জলের দাগ
শেষ রাতের আকাশটায় তখন নীলচে আভা৷ নীলাভ ধোঁয়ার পাতলা চাদর অবিন্যস্তভাবে ঘুরে ঘুরে উড়ে চলেছিল আকাশের দিকে৷ সারারাত জ্বলে জ্বলে ক্লান্ত চাঁদ ঠাঁই নিয়েছে আকাশের এককোণে৷ জ্যোৎস্নায় ধোঁয়ার শরীর মাঝে মাঝে বড় অলৌকিক বলে মনে হয়৷ যেন একরাশ অপূর্ণ ইচ্ছের ছায়ামূর্তি চাঁদের আলোয় ভিজে চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে; নিঃসঙ্গ, কায়াহীন ও অসহায়!
বড় বড় নিষ্প্রভ চোখদুটো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে কী যেন দেখছিল! দেখার বিষয় বলতে তেমন কিছু নেই৷ কলকাতার একটা পুরোনো বাড়ির ঘর আর আশেপাশের উদ্বিগ্ন মুখগুলো ছাড়া৷ একেবারে বিছানায় মিশে যাওয়া কঙ্কালসার মানুষটার আত্মীয়স্বজন অমোঘ উদ্বেগে দেখছিল পাঁজরসর্বস্ব বুকের ওঠাপড়া আস্তে আস্তে ক্ষীণ হয়ে আসছে৷ জীর্ণ ফুসফুস হাতড় হাতড়ে খুঁজছে অক্সিজেন৷ এমন বাতাসে ভরা পৃথিবীতে আজ শুধু এই একটি মানুষের জন্য এক ফোঁটা অক্সিজেনও বরাদ্দ নেই৷
বড় কষ্টকর এই দৃশ্য! তবু দেখতেই হয়!
ডাক্তার একটু আগেই দিয়ে গেছেন শেষ জবানবন্দি—
—‘অবস্থা খুবই খারাপ৷ আমি ইঞ্জেকশন দিয়ে গেলাম৷ কিন্তু কাজ কতদূর হবে……’ তারপরই অনিশ্চিত অথচ বিষণ্ণ গলায় বললেন, ‘আর হয়তো ঘণ্টাখানেক সময়……’
ঘণ্টাখানেক সময়! ঘণ্টাখানেক সময় কি আদৌ যথেষ্ট? একটি মানুষের দীর্ঘ পঁচাশি বছরের সমস্ত সাধ, সমস্ত আকাঙ্ক্ষার গায়ে দাঁড়ি টেনে দেওয়ার জন্য এক ঘণ্টা সময় কতটুকু! একদিকে পঁচাশি বছর; অন্যদিকে একঘণ্টা! তবু আজ বোধহয় সেই একঘণ্টাই পঁচাশি বছরকে মাত দেয়!
ফ্যালফ্যালে চোখদুটো ফের ঘুরল উপস্থিত সকলের দিকে৷ চোখের সামনে সবটাই আবছা৷ তবু দৃষ্টি বারবার খুঁজে বেড়াচ্ছিল কিছু নির্দিষ্ট মুখ৷ কার মুখ কে জানে! মানুষটার জীবনে যে মুখগুলো বারবার উঠে এসেছে সেই মুখের সারি তার চারিদিকে মজুত৷ অথচ এই মুহূর্তে তাদের কাউকেই মনে পড়ল না৷ বরং মনে পড়ে গেল এক বিরাট মাঠের কথা!……
সেই মাঠের বুকে কাশবন হাওয়ার সাথে খেলা করত৷ মাঠের একপাশে ছিল স্বচ্ছ টলটলে বিরাট ঝিল৷ ঝিলের বুক থেকে উঠে আসা দামাল হাওয়ায় ঘুড়ি উড়িয়ে বেড়াত এক দুষ্টু কিশোর৷ কচি কচি ঘাসের উপর দিয়ে খালি পায়ে দৌড়ে যেত এক অদ্ভুত খেয়ালে৷ কখনও নারকেলবাগানে, কখনও আমবাগানে দস্যিপনা করে কেটে যেত দিন……৷
—‘বাবা…বাবা…!’
মস্তিষ্ক যেন সামান্য সাড়া দিয়ে উঠল৷ ইতস্তত এদিক-ওদিক তাকিয়ে কী যেন খুঁজছে চোখ৷ এবার সামনে ঝুঁকে পড়া মুখটার দিকে ন্যস্ত হল৷
—‘বাবা?’
—‘উঁ?’
—‘কী খোঁজো? কাকে খোঁজো?’
ফের উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি চতুর্দিকটা অদ্ভুত ঘোর নিয়ে জরিপ করতে শুরু করল৷
—‘কী খুঁজছ বাবা?’
ঘড়ঘড় একটা শব্দ৷ অতিকষ্টে গলা দিয়ে বেরোল প্রশ্নের উত্তর—
—‘আমার দ্যাশ!’
গল্প—১
মাঠের ওপ্রান্তে ছিল করিমচাচাদের বাড়ি৷ ছোট্ট একফালি সবুজ দিয়ে ঘেরা একটা অনাড়ম্বর মাটির ঘর৷ মাচায় লাউ, কুমড়ো লতায় পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ফলে থাকত৷ সামনের ছোট্ট সবজি বাগানটা করিমচাচা বড় সযত্নে গড়ে তুলেছিলেন৷ যখনই এক ছোট্ট বালক সেখানে গিয়ে হানা দিত, তখনই তার হাত ধরে আদর করে দেখাতেন—
—‘মনু, দেখছ নি? কেমন কাঁচালঙ্কা হৈছে গাছডায়?’
উত্তরে আসত একটা ছোট্ট সবিস্ময় প্রশ্ন, ‘এইডা কাঁচালঙ্কার গাছ চাচা?’
—‘হঃ৷’ তিনি সগর্বে মাথা নাড়তেন, ‘এইবার ভালা ফলছে৷ দেখছ কেমনি লাল, সইবজা; টোপা টোপা হইছে৷ সোন্দর না?’
মনু কোনওদিন বেশি প্রশ্ন করত না৷ অবাক হয়ে দেখত করিমচাচার মুখে শরতের আলো! মা বলত, করিমচাচারা নাকি বড় গরিব, অন্যের খেতে ভাগচাষি হয়ে খাটে৷ দু-বেলা নুন আনতে পান্তা ফুরোয়৷ অথচ ওই মুহূর্তে মানুষটা যেন ঐশ্বরিক আনন্দে দেখিয়ে যেত একের পর এক তার সৃষ্টি৷
—‘মাচায় কুমড়াখান কেমন হইছে কও দেহি!’ তিনি সগর্বে ঘোষণা করলেন, ‘লতিফের আম্মায় কইতাছিল; লতাখান বাঁচব না! আমি কই, চাষার হাতে পড়লে ধানের তুষও কথা কয়! আর এ তো হইল গিয়া একখান কুমড়ার লতা! বাঁচব না মানে! বাঁচাইয়াই তয় ছাড়ুম!’
করিমচাচার কথায় ছোট্ট মনু ফিক করে হেসে ফেলে৷ সরল অনাড়ম্বর আন্তরিকতায় তার ক্ষুদ্র হৃদয়ও প্রসন্ন হয়ে ওঠে৷ করিমচাচার মাটির বাড়িটাই যে কখন নন্দনকাননে পরিণত হয়, সে টেরও পায় না৷
—‘সোন্দর হইছে না মনু? নিবা নাকি?’
সে দেশে কেউ কোনওদিন শিখিয়ে দেয় না যে অন্যের জিনিস কখনও নিতে নেই৷ কারুর অযাচিত স্নেহের দানের পিছনে সন্দেহতীক্ষ্ণ ভ্রূকুটির কথাও মনে পড়ে না৷ শুধু মায়ের সামান্য বকুনিটুকুর ভয়ে সে মিনমিন করে বলে, ‘থাউক চাচা, মায় রাগ করব৷ কইব, হ্যাংলাপানা………!’
—‘মা জননীরে আমি কইয়া দিমু সনা৷ মায় কিস্যু কইব না’৷ করিমচাচা তার মাথার চুল ঘাঁটতে ঘাঁটতে বলেন, ‘তাইলে নিবা তো?’
মনু হেসে ঘাড় কাত করে দেয়৷ তিনি যেন স্বর্গীয় আনন্দ লাভ করেন৷ যেন তাঁর সোনার ফসলের প্রথম ভাগটা কোনও দেবতার হাতে সমর্পণ করছেন৷ স্বার্থহীন দেওয়ার মধ্যে যে এত আনন্দ তা বোধহয় করিমচাচার কাছেই শিখেছিল তাঁর স্নেহের ‘মনু’৷
এমনই ছিলেন করিমচাচা৷ হঠাৎ হঠাৎই কথা নেই বার্তা নেই এসে পড়তেন বাড়িতে৷ কখনও ঘাড় থেকে নামত কলার কাঁদি, কখনও রাঙা আলু, কখনও বা লাউ, কুমড়ো৷ কখনও আবার হাঁকডাক করে বলতেন, ‘অ-মা জননী৷ মনু আইজ আমাগো ঘর খাইবে৷ ইদের নিওতা দিলাম৷’
মা আশ্চর্য হয়ে যেতেন৷ আশ্চর্য হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক৷ যে মানুষটার নিজেরই অন্ন সংস্থান নেই সে যখন হাসিমুখে এসে খাওয়ার নিমন্ত্রণ দেয় তখন অবাক লাগেই বটে৷ কখনও কখনও জানাতেন মৃদু প্রতিবাদও :
—‘না করিম, এইবার থাউক গা৷’
—‘না মা, এইডা তুমি কি কইলা? থাকব না৷’ করিমচাচা জোরালো গলায় বলতেন, ‘মনুরে পাঠায়া দিও৷ কোনও কথা শুনুম না৷’
অগত্যা৷ মা একটু দ্বিধা করতেন বটে৷ কিন্তু মনুর কোনও দ্বিধা ছিল না৷ সময় হলেই সে নাচতে নাচতে বাবার হাত ধরে পরমোৎসাহে গিয়ে হাজির হত করিমচাচার বাড়ি৷ ডাল, ভাত, ভাজাভুজি, ঝাল ঝাল মাংসের ঝোল আর সিমুইয়ের পায়েস প্রায় অমৃতজ্ঞানে খেত৷ করিমচাচার মুখে শুনত পদ্মাগাঙের ডাকাতদের গল্প৷ যারা বহু বছর আগে নৌকো করে নদীর বুকে ভেসে বেড়াত, আর বড়লোকদের বজরা দেখলেই লুটে নিত৷ একেকজনের ইয়া মস্ত বড় গোঁফ ছিল৷ ভাঁটার মতো লাল চোখ আর বুক প্রায় পিপের মতো চওড়া!
—‘চাচা, তুমি ডাকাইত দেখো নাই?’
—‘খুব দেখছি মনু৷’
—‘আমারে দ্যাখাবা?’
—‘দেখামু হ’নে৷’
—‘কবে দ্যাখাবা?’
করিমচাচা একটু ভেবে উত্তর দিতেন, ‘ডাকাইত দ্যাখলে তুমি ডর খাবা না তো মনু?’
মনু বুক ফুলিয়ে বলত, ‘ভয় পামু ক্যান? উল্টা দিমু একখান চোপাড়!’
তিনি হো হো করে হেসে উঠতেন৷ মনুর বাবাকে উদ্দেশ করে বলতেন, ‘শোনছেন নি কত্তা? কী কয় আপনের পোলায়! বড় হইয়া আমাগো মনু দারোগা হইবো হ’নে৷’
এরপর থেকে করিমচাচার সাথে প্রায়ই গোপনে গজল্লা হত৷ কোথায় ডাকাত দেখতে যাবে, কেমন করে যাবে, ইত্যাদি ইত্যাদি…৷
আর সাথে সাথেই উঠে আসত একটাই প্রশ্ন, ‘ডাকাইত কবে দ্যাখাবা আমারে…ও চাচা!’
সহাস্য উত্তর, ‘এই তো, দেখামু৷’
শেষ পর্যন্ত আর ডাকাত দেখা হয়নি মনুর৷ পরের বর্ষাতেই কী এক অজানা জ্বরে তিনদিন ভুগে সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন করিমচাচা৷ এক অদৃশ্য ডাকাত তাঁকেই ছিনিয়ে নিয়ে গেল সবার কাছ থেকে৷
শেষের দিকে করিমচাচাকে কেমন যেন ফ্যাকাশে সাদা ঘুড়ির মতো লাগছিল৷ এক্ষুনি যেন উড়তে উড়তে কোথায় হারিয়ে যাবে৷
করিমচাচার বৌ, ছেলে লতিফ খুব কাঁদছিল৷ মনু বুঝতে পারেনি কীজন্য সবার এত মন খারাপ৷ সে প্রশ্ন করেছিল—
—‘চাচা, তোমার কী হইছে?’
ক্লিষ্ট হেসে উত্তর দিয়েছিলেন চাচা, ‘কিছু হয় নাই বাপ৷’
—‘তয় চাচি কাঁদে ক্যান?’
—‘আমার তবিয়ৎ খারাপ, তাই কাঁদে৷’
একটু আশ্বস্ত হয়ে ফের সেই প্রশ্নটা করল সে, ‘আমারে ডাকাইত দ্যাখাবা না?’
অদ্ভুত অর্থপূর্ণ হাসি হেসেছিলেন করিমচাচা৷ তখন সে হাসির অর্থ বোঝেনি৷ পরে বুঝেছিল ওটা ফাঁকি দিতে পারার আনন্দের হাসি৷
করিমচাচা ফাঁকি দিয়েছিল৷ কথা রাখেনি৷
গল্প—২
সে দেশে আকাশটা বিরাট বড় ছিল৷ তেমন আকাশ বোধহয় আর কোথাও দেখা যায় না৷ শান্ত আকাশের গায়ে রোদের ঝিকিমিকি হাসি৷ নীচে কলকল ছলছল করে তরঙ্গে তরঙ্গে বয়ে চলেছে পদ্মা নদী৷ আকাশের সাথে এমন ভাবে দিগন্তে মিশেছে যে দেখলে চমকে যেতে হয়৷ মনে হয় আকাশটাই যেন চঞ্চল হয়ে নেমে এসেছে পদ্মার গা বেয়ে৷ দুই বিশালত্ব একাকার হয়ে মিলে গেছে অসীমে!
বিকেলের আলো পদ্মায় চুঁইয়ে পড়ত৷ পদ্মার দিগন্তবিস্তৃত জলরাশি তখন পড়ন্ত রোদের আদরে চিকমিক করে উঠত৷ আদুরে স্রোতে অভ্রমাখা আঁচল উড়িয়ে কখনও ঘূর্ণনে, কখনও সরলরেখায় ছপছপ করে নেচে চলে সে৷
তার পাড়ে বসে মুগ্ধ চোখে সেদিকেই তাকিয়ে থাকত দুই কিশোর৷ আস্তে আস্তে সন্ধে হয়ে আসে৷ জেলেদের নৌকোর বাতিগুলো মিটমিট করে জোনাকির মতো জ্বলে ওঠে৷ মাঝেমধ্যে নদীর বুক থেকে উঠে আসা কুয়াশা ম্লান করে দিত সে দ্যুতি৷ কিন্তু সে অস্পষ্টতা ক্ষণস্থায়ী৷ কিছুক্ষণ পরেই ধোঁয়াশা কেটে প্রকট হয়ে ওঠে টিমটিমে আলোর বিন্দু৷ মনে হত আকাশের তারাগুলো আকাশ বেয়ে বুঝি নেমে এসেছে নদীর জলে! আলোর মালায় সেজে উঠত পদ্মা৷ আর তার কালো জল মসৃণ গতিতে চলতে চলতে আওয়াজ তুলত ছপছপ!
—‘মিতা……’ সিরাজ তার কোঁচড় থেকে বের করে আনত পানিফল৷ মিতার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলত, ‘আমি বড় হইয়া মাঝি হমু৷ তুমি কী হইবা?’
মিতা তখনও ভেবে উঠতে পারেনি বড় হয়ে সে কী হবে! সে নির্বিবাদে একটা পানিফল মুখে পুরে দিয়ে বলে, ‘কখুনও ভাবি নাই; কিন্তু তুমি মাঝি হইবা ক্যান?’
সিরাজের মুখে মাঝিদের নৌকোর আলো ঝলমল করে উঠত৷ তার একটা ভেঁপু ছিল৷ ওই ভেঁপুটা বোধহয় তার প্রাণের থেকেও প্রিয়৷ সবসময়ই তার কোমরে গোঁজা থাকত৷ সেই ভেঁপুতে গোটাকয়েক টান মেরে বলত সে, ‘আমি পদ্মায় নাও বাইয়া বেড়ামু৷ জাল ফালাইয়া ইলশা ধরুম৷ আর দিবারাত্তর গলা ছাইড়া গান গামু৷ দ্যাখো নাই? মাঝিরা কী সুখেই না গান গায়! পদ্মার পানিতে কী সুখ মিতা, জানো নাই!’
—‘তয় আমিও মাঝি হমু৷’
সিরাজ মায়া জড়ানো হাসি হাসে, ‘না, তুমি মাঝি হবা না৷ তুমি অনেক বড় হইবা! জজ-ম্যাজেস্টর হইবা! আমাগো মুখ রওশন করবা৷’
মিতার একটু সন্দেহ হয়৷ জজ-ম্যাজিস্ট্রেট হলে সিরাজের সাথে আর দেখা হবে কি? সে কথা বলতেই সিরাজ ফের হাসে, ‘ক্যান? দ্যাখা হইব না ক্যান? আমি মাছ ধইরা তোমারে দিমু, আর তুমি খাবা!’
ব্যস, এইটুকুতেই নিশ্চিন্ত!
এভাবেই সন্ধেটা কাটত৷ নদীর পাড়ে বসে, কখনও ভেঁপু বাজিয়ে, কখনও সুখ-দুঃখের কথা বলে৷ সিরাজ প্রায়শই বলত, ‘বোঝলা মিতা, আববাজান আমারে মেলায় এই ভেঁপুডা দিছিল৷ আর তারপরই কলেরায় লোকডা মইরা গেল৷ আমাগো ঘরে দামি কিস্যু নাই৷ থাকনের মধ্যে এই ভেঁপুডা! এডারে আমি মরলেও ছাড়ুম না৷ এইডা আমার আববাজানের চিহ্ন৷’
আর সকালবেলাটা কাটত ঘুড়ি উড়িয়ে৷ বিস্তৃত মাঠের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত অবধি সিরাজ আর তার মিতা খালি পায়ে দৌড়ে বেড়ায়……
—‘মিতা-আ-আ! তোমার ঘুড়ি কাটছে…কা-ট-ছে রে-এ-এ……৷’
এরপরই শুরু হত প্রতিযোগিতা৷ কে আগে গিয়ে কাটা ঘুড়ি ধরতে পারে৷
মাঠের নরম শিশিরবিন্দু এই কাণ্ড দেখে ঝলমলিয়ে হাসত৷ ঝিলের বুক থেকে হু হু করে হাওয়া এসে লুটোপুটি খেত দুই কিশোরের গায়ে৷ জলে বড় বড় শালুক অবাক হয়ে চেয়ে দেখত সেদিকেই৷ সোনালি রোদ যেন আকাশের অনাবিল আনন্দধারার মতো গলে গলে পড়ত!
খোলা মাঠে, তাজা শিশির পায়ে মাড়িয়ে ছুটে চলেছে দুজনে৷ দুজনের খিলখিল হাসি খোলা মাঠ ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে খোলা আকাশে৷ কাটা ঘুড়ি বাতাসের টানে গোঁত্তা খেতে খেতে পড়ল গিয়ে পুঁটে গাজিদের বাগানে! আটকে গেল গাছে৷
পুঁটে গাজিদের বাগান আলো করে ফলে থাকত কুল, বৈঁচি, আমড়া! থোকায় থোকায় পাকা কুল ঝুলত বোঁটায় বোঁটায়৷
—‘রও মিতা, আমি দেখতাছি…’
চোখের পলকে ভেঁপুটা কোমরে গুঁজে তরতর করে গাছ বেয়ে উঠে যায় সিরাজ! একহাতে কাটা ঘুড়ি ধরে আরেক হাতে পটাপট ছিঁড়ে নিত কুল৷ একটা করে নিজের মুখে পুরত, আর গুচ্ছ গুচ্ছ ফল ছুঁড়ে দিত নীচে; যেখানে কোঁচড় পেতে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার মিতা৷
—‘এই ক্যাডা! ক্যা-ডা-রে?’
হঠাৎই বাগানের ওপ্রান্ত থেকে ভেসে আসে কর্কশ চিৎকার৷ সিরাজ ভয়ার্ত দৃষ্টিতে দেখে উল্টোদিক থেকে বিদ্যুৎবেগে ছুটে আসছে পুঁটে গাজি! খালি গা, পরনে লুঙ্গি আর পায়ে একজোড়া শতছিন্ন বুটজুতো! এই বুটজোড়া তাকে কে দিয়েছিল কে জানে! কিন্তু সর্বক্ষণই সে বুটজুতো পরে থাকত৷
—‘পলাও…পলাইয়া যাও মিতা!’
উপর থেকে চেঁচিয়ে বলে সিরাজ৷ কিন্তু সিরাজের মিতা অনড়! সে বন্ধুকে ছেড়ে যাবে না!
কোনওমতে তড়বড় করে গাছ থেকে নেমে আসে সিরাজ৷ বন্ধুর হাত কষে ধরে বলে, ‘পলাও৷’
পুঁটে গাজি ততক্ষণে কাছে এসে পড়েছে৷ দূর থেকে তীক্ষ্ণ কর্কশ গলায় চিৎকার করে বলে, ‘হালা নি-বৈবং-শা! চুরি করতাছ! হা-লা, কাইট্টাই ফেলুম!’
বলেই ছেলেদুটোর পিছনে তাড়া করে৷ কিন্তু তাড়া করে আর কতক্ষণ পারবে! দুজনেই বয়েসে নবীন৷ দুরন্ত গতিতে মুহূর্তের মধ্যে পুঁটে গাজিকে পিছনে ফেলে ছুটে চলল৷ বাগান পেরিয়ে, ধানখেতের মধ্য দিয়ে৷ দুই ধারে সোনালি ধানখেত যতদূর চোখ যায় চলে গেছে৷ সেই আলের উপর দিয়ে দুই বালক হাত ধরাধরি করে দুষ্টুমি ভরা খিলখিল হাসি হাসতে হাসতে ছুটেই চলেছে…ছুটেই চলেছে!
পুঁটে গাজি কিছুদূর ধাওয়া করেও ধরতে পারত না দুই চোরকে৷ নিষ্ফল আক্রোশে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বলত, ‘হা-রা-ম-জা-দা!’
দুজনেই ফের হেসে ওঠে৷ সিরাজ তার ভেঁপুটা বিজয় আনন্দে বাজায়৷ তারপর আলের উপর দাঁড়িয়েই পুঁটে গাজিকে খুব একচোট মুখ ভেঙচে ফের পালিয়ে যায়৷
সিরাজের অভ্যাসই ছিল পরের বাগানে ডাকাতি করা! এর বাগান থেকে কয়েৎবেল, ওর বাগান থেকে আমড়া কিংবা কাঁচা আম; রোজই সে কিছু না কিছু চুরি করে আনত৷ ফলস্বরূপ কপালে মারধোরও জুটত৷ অনেকবার তার মিতা দেখেছে যে সিরাজের গালে পাঁচ আঙুলের দাগ, কপালে কালসিটে!
সে উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চায়, ‘তুমি আইজ আবার মাইর খাইছো?’
সিরাজ কুলকুল করে হাসত, ‘মাইর যত না খাইছি, লগে ফলও খাইছি বিস্তর৷ তুমার লাইগ্যাও আনছি৷’
বলেই কোঁচড় থেকে বের করে দিত সব চুরির সম্পদ৷ দুজনে মিলে পদ্মার ধারে বসে সেই ফল খেত, ভেঁপু বাজাত আর গল্প করত৷ সিরাজ উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত নদীর দিকে আর বলত :
—‘দেইখ্যো, আমি ঠিক মাঝি হমু৷ আর তুমারে নাও-এ লইয়া মাঝদরিয়ায় যামু৷ হেইখানে গিয়া আমি গান গামু আর তুমি ভেঁপু বাজাইবা! তোমাগো কেষ্টঠাকুর যেমনি বাঁশি বাজায়, তুমিও তেমনি কইরাই ভেঁপু বাজাইও মিতা৷ এ গাঙের পানিতে ভেঁপুর সুর বড় মিঠা লাগে৷’
—‘কিন্তু আমি তো ভেঁপু বাজাইতে পারি না!’
—‘আমি পারি৷’ সিরাজ হেসে বলেছিল, ‘আমি তুমারে শিখাইয়া দিমু’নে৷’
এরপর পদ্মার জল অনেকদূর গড়িয়েছে৷
সিরাজের মিতার বাবা প্রথমে কর্মসূত্রে ঢাকায় চলে গেলেন৷ কয়েকদিন বাদে ফিরে এসে তাঁর পরিবারকেও নিয়ে গেলেন৷
যাওয়ার আগের দিন সিরাজ এসেছিল৷ ছলছলে চোখে বলেছিল :
—‘তুমি আর এইহানে থাকবা না?’
মিতার চোখেও জল ছলকে উঠেছিল৷ ধরা গলায় বলে; ‘বাবায় কয় আমাগো ঢাকা লইয়া যাইব৷ আমরা এহন হইতে ওইহানেই থাকুম৷’
—‘ভালা…’ সিরাজ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছিল, ‘আমি শহর দেখি নাই৷ তুমি দ্যাখবা৷ ফিরা আইস্যা কইও শহরে কী কী দ্যাখলা৷ আসবা না?’
সে মাথা নাড়ে, ‘আসুম৷’
—‘আর…’ সিরাজ তার অতিপ্রিয় ভেঁপুটা বের করে এনেছে, ‘এইহান রাহো৷’
মিতা অবাক হয়েছিল! এই ভেঁপুটা সিরাজের প্রাণ! সে একমুহূর্তও ওটাকে ছেড়ে থাকতে পারে না৷ অথচ……!
ভেঁপুটা তার হাতে গুঁজে দিয়ে কান্নামাখা হাসি হেসেছিল সিরাজ, ‘এডারে সামলাইয়া রাইখ্যো৷ তুমারে দিলাম৷ যেমনি এডারে বাজাবা, তেমনি আমারে মনে করবা৷ আমারে ভোলবা না তো মিতা?’
মিতা মাথা নাড়িয়ে জানিয়েছিল, কোনওদিন ভুলবে না৷
পরদিন ভোরে সমস্ত বাক্স-প্যাঁটরা গুছিয়ে রওনা হল ওরা৷ গোরুর গাড়িতে যেতে যেতে সে দেখেছিল রাস্তার সমান্তরাল আলপথ দিয়ে ছুটে আসছে সিরাজ৷ যতদূর যাওয়া সম্ভব ততদূর সে গাড়ির পিছনে ছুটতে ছুটতে এসেছিল৷ আর চিৎকার করে ডেকেছিল :
—‘মি-তা-আ-আ-আ………মি-তা-আ-আ-আ-আ……মি-তা-আ-আ-আ-আ……৷’
ভেঁপু বাজানো আর শেখা হয়নি মিতার!
গল্প—৩
—‘বরিশালে দাঙ্গা লাগছে দাদাভাই!’
ইসমাইল ভাইজানের কথাটা শুনে থ হয়ে বসেছিল দাদাভাই! এ তো লাগারই ছিল! দেশের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল অনেকদিন থেকেই৷ হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কে আস্তে আস্তে চিড় ধরেছে৷ সময়ের সাথে সাথেই ঘনিয়ে আসছিল তীব্র সঙ্কট! তার মধ্যেই গোটা বাংলা দু-টুকরো হয়ে গেল৷ ওপারের নাম হল পশ্চিমবঙ্গ৷ আর এপার : পূর্বপাকিস্তান!
তোড়জোড় আগে থেকেই শুরু হয়েছিল৷ দাঙ্গা লাগতেও সময় লাগল না৷ দাঙ্গা ক্রমশই বিধ্বংসী রূপ নিচ্ছে৷ কোথাও শান্তি নেই; জনজীবনে থাবা বসাতে শুরু করল তীব্র আতঙ্ক৷
তবুও সে কখনও ভাবেনি কোনওদিন এ দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে৷ তার বাবা প্রথমে চাকরিসূত্রে ঢাকায় এসেছিলেন৷ পরে নিজেই কাঠের ব্যবসা ফেঁদে বসেন৷ অসম থেকে নদীর জলে ভেসে আসত কাঠ৷ সেই কাঠকেই প্রায় সোনায় পরিণত করলেন তার বাবা৷ ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠল৷
বাবা গত হওয়ার আগেই তার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল৷ বাবার পর সে-ই ব্যবসার হাল ধরল৷ আপাতত সে বাড়ির কর্তা৷ সদ্যোজাত সন্তানের বাবা এবং একজন বড়সড় ব্যবসায়ী৷
তাদের পাশের বাড়িতেই থাকেন ইসমাইল ভাইজান আর রেশমাভাবি৷ ইসমাইল তার থেকে বয়েসে বড় হলেও আদর করে তাকে ‘দাদাভাই’ ডাকতেন৷ ইদ উপলক্ষ্যে প্রত্যেকবারই থলে হাতে এসে হাঁকাহাঁকি শুরু করেন, ‘দাদাভাই— দা-দা-ভা-ই! কই গেলা!’
দাদাভাই ত্রস্তব্যস্ত হয়ে ছুটে আসত, ‘হ ভাইজান, কী হইছে?’
—‘হইছে আমার মুন্ডু৷’ ইসমাইল হাতের থলে থেকে বের করতেন নতুন ধুতি, পাঞ্জাবি, শাড়ি আরও কত কী!
—‘নাও, এইগুলান রাইখ্যা আমারে উদ্ধার করো৷’
সে বিব্রত হয়ে বলে, ‘ভাইজান, আবার কী আনছো?’
—‘তক্কো কইরো না৷’ তিনি ছদ্মরাগ দেখিয়ে বলতেন, ‘মুখে ভাইজান কও৷ আর কামের বেলায় লবডঙ্কা! ভাইজানের সওগাত লইতে শরম হয় বুঝি?’
এরপর আর কী বলা চলে! অগত্যা দাদাভাই থলেটা নিয়ে সুড়সুড় করে ভিতরবাড়িতে চলে যায়৷ কিছুক্ষণ পরেই ভিতর থেকে মায়ের আবির্ভাব :
—‘ইছমাইল, তুই কিন্তু কাইল এইহানেই খাইয়া যাইস৷ আমার বত্ত আছে৷ আর একা আইবি না৷ তর বিবিরে লইয়া আইস৷’
—‘এই, মা! তোমার হুকুমের লাইগ্যা বইস্যাছিলাম৷’ ইসমাইল আকর্ণবিস্তৃত হাসি হাসেন, ‘কইছো যখন, তখন দুইডায় মিল্যা কাইল তোমার অন্নধ্বংস না কইরা নড়ুম না! মায়ের হুকুম তামিল না কইরা কি দোজখে যামু!’
এই ইসমাইল ভাইজানই প্রথম এনেছিলেন দুঃসংবাদটা৷ বিষণ্ণ মুখে বলেছিলেন :
—‘দাদাভাই, ভালা বুঝি না৷ বরিশালে জব্বর দাঙ্গা লাগছে৷ মোল্লারা ঘুঙুর পইরা, মুখোশ পইরা হিঁদু কাটতাছে৷ হগগলডি কয় দাঙ্গা এহানেও লাগব’৷
কথাটা শুনেই বুকের ভিতরটা ধক করে উঠল তার৷ এর আগেও নোয়াখালিতে বিরাট দাঙ্গা লেগেছিল৷ দাঙ্গায় মারা গিয়েছে অসংখ্য হিন্দু৷ তাদের ঘর আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে৷ যারা প্রাণে বেঁচেছে তারা এক কাপড়ে ও দেশে পালিয়ে গেছে৷ অনেকে পালালেও পৌঁছতে পারেনি৷ মাঝরাস্তাতেই তাদের রামদা, তলোয়ার দিয়ে কুপিয়েছে দুর্বৃত্তরা!
দেশ ভাগ হওয়ার পর থেকেই যে অশান্তি ধিকিধিকি জ্বলছিল, তা একেবারে চরমে উঠল৷ অনেকের মুখেই শোনা গেল, এটা নাকি হিন্দুদের দেশ নয়! তাদের দেশ ভারতবর্ষ৷ আর এটা পূর্বপাকিস্তান! মুসলিমদের দেশ!
সেই শোনা কথাটাই অপরিসীম বেদনা নিয়ে উঠে এসেছিল দাদাভাইয়ের মুখে :
—‘ভাইজান, এডা কি আর আমাগো দ্যাশ নাই? এই ধানখেত নদী মাঠ খাল-বিল দেইখ্যা বড় হইছি৷ এইহানে আমাগো বাপ পিতামো চোইদ্দ পুরুষের ভিটা! এই দ্যাশের ভাষায় কথা কই! রক্তে রক্তে পদ্মা বয়! তবু মানষে কয়—এই দ্যাশ আর আমাগো নাই! এই ভিটা ছাইড়া যাইতে কয়৷ যে দ্যাশডারে জনমে চক্ষেও দেখি হেইডা নাকি আমাগো দ্যাশ!’
চোখ ফেটে টপটপ করে জল পড়েছিল দাদাভাইয়ের৷ বুকের ভিতরের হাহাকার যেন গলা চুঁইয়ে পড়ল, ‘আর কী করলে এই দ্যাশডা আমাগো হইব কইতে পারো ভাইজান?’
ইসমাইলের গলাও ব্যথায় বুঁজে এসেছিল৷ তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন৷
—‘দাদাভাই, একটু সজাগ থাইক্যো৷ তোমাগো বড় ঘর৷ দাঙ্গা হইলে বিপাকে পড়বা৷ উয়ারা লুঠতরাজ করতে আছে৷ তোমাগো ছাড়ব না৷’
—‘কারা ছাড়ব না?’
—‘মোছলমানেরা৷’
কান্নাভেজা রাঙা চোখ দুটো তুলে বলেছিল দাদাভাই, ‘তয় ভাইজান, তুমিও তো মোছলমান!’
ইসমাইল স্তম্ভিত হয়ে যান৷ কী বলবেন বুঝতে পারেননি৷ তাঁর চোখের পাতাও ভিজে গিয়েছিল৷ ধরা গলায় শুধু বললেন, ‘হ, হক কথা কইছ বটে৷’
তারপর আস্তে আস্তে চলে গিয়েছিলেন৷ তার আদরের দাদাভাই তার গমনপথের দিকে তাকিয়ে থাকে৷ সে দেখেছিল অমন টানটান লম্বা চেহারার মানুষটা যেন শুধু একটা কথার ভারেই কুঁজো হয়ে গিয়েছে!
এরপর ভীষণ আতঙ্কে কেটে যায় কয়েকটা দিন৷ চতুর্দিকে কেমন যেন থমথমে পরিবেশ৷ বেতারে একের পর এক দুঃসংবাদ! সে খবর শুনে বজ্রাহত গাছের মতো ‘থ’ হয়ে যেত দাদাভাই৷ মনের ভিতরে আঁচড়ে বেড়াত একটা ভয়৷ তার ঘরে বৃদ্ধা মা, যুবতী বৌ আর সদ্যোজাত শিশু৷ কী হবে এদের?
অবশেষে সে রাতটাও এল! কোনওদিন সেই রাতটার কথা ভুলতে পারবে না সে!
তখন ঘড়িঘরে ঢংঢং করে বারোটার ঘণ্টা বাজছে৷ এক একটা ঘণ্টার সাথে হৃৎপিণ্ড যেন নেচে নেচে উঠছিল৷ এই ঘড়িঘরে রোজই ঘণ্টা পড়ে৷ কিন্তু কোনওদিন সে আওয়াজ এত ভয়ংকর মনে হয়নি! সেদিন মনে হচ্ছিল, ঘণ্টাগুলো যেন আসন্ন প্রলয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে!
ঘড়িঘরে বারোটার ঘণ্টা পড়া শেষ হওয়ামাত্রই আকাশ ফাটানো চিৎকার ঘুমন্ত শহরের হাড়-পাঁজর কাঁপিয়ে দিল৷ চতুর্দিকে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে হতে ফিরল গায়ের রক্ত হিম করা রব—
—‘আ-ল্লা হো-ও-ও-ও আ-ক-ব-র!’
মুহূর্তের মধ্যে তার মনে হল বোধহয় সে আর বেঁচে নেই! দেহটা বড় ভার লাগে৷ পা দুটো যেন লোহার বেড়ি দিয়ে কেউ বেঁধে দিয়েছে! কী করবে, কোথায় যাবে কিছুই যেন ভাবতে পারছে না! শুধু কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো জানলা দিয়ে দেখল অনতিদূরের হিন্দুবাড়িগুলোয় জ্বলে উঠেছে আগুন! লেলিহান শিখা ধূমায়িত হয়ে লকলক করে উঠছে! তরোয়ালের ঝনঝন শব্দ, নারী-পুরুষের আর্তচিৎকার আর উন্মত্ত হুঙ্কারে ভরে উঠল আকাশ-বাতাস৷ মৃত্যুভয়ে সবাই ছুটে বেড়াচ্ছে দিগ্বিদিকে! পিছনে উদ্যত রামদা নিয়ে দুর্বৃত্ত!
সেই আওয়াজে পাশের ঘর থেকে ছুটে এসেছেন মা৷ স্ত্রী সচকিত হয়ে উঠে বসেছে৷ কোলের ছেলেটা জেগে উঠে তীক্ষ্ণ গলায় কান্না জুড়ল৷
মা আর স্ত্রীয়ের ভয়ার্ত দৃষ্টির উত্তরে সে নিষ্প্রাণ ও হতবুদ্ধি স্বরে বলে; ‘দাঙ্গা লাগছে৷’
কথাটা শেষ হতে না হতেই পিছনের দরজায় প্রবল করাঘাত! উগ্র, দ্রুত হাতে কেউ কড়া নাড়ছে—
—‘ঠক…ঠক…ঠক…’
—‘কে?’
ভীত, চাপা গলায় মা বললেন, ‘কে কড়া নাড়ে?’
সে ঠোঁটে আঙুল রেখে আওয়াজ করতে বারণ করে৷ দরজার শব্দের সাথে যেন বুকের ভিতরে কেউ হাতুড়ি পিটছে৷ আস্তে আস্তে দরজার সামনে গিয়ে কান পেতে বোঝার চেষ্টা করল ওপ্রান্তে ঠিক কী অপেক্ষা করছে!
ওপ্রান্ত থেকে কিন্তু কোনও হুঙ্কার ভেসে এল না৷ এল না কোনও তীব্র গর্জন৷ শুধু একটা পরিচিত স্বর ফিসফিস করে বলল :
—‘দাদাভাই…জলদি দোর খুলো…আমি আইছি…আমি…তোমার ভাইজান৷’
দাদাভাই নিমেষের মধ্যে দরজা খুল দিয়েছে৷ বিদ্যুৎগতিতে ঘরে ঢুকে পড়ে ইসমাইল উত্তেজিত স্বরে বললেন, ‘কথা কওনের সময় নাই৷ হাতের কাছে যা পাও সবডি লইয়া আমাগো ঘর চলো৷ দাঙ্গা লাগছে৷ অ’রা আওনের আগে পিছের দোর দিয়া পলাইতে হইব৷ জলদি করো৷’
তখন ভাবার সময় সত্যিই ছিল না৷ একবস্ত্রে, হাতের কাছে যেটুকু নামমাত্র টাকাপয়সা, সোনাদানা পেল সেটুকু নিয়েই তারা উঠে এল ইসমাইলের বাড়ি৷ পিছনের দরজা দিয়ে পালাতে পালাতেই শুনল সামনের দরজা ভাঙার শব্দ! তার সাথে সাথেই তীব্র উন্মত্ত চিৎকার—
—‘আ-ল্লা হো-ও-ও-ও আ-ক-ব-র!’
দুর্বৃত্তরা ঘরে ঢুকে কাউকে পেল না৷ নিষ্ফল আক্রোশে তারা বাড়ি ভাঙচুর করল৷ জিনিসপত্র যা লুটে নেওয়ার, তা নিয়ে শেষে গোটা বাড়িতেই আগুন ধরিয়ে দিল৷
ইসমাইলের বাড়ির জানলা দিয়ে তিনটে মানুষ সজল চোখে দেখল তাদের এতদিনের তিলতিল করে গড়ে তোলা স্বপ্ন, সাধ, আকাঙ্ক্ষা; সব পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে! আর সেই মর্মান্তিক ধ্বংসলীলা প্রত্যক্ষ করতে করতে উল্লাসে চিৎকার করছে কতগুলো নির্বোধ জানোয়ার!
মা এই দৃশ্য দেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিলেন৷ তাঁর সাধের ফলন্ত সংসার এভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে দেখে কান্না চাপতে পারেননি৷
—‘কাইন্দো না মা৷’ ইসমাইল সান্ত্বনা দেন, ‘মানষের পরানডা আগে৷ পরানে বাঁচলে আবার সবকিছু হইব৷ কাইন্দো না৷’
—‘ইছমাইল৷’ কান্নাজড়ানো গলায় মা বলেন, ‘অগো কী ক্ষতি করছি আমরা…?’
ইসমাইল তার উত্তর দেন না৷ চুপ করে নির্বাক মূর্তির মতো দাঁড়িয়েছিলেন৷
—‘ভাইজান…অ’রা আবার তোমাগো ঘরে হামলা করব না তো?’ প্রচণ্ড আতঙ্কে বলেছিল দাদাভাই, ‘আমাগো লাইগ্যা তুমি এত বড় ঝুঁকি নিবা?’
—‘হ, নিমু৷’ ইসমাইল শান্তস্বরে বলেন, ‘তুমি হক কথা কইছিলা দাদাভাই৷ আমি মোছলমান৷ আমার ধম্ম আমারে মারতে শিখায় নাই! মানষেরে ভালোবাসতে, বাঁচাইতে শিখাইছে৷ যারা মানষ হইয়া মানষেরে মারে; তারা পাপী৷ পাপীর কুনো জাত হয় না…ধম্ম হয় না৷’
তিনি একটু থেমে ফের দৃঢ়স্বরে বললেন, ‘আমি আমার ধম্ম পালন করুম৷ যতক্ষণ আমার দ্যাহে জান আছে কেও তোমাগো কিস্যু করতে পারব না—আল্লার নামে এই কসম খাইলাম৷’
কসম রেখেছিলেন ইসমাইল৷ দুষ্কৃতীরা কী করে যেন জানতে পেরেছিল যে তাঁর বাড়িতেই লুকিয়ে রয়েছে একঘর হিন্দু৷ সহজে ছাড়তে চায়নি৷ কিন্তু ইসমাইল প্রভাবশালী লোক ছিলেন বলে হামলা করতেও সাহস করেনি৷ শুধু একরাতে কয়েকজন মুখোশধারী এসে বলেছিল, ‘মিঞা, তোমার লগে আমাগো কুনো দুশমনি নাই৷ কিন্তু মোছলমান হইয়া ঘরে হিঁদু লুকায়ে রাখছো৷ অগো বাইর কইরা দাও৷ নয় তোমারেও ছাড়ুম না৷’
—‘হা-লা, শুয়ারের বাচ্চা, হা-রাম-খো-র!’ একহাতে রামদা আরেক হাতে ল্যাজা নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন ইসমাইল৷ দু-চোখে ধকধক করে জ্বলে উঠেছিল আগুন :
—‘কারোর ঘর পোড়ে; কেউ খই খাও! মজা পাইছো! হিম্মত থাকলে হালা, আগায়ে আয়৷ আইয়া দ্যাখ—এই ল্যাজা আর রামদা দিয়া তগো না কাটছি, তয় আমারও নাম ইছমাইল না!’
ইসমাইলের রুদ্রমূর্তির সামনে আর দাঁড়াতে সাহস পায়নি তারা৷ তখনকার মতো চলে গিয়েছিল৷ তবে হুমকি দিয়ে গিয়েছিল যে দলবল নিয়ে আবার আসবে৷
তিনি সে হুমকিকে পাত্তাও দেননি৷ রাতের বেলা তিনি আর রেশমাবিবি পালা করে বাইরের ঘরে রামদা আর ল্যাজা নিয়ে পাহারা দিতেন৷ আর ভিতরের ঘরে ভয়ে কাঁটা হয়ে দিন কাটাত তিনটে মানুষ৷ বাচ্চাটা যখন-তখন কেঁদে উঠত বলে তার মুখে কাপড় গুঁজে রাখত তার মা৷
এমনভাবেই কেটে গেল কয়েকদিন৷ ততক্ষণে ওরা তিনজনেই বুঝতে পেরেছে যে এ দেশ ছেড়ে না গেলে আর রক্ষা নেই৷ দুষ্কৃতীদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে হাজার হাজার মানুষ৷ বাকিরা দলে দলে দেশ ছেড়েছে৷
ভাবলেই মনের ভিতরটা অবশ হয়ে আসে! আজন্ম পরিচিত এই মাটি ছেড়ে কোথায় যাবে? তাদের সমস্ত অস্তিত্ব তো এই মাটিতেই মিশে আছে!
তবু মা একদিন ইসমাইলকে বললেন :
—‘তর ঘাড়ে বইস্যা আর কত খামু ইছমাইল? তর বোঝা হইয়া থাকতে ভালা লাগে না৷’
তিনি বিস্মিত, ব্যথিত হলেন, ‘এইডা তুমি কইতে পারলা মা? তোমাগো ঘরে কত খাইছি, পরছি, মাখছি৷ দুখের দিনে সব ভুইলা যামু? আমারে কি তুমি নিমকহারাম ভাবলা!’
মায়ের চোখে জল এল৷ এত দুঃখের দিনে এমন আন্তরিকতা পেলে সবারই কান্না পায়৷ তবু পরিস্থিতি মানুষকে শক্ত হতে শেখায়৷ মা কান্না চেপে বলেন, ‘হেই কথা কই নাই৷ তুই আমার পোলারও বাড়া৷ আরেকখান কাম কইরা দে বাপ৷’
—‘হুকুম করো মা৷’
—‘আমাগো ও দ্যাশে যাওনের বন্দোবস্ত কর৷’ মা কেঁদে ফেললেন, ‘এ দ্যাশ এহন শত্তুর হইছে৷ এইহানে আর মন টিঁকে না৷’
ইসমাইলও বুঝতে পারছিলেন যে এভাবে বেশিদিন চলতে পারে না৷ রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেদিকে মোড় নিচ্ছে তাতে এ দেশ আর নিরাপদ নয়৷
তবু মন মানে না! যুক্তি-বুদ্ধির উপরও টেক্কা দেয় হৃদয়৷ ইদের দিনে আর কেউ হাসিমুখে নেমন্তন্ন খেতে আসবে না, পুজো-পার্বণে কেউ সহাস্যে পিঠে-পুলি বা ভাত-মাছ বেড়ে দেবে না—ভাবলেই বুকটা হু হু করে৷
কিন্তু কষ্টটা বুকে চেপেই বললেন, ‘জবান দিলাম মা৷ তাই হইব৷’
বলেই আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছিলেন৷ পিছন থেকে মা ডাকেন, ‘শোন৷’
ইসমাইল থমকে দাঁড়ালেন৷
—‘এইহানে আয়…আমার কাছে বয়…’
তিনি বাধ্য ছেলের মতো মায়ের সামনে বসে পড়লেন৷ মা তাঁর মুখ দু-হাতে স্পর্শ করেছেন৷ একদৃষ্টে সেই প্রশান্ত শ্মশ্রুগুম্ফ আচ্ছাদিত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তাঁর চোখ জলে ভরে এসেছে৷ প্রচণ্ড উচ্ছ্বসিত কান্নাকে চাপতে চাপতে দু-হাতে তাঁর মুখ ধরে বললেন, ‘এ জনমে আমার একখানই দুস্ক রইল ইছমাইল…৷ তোরে ক্যান আমি প্যাডে ধরি নাই বাপ……!’
ইসমাইল চোখ নীচু করলেন! সম্ভবত চোখের জল গোপন করাই মুখ্য উদ্দেশ্য!
পরের দিন রাতের বেলায় মাছের ঢাকা গাড়িতে আঁশটে গন্ধ মাখা চুপড়ির সাথে রওনা হল তিনটে মানুষ আর একটি শিশু৷ গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেলেন স্বয়ং ইসমাইল৷ পথে যদি কোনও বিপদ আসে সেজন্য হাতের কাছে অস্ত্রও রেখেছিলেন৷ কিন্তু সম্ভবত গাড়িটা ইসমাইল মিঞার বলেই কোনওরকম বিঘ্ন এসে উপস্থিত হল না৷ রাতের অন্ধকার মেখেই গাড়ি ছুটে চলল ভারত-পূর্বপাকিস্তান সীমান্তের দিকে৷
তিনটে ছিন্নমূল প্রাণ সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে এসে জুটল পশ্চিমবঙ্গে৷ এখানে প্রাণের ভয় নেই৷
তার সাথে নেই সেই মাটির গন্ধ, পদ্মার সেই ছুটে চলা, সেই দিগন্তব্যাপী ধানের খেত, নেই করিমচাচা, সিরাজ, ইসমাইল ভাইজানরাও৷
আর নেই সেই নাড়ির টান!
……আচ্ছন্ন দৃষ্টি বারবার তবু কী যেন খুঁজে বেড়ায়…!
কবেই তো সব শেষ হয়ে গেছে; তবু কী যেন অমোঘ টানে বারবার টেনে ধরে! পদ্মাপাড়ের হাওয়া আজ আর ত্রিসীমানায় নেই; তবু কোথাও যেন আজও হু হু করে বয়ে বেড়ায়! কবেই তো অতীত হয়ে গেছে, তবু কেন সেই দিগন্তবিস্তৃত মাঠ বারবার ফিরে আসে স্মৃতিতে……!
মৃত্যুপথযাত্রী মানুষটা অনুভব করে অদ্ভুত একটা দুলুনি৷ এমন দুলুনি পদ্মা নদীর বুকে ভেসে চলা নৌকোগুলোয় চড়লে টের পাওয়া যেত৷ বড় সস্নেহে পদ্মা যেন কোলে তুলে দোলাচ্ছে!
নিঃশ্বাস নিতে বড় কষ্ট…আঃ…
…তখনও আদিগন্ত মাঠ রোদে ঝলমল করছে! ঘাসের বুকে ফোঁটা ফোঁটা তাজা স্বচ্ছ শিশির৷ ঝিলের বুকের সাদা শালুকের দল শিশিরে স্নান করেছে৷ কাশবন ঢেউয়ে ঢেউয়ে হাত নেড়ে ইশারায় বলে, ‘আয়…আয়…’
……সেই মাঠের ওপ্রান্তে করিমচাচার বাড়ি৷ করিমচাচা খুব মন দিয়ে সবজীবাগানটা দেখছিলেন৷ তাকে দেখতে পেয়েই সোৎসাহে বললেন, ‘আইছো মনু?…আয়ো…আয়ো…’
লোকটা আপনমনেই ঘোরের মধ্যে বিড়বিড় করে বলে, ‘এই আসতাছি…’
—‘কী বলছ?…কী বলছ বাবা?’
সে চুপ করে গেল…
…তখনও চোখের সামনে সেই বিরাট মাঠ…সিরাজ পড়ি কি মরি করে দৌড়চ্ছে কাটা ঘুড়ির পিছন পিছন৷ খিলখিল করে হাসছে৷ আর চিৎকার করে বলছে :
—‘মিতা-আ-আ-আ…আমি নৌকা চালাইতে শিখছি৷ তুমি সনে ভেঁপু বাজাবা না? আইসো…শিগগির আইসো মিতা…’
লোকটা ফের বলে, ‘এই যাই……’
আশেপাশের মুখগুলো অবাক হয়ে এ ওর দিকে তাকায়৷ বিড়বিড় করে কি বলছে মানুষটা? এ কি বিকার!
—‘বাবা…কী বলছ?’
…ইদের দিন সকালে ইসমাইল ভাইজান একখানা পেল্লায় থলে নিয়ে এসে হাজির৷ হাসিমুখে চেঁচিয়ে বলছে, ‘আমারে ছাইড়া যাইবা কই দাদাভাই? এই ইদের নিওতা দিলাম৷ আইবা না?’
সে আপন মনেই জবাব দেয়, ‘আসুম৷’
—‘বাবা…বাবা…!’
কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন তার হুঁশ ফেরে৷ প্রচণ্ড শব্দ করে শ্বাস টানতে টানতে বড় বড় চোখে এদিক-ওদিক তাকায়৷
—‘কিছু বলছ?’
জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলার সাথে উঠে এল ভীষণ কাশি৷ একদলা কফ মুখের কষ বেয়ে পড়ছে৷ সেই অবস্থাতেই ঘড়ঘড় শব্দে উত্তর এল…
—‘আমারে ডাকে…’
—‘কে ডাকে? কে ডাকে বাবা?’
উদ্বিগ্ন মুখগুলো তার মুখের সামনে ঝুঁকে পড়েছে৷ সে দেখতেও পেল না৷ দুলুনি যেন ক্রমশ বাড়ছে৷ পদ্মা তাকে ঘুম পাড়াচ্ছে৷ চোখের পাতায় নেমে আসছে ঘুম৷ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে সবুজ মাঠ, সোনালি ধানখেত, রুপোলি রোদ্দুর……
নিশ্ছিদ্র কালো সন্ধ্যা তার দু-চোখে ডানা মেলে দিল৷ বুকের উপর দশমণি পাথর চাপানো! হাঁ করে নিঃশ্বাস টানার শেষ যুদ্ধ করতে করতে শেষ প্রশ্নের উত্তরটা দিয়ে গেল সে…
—‘বাবা? কে ডাকে তোমায়?’
ক্ষীণ, অস্পষ্ট, প্রায় মিলিয়ে যাওয়া স্বরে সে ফিসফিস করে বলল—
—‘আ-মা-র…দ্যা-শ…!’
—