অধ্যায় ১৫
ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে সাতটা বেজে ত্রিশ মিনিট। একটা ব্যাগ হাত নিয়ে অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বের হলো ইশিগামি। ব্যাগের ভেতরের জিনিসগুলো তার কাছে খুবই দামি। আদতে দেখলে কয়েকটা সাধারণ ফাইল ছাড়া কিছু মনে হবে না, কিন্তু ওগুলোতেই আছে ইশিগামির সারা জীবনের গবেষণার ফসল। এমন একটা গাণিতিক সমস্যা যার সমাধান করা সম্ভব হয়নি কারো পক্ষেই। এটার ওপরেই ইউনিভার্সিটিতে থিসিস করেছিল সে।
হিসেব করে দেখেছে, আরো মোটামুটি বিশ বছর লাগবে তার কাজটা শেষ করতে। বেশিও লাগতে পারে। কিন্তু এটা এমন একটা কাজ যেটার পেছনে সারাজীবন ব্যয় করলেও ক্ষতি নেই। এখনও সমাধান থেকে অনেক দূরে আছে সে, কিন্তু এ মুহূর্তে যে অবস্থানে আছে সেটুকুতেও আসতে পারেনি কেউ কখনও।
সে মাঝে মাঝেই ভাবে, সব কাজ ফেলে যদি এটা নিয়ে ডুবে থাকা যেত! যতবারই মৃত্যুচিন্তা মাথায় এসেছে ততবারই মনে হয়েছে, কাজটা শেষ করে যেতে পারবে তো!
যেখানেই যায় না কেন, সাথে করে ফাইলগুলো নিয়ে যায়। ছুটির মধ্যেও বিশ্রাম না নিয়ে সমস্যা সমাধানের পেছনে লেগে থাকে। আর সে জন্যে কয়েকটা কাগজ আর কলম থাকলেই যথেষ্ট।
এসব কথা চিন্তা করতে করতে যান্ত্রিকভাবে শিনোেহাশি ব্রিজের রাস্তাটা ধরে হাটতে লাগলো, যেমনটা প্রতিদিন করে। সুমাইদা নদী আর বাস্তুহারাদের গ্রামটা দেখা যাচ্ছে। লম্বা চুলের লোকটা আবারও একটা পাত্রে কী যেন সিদ্ধ করছে। তার পাশে একটা ছোট্ট কুকুরকে দেখা গেলো, আগ্রহভরে মালিককে দেখায় ব্যস্ত। একটু পর পর লেজ নাড়ছে।
ক্যান-মানব তার দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত। ইতিমধ্যেই দুটো বড় ব্যাগ দোমড়ানো ক্যানে ভর্তি করে ফেলেছে সে। কিছুক্ষণ এসব দেখে আবার হাটা শুর করলো ইশিগামি।
হঠাৎ টের পেলো পেছন থেকে তার দিকে এগিয়ে আসছে কেউ। এসময়েই ঐ বয়স্ক মহিলাটা তার কুকুরগুলো নিয়ে বের হন, কিন্তু পায়ের আওয়াজটা অন্যরকম লাগছে আজকে। অন্য কেউ নিশ্চয়ই, ইশিগামি ঘুরে তাকালো।
নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে একটা ‘ওহ্’ জাতীয় শব্দ বের হয়ে গেলো তার, যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়লো।
হাসিমুখে তার কাছে এসে দাঁড়াল লোকটা
“গুড মর্নিং,” মানাবু ইউকাওয়ার মুখটা এখনও হাসি হাসি হয়ে আছে।
ইতস্ততবোধ করতে লাগল ইশিগামি, বুঝতে পারছে না কী জবাব দেবে। শুকনো ঠোঁটগুলো একবার ভিজিয়ে নিয়ে বলল, “আমার জন্যে অপেক্ষা করে ছিলে তুমি।”
“ঠিক ধরেছো,” ইউকাওয়া বলল। “আসলে অপেক্ষা করছিলাম বললে ভুল হবে, কেবলই কিয়োসু ব্রিজ থেকে হেটে এদিকে এসেছি। জানতাম এ পথ দিয়েই যাওয়া-আসা করো তুমি প্রতিদিন।”
“নিশ্চয়ই জরুরি কোন কাজ আছে?”
“জরুরি? হতে পারে।”
“সেটা নিয়ে কি এখনই কথা বলতে চাও?” একবার হাতঘড়িটা দেখে নিলো ইশিগামি, “বেশি সময় নেই আমার হাতে।”
“বড়জোর পনেরো মিনিট লাগবে আমার।’
“তাহলে হাটতে হাটতে কথা বলি?”
“কোন সমস্যা নেই,” আশেপাশে একবার নজর বুলিয়ে বলল ইউকাওয়া। “কিন্তু তার আগে এখানে কিছুক্ষণ কথা বলে নেই। এই দু- তিন মিনিট। ওখানে বেঞ্চটাতে বসি?” এই বলে নদীর তীরের একটা বেঞ্চের দিকে এগিয়ে গেলো সে উত্তরের অপেক্ষা না করেই।
উপায় না দেখে তাকে অনুসরণ করলো ইশিগামি।
“এখান দিয়ে তো আগেও একবার হেটে গিয়েছিলাম আমরা, তাই না?”
“হ্যা।”
“আমার মনে আছে তুমি বলেছিলে, এই বাস্তুহারা লোকদেরকে ঘড়ি হিসেবে ব্যবহার করতে পারবো আমি। ভুলে গেছো?”
“না, মনে আছে। আর তুমি বলেছিলে, নিয়ম ছাড়া জীবন-যাপন করলে এমনই হয়।”
সন্তুষ্ট হয়ে মাথা নাড়লো ইউকাওয়া। “আমাদের ক্ষেত্রে কিন্তু সেরকমটা ঘটে না। না চাইতেও এই পৃথিবীর নিয়ম-কানুনে জড়িয়ে গিয়েছি আমরা আষ্টেপৃষ্ঠে। ঘড়ির কাঁটার মত। একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে স্থির রেখে ওটার চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছি আমরা। কিন্তু সেই লক্ষ্যটা না থাকলে ছিটকে যাবো চারপাশে। অনেকের কাছে অবশ্য এই লক্ষ্যহীন জীবনই ভালো লাগে। আমি শুনেছি বাস্তুহারাদের অনেকে নাকি আর স্বাভাবিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত হতে পারে না কখনও।”
“এসব দার্শনিক মার্কা কথা বলতে বলতেই কিন্তু তোমার দু-তিন মিনিট শেষ হয়ে যাবে। এক মিনিট ইতিমধ্যেই শেষ করে ফেলেছো।”
“ঠিক আছে, আসল কথায় আসছি। ঘড়ির মত এই পৃথিবীরও চলার জন্যে ঐ কাঁটাগুলোর দরকার আছে। আর সেই কাঁটাগুলো হচ্ছি আমরা। একটা ঘড়িতে কোন কাঁটাই যেমন অপ্রয়োজনিয় নয়, তেমনি এই পৃথিবীতে কোন মানুষই ফেলনা নয়। এটাই বলতে চেয়েছিলাম তোমাকে,” ইশিগামির চেহারার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলল ইউয়াকাওয়া। এরপর যোগ করলো, “শিক্ষকতা ছেড়ে দেবে নাকি তুমি?”
ইশিগামির চোখগুলো বিস্ময়ে বড় হয়ে গেলো। “একথা জিজ্ঞেস করলে কেন?”
“না, তোমার হাবভাব দেখে সেরকমই মনে হচ্ছিল, তাই বললাম। সারাজীবন তো নিশ্চয়ই এই ‘গণিতের শিক্ষক’ তকমা লাগিয়ে ঘুরতে চাও না তুমি। উঠি তাহলে?” থমকে দাঁড়ালো ইউকাওয়া।
সুমাইদা নদীর পাশ দিয়ে হাটা শুরু করলো দু-জনে। ইশিগামি কিছু বলছে না, তার বন্ধুর বলার জন্যে অপেক্ষা করছে।
“শুনলাম কুসানাগি নাকি আরেকবার দেখা করে গেছে তোমার সাথে?”
“হ্যা, গত সপ্তাহে।”
“তোমাকে সন্দেহ করে সে।”
“সেরকমটাই মনে হচ্ছে। যদিও আমি জানি না কেন।”
হঠাৎ করে হেসে উঠলো ইউকাওয়া। “সত্যি কথা বলতে কি, সে নিজেও ঠিকমত জানে না। তোমার প্রতি তার আগ্রহের কারণ হচ্ছি আমি। কুসানাগি যখন থেকে খেয়াল করেছে আমি তোমার সাথে নিয়মিত দেখা- সাক্ষাত করছি, তখন থেকেই সন্দেহ জট পাকতে শুরু করে তার মনে। পুলিশের কাছে এখনও তোমার বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ নেই, যদিও আমার উচিত হচ্ছে না তোমাকে সেটা জানানোর।“
“তাহলে জানাচ্ছো কেন?” ইশিগামি হাটা থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো। ইউকাওয়াও থেমে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “কারণ আমি তোমার বন্ধু। এছাড়া আর কোন কারণ নেই।”
“তুমি আমার বন্ধু আর এজন্যেই একটা খুনের তদন্তের সব খবর আমাকে জানাচ্ছো? কেন? আমি তো কোনভাবে এই অপরাধের সাথে জড়িত না। পুলিশ আমাকে সন্দেহ করছে কি করছে না এতে আমার কি আসে যায়?”
জবাবে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলার আওয়াজ শুনলো ইশিগামি। তার বন্ধুর বেদনার্ত চেহারাটা দেখে কেমন যেন বিচলিত বোধ করতে শুরু করলো সে।
“অ্যালিবাইটার কোন গুরুত্ব নেই,” শান্তস্বরে বলল ইউকাওয়া।
“কি?”
“কুসানাগি আর তার দলের সবাই সন্দেহভাজনদের অ্যালিবাই নিয়ে মেতে আছে। তাদের ধারণা ইয়াসুকো হানাওকার গল্পটা নিয়ে তদন্ত করতে করতে একসময় ফুটো খুঁজে পাবে ওতে, আর তাতেই সত্যটা বের হয়ে আসবে। তাদের ধারণা, যেহেতু তুমি ইয়াসুকোর সহযোগি, তাই তোমার অ্যালিবাইও যাচাই করে দেখতে হবে, তাহলেই সব জানতে পারবে তারা।”
“তোমার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই ধরতে পারছি না,” ইশিগামি ভুরু কুঁচকে বলল। “তাছাড়া অ্যালিবাই যাচাই করে দেখার মধ্যে ক্ষতি কোথায়? এটাই তো তাদের কাজ।”
ইউকাওয়ার মুখের ভঙ্গি কিছুটা কোমল হয়ে আসল। “কুসানাগি বেশ মজার একটা কথা বলেছিল সেদিন। তুমি যেভাবে পরীক্ষার প্রশ্ন সাজাও সেটা নিয়েই কথা বলছিলাম আমরা। শিক্ষার্থিদের অতিরিক্ত চিন্তা করার অভ্যেসটার সুযোগ নিয়ে ঘুরিয়ে প্রশ্ন করো তুমি। যেমন একটা বীজগণিতের প্রশ্ন এমনভাবে করো যাতে দেখলে জ্যামিতিক সমস্যা মনে হয় সেটাকে। শিক্ষার্থিরাও জ্যামিতি ভেবে লাফিয়ে পড়ে সেটার ওপর, কিন্তু ফলাফল শূন্য। অনেকের কাছে হয়তো ভালো লাগবে না পদ্ধতিটা, কিন্তু আমার মনে হয় কারো প্রকৃত মেধা যাচাইয়ের জন্যে সর্বোত্তম পদ্ধতি এটাই,” বলল সে।
“কি বলতে চাচ্ছো তুমি?”
গম্ভীর মুখে বলতে শুরু করলো ইউকাওয়া, “কুসানাগি আর তার দলের ধারণা এই পরীক্ষাতে অ্যালিবাইয়ের সত্যতা যাচাই করতে হবে তাদেরকে। আর কেনই বা করবে না? প্রধান সন্দেহভাজন আসামির তো একটা অ্যালিবাই আছেই। আরো মজার ব্যাপার হলো সেই অ্যালিবাইটাও বেশ নড়বড়ে, সিনেমা হলের কথাটা বলছি আর কি। আমাদের গবেষণার ক্ষেত্রেও অনেক সময় এমনটা হয় কিন্তু, বছরের পর বছর ভুল একটা সূত্র নিয়ে চিন্তা করতে থাকি আমরা। যেখানে প্রকৃত সমাধানের রাস্তাটা একেবারেই ভিন্ন। পুলিশও এই ফাঁদেই পা দিয়েছে। টোপটা দেয়াই ছিল, সেটা শুধু গিলতে হয়েছে তাদের।”
“তোমার যদি তদন্তটা নিয়ে এতই চিন্তা হয়ে থাকে তবে ডিটেক্টিভ কুসানাগির সাথে সে ব্যাপারে আলাপ করছো না কেন?”
“হ্যা, সেটা তো একসময় করতেই হবে আমাকে। কিন্তু তার আগে তোমাকে জানিয়ে রাখতে চাচ্ছিলাম কথাগুলো। আর কেন সেটা জানাচ্ছি তা তো আগেই বলেছি।”
“কারণ তুমি আমার বন্ধু।”
“হ্যা, আরেকভাবে বলতে গেলে, তোমার মত একজন মানুষকে হারাতে চাই না আমি। এসব মায়াজাল থেকে তোমাকে মুক্ত করে, সঠিক পথে নিয়ে আসতে চাই। তোমার মত মেধাবি একজনের জীবন নষ্ট হতে দেখাটা সম্ভব নয় আমার পক্ষে।”
“এসব কথা আমাকে বলতে হবে না তোমার। ইতিমধ্যেই যা নষ্ট করার করে ফেলেছি আমি,” ইশিগামি বলল। এরপর ঘুরে তাড়াতাড়ি হাটতে শুরু করলো সে, এজন্যে নয় যে, কোন তাড়া আছে তার, বরং ইউকাওয়ার আশেপাশে থাকাটা ক্রমশই অসহ্য হয়ে উঠছে।
ইউকাওয়া অনুসরণ করলো তাকে। “এই কেসটার সমাধান করতে হলে আমাদের বুঝতে হবে, সন্দেহভাজনের অ্যালিবাইটা কোন সমস্যা নয়, সমস্যাটা অন্যকোথাও।”
“আচ্ছা, এমনি কৌতুহল থেকেই প্রশ্নটা করছি, সমস্যাটা কি?” ইশিগামি তার দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলো।
“সমস্যাটা এত সোজা নয় যে, জিজ্ঞেস করলেই উত্তর পেয়ে যাবে। কিন্তু এক কথায় বলতে গেলে, পুরো ব্যাপারটাই ক্যামোফ্ল্যাজ কিংবা ছদ্মবেশের। তদন্তকারিরা মূল অপরাধির ছদ্মবেশ দেখে বোকা বনে গেছে। যে সূত্রই তারা আবিষ্কার করছে না কেন, প্রতিটাই ইচ্ছে করে তাদের জন্যে সাজিয়ে রাখা হয়েছে আগে থেকে।”
“খুবই জটিল শোনাচ্ছে ব্যাপারটা।”
“আসলেই জটিল। কিন্তু তুমি যদি তোমার দৃষ্টিভঙ্গিটা একটু পরিবর্তন করো তখন হাস্যকর রকমের সোজা হয়ে যাবে গোটা ব্যাপারটা। যখন একজন আনাড়ি কোন সত্যকে লুকোনোর চেষ্টা করে তখন খুবই জটিল একটা ছদ্মবেশ তৈরি করে সে। আর এতেই কাল হয় তার। একজন দক্ষ লোক কিন্তু সেটা করে না, খুবই সাধারণ একটা পদ্ধতি অবলম্বন করে সে। কিন্তু অন্য কারো মাথায় সেটা স্বপ্নেও আসবে না। এই সাধারণ ব্যাপারটাই জটিলতার সৃষ্টি করে সবার মনে।’
“আমি ভেবেছিলাম পদার্থবিদরা এরকম ভাসা ভাসাভাবে কথা বলে না।”
“তুমি চাইলে আরো ভালোমত ব্যাখ্যা দিতে পারি আমি। আর কতক্ষণ সময় আছে তোমার?”
“বেশ খানিকক্ষন আছে।”
“লাঞ্চশপটাতে ঢুঁ মেরে আসবে নাকি?”
“আমি কিন্তু প্রতিদিন সেখান থেকে লাঞ্চ কিনি না,” রাস্তার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো ইশিগামি।
“তাই নাকি? আমি তো অন্যকথা শুনেছি। প্রতিদিনই নাকি সেখানে যাও তুমি?”
“তোমার কি ধারণা, এই তথ্যটাই কেসের সাথে জড়িয়ে ফেলেছে আমাকে?”
“হ্যা এবং না। তুমি যদি কেবল লাঞ্চ কিনতেই সেখানে যেতে প্রতিদিন তাহলে কোন প্রশ্ন উঠতো না। কিন্তু বিশেষ একজন মহিলার জন্যে সেখানে গেলে সেটা সহজে কারো চোখ এড়াবে না।”
ইশিগামি থেমে তার বন্ধুর দিকে তাকালো। “তোমার কি মনে হয়? তুমি আমার পুরনো বন্ধু দেখে যা ইচ্ছে বলবে আর সেটা আমি মেনে নেবো?”
ইউকাওয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ইশিগামির দিকে তাকালো। চশমার কাঁচ তার চোখের আত্মবিশ্বাসকে ঢাকতে পারছে না। সে বলল, “আরে, তুমি দেখি রেগে গেছো?”
“ফালতু যত্তসব,” বিড়বিড় করে বলে আবার হাটা ধরলো ইশিগামি। কিছুদূর গিয়ে কিয়োসু ব্রিজের সিঁড়িগুলো টপকে ওপরে উঠতে শুরু করলো।
“লাশ থেকে একটু দূরেই ভিক্টিমের জামাকাপড় পাওয়া গিয়েছিল, অন্তত পুলিশদের ধারণা ওগুলো ভিক্টিমেরই,” ইশিগামির পেছন পেছন আসতে লাগল ইউকাওয়া। “আধপোড়া অবস্থায় একটা তেলের ড্রামের ভেতরে ছিল ওগুলো। তাদের ধারণা খুনিই কাজটা করেছে। আমি যখন সেটা শুনেছিলাম তখন ভেবেছিলাম পুরোপুরি ওগুলো পোড়াল না কেন খুনি। পুলিশের লোকদের ধারণা সেখান থেকে যত দ্রুত সম্ভব পালানোর চেষ্টায় ছিল খুনি। কিন্তু এই কথাটা শুনে অনেকে চিন্তা করতে পারে, এতই যখন তাড়া ছিল তাহলে সেগুলো সঙ্গে করে নিয়ে গেলো না কেন খুনি? নাকি সে ভেবেছিল আরো তাড়াতাড়ি পুড়ে যাবে ওগুলো? ব্যাপারটা খোঁচাতে থাকে আমাকে। তাই আমি নিজেই কিছু কাপড় পুড়িয়ে দেখেছি।”
ইশিগামি আবার থেমে গেলো, “তুমি তোমার জামাকাপড় পুড়িয়েছো?”
“হ্যা, একটা তেলের ড্রামে। একটা জ্যাকেট, একটা সোয়েটার, কিছু প্যান্ট…ও হ্যা, একটা আন্ডারওয়্যারও ছিল। সেকেন্ডহ্যান্ড দোকান থেকে কিনেছিলাম ওগুলো। দেখলে তো? কোন একটা এক্সপেরিমেন্ট হাতে কলমে না করে দেখলে ভালো লাগে না পদার্থবিদদের।”
“আর এক্সপেরিমেন্টের ফলাফল?”
“খুব তাড়াতাড়িই পুড়ে গিয়েছিল ওগুলো, ধোঁয়াও তৈরি হয়েছিল প্রচুর। পাঁচমিনিটের মধ্যেই সব জ্বলে ছাই হয়ে গিয়েছিল।”
“তো?”
“আমদের খুনি কেন ঐ পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করতে পারলো না?”
একবার কাঁধ ঝাঁকিয়ে আবার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করলো ইশিগামি। রাস্তায় উঠে বামে হাটতে শুরু করলো সে, বেন্টেন-টেইয়ে যাওয়ার রাস্তাটার উল্টোদিকে সে।
“লাঞ্চ কিনবে না তাহলে?” ইউকাওয়া প্রশ্ন করলো।
“বললামই তো প্রতিদিন সেখানে যাই না আমি,” ভুরু কুঁচকে বলল
“তুমি দুপুরে কি খাবে সেটা নিয়ে চিন্তা করছিলাম দেখেই বললাম আর কি,” দ্রুত হেটে তার পাশে চলে আসল ইউকাওয়া। “লাশের কাছে কিন্তু একটা সাইকেলও খুঁজে পেয়েছিল তারা। পরে দেখা যায় সেটা শিনোজাকি স্টেশন থেকে চুরি করা হয়েছে। সম্ভাব্য ভিক্টিমের আঙুলের ছাপ ছিল ওটার গায়ে।”
“তো, আমি কি করবো?”
“ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত লাগছে না তোমার কাছে? খুনি এত কষ্ট করে ভিক্টিমের চেহারার নকশা পাল্টে দিলো, আর সে কিনা সাইকেল থেকে আঙুলের ছাপ মুছতে ভুলে গেলো? গাধার মত একটা কাজ, যদিনা ইচ্ছে করে আঙুলের ছাপ না মোছা হয়। কিন্তু সেটা ও করতে যাবে কেন?”
“আমি নিশ্চিত ওটাও আমাকে শোনাবে তুমি।”
“সাইকেলের ব্যাপারটা ভিক্টিমের সাথে জড়ানোর জন্যে কাজটা করা হতে পারে। আর পুলিশ সেটা ভাবলে অপরাধিরই সুবিধা।“
“সেটা কেন?”
“কারণ অপরাধি চাইছিল যাতে পুলিশ মনে করে ভিক্টিম শিনোজাকি স্টেশন থেকে সাইকেল চালিয়ে সেখানে গিয়েছিল। আর সেজন্যে যেকোন পুরনো সাইকেল ব্যবহার করলে চলতো না।“
“বলতে চাইছো সাইকেলটারও কোন বিশেষত্ব আছে?”
“ঠিক ‘বিশেষত্ব’ বলবো না। খুবই সাধারণ একটা সাইকেল ওটা। শুধু একটা জিনিসই চোখে পড়বে : একদম নতুন সেটা।”
ইশিগামির পেটটা মোচড় দিয়ে উঠলো। স্বাভাবিকভাবে নিঃশ্বাস নেয়াও অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
এই সময়ে এক ছাত্রি সাইকেলে করে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় “গুড মর্নিং” বলে গেলো তাকে। জবাবে সে-ও “গুড মর্নিং” জানালো, যদিও এই সকালটার ব্যাপারে ‘গুড’ কিছু আছে মনে হচ্ছে না একন।
“বাহ্, এখনও টিচারদের সাথে স্কুলের বাইরে কথা বলে ছাত্র-ছাত্রিরা। আমি তো ভাবতাম বলতো না,” ইউকাওয়া মন্তব্য করলো।
“খুব কমই বলে। তো, সাইকেলটাকে নতুন হতে হবে কেন?”
“পুলিশের ধারণা সাইকেলটা চোরের খুব পছন্দ হয়েছিল, তাই সেটা চুরি করেছিল সে। কিন্তু আমাদের চোর সেটা ভেবে চুরি করেনি। তার চিন্তায় ছিল সাইকেল পার্ক করে রাখার সময়টা।”
“কারণ…?”
“চোরের এমন কোন সাইকেল দরকার ছিল না যেটা কিনা দিনের পর দিন স্টেশনে ফেলে রাখা হয়েছে। সে চাইছিল মালিক যাতে পুলিশে রিপোর্ট করে। এজন্যেই সাইকেলটাকে নতুন হতে হবে। মালিকেরা নতুন সাইকেল কখনও বেশি সময়ের জন্যে বাইরে ফেলে রাখে না। আর কোনভাবে সাইকেল চুরি হয়ে গেলে সেই মালিকদেরই পুলিশের কাছে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এই কাজটার যে খুব দরকার ছিল তা নয়, কিন্তু অপরাধি কোন ঝুঁকি নিতে চায়নি।”
“হুম।”
কোন প্রকার মন্তব্য করা থেকে নিজেকে বিরত রাখলো ইশিগামি। সামনের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ হাটতে লাগল। স্কুলের ছাত্রছাত্রিরা আসতে শুরু করেছে।
“খুব সুন্দর একটা গল্প, আরো শুনতে ইচ্ছে করছে আমার,” ইউকাওয়ার মুখোমুখি হয়ে বলল সে। “কিন্তু এখন ছেড়ে দিতে হবে আমাকে। আমি চাই না ছাত্র-ছাত্রিরা অপেক্ষা করুক।”
“অবশ্যই, আমার যা যা বলার ছিল প্রায় সবই বলা শেষ।”
“মনে আছে? একটা প্রশ্ন করেছিলে তুমি আমাকে?” ইশিগামি বলল। “জিজ্ঞেস করেছিলে, একটা সমস্যার সমাধান করা বেশি কঠিন নাকি সমস্যাটা তৈরি করা বেশি কঠিন?”
“হ্যা। তার উত্তরও আছে আমার কাছে। সমস্যার সমাধানের চেয়ে সেটা তৈরি করাই বেশি কঠিন।”
“ঠিক বলেছো,” ইশিগামি বলল। “আর P=NP সমস্যাটার কথা মনে আছে? যেখানে প্রশ্ন ছিল কারো সমাধান ভুল প্রমাণ করার চেয়ে নিজে সেই সমাধানটা বের করা কঠিন কিনা?”
“হ্যা, মনে আছে,” মৃদু স্বরে বলল ইউকাওয়া, ধরতে পারছে না ইশিগামি কি বোঝাতে চাচ্ছে।
“তোমার সমাধান তো আমাকে শোনালে,” এক আঙুল দিয়ে ইউকাওয়ার বুক বরাবর ইশারা করে বলল ইশিগামি। “এখন সময় এসেছে অন্য কারো সমাধান যাচাই করে দেখার।”
“ইশিগামি…”
“গুড মর্নিং,” এই বলে ঘুরে স্কুলের ভেতর ঢুকে গেলো সে। হাতের ব্যাগটা শক্ত করে ধরে রেখেছে।
সব শেষ, ভাবলো সে। ইউকাওয়া ধরে ফেলেছে সবকিছু।
X
খুব অস্বস্তির সাথে বসে পুডিং খাচ্ছে মিশাতো। ইয়াসুকোর আবারো মনে হতে লাগলো মেয়েটাকে বোধহয় বাসায় রেখে আসলেই ভালো হত।
“ঠিকমত খাচ্ছো তো, মিশাতো?” কুডো জিজ্ঞেস করলেন। পুরো সন্ধ্যাই এরকম প্রশ্ন করেছেন তিনি মেয়েটাকে।
মিশাতো তার দিকে না তাকিয়েই যান্ত্রিকভাবে মাথা নাড়লো। পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে রেস্টুরেন্টে এসে ভালো লাগছে না তার
গিনজার এক নামকরা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে এসেছে তারা ডিনারের জন্যে। কুডো ইয়াসুকোকে জোর করছিল যাতে মিশাতোকে নিয়ে আসে। তাই আজ মিশাতোকে এনেছে সাথে করে। মেয়েটার অবশ্য আসার ইচ্ছে একদমই ছিল না, কিন্তু ইয়াসুকো তাকে বুঝিয়েছে, তারা যদি স্বাভাবিক আচরণ না করে তাহলে হয়তো পুলিশের মনে সন্দেহ জাগবে।
কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আসলেও ভুল হয়েছে কাজটা। পুরো সন্ধ্যা জুড়ে মিশাতোর সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করেছেন কুডো। কিন্তু প্রতিবারই হ্যা- না এ উত্তর দিয়েছে মিশাতো। রীতিমত উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে এখন কুডোকে।
মিশাতো তার পুডিং খাওয়া শেষ করে ইয়াসুকোর দিকে ঘুরে বলল, “বাথরুমে যাচ্ছি আমি।”
“আচ্ছা।”
মিশাতোর যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলো ইয়াসুকো। এরপর কুডোর দিকে ঘুরে বলল, “আমি আসলেই দুঃখিত।”
“কেন? কি নিয়ে?” কুডোকে দেখে আসলেই অবাক মনে হলো, তবে ইয়াসুকোর ধারণা অভিনয় করছেন তিনি।
“ও আসলে খুব লাজুক ধরণের। আর বয়স্ক লোকদের সাথে কথা বলতে ওর সমস্যা হয়।“
“আরে, চিন্তা করো না। ওর মত বয়সে আমিও অমনই ছিলাম। আর আমি ভাবিওনি একদিনের সাক্ষাতের পরেই বন্ধু হয়ে যাবো আমরা। ওর সাথে দেখা করতে পেরেই খুশি আমি।”
“ধন্যবাদ, আপনি আসলেও খুব ভালো।”
কুডো মাথা নেড়ে চেয়ারের পেছনে ঝোলানো কোটের পকেট হাতড়ানো শুরু করলেন। সেখান থেকে একটা সিগারেট আর লাইটার বের করে সিগারেটটা ধরালেন তিনি। এতক্ষণ মিশাতো ছিল বলে সিগারেট খেতে পারছিলেন না।
“পরিস্থিতির কেমন সবকিছুর?”
“কিসের পরিস্থিতি?”
“তদন্তের ব্যাপারে বলছিলাম।”
“ওহ্,” এই বলে কুডোর দিকে তাকালো ইয়াসুকো। “না, সেরকম
কিছু ঘটেনি। স্বাভাবিকভাবেই চলছে সবকিছু।”
“শুনে খুশি হলাম। ডিটেক্টিভরা আর বিরক্ত করছে না তাহলে?”
“গত কয়েকদিনে তো আসেনি তারা। আপনার কি খবর?”
“এখানেও সব স্বাভাবিক। আমাকে বোধহয় আর সন্দেহ করছে না তারা,” অ্যাশট্রেতে ছাই ফেলতে ফেলতে বললেন কুডো। “তবে একটা ব্যাপার নিয়ে বেশ চিন্তায় আছি, তোমার ঘটনার সাথেই বোধহয় জড়িত ওটা।”
“কি সেটা?”
“আসলে,” কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে বললেন কুডো, “গত কয়েকদিন যাবত কিছু অদ্ভুত ফোন আসছে আমার বাসায়। রিং হয় কিন্তু রিসিভার ওঠানোর পরে ওপাশ থেকে কেউ কথা বলে না।”
“তাই? অদ্ভুত তো,” ইয়াসুকো ভুরু কুঁচকে বলল।
“আরেকটা ব্যাপারও আছে,” কিছুক্ষণ ইতস্তত করার পরে একটা কাগজের টুকরো বের করলেন প্যান্টের পকেট থেকে। “কিছুদিন আগে আমার ঠিকানায় এটা পাঠিয়েছে কেউ।”
নিজের নাম কাগজটার গায়ে দেখতে পেয়ে জমে গেলো ইয়াসুকো। সেখানে লেখা :
ইয়াসুকো হানাওকা থেকে দূরে থাকবি। তোর মত লোকের সাথে কখনই সুখি হতে পারবে না সে।
কম্পিউটারে প্রিন্ট করে লেখা হয়েছে কাগজটাতে। প্রেরক সম্পর্কে কোন তথ্য নেই।
“কেউ আপনাকে বাই পোস্টে পাঠিয়েছে এগুলো?”
“না, আমার ধারণা বাসায় এসে নিজহাতে মেইলবক্সে ঢুকিয়ে রেখে গেছে।”
“কে হতে পারে?”
“ সে সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই। ভাবছিলাম, তুমি বলতে পারবে।”
“দুঃখিত। আমি চিন্তাই করতে পারছি না…” এই বলে ইয়াসুকো ব্যাগ থেকে একটা রুমাল বের করলো। হাত ঘামতে শুরু করেছে তার। “শুধু এই চিরকুটটাই ছিল সেখানে?”
“না, একটা ছবিও ছিল।”
“একটা ছবি?”
“তোমার সাথে যেদিন শিনাগাওয়ায় দেখা করেছিলাম সেদিন তোলা হয়েছিল ওটা। পার্কিংলটে। আমি বুঝতেই পারিনি কিছু।”
নিজের অজান্তেই আশেপাশে একবার চোখ বোলাল ইয়াসুকো। কেউ দেখছে না তো এখন?
এরমধ্যে মিশাতো ফিরে আসলে সে প্রসঙ্গে আর কথা বলল না তারা। কিছুক্ষণ পরে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে কুডোর কাছ থেকে বিদায় জানিয়ে একটা ট্যাক্সিতে উঠে পড়লো মিশাতো আর ইয়াসুকো।
“তোমাকে বলেছিলাম না, খাবার খুব ভালো এখানকার,” ইয়াসুকো বলল। কিন্তু মিশাতো কোন জবাব না দিয়ে কপাল কুঁচকে বসে থাকলো। “এরকম চেহারা বানিয়ে বসে থাকাটা উচিত হয়নি তোমার।“
“আমাকে নিয়ে আসাও উচিত হয়নি তোমার। আমি তো বলেইছিলাম, আসার কোন ইচ্ছে নেই আমার।”
“কিন্তু উনি তোমার কথা বারবার করে বলে দিয়েছিলেন।”
“তোমাকে পেলেই খুশি থাকতেন তিনি। এরপরে আর কখনও আসবো না আমি তোমার সাথে।”
জোরে একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইয়াসুকো। কুডোর সাথে মিশাতোর কখনও ভাব হবে বলে মনে হয় না।
“তুমি কি তাকে বিয়ে করবে, মা?” হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করলো মিশাতো।
ইয়াসুকো সোজা হয়ে বসলো, “কি বলছো এসব?”
“ঠিকই বলছি। তাকে বিয়ে করতে চাও তুমি, তাই না?”
“না!”
“আসলেই?”
“অবশ্যই। মাঝে মাঝে একসাথে ডিনার করি আমরা, এটুকুই।”
“তাহলে ঠিক আছে,” মিশাতো জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল। “কিন্তু হঠাৎ করে এই প্রশ্ন করলে কেন? কিছু…কিছু বলার আছে তোমার?”
“না,” আস্তে আস্তে তার দিকে ঘুরে বলল মিশাতো। “কিন্তু অন্য লোকটাকে ঠকানো উচিত হবে না।”
“অন্য কোন লোক?”
মিশাতো ইয়াসুকোর দিকে তাকিয়ে থাকলো কিন্তু কিছু বলল না। বোঝাই যাচ্ছে, ইশিগামির কথা বলতে চাইছে সে, কিন্তু ট্যাক্সি ড্রাইভারের সামনে তার নাম উচ্চারণ করছে না।
“আমার মনে হয় সেটা নিয়ে তোমার চিন্তা না করলেও চলবে,” ইয়াসুকো বলল।
“হুম,” মিশাতো বলল। ভাব দেখে অবশ্য মনে হলো না তার কথার
সাথে একমত সে।
বাকি পথটা কুডোর মেইলবক্সে আসা চিঠি আর ছবি নিয়ে ভাবতে থাকলো ইয়াসুকো। তার মনে হচ্ছে, এটা ইশিগামিরই কাজ। কুডো আর তার মধ্যকার সম্পর্কটা বের করে ফেলা লোকটার পক্ষে কঠিন কোন কাজ নয়। আর সেটা দেখে ঈর্ষাকাতর হয়েই ওগুলো পাঠিয়েছে সে।
হাজার হলেও ইয়াসুকোকে পছন্দ করে ইশিগামি। আর সেটা যে শুধু নিছক পছন্দের পর্যায়ে আছে তা নয়। কারণ যেভাবে ইয়াসুকোকে সাহায্য করছে সেটা অন্য কেউ হলে করতো বলে মনে হয় না। একমাত্র তার কারণেই টোগাশির খুনের দায়ে পুলিশ এখনও গ্রেফতার করতে পারেনি তাদেরকে। ইশিগামির প্রতি অবশ্যই কৃতজ্ঞ সে। কিন্তু তার মানে কি সারাজীবন অন্য কোন পুরুষের সাথে দেখা করতে পারবে না সে? বিয়ে তো দূরের কথা। তাহলে আর আগের জীবনের চেয়ে পার্থক্য কি থাকলো? টোগাশির সাথে থাকা অবস্থাতেও তো এরকম হয়নি তার সাথে। সম্পূর্ণ অন্য ধাঁচের একজন মানুষের সাথে মানিয়ে চলতে হবে তাকে এখন থেকে।
আর এবার আসলেই কোন নিস্তার নেই।
বাসায় পৌছে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করলো তারা। ইশিগামির ঘরে তখনও বাতি জ্বলছে।
অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে কাপড় বদলাচ্ছে এমন সময় পাশের বাসার দরজা খোলা এবং বন্ধ হবার আওয়াজ কানে আসল তার।
“দেখলে তো?” মিশাতো বলল। “আমাদের জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন তিনি এতক্ষণ।”
“ সেটা বলতে হবে না তোমাকে,” চড়া গলায় বলল ইয়াসুকো। কিছুক্ষণ পরে তার মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো
“হ্যালো?”
“আমি, ইশিগামি,” পরিচিত আওয়াজ ভেসে আসল ওপাশ থেকে
“এখন কথা বলতে পারবেন?”
“হ্যা।”
“রিপোর্ট করার মত কিছু ঘটেছে আজকে?
“না।”
“ভালো,” ফোনের এপাশ থেকেও ইশিগামির ভারি নিঃশ্বাসের আওয়াজ পেলো ইয়াসুকো। “আসলে আপনার সাথে কয়েকটা ব্যাপারে কথা ছিল।”
“জি, বলুন।”
“আপনার দরজার সামনে মেইলবক্সে চিঠিভর্তি তিনটা খাম রেখে দিয়েছি আমি। দয়া করে ফোন রাখার পরপরই ওগুলো নিয়ে আসবেন।”
“চিঠি?” দরজার দিকে চোখ চলে গেলো ইয়াসুকোর।
“সাবধানে রাখবেন ওগুলো। খুব শিঘ্রই কাজে লাগবে। ঠিক আছে?”
“হ্যা।”
“চিঠিগুলোর সাথে একটা কাগজে নির্দেশনা লিখে দিয়েছি আমি। সেগুলো কিভাবে ব্যবহার করতে হবে ওটা পড়লেই বুঝতে পারবেন। পড়া শেষ হলে কাগজটা যে পুড়িয়ে ফেলতে হবে সেটা আশা করি আপনাকে বলতে হবে না। বুঝতে পারছেন কি বলছি?”
“জি। ওগুলো কি এখনই নিয়ে আসবো?”
“না, পরে নিলেও সমস্যা নেই। আরেকটা জরুরি কথা আছে আমার,” কেমন যেন কাঁপা কাঁপা শোনাল ইশিগামির গলা।
“জি, বলেন?”
“এটাই আমার শেষ ফোন কল। এরপরে আর কোনদিন আপনার সাথে যোগাযোগ করবো না আমি। আপনিও আমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করবেন না। যাই ঘটুক না কেন, আপনি আর আপনার মেয়ে সেসবের সাথে জড়াবেন না। তাহলেই নিরাপদ থাকবেন আপনারা।”
ইয়াসুকোর বুকের ভেতর কেউ যেন হাতুড়িপেটা করতে থাকলো। “কি বলছেন এসব, মি. ইশিগামি? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“খুব শিঘ্রই বুঝতে পারবেন। এখন আপনার না জানাই ভালো। আমি যা যা বললাম তাই করবেন, ঠিক আছে?”
“না, ঠিক নেই। আপনি খুলে বলুন সব।”
মিশাতো তার মার কথা বলার ধরণ দেখে পাশে এসে দাঁড়াল।
“খুলে বলার মত কিছু নেই। ভালো থাকবেন।”
“দাঁড়ান-” সে বলল, কিন্তু এরইমধ্যে লাইন কেটে দেয়া হয়েছে।
X
কুসানাগি গাড়িতে ছিল এমন সময়ে তার ফোনটা বাজতে শুরু করলো। প্যাসেঞ্জার সিটে বসে বিশ্রাম করছিল। সে অবস্থাতেই ফোনটা বের করে কানে দিলো। “কুসানাগি বলছি।“
“আমি, মামিয়া,” ওপাশ থেকে চিফের গার আওয়াজ ভেসে এলো। “এখনই এডোগাওয়া পুলিশ স্টেশনে আসো : তামরা দু-জন।”
“কেন? কিছু পেয়েছেন নাকি?”
“এখানে একজন লোক তোমার সাথে কথা বলতে চায়।”
“কে?” কুসানাগি জিজ্ঞেস করলো।
“তার নাম ইশিগামি, ইয়াসুকো হানাওকার পাশের বাসায় থাকেন তিনি।“
“ইশিগামি? আমার সাথে কথা বলতে চায়? তাহলে ফোন দিলো না কেন?”
“আসলে ব্যাপারটা তার চেয়ে জটিল,” মামিয়া গম্ভীর স্বরে জবাব দিলো।
“সে কি আপনাকে কিছু বলেছে চিফ?”
“সে বলছে, তুমি বাদে আর কারো সাথে বিস্তারিত কথা বলবে না। এজন্যেই তোমাকে এখানে দরকার এখন।”
“জি, এখনই আসছি,” কুসানাগি হস্তদন্ত হয়ে বলল। এরপর রিসিভার একহাতে চাপা দিয়ে অন্য হাতে কিশিতানিকে গুঁতো দিলো, “চিফ এখনই আমাদের এডোগাওয়া স্টেশনে যেতে বলছেন।”
এসময় ফোনের স্পিকারে মামিয়ার গলার আওয়াজ ভেসে আসল, “বলছে, সে-ই নাকি কাজটা করেছে।”
“জি? কি বললেন?”
“টোগাশিকে নাকি সে নিজে খুন করেছে। আত্মসমর্পণ করতে এসেছেন ইশিগামি।”
“মানে!?”
এত জোরে উঠে বসলো কুসানাগি যে সিটবেল্টের দাগ বসে গেলো তার গায়ে।