দ্য ডিভোশন অব সাসপেক্ট এক্স – ১৪

অধ্যায় ১৪

কতগুলো গোমড়া মুখের দিকে তাকিয়ে আছে ইশিগামি। কয়েকজনকে দেখে তো মনে হচ্ছে, পুরো দুনিয়ার ওপরই হতাশ তারা। আর কয়েকজন বহু আগেই রণে ভঙ্গ দিয়ে বেঞ্চের ওপরে ঘুমিয়ে পড়েছে। মরিওকা অবশ্য প্রশ্নের দিকে তাকিয়েও দেখেনি একবার। শূন্য দৃষ্টিতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য অবলোকনে ব্যস্ত সে এই মুহূর্তে। আজকের দিনটাও সুন্দর, যতদূর চোখ যায় নীল আকাশ। মেঘের ছিটেফোটাও নেই কোথাও। মরিওকা নিশ্চয়ই ভাবছে তার মোটরসাইকেলটা নিয়ে অ্যাডভেঞ্চারে বের হবার সবচেয়ে ভালো সময় এটাই। আর সেই সময়টা সে কিনা নষ্ট করছে এই ফালতু ক্লাসটাতে বসে বসে।

স্কুলের বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রিই বসন্তের ছুটি কাটাতে ব্যস্ত এখন। কিন্তু এই ক্লাসের ছেলেমেয়েদের ছুটি শুরু হয়নি এখনও। তার আগে এই পরীক্ষাটায় পাশ করতে হবে তাদের। ফাইনালের পরে যে মেক-আপ টেস্ট হয়েছিল সেখানেও পাশ করতে পারেনি অনেকে। তখন বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থা করা হয় তাদের জন্যে। ইশিগামির ত্রিশজন ছাত্র-ছাত্রি এই বিশেষ ক্লাসগুলোতে ছিল। অন্যান্য বিষয়ের তুলনায় গণিতেই বেশি খারাপ অবস্থা শিক্ষার্থিদের। বিশেষ ক্লাসগুলো শেষ হবার পর আরেকটা মেক-আপ টেস্ট দিতে হচ্ছে তাদের।

ইশিগামি যখন পরীক্ষার প্রশ্ন করছিল তখন প্রধান শিক্ষক একবার এসে কথা বলে গেছেন তার সাথে। প্রশ্ন যাতে কঠিন না হয় সেদিকে বিশেষ নজর রাখতে বলেছেন।

“কথাগুলো বলতে ভালো লাগছে না আমার, কিন্তু এ পর্যায়ে এসে মেক-আপ টেস্টগুলো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া কিছু নয়, আপনাকে বুঝতে হবে ব্যাপারটা। আর আপনারও নিশ্চয়ই এতবার পরীক্ষা নিতে ভালো লাগছে না? শিক্ষার্থিরা অভিযোগ করেছে, গণিতের প্রশ্ন নাকি প্রতিবারই কঠিন হয়েছে। এবার খেয়াল রাখবেন, যাতে সবাই পাশ মার্ক পায়, ঠিক আছে?”-এটাই বলেছিলেন তিনি।

ইশিগামির অবশ্য ধারণা তার প্রশ্নের ধরণ ঠিকই আছে, মোটেও কঠিন নয় সেগুলো। ক্লাসে যা পড়িয়েছে তার বাইরে থেকে কিছু দেয় না সে পরীক্ষায়। গণিতের ব্যাপারে যার একটুও ধারণা থাকবে, সে-ও উত্তর দিতে পারবে। তবে সাধারণত প্রশ্নের চেহারাটা একটু পাল্টিয়ে দেয় সে। ক্লাসে যা শেখালো সেই প্রশ্নই যদি হুবহু পরীক্ষায় তুলে দেয়, তাহলে আর কী লাভ! তবে যে শিক্ষার্থিরা অঙ্ক মুখস্ত করার চেষ্টা করে, তাদের পক্ষে একটু কঠিনই হবে উত্তর দেয়া।

কিন্তু এবার সে প্রধান শিক্ষকের কথামতই কাজ করেছে। প্র্যাকটিস শিট থেকেই বেশিরভাগ প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। যারা একটু খেটে পড়েছে তাদের কাছে পাশ করাটা কোন ব্যাপারই না।

মরিওকা বড় করে একবার হাই তুলে তার ঘড়ির দিকে তাকালো। এরপর ইশিগামির সাথে চোখাচোখি হলো তার। হাত দিয়ে একটা শূন্য এঁকে দেখালো সে বাতাসে, যেন বলতে চাইছে, এবারও তার পরীক্ষার খাতায় এ নম্বরই পাবে সে।

ইশিগামি একটা হাসি উপহার দিলো তাকে, সেটা দেখে পুরোপুরি ভড়কে গেলো মরিওকা। কি করবে বুঝতে না পেরে শেষে বোকার মত হেসে আবার জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখা শুরু করলো।

এরকম একটা জায়গায় কি করছি আমি? ইশিগামি ভাবলো। এই প্রশ্নটা আগেও নিজেকে বহুবার করেছে সে। এমন একদল ছাত্র-ছাত্রিকে গণিতে শেখাচ্ছে যাদের কোন আগ্রহই নেই এই বিষয়ে। শুধু পাশ করে অন্য গ্রেডে যাওয়াই যাদের লক্ষ্য। গণিতের প্রকৃত সৌন্দর্য বোঝার ক্ষমতা কোনদিনই তাদের হবে না। এটা আসলে তাদের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থারই দোষ।

উঠে দাঁড়িয়ে বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিলো ইশিগামি। এরপর পুরো ক্লাসে চোখ বুলিয়ে বলল, “যে যেখানেই আছো, লেখা বন্ধ করো।” সবাই অবাক হয়ে তাকালো তার দিকে, কারণ পরীক্ষা শেষ হতে এখনও বেশ খানিকটা সময় বাকি, “নতুন একটা পাতায় এ মুহূর্তে কি ভাবছো তোমরা সেটা লিখবে।”

সবাই বিভ্রান্ত হয়ে গেলো তার কথা শুনে। গুঞ্জন ভেসে বেড়াতে লাগলো পুরো ক্লাস জুড়ে, “কি ভাবছি এটা লিখবো মানে?”

“গণিত নিয়ে কি ধারণা তোমাদের সেটাই জানতে চাচ্ছি আমি,” ইশিগামি বলল। “যেকোন কিছু লিখতে পারো তোমরা এ সম্পর্কে। আর সেটার ভিত্তিতেই গ্রেডিং করা হবে তোমাদের।”

উৎসাহের বন্যা বয়ে গেলো পুরো ক্লাস জুড়ে।

“কি গ্রেড দেবেন আপনি আমাদের?” একজন শিক্ষার্থি জিজ্ঞেস করলো।

“সেটা তোমাদের লেখার ওপর নির্ভর করবে। আশা করি অন্তত এই কাজটা ঠিকমত করতে পারবে তোমরা,” চেয়ারে বসতে বসতে বলল সে।

পাতা উল্টে সবাই লেখা শুরু করে দিয়েছে ইতিমধ্যেই, এমনকি মরিওকাও।

এবার তাহলে সবাইকে পাশ করাতে পারবো, ভাবলো ইশিগামি। খালি খাতার তো গ্রেডিং করা সম্ভব হত না। প্রধান শিক্ষক হয়তো ভুরু কুঁচকাতে পারেন তার পদ্ধতি দেখে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনিও কিছু বলবেন না। কারণ সবাই পাশ করলেই খুশি তিনি, সেটা যেভাবেই হোক না কেন।

পরীক্ষা শেষ হবার ঘন্টা বেজে উঠলো একটু পরে। কয়েকজন শিক্ষার্থি বলল, তাদের আরো কিছু সময় লাগবে, তাই বাড়তি পাঁচ মিনিট দিলো ইশিগামি।

সবার লেখা শেষ হলে খাতাগুলো জমা নিয়ে ক্লাস থেকে বের হয়ে গেলো সে। পেছন থেকে শিক্ষার্থিদের হুল্লোড় শোনা যাচ্ছে।

টিচার্স রুমে গিয়ে দেখলো এক অফিস সহকারি সেখানে তার জন্যে অপেক্ষা করছে।

“আপনার সাথে দেখা করতে একজন এসেছেন, মি. ইশিগামি।”

“আমার সাথে?”

জবাবে অফিস সহকারিটা হেটে এসে কানে কানে বলল, “আমার মনে হয় সে একজন পুলিশ অফিসার।”

ইশিগামি জোরে একবার শ্বাস ছাড়লো।

“এখন কি করবেন আপনি?” আগ্রহ নিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলো অফিস সহকারি।

“কি করবো আবার? আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন না উনি?”

“হ্যা, কিন্তু তাকে আমি বলে দিতে পারি, আপনি এ মুহূর্তে ব্যস্ত আছেন।”

“তার দরকার হবে না,” মৃদু হেসে বলল ইশিগামি। “কোথায় তিনি এখন?”

“অভিভাবকদের ঘরে।”

“আমি আসছি সেখানে,” এই বলে পরীক্ষার খাতাগুলো ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলো সে। বাসায় গিয়ে দেখতে হবে এগুলো।

অভিভাবকদের রুমে যাবার সময় অফিস সহকারিও তার পেছন পেছন আসতে লাগলো। “আমি একা একাই যেতে পারবো,” লোকটাকে বলল সে। পুলিশ অফিসার আর ইশিগামির মধ্যে কি কথাবার্তা হয় এটা জানাই উদ্দেশ্য ছিল তার। কিন্তু সেটা করতে না পেরে হতাশ হয়ে চলে যেতে হলো তাকে।

ইশিগামি অভিভাবকদের রুমে যাওয়ার পথেই বুঝতে পারলো কে অপেক্ষা করছে তার জন্যে সেখানে : ডিটেক্টিভ কুসানাগি।

“এই সময়ে আপনাকে কষ্ট দেয়ার জন্যে দুঃখিত,” উঠে দাঁড়িয়ে বাউ করে বলল কুসানাগি।

“সাধারণত এই মাসটাতে স্কুলে আসি না আমি। কিন্তু আপনি জানলেন কিভাবে আমি এখন এখানে?”

“আসলে আপনার বাসাতেই গিয়েছিলাম, কিন্তু সেখানে আপনাকে না পাওয়ায় স্কুলে ফোন করে জানতে পারলাম আপনি এখানে। মেক-আপ টেস্ট না কী যেন চলছে এখন। এই ছুটির মধ্যেও পরীক্ষা নিতে হয় নাকি আপনাকে?”

“ছাত্রছাত্রিদের অবস্থা তো আরো করুণ। এই ছুটিতেও বাসায় পড়তে হয়েছে ওদের। আর এটা প্রথম মেক-আপ টেস্ট নয়, এর আগেও একটা হয়েছিল।”

“পরীক্ষায় কঠিন প্রশ্ন করতে বোধহয় পছন্দ করেন আপনি?”

“একথা বললেন কেন?” ডিটেক্টিভের চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করলো ইশিগামি।

“না, এমনিই। মনে হচ্ছিল তাই বললাম।“

“অতটা কঠিন হয় না প্রশ্নগুলো। একটা প্রশ্ন ঘুরিয়ে করলে সেটা নিয়ে শিক্ষার্থিরা যে অতিরিক্ত চিন্তা করে, তারই সুযোগ নেই আমি। আর একটু বেশিই অতিরিক্ত চিন্তা করে তারা।”

“ঘুরিয়ে প্রশ্ন করেন মানে?”

“এই যেমন, তাদের এমন একটা সমস্যার সমাধান করতে দেই যেটার প্রশ্ন দেখে মনে হয় যেন একটা জ্যামিতিক সমস্যা। কিন্তু আসলে সেটা বীজগণিত। তারা যদি অঙ্ক মুখস্ত না করে-” এটুকু বলেই হঠাৎ থেমে গেলো ইশিগামি। ডিটেক্টিভের পাশে বসতে বসতে বলল, “দুঃখিত, এসব ব্যাপারে নিশ্চয়ই আগ্রহ নেই আপনার। তো, কেন এসেছেন জানতে পারি?”

“আসলে সেরকম কিছু না,” কুসানাগি একটা নোটপ্যাড বের করে বলল। “সেই রাতটার ব্যাপারেই আবার কিছু প্রশ্ন করতে চাচ্ছিলাম।“

“সেই রাত বলতে কী বোঝাতে চাইছেন?”

“মার্চের দশ তারিখ,” কুসানাগি বলল। “আশা করি ঘটনাটা কবে ঘটেছিল আপনার সেটা মনে আছে?”

“মানে, আরাকাওয়া নদীর পাশ থেকে যে লাশটা উদ্ধার করেছিলেন আপনারা, সেটা?”

“আরাকাওয়া না, পুরনো এডগাওয়া নদী,” কুসানাগি সংশোধন করে দিলো। “আপনার বোধহয় মনে আছে আমি আর আমার পার্টনার এসেছিলাম মিস হানাওকার ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন করতে? সে রাতে উল্টাপাল্টা কিছু শুনেছিলেন কিনা সেটা জানতে চেয়েছিলাম।”

“জি, মনে আছে আমার। আর এটাও মনে আছে আমি বলেছিলাম সেরকম কিছু কানে আসেনি আমার।”

“হ্যা, তা বলেছিলেন। কিন্তু আমি আশা করছিলাম সে রাতের ব্যাপারে আরেকটু চিন্তা করে বলবেন আপনি।”

“তা কিভাবে সম্ভব। কিছু যখন হয়ইনি তখন আর কি চিন্তা করবো আমি?”

“বুঝতে পারছি আপনার কথা। কিন্তু আমরা চলে আসার পরেও তো আপনার কিছু মনে পড়তে পারে, যেটার কথা তখন বলতে ভুলে গিয়েছিলেন। আরেকবার ভালোমত ভেবে বলুন আমাকে সে-রাতের কথা।”

“ঠিক আছে, ভাবছি,” ঘাড় চুলকাতে চুলকাতে বলল ইশিগামি।

“আমি জানি এটা বেশ কয়েকদিন আগের কথা, তাই একটা জিনিস নিয়ে এসেছি সাথে করে। যাতে আপনার মনে করতে সুবিধা হয়,” এই বলে পকেট থেকে একটা চার্ট বের করলো কুসানাগি। সেখানে মার্চের দশ তারিখের ইশিগামির কর্মতালিকা লেখা আছে। কি কি ক্লাস সেদিন নিতে হয়েছিল তাকে, সাথে স্কুলের অন্যান্য দায়িত্বের কথাও লেখা। অফিস থেকে নিশ্চয়ই এটা জোগাড় করেছে কুসানাগি। “কিছু মনে পড়ছে আপনার?” হেসে জিজ্ঞেস করলো ডিটেক্টিভ।

চার্টটা দেখার সাথে সাথে কুসানাগির এখানে আসার আসল উদ্দেশ্য পরিস্কার হয়ে গেলো ইশিগামির কাছে। ইয়াসুকো হানাওকার ব্যাপারে প্রশ্ন করতে আসেনি সে, এসেছে ইশিগামির অ্যালিবাই যাচাই করে দেখতে। হঠাৎ করে তার ওপর পুলিশের এই আগ্রহের কারণটা ঠিক ধরতে পারলো না, তবে এর সাথে নিশ্চয়ই মানাবু ইউকাওয়ার ওরকম অদ্ভুত ব্যবহারের কোন যোগাযোগ আছে।

ডিটেক্টিভ কুসানাগি যদি আসলেই অ্যালিবাইয়ের জন্যে এসে থাকেন, তাহলে তার উচিত সব প্রশ্নের উত্তর ঠিকমত দেয়া। সোজা হয়ে বসে বলল সে, “জুডো টিমের প্র্যাকটিস শেষে সরাসরি বাসায় যাই আমি সে-রাতে। সাতটা নাগাদ হবে সেটা। এটা তো আগেও আপনাকে বলেছি বোধহয়।”

“তা, বলেছেন। এরপরের পুরো সময়টা বাসাতেই ছিলেন আপনি?”

“হ্যা, তাই বোধহয়,” ইচ্ছে করেই অস্পষ্টভাবে উত্তর দিলো ইশিগামি। কুসানাগির প্রতিক্রিয়া দেখতে চায় সে।

“কেউ কি এসেছিল অ্যাপার্টমেন্টে? অথবা ফোন করেছিল?”

“কার অ্যাপার্টমেন্টের কথা জিজ্ঞেস করছেন আপনি? মিস হানাওকার?” এক ভুরু উঁচু করে জিজ্ঞেস করলো ইশিগামি।

“না, আপনার অ্যাপার্টমেন্ট।”

“আমার?”

“আমি জানি আপনি ভাবছেন এসবের সাথে তদন্তের কি সম্পর্ক। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আপনাকে সন্দেহ করছি না আমরা। সেদিন ইয়াসুকো হানাওকার বাসার চারপাশে কি কি ঘটেছিল সেটারই একটা সাধারণ দৃশ্য ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছি মাত্র।”

খুবই খোড়া একটা যুক্তি। কিন্তু ডিটেক্টিভকে সেটা নিয়ে বেশি চিন্তিত মনে হলো না।

“সেদিন কারো সাথে দেখা করিনি আমি। আর কেউ ফোনও দেয়নি। আসলে খুব কম মানুষই আমার সাথে দেখা করতে আসে।”

“জি, বুঝতে পেরেছি।”

“আমি দুঃখিত, বেশি কিছু জানাতে পারলাম না। এতদূর কষ্ট করে আসলেন আপনি…”

“আরে, আমার ব্যাপারে চিন্তা করতে হবে না আপনাকে, ধন্যবাদ। আমি নিজে দুঃখিত এভাবে আপনার সময় নষ্ট করার জন্যে। ওহ্, আরেকটা কথা,” এই বলে ইশিগামির কর্মতালিকাটা তুলে নিলো কুসানাগি, “এখানকার ক্যালেন্ডার অনুযায়ি এগারো তারিখ সকালবেলা আপনি ছুটি নিয়েছিলেন, কেবল বিকেলের দিকে এসেছিলেন একবার। কিছু হয়েছিল?”

“মানে, পরের দিন? না, সেরকম কিছু না। আমার শরীর খুব খারাপ লাগছিল, তাই ঘুমুচ্ছিলাম। আর সেদিনের ক্লাসটাও তেমন জরুরি ছিল না।”

“ডাক্তার দেখিয়েছিলেন?”

“না, তার প্রয়োজন বোধ করিনি। পরের দিকে ভালো লাগছিল, তাই বিকেলে চলে আসি স্কুলে।”

“কিছুক্ষণ আগেই অফিস সহকারির সাথে কথা বললাম আমি। তার কাছ থেকে জানতে পারলাম খুব কমই নাকি ছুটি নেন আপনি? মাসে সর্বোচ্চ একবার?”

“হ্যা, এভাবেই ছুটিগুলোকে কাজে লাগাই আমি।“

“জি। অফিস থেকে বলল রাত জেগে অঙ্ক করলে পরেরদিন সকালবেলাটা ছুটি নেন আপনি, তাই না?”

“হ্যা, এরকমই কিছু একটা বলি আমি ছুটি চাওয়ার সময়।”

“আর এরকমটা ঘটে মাসে বড়োজোর একবার…” এই বলে আবার কর্মতালিকাটার দিকে তাকালো কুসানাগি। সেখানে আসলে পুরো মাসের হিসাবই দেয়া আছে। “কিন্তু এখানে তো দেখাচ্ছে এর আগেরদিন, অর্থাৎ দশ তারিখ সকালেও ছুটি নিয়েছিলেন আপনি। অফিস থেকে বলছিল প্ৰথম দিন ছুটি চাইলে কিছু মনে করেনি তারা, কিন্তু পরের দিনও আপনি যখন ছুটি চাইলেন তখন একটু অবাকই হয়েছিল সবাই। এই প্রথম এরকম হলো, তাই না?”

“জি, এটাই প্রথম,” কপালে হাত বুলিয়ে উত্তর দিলো ইশিগামি। খুব সাবধানে কথা বলতে হবে এখন তাকে। “অবশ্য বিশেষ কোন কারণ ছিল না ওরকমটা করার। যেমনটা আপনি বলছিলেন, দশ তারিখের আগের রাতে অঙ্ক করতে করতে দেরি হয়ে যায় আমার। সকালে উঠে জ্বর জ্বর লাগছিল, তাই আর যাইনি স্কুলে।”

“কিন্তু দুপুর নাগাদ ঠিক হয়ে গেলেন? লাঞ্চের পর তো এসেছিলেন আপনি।”

“জি,” ইশিগামি মাথা নেড়ে বলল।

“হুম,” সন্দেহের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলল কুসানাগি।

“কোন সমস্যা?”

“না, ঠিক সমস্যা না। কিন্তু পরপর দু’দিন এরকম ছুটি নেয়াটা একটু অদ্ভুত ঠেকছে আমার কাছে। তা-ও শুধু সকাল বেলাটুকু,” এখন আর বেশি রাখঢাক করছে না কুসানাগি। যেকোনভাবে তথ্য বের করে নিতে চাচ্ছে ইশিগামির মুখ থেকে

কিন্তু ইশিগামি টোপটা গিলল না। শুকনো একটা হাসি দিয়ে বলল, “আসলে সকালের ক্লাসটা মিস দেয়াতে আমার নিজেরই খারাপ লাগছিল, তাই লাঞ্চের সময়ে একটু ভালো অনুভব করাতে স্কুলে চলে যাই।”

ইশিগামির কথা বলার পুরোটা সময় কুসানাগি তার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল। ছুরির মত ধারালো সে দৃষ্টি। সেটা দেখেই যে কেউ বলে দিতে পারবে ইশিগামির কথা বিশ্বাস করছে না সে।

“জুডো শেখাটা তাহলে ভালোই কাজে দিয়েছে আপনার, কি বলেন? অর্ধেক দিন যেতে না যেতেই সুস্থ হয়ে যান। অফিসের লোকটা বলছিল কোনদিন নাকি অসুস্থ হতে দেখেনি আপনাকে।“

“এটা একটু বাড়িয়ে বলেছে। মাঝে মাঝেই সর্দি লাগে আমার।”

“আর দশ তারিখ রাতেও সেরকমটাই হয়েছিল, তাই না?”

“কি বোঝাতে চাইছেন আপনি? আমি জানি সেদিন রাতেই খুনটা হয়েছিল, কিন্তু আমার জন্যে একটা সাধারণ রাতই ছিল ওটা।”

“জি, অবশ্যই,” নোটপ্যাড বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল কুসানাগি। “সাহায্য করতে পারলাম না বলে আবারও দুঃখিত।”

“সমস্যা নেই, রুটিন প্রশ্নের জন্যে এসেছিলাম কেবল।”

অভিভাবকদের রুম থেকে একসাথে বেরিয়ে আসল দু-জনে। ডিটেক্টিভকে সদর দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলো ইশিগামি।

“ইদানিং ইউকাওয়ার সাথে দেখা হয়েছে নাকি আপনার?” হাটতে হাটতে জিজ্ঞেস করলো কুসানাগি।

“না, একদমই দেখা হয়নি,” ইশিগামি জবাব দিলো। “আপনার সাথে?”

“আমার সাথেও দেখা হয়নি। আমি একটু ব্যস্ত এখন। আমাদের তিনজনের একদিন আড্ডা দেয়া উচিত। ইউকাওয়ার কাছে শুনলাম হুইস্কির প্রতি নাকি বিশেষ টান আছে আপনার?” একটা গ্লাস ওঠানোর ভঙ্গি করে বলল সে।

“জি, ভালোই হবে তাহলে। কিন্তু আপনার হাতের কেসটা সমাধান হয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত না আমাদের?”

“হ্যা। তবে সবসময় কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে ভালো লাগে না। আপনাকে ফোন দেবো আমি।”

“ঠিক আছে,” হেসে বলল ইশিগামি।

একবার বাউ করে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলো কুসানাগি।

হলওয়ের জানালা দিয়ে কুসানাগিকে দেখতে লাগলো সে। স্কুল থেকে বের হয়েই ফোনে কথা বলা শুরু করেছে লোকটা।

ডিটেক্টিভের এখানে আগমনের কারণ সম্পর্কে ভাবতে লাগল ইশিগামি। কি এমন ঘটেছে যে হঠাৎ করে তাকে সন্দেহ করতে শুরু করেছে পুলিশের লোকজন? নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে, কিন্তু সেটা কি? গতবার কুসানাগির দেখা হবার সময় তো এরকম মনে হয়নি।

কুসানাগির প্রশ্নগুলো শুনে তো মনে হয়েছে, আসল সত্য থেকে এখনও অনেক দূরে তারা। আন্দাজে ঢিল ছুড়ছিল সে। ইশিগামির কোন শক্ত অ্যালিবাই না থাকায় সন্দেহের মাত্রা বোধহয় বেড়ে গেছে তাদের। বাড়ুক সন্দেহ, এসব কিছুও চিন্তা করে রেখেছে সে আগে থেকে।

কিন্তু সমস্যা ভিন্ন জায়গায়।

মানাবু ইউকাওয়ার ছবি ভেসে উঠলো তার মনে। সে সত্য সম্পর্কে কতটা জানে? আর সেটা কি কুসানাগিকে বলবে?

ইয়াসুকো এর আগের দিন তাকে ফোনে যা বলেছিল সেটা মনে পড়লো। ইউকাওয়া নাকি জিজ্ঞেস করেছে ইশিগামি সম্পর্কে তার মতামত কি? তার প্রশ্ন করার ধরণ শুনে ইয়াসুকোর মনে হয়েছিল, ইশিগামি যে তাকে পছন্দ করে এটা ইউকাওয়া জানে।

ইউকাওয়ার সাথে হওয়া তার কথোপকথনগুলো মনে করার চেষ্টা করলো সে। এমন কিছু তো সে বলেনি যাতে করে বিন্দুমাত্র সন্দেহ জাগতে পারে ইউকাওয়ার মনে। তাহলে কিভাবে বুঝল?

ঘুরে টিচার্স রুমর দিকে রওনা দিলো সে। পথে সেই অফিস সহকারির সাথে দেখা হয়ে গেলো।

“পুলিশের লোকটা চলে গেছে?”

“হ্যা, কেবলই গেলো।”

“আপনি বাসায় চলে যাবেন না এখন, মি. ইশিগামি?”

“হ্যা, কিন্তু তার আগে একটা কাজ করতে হবে আমাকে।“

লোকটার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে টিচার্স রুমে চলে এলো সে দ্রুত। সেখানে তার ডেস্কে বসে নিচ থেকে একটা বাক্স বের করলো। কিছু জরুরি ফাইল আছে সেটাতে। ক্লাসের ফাইল নয় সেগুলো, ইশিগামির ব্যক্তিগত ফাইল। গণিতের একটা বিশেষ সমস্যা নিয়ে কাজ করছে সে গত কয়েক বছর ধরে। সেটারই কিছু সম্ভাব্য ফলাফল লেখা আছে কাগজগুলোতে।

ফাইলগুলো ব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো সে।

X

“কতবার তোমাকে এই কথা বলতে হবে, একটা রিসার্চ করার সময় একই পরীক্ষা বেশ কয়েকবার করে দেখতে হবে তোমাকে? যেকোন একটা উত্তর পেলেই ঢ্যাং ঢ্যাং করে নাচা শুরু করে দিলে চলবে না। উত্তরটা কি আসলেই ঠিক কিনা আবার যাচাই করে দেখতে হবে। তুমি যা ভাবছো সেরকমটা তো না-ও হতে পারে, তাই না? এই এক্সপেরিমেন্টটা আবার শুরু থেকে করবে তুমি। ভালোমত পর্যবেক্ষণ করে উত্তর লিখে তবেই আমার কাছে আসবে।”

ইউকাওয়াকে সচরাচর এতটা বিরক্ত হতে দেখা যায় না। সামনে দাঁড়ানো শিক্ষার্থির দিকে রিপোর্টটা ছুড়ে দিলো সে। সেটা নিয়ে বাউ করে চলে গেলো ছেলেটা।

“এরকম রাগতে দেখিনি তো তোমাকে।“

“রাগের ব্যাপার না এটা। মনোযোগ দিয়ে কাজটা করেনি সে। তাই একটু পথ দেখিয়ে দিলাম, এই আরকি,” উঠে দাঁড়িয়ে কফি বানাতে শুরু করলো সে। “তো, কিছু খুঁজে পেলে?”

“ইশিগামির সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম তার অ্যালিবাই সম্পর্কে জানতে।”

“সামনাসামনি আক্রমণ করেছো দেখছি,” ইউকাওয়া সিঙ্কের দিক থেকে ঘুরে বলল। হাতে বড় একটা কাপ। “কি রকম প্রতিক্রিয়া দেখলে?”

“সেরাতে পুরোটা সময় নাকি বাসাতে একাই ছিল সে।“

বিরক্ত হবার ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো ইউকাওয়া, “আমি জিজ্ঞেস করেছি, কেমন প্রতিক্রিয়া দেখলে, সে কি বলেছে তোমাকে এটা জানতে চাইনি।”

“আসলে তাকে দেখে অতটা বিচলিত মনে হয়নি। কিন্তু সেখানে গিয়ে তার সাথে দেখা করার জন্যে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছে আমাকে, এই ফাঁকে হয়তো নিজেকে সামলে নিয়েছিল।”

“তুমি যে তার অ্যালিবাই সম্পর্কে জানতে চাইছিলে এটা শুনে অবাক হয়নি?”

“না, সরাসরি ওরকম কিছু বলেনি। আর আমিও একটু ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে প্রশ্নগুলো করছিলাম।”

“তাকে যতদূর চিনি, সে নিশ্চয়ই জানতো তুমি এক না এক সময়ে তার অ্যালিবাইয়ের ব্যাপারে কথা বলতে যাবে,” ইউকাওয়া নিজেকেই শোনাল যেন কথাগুলো। শব্দ করে কফির কাপে একবার চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তো, ঘটনার দিন রাতে বাসাতেই ছিল সে?”

“হ্যা, তার নাকি শরীর খারাপ লাগছিল, এজন্যে পরেরদিন সকালবেলার ক্লাসগুলো নেয়নি,” এই বলে স্কুলের অফিস থেকে জোগাড় করা ইশিগামির কর্মতালিকার চার্টটা বের করে টেবিলে রাখলো সে।

ইউকাওয়া হাতের কাপটা নিয়েই টেবিলে এসে বসলো। কাগজটা তুলে নিয়ে দেখতে লাগলো।

“পরের দিন সকালে… হুম।”

“খুনের পরদিন নিশ্চয়ই কিছু জিনিস গোছাতে হয় তাকে।”

“মিস হানাওকার কি খবর? পরদিন সকালে সে কি করছিল, সেটা জানো তুমি?”

“অবশ্যই। প্রতিদিনের মতই কাজে গিয়েছিল সে। আর তার মেয়েও স্কুলে গিয়েছিল। এমনকি একটু দেরিও হয়নি তাদের।”

কাগজটা টেবিলে রেখে দিয়ে হাত ভাঁজ করে বসলো ইউকাওয়া। “খুনের পরদিন নিশ্চয়ই কিছু জিনিস গোছাতে হয়’ এমনটাই বলছিলে তো তুমি, তাই না? তাকে কি কি করতে হয়েছিল বলে তোমার মনে হয়?”

“এই যেমন খুনের অস্ত্রটা লুকাতে হয়েছিল।”

“ সেটা করতে তো আর দশ ঘন্টা লাগবে না।”

“দশ ঘন্টা?”

“খুনটা হয়েছিল দশ তারিখ রাতে। আর পরদিন সকালের ক্লাসগুলোও নেয়নি সে। তার মানে হাতে কম করে হলেও দশ ঘন্টার বেশিই সময় ছিল তার।”

“ঘুমোতে তো হয়েছে তাকে।“

“আমার মনে হয় না ওরকম সময়ে কেউ ঘুমানোর কথা চিন্তা করবে। বিশেষ করে খুনের আলামত লুকাতে হবে যখন। সব কাজ শেষে যদি হাতে পর্যাপ্ত ঘুমের সময় না-ও থাকে তবুও কিন্তু কাজে যেতে হবে তাকে। কারণ ক্লান্ত অবস্থায় কাজে গেলে যেরকম সন্দেহ জাগবে সবার মনে, একেবারে বাদ দিলে তার চেয়ে বহুগুণে বেশি সন্দেহ করবে লোকে।”

“তাহলে ঐ সময়ে কিছু একটা তো করেছে সে।“

“সেটাই বের করার চেষ্টা করছি।”

“তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছিলাম কয়েকদিন ধরে। ইশিগামিকে সন্দেহ করা শুরু করলে কেন তুমি? এটা না জানা পর্যন্ত ঠিক স্বস্তি পাচ্ছি না। আমাদের চোখে কি কিছু এড়িয়ে গিয়েছিল তদন্তের সময়?”

“অবাক না হয়ে পারলাম না তোমার প্রশ্নটা শুনে। তোমার মাথায় কি এটা কখনও আসেনি, ইয়াসুকোকে পছন্দ করে ইশিগামি? আমি কি ভাবছি এটা নিয়ে এত লেগেছো কেন?”

“কারণ আছে। আমাকে আমার চিফের কাছে সব ব্যাপারে রিপোর্ট করতে হয়। আমি তো আর বলতে পারি না হঠাৎ মনে হলো আর ইশিগামিকে সন্দেহ করা শুরু করলাম আমরা।”

“এটা বলতে পারো না, ইয়াসুকো হানাওকার পরিচিত সবার ব্যাপারে তদন্ত করার সময়ে ইশিগামির ব্যাপারটা উঠে এসেছে?”

“তা বলেছি আমি। কিন্তু তাদের দু-জনের মধ্যে যে কিছু চলছে সে ব্যাপারে কোন তথ্য-প্রমাণই জোগাড় করতে পারিনি।”

মগটা হাতে থাকা অবস্থাতেই জোরে জোরে হাসা শুরু করলো ইউকাওয়া। “অবাক হলাম না।”

“কি? কেন? কি বলতে চাও তুমি?”

“সেরকম কিছু না। আমি আসলে আশাও করিনি তাদের মধ্যে কোন সম্পর্ক থাকবে। একটা ব্যাপার গ্যারান্টি দিয়ে বলছি তোমাকে, হাজার চেষ্টা করেও এ ব্যাপারে কোন প্রমাণ বের করতে পারবে না।

“বাহ্, শুভকামনার জন্যে ধন্যবাদ। আমাদের চিফের ইতিমধ্যেই ইশিগামির ব্যাপারে আগ্রহ কমতে শুরু হয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি আমার হাত থেকেও সব কিছু বেরিয়ে যাবে। এজন্যেই তোমাকে জিজ্ঞেস করছিলাম, কি দেখে তাকে সন্দেহ করা শুরু করলে তুমি? অনেক হলো তো ইউকাওয়া। অনেক ঘুরিয়েছো আমাকে, এবার বলো?”

ইউকাওয়ার চেহারাটা গম্ভীর হয়ে গেলো হঠাৎ করে। কফির কাপটা নামিয়ে রেখে বলল, “তোমাকে বলিনি কারণ সেটা শুনে তোমার কোনই লাভ নেই। কাজে দেবে না ওটা।”

“সেটা আমাকেই ঠিক করতে দাও না।“

“ঠিক আছে, বলছি। তুমি যেমন ভেবেছিলে, ইয়াসুকোকে কেউ একজন সাহায্য করছে, আমিও শুরুতে সেরকমটাই ভেবেছিলাম। কিন্তু কে সেটা বুঝতে পারছিলাম না। এসময় হঠাৎ করেই ইশিগামির কথা মাথায় আসলো আমার। এই ‘হঠাৎ করে কিভাবে হলো, সেটার ব্যাখ্যা আমি তোমাকে দিতে পারবো না। কারণ ইশিগামিকে যদি কেউ আগে থেকে না চেনে তাহলে তার পক্ষে সেটা বোঝা অসম্ভব। যাই হোক, এখানে আসার পর থেকে তুমি যেটা বলছিলে, তাদের মধ্যে কোন সম্পর্ক আছে, আমিও সেটা নিয়েই ভেবেছি। কল্পনাশক্তি একজন গোয়েন্দার সবচেয়ে দামি অস্ত্র-তোমারই কথা এটা।”

“আমি তো এতদিন ভাবতাম এইসব কল্পনায় বিশ্বাসি নও তুমি।”

“সবসময় যে একইরকমভাবে চিন্তা করবো, তা তো নয়।”

“ঠিক আছে। ইশিগামি যে ইয়াসুকোর প্রতি দূর্বল এটা ঠিক কখন থেকে মনে হওয়া শুরু হলো তোমার? এটুকু তো বলো।”

“দুঃখিত,” সাথে সাথে জবাব দিলো ইউকাওয়া।

“ধ্যাত! বলো না!“

“ব্যক্তিগত ব্যাপার এটা। ইশিগামির ব্যক্তিগত ব্যাপার। তার বন্ধু হয়ে সেটা অন্য কাউকে বলে বেড়াবো আমি, তা হতে পারে না।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে লাগল কুসানাগি। এই সময় কেউ একজন দরজায় নক করলো। ইউকাওয়া ভেতরে আসার অনুমতি দিলে দরজা খুলে ভেতর ঢুকলো এক ছেলে। দেখে মনে হচ্ছে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থি, হাতে একটা রিপোর্ট ফাইল। সরাসরি ইউকাওয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে।

“এভাবে হঠাৎ করে তোমাকে ডেকে পাঠানোর জন্যে দুঃখিত। কিন্তু সেদিনের তোমার ঐ রিপোর্টটার ব্যাপারে কিছু কথা ছিল আমার।”

“কি সেটা, স্যার?” ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো ছেলেটা।

“তোমার রিপোর্টটা বেশ ভালোই ছিল। কিন্তু একটা কথা বলো তো আমাকে, ওরকম সলিড স্টেট সূত্র দিয়ে সবকিছুর ব্যাখ্যা করেছিলে কেন তুমি?”

ছেলেটা অবাক হয়ে গেলো প্রশ্নটা শুনে, “সেটা তো একটা সলিড স্টেট এক্সপেরিমেন্টই ছিল, স্যার।”

হেসে মাথা নাড়লো ইউকাওয়া, “বুঝতে পারোনি তাহলে। আমি আসলে এক্সপেরিমেন্টটা এলিমেন্টারি ার্টিকেল তত্ত্বের ভিত্তিতে সাজিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম রিপোর্ট লেখার সময় সেটা নিয়েও চিন্তা করবে তুমি। শুধুমাত্র দেখে সলিড স্টেট এক্সপেরিমেন্ট মনে হলেই যে অন্য কোন তত্ত্ব নিয়ে ভাবা যাবে না তা নয় কিন্তু। এরকমভাবে চিন্তা করলে আর রিসার্চার হতে পারবে না সহজে। কখনও আগে থেকে কোন কিছু ধরে নেবে না। তাহলে চিন্তা করার ক্ষেত্রটা ছোট হয়ে আসবে। সহজ একটা সূত্রই চোখে পড়বে না তখন।”

“জি, স্যার।”

“তোমাকে এই উপদেশটা দিচ্ছি কারণ তোমার কাজের ধরন ভালো লেগেছে আমার। এখন যাও তাহলে।”

ধন্যবাদ দিয়ে বের হয়ে গেলো ছেলেটা।

ইউকাওয়া কুসানাগির দিকে ঘুরে দেখলো সে চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

“কি? আমার মুখে কিছু লেগে আছে নাকি?”

“না। তোমরা বিজ্ঞানীরা সবসময় একইভাবে চিন্তা করো দেখি।“

“মানে?”

“আজ ইশিগামির সাথে যখন দেখা করেছিলাম তখন সে-ও তোমার মতই কথা বলছিল।” ইউকাওয়াকে ইশিগামির গণিতের প্রশ্ন করার ধরন সম্পর্কে খুলে বলল সে।

“অতিরিক্ত চিন্তা করার সুযোগ নেয়া, তাই তো? এরকমটা করাই স্বাভাবিক তার পক্ষে,” হাসতে হাসতে বলল ইউকাওয়া। কিন্তু পরমুহূর্তেই একদম গম্ভীর হয়ে গেলো সে। লাফ দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে চলে গেলো জানালার কাছে, এরপর উপরের দিকে তাকিয়ে আকাশ দেখতে শুরু করলো।

“ইউকাওয়া?”

হাত নেড়ে তাকে চুপ থাকার নির্দেশ দিলো পদার্থবিদ। কুসানাগি একবার ঘাড় নেড়ে তার বন্ধুকে দেখতে লাগল।

“অসম্ভব,” ইউকাওয়া বিড়বিড় করছে। “কোনভাবেই এটা করতে পারে না- “

“কি? কি করতে পারে না?” আর সহ্য না করতে পেরে জিজ্ঞেস করলো কুসানাগি।

“ঐ কাগজটা দেখাও তো আমাকে, ইশিগামির কর্মতালিকা।”

দ্রুত কাগজটা ইউকাওয়ার দিকে বাড়িয়ে ধরলো কুসানাগি। ছো মেরে সেটা নিয়ে নিলো ইউকাওয়া। মনোযোগ দিয়ে কিছুক্ষণ দেখলো সেটা, এরপর গুঙিয়ে উঠলো। “আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না…’

“কি বিশ্বাস হচ্ছে না, ইউকাওয়া? কি নিয়ে কথা বলছো তুমি? বলো আমাকে!”

“দুঃখিত, কিন্তু এখন যেতে হবে তোমাকে,” কাগজটা ঠাস করে কুসানাগির দিকে ছুড়ে মেরে বলল ইউকাওয়া।

“কি! অসম্ভব,” কুসানাগি প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলো। কিন্তু পরমুহূর্তে তার বন্ধুর চেহারাটা দেখে আর কিছু বলার সাহস পেলো না।

ইউকাওয়ার চেহারায় স্পষ্ট বেদনা আর দুশ্চিন্তার ছাপ। তাকে আগে কখনও এতটা মুষড়ে পড়তে দেখেনি সে।

“আমি আসলেই দুঃখিত, কিন্তু দয়া করে বিদায় হও এখন,” ইউকাওয়া করুণ সুরে অনুরোধ করলো তাকে।

টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়াল কুসানাগি। হাজারটা প্রশ্ন ঘুরছে তার মাথায়, কিন্তু এখন সেগুলো করা সম্ভব নয়। চলে যাওয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই আপাতত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *