কাঠিবাবু

কাঠিবাবু

লোকটার নাম বটকৃষ্ণ৷ অপভ্রংশে বটকেষ্ট৷

বয়স ত্রিশ থেকে তেতাল্লিশ পর্যন্ত যে কোনও সংখ্যা হতে পারে৷ দৈর্ঘ্যে পাঁচ ফুট দু-ইঞ্চি৷ ওজন চল্লিশ কেজি! উস্কোখুস্কো চুল, আমের আঁটির মতো মুখে তেল মজুত রাখার উপযুক্ত দুটি গাল, কাদা ঘোলা চোখ এবং খিটখিটে মেজাজের মালিক!

নিন্দুকেরা বলে বটকেষ্টর মুখ দেখলে নাকি একটানা সাতদিন ডিসেকশন টেবিলে কাটানোর এফেক্ট হয়৷ সত্যি সত্যিই তাই হয় কি না জানা নেই, তবে নিন্দুকদের কথা গায়ে না মাখাই ভালো৷ বটকেষ্ট মাখেও না৷

বারাসতের একটু অভ্যন্তরে একখানা কচুরিপানাযুক্ত ও মশাচ্ছন্ন পুকুরের পাশে ছোট্ট শ্যাওলাধরা ইট-পাঁজর সর্বস্ব বাড়িতে দুটি টিয়া, একটি ঘুঘু, একরাশ ছুঁচো ও ইঁদুর; আর একটি রুগণ বৌ নিয়ে তার উলোঝুলো সংসার৷ রোজ সকালে ‘অ্যাঁ…অ্যাঁ’ করে একরাশ বমির সাথে নৈঃশব্দ্যকে উত্তেজিত করতে করতে দিনের শুরু৷ আর রাতে ঝাল ঝাল শুয়োর বা মুরগির পরিত্যক্ত অবশিষ্টাংশের সাথে সস্তার বাংলা মদে দিনের শেষ৷

এই জাতীয় শুরু ও সারার মাঝখানের সময়টা কাটে মেইন রোডের উপর তার নিজস্ব ছোট্ট ঘুপচি পানের দোকানে বসে৷

বটকেষ্ট প্লেটো বা অ্যারিস্টটলের নাম কস্মিনকালেও শোনেনি৷ পানের দোকানে বসে সে সারাদিনে যতটুকু নিজস্ব দার্শনিক তত্ত্ব আবিষ্কার করে সেটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট৷ তার মৌলিকতা সম্পর্কে কোনও আগ্রহ নেই৷ থাকলে জানতে পারত যে, মাস্কারাময়ীর আস্কারায় জেগে ওঠা মনের গভীর আকুতি শুধু তার একার নয়; ব্যর্থতার এই জ্বালায় কমবেশি সকলেই জ্বলেছেন৷ পানের দোকানি, নিরীহ কেরানি থেকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, এমনকি দান্তে, শেলি, বায়রন পর্যন্ত কেউ বাদ যাননি৷

অতঃপর সারাদিন দোকানে কাটিয়ে এসে রাত্রে একথালা পান্তাভাত আর ঝাল ঝাল মাংস সপাসপ মেরে দেওয়া৷ সাথে দেশি মদের অনুষঙ্গ! এবং স্বাভাবিক নিয়মেই চিররুগ্ন স্ত্রীর সাথে অস্বাভাবিক নড়বড়ে সঙ্গম৷ বাকি রাতটা কাটে গেঁয়ো পাঁচীর বিছানায় শুয়ে পরির স্বপ্ন দেখে!

জীবন বলতে এইটুকুই! প্রাত্যহিক একঘেয়ে কাজগুলো নিয়ে নাড়াঘাঁটা করা৷ আলুথালু ফাটাফুটি দিনগুলোকে সেলাই করে যাওয়া৷ অবশেষে ক্লান্ত হয়ে পড়া,—আর আবার পরের দিন সেই একই কাজের পুনরাবৃত্তি!

স্বাভাবিকভাবেই মনে খুব সঙ্গত একটা প্রশ্ন জাগে৷ লোকটা বাঁচে কী নিয়ে? এ হেন নিস্তরঙ্গ একটানা বিনোদনহীন জীবন; আর যাই হোক, মানুষকে সুস্থ রাখতে পারে না৷ যাঁরা এই ধরনের জীবন যাপন করেন তাঁরা তাস-পাশা খেলে, জুয়া-সাট্টার আড্ডায় গিয়ে অথবা রেড লাইট এরিয়ার ঊর্বশীদের কাছ থেকে প্রেম কিনে কোনওমতে দিন গুজরান করেন৷ ওইটুকুই তাদের রসদ!

অথচ বটকেষ্ট এর কোনওটাই করে না! তাস-জুয়ার নেশা তার নেই! মদ খেলেও, মেয়েমানুষের দোষ আছে একথা বটকেষ্ট সম্পর্কে কেউ বলবে না! আজ পর্যন্ত নিষিদ্ধ পাড়ায় তার ছায়াও পড়েনি; যদিও ও পাড়ায় যাতায়াত থাকার বেশ যুৎসই কারণ ছিল!

এই কার্য-কারণের মাঝখানের ফাঁকটাই লোকটার সম্পর্কে কৌতূহল জাগিয়ে তোলে৷ জুয়া খেলা বা লাম্পট্য; কোনওটাই খুব গুণের কথা নয়৷ কিন্তু তার মতো মানুষের ক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিক চরিত্রগত ত্রুটি৷ ওই ত্রুটিটুকু না থাকার জন্যই হয়তো লোকটাকে বড় বেশি অস্বাভাবিক লাগে৷ মনে হয় কোনওরকম বিনোদন ছাড়া মানুষটা বেঁচে আছে কী করে………?

সেদিন সকালে খোশমেজাজে দোকান খুলে বসেছিল বটকেষ্ট৷

এখন অফিসটাইম৷ বাবুরা ভাত খেয়ে পান চিবুতে চিবুতে আপিস যাবেন৷ তাই সকালের দিকটায় বিক্রিবাটা বেশি হয়৷ ব্যস্ততাও তদনুরূপ৷ কারও মিঠাপাতিতে চুন, সুপুরি, খয়ের৷ কারুর মৌরী, মশলা, চমন বাহার, কেউ বা আবার সাদাপানে জর্দা! তার সাথে চ্যান্সেলর, নেভিকাটের ফরমায়েশ তো আছেই৷ বটকেষ্টকেই সব মনে রাখতে হয়৷ ধরাবাঁধা খদ্দেরকে বাঁধাধরা অর্ডার সাপ্লাই দিতে দিতে আবার টুকটাক রসালাপও চলে :

—‘কেমন আছেন দাদা? আজ যে এত সকাল সকাল?’

দাদার উত্তর দেবার অবসর নেই৷ কোনওমতে খুচরো আড়াই টাকা বের করে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘স্পেশ্যাল ডিউটি৷’

—‘ইস্পেশাল ডিউটির জন্য ইস্পেশাল পান বুঝি? হেঁ হেঁ হেঁ…৷’

দাদাটি তার ছোট্ট রসিকতায় হাসার সময় পেলেন না দেখে সে নিজেই একচোট দেঁতো হাসি হেসে নিল৷ পরমুহূর্তে খরিদ্দারটি পিছন ফিরে চলে যাওয়া মাত্রই হাসি থামিয়ে ভেংচি কেটে বলল, ‘ইস্পেশাল ডিউটি! সা-ল্লা-হহ৷’

তার প্রায় মৃতবৎ নিষ্প্রভ চোখ চিতার আগুন নিয়ে ধক ধক করে জ্বলে ওঠে! সবাইকে সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাঁক করে দিতে চায়!!!

আস্তে আস্তে বেলা গড়িয়ে আসে৷ খদ্দেরদের ভিড়ও ক্রমশ পাতলা হচ্ছে৷ কাছাকাছি বাড়ির গুটিকতক বৌদি তার নিয়মিত ক্রেতা৷ ভাতঘুম দেওয়ার আগে একটা মিষ্টি পান তাদের বরাদ্দ৷ কিছুক্ষণের জন্য একটা মেয়েলি সুখী সুখী গন্ধ ভেসে বেড়ায় ছোট্ট দোকানে৷ তারপরেই ফেটে যায় আবেশের বুদবুদগুলো! মেইন রোডের শ্লথ ট্র্যাফিকের পাশে ক্ষুদ্রতম ছায়া নিয়ে এসে দাঁড়ায় খাঁ খাঁ নির্জন দুপুর!

বটকেষ্ট তার স্বল্প পরিসর দোকানে হাত-পা গুটিয়ে প্রায় গোল হয়ে বসে ঝিমোচ্ছিল৷ সবে তন্দ্রার ঝিমঝিমে মৌতাত অল্প অল্প ছড়িয়ে পড়ছে, এমন সময় ‘ক্যাঁ—চ’ করে একটা গাড়ি ব্রেক কষে এসে দাঁড়াল তার সামনে৷

তন্দ্রাটা কেটে যেতেই ধড়মড় করে উঠে বসে বটকেষ্ট৷ ততক্ষণে গাড়ির পিছনের দরজা খুলে জুতো মসমসিয়ে নেমে এসেছেন এক সুসজ্জিত ভদ্রলোক৷

—‘ইন্ডিয়া কিং আছে?’

সে বোকার মতো মাথা নাড়ে৷ এই নামটা তার কাছে পরিচিত নয়৷ ভদ্রলোক বিরক্ত হলেন মনে হয়৷ মুখে সামান্য কুঞ্চন ছাপ ফেলেই মিলিয়ে গেছে৷

—‘শুনছ?’ গাড়ির জানলায় এবার একটা মুখ ভেসে উঠেছে৷ মুখ না বলে বেলুন বললেই বোধহয় ভালো হয়৷ পিটপিটে চোখ, ডাবল ডেকারে চাপা দেওয়া নাক, গ্রীবার লেশমাত্র নেই৷ সারা গায়ে একরাশ সোনালি আলো ঝমর ঝমর করে বলল, ‘ওকে জিজ্ঞাসা করো না! লোক্যাল লোক৷ বলতে পারবে৷’

ভদ্রলোক ঘাড় ঘুরিয়ে গাড়ির দিকে তাকালেন৷ তারপর এদিকে ফিরে গলা সাফ করে নিয়ে বললেন, ‘রজনীবাবু,…মানে রজনী সান্যালের বাড়িটা কোন দিকে বলতে পারো?’

বটকেষ্ট প্রথমে প্রশ্নটা খেয়াল করেনি৷ সে অবাক হয়ে মহিলাকেই দেখছিল৷ এই ভর দুপুরে জগদ্দল চেহারার মহিলা এমন ভয়ানক সেজেছেন কেন? এ পাড়ায় কোথাও কোনও বিয়ে আছে বলেও তো মনে পড়ছে না!

—‘এক্সকিউজ মি…রজনী সান্যালের বাড়ি…’

রজনী সান্যাল এ পাড়ার নামজাদা রইস!

—‘সান্যালবাবুর বাড়ি?’ সে এঁড়ে গলায় বলল, ‘এই তো সোজা গিয়ে ডানদিকের গলির দুটো বাড়ির পরের তিনতলা বাড়িটা!’

—‘থ্যাঙ্কস৷’

ভদ্রলোক আর কথা না বাড়িয়ে চলে যাচ্ছেন দেখে বটকেষ্ট পেছন থেকে ডাকে, ‘ও সার, শুনুন…’

তিনি অবাক হয়ে ফিরে দাঁড়ান, ‘ইয়েস!’

—‘না…মানে আপনি সান্যালবাবুর কে হন?’

নিতান্তই নিরীহ কৌতূহল৷ উত্তরে গাড়ির ভিতর থেকে ভেসে এল অ্যালসেশিয়ান গর্জন৷ যেন বলতে চায়, ‘কে হে তুমি! আমার মনিব কার কে হন তাতে তোমার কী?’

সে ঢোঁক গেলে৷ আড়চোখে গাড়ির জানলায় তাকায়৷ কুকুরটা বাঁধা আছে তো?

—‘না…আসলে আপনাকে অনেকটা ওঁর মতোই দেখতে কি না…তাই জানতে চাচ্ছিলাম…৷’

কথাটা বলেই বুঝতে পারল কী ভুল করেছে!

সান্যালমশাই অত্যন্ত কুৎসিত দর্শন! তাঁর মতো দেখতে মানে…

ভদ্রলোক কিন্তু বেশ ভালো মানুষ৷ রাগলেন না৷ অর্থাৎ পয়সাওয়ালা মাত্রেই খেঁকুটে নয়৷ বরং হেসে বললেন, ‘আমি ওঁর কেউ নই৷ তবে হতে যাচ্ছি৷ ওঁর ছেলের সাথে আমার মেয়ের…’

বটকেষ্টর মাথা একধাক্কাতেই পরিষ্কার৷ সে অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে পান সাজতে সাজতে বলে, ‘অ!!! ও-না-র ছে-লে! তা ভা-লো!’

ভদ্রলোক তার মুখভঙ্গি দেখে চলে যেতে গিয়েও পারলেন না৷ পানের দোকানি মিটমিট করে তাঁর দিকেই তাকাচ্ছে৷ মুখ দেখলেই মনে হয়, ওর ভিতরে কোনও রহস্য আছে৷ অথবা গোপনীয় কোনও কথা!

এমন কিছু, যা সে বলি বলি করেও বলছে না৷

—‘তুমি ওঁর ছেলেকে চেনো?’

বটকেষ্ট সুপুরির কুঁচির মতোই মিহি দৃষ্টিতে তাকিয়েছে, ‘চিনব না স্যা-র!!! কে না চে-নে!’

এমন কথা থেকে বুদ্ধিমান লোক মাত্রেই বুঝতে পারে যে চেনার খবরটা খুব স্বস্তিজনক নয়৷ ভদ্রলোক তখনও সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন দেখে সে বাকিটা পূরণ করে দেয়৷

—‘ও ছেলেটার আগের বৌটা তো কম হাঙ্গামা করেনি! পাড়াময় ঢি ঢি পড়ে গিয়েছিল৷’

বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো মোক্ষম কথাগুলো এসে ধড়াম করে ঘাড়ে পড়ল! তিনি চমকে উঠলেন; এমন একটা প্রসঙ্গ এসে পড়বে তা কল্পনাও করেননি৷ বিস্মিত, ব্যথিত স্বরে বললেন, ‘না…না…ভুল হচ্ছে কোথাও…! ওঁর ছেলে তো অবিবাহিত!!!’

—‘ওরা তাই বলে৷ মেয়েটাকে বৌ বলে স্বীকার করতে চায়নি৷’ বটকেষ্ট এদিক-ওদিক সন্তর্পণে তাকায়৷ গলার স্বর যথাসম্ভব নীচু করে বলে, ‘আপনি ভালো মানুষ মনে হয় সার৷ কাউকে বলবেন না যেন…৷’

মানুষটি কোনওমতে মাথা নেড়ে জানালেন, বলবেন না৷

—‘মেয়েটা ভরা পোয়াতি ছিল! ওই গুণধর ছেলের কীর্তি৷—পেম! পেম! বুঝলেন কি না? কালীঘাটে গিয়ে নাকি সিঁদুরও পরিয়েছিল! কিন্তু তারপর আর স্বীকারই করল না৷ মেয়েটা খেপে গিয়ে মহা হাঙ্গামা করেছিল৷ পাড়ার ছেলেদের নিয়ে একদিন সান্যালবাবুর বাড়িতে গিয়ে হাজির! অনেক গলাবাজি করে হুমকি দিয়ে এল, বৌ বলে ঘরে না তুললে পুলিশে নালিশ করবে৷’

সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ‘মেয়েটার তেজ ছিল সার৷’

ভদ্রলোকের মুখ আস্তে আস্তে কঠিন হয়ে উঠছিল৷ রুদ্ধশ্বাসে কাহিনি শুনছেন…

—‘তারপর?’

—‘তারপর আর কী?’ বটকেষ্টর চোখ গোল গোল হয়ে গেছে, ‘দু-দিন পরে মেয়েটার লাশ মিলল ইস্টিশনে৷ ট্রেনে কাটা পড়ে মরেছে! এখন নিজেই মরেছে না কেউ মেরেছে তা ভগবান জানে৷ তবে সেই ঘটনার পর পাড়াসুদ্ধু লোক ছেলেটাকে চেনে! সবাই জানেও৷’

শ্রোতাটি তবু দ্বিধাজড়িত স্বরে বলেন, ‘সবাই জানে! কিন্তু একথা তো কেউ আমাদের বলেনি! আমরাও তো খোঁজখবর নিয়েছি……!’

—‘কে বলবে সার?’ সে বঙ্কিম হাসল, ‘আপনি বাঁচলে পরের নাম৷ পেয়ারের জানটা কেউ সেধে হারাতে চায়?’

সান্যালবাবুর ভাবী সম্বন্ধীর মনের অবস্থা বলার অপেক্ষা রাখে না৷ কথাবার্তা শেষ করে যখন গাড়িতে উঠে বসলেন, তখন তাঁর মুখ গম্ভীর৷ চোয়াল শক্ত!

স্ত্রী তাঁর কাঁধে হাত রেখেছেন, ‘একটা পানওয়ালার কথায় এত গুরুত্ব দিচ্ছো কেন? ওরা সবসময়ই বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলে৷’

তিনি সরাসরি জবাব দিলেন না৷ শুধু আলগোছে বললেন, ‘হুঃ৷’

বলাই বাহুল্য যে ছোট্ট শব্দটায় তেমন জোর পাওয়া গেলো না…!

খবরটা যেন রাতারাতি দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল৷

দুনিয়ার এটাই নিয়ম৷ এখানে গরিব লোককে প্রতিনিয়ত লাঞ্ছিত হতে হয়৷ তাই তার হেনস্থা খুব জোর খবর নয়৷ কিন্তু ধনী ব্যক্তি যদি দৈবাৎ বিপাকে পড়েন তাহলে সেটাই জনসাধারণের গরমাগরম আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে, এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি৷

বিনা ইন্ধনেই চিড়বিড় করে জ্বলছেন রজনীবাবু! ছেলের বিয়েটা বেশ বড়ঘরেই ঠিক করে ফেলেছিলেন৷ কেতাদুরস্ত আদব-কায়দা ও মোলায়েম অভিজাত ব্যবহারে মেয়েপক্ষ বেশ ভিজেছিল৷ শুধু পাকাকথা বাকি৷ বিয়েটা এখানে দিতে পারলে ঘরের লক্ষ্মীর সাথে বেশ মোটাসোটা লক্ষ্মীপ্রাপ্তিও হত৷ কিন্তু আকস্মিক ভাবেই গোটা ব্যাপারটা ভেস্তে গেল! কী করে এমন অবশ্যম্ভাবী সম্বন্ধটা ভেঙে গেল, তা এখনও তাঁর বোধ-শক্তির বাইরে!

তার উপর আবার দুশ্চরিত্র, লম্পট বদনাম! ভাবলেই শিরায় শিরায় লাভার স্রোত বয়ে যাচ্ছে! বহু চেষ্টাতেও তাকে শান্ত করা যাচ্ছে না! কী প্রচণ্ড অপমান! কী প্রচণ্ড……!!!!

একেই হাই ব্লাডপ্রেশারের রোগী, মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো আবার এই কাণ্ড! সকাল থেকে একের পর এক গ্লাস শেষ হচ্ছে! ঠোঁটের ফাঁকে ঝুলে থাকা সাবেকি পাইপটার প্রাণ থাকলে এতক্ষণে ‘ত্রাহি মধুসূদন’ বলে ডাক ছাড়ত৷ মেয়ের বাপকে হাতের কাছে পেলে বোধহয় এভাবেই মুখে ফেলে চিবোতে শুরু করতেন৷ কিন্তু উপস্থিত যখন তার সম্ভাবনা নেই তখন পাইপের উপর দিয়েই গায়ের ঝাল মেটাচ্ছেন!

পরপর তিনদিন গৃহবন্দি থাকার পর আর পারলেন না! উত্তপ্ত মস্তিষ্ক একটু শীতলতা চাইতে চাইতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে৷ তাই বেরিয়ে পড়তেই হল৷

নিজের ছোট্ট পানের দোকানে বসে বটকেষ্ট তখন অন্যান্য দিনের মতোই দুলে দুলে পান সাজতে ব্যস্ত! মন খুশি খুশি৷ মাঝেমধ্যে রেডিওটার সাথে তাল মিলিয়ে হুঁ হুঁ করে গানও গাইছে৷ হেঁড়ে গলায় বিশেষ সুর নেই৷ তবু বেসুরো গলার গান তার নিজেরই কানে মধুবর্ষণ করছে৷

হঠাৎ হেঁচকি উঠে গানে তালা পড়ে গেল৷ রজনীবাবু দ্রুত গতিতে এদিকেই আসছেন যে! কী সর্বনাশ! জানতে পেরেছেন নাকি! তার টাকরা থেকে ব্রহ্মতালু অবধি শুকিয়ে গেলো৷ রজনীবাবুর সুখ্যাতি এদিকে বিশেষ নেই৷ বরং দুর্নামই আছে৷ ক্ষমতাশালী লোক ইচ্ছে করলে সবই পারেন৷ এরপর হয়তো কোনওদিন বটকেষ্টর লাশটাই……!!!!

চোখদুটো জবাফুলের মতো লাল! মুখ থেকে ভক ভক করে মদের গন্ধ বেরোচ্ছে! মাথার চুল উস্কোখুস্কো! একী মূর্তি! সে ভয়ে সিঁটিয়ে গেছে! এখন তার হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছিল! কেন যে শখ করে কেউটের লেজে টান মারতে গিয়েছিল! এখন বুঝি ছোবল খেতে হয়৷ হয়তো এক্ষুনি লোকটা এসে তার গলা টিপে ধরে বলবে……

—‘তামাক দে৷’

রজনীবাবু একটা নোট বাড়িয়ে দিয়েছেন, ‘কড়া তামাক দিবি৷ ভেজাল হলে সব ফেরত দিয়ে যাব!’

ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ল৷ কথার ধরন শুনলে গা জ্বলে যায়৷ তবু হেঁ হেঁ করতে করতে তামাকের প্যাকেট এগিয়ে দিয়েছে সে৷

—‘কেমন আছেন সার? সব ভালো তো?’

আলগোছে একটা ‘হুঁ’ বলে রজনী চুপ করে গেলেন৷ তাঁর নীরবতা যে কোনও অংশেই ‘মহান নীরবতা’ নয় তা বুঝতে বাকি থাকে না৷

—‘শুনলাম আপনার ছেলের বিয়ে নাকি ঠিক?’

ভদ্রলোক লাল চোখ আরও লাল করে তাকিয়েছেন!

—‘খুব ভালো খবর সার…খুব ভালো খবর…পানের অডারটা কিন্তু আমার দোকান থেকেই নিতে হবে৷ আপনারা সজ্জন ব্যক্তি৷ কত শিক্ষেদীক্ষে! আপনাদের পায়ের ধুলো পড়লে…বুঝলেন কি না…হেঁ হেঁ হেঁ…’

বটকেষ্ট একতরফাই বকে গেল৷ রজনী কী বুঝলেন কে জানে! গম্ভীর মুখে তামাকের প্যাকেট নিয়ে চলে গেলেন৷

সে একদৃষ্টে লোকটার গমনপথের দিকে তাকিয়েছিল৷ অতবড় রাগি, দাপী মানুষটাকে কেমন যেন অসহায় লাগছে৷ এলোমেলো পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন৷ সেই স্বাভাবিক আত্মবিশ্বাসী পদক্ষেপ আর নেই৷ প্রকাণ্ড কয়েকমহলা অট্টালিকা যখন ভেঙে ধ্বংসস্তূপ হয়ে যায় তখন বোধহয় তাকে এমনই দেখতে লাগে৷

কয়েক মুহূর্তের জন্য একটা দ্বিধা বিবেকে কামড় বসাল৷ কাজটা কি ঠিক হল? সে মিথ্যে কথা বলেনি ঠিকই; কিন্তু সত্যিটাকে অনেক বেশি বাড়িয়ে বলেছে৷ এতটাই বেশি জমকালো করে তুলেছে যে ঘটনাটা অসহনীয় হয়ে উঠেছে!

আসল ঘটনাটা আদৌ এতটা অসহ্য ছিল না৷ রজনীবাবুর ছেলের প্রাক্তন প্রেমিকা ঝামেলা করেছিল ঠিকই৷ পাড়াসুদ্ধু তা নিয়ে ঢি ঢিও পড়ে গিয়েছিল; কিন্তু সে গর্ভবতী ছিল না৷ এমনকি মারাও যায়নি৷ বরং নবদ্বীপের কোন এক ব্যবসায়ীকে বিয়ে করে সুখে সংসার করছে৷

এর সবটাই বটকেষ্ট জানত৷ অথচ……!

নিষ্প্রভ চোখদুটো আবার অগ্নিকুণ্ডের মতো দপ করে জ্বলে ওঠে৷ বেশ হয়েছে! বেশ করেছে বলেছে! আবার বলবে! কী ভেবেছে লোকগুলো? দুনিয়ার সমস্ত সুখ করায়ত্ত করে বসে থাকবে? দুঃখ, গ্লানি, কদর্যতা কোনওদিন তাদের স্পর্শও করবে না!

মামাবাড়ির আবদার!

সে সমস্ত চিন্তা নিমেষে ঝেড়ে ফেলে পান সাজায় মন দিল৷ ভাবনাগুলোকে দূর করতে পারলেই বাঁচে৷ এই চিন্তা-ভাবনা নামক বস্তুগুলোই আসলে যত নষ্টের গোড়া৷ যত কম ভাবা যায় তত বেশি আনন্দে থাকা যায়৷ ভাবতে বসলেই যত বিপদ!

—‘বটকেষ্ট, একটা মিষ্টি পান দে, এলাচ ছাড়া৷’

বটকেষ্ট মুখ গুঁজে পান সাজছিল৷ পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে মুখ তুলে তাকিয়েছে৷ তার মুখে আলতো একটা হাসি ঝিলিক মেরে যায় :

—‘আ-রে! সেকেটারিবাবু যে! আসুন আসুন…কতদিন আসেন না৷’

হারাধন মণ্ডল স্থানীয় হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের সেক্রেটারি৷ বিয়ে-থা করেননি৷ সম্পূর্ণ স্বাধীনচেতা মানুষ৷ স্কুলের কাজেই জীবন উৎসর্গ করেছেন৷ স্কুল-অন্ত-প্রাণ মানুষটি আবার ভয়াবহ আদর্শবাদীও বটে৷ ঠিক করেছেন তাঁর স্কুলের কোনও শিক্ষককে প্রাইভেটে পড়াতে দেবেন না৷ শিক্ষকরা তাঁকে প্রায় যমতুল্য জ্ঞান করেন৷ মাঝেমধ্যে তাঁর জন্য যমের করুণাও প্রার্থনা করে থাকেন৷ কিন্তু এত লোকের সমবেত প্রার্থনায়ও মৃত্যুদেবতা কর্ণপাত করেননি!

পান সাজতে সাজতেই বটকেষ্ট ‘ক্ল্যাসিক’-এর প্যাকেট এগিয়ে দিয়েছে৷ হারাধনবাবুর ওটাই ব্র্যান্ড৷

তিনি প্যাকেট থেকে আলগোছে একটা সিগ্রেট তুলে নেন৷

—‘ভাবছি সিগ্রেট খাওয়াটা ছেড়ে দেবো৷’

গত তিন বছর ধরেই হারাধন সিগ্রেট ছাড়ার কথা ভেবে যাচ্ছেন৷ স্রেফ ভেবেই যাচ্ছেন৷ ছাড়া আর হচ্ছে না৷ বটকেষ্ট মিটিমিটি হাসে৷ পানের গায়ে তরল খয়ের বোলাতে বোলাতে রেডিওর কান মোচড়াচ্ছে! আদ্যিকালের পুরোনো রেডিওটা মাঝেমধ্যেই গাঁক গাঁক করে বাজতে শুরু করে দেয়৷ এখনই ফের তারস্বরে বাজতে শুরু করে রসালাপে ব্যাঘাত ঘটাতে যাচ্ছিল৷

কিন্তু তার আগেই বটকেষ্ট রেডিও বন্ধ করে দিয়েছে৷

—‘তা ছেড়ে দিন না৷ ওটা কি একটা খাওয়ার জিনিস হল?’

একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল, ‘ছাড়ব তো ভাবি৷ কিন্তু পারছি না৷’

উত্তরে একটা রহস্যময় হাসি হাসল সে৷ এক একটা নেশার প্রকোপ এতটাই বেশি যে ছেড়ে দেওয়া মুস্কিল৷ ছাড়তে চাইলেও ছাড়ে কই!

—‘পানও ছাড়বেন না কি?’

—‘নাঃ, পান চলতে পারে৷’ তিনিও হাসছেন, ‘পানে কোনও দোষ নেই৷ ওটা হার্মলেস৷’

—‘তাহলে বটকেষ্টর ইস্পেশাল পান খেয়ে দেখুন৷ মুখে দিলেই গলে যাবে৷’

—‘ঠিক আছে৷ খেয়ে দেখছি৷’ হারাধনবাবু ঘড়ি দেখছেন, ‘তবে একটু তাড়াতাড়ি কর৷ একটু তাড়া আছে৷’

—‘এক্ষুনি হয়ে যাবে৷’ সে ক্ষিপ্রহাতে সুপুরি সাজাচ্ছে, ‘তা তাড়া কীসের? যাবেন কোথায়?’

—‘একটু জিতেনের বাড়ি যাব৷ স্কুলের ব্যাপারে একটু কথা আছে৷’

পিটপিটে তেরছা চোখে বটকেষ্ট তাকাল৷ জিতেন হালদার মেকানিকসের শিক্ষক৷ মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক লেভেলে ফিজিক্সও ভালো পড়ান৷

—‘অ৷’’ সে পানটা মুড়তে মুড়তে এগিয়ে দিয়েছে, ‘কিন্তু এখন কি তাকে পাবেন?’

হারাধন আস্ত পানটা মুখে পুরে দিয়েছেন৷ পানের রসে মুখভর্তি৷ পিচ করে পিক ফেলে বললেন, ‘কেন? বাড়ি নেই নাকি?’

—‘না…না…যাবেন কোথায়? তবে একটু আগেই…’ সে খুচ খুচ করে মাথা চুলকুচ্ছে!

—‘একটু আগেই? একটু আগে কী?’

—‘একটু আগেই আপনাদের ইস্কুলের কয়েকজন ছাত্তরকে ওদিকপানেই যেতে দেখলাম কি না! তাই বলছিলাম…উনি বোধহয় ছাত্তর পড়াচ্ছেন…৷’

—‘কী?’ সেক্রেটারিবাবু প্রায় তড়িতাহত ব্যাঙের মতো লাফিয়ে ওঠেন৷ পরক্ষণেই টাইফুন গতিতে জিতেনের বাড়ির দিকে এগিয়ে গেছেন৷ প্রায় দৌড়তে দৌড়তেই চিৎকার করে বললেন, ‘তোর পান-সিগ্রেটের দাম পরে দিয়ে যাচ্ছি বটকেষ্ট…আমি এখন একটু ব্যস্ত……’

বটকেষ্ট ঝকঝকে দাঁত বের করে হাসল, ‘নিয়ে যান বাবু, দাম দিতে হবে না৷ আপনারটা ফি-রি!’

তখন বেশ রাত হয়ে এসেছে৷ আশেপাশের বাড়িগুলোর জানলার চোখ ফুটেছে টুপটুপ করে৷ তেল চকচকে পিচের রাস্তা চাঁদের আলোয় কেউটের পেটের মতো মসৃণ৷ আকাশ যেন ময়ূরকণ্ঠী জেলি৷ মেইনরোডের উপর হুশহাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়ির সঞ্চরণ৷ ল্যাম্পপোস্টগুলোর কোনওটার চোখে আলো জ্বলছে, কোনওটা আবার নিরেট অন্ধ৷ তাদেরই সমবেত আলোয় স্পষ্ট মেইনরোড৷ আর একটু দূরেই নিষ্প্রভ জ্যোৎস্নায় নারকেল গাছের ছায়া ছায়া শরীর দিগন্তে প্রান্তসীমা টেনে দিয়েছে৷

পানের দোকানে এখনও জমাট ভিড়৷ সামনের স্টিরিওর শোরুমে হিমেশ রেশমিয়ার অনুনাসিক কণ্ঠস্বর৷ অফিস ফেরত বাবুরা বাজারে শোরগোল জমিয়ে তুলেছেন৷ আজ শনিবার৷ কাল সকাল থেকেই ভালোমন্দ চলবে৷ মাছের বাজারে প্যাচপ্যাচে মাছধোয়া আঁশটে কাদায় দাঁড়িয়ে দরাদরি চলছে রুইমাছের মাথা, ইলিশের পেটি, কুচো চিংড়ি অথবা ভেটকির টুকরোর৷ পাঁঠার মাংসের দোকানের সামনে লম্বা কিউ৷ শাকসবজীর দোকানে পান্নার মতো ঝকঝকে সবুজ পুঁইডাটা, তাজা হেলেঞ্চা, পটল, ঢেঁড়স৷ দেখলেই জিভে জল আসে৷

রাত আরেকটু গভীর হয়ে আসতেই বটকেষ্ট দোকানের ঝাঁপ ফেলে ঘরমুখো হল৷ ডানহাতের ঢিলে স্ট্র্যাপওয়ালা আদ্যিকালের রংচটা ঘড়িতে সাড়ে দশটা বাজে৷ রাস্তাঘাট শুনশান৷ রাত্রি অদ্ভুত মোহিনী সর্পিণীর মতো আস্তে আস্তে গিলে ফেলছে গোটা অঞ্চলকে৷

সবজিবিক্রেতা মকবুল কিন্তু তখনও বসে আছে তার সর্বশেষ ক্রেতাটির জন্য৷ বটকেষ্টকে সে নাম দিয়েছে, কাঠিবাবু৷ কোনও একসময় নেশাতুর দুর্বলতায় এর কাছে তার গোপন কথা ফাঁস করে ফেলেছিল৷ তারপর থেকেই এই নতুন নামকরণ৷ তবে মকবুল মানুষ ভালো৷ প্রাচীন পরিত্যক্ত কুয়োর মতো রহস্যটুকু নিজের পেটেই জমিয়ে রেখেছে; পাঁচকান করেনি৷

পোকায় কাটা বেগুন, বাসি আলু আর মাংসের টুকরোয় থলি ভরে যখন সে বাড়ির দিকে রওনা হল তখন মাথার উপর অজস্র তারা টুনি বাল্বের মতো জ্বলছে, নিভছে৷ বেশ বড়সড় জলসাঘরের বাতির মতোই নীলাভ, কুহকময়৷

বটকেষ্ট হাঁটতে হাঁটতেই নিজের কথা ভাবছিল৷ পৃথিবীর সব অংশে না জানি এখন কত সুখ! প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু আনন্দ আছে৷ কারুর দাম্পত্য সুখ, কারুর সুখটা অর্থকরী; কারুর বা সন্তানলাভের আনন্দ৷ দুঃখ থাকলেও কোথাও না কোথাও সুখের তিরতিরে ঝোরা ক্রমশই বয়ে চলেছে৷

শুধু একা সে-ই সবকিছু থেকে বঞ্চিত! কেন? মকবুলের দেওয়া নামটা বারবার মনে পড়ছিল তার৷ কাঠিবাবু! পরের পিছনে কাঠি দেওয়া যার স্বভাব তার এমন নাম হওয়াই স্বাভাবিক৷

সে আপনমনেই ফিক করে হেসে ফেলল৷ মকবুল জানে না, যাকে ওরা ‘আল্লাহ’ বলে আর বটকেষ্টরা ‘ভগবান’, তার চেয়ে বড় ‘কাঠিবাবু’ দুনিয়ায় আর নেই৷ সে যখন কাঠি দেয় তখন জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে৷

আকাশটা তখনও ঝকঝক করে হাসছিল৷ বটকেষ্ট আকাশের দিকে তাকিয়ে অদৃশ্য কারুর দিকে মনে মনে একরাশ গালাগালি ছুড়ে দেয়৷ চোখে আগুনের হল্কা নিয়ে উগরে দেয় অশ্রাব্য খিস্তিখেউড়…

শালা…হারামজাদা…শুয়োরের বাচ্চা!…পিছনে কাঠি দেওয়ার জন্য তুই একটা হতভাগা পানওয়ালাকেই পেয়েছিলি?……

বাড়ি ফেরার পর মেজাজ আরও খিঁচড়ে গেল৷

সব পুরুষই চায় সারাদিনের খাটুনির পর স্ত্রীর সঙ্গলাভ করতে৷ ক্লান্ত তৃষ্ণার্ত মানুষের সামনে জলের গ্লাস এনে দেওয়ার একটা চুড়ি পরা হাত৷ সযত্নে খাবার বেড়ে দেওয়া৷ পান্তাভাতই হোক কি বিরিয়ানি; একটি মানুষের সস্নেহ পরিপাটি পরিবেশনে তাই হয়ে ওঠে অমৃত৷ তারপর রাতে একটি সুস্থ, সুন্দর, সপ্রেম মিলন৷

অথচ বিছানায় শুয়ে যন্ত্রণায় রীতিমতো দাপাদাপি করছিল বৌটা! এমন পেট ব্যথা তার প্রায়ই হয়৷ তখন কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করতে থাকে৷ আজ বোধহয় একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে৷ মধ্যরাত অবধি একফোঁটাও ঘুমোতে পারেনি৷ মনে হচ্ছিল আজই বুঝি সব যন্ত্রণার শেষ হয়৷ কিন্তু মাঝরাতের দিকে ব্যথাটা নরম হয়ে আসতেই বাঁচোয়া৷

মেয়েছেলের একেবারে কই মাছের প্রাণ!

বাড়ির বাইরে দাওয়ায় বসে বৌয়ের ঝটপটানির শব্দ শুনছিল বটকেষ্ট৷ তার সাথে সাথেই চলছিল নিজের স্বর্গগত বাপের দ্বিতীয়বার শ্রাদ্ধ! সারা দুনিয়ায় আর মেয়ে খুঁজে পায়নি! একটা রোগের ডিপোকে ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে গেল! নে শালা! পচা লাশ ঘাড়ে চাপিয়ে বৈতরণী পার হ! বাপ নয়…বাপ নয়…শত্তুর! নিজে তিনটে বিয়ে করেছিল৷ র-সে-র না-গ-র! আর ছেলের বেলায় একটা জন্মরোগীকে গছিয়ে দিয়ে কেটে পড়েছে!

মরা বাপটাকে হাতের কাছে পেলে এইমুহূর্তে খুনোখুনি হয়ে যেতে পারত৷ কিন্তু সে উপায় নেই৷ অগত্যা স্বর্গীয় পিতার উদ্দেশে ‘ছিক’ করে একদলা থুতু ফেলে সে উঠে দাঁড়াল৷ রাতের খাওয়া হয়নি৷ খাবারে বা মদে আর রুচি ছিল না৷ শিকারি বেড়ালের মতো ক্ষুধার্ত জ্বলজ্বলে চোখ! ঠান্ডা হাওয়া ঝাঁপিয়ে পড়ে উত্তপ্ত শরীরকে জুড়িয়ে দেওয়ার বৃথা চেষ্টায়৷

বটকেষ্টর বাড়ির কাছেই তখন ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ! মেয়ে গলার চাপা হাসি, পুরুষের উত্তেজিত শ্বাস! তার মুখগহ্বর ঘন লালায় ভরে গেল৷ শরীরটা কেমন যেন আঁকুপাঁকু করছে!

ডোবার ঠিক উল্টোদিকের বাড়ির ছেলেটার নতুন বিয়ে হয়েছে৷ ছেলেটাকে দেখতে আস্ত ষাঁড়ের মতো! অথচ বৌটা বেশ৷ নরমসরম পাউরুটির মতো ফুলো ফুলো গাল৷ পরিষ্কার রং, গড়নটাও চমৎকার! অমন পুতুলের মতো মেয়েটাকে একটা ষাঁড়ের সাথে বিয়ে দিল কেন মেয়ের বাপ কে জানে! দুনিয়ার সব বাপগুলোই বোধহয় চোখে ঠুলি পরে বসে আছে৷ নয়তো কোন প্রাণে বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা দেয়?

বটকেষ্ট গুটি গুটি পায়ে সেদিকেই এগিয়ে যায়৷

শোবার ঘরের জানলা বন্ধ করেনি কেউ৷ এই ভ্যাপসা গরমে জানলা বন্ধ করেও ঘুমোনো সম্ভবও নয়৷ সদ্য বিবাহিত দম্পতির ঘরের জানলাও খোলাই ছিল৷

ভিতরে জমাট অন্ধকার৷ তা সত্ত্বেও দুটো ছায়া স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে৷ দুটো শরীর মেতে উঠেছে আনন্দ খেলায়! উপরের দেহটা পুরুষের৷ তার দেহ আড়াল করে আছে নারীকে৷ মিলনের চরম সুখে দুজনেই আকুল হয়ে উঠেছে! চরম উত্তেজনায় উদ্বেলিত৷

হঠাৎই মেয়েটির স্তিমিত দৃষ্টির সামনে যেন একটা পর্দা খসে পড়ল! ওকী! খোলা জানলায় এত রাতে ওটা কার মুখ! দুই জ্বলজ্বলে অতৃপ্ত চোখ মেলে নির্লজ্জের মতো চেয়ে আছে……কে?

পুরুষকে ছিটকে সরিয়ে দিয়ে আর্তচিৎকার করে ওঠে মেয়ে, ‘ওই…ওই…কে?’

মুখটা সাঁৎ করে বিদ্যুৎগতিতে জানলা থেকে সরে গেল৷ পুরুষটি ততক্ষণে লাফ মেরে দরজা খুলে ফেলেছে……

—‘এই শালা…বা……’

একটা ছায়া ক্ষিপ্রগতিতে ছুটে গিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল৷ বাইরে শুধু জমাট কালোর প্রলেপ ছাড়া আর কিছু নেই!

জানলা-দরজা বন্ধ করে আবার বিছানায় ফিরে এল পুরুষ৷ মেয়েটি নিথর হয়ে শুয়েছিল৷ স্বামী তাকে স্পর্শ করতেই নিস্তেজ স্বরে বলে, ‘আজ থাক’৷

দুটি শরীর পাশাপাশি শুয়ে রইল; নিস্পন্দ, প্রতিক্রিয়াহীন!

পালাতে পালাতে বস্তি পেরিয়ে বটকেষ্ট ফের রাস্তায় চলে এসেছে৷ সার সার ল্যাম্পপোস্ট রাস্তার দু-পাশে ‘থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে৷ গায়ে পালস পোলিও টিকার জমকালো বিজ্ঞাপন৷ রাস্তার পাশে জলের কল থেকে জলবিন্দু পড়ছে টুপটাপ৷ আর কোনও শব্দ নেই৷

সামনেই মাথা উঁচু দাম্ভিক ফ্ল্যাটের বাঁদিকের জানলায় নীল সমুদ্র৷ নীল জোয়ারে হয়তো ইউক্যালিপ্টাসের গন্ধ! দুটো সোনালি মাছ হাবুডুবু খেয়ে খেলা করছে এখন৷

বটকেষ্ট একটা ল্যাম্পপোস্টের গায়ে ঠেস দিয়ে পাগলের মতো খুব একচোট হেসে নিল৷ ছেলেমেয়ে দুটোর সুখের রাতটায় আচ্ছা কাঠি হয়েছে! রোজই সুখ ভোগ করবে! আহ্লাদ! একটা রাত অন্তত নষ্ট হোক৷

ফ্ল্যাটের নীচে দাঁড়িয়ে দামি চতুষ্পদ৷ বেশ দামি গাড়ি৷ কাচে আলো পড়ে ঝলসে উঠছে৷ ভেলভেটের মতো গায়ে মাছি বসলেও বোধহয় পিছলে পড়বে! তেল চকচকে শরীরে ঝকঝক করছে অর্থ, সুখ, সমৃদ্ধি, প্রতিপত্তি৷

এটা এই ফ্ল্যাটের প্রোমোটার তপন পালের গাড়ি৷ নীল কাচওয়ালা ফ্ল্যাটটাও তারই৷ শালা, একনম্বরের খচ্চর! অমন মাগীবাজ লোক দুটো নেই৷ একটা বৌ আর দুটো মেয়ে থাকে ব্যারাকপুরে৷ তারপরেও হারামির হাতবাক্সটা আরেকটা মেয়ের সাথে হাওড়ার ফ্ল্যাটে থাকে৷ আবার মালতীবৌদির সাথে এই ফ্ল্যাটে প্রায়ই রাতে রাসলীলা করে৷ আরও কটা বেশ্যা পুষে রেখেছে কে জানে! ব্যাটা টাকার কুমির; একশোটা মহিলা থাকাও আশ্চর্য নয়৷

নীল কাচের দিকে তাকিয়ে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল সে৷ মালতী-বৌদি ভিতরে আছে নিশ্চয়ই৷ স্বামীটা ঘরে মরছে৷ নিজস্ব একটা পয়সাও নেই চিকিৎসার জন্য৷ তপন পালের পয়সায় বেঁচে আছে গোটা পরিবার৷ ক্যান্সারের রোগী বরটা বেশিদিন বাঁচবে না সে ওই হারামি প্রোমোটারটাও জানে৷ লোকটা মরলে তো ওরই পোয়াবারো!

মালতীবৌদিরও কি পোয়াবারো? মহিলাকে বোঝা মুস্কিল৷ স্বামী বাঁচবে না তা কি সে নিজে বোঝে না? তবু কীসের আশায় বহুনারীভোগী লম্পটটার হাতে নিজের চামড়া বেচছে?

ধুস…!

বটকেষ্ট ভেবে দেখল সে আবার ভুলভাল ভাবতে শুরু করেছে! আজকাল কি একটু বেশিই ভাবছে? নিজের ভিতরই কী করে যেন দুটো ভাগ টের পায় সে! একটা তার মতোই কুচকুচে কালো৷ আরেকটা সাদা৷ সাদাটা যে কোথা থেকে এসে টপকে পড়ে তা ভগাই জানে! সে ব্যাটা শুধু প্রশ্ন করে যায়, এটা ঠিক হল?…ঠিক হল? এটা কি ঠিক হল?……

আচমকা পিঠের উপর একটা নরম স্পর্শ!

বটকেষ্ট চমকে পিছনে ফিরল৷ পিছনে তাকাতেই বিস্ময়টা আরও প্রগাঢ় হয় তার! এত রাতে নিঝুম রাস্তায়, তার পিছনে একটা বাচ্চা ছেলে এসে দাঁড়িয়েছে! জ্বলজ্বলে দুই চোখে নির্ভেজাল হিংস্রতা নিয়ে তাকিয়ে আছে ওই নীল জানলার দিকেই!

মালতীবৌদির ছেলে—বিট্টু!!!

সে অবাক হয়! বাচ্চা ছেলেটা এত রাতে এখানে কী করছে? কতই বা বয়েস ওর? মেরেকেটে চোদ্দো কি পনেরো হবে৷ এখন ওর ঘুমোনোর কথা, স্বপ্ন দেখার সময়৷ সেসব ছেড়ে এত রাতে এই জনহীন রাস্তায় কীজন্য এসেছে সে?

বটকেষ্ট গলা খাঁকারি দেয়, ‘তুই বিট্টু না?’

ছেলেটার জ্বলজ্বলে চোখ ফ্ল্যাটের জানলা থেকে বটকেষ্টর মুখের দিকে ফিরল৷ সে একটু চুপ করে থেকে উত্তর দেয়, ‘হুঁ৷’

—‘এখানে কী করছিস?’

তার দৃষ্টি অনাবিল জিঘাংসা নিয়ে ফের ঘুরে গেছে ফ্ল্যাটের জানলার দিকে৷ বটকেষ্টর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন সে বোধ করল না৷

—‘কী হল?’ বটকেষ্ট ঝাঁঝিয়ে ওঠে, ‘এত রাতে এখানে কী করছিস? চোখে ঘুম নেই?’

বিট্টু যেন চমকে উঠে তার দিকে তাকায়৷ অন্যমনস্ক হয়ে কী যেন ভাবছে সে! এবারও প্রশ্নের কোনও উত্তর দিল না৷ তবে কয়েক মুহূর্ত গভীরভাবে কী যেন চিন্তা করে আস্তে আস্তে পা বাড়াল উল্টোদিকে৷

বটকেষ্ট দেখল বিট্টু ধীরে ধীরে নিজের বাড়ির দিকে চলে যাচ্ছে৷

এরপর আরও দিন তিনেক বিট্টুকে দেখেছে বটকেষ্ট৷ রাতদুপুরে, ওই ফ্ল্যাটের সামনে৷ সে যেন কিছু করতে চায়৷ একটা অদম্য ইচ্ছা তার ভিতরে দাপিয়ে মরছে৷ অথচ আরও একটা মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাচ্ছে৷

বটকেষ্ট অনুভব করে অনিচ্ছাসত্ত্বেও আজকাল কিছু কিছু বিষয় তাকে বড়ই ভাবায়৷ অনেকবার ঠিক করেছে যে কিছুতেই ভাববে না৷ তবু একেবারে ঝেড়ে ফেলা মুস্কিল৷ বিশেষ করে বিট্টুর কথা৷ ছেলেটা ঠিক কী করতে চায়? কোন উদ্দেশ্য নিয়ে সে প্রায়ই ওই ফ্ল্যাটের সামনে এসে দাঁড়ায়? কী আছে ওর মনে?

মালতীবৌদিকেও প্রায়ই দেখতে পায় সে৷ ঘরে একটা আধমরা মানুষ, তাও মহিলার কী সাজের ঘটা! স্বামী মরতে চলেছে; কিন্তু বৌয়ের গাঢ় লিপস্টিক তাতেও ফিকে হয় না! দামি দামি শাড়ি-গয়না পরে তপন পালের এসি গাড়ি চড়ে হুশ করে চলে যায়৷ দেখলেই গায়ে জ্বালা ধরে তার৷ মেয়েছেলের কী নষ্টামি! হোক মৃত্যুপথযাত্রী; তবু স্বামী তো আছে! তাকে ঘরে ফেলে মাগী ফুর্তি করতে চলল! পেটে অল্পস্বল্প শিক্ষেদীক্ষেও আছে৷ একেবারে ক’ অক্ষর গোমাংস নয়৷ গতরে শক্তি আছে৷ তাই খাটিয়ে খা না বাপু! পরপুরুষের সাথে ঢলাঢলি করতেই হবে?

তার হাত নিশপিশ করে৷ খুব ইচ্ছে হয় দুটোর ফুর্তিতে কোনওভাবে কাঠি দিতে৷ কোনও কষ্ট নেই, খাটনি নেই; শুয়ে শুয়েই কী সুন্দর আরাম আর বিলাসের জিনিসগুলো হাসিল করে নিচ্ছে মহিলা! এত সহজে হাসিল করে নেবে সব সুখ! কী অন্যায় আবদার!

ধুত্তোর! মাথা ঝাঁকিয়ে যেন চিন্তাগুলোকেও ঝেড়ে ফেলতে চায় বটকেষ্ট৷ পরের ছেলে পরমানন্দ, যত গোল্লায় যায় তত আনন্দ৷ মরুক গে যাক৷ এসব লটঘট নিয়ে চিন্তা করে খামোখা সময় নষ্ট৷ যা পারে করুক৷ তার কী?

সে সমস্ত ভাবনাকে দূরে সরিয়ে রেখে পান সাজায় মন দেয়৷ আজ অন্যান্য দিনের তুলনায় গরম কম৷ ভোরের দিকে একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে৷ হাওয়াটা বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা৷ গা জুড়িয়ে দেয়৷ মনটাও ফুরফুরে হয়ে ওঠে৷

পান সাজার মধ্যেই কানে আসে, কোথায় যেন রেল রোকো হয়েছে৷ অফিসযাত্রী, স্কুলের ছেলেমেয়েদের দুর্ভোগের অন্ত নেই৷ অনেকে স্টেশনে গিয়ে ফের বাড়ি ফেরত চলে এসেছে৷ কেউ কেউ আবার বাসের দমবন্ধ ভিড়ে মারামারি করে অফিস-স্কুলমুখো হয়েছে৷

খদ্দেরকে পছন্দমতো পান দিতে দিতে সবই চুপচাপ শুনছিল বটকেষ্ট৷ এসব খবরে কোনও নতুনত্ব নেই৷

এক দাদা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সিগ্রেট ধরিয়ে পশ্চিমবঙ্গের দুরবস্থা নিয়ে লম্বা লম্বা লেকচার ঝাড়ছিলেন৷ তাঁর সাথে হঠাৎ আরেক দাদার তর্ক বেধে গেল৷

—‘আরে বনধ কি লোকে এমনি এমনি করে? এসব বনধ, রেলরোকো না করলে সরকারের যে টনক নড়ে না!’ প্রথম দাদা প্রায় গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছেন, ‘এতদিনের শাসনে কী দিতে পেরেছে সরকার? তেলের দাম হু হু করে বাড়ছে৷ বাজার অগ্নিমূল্য৷ মিডল ক্লাস খাবে কী? চালের দাম দেখেছেন?’

দ্বিতীয় দাদা অপেক্ষাকৃত শান্ত, ‘ওটা সেন্ট্রালের ব্যাপার৷ স্টেট গভর্নমেন্ট কী করবে? তা ছাড়া এতদিনে কি রাজ্যটা উচ্ছন্নে গেছে?’

—‘নয়তো কোথায় গেছে?’ প্রথম দাদা মুখে ফেনা ভেঙে বললেন—‘অন্যান্য মেট্রো সিটিগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখেছেন…..?’

বটকেষ্ট মিটমিট করে হাসছিল৷ লোকগুলোর খেয়ে আর কাজ নেই৷ ফালতু মগজমারি নিয়ে গজ-কচ্ছপের যুদ্ধ লাগিয়েছে৷ দুনিয়ার খবর রাখে, শুধু নিজের ঘরের খবর ছাড়া!

সে তর্কের মধ্যে বাগড়া দেয়৷ প্রথম দাদার দিকে তাকিয়ে হাসছে :

—‘দাদা কি দল পাল্টেছেন নাকি?’

প্রথম দাদা থতমত খেয়ে তাকিয়েছেন, ‘মানে?’

—‘আপনি সরকারি চাকরি করেন না?’

—‘করি৷ তাতে কী?’ তিনি আবার চেঁচাতে শুরু করেছেন, ‘সরকারি চাকরি করলেই পা চাটতে হবে নাকি?’

—‘অ!’ তার চোখে পেটেন্ট মিহি দৃষ্টিটা ফের উঠে এসেছে৷ এই দাদাটি তার চেনা৷ পাড়ারই লোক৷ এঁর মেয়ে ক্লাস ফোরে পড়ে৷ রোজ সকালে যখন বটকেষ্ট দোকান খোলে তখন মেয়েকে স্কুলে দিতে যান ভদ্রলোক৷ ওনার বৌ ভারী আলাপী মানুষ৷ দুপুরবেলা প্রায়ই মিষ্টি পান নিতে আসেন৷ গল্পগাছা করেন৷

—‘বৌদি বলছিলেন মেয়েকে ইংরিজি মিডিয়ামে দেওয়ার খুব ইচ্ছে আপনার’৷ সে ধীরেসুস্থে বলে, ‘নামী ইস্কুলে ভর্তির জন্য পাট্টির লোক রাজীব সমাদ্দারকে ধরেছিলেন না? রাজীববাবুও কাজটা করে দেবেন বলে দিয়েছিলেন……’

তড়পানি যে কোথায় গেল! দাদার মুখ চুপসে ফাটা ঠোঙা৷ আশেপাশের লোকেরা তার দিকেই দেখছে৷ সকলের চোখেই প্রচ্ছন্ন বিস্ময়ের সাথে মিশ্রিত বিদ্রূপ৷ কেউ কেউ বঙ্কিম অম্লরসাক্ত হাসিও হাসছে৷

খুব সুনিপুণ ভাবে কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকল বটকেষ্ট, ‘আপনি দল বদলেছেন সে কথা রাজীববাবু জানেন?’

জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাদা তাকে জরিপ করছেন৷ এভাবে লোকটা সবার সামনে বাঁশ দিয়ে দেবে তা ভাবেননি৷ আশেপাশের লোকগুলো মিটিমিটি হাসছে৷

দাঁতে দাঁত পিষলেন তিনি৷ গিন্নির পেট পাতলা হলে কর্তাদের এমন সর্বনাশই হয়!

অসম্ভব রাগ আর অপমান কোনমতে গিলে ফেলে জ্বালাময়ী কণ্ঠে বললেন,

—‘একটা চ্যান্সেলরের প্যাকেট দিতে আর কত সময় লাগাবি তুই?’

বটকেষ্ট হেসে ফেলল৷ বোঝা গেছে লোকটার দৌড়!

—‘ঔরত জাতই হয় সব্বোনাশের গোড়া৷’ মকবুল সবজি মেপে মেপে চটের থলিটায় ভরে দিচ্ছিল৷ রোজই সে পরিমাণে একটু বেশিই দেয়৷ বলাই বাহুল্য, এই হতভাগা কাঠিবাবুর উপর তার মায়া পড়ে গেছে৷ বেশির ভাগ ক্রেতাই সবজীবিক্রেতাকে মানুষ বলে গণ্য করে না৷ কথা বলার ভঙ্গিতেই থাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য৷

একমাত্র এই লোকটার সাথেই আলাপ জমাতে পারে মকবুল৷ পেশ করতে পারে তার দার্শনিক তত্ত্বগুলো৷

আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি৷

—‘উয়াদের রংঢং দেইখ্যা ভোললেই জাহান্নামের রাস্তা খুলে! বোঝলা নি কাঠিবাবু?’

বটকেষ্ট হাসে, ‘রংঢং দেখার সুযোগ হল কই রে?’

—‘ক্যান?’ মকবুলের মুখে চিন্তার ছাপ, ‘বিবিজানের বিমারি কুমে নাই?’

সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল৷ এ বিমারি আর কমার নয়৷ রোগী নিয়ে ঘর করতে করতে তাকেও যেন রোগে ধরেছে৷ মাঝেমধ্যেই টের পায় ভিতরটা বড্ড জ্বালাপোড়া করে৷ একেবারে দাবানলের মতো বুকের ভিতরে আগুন পাঁজর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দেয়৷ শুধু ভস্ম…! শুধু শ্মশানের ছাই মেখে বসে আছে সে! এ এক অদ্ভুত রোগ! এ রোগেরও নিরাময় নেই৷

—‘আল্লাহরে তো আর বিশ্বাস করো না’৷ মকবুল ব্যাগটা এগিয়ে দিয়েছে, ‘ভাবিজানরে লইয়া কুনো পিরের দরগায় যাও৷ দানোর নজর লাগে মনে লয়৷ নিজের জন্য না যাও বিবিডার কথা ভাইব্যা দেইখ্যো৷’

ব্যাগটা হাতে নিয়ে বটকেষ্ট অর্থপূর্ণ হাসল৷ আর কথা না বাড়িয়ে এবার ফেরার পথ ধরেছে৷ মকবুল ধর্মপ্রাণ মানুষ৷ তাই জগৎজুড়ে ঈশ্বরের কৃপা আর দানবের কুদৃষ্টিই তার চোখে পড়ে৷ তার বিশ্বস্ত ‘আল্লাহ’ও যে কুদৃষ্টি দিতে পারেন তা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারে না৷

সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে৷ আজকাল আর বাড়ি ফিরতেও ইচ্ছে করে না৷ ঘরের টান নেই৷ সংসারের প্রতি তীব্র অনীহা৷ জৈবিক চাহিদাগুলো দমবন্ধ হয়ে শরীরের ভিতরে আঁকুপাঁকু করতে থাকে৷ নবদম্পতি সেদিনের ঘটনার পর জানলা বন্ধ করে শুতে শুরু করেছে৷ আর যারা প্রতিবেশী আছে তাদের বেশির ভাগই বুড়োবুড়ি৷ দেখার কিছু নেই৷ এমতাবস্থায় নিজের রিপুকে শান্ত করার উপায়ও অপ্রতুল৷

বাজার থেকে অনতিদূরে রাস্তার পাশের সাদা বাড়িটা মুখুজ্যেদের বাড়ি৷ এ বাড়ির বৌ রেখা সম্ভবত বাঁজা৷ এখনও পর্যন্ত বাচ্চা-কাচ্চা হওয়ার লক্ষণ নেই৷ কিন্তু দম্পতির মধ্যে প্রেমের অভাব তো নেই-ই উপরন্তু লোক দেখানো সোহাগের চোটে চোখে অন্ধকার! ভাব এমন করে যেন উত্তম-সুচিত্রা চলেছে! রাস্তাঘাটে প্রকাশ্যেই প্রায় জড়াজড়ি করে হাঁটে৷ লজ্জাশরমের মাথা খেয়েছে!

বটকেষ্টর খুব ইচ্ছে ছিল উত্তম-সুচিত্রার মধ্যে বিকাশ রায় হয়ে ঢুকে পড়ে৷ অনেকদিন ধরেই ইচ্ছেটা প্রবল হয়ে উঠেছে৷ তবে সুযোগ হয়ে ওঠেনি৷

আজ মনটা বিক্ষিপ্ত ছিল৷ নিজের দাম্পত্য জীবনের ব্যর্থতায় মনে মনে জ্বলছিল সে৷ কোথাও জ্বালাটা উগরে না দেওয়া অবধি শান্তি নেই৷ চিড়বিড়ে যন্ত্রণাটা জ্বালিয়ে খাচ্ছিল তাকে৷

এমন সময়ই সামনে পড়ে গেলেন রেখাবৌদি৷

সম্ভবত স্বামী এখনও অফিস থেকে ফেরেননি৷ হয়তো ওভারটাইম অথবা যানজটে আটকে গেছেন৷ বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে তাঁর অপেক্ষাই করছিলেন রেখা৷ স্বামীর বাড়ি ফেরার সময় হলেই প্রতিদিন নিজেকে সুন্দর করে সাজিয়ে নেন৷ একঢাল খোলা রেশমি চুল ফুরফুর করে হাওয়ায় উড়ছে৷ উড়ছিল পরিপাটি করে পরা শাড়ির আঁচলও৷

বটকেষ্ট পাশ দিয়ে যেতে যেতেই থমকে দাঁড়াল৷ একটা অদ্ভুত সুন্দর উষ্ণ গন্ধ ভেসে আসছে রেখাবৌদির শরীর থেকে! গন্ধটা নাকে আসতেই ভিতরের রিপুগুলো অসহ্য রাগে ফের রাক্ষুসে দাপাদাপি করতে শুরু করল৷

বটকেষ্টর মুখ কিন্তু ভাবলেশহীন৷ অন্দরের উথালপাথাল উত্তেজনা ছাপ ফেলেনি বাইরে৷ সে হেসে বলে, ‘বৌদি, এত রাতে বাইরে যে! দাদা ফেরেননি বুঝি?’

রেখা বৌদি প্রায় ফিল্মের নায়িকার ভঙ্গিতেই অপেক্ষা করছিলেন৷ বটকেষ্টকে হয়তো লক্ষ করেননি৷ এবার খেয়াল হল৷

—‘নাঃ৷’ তিনি হাসছেন, ‘ওর ওভারটাইম চলছে৷ ফিরতে দেরি হবে৷’

—‘রোজই ওভারটেম?’

—‘হ্যাঁ, এই সময়টা ওদের কাজের চাপটা বেশি থাকে৷’

—‘রোজই? বলেন কী?’ বটকেষ্ট অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বলে, ‘তা’লে গত তিনদিন ধরে আপনারা দুজনে মিলে বাইকে বেড়াচ্ছেন কী করে?’ পরক্ষণেই ফিক করে হেসে ফেলেছে, ‘দাদা আপিসের কাজেও ফাঁকি দেন তা’লে!’

—‘কে বলল তিনদিন ধরে বাইকে চড়ে বেড়াচ্ছি?’ রেখার মুখে পাতলা হাসি, ‘একসময় অবশ্য খুব বেড়াতাম৷ কিন্তু এখন ওর সময় হয় না৷’

—‘কী যে বলেন বৌদি!’ তার চোখে কৌতুক, ‘আমাদের কাছে লুকিয়ে লাভ কী? এই তো গতকাল, পরশু, তার আগের দিনও আপনাদের দুজনকে একসাথে বাইকে করে ফিরতে দেখলুম! আপনি কমলা রঙের জামা আর কালো প্যান্ট পরেছিলেন৷ মনে নেই?’

রেখাবৌদির মুখের হাসিটা কেউ যেন ব্লটিং পেপার দিয়ে শুষে নিল৷ চোখে অনাবিল বিস্ময়, ‘টপ! জিনস! কিন্তু আমি তো টপ-জিন্স পরি না!’

—‘সেকী! আপনি পরেন না!’ সে যেন থতমত খেয়ে বলে, ‘তবে দাদার পিছনে কে বসেছিল!’

বৌদির মুখ আস্তে আস্তে শক্ত হয়ে উঠছিল৷ আগের ‘নায়িকা নায়িকা’ ভাব আর নেই৷ বটকেষ্টর মনে মনে ব্যাপক হাসি পাচ্ছে৷ আজ বেচারি উত্তমকুমারের কপালে দুঃখ আছে৷ বাড়ি ফিরে সুচিত্রা সেনের বদলে ‘গীতা দে’র রণং দেহি মূর্তির মোকাবিলা করতে হবে৷ বেচারা!

—‘তুমি বোধহয় ভুল দেখেছ৷’

—‘হুঃ!’ সে একটা ইঙ্গিতপূর্ণ দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে, ‘বোধহয় তাই৷ যদিও খুব একটা ভুল আমার হয় না৷ তবে…আপনি বলছেন যখন…তখন বোধহয়…ভু-ল-ই দেখেছি!’

স্তম্ভিত বৌদিকে পিছনে ফেলে আর কোনও বাক্যব্যয় না করে এগিয়ে গেল বটকেষ্ট৷ তার পেট ফেটে হাসি পাচ্ছিল৷ মহিলা যেমনই হোক, যতই সুন্দরী আধুনিক হোক, বরকে সন্দেহ করতে ছাড়বে না৷ ওটা মেয়েদের বহু অভ্যাসের একটা!

যাক, আজ আরও দুটো নারী-পুরুষের রাত মাটি করে দেওয়া গেছে৷ সে আত্মতৃপ্তির হাসি হাসে৷ কখনও কখনও নিজের হাসিটা তার চতুর খ্যাঁকশেয়ালের মতো মনে হয়৷ হায়নার হাসির কথা অনেকেই শুনেছে৷ কিন্তু শেয়াল হাসে কি না ঠিক জানা নেই৷

তবে আন্দাজ করা যায় যে শেয়াল হাসলে বটকেষ্টর মতো করেই হাসত৷ এমনই চতুরতা আর হিংস্রতার সম্পৃক্ত মিশ্রণ!

আজ কিছুতেই বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে হল না৷ ইচ্ছেটাই বিকল হয়ে গেছে৷ বাড়ি যত কাছে আসছিল তত যেন একটা দমবন্ধ অনুভূতি চেপে ধরছিল তাকে৷ যেন ভেতরে ব্যর্থতা নামের একটা রাক্ষস বসে আছে তারই অপেক্ষায়৷ ঘরে ঢুকলেই চেপে ধরবে!

নিজের বাড়ির সামনে এসে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল বটকেষ্ট৷ ভিতরে যথারীতি নিস্তব্ধতা ও অন্ধকার৷ বাড়ি নয়; শ্মশান! এখানে কোনও জীবিত মানুষ ঘর করে না৷ মৃত স্বপ্ন আর ইচ্ছেরা সংসার পেতে বসেছে৷ ইট-কাঠ-পাথরগুলোও শোকস্তব্ধ৷

এখন নিজের বাড়িতে ঢুকতেও ভয় করে৷ আজ পর্যন্ত এই বাড়িটা ‘ঘর’ হয়ে উঠল না৷ দেওয়ালগুলো কোনওদিন হাসি শুনল না৷ বহুদিনের নীরবতা জমে জমে ভারাক্রান্ত হয়ে আছে৷

সে বাইরে দাঁড়িয়েই ভিতরের ঘরে বৌয়ের ব্যথাক্লান্ত নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল৷ ওই শব্দটুকুই একমাত্র প্রমাণ যে এ বাড়িতে একজন জীবন্ত মানুষ আছে৷ অন্ধকার চৌহদ্দির মধ্যে আর কোনও প্রাণের সাড়া নেই৷ নেই আলো, নেই শান্তি!

অথচ আকাশটা আজও কী সুন্দর! সামান্য ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ এখনও ইতস্তত ভাসছে৷ রুপোর টাকার মতো চাঁদটা জ্বলজ্বল করছিল একপাশে৷ কখনও কখনও মেঘের পাতলা আস্তরণ অল্প অল্প ছুঁয়ে যাচ্ছে; কিন্তু ম্লান করে দিতে পারেনি৷ নীলাভ আভার শান্ত জ্যোৎস্না গাছের মাথা থেকে চুঁইয়ে পড়ছিল৷ আলোর ধারায় ভেসে যাচ্ছে সব! কত আলো! কত আলো!

এমন আলোর একাংশও কি তার ঘরে জ্বলতে পারত না? সবাই এর ভাগ পেতে পারে; একা বটকেষ্টই বাদ!

বাড়ি ফিরেও সে ভেতরে ঢুকল না৷ রুচি ছিল না৷ বেশ কিছুক্ষণ দাওয়ায় বসেই কাটিয়ে দিল৷ তারপর কী ভেবে যেন ফের উঠে দাঁড়িয়েছে৷ গন্তব্যস্থান ঘর নয়৷ কোথায় যাবে নিজেও জানে না৷ শুধু এইটুকু জানে এই অভিশপ্ত বাড়ি থেকে যতদূরে পালানো যায় তত ভালো!

বটকেষ্ট দ্রুতগতিতে হাঁটতে হাঁটতে মেইনরোডের দিকে চলল৷ সে পালাচ্ছে৷ নিজের বাড়ির বিষণ্ণতার দিকে মুখ ফিরিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল মানুষটা৷

ঝোপঝাড়ের গা থেকে একটা বুনো গন্ধ ভেসে আসছে৷ রোজ এই গন্ধটা পাওয়া যায় না৷ সকালের দিকে বৃষ্টি হয়েছিল বলেই এখনও স্যাঁতস্যাঁতে ভেজা আগাছার গন্ধ প্রকট৷

ঝোপের ফাঁকে ছোট ছোট স্ফুলিঙ্গের মতো জোনাকি জ্বলছিল৷ তার পদতারণায় সন্ত্রস্ত হয়ে উড়ে গেল৷ চতুর্দিক অন্ধকার৷ শুধু সামান্য দূরে ল্যাম্পপোস্টের আলো মিটমিট করে জ্বলছে৷ সামনের দশাসই ফ্ল্যাটের গায়ে প্রতিফলিত হয়ে তারই ক্ষীণ রশ্মি উল্টোদিকের মেটে রাস্তায় এসে পড়েছে৷ খানিকটা আলোকিত করার চেষ্টা করছে যেন৷ কিন্তু বিপরীতদিকের শূন্যতা সেই সামান্য আভাকেও শুষে নিয়েছে৷ সেখানে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুর অস্তিত্ব থাকতেই পারে না৷

রাস্তার উপরের ফ্ল্যাটে তপন পালের ঘরের জানলায় নীলাভ আলোটা আজও দেখা যাচ্ছে৷ অর্থাৎ কপোত-কপোতী ভিতরেই আছে৷ ফ্ল্যাটটাকেই বৃন্দাবন বানিয়ে ফেলেছে দুজনে৷ দামি কাচের জানলায় নির্লজ্জ নীল রশ্মি৷ স্পষ্ট নয়, যেন নীল কুয়াশায় আবেশাচ্ছন্ন৷

বটকেষ্ট সেদিকেই জ্বলন্ত দৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে৷ জানলাটা বড্ড উঁচুতে৷ নয়তো উঁকি মেরে একটু লীলাখেলা দেখা যেত৷ মন আনচান করছে৷ ভিতরে নিশ্চয়ই গরমাগরম ব্লু ফিল্ম-এর লাইভ টেলিকাস্ট চলছে! দেখার লোভ সম্পূর্ণ আছে৷ উপায় নেই৷

সে লক্ষ করেনি কখন যেন অগোচরে আরেকটা ছায়ামূর্তি সরীসৃপের মতো সাবধানি ভঙ্গিতে উঠে এসেছে রাস্তার উপরে৷ অগ্নিদৃষ্টিতে ওই জানলাটার দিকেই তাকিয়ে আছে৷ বটকেষ্টর পিছনে, কয়েক হাত দূরত্বে একটা ছোট্ট ছায়া!

তার দু-চোখ রাতচরা নেকড়ের মতো ধক ধক করে জ্বলছিল!

কয়েক মুহূর্ত নিস্তব্ধতা! পরক্ষণেই ছোবল মারার মতো বিদ্যুতগতিতে উঠে এসেছে ছায়াটার হাত! একটা আধলা ইট অভ্রান্ত লক্ষ্যে আছড়ে পড়ল নীলাভ জানলাটার উপরে৷ মুহূর্তের ভগ্নাংশে আরও একটা!

প্রচণ্ড শব্দে ঝন ঝন করে ভেঙে পড়ল জানলার কাচ! রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে খান খান করে দিল একটা বিকট চিৎকার! ইটটা কারুর গায়ে পড়েছে!

—‘এই কে?…কে রে?’

বটকেষ্ট দ্রুতগতিতে পিছনে ফিরল৷ ছায়াটা প্রাণপণে পালাবার চেষ্টা করছিল৷ সে প্রায় বাঘের মতো লাফ মেরে তাকে চেপে ধরেছে৷ তার ভীম বেষ্টনের মধ্যে ছায়াটা ছটফট করছে৷ কিন্তু পালাতে পারেনি৷

—‘কে রে শালা? রাতদুপুরে লোকের জানলায় ইট……!’

বলতে বলতেই সে থেমে গেল! ল্যাম্পপোস্টের আলোয় অপরাধীর মুখ দেখতে পেয়েছে৷ একটা বছর চোদ্দো-পনেরোর অপরিণত মুখ৷

কিন্তু সে কী মুখ! হিংস্রতায় মুখের প্রত্যেকটা পেশি শক্ত! চোয়ালের হাড় কঠিন সঙ্কল্পে দৃঢ়বদ্ধ!

—‘বিট্টু! তুই……!’

অপরিসীম বিস্ময়ে সে হতবাক৷ কী বলবে ভেবে পেল না৷ ছেলেটা এখন আর ছটফট করছে না৷ ভীষণ রাগে ফুঁসছে! সে অপলকে বটকেষ্টর দিকেই তাকিয়ে ছিল৷

—‘কৌন বে মা……? কৌন হ্যায়?’

ফ্ল্যাটের হিন্দুস্থানি নাইটগার্ডের আওয়াজ শুনতে পেল বটকেষ্ট৷ একঝলক তার চেহারাটাও দেখা যায়! মুশকো লোকটা হাতে লোহার রড উঁচিয়ে এদিকেই ছুটে আসছে!

সে একধাক্কায় সরিয়ে দিয়েছে বাচ্চাটাকে৷ ক্রুর, নিষ্ঠুর গলায় বলল :

—‘পালা…৷’

বিট্টু হতবাক, এত সহজে ছাড়া পাবে ভাবেনি! বাইরে প্রকাশ না করলেও সে ভয় পেয়ে গিয়েছিল৷ ভেবেছিল লোকটা তাকে ধরিয়ে দেবে৷ কিন্তু……

—‘কী হল?’ বটকেষ্ট চাপা অথচ কর্কশ ভাবে বলে, ‘দারোয়ানের লাঠি পিঠে পড়লে তবে যাবি? যাঃ ভাগ……ভাগ বলছি!’

পরিস্থিতি সঙ্গীন বুঝতে পেরে বিট্টু পড়ি কি মরি করে দৌড়েছে৷ ক্ষিপ্রগতিতে সাঁৎ করে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে৷

ততক্ষণে নাইটওয়াচম্যানের চিৎকারের সঙ্গে মিশেছে তপন পালের ক্রুদ্ধ গর্জন৷ একটা ইট তার কপালে পড়েছে৷ তবে একদম সোজাসুজি লাগেনি৷ অতবড় ইটের টুকরো মাথায় পড়লে মাথাটা আর আস্ত থাকত না৷ অল্পের উপর দিয়ে গেলেও চোট লেগেছে৷ কপাল থেকে রক্ত ঝরছে৷ জামাকাপড় অবিন্যস্ত! মদের নেশায় চোখ লাল৷ বীভৎস মূর্তি নিয়ে লোকটা ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছে :

—‘হারামি…খানকির বাচ্চা! বদরী ধর শুয়োরটাকে! কাচে ইট মারা! তপন পালের মাথা ফাটানো! দেখে নেব বা…টাকে!’

নাইটওয়াচম্যান ততক্ষণে রাস্তায় চলে এসেছে৷ বটকেষ্ট বিট্টুকে ছেড়ে দিলেও নিজে পালানোর চেষ্টা করেনি৷ নাইটগার্ড বদরীপ্রসাদ হাতের কাছে তাকে পেয়েই কলার চেপে ধরল৷

—‘শালে! সাবজি কা কাচ তোড় দিয়া! সর ফোঁড় দিয়া!…চল……’

সে বিন্দুমাত্রও প্রতিবাদ করল না৷ নিজেকে দরোয়ানের হাত থেকে ছাড়ানোর চেষ্টাও নেই৷ বদরী তাকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে গেল তপন পালের ফ্ল্যাটে৷

তপন পালের কপাল থেকে রক্ত পড়ছিল৷ সে একটা তোয়ালে চেপে রেখেছে ক্ষতস্থানে৷ জামাটার বুক খোলা৷ গোরিলার মতো রোমশ বুক৷ পাঁচ মাসের পোয়াতির মতো ভুঁড়ি৷ লুঙ্গিটা নাভির নীচে এমনভাবে পরেছে যে ভয় হয়, এই বুঝি খসে পড়ল!

লোকটাকে দেখেই বটকেষ্টর গা ঘিনঘিন করে ওঠে…৷

তপন পাল একদৃষ্টে তাকেই দেখছিল৷ বটকেষ্টকে সে চেনে৷ বেশ কয়েকবার ওর দোকান থেকেই পান, সিগ্রেট কিনেছে৷ সে অত্যন্ত ধূর্ত লোক৷ লোক চরিয়ে প্রোমোটারি করে খায়৷ একঝলক দেখেই আন্দাজ করল, বোধহয় এ লোকটা এ কাজ করেনি৷ তার মতো লোকের বাড়ির জানলা ভেঙে দেওয়ার মতো সাহস হয়তো ওর নেই৷ তা ছাড়া একটা পানওয়ালা তার কপাল ফাটাতে যাবে কেন?

তবু সে তীব্র কণ্ঠে বলে, ‘তুই এখানে কী করছিস বে?’

বটকেষ্ট নিরুত্তর৷ সে মনে মনে ভাবছিল অন্য কথা৷ সব কথা ফাঁস করে দিলে কেমন হয়? এমন সাধের লটঘটটায় কাঠি হয়ে যাবে৷ প্রেমিকার ছেলে ইট মেরে নাগরের মাথা ফাটিয়েছে একথা জানতে পারলে পিরিত আর থাকবে কি? এমন সুন্দর রোজগারের রাস্তাটিও বন্ধ হয়ে যায়৷ মালতীবৌদির যাবতীয় সুখ, আরাম, বিলাসের মুখে ছাই পড়ে৷

—‘তুই এ কাজ করিসনি৷’ তপন পাল হিসহিসিয়ে বলে, ‘আমি মানুষ চিনি৷ তোর এত সাহস নেই৷ কিন্তু নিশ্চয়ই দেখেছিস কে করেছে৷ বদরী তোকে ফ্ল্যাটের সামনে থেকে ধরেছে৷ তুই কিছু জানিস না তা হতেই পারে না৷’

বটকেষ্টর গলার হাড় সামান্য নড়ল৷ যেন কিছু বলবে৷

মালতীবৌদি পাশের ঘর থেকে সশঙ্ক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন৷ স্পষ্ট না জানলেও আন্দাজ করতে পারেন এ কাজটা কে করেছে৷ অনেকদিন ধরেই এ আশঙ্কা ছিল৷ চাপা উত্তাপের আঁচও পেয়েছিলেন৷ কিন্তু একটা বাচ্চা ছেলের আক্রোশ এতদূর গড়াবে তা ভাবতে পারেননি৷

তিনি অসম্ভব আতঙ্কে বটকেষ্টর দিকেই তাকিয়েছিলেন৷ বটকেষ্টও সেদিকেই তাকাল৷

হঠাৎ চোখে চোখ পড়ে গেল!

—‘বল কে ইট মেরেছে৷’ তপন পাল যেন সাপের গলায় কথা বলছে; ‘নয়তো তোকে পুলিশে দেবো৷ পুলিশের মার খেলে বুঝবি তপন পাল কী চিজ৷ সিধা সিধা বল, নয়তো….৷’

বটকেষ্ট মালতীবৌদির ফ্যাকাশে মুখের দিকে একবার দেখে নিল৷ মহিলা আতঙ্কে সাদা! তার প্রাণভোমরা এখন এই কাঠিবাবুর হাতে৷ একটা নাম বললেই মাগীর ফূর্তিতে কাঠি!

তার চোখ মহিলার মুখ থেকে সরে গেল৷ ফ্ল্যাটের ভাঙা জানলা দিয়ে আকাশটা দেখা যাচ্ছে৷ স্বচ্ছ, সমুদ্রনীল আকাশটা আলোয় ভেসে যাচ্ছে! সে নিষ্পলকে সেদিকেই দেখছিল৷ উপরওয়ালা মিটমিট করে হাসছে৷ একটা চোদ্দো-পনেরো বছরের ছেলেকেও ছাড়েনি হারামজাদা!

—‘বলবি না পুলিশ ডাকব?’

আবার হুমকি!

সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে৷ বড় কাঠিবাবু যার পিছনে অন্তহীন কাঠি দিয়ে রেখেছে, এই নগণ্য কাঠিবাবু আর নতুন করে তাকে কি কাঠি দেবে?

—‘ডাকব পুলিশ?’

—‘যাকে খুশি ডাক৷’

হঠাৎ সমান আক্রোশে বলে ওঠে বটকেষ্ট৷ তার মুখ ক্রমশ হিংস্র হয়ে উঠছে! উদ্ধত অনমনীয় ভঙ্গিতে বলল :

‘আমিই ইট মেরেছি৷ বেশ করেছি! কী করবি…কর শা-লা!’

বিট্টুর চোখের চাপা রাগ বটকেষ্টর চোখে লেলিহান আগুন নিয়ে জ্বলে উঠেছে! ধক ধক করে দাবানল সব গ্রাস করে নিতে চায়৷ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দিতে চায় সব কিছু….!

শুধু ভস্ম….শুধু ভস্ম….আর কিছু না….!!!!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *