দ্য ডিভোশন অব সাসপেক্ট এক্স – ১৬

অধ্যায় ১৬

একদম পাথরের মত মুখ করে কুসানাগির দিকে তাকিয়ে আছে ইশিগামি। কোন অনুভূতি নেই সেই চেহারায়। কুসানাগির কেমন যেন অস্বস্তি হতে লাগল।

“তাকে আমি প্রথম দেখেছিলাম মার্চের দশ তারিখে,” একদম শান্ত গলায় কথা বলছে লোকটা। “স্কুল থেকে ফেরার পথে দেখি ইয়াসুকোর অ্যাপার্টমেন্টের বাইরে পায়চারি করছে সে। তাদের মেইলবক্সের ভেতরে হাত ঢোকাতে দেখে ফেলি আমি তাকে।”

“কার কথা বলছেন আপনি?”

“মি. টোগাশি! আর কার কথা বলবো? অবশ্য তখনও তার নামটা জানতাম না,” ইশিগামি উত্তর দিলো।

কুসানাগি আর কিশিতানি গণিত শিক্ষকের সাথে এডোগাওয়া থানার একটা রুমে বসে আছে এখন। এখানেই অপরাধিদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ইশিগামি বলে দিয়েছিল তাদের দু-জন ছাড়া অন্য কারো সাথে কথা বলবে না সে। কারণ একসাথে অনেকজন মিলে প্রশ্ন করলে নাকি তার অসুবিধা হয়। কিশিতানি একটা নোটপ্যাডে সবকিছু লিখছে।

“টোগাশিকে সেখানে দেখে কেমন যেন খটকা লাগে আমার। তাই ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করি এখানে কি কাজ তার। প্রথমে ভড়কে গেলেও পরে বলে সে নাকি ইয়াসুকো হানাওকার স্বামী। তখনই তাকে চিনতে পারি আমি আর এ-ও বুঝতে পারি, ডাহা মিথ্যা বলছে সে। কিন্তু তাকে সেটা বুঝতে দেই না।”

“দাঁড়ান, দাঁড়ান,” হাত তুলে তাকে থামার নির্দেশ দিলো কুসানাগি। “আপনি বুঝলেন কিভাবে যে সে মিথ্যা কথা বলছে?”

ছোট করে একবার নিঃশ্বাস নিলো ইশিগামি, “কারণ ইয়াসুকো হানাওকা সম্পর্কে যা যা জানা দরকার সব জানি আমি। আমি জানতাম পাঁচ বছর আগেই তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে আর আগের স্বামীর হাত থেকে বাঁচার জন্যে বারবার বাসা বদলাতে হয়েছে তাকে।”

“কিন্তু এসব জানলেন কিভাবে আপনি? আমার জানামতে তার সাথে তো কথাই হত না আপনার। শুধুমাত্র লাঞ্চ শপটাতে নিয়মিত যেতেন বলেই প্রতিদিন অল্প সময়ের জন্যে দেখা হত।”

“সবাইকে সেটাই বলি আমি।”

“জি?”

চেয়ারে সোজা হয়ে বসলো ইশিগামি। “আমি আসলে ইয়াসুকো হানাওকার বডিগার্ড। খারাপ লোকদের হাত থেকে তাকে বাঁচানোই আমার কাজ। কিন্তু সঙ্গত কারণে সেটা কাউকে জানতে দেইনি আমরা। হাজার হলেও একজন স্কুল শিক্ষক আমি।”

“কিন্তু আপনার সাথে প্রথম যেদিন দেখা হলো সেদিন তো বলেছিলেন আপনাদের মধ্যে কথাবার্তাই হয় না,” কুসানাগি জোর দিয়ে বলল।

“আপনি তো টোগাশির খুন সম্পর্কে প্রশ্ন করতে এসেছিলেন আমার বাসায়, তাই না? তাই সত্যটা বলার প্রশ্নই আসে না। তাহলে সাথে সাথে আমাকে সন্দেহ করা শুরু করতেন আপনারা।”

“আচ্ছা…” কুসানাগি ইতস্তত করতে লাগল। “তার মানে বলতে চাচ্ছেন ইয়াসুকো হানাওকা সম্পর্কে সবকিছু জানেন কারণ আপনি তার বডিগার্ড?”

“ঠিক বলেছেন।”

“তাহলে তো বেশ অনেকদিন ধরেই তার সাথে ঘনিষ্ঠতা আপনার। ঘটনার আগে থেকেই?”

“হ্যা, যেরকমটা বলেছি, আমাদের চুক্তিটা ছিল একদম গোপনিয়। যোগাযোগের ব্যাপারে খুবই সাবধানি ছিলাম আমরা। এমনকি তার মেয়েও কিছু জানতো না এ ব্যাপারে।”

“কিভাবে সেটা করতেন আপনারা?”

“বেশ কয়েকটা উপায় ছিল আমাদের। সেসব সম্পর্কে এখনই শুনতে চান?” চোখে প্রশ্ন নিয়ে ডিটেক্টিভের দিকে তাকালো ইশিগামি।

কুসানাগি এখনও একধরণের ঘোরের মধ্যে আছে। লোকটার কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তার। ইয়াসুকোর সাথে তার গোপন এই সম্পর্কের কথা যেভাবে অকপটে স্বীকার করলো তাতে অবাক না হয়ে পারেনি কুসানাগি। আবার অবিশ্বাসও করতে পারছে না কিছু। তবে সত্যিই যদি এমন কিছু ঘটে থাকে তাহলে সেটা জানতে চায় সে।

“না,” কুসানাগি বলল। “সে ব্যাপারে পরে প্রশ্ন করবো আপনাকে। আগে মি. টোগাশির ব্যাপারে বলুন। আপনি বলছিলেন, দশ তারিখে মিস হানাওকার বাসার বাইরে প্রথম দেখেছিলেন তাকে। আর দেখেও কিছু না বোঝার ভান করেছিলেন। এরপর কি হলো?”

“সে আমাকে ইয়াসুকোর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে, সে কোথায় আছে, তার মেয়ে কোথায়-এসব। উত্তরে আমি বলি, সেখান থেকে চলে গেছে হানাওকারা। নতুন একটা চাকরি পেয়েছে ইয়াসুকো। বুঝতেই পারছেন, অবাক হয়ে গিয়েছিল সে আমার কথা শুনে। এরপরে ইয়াসুকোর নতুন ঠিকানা জানি কিনা সেটা জিজ্ঞেস করে। আমি বলি, সেটা জানা আছে আমার।”

“কি বলেছিলেন তাকে?”

“শিনোজাকির কথা বলেছিলাম। বলি যে, পুরনো এডোগাওয়া নদীর পাশে একটা অ্যাপার্টমেন্টে চলে গেছে তারা,” হেসে জবাব দিলো ইশিগামি।

শিনোজাকির কথা কখন উঠবে সেটাই ভাবছিলাম, মনে মনে বলল কুসানাগি। “এটুকুই বলেছিলেন?” জিজ্ঞেস করলো। “এভাবে তো খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। নদীর পাশে অনেকগুলো অ্যাপার্টমেন্ট আছে আর জায়গাটাও বেশ বড়।“

“ঠিকানাও জানতে চেয়েছিল টোগাশি। তাকে অপেক্ষা করতে বলে ভেতরে চলে যাই আমি। ম্যাপ দেখে একটা ঠিকানা লিখে দেই তাকে। কিন্তু ঠিকানাটা আসলে একটা পরিত্যক্ত পানি শোধনাগার কেন্দ্রের। তার মুখের হাসিটা যদি দেখতেন তখন! আমাকে বলেছিল আমি নাকি অনেক ঝামেলা কমিয়ে দিয়েছি তার।”

“তাকে সেই ঠিকানাটা দিলেন কেন আপনি?”

“কারণ জায়গাটা একদম নিরিবিলি। কোন সাক্ষি থাকবে না আশেপাশে। আর ওখানটা ভালোমত চিনি আমি।”

“দাঁড়ান,” অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলল কুসানাগি। “তার মানে তখন থেকেই তাকে খুন করার পরিকল্পনা করা শুরু করে দেন আপনি?”

“অবশ্যই,” দেরি না করে জবাব দিলো ইশিগামি। “যেমনটা বলেছি, মিস হানাওকাকে রক্ষা করাই আমার কাজ। কেউ যদি তার কোন সমস্যা করার চেষ্টা করে তাহলে তাকে রাস্তা থেকে সরানোটা আমার দায়িত্ব।”

“আর আপনার মনে হয়েছিল মি. টোগাশি তার ক্ষতি করার চেষ্টা করবে?”

“মনে হওয়ার কিছু ছিল না। আমি জানতাম সেটা। এর আগেও তার ওপর অনেক অত্যাচার করেছে টোগাশি। এজন্যেই তো বাসা বদলে আমার পাশের অ্যাপার্টমেন্টে চলে আসে তারা।”

“মিস হানাওকা কি নিজে আপনাকে এসব বলেছেন?”

“মানে, আমাদের ঐ গোপন যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে যতটা বলা যায় আর কি।”

কোন প্রকার ইতস্তত বোধ করা ছাড়াই কথাগুলো বলছে ইশিগামি। এখানে আসার আগে গল্পটা সাজানোর অনেক সময় পেয়েছে সে, নিজেকেই বলল কুসানাগি। তারপরেও সেটা শুনে সন্দেহ জাগছে তার মনে। ইশিগামির ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে এতদিন সে যা ভবতো তার সাথে কিছুই মিলছে না। শান্তশিষ্ট স্কুল শিক্ষকের এ কোন রূপ? কিন্তু তারপরেও পুরো গল্পটাই শুনতে হবে তাকে, সেটা সত্য হোক আর না হোক।

“তাকে ঠিকানাটা দেয়ার পরে কি করলেন?”

“সে আমার কাছে ইয়াসুকোর নতুন কর্মস্থল সম্পর্কে জানতে চায় এরপর। উত্তরে বলি, আমি ঠিকানাটা সঠিক জানি না, কিন্তু শুনেছি একটা রেস্তোরাঁয় চাকরি করে সে এখন। সেখানে রাত এগারোটা পর্যন্ত কাজ করতে হয় তাকে, তার মেয়ে স্কুল শেষে সেখানে গিয়ে অপেক্ষা করে। ইয়াসুকোর কাজ শেষে রাতে একসাথে বাসায় ফেরে দু-জন। সবটাই অবশ্য বানানো ছিল।”

“আর এসব কিছু বানালেন কেন আপনি?”

“কারণ সে তখন কি করবে সেটা নিয়ে চিন্তায় ছিলাম আমি। আমি তাকে যে জায়গার ঠিকানাটা দিয়েছি সেটা নিরিবিলি হলেও দিনের বেলা আশেপাশে চলে আসতে পারে অনেকে। আর তাকে যদি আমি এটা বলি যে, রাত করে বাসায় ফিরবে ইয়াসুকো আর তার মেয়ে, তাহলে তখনই তাদের অ্যাপার্টমেন্টে যাবে না সে।”

“থামুন,” আবার হাত উঠিয়ে ইশারা করলো কুসানাগি। “সে মুহূর্তে ওখানে দাঁড়িয়েই এত কিছু পরিকল্পনা করে ফেললেন আপনি?”

“হ্যা। কেন, আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না?”

“তা নয়…কিন্তু এত দ্রুত কেউ এরকম চিন্তা করতে পারে সেটা মানতে একটু কষ্ট হচ্ছে বৈকি।”

“অত কঠিনও না ব্যাপারটা,” ইশিগামি মৃদু হেসে বলল। “আমি জানতাম ইয়াসুকোর সাথে দেখা করার জন্যে তর সইছিলো না টোগাশির। আর সেটাকেই তার বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছি আমি।”

“আপনার জন্যে হয়তো কঠিন না,” ঠোঁট ভিজিয়ে বলল কুসানাগি। “তো, এরপর কি হলো?”

“সে চলে যাওয়ার আগে তাকে আমার মোবাইল নম্বরটা দেই আমি। বলি, অ্যাপার্টমেন্টটা খুঁজে না পেলে যেন আমাকে ফোন দেয়। তার জায়গায় অন্য কেউ হলে কিন্তু আমার এই অতি আগ্রহ দেখে সন্দেহ করতো, কিন্তু তার মনে ওরকম কিছুই আসেনি। সত্যি কথা বলতে কি, তাকে অতটা চালাক মনে হয়নি আমার।”

“এটা কিন্তু খুব কম লোকের মাথাতেই আসবে যে, সদ্য পরিচয় হওয়া একজন লোক তাকে খুন করার পরিকল্পনা আঁটছে।”

“যাই হোক, ভুয়া ঠিকানাটা পকেটে ভরে খুশিমনে সেখান থেকে চলে যায় সে। এরপর অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে প্রস্তুতি নিতে শুরু করি আমি,” এই বলে সামনে রাখা চায়ের কাপটায় নিঃশব্দে একবার চুমুক দিলো ইশিগামি।

“কি রকম প্রস্তুতি?”

“ওরকম বড়সড় কোন প্রস্তুতি না। জামাকাপড় পাল্টে অপেক্ষা করতে থাকি আমি। কোন উপায়ে তাকে খুন করলে সবচেয়ে বেশি সুবিধা হবে সেটা চিন্তা করা শুরু করি। বেশ কিছুক্ষণ ভাবার পর ঠিক করি শ্বাসরোধ করে মারাটাই উচিত হবে। কারণ রক্তপাতও হবে না এতে। আর সেরকম ভারি কোন অস্ত্রেরও দরকার পড়বে না। তবে শক্ত কিছু লাগবে এটা জানতাম আমি, এজন্যেই কোটাটসু হিটারটার তার খুলে নেই।”

“সেটা কি আপনি ঘটনাস্থলে নিয়ে গিয়েছিলেন সঙ্গে করে?”

ইশিগামি মাথা নেড়ে বলল, “হ্যা। দশটার দিকে বাসা থেকে বের হই আমি। তারটার পাশাপাশি একটা জিপো লাইটারও ছিল আমার সাথে। স্টেশনে যাওয়ার পথে খেয়াল করি রাস্তার পাশে কেউ একজন নীল রঙের একটা প্লাস্টিকের পর্দা ফেলে রেখেছে, সেটাও উঠিয়ে নেই। ট্রেন থেকে মিজু স্টেশনে নেমে যাই, এরপর একটা ট্যাক্সি নিয়ে পুরনো এডোগাওয়া নদীর কাছে যাই আমি।”

“মিজু স্টেশন? শিনোজাকি না?”

“অবশ্যই না,” নির্দ্বিধায় বলল ইশিগামি। “আমি চাইনি ভুল করে লোকটার সাথে দেখা হয়ে যাক আগেভাগেই। তাকে যে জায়গাটার কথা বলেছিলাম সেখান থেকে কিছুটা দূরে ট্যাক্সি থামিয়ে নেমে যাই।“

“তো, ট্যাক্সি থেকে বের হওয়ার পর কি করলেন?”

“চারপাশে খেয়াল করে যখন দেখলাম কেউ নেই, তখন গন্তব্যস্থলের দিকে রওনা দিলাম। অবশ্য অতটা সতর্ক না হলেও চলতো, ঐ সময়ে ওদিকে খুব একটা যায় না কেউ,” আবারো চায়ের কাপে একটা চুমুক দিলো ইশিগামি। “নদীর তীরে পৌছানোর সাথে সাথে আমার ফোনটা বাজতে শুরু করে। টোগাশিই ফোন দিয়েছিল। বলে, আমি যে ঠিকানাটা দিয়েছি ওখানে কোন অ্যাপার্টমেন্ট খুঁজে পাচ্ছে না। আমি জিজ্ঞেস করি ঠিক কোথায় আছে সে। তখন আশেপাশে দেখে বিস্তারিতভাবে সেখানকার বর্ণনা দেয় আমাকে। কিন্তু এটা বুঝতে পারে না, আমি সেখানেই যাচ্ছি তখন। ততক্ষণে তার অবস্থান সম্পর্কে একদম নিশ্চিত হয়ে গিয়েছি। ওখানে পৌঁছে দেখি নদীর পাশে ঘাসের ওপর বসে আছে টোগাশি। তার একদম পেছনে গিয়ে না দাঁড়ানো পর্যন্ত কিছুই টের পায়নি সে। কিন্তু ততক্ষণে কোটাটসুর তারটা দিয়ে তার গলা পেঁচিয়ে ধরেছি আমি। সে বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করেছিল অবশ্য, কিন্তু আমার সাথে পেরে ওঠেনি। খুব তাড়াতাড়িই নিস্তেজ হয়ে আসে। যতটা ভেবেছিলাম তার চেয়েও সহজ ছিল কাজটা,” ইশিগামির চোখ তার চায়ের কাপটার দিকে গেলো, “আরেক কাপ চা দেয়া যাবে কি?”

কিশিতানি দাঁড়িয়ে কেতলি থেকে চা ঢেলে দিলো তার কাপে। ইশিগামি মাথা নেড়ে ধন্যবাদ জানাল।

“ভিক্টিমের শারীরিক গঠন কিন্তু অতটা দূর্বল ছিল না। ভালোমতই বাঁধা দেয়ার কথা তার,” কুসানাগি যুক্তি দেখালো।

ইশিগামির অভিব্যক্তির কোন পরিবর্তন হলো না, কেবল চোখদুটো সরু হয়ে আসল। “আমি আমার স্কুলের জুডো ক্লাবের পরিদর্শক। তাছাড়া পেছন দিক দিয়ে কাউকে ঘায়েল করা তুলনামূলক অনেক সোজা, লোকটা যতই শক্তিশালি হোক না কেন।”

“তাকে মেরে ফেলার পরে কি করলেন?” কুসানাগি মাথা নেড়ে জিজ্ঞেস করলো।

“আমি জানতাম লাশটার পরিচয় গুম করতে হবে। কারণ পুলিশ যদি তার নাম জেনে যায় তাহলে অবশ্যই ইয়াসুকো হানাওকাকে সন্দেহ করা শুরু করবে তারা। প্রথমে তার জামাকাপড় খুলে ফেলি, তারপর চেহারাটা থেতলে দেই,” শীতল স্বরে বলল ইশিগামি। “সেটার জন্যে প্রথমে প্লাস্টিকের পর্দাটা দিয়ে তার চেহারাটা মুড়িয়ে নেই, এরপর একটা বড় পাথর দিয়ে আঘাত করতে থাকি। কয়বার আঘাত করেছিলাম সেটা বলতে পারবো না, কিন্তু ডজনখানেক বার তো হবেই। আর লাইটারটা দিয়ে আঙুলগুলো পুড়িয়ে দেই। এরপর তার জামাকাপড়গুলো নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে চলে যাই। কিছুদূর যাওয়ার পর একটা পুরনো তেলের ড্রাম চোখে পড়ে আমার। ব্যাস, ওর মধ্যে কাপড়গুলো ঢুকিয়ে দিয়ে লাইটার দিয়ে জ্বালিয়ে দেই। কিন্তু আগুনটা বেশি উঁচুতে উঠে যাওয়ায় ভয় পেয়ে যাই আমি। কেউ দেখে ফেলার আগেই ওগুলো রেখে পালিয়ে যাই। এরপর একটা ট্যাক্সি ধরে টোকিও স্টেশনে চলে আসি। সেখান থেকে আরেকটা ট্যাক্সি নিয়ে বাসায়। মধ্যরাতের একটু পরে বাসায় ফিরি,” একটানে কথাগুলো বলে থামল সে। “এই তো, এভাবেই ঘটেছিল ব্যাপারটা। খুনের কাজে যে তার আর লাইটারটা ব্যবহার করেছিলাম সেটা আমার অ্যাপার্টমেন্টে খুঁজে পাবেন আপনারা।”

চোখের কোণ কিশিতানির দিকে তাকালো কুসানাগি, নোটপ্যাডে লিখতে ব্যস্ত জুনিয়র ডিটেক্টিভ। একটা সিগারেট ধরিয়ে ইশিগামির দিকে তাকালো সে। শান্তশিষ্ট ভঙ্গিতে বসে আছে লোকটা।

গল্পটায় কোন ফাঁক নেই। লাশের অবস্থা থেকে শুরু করে ক্রাইম-সিন সম্পর্কে যা যা বলেছে সে, সবই মিলে গেছে। আর যেহেতু পুলিশের পক্ষ থেকে এর আগে খুনটা সম্পর্কে কোন খবরের কাগজে কিংবা টিভিতে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি, সেহেতু বানিয়ে বানিয়ে বলার সম্ভাবনাও কম।

“আপনি কি ইয়াসুকো হানাওকাকে বলেছিলেন খুনটার ব্যাপারে?” কুসানাগি জিজ্ঞেস করলো কিছুক্ষন পর।

“তার দরকার কি?” ইশিগামি পাল্টা প্রশ্ন করলো। “তাকে বললে সে যদি কথায় কথায় অন্য কাউকে বলে দিতো? মহিলাদের পেট এমনিতেও অনেক পাতলা হয়।“

“তার মানে, কি ঘটেছে এ ব্যাপারে তার সাথে কোন কথাই বলেননি আপনি?”

“কিছুই বলিনি। আর আপনারা যখন থেকে ওরকম ছোক ছোক করা শুরু করলেন তখন থেকে তার সাথে যতটা সম্ভব কম যোগাযোগ করার চেষ্টা করি আমি। যাতে সন্দেহ না জাগে কারো মনে।”

“আপনি বলছিলেন বিশেষ উপায়ে মিস হানাওকার সাথে যোগাযোগ করতেন আপনি। সে সম্পর্কে এখন বলতে পারবেন?”

“বেশ কয়েকটা উপায়ে যোগাযোগ করতাম আমরা। এই যেমন আমার সাথে সরাসরি কথা বলতেন তিনি।”

“মানে, কোথাও দেখা করতেন আপনারা?”

“সেরকম কিছু না। ওতে লোকজনের দেখে ফেলার ভয় ছিল। সে তার অ্যাপার্টমেন্ট থেকেই কথা বলতো আর এপাশ থেকে একটা যন্ত্রের মাধ্যমে সেগুলো শুনতাম আমি।”

“কি রকম যন্ত্র?”

“আমাদের অ্যাপার্টমেন্ট দুটোর মাঝের দেয়ালটায় সাউন্ড অ্যামপ্লিফাইয়ার বসিয়ে দেই আমি। তাই সবকিছু পরিস্কার শোনা যেত।”

কিশিতানির লেখা বন্ধ করে মুখ তুলে তাকালো। কুসানাগি জানে কেন লেখা বন্ধ করেছে সে।

“তার মানে, আড়ি পাততেন আপনি?”

ইশিগামির ভুরু কুচকে গেলো। “আড়ি পাততে যাবো কেন? আমার সাথেই তো কথা বলতেন ইয়াসুকো!”

“তো, মিস হানাওকা এই যন্ত্রের কথা জানতেন?”

“সেটার কথা হয়তো জানতেন না কিন্তু দেয়ালের দিক মুখ করেই কথাগুলো বলতেন তিনি।”

“সেজন্যেই আপনি বলছেন, আপনার সাথে কথা বলতেন তিনি?”

“হ্যা। সেখানে তার মেয়েও থাকতো, তাই সরাসরি আমার সাথে কথা বলতে পারতেন না, বুঝতেই পারছেন। এজন্যে মেয়ের সাথে কথা বলার ছল করে আমাকে নির্দেশ দিতেন।”

কুসানাগির হাতের সিগারেটটা অর্ধেক পুড়ে গেছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত একবারও ঝাড়া দেয়নি সেটা। শেষবারের মত একটা টান দিয়ে সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে ফেলে দিয়ে কিশিতানির দিকে তাকালো। জুনিয়র ডিটেক্টিভ

বোকার মত ঘাড় চুলকাচ্ছে, বিভ্রান্ত হয়ে গেছে পুরোপুরি।

“ইয়াসুকো হানাওকা কি আপনাকে এটা নিজে জানিয়েছিলেন, মেয়ের সাথে কথা বলার ছলে আসলে আপনার সাথে কথা বলছেন তিনি?”

“সেটা বলার তো দরকার ছিল না। আমি তার সম্পর্কে সবকিছুই জানতাম,” ইশিগামি প্রবলভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে নিশ্চিত করলো তাদেরকে।

“তার মানে, সেরকম কিছু বলেননি তিনি? হয়তো গোটা ব্যাপারটাই আপনি কল্পনা করে নিয়েছিলেন?”

“অসম্ভব,” ইশিগামির অভিব্যক্তিহীন চেহারায় একটু বিরক্তি ভর করলো যেন। “আমি তো তার শয়তান স্বামীটার কথা তার কাছ থেকেই শুনেছি। না-হলে নিজের মেয়েকে সে কথা জানানোর কি প্রয়োজন তার? আমার সুবিধার জন্যেই তথ্যগুলো পাচার করছিলেন তিনি। ইঙ্গিতে সে ব্যাপারে সাহায্য চাচ্ছিলেন।”

কুসানাগি হাত নেড়ে তাকে শান্ত হয়ে বসার নির্দেশ দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি অন্য উপায়েও যোগাযোগ করার কথা বলছিলেন না?”

“হ্যা। প্রতি সন্ধ্যায় তাকে ফোন করতাম আমি।’

“তার বাসার ফোনে?”

“না, মোবাইল ফোনে। কথা বলতাম না অবশ্য আমরা। যদি তার কোন দরকার থাকতো তাহলে ফোনটা ধরতেন। না-হলে পাঁচবার রিং হবার পরে রেখে দিতাম আমি। এটাই ঠিক করে নিয়েছিলাম আমরা।“

“আপনারা ঠিক করে নিয়েছিলেন? তার মানে, এ ব্যাপারে ধারণা ছিল তার?”

“অবশ্যই। আগেই কথা বলে ঠিক করে নিয়েছিলাম আমরা।”

“মিস হানাওকাকে কিন্তু এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।”

“কেন করবেন না? একমাত্র তখনই তো নিশ্চিত হতে পারবেন আপনারা,” আত্মবিশ্বাসের সাথে জবাব দিলো ইশিগামি।

“এই কথাগুলো আপনাকে আরো কয়েকবার বলতে হতে পারে। একটা আনুষ্ঠানিক জবানবন্দি দিতে হবে আমাদের কাছে।“

“কোন সমস্যা নেই। আমি জানি অনেক নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয় আপনাদের।”

“তার আগে আপনার কাছে আরেকটা প্রশ্ন আছে আমার,” কুসানাগি টেবিলে হাত রেখে বলল। “আপনি আত্মসমর্পণ করলেন কেন?”

“কেন, আত্মসমর্পণ করা কি উচিত হয়নি আমার?” একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে জিজ্ঞেস করলো ইশিগামি।

“সেটা তো আমি জিজ্ঞেস করিনি। আমি বলছি, কেন এখন আত্মসমর্পণ করলেন আপনি?”

“তাতে কি আসে যায়? আপনারা তো একটা স্বীকারোক্তি চাচ্ছেন তাই না? ‘নিজের ভুল বুঝতে পেরে একদম ভেঙে পড়ে খুনি, এরপর নিজেই পুলিশের কাছে ধরা দেয়’-এটা কেমন হয়?”

“আপনাকে দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে না বিন্দুমাত্র ভেঙে পড়েছেন।”

“যদি আপনার মনে প্রশ্ন আসে, কাজটা করে আমার খারাপ লাগছে কিনা, তাহলে বলবো সেরকম কিছু মনে হচ্ছে না আমার। পরিতাপ আছে অবশ্যই। যা করেছি সেটা না করলেও পারতাম। আর যদি জানতাম আমার সাথে এভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে, তাহলে মোটেও লোকটাকে খুন করতাম না আমি।”

“কি? বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে আপনার সাথে?”

“আসলে ইয়াসুকো…” নিচের দিকে তাকিয়ে বলল ইশিগামি, “ইয়াসুকো অন্য একটা লোকের সাথে এখন নিয়মিত দেখা-সাক্ষাত করছে। কিন্তু ঐ টোগাশির হাত থেকে তো আমি বাঁচিয়েছি তাকে! সে যদি আমাকে ওসব না বলতো তাহলে কখনই খুনটা করতাম না। মনে আছে একদিন পরিস্কার করে বলেছিল সে : ‘ওকে যদি মেরে ফেলতে পারতাম!’ এজন্যেই তার হয়ে টোগাশিকে খুন করি আমি। এটা করতে সে-ই আমাকে কৌশলে নির্দেশ দিয়েছে। আচ্ছা, পুলিশ তাকে এখনও গ্রেফতার করছে না কেন?”

X

ইশিগামির স্বীকারোক্তির সাথে মিলিয়ে দেখার জন্যে তার বাসায় তল্লাশি চালাতে আসে কুসানাগি আর তার দলবল। তল্লাশি চলাকালীন সময়ে পাশের বাসায় ইয়াসুকো হানাওকার সাথে কথা বলেছে সে আর কুসানাগি। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, ইয়াসুকো আর মিশাতো দু-জনেই বাসায়। একজন মহিলা অফিসার অবশ্য মিশাতোকে বাইরে নিয়ে গেছে আলাদাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্যে।

ইয়াসুকো যখন শোনে ইশিগামি আত্মসমর্পণ করেছে বিস্ময়ে চোখগুলো বড় বড় হয়ে যায় তার; দেখে মনে হয় নিঃশ্বাসও নিতে পারছে না। মুখ খুললেও আওয়াজ বের হয় না সেখান থেকে।

“খুব অবাক হয়েছেন নিশ্চয়ই?” কুসানাগি তার অভিব্যক্তি লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করলো।

“আমার কোন ধারণাই ছিল না এব্যাপারে। টোগাশিকে কেন খুন করতে যাবেন তিনি?” অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা দোলাতে দোলাতে বলল ইয়াসুকো।

“সম্ভাব্য কোন কারণের কথাই কি মাথায় আসছে না আপনার?”

প্রশ্নটা শুনে ইতস্ততবোধ করতে লাগলো ইয়াসুকো। তাকে দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা বলতে চাচ্ছে, কিন্তু বলতে পারছে না।

“ইশিগামি বলেছে আপনার জন্যেই নাকি এসব করেছে সে। আপনার পক্ষ থেকে খুন করেছে মি. টোগাশিকে।“

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইয়াসুকো।

“তার মানে, কোন কারণ আছে তাহলে।“

ইয়াসুকো মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলল, “আমি জানি আমাকে মনে মনে পছন্দ করতেন তিনি। কিন্তু তার জন্যে এতদূর যাবেন-”

“সে আমাদের বলেছে আপনাদের দু-জনের মধ্যে নাকি বেশ অনেকদিন যাবত যোগাযোগ ছিল?”

“যোগাযোগ?” ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো ইয়াসুকো। “আমরা তো কথাই বলতাম না বলতে গেলে।”

“কিন্তু প্রতিদিন সন্ধ্যায় ফোন তো করতেন তিনি?” এরপর কুশাটানি ফোনকলের ব্যাপারটা খুলে বলল তাকে। সেটা শুনে আবারও ভুরু কুঁচকে গেলো ইয়াসুকোর।

“তার মানে উনিই ফোন করতেন!”

“আপনি জানতেন না সেটা?”

“আমি একবার ভেবেছিলাম উনিই হবেন, কিন্তু নিশ্চিত ছিলাম না। কখনও নাম বলেননি তিনি ফোনে।”

“বেশ। এই ফোনকলগুলোর ব্যাপারে একটু বিস্তারিত বলতে পারবেন?”

ইয়াসুকো বলল তিনমাস আগে একদিন সন্ধ্যায় প্রথম ফোন আসে তার মোবাইলে। নাম না বলেই ওপাশ থেকে তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আলোচনা শুরু করে দেয় লোকটা। এমন সব কথা বলে যেগুলো কারো পক্ষে জানা প্রায় অসম্ভব, যদি না তার ওপর ক্রমাগত নজর রাখে কেউ। সে ভয় পেয়ে গিয়েছিল, কেউ একজন হয়তো তার পিছু নেয় সবসময়। তার সব কর্মকান্ডের ওপর নজর রাখে। কিন্তু লোকটার পরিচয় খুঁজে পায়নি। এরপর থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় ঐ নির্দিষ্ট সময়টাতে ফোন আসতে শুরু করে, কিন্তু কোনবারই ফোন ধরেনি সে। একবার অতিষ্ঠ হয়ে অত কিছু না ভেবেই ফোনটা ধরে। তখন ওপাশ থেকে লোকটা বলে : “আমি জানি আপনি অনেক ব্যস্ত থাকেন, তাই ফোন ধরতে পারেন না। তাই একটা বুদ্ধি দেই আপনাকে, এখন থেকে প্রতিদিনই পাঁচবার ফোন দেবো আমি। যদি আপনার কিছু দরকার থাকে, তাহলে পঞ্চমবারের আগেই ফোন ধরবেন।”

না চাওয়া সত্ত্বেও একমত হয়েছিল ইয়াসুকো। এরপর থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় কোন আসতে থাকে। লোকটা কোন টেলিফোন বুথ থেকে ফোন দিত। কিন্তু কোনবারই ফোন ধরেনি সে।

“আপনি কি তার গলা শুনেও চিনতে পারেননি?”

“না। এর আগে খুব কমই কথা হয়েছিল আমাদের। আর ঐ দু-বার ছাড়া কখনও তার ফোন ধরিনি আমি। আর আমার মাথাতেও এটা আসেনি, তিনি ওরকম কাজ করবেন। হাজার হলেও একজন স্কুল শিক্ষক বলে কথা!”

“কিন্তু এখনকার যুগে সেটা কোন চারিত্রিক সনদপত্র হতে পারে না,“ কিশিতানি বলল। বলে নিজেই যেন লজ্জা পেয়ে গেলো, তাড়াতাড়ি মাথা নিচু করে নিলো সে।

কুসানাগির মনে পড়লো, শুরু থেকেই ইয়াসুকোর পক্ষে কথা বলে আসছে জুনিয়র ডিটেক্টিভ। ইশিগামি আত্মসমর্পণ করায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে সে।

“ফোনকলগুলো ছাড়াও অন্য কিছু ঘটেছিল নাকি?”

“একটু অপেক্ষা করুন,” এই বলে উঠে পাশের ঘর থেকে তিনটা খাম নিয়ে আসল ইয়াসুকো। প্রতিটার সামনের দিকে লেখা ‘ইয়াসুকো হানাওকা।

“এগুলো কি?”

“আমার মেইলবক্সে পেয়েছিলাম খামগুলো। আরো ছিল, কিন্তু ওগুলো ফেলে দিয়েছি আমি। যদি কোনদিন কাজে লাগে এই ভেবে এই তিনটা রেখে দিয়েছিলাম। রাখতে অবশ্য ভালো লাগেনি, কিন্তু টিভিতে এরকম করতে দেখেছি আমি অনেককে।”

কুসানাগি খামগুলো খুলল।

প্রতিটাতে একটা কাগজ ভাঁজ করে রাখা আছে, আর সেগুলোতে কম্পিউটারে টাইপ করে কিছু লেখা। কোনটাই অবশ্য বেশি লম্বা নয় :

আমি লক্ষ্য করছি ইদানিং আপনি বেশি বেশি মেকআপ করছেন। রঙচঙে জামা-কাপড়ও পরছেন। এটা তো আপনার সাথে যায় না। সাধারণ জামা- কাপড়েই আপনাকে বেশি ভালো দেখায়। আপনি যে আজকাল দেরি করে বাসায় ফিরছেন সেটাও আমাকে বেশ পীড়া দিচ্ছে। কাজ শেষ করেই আপনার বাসায় ফিরে আসা উচিত।

কোনকিছু নিয়ে কি আপনি চিন্তিত? যদি সেরকম কিছু হয়ে থাকে তাহলে দয়া করে আমাকে সেটা বলতে সঙ্কোচ করবেন না। আপনি জানেন,

আপনি জানেন, এজন্যেই প্রতিরাতে আপনাকে ফোন করি আমি। আপনাকে উপদেশ দিতে পারি এরকম অনেক বিষয় আছে। অন্য কাউকে ঘুণাক্ষরেও বিশ্বাস করবেন না। আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিশ্বাস করা আপনার উচিত হবে না।

আমার কেন যেন মনে হচ্ছে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটেছে। আমার আশঙ্কা আপনি আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। আমি আমার অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করি, আপনি এরকম কিছু কখনও করবেন না, কিন্তু যদি করেন তাহলে আমি আপনাকে ক্ষমা করতে পারবো বলে মনে হয় না। আমি আপনার একমাত্র পুরুষ। একমাত্র আমিই আপনাকে রক্ষা করতে পারবো।

“আমি এগুলো নিয়ে গেলে কিছু মনে করবেন?”

“ওতেই বরং খুশি হবো আমি।”

“এগুলো ছাড়া ইদানিং আর কিছু ঘটেছে?”

“আমার সাথে? না, তেমন কিছু ঘটেনি…” ইয়াসুকোর গলার আওয়াজ

কমে আসল যেন।

“তাহলে আপনার মেয়ের সাথে?”

“তা-ও না। কিন্তু…মি. কুডোর সাথে কিছু ঘটনা ঘটেছে।”

“মি. কুনিয়াকি কুডো? কি ঘটেছে?”

“সেদিন একসাথে ডিনার করার সময় বললেন তাকে কে যেন অদ্ভুত একটা চিঠি পাঠিয়েছে। প্রেরকের নাম-ঠিকানা কিছুই উল্লেখ করা ছিল না, কিন্তু লেখা ছিল আমার থেকে যেন দূরে থাকেন উনি। আর খামের ভেতরে কিছু ছবিও ছিল। তার অজ্ঞাতসারেই তোলা হয়েছিল ছবিগুলো।”

“তার মানে, যে আপনাকে বিরক্ত করছিল সে মি. কুডোরও পিছু নিয়েছিল?”

কুসানাগি আর কিশিতানি একবার দৃষ্টি বিনিময় করলো পরস্পরের মধ্যে। শুনে মনে হচ্ছে ইশিগামিরই কাজ এগুলো। মানাবু ইউকাওয়ার কথা চিন্তা করলো কুসানাগি। ইশিগামিকে কতটা সম্মান করে পদার্থবিদ! কিন্তু যখন শুনবে সে একজন আধপাগল প্রেমিক ছাড়া কিছু নয়, তখন ভীষণ কষ্ট পাবে।

কেউ একজন দরজায় নক করলে ইয়াসুকো খুলে দিলো সেটা। এক জুনিয়র পুলিশ অফিসার ভেতরে ঢুকলো। ইশিগামির অ্যাপার্টমেন্টে তল্লাশি দলের সদস্য সে।

“আপনার সাথে কিছু কথা ছিল, স্যার,” ডিটেক্টিভ কুসানাগির উদ্দেশ্যে বলল।

“অবশ্যই,” মাথা নেড়ে তার সাথে বের হয়ে এলো সে।

পাশের অ্যাপার্টমেন্টে পুলিশ চিফ মামিয়া ডেস্কের পাশে একটা চেয়ারে বসে আছে। তার পাশের কম্পিউটারের মনিটরটা চালু করে রাখা হয়েছে। পুরো বাড়িতে এখনও তল্লাশি চালাচ্ছে জুনিয়র অফিসারেরা। অপ্রয়োজনিয় আলামত কার্ডবোর্ডের বাক্সে করে স্টেশনে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছে।

মামিয়া বুকশেলফের দিককার দেয়ালের দিকে নির্দেশ করে বলল, “এদিকটা দেখো।”

কুসানাগি অবাক হয়ে গেলো সেদিকে তাকিয়ে।

ওয়ালপেপার সরানোর পরে চারকোণা একটা ফুটো বেরিয়ে পড়েছে। সেখানে কিম্ভুত দর্শন একটা যন্ত্র লাগানো আছে, এয়ারফোনের তার ঝুলছে ওটা থেকে।

“শুনে দেখো।”

কুসানাগি এয়ারফোনটা কানে দিতেই গলার আওয়াজ শুনতে পেলো। “ইশিগামি যা বলছে সেটা যদি সব সত্যি হয়, তাহলে আর বেশিদিন আপনাকে বিরক্ত করবো না আমরা, মিস হানাওকা।“

কিশিতানির গলার আওয়াজ। একটু ভোতা শোনাচ্ছে শব্দটা, কিন্তু সবকিছু পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে। নিজের চোখে না দেখলে সে বিশ্বাসই করতো না শব্দগুলো অন্যপাশের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে আসছে। আবার কানে দিলো সে এয়ারফোনটা।

“….ইশিগামির বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হবে?”

সেটা কোর্ট ঠিক করবে। কিন্তু এটা তো খুনের কেস, তাই যাবজ্জীবন হয়ে যেতে পারে। যদি না মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় আর কি। যাই হোক, আপনাকে আর বিরক্ত করতে পারবে না সে।”

একজন গোয়েন্দার তুলনায় বেশিই কথা বলে ছেলেটা কান থেকে এয়ারফোন সরাতে সরাতে ভাবলো কুসানাগি।

“মিস হানাওকাকে এটা দেখাতে হবে। যদিও ইশিগামি বলেছে এ ব্যাপারে জানেন তিনি, কিন্তু আমার সন্দেহ আছে তাতে,” মামিয়া বলল।

“তার মানে আপনি নিশ্চিত ইয়াসুকো হানাওকা এ ব্যাপারে কিছু জানত না?”

“আমি তোমাদের মধ্যকার সব কথাবার্তা শুনেছি ঐ যন্ত্রটা দিয়ে,” হাসিমুখে বলল মামিয়া। “বোঝাই যাচ্ছে কিছু জানতেন না তিনি। ইশিগামি হচ্ছে একজন আদর্শ পাগলা প্রেমিক। ইয়াসুকোর সাথে সম্পর্কের কথা মনে মনে কল্পনা করে নিয়েছিল সে। সবার হাত থেকে তাকে বাঁচানোর দায়িত্বটা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল। এরকম একজন লোক মি. টোগাশিকে যে ঘৃণা করবে সেটাই স্বাভাবিক।

নাক দিয়ে একটা আওয়াজ করলো কুসানাগি।

ওরকম করছো কেন? খটকা লাগছে কোন ব্যাপারে?”

“না। কিন্তু এই ইশিগামি বান্দাটাকে এখনও বুঝতে পারলাম না আমি। তাকে যেরকম ভেবেছিলাম তার সাথে কিছুই মিলছে না। বিভ্রান্তিকর।“

“একজন মানুষের অনেকগুলো চেহারা থাকে। আর এরকম লোকদের দেখলে বাইরে থেকে কিছু বোঝা যায় না।”

“তা জানি আমি…তবুও। এই যন্ত্রটা ছাড়া অন্যকিছু খুঁজে পেয়েছেন আপনারা?”

“কোটাটসুর তারটাও পেয়েছি। ক্লোজেটে ছিল ওটা। কাপড় দিয়ে পেঁচানো তারটা, ঠিক যেমনটা ব্যবহার করা হয়েছিল টোগাশিকে খুন করার সময়। ফরেনসিকের কাছে দিলেই সব প্রমাণ হয়ে যাবে।”

“আর কিছু?”

“এদিকে দেখো,” এই বলে কম্পিউটারের মনিটরটা তার দিকে ঘুরিয়ে দিলো মামিয়া।

একটা ডকুমেন্ট ফাইল খোলা আছে সেখানে। কুসানাগি লেখাগুলোতে চোখ বোলাতে লাগল :

ছবি দুটো দেখে বুঝতেই পারছো ধরা পড়ে গেছো। যার সাথে লুকিয়ে দেখা করো তার পরিচয় জেনে ফেলেছি আমি।

এই লোকটার সাথে কি দরকার তোমার? তুমি যদি তার সাথে কোন সম্পর্কে জড়াও তাহলে সেটা বিশ্বাসঘাতকতা বলে গণ্য করা হবে।

তুমি কি জানো না আমি তোমার জন্যে কি কি করছি? কত বড় ঝুঁকি নিয়েছি?

লোকটার সাথে দেখা-সাক্ষাত বন্ধ করতে হবে তোমাকে। যদি তা না করো তাহলে সব রাগ এই লোকটার ওপর ঝাড়বো আমি। তার উপযুক্ত কারণ এবং ক্ষমতা দুটোই আছে আমার।

আবারও বলছি, তুমি যদি তার সাথে কোন সম্পর্কে জড়াও তাহলে সেটা বিশ্বাসঘাতকতা বলে গণ্য করা হবে। আর সেটাকে ক্ষমা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। উপযুক্ত প্রতিশোধ নেয়া হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *