইকেলটার ব্যাপারে কি বলেন।”
“সাইকেলটা থেকে কোন আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে?”
“ওটার ব্যাপারে তোমার এখন না ভাবলেও চলবে। কিশিতানিকে নিয়ে রওনা হয়ে যাও তুমি,” মামিয়া বিরক্ত স্বরে বলল।
“যাক, সাইকেলটা তাহলে চুরি করা হয়েছিল। আমার অনুমানের সাথে মিলে গেছে,” গাড়ির দিকে আগাতে আগাতে বলল কুসানাগি। একটা কালো রঙের স্কাইলাইন গাড়ি চালায় সে। গত আট বছর ধরে এটাই তার সঙ্গি।
“আপনার কি মনে হয়, খুনি সাইকেলটা সেখানে ফেলে রেখে গেছে?”
“হতে পারে, কিন্তু আমার মনে হয় না মালিককে জিজ্ঞেস করে কোনও লাভ হবে। সে তো আর জানে না কে তার সাইকেল চুরি করেছিল। অবশ্য চুরিটা কোথা থেকে হয়েছিল সেটা জানা গেলে খুনির অবস্থান সম্পর্কে কিছুটা তথ্য হাতে আসতে পারে।”
ম্যাপের সাথে ঠিকানাটা মিলিয়ে বাসা খুঁজে বের করলো ওরা। একটা আধুনিক বাড়ির সামনে গাড়ি থামালো কুসানাগি। দরজার নেমপ্লেটে ‘ইয়ামাবে’ নামটা দেখা যাচ্ছে।
ইয়োকো ইয়ামাবে একজন গৃহবধূ, বয়স চল্লিশের কাছাকাছি হবে। তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ আগেই মেকআপ করেছে।
“কোন সন্দেহ নেই, এটাই আমার সাইকেল,” ফরেনসিকের তোলা সাইকেলের ছবিটা দেখে বলল মহিলা।
“আশা করি স্টেশনে এসে সেটা শনাক্ত করতে আমাদের সাহায্য করবেন আপনি।”
“আমি তো সেটা ফিরে পাবো, তাই না?”
“অবশ্যই। কিন্তু আমাদের সহকর্মিরা আরো কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাবে ওটার ওপর। সেজন্যে আপনাকে কিছুটা অপেক্ষা করতে হতে পারে।”
“কিন্তু ওটা তো আমার এখনই দরকার। বাজার করা খুব সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে সাইকেলটা ছাড়া,” হতাশায় ভুরু কুঁচকে বললো সে। তার গলার সুর শুনে মনে হচ্ছে যেন পুলিশই চুরি করেছে তার সাইকেলটা।
কিছু না বলে আস্তে করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো কুসানাগি। এরকম মহিলাদের চেনা আছে তার। স্টেশনে কি ঘটতে যাচ্ছে পরিস্কার বুঝতে পারছে সে এখনই। ফুটো হয়ে যাওয়া চাকার জন্যে নিশ্চিত ক্ষতিপূরণ চাইবে সে। একবার ভাবলো, মহিলাকে বলে দেবে তার সাইকেলটা একটা খুনের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। তাহলে নিশ্চয়ই সেটাতে চড়ার শখ চিরতরে মিটে যাবে তার। কিন্তু বাতিল করে দিলো চিন্তাটা।
মহিলার মতে, সাইকেলটা একদিন আগে চুরি করা হয়েছিল। মার্চের দশ তারিখে। সকাল এগারোটা থেকে রাত দশটার মাঝামাঝি কোন এক সময়ে। এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে গিনজায় গিয়েছিলো সে। এরপর শপিং শেষে রাতের খাবার খায় একটা রেস্তোরাঁয়। শিনোজাকি স্টেশনে ফিরতে ফিরতে রাত দশটা বেজে গিয়েছিল। ওখান থেকে বাসে করে বাসায় ফেরে।
“সাইকেলটা কি পার্কিংলটেই রেখে যান আপনি?”
“না, সাইডওয়াকের পাশে।”
“তালা দেয়া ছিল?”
“অবশ্যই। একটা চেইন দিয়ে বেঁধে রেখেছিলাম সেটা।” চেইনের কথা স্টেশনের কেউ উল্লেখ করেনি।
মিস ইয়ামাবাকে নিয়ে শিনোজাকি স্টেশনে গেলো সে। যেখান থেকে সাইকেলটা চুরি হয়েছে সেখানটা ভালোমত পরীক্ষা করে দেখলো।
“ঠিক এখানটাতেই রেখেছিলাম,” সাইডওয়াকের পাশে একটা জায়গা দেখিয়ে বলল মহিলা। ওটার উল্টোদিকে একটা ছোট বাজার। অনেকগুলো সাইকেল এখনও বাঁধা আছে সেখানে।
আশেপাশে নজর বোলাল কুসানাগি। একটা ব্যাঙ্ক আর বইয়ের দোকান চোখে পড়লো। সকাল আর বিকেলের দিকে বেশ ভিড় থাকার কথা। সে সময় এখান থেকে সাইকেল চুরি করাটা কঠিনই হবে। চোর নিশ্চয়ই আরো পরে কাজটা করেছিল। সবকিছু নিরিবিলি হয়ে যাবার পর।
এরপর তারা মিস ইয়ামাবাকে এডোগাওয়া পুলিশ স্টেশনে নিয়ে আসলো সাইকেলটা সনাক্ত করার জন্যে।
“আমার মনে হয় আমার ভাগ্যটাই খারাপ, বুঝলেন,” পেছনের সিট থেকে বলল সে। “কিছুদিন আগেই সাইকেলটা কিনেছিলাম আমি। যখন বুঝলাম চুরি হয়েছে তখন এত রাগ লাগছিল যে সবার আগে পুলিশ স্টেশনে গিয়েছিলাম অভিযোগ করতে।”
“রেজিস্ট্রেশন নম্বরটা আপনার মুখস্ত ছিল, বাহ্!”
“কিছুদিন আগেই কিনেছিলাম, বললাম না। আমার বাসায় এখনও কেনার রশিদটা আছে। আমার মেয়েকে ফোন দিতেই সে রেজিস্ট্রেশন নম্বরটা বলে দিয়েছিল।”
“ওহ্।”
“আচ্ছা, এটা কেমন ধরণের কেস? যে লোকটা আমাকে বাসায় ফোন করেছিলো পুলিশ স্টেশন থেকে সে কিছু খুলে বলেনি। আমার খুব কৌতূহল হচ্ছে ব্যাপারটা নিয়ে।”
“আসলে আমরা নিজেরাও এখনও জানি না কেসটা কোনদিকে এগোচ্ছে, ম্যাম।”
“তাই নাকি?” নাক দিয়ে একটা আওয়াজ করে বলল মহিলা। “আপনাদের পেট থেকে যে কথা বের করা এত কঠিন তা তো জানতাম না।”
প্যাসেঞ্জার সিটে কিশিতানি খুব কষ্ট করে হাসি চেপে রেখেছে। কুসানাগি এই ভেবে স্বস্তিবোধ করছে যে, খুনের ব্যাপারটা জানাজানি হবার আগেই তারা মহিলার বাসায় গেছে। না হলে আরো অদ্ভুত সব প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হত।
মিস ইয়ামাবে এডোগাওয়া স্টেশনে এসে একবার দেখেই সাইকেলটা সনাক্ত করে ফেললো। এরপর কুসানাগির তাকিয়ে প্রশ্ন করলো সে, “আমার সাইকেলের ক্ষতিপূরণ কে দেবে?’
X
ফরেনসিক ডিপার্টমেন্ট সাইকেলের হ্যান্ডেলে, সিটে আর ফ্রেমে কয়েকটা হাতের ছাপ খুঁজে পেয়েছে। অন্য কিছু প্রমাণও পাওয়া গেছে। ভিক্টিমের জামাকাপড় উদ্ধার করা হয়েছে খুনের জায়াগা থেকে একটু দূরে। একটা পাঁচ গ্যালন তেলের ক্যানের ভেতর ছিল ওগুলো আংশিক জ্বালানো অবস্থায়। একটা জ্যাকেট, প্যান্ট, মোজা আর সোয়েটার। তাদের ধারণা খুনি সেগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল কিন্তু পুরোপুরি পুড়ে যাওয়ার আগেই কোন কারণে আগুন নিভে যায়।
কাপড়গুলোকে দেখে বিশেষ কিছু বলে মনে হয়নি। খুবই সাধারণ ডিজাইনের, পুরো দেশজুড়ে হাজারো মানুষের পরনে থাকে ওরকম জামাকাপড়। পুলিশের স্কেচ আর্টিস্ট কাপড়গুলো আর ভিক্টিমের দেহের আকার দেখে মারা যাবার আগে তার সম্ভাব্য চেহারা আঁকার চেষ্টা করেছে। কয়েকজনের হাতে সেই ছবি ধরিয়ে দিয়ে শিনোজাকি স্টেশনের আশেপাশে খোঁজ করতে পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু উপযুক্ত তথ্যের অভাবে কিছুই খুঁজে পায়নি তারা।
রাতের খবরেও সেই ছবিটা প্রচার করা হয়। কয়েক ডজন ফোন আসে, কিন্তু তার মধ্যে কোনটিই এডোগাওয়া স্টেশনের জন্যে প্রয়োজনিয় কোন তথ্য সরবরাহ করতে পারেনি।
নিখোঁজ মানুষের তালিকার সাথে মিলিয়েও পুলিশ কিছু খুঁজে বের করতে পারেনি। অবশেষে যখন আশেপাশের হোটেল আর বোর্ডিং হাউজগুলোতে খোঁজ নেয়া হলো তখন একটু আশার প্রদীপের দেখা মিলল।
কামেডোর ‘ওগিয়া বোর্ডিং হাউজ’ থেকে একজন বাসিন্দা নিখোঁজ হয়েছে এগারো মার্চে, লাশটা খুঁজে পাওয়ার দিন। যখন লোকটা আর ফিরে আসেনি তখন এক কর্মচারি তার ঘরে গিয়ে দেখে সেটা খালি। কেবল অল্পকিছু ব্যক্তিগত জিনিস পড়ে আছে এখানে সেখানে। ম্যানেজার ও পুলিশকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি, কারণ ভাড়া অগ্রিম পরিশোধ করে দেয়া হয়েছিল।
ফরেনসিক ডিপার্টমেন্ট সাথে সাথে সেখানে পৌঁছে যায়। প্রতিটা ইঞ্চি পরীক্ষা করে দেখা হয়। ছাপ, চুলের নমুনা সংগ্রহ করে। অবশেষে ফল পায় তারা। ঘরটাতে পাওয়া একটা চুলের সাথে ভিক্টিমের চুলের নমুনা পুরোপুরি মিলে যায়। আর দেয়ালে যে আঙুলের ছাপ পাওয়া যায় সেটাও সাইকেলের আঙুলের ছাপের সাথে মিলে যায়।
নিখোঁজ লোকটা রেজিস্ট্রারে তার নাম সই করেছিলো শিনিজি টোগাশি নামে, ঠিকানা লিখেছিল : পশ্চিম শিনজুকু, শিনজুকু ওয়ার্ড।