দ্য ডিভোশন অব সাসপেক্ট এক্স – ১১

অধ্যায় ১১

শিনোজাকি স্টেশন থেকে বের হয়ে মোবাইলফোনটা হাতে নিলো কুসানাগি। মানাবু ইউকাওয়ার নম্বরটা বের করে কল বাটনে চাপ দিলো দুপুর তিনটা বাজছে এখন। ভেবেছিল এই সময়ে ভিড় একটু কম হবে স্টেশনে, কিন্তু দেখা যাচ্ছে লোকজনের কমতি নেই আশেপাশের রাস্তায়। উল্টোদিকের সুপারমার্কেটটার সামনে সারি সারি সাইকেল পার্ক করে রাখা।

খুব তাড়াতাড়িই সিগনাল খুঁজে পেলো কুসানাগির ফোন, কিন্তু রিং হবার আগেই সেটা বন্ধ করে দিলো। যাকে খুঁজছে তাকে পেয়ে গেছে।

একটা বইয়ের দোকানের সামনে রেলিঙের উপর বসে আছে ইউকাওয়া, হাতে একটা কোন আইস্ক্রিম। পরনে সাদা ট্রাউজার আর কালো রঙের ফুল হাতা শার্ট। একটা সানগ্লাসও চাপিয়েছে চোখে।

শব্দ না করে ইউকাওয়ার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল সে। অন্যদিকে ঘুরে সুপারমার্কেটের লোকজনদের ওপর নজর রাখছে।

“ডিটেক্টিভ গ্যালেলিও!” জোরে ডাক দিলো, ভেবেছিল এতে চমকে উঠবে ইউকাওয়া, কিন্তু আশানুরূপ ফল পেলো না। অন্যান্য সময়ের মত বিরক্তও হলো না পদার্থবিদ। আস্তে করে তার দিকে মুখ ফেরাল সে।

“তোমার নাক তো ঠিকই আছে দেখছি। পুলিশ ডিপার্টমেন্ট এত খরচ করে ঐ কুকুরগুলো পুষছে কেন তাহলে?” মুখে বিরক্তির ভাব ফুটিয়ে বলল। “এখানে কি করছো তুমি?” জিজ্ঞেস করলো কুসানাগি। “এটা বলবে না আবার, ‘আইস্ক্রিম খাচ্ছিলাম।”

তোমাকেও একই প্রশ্ন করতে পারি আমি, কিন্তু করবো না। আমার খোঁজেই এখানে এসেছো তুমি। আসলে আমি কি করছি সেটা জানাই তোমার উদ্দেশ্য।”

“বুঝতেই যখন পারছো, ঝেড়ে কাশো দেখি এবার।”

“তোমার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম আমি।”

“ওহ্, তাই?”

“সত্যিই বলছি। কিছুক্ষণ আগে ল্যাবে ফোন করেছিলাম, সেখান থেকে এক শিক্ষার্থি জানাল তুমি নাকি আমার খোঁজে আজ গিয়েছিলে। কাল সন্ধ্যায়ও একবার ঢুঁ মেরে এসেছো শুনেছি। তাই ভাবলাম এখানে যদি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি তাহলে একটা সময় তোমাকে পাবোই। ঐ ছেলেটাই তোমাকে শিনোজাকি স্টেশন সম্পর্কে জানিয়েছে, তাই না?”

এগুলো সবই সত্যি, কিন্তু কুসানাগি যে প্রশ্ন করেছিল তার উত্তর এখনও দেয়নি ইউকাওয়া। কুসানাগিও আজ ছেড়ে দেয়ার মুডে নেই।

“আমি জানতে চাচ্ছিলাম তুমি এই জায়গায় কি করছো?” একটু চড়া গলায় জিজ্ঞেস করলো সে। ইউকাওয়ার কথাবার্তার ধরণের সাথে সে পরিচিত, তবুও সবসময় রাগ চেপে রাখা যায় না।

“এত অধৈর্য হচ্ছো কেন? কফি চলবে? ঐ ভেন্ডিং মেশিন থেকে কিনতে হবে, কিন্তু ল্যাবের ইন্সট্যান্ট কফি থেকে ভালো হবে এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত,” উঠে দাঁড়িয়ে হাতের আইক্রিমটা পাশের ট্র্যাশ ক্যানে ফেলে দিলো ইউকাওয়া।

কুসানাগিকে নিয়ে সুপারমার্কেটের কাছে গেলো সে। সেখানকার ভেন্ডিং মেশিন থেকে দু’কাপ কফি নিয়ে একটা ডিটেক্টিভের দিকে এগিয়ে দিলো। এরপর পাশেই একটা পার্ক করা সাইকেলের ওপর বসে কফির কাপে শব্দ করে চুমুক দিতে লাগল।

কুসানাগি অবশ্য দাঁড়িয়েই থাকলো, নিজের কফির কাপে চুমুক দিলো সে, এরপর বলল, “অন্য মানুষের সাইকেলে ওভাবে বসা উচিত না। মালিক যদি ফিরে আসে?”

“আসবে না। অন্তত আরো কিছুক্ষণ নির্বিঘ্নে এখানে বসে থাকতে পারবো আমি।”

“তুমি কিভাবে জানলে সেটা?”

“কারণ এর মালিক কিছুক্ষণ আগে এটা এখানে রেখে সাবওয়ে স্টেশনে ঢুকতে দেখেছি আমি। সবচেয়ে কাছের স্টেশনটাতে পৌঁছুতেও ত্রিশ মিনিট লাগার কথা তার, আর সেখানে গিয়ে তার কাজ সেরে আসতে আরো সময় লাগবে।”

“এখানে বসে বসে একাজই করছিলে নাকি এতক্ষণ?”

পর্যবেক্ষণ করা আমার শখের মধ্যে পড়ে, জানোই তো। আর কাজটা করেও মজা পাই আমি।”

“শখ থাকা ভালো কিন্তু এমুহূর্তে আমার প্রশ্নের জবাব তোমার কাছে থাকলেই বেশি খুশি হবো আমি। কেন এসেছো এখানে? এটা আবার বোলো না, আমার কেসের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।”

ইউকাওয়া ঘুরে সাইকেলের হ্যান্ডেলবারটা পরীক্ষা করতে লাগল। “এখন আর লোকজন সাইকেলে নাম লিখে রাখে না। মনে হয় নিজের পরিচয় অন্য কাউকে জানাতে চায় না তারা। কিছুদিন আগেও কিন্তু সবাই তাদের সাইকেলে নাম লিখে রাখত। সময়ের সাথে সাথে সব বদলে যায়।” এতক্ষনে কুসানাগি কিছুটা বুঝতে শুরু করেছে, “আমরা সাইকেল নিয়ে এর আগেও কথা বলেছি, তাই না?”

ইউকাওয়া মাথা নেড়ে সায় দিলো। “তুমিই তো আমাকে বলেছিলে খুনের ঘটনাস্থলের কাছে ইচ্ছেকৃতভাবে সাইকেল রেখে দেয়ার ঘটনাটা তোমাকে খোঁচাচ্ছে।”

“ঠিক সেটা বলিনি। আমি বলেছি ইচ্ছেকৃতভাবে সাইকেলটা ওখানে রেখে দেয়ার কোন মানে হয় না। খুনি যদি ভিক্টিমের আঙুলের ছাপ ওখানে লাগাবেই, তাহলে আঙুলগুলো পোড়ানোর কি দরকার ছিল? ঐ আঙুলের ছাপ দিয়েই তো লাশের পরিচয় খুঁজে বের করি আমরা।”

“ভালো বলেছো। কিন্তু একটা ব্যাপার, যদি সাইকেলে কোন আঙুলের ছাপ না থাকতো তাহলে কি লাশের পরিচয় খুঁজে বের করায় কোন হেরফের হত?”

পুরো দশ সেকেন্ড ব্যাপারটা নিয়ে ভাবলো কুসানাগি, এই প্রশ্নটা আগে আসেনি তার মাথায়।

“না, হতো না,” অবশেষে বলল সে। “আঙুলের ছাপ আমরা মিলিয়ে দেখেছিলাম ঠিকই, কিন্তু সেটা না করলেও হত। কারণ ঐ বোর্ডিং হাউজের ঘর থেকে কিছু চুলও পেয়েছিলাম আমরা। সেটার ডিএনএ অ্যানালাইসিস করেই পরিচয় খুঁজে বের করা হয়।”

“ঠিক। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, আঙুলগুলো পুড়িয়ে কোন লাভই হয়নি। কিন্তু আমি যদি বলি, খুনি সেটা আগে থেকেই জানতো?”

“মানে, লাভ নেই জেনেও খুনি আঙুলগুলো পুড়িয়েছিল বলতে চাচ্ছো?”

“কোন না কোন কারণ তো অবশ্যই আছে। তবে সেটা লাশের পরিচয় গুম করার জন্যে নয়, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। এমনও হতে পারে সাইকেলটা সেখানে রাখার আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাদের বোঝানো যে, এটা নিছক কোন সাজানো ঘটনা নয়।”

বিষয়টা হজম করতে কুসানাগির কিছু সময় লাগল, “মানে বলতে চাচ্ছো সেটা সেখানে সাজিয়ে রাখা হয়েছে আমাদের কোনভাবে বিভ্রান্ত করার জন্যে?”

“হ্যা, কিন্তু সেই ‘কোনভাবে’টাই আমি বের করতে পারিনি এখনও, “ সাইকেলটা থেকে নেমে বলল ইউকাওয়া। “আমি নিশ্চিত, সে চাইছে আমরা যেন ভাবি ভিক্টিম সাইকেলে চড়ে সেখানে এসেছে। কিন্তু সেটা কেন?”

“এ ব্যাপারটা লুকানোর জন্যে যে, ভিক্টিমের একার পক্ষে সেখানে যাওয়ার মত অবস্থা ছিল না,” কুসানাগি বলল। “কারণ ততক্ষণে সে মারা গেছে। পরে খুনি তাকে সেখানে বয়ে নিয়ে যায়। আমাদের চিফ এটাই ভাবেন।”

“কিন্তু তুমি তো তার সাথে একমত নও, তাই না? কারণ প্রাইম সাসপেক্ট ইয়াসুকোর কোন ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই।“

“অবশ্য তার একজন সঙ্গি থাকলে এই যুক্তিটা খাটবে না।”

“কিন্তু এখন সাইকেল চুরি হওয়ার সময়টার ব্যাপারে মনোযোগ দাও। তোমাদের রিপোর্ট অনুযায়ি সকাল এগারটা থেকে রাত দশটার মধ্যে যেকোন এক সময়ে চুরি হয়েছিল সেটা। কিন্তু এত নিখুঁতভাবে সময়টা কিভাবে বের করলে, সেটা আমি বুঝতে পারছি না।“

“ওটা নিয়ে এত গবেষণার কি আছে? সাইকেলের মালিকই জানিয়েছিল আমাদের সময়টা।”

“ওহ্,” হাত নেড়ে বলল ইউকাওয়া। “আর তাকে এত তাড়াতাড়ি খুঁজে পেলে কিভাবে?”

“তিনি সাইকেলটা চুরির ব্যাপারে রিপোর্ট করে রেখেছিলেন। আমাদের শুধু রেজিস্ট্রেশন নম্বর মিলিয়ে দেখতে হয়েছে।”

কিন্তু উত্তরটা শুনে ইউকাওয়া যে সন্তুষ্ট হতে পারছে না সেটা চশমার পেছনে তার চোখদুটো না দেখা সত্ত্বেও বুঝতে পারলো কুসানাগি। “এখন আবার কি ভাবছো?”

“তুমি কি জানো সাইকেলটা চুরি হবার সময় কোথায় রাখা ছিল?”

“অবশ্যই। সেটার মালিককে আমি নিজেই জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলাম।”

“তাহলে সেখানে আমাকে নিয়ে যেতে পারবে? আশেপাশেই তো হবার কথা।”

কুসানাগি একবার ভাবলো, জিজ্ঞেস করবে ‘কি দরকার?’ কিন্তু সেটা আর করলো না। ইউকাওয়াকে দেখে মনে হচ্ছে নতুন কোন সূত্র আবিষ্কারের দোরগোড়ায় আছে সে এখন

“আসো আমার সাথে,” বলে সেদিকে রওনা হলো সে। জায়গাটা তারা

যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল তার চেয়ে মাত্র পঞ্চাশ মিটার দূরে। সারি করে দাঁড়ানো অনেকগুলোর সাইকেলের সামনে এসে থামলো কুসানাগি।

“তিনি বলেছিলেন, সাইডওয়াকে চেইন দিয়ে রেলিঙের সাথে বেঁধে রেখেছিলেন সেটা, ঠিক এখানে।”

“চোর তাহলে চেইনটা কেটে ফেলে?”

“তাই তো হবার কথা।”

“তার মানে চোরের সাথে বোল্ট কাটারও ছিল…” বিড়বিড় করে বলল ইউকাওয়া। “কিন্তু এখানে তো চেইন ছাড়াও অনেক সাইকেল দেখা যাচ্ছে, তাহলে সে ওটা চুরি করতে গেলো কেন?”

“আমি কিভাবে জানবো? বোধহয় সাইকেলটা তার পছন্দ হয়েছিল।”

“পছন্দ করেছিল?” নিজেকেই বলল ইউকাওয়া। “কি পছন্দ করেছিল?”

“কিছু বলতে চাইলে পরিস্কার করে বলো,” কুসানাগি বিরক্ত হয়ে বলল।

“তুমি তো শুনেছোই, কালকেও এখানে এসেছিলাম আমি। এসে আজকের মতই নজর রাখছিলাম আশেপাশে। সারাদিনই এখানে এভাবে সাইকেল রাখা থাকে। কিছু কিছু সাইকেল এমনভাবে পড়ে থাকে, দেখে মনে হয় মালিক চাইছে সেটা চুরি হোক। কিন্তু এই সাইকেলগুলো থাকা সত্ত্বেও আমাদের খুনি ঐ সাইকেলটাই নিলো কেন?”

“আমরা কিন্তু জানি না খুনিই সাইকেলটা চুরি করেছে।”

“আচ্ছা, ধরো তোমার কথাই ঠিক। তাহলে ভিক্টিম এখান থেকে সাইকেলটা চুরি করেছিল। কিন্তু ঐ সাইকেলটাই কেন?”

“আমি কিছুই বুঝতে পারছি না,” কুসানাগি মাথা ঝাঁকিয়ে বলল। ‘সাইকেলটার মধ্যে তো ওরকম বিশেষ কিছু ছিল না। আমার মনে হয় ভিক্টিম অতকিছু না ভেবেই ওটা চুরি করেছিল।”

“না, ব্যাপারটা এত সহজ নয়,” ডিটেক্টিভের মুখের সামনে একটা আঙুল দুলিয়ে বলল ইউকাওয়া। “আমার ধারণা সাইকেলটা একদম নতুন ছিল, ঠিক?”

অবাক হয়ে গেলো কুসানাগি। “হ্যা, সাইকেলের মালিক তো অমনটাই বলছিল। একমাস আগে কেনা হয়েছিল সাইকেলটা।”

ইউকাওয়ার চেহারা দেখে বোঝা গেলো সে এই উত্তরটাই আশা করছিল। “যা ভেবেছিলাম। একটা নতুন সাইকেল, যেটা কিনা দামি চেইন দিয়ে তালা মারা থাকবে। আর সেটা চুরি যাওয়ার সাথে সাথে পুলিশে রিপোর্ট করবে মালিক। এজন্যেই সে সাথে করে বোল্ট কাটার নিয়ে এসেছিল।”

“মানে, সে ইচ্ছে করে নতুন সাইকেল চুরি করেছে?”

“হ্যা।”

“কেন?”

“এর একটাই কারণ হতে পারে, অপরাধি চাইছিল মালিক যেন পুলিশের কাছে অভিযোগ করে। এটা তার পরিকল্পনারই অংশ। আমার ধারণা তদন্তটাকে অন্যদিকে ঘোরানোর জন্যেই সে একাজ করেছে।”

“তার মানে তুমি বলতে চাইছো সাইকেল চুরি যাওয়ার সময় সম্পর্কে আমাদের ধারণাটাও ভুল। সকাল দশটা থেকে রাত এগারোটার মধ্যে চুরি হয়নি ওটা? কিন্তু চোর কিভাবে জানলো ওটার মালিক আমাদের কি বলবে?”

“সে হয়তো সময়ের কথাটা জানতো না, কিন্তু এটা ধারণা করে নিয়েছিল, রিপোর্টটা ঠিকই করা হবে। আর তাতে সবার নজর এই স্টেশনের দিকে ঘুরে যাবে।”

একবার ঢোক গিলল কুসানাগি। “তুমি বলতে চাইছো, আমাদের নজর এই স্টেশনের ওপর ফেলার জন্যেই পুরো ঘটনাটা সাজানো হয়েছে?”

“একটা সম্ভাবনার কথা বলছি মাত্র।”

“এখানকার আশেপাশে খোঁজ-খবর নেয়ার জন্যে আমরা অনেক সময় নষ্ট করেছি।’

“ঠিক নষ্ট করেছো তা বলবো না। সাইকেলটা তো এখান থেকেই চুরি করা হয়েছিল। কিন্তু এইসব তথ্য জানতে পারলেই যে কেসটার সমাধান করতে পারবে, সেটা ভাবলে ভুল হবে। আরো গভীর ষড়যন্ত্র আছে এর পেছনে।”

হঠাৎ করে ইউকাওয়া ঘুরে বিপরীত দিকে হাটা দিলো।

“আরে,” কুসানাগি দ্রুত তার পিছু নিয়ে বলল, “এখন আবার কোথায় যাচ্ছো?”

“বাসায়। আর কোথায়?”

“দাঁড়াও,” ইউকাওয়ার ঘাড় ধরে তাকে থামিয়ে বলল কুসানাগি। “আরেকটা প্রশ্ন আছে আমার। এই কেসটা নিয়ে এত আগ্রহ দেখাচ্ছো কেন তুমি?”

“কেন, আগ্রহ না দেখাবার কথা ছিল নাকি?”

“এটা কিন্তু কোন উত্তর হলো না।”

ইউকাওয়া ঘাড় থেকে কুসানাগির হাতটা সরিয়ে দিলো। “আমাকে কি সন্দেহ করছো?”

“সন্দেহ করবো? না, তা কেন করতে যাবো?”

“তাহলে আমার যা ইচ্ছে আমি সেটাই করতে পারি। তোমার তদন্তের কাজে তো আর বাঁধা দিচ্ছি না আমি।”

“ঠিক আছে, সরাসরিই বলি কথাটা। তুমি মি. ইশিগামির সাথে আমাকে নিয়ে কথা বলেছো, তাই না? তুমি তাকে এও বলেছো, আমি নাকি তোমাকে তার কাছে সাহায্য চাওয়ার জন্যে পাঠিয়েছি। এটার কারণ জিজ্ঞেস করার অধিকার আমার আছে।”

ঘুরে কুসানাগির দিকে ঠান্ডা দৃষ্টিতে তাকালো ইউকাওয়া, “তুমি তার সাথে কথা বলতে গিয়েছিলে?”

“হ্যা। কারণ তুমি আমাকে কিছুই জানাচ্ছিলে না।”

“সে কি বলল?”

“আমি প্রশ্ন করছি এখানে, তুমি না। তাকে ও কথা বলেছো কেন তুমি? তোমার ধারণা সে-ও এসবের সাথে জড়িত?”

ইউকাওয়া আবার ঘুরে হাটা দিলো।

“আরে! দাঁড়াও!” পেছন থেকে বলল কুসানাগি।

ইউকাওয়া ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকালো। “এবার আমি তোমাকে কিছু কথা সরাসরি বলি। এই কেসে তোমাকে সহযোগিতা করা সম্ভব হবে না আমার পক্ষে। কিছু ব্যক্তিগত কারণে এটাতে জড়িয়েছি আমি, তাই সাহায্যের আশা ভুলে যাও।”

“তাহলে আমার তরফ থেকেও কোন সহযোগিতা পাবে না তুমি।”

“ঠিক আছে। এবার তাহলে একা একাই কাজ করতে হবে আমাদের, ‘ নিচের দিকে তাকিয়ে বলল ইউকাওয়া।

কুসানাগি বুঝল, ইউকাওয়াকে তার কথা থেকে টলানো যাবে না এখন, তাই আর ডাক দিলো না সে পেছন থেকে

একটা সিগারেট খেয়ে নিজেও স্টেশনের দিকে রওনা দিলো সে। ইচ্ছে করেই দেরি করেছে, যাতে ইউকাওয়ার সাথে একই ট্রেনে না যেতে হয়। সে বুঝতে পারছে না তার বন্ধুর কি এমন ব্যক্তিগত কারণ আছে যাতে সে এই কেসটার পেছনে এভাবে লেগেছে। তা-ও নিজে নিজেই সব কাজ করছে সে। তাকে অবশ্য বিরক্ত করবে না কুসানাগি।

কি নিয়ে এত চিন্তিত ইউকাওয়া? ট্রেনে বসে চিন্তা করতে লাগলো সে।

ইশিগামিকে নিয়ে? কিন্তু ইশিগামি যদি কোনভাবে কেসটার সাথে জড়িত থেকেই থাকে, তাহলে তদন্তে তার নাম উঠে আসলো না কেন কখনও? পুলিশ খালি এটা জানে, সে প্রধান সন্দেহভাজনের প্রতিবেশি। ইউকাওয়া তাকে নিয়ে এত ভাবছে কেন?

দু-দিন আগের কথা মনে করার চেষ্টা করলো সে। লাঞ্চবক্স শপটাতে দুজনকে একসাথে ঢুকতে দেখেছিল সেদিন। ইশিগামি তাকে বলেছে ইউকাওয়ার আগ্রহেই সেখানে গিয়েছিল তারা।

কারণ ছাড়া কোন কিছু করার মানুষ নয় ইউকাওয়া। তার মনে নিশ্চয়ই কিছু একটা চলছিল। কি সেটা?

আর কুডোও ঠিক সেই সময়ে সেখানে হাজির হয়েছিলেন… অবশ্য সেটা কোনভাবেই ইউকাওয়ার জানবার কথা নয়।

কুডোর সাথে যা যা কথা হয়েছে তা আবার একবার ভাবলো সে মনে মনে। ইশিগামির ব্যাপারে কিছুই বলেনি সে। আসলে কুডো কারো নামেই কিছু বলেনি।

হঠাৎ করে একটা কথা মনে পড়লো তার। কুডো বলেছিলেন, বেন্টেন- টেই’তে শুধু ইয়াসুকোকে দেখতেই নাকি অনেক কাস্টমার আসে। খুব বিরক্তি নিয়ে কথাটা বলেছিলেন ভদ্রলোক।

লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে সোজা হয়ে বসলো কুসানাগি। উল্টোদিকে বসে থাকা এক মহিলা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে।

ট্রেনের দরজায় টাঙানো ম্যাপটাতে একবার নজর বোলাল সে। হামাকোতে একবার থামতে হবে তাকে।

X

শেষ কবে গাড়ি চালিয়েছিল সেটা ভুলে গেছে ইশিগামি। কিন্তু ত্রিশ মিনিটের মধ্যেই আবার সব কিছু আওতায় এসে পড়লো তার। তবুও তার গন্তব্যস্থলে গাড়িটা পার্ক করতে বেশ খানিকটা সময় চলে গেলো। যেখানেই গাড়িটা রাখতে যাবে, কেউ না কেউ ঢুকে পড়ছে হুট করে। অবশেষে দুটো ট্রাকের মাঝে চাপা একটা জায়গা দেখে সেখানেই পার্ক করলো।

এই নিয়ে জীবনে দ্বিতীয়বারের মত গাড়ি ভাড়া করলো ইশিগামি। এর আগে টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট থাকাকালীন একদল শিক্ষার্থিকে নিয়ে একটা পাওয়ার প্ল্যান্ট ভ্রমণে যেতে হয়েছিল তাকে। সেবার একটা বড় ভ্যান চালিয়েছিল। কিন্তু আজকের গাড়িটা সে তুলনায় অনেক ছোট আর সামলানোও সোজা।

ডানদিকে একটা বিল্ডিঙের দিকে তাকালো সে। একটা সাইন বোর্ড ঝুলছে সেটার সামনে : হিকারি গ্রাফিক্স লিমিটেড। কুনিয়াকি কুডোর কোম্পানি এটা।

এই জায়গাটা খুঁজে পেতে অবশ্য বেশি বেগ পোহাতে হয়নি ইশিগামিকে। কুডোর নামটা ডিটেক্টিভ কুসানাগিই বলেছিল তাকে। সাথে এও বলেছিল, একটা প্রিন্টিং কোম্পানি আছে তার। বাকি কাজটা সে ইন্টারনেট থেকে সেরে নিয়েছে। একমাত্র হিকারি গ্রাফিক্স-এর ম্যানেজারের নামই কুনিয়াকি কুডো।

স্কুল শেষে সরাসরি রেন্ট-এ-কারের অফিসে চলে যায় সে। সেখান থেকে আগেই বুক করে রাখা গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। একটু ঝুঁকি আছে অবশ্য কাজটায়। কারণ টাকা-পয়সা আদান প্রদানের একটা রেকর্ড রয়ে যাবে কোম্পানিটার কাছে। কিন্তু বুঝে-শুনেই ঝুঁকিটা নেয় সে।

ঘড়িতে যখন ৫:৫০ বাজছিল তখন সামনের দরজা দিয়ে কয়েকজন লোক বেরিয়ে আসলো। কুডোও আছে তাদের মধ্যে। তাকে দেখেই জমে গেলো ইশিগামি।

ওদিক থেকে চোখ না সরিয়েই ডিজিটাল ক্যামেরাটা হাতে নিলো। এরপর ভিউ-ফাইন্ডারে চোখ রেখে যতটা সম্ভব জুম করে নিলো সে।

কুডো খুব ফিটফাট অবস্থায় আছে এখন। ইশিগামি জানেও না ওসব জামাকাপড় কোথায় পাওয়া যায়। আর ইয়াসুকো একারণেই কুডোকে পছন্দ করে। অবশ্য বেশিরভাগ মহিলাই তার আর কুডোর মধ্যে তুলনা করে কুডোকেই বেছে নেবে। হিংসা হতে লাগলো তার লোকটার প্রতি।

ঝটপট একটা ছবি তুলে ফেলল। ইচ্ছা করেই ফ্ল্যাশটা বন্ধ করে রেখেছে, তা সত্ত্বেও বেশ ভালোই এসেছে ছবিটা।

কুডো বিল্ডিঙের পেছন দিকে যাচ্ছিল। ইশিগামির ধারণা সেখানেই তার দামি গাড়িটা পার্ক করে রাখা। অপেক্ষা করতে লাগল সে। কিছুক্ষণ পরেই সবুজ একটা মার্সিডিজ বেরিয়ে এলো রাস্তায়। কুডোকে সেটার ড্রাইভিং সিটে দেখে দ্রুত নিজের ইঞ্জিনটা চালু করে নিলো সে।

সাবধানে কুডোর পিছু নিলো। বেশ কঠিন কাজটা, কিন্তু সৌভাগ্যবশত কুডো খুব আস্তে আস্তে, নিয়ম মেনে গাড়ি চালাচ্ছে। আর প্রতি মোড়ে হলুদ লাইট জ্বলতে দেখলেই থেমে যাচ্ছে সে।

গাড়ি চালানোর ফাঁকে জিপিএস-এর দিকে নজর বোলাল কয়েকবার। অপরিচিত রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে সে এখন, কিন্তু জিপিএস অনুযায়ি কুডোর মার্সিডিজটা শিনাগাওয়ার দিকে চলেছে।

কিছুক্ষণ পরেই রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা বেড়ে গেলে পিছু নেয়া আরো কঠিন হয়ে দাঁড়ালো। হঠাৎ করে তার আর কুডোর মাঝে একটা ট্রাক ঢুকে গেলো। সামনে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। একটু পরেই লাল লাইট জ্বলে উঠলে থেমে যেতে হলো তাকে। ট্রাকটা রাস্তার একদম সামনে গিয়ে থেমেছে। তার মানে কুডোর গাড়ি ইতিমধ্যেই সিগনাল পার হয়ে গেছে।

হারিয়ে ফেললাম এত তাড়াতাড়ি, নিজের ভাগ্যকে গাল দিয়ে মনে মনে বলে উঠলো ইশিগামি।

কিছুক্ষণ পরে সবুজ লাইট জ্বললে তাড়াতাড়ি গাড়ি নিয়ে সামনে বাড়ল। সৌভাগ্যবশত একটু পরেই সবুজ মার্সিডিজটা নজরে আসল তার। ডানদিকে মোড় নেয়ার জন্যে অপেক্ষা করছে সেটা। পেছনের ইন্ডিকেটর লাইটটা জ্বলছে আর নিভছে। একটা হোটেলে ঢুকবে কুডো।

বিন্দুমাত্র ইতস্তত না করে সেটার পিছু নিলো সে। এতে হয়তো কুডোর মনে সন্দেহ জাগতে পারে, কিন্তু ঝুঁকিটা নিতেই হবে, নইলে আবার হারিয়ে ফেলবে।

কিছুক্ষণ পরে গাড়ি নিয়ে হোটেলটার পার্কিংলটে ঢুকে গেলো কুডো ইশিগামিও অনুসরণ করলো তাকে।

পার্কিংলট থেকে যখন টিকেট নিচ্ছিল ইশিগামি, সে-সময় কুডো পেছনে তাকায় একবার। বাধ্য হয়ে ড্রাইভিং সিটে বসেই ঝুঁকে পড়ে সে। কুডো তাকে দেখে ফেলেছে নাকি বুঝতে পারছে না।

পার্কিংলটটা খালিই বলতে গেলে। দরজার কাছাকাছি একটা জায়গায় পার্ক করলো কুডো। তার থেকে বেশ খানিকটা দূরে গাড়ি থামাল ইশিগামি। ক্যামেরাটা হাতে তুলে নিলো। মার্সিডিজ থেকে কুডো বের হচ্ছে এমন সময় আরেকটা ছবি তুলল। কুডো এদিকেই তাকিয়ে আছে, নিশ্চয়ই কিছু সন্দেহ করেছে! আবারও লুকিয়ে পড়লো ইশিগামি।

কিন্তু এদিকে না এসে হোটেলে ঢুকে গেলো কুডো। লোকটা দৃষ্টির আড়াল হবার পরে আবার গাড়ি চালু করে সেখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলো সে।

দুটো ছবিতেই কাজ চালাতে হবে। পার্কিংলট থেকে বের হবার সময় ছবি দুটোর সাথে যে চিঠিটা পাঠাবে সেটা মনে মনে লিখতে শুরু করল :

ছবি দুটো দেখে বুঝতেই পারছো ধরা পড়ে গেছো। যার সাথে লুকিয়ে দেখা করো তার পরিচয় জেনে ফেলেছি আমি। এই লোকটার সাথে কি দরকার তোমার? তুমি যদি তার সাথে কোন সম্পর্কে জড়াও তাহলে সেটা বিশ্বাসঘাতকতা বলে গণ্য করা হবে। তুমি কি জানো না, আমি তোমার জন্যে কি কি করছি? কত বড় ঝুঁকি নিয়েছি? লোকটার সাথে দেখা-সাক্ষাত বন্ধ করতে হবে তোমাকে। যদি তা না করো তাহলে সব রাগ এই লোকটার ওপর ঝাড়বো আমি। তার উপযুক্ত কারণ এবং ক্ষমতা দুটোই আছে আমার। আবারও বলছি, তুমি যদি তার সাথে কোন সম্পর্কে জড়াও তাহলে সেটা বিশ্বাসঘাতকতা বলে গণ্য করা হবে। আর সেটাকে ক্ষমা করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। উপযুক্ত প্রতিশোধ নেয়া হবে।

বারবার একই জিনিস ভাবতে লাগল ইশিগামি। প্রতিবারই কিছু লাইন যোগ করছে আর বাদ দিচ্ছে। একটু বেশিই কি কঠিন হয়ে যাচ্ছে হুমকিটা? হোক।

হোটেলের পার্কিংলট থেকে প্রায় বেরিয়ে গেছে, এমন সময় একটা দৃশ্য দেখে চোখ বড় বড় হয়ে গেলো তার।

ইয়াসুকো হানাওকা ঢুকছে হোটেলের ভেতরে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *