গুংগার গাছ

গুংগার গাছ

হঠাৎ একদিন বাজ পড়ে গাছটা পুড়ে গেল!

কয়েকদিন ধরেই তুমুল ঝড়বৃষ্টি চলছিল৷ খ্যাপা হাতির দঙ্গলের মতো হাওয়া তছনছ করে বেড়িয়েছে গোটা গ্রাম৷ উড়ে গেছে খড়ের চালা! দরমার বেড়া ভেঙে গেছে! ঘরবাড়ি বিপর্যস্ত!

এ গ্রামে শিবু মহাজন ছাড়া আর কারুর পাকা বাড়ি নেই৷ ভয়ার্ত বিপন্ন মানুষগুলো প্রথমে সেখানেই আশ্রয় চাইল৷ সেখান থেকে গলাধাক্কা খেয়ে শেষ পর্যন্ত প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নিল মহাকালীর মন্দিরে৷ বহুদিনের পুরোনো মন্দির৷ একসময়ে হয়তো শক্তপোক্তই ছিল৷ এখন তার অবস্থাও নড়বড়ে৷ ইঁট কাঠ পাথর সর্বস্ব শুধু প্রাচীন ফসিলটাই পড়ে আছে৷ থাকার মধ্যে রয়েছে মহাকালীর ভাঙাচোরা একটি বিগ্রহ আর একটা জংধরা ত্রিশূল৷

গ্রামের অসহায়, ঘরছাড়া মানুষগুলো সেই জরাজীর্ণ কঙ্কালকেই আঁকড়ে ধরে অনাহারে কয়েকটা দিন কাটিয়ে দিল৷ পেটে ভাতের এক কণাও নেই, তেষ্টা পেলে খাবার জল নেই, তবু মাথার উপরে একটা ছাত তো আছে! যদিও তার তলার মানুষগুলো মুহুর্মুহু ঝড়ের প্রচণ্ড দাপটে থরথর করে কেঁপে ওঠা ছাতের শব্দ শোনে৷ আর প্রমাদ গোনে, এই বুঝি ছাতটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল তাদের উপরে!

কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল দেবী মহাকালী এখনও মহাজনদের দলে ভেড়েননি৷ তাঁর দয়ায় মানুষগুলোর প্রাণ বাঁচল৷ চার দিন, চার রাত্তির বজ্রবিদ্যুতে সবাইকে ধমকে চমকে দিয়ে, গ্রামের নিস্তরঙ্গ জীবন ছারখার করে অবশেষে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিদায় নিল৷ কিন্তু বিদায় নেওয়ার আগে দিয়ে গেল শেষ কামড়! মধ্যরাত্রে আধোতন্দ্রায় থাকা মানুষগুলোকে কাঁপিয়ে দিয়ে গ্রামের প্রান্তসীমায় সেদিন একটা পেল্লায় বাজ পড়েছিল৷ লোকগুলো তার বিকট আওয়াজে ভয় পেয়ে কাঁপতে কাঁপতে মনে মনে ইষ্টনাম জপ করতে শুরু করে৷ অমন একটা বাজ যদি মন্দিরের উপরও পড়ে তাহলে আর রক্ষে নেই!

শেষ পর্যন্ত দেবীর অসীম কৃপায় কোনও অনর্থ হয়নি৷ ঝড়বৃষ্টি থেমে গেল৷ পরের দিন সকাল থেকে আবার সব স্বাভাবিক৷ মেঘ কেটে গিয়ে সোনালি রোদ্দুর উঠেছে৷ গ্রামবাসীরা আশ্বস্ত হয়ে নিজের নিজের ঘরের দিকে ফিরতে শুরু করে৷ ঘর তো তখন আর ঘর নেই! সব ধ্বংসস্তূপ! অবস্থা দেখে সবার মাথায় হাত! আপাতত প্রাণ বাঁচলেও মাথা গুঁজবে কোথায়, খাবে কী তার ঠিক নেই! মুখে শত দুশ্চিন্তার কাটাকুটি নিয়ে নীরবে, পরিশ্রান্ত দেহে ফিরে আসছিল তারা৷

এমন সময়েই পরিষ্কার আকাশ থেকে যেন আচমকা ফের একটা বাজ এসে পড়ল তাদের মাথায়! এ কী! এমন সম্ভাবনার কথা তো দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি! গ্রামের প্রান্তসীমায় ডালপালা মেলে এতদিন দাঁড়িয়েছিল গুংগার গাছ! সেটা কোথায়! কী সর্বনাশ!

তারা হাঁ করে দেখল গাছটা যেন ন্যাড়া হয়ে গেছে! তার মস্ত বড় বহর, বিস্তৃত ডালপালা শুকিয়ে এইটুকু! আগের রাতে যে মোক্ষম বাজটা পড়েছিল তার ধাক্কাতেই অতবড় বটগাছটা পুড়ে ছারখার!

দৃশ্যটা দেখে সবাই থ! কারুর মুখে কোনও কথা নেই৷ শুধু গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি, নারায়ণ দাদু বিড়বিড় করে বলেছিলেন, ‘সর্বনাশ! মহা সর্বনাশ!’

ছোট্ট পাঁচু নারায়ণ দাদুর কথা বুঝতে পারেনি, ‘কী হয়েছে দাদু?’

দাদু গাছটার দিকে আঙুল তুলে বললেন, ‘সনাতন গুণিন ওই গাছটার সাথে গুংগাকে বেঁধে রেখেছিল৷ এখন গাছটাও পুড়ে গেল! গুংগা ছাড়া পেয়ে গেছে৷ সারা গ্রামের উপর এবার মহা সর্বনাশ আসতে চলেছে!…মহা সর্বনাশ!’

—‘গুংগা কে?’

চতুর্দিক থেকে ‘চুপ চুপ’ ধ্বনি উঠল৷ নারায়ণ দাদু বললেন, ‘নাম নিস না পাঁচু৷ নাম নিলে ওদের শক্তি আরো বাড়ে৷’

—‘কার শক্তি বাড়ে?’

দাদু কোনও কথা না বলে তাঁর নীলাভ ধূসর চোখদুটো রেখেছিলেন পাঁচুর চোখের উপরে৷ সেই দৃষ্টিতেই পাঁচুর বুকের ভিতরটা শিমশিম করে উঠেছিল! অভুক্ত, অবসন্ন ছেলেটার মনে হয়, নিশ্চয়ই গুংগা কোনও ভয়ংকর কিছু৷ জন্ম থেকেই সে গুংগার গাছটাকে দেখে আসছে৷ কিন্তু কেন ওটার নাম ‘গুংগার গাছ’ তা তাকে কেউ বলেনি৷ যখনই জিজ্ঞাসা করেছে তখনই সবাই মিলে সভয়ে ‘চুপ চুপ’ করে উঠেছে৷ কৌতূহলী চোখে সে লক্ষ করেছে, একটা মোটা লাল রঙের দড়ি দিয়ে বটগাছটা বাঁধা! এমন ভাবে দড়িটা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে শক্ত করে আটকানো যে দেখলেই সন্দেহ হয়, শুধু গাছ নয়; গাছের সাথে আরও কাউকে বেঁধে রাখা হয়েছে৷

এতদিনে জানল যে গুংগাকে বেঁধে রাখা হয়েছিল গাছটার সঙ্গে৷ কিন্তু গুংগা কে? কোনও বদমায়েশ লোক?

সে কথা জিজ্ঞাসা করতেই নারায়ণ দাদু ফের ফিসফিস করে উঠলেন, ‘চুপ কর পাঁচু৷ ওদের বদমায়েশ বলতে নেই৷ এতদিন বাঁধা ছিল৷ এখন ছাড়া পেয়ে কী করবে ঠিক নেই৷ ওরা সব জায়গায় থাকতে পারে৷ হয়তো তোর পেছনে দাঁড়িয়েই সব শুনছে৷ যদি শোনে তুই ওকে ‘বদমায়েশ’ বলছিস…!’ বলতে বলতেই ডানহাতটা কপালে ছোঁয়ালেন, ‘দুগ্গা…দুগ্গা…৷’

তাঁর আশঙ্কা যেন আতঙ্ক হয়ে ছড়িয়ে পড়ল চতুর্দিকে৷ শীর্ণ মানুষগুলোর মুখ ভয়ে চুপসে গেছে৷ প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে যদিও বা রক্ষা পাওয়া গেল, গুংগার হাত থেকে বুঝি আর রক্ষা নেই!

গ্রামের নাম শিবনারায়ণপুর৷

এই পশ্চিমবঙ্গের মধ্যেই আরেক পশ্চিমবঙ্গ আছে যার খোঁজ খুব কম লোকেই রাখে৷ বেশির ভাগ লোকই সেই পশ্চিমবঙ্গকে চেনে না৷ শুধু কোনও কারণে সেখানে সাঙ্ঘাতিক কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে তবেই খবরের কাগজের পাতায় তার নাম জানা যায়৷ শহরের মানুষ গরম গরম চায়ের সাথে খবরের কাগজে সেই অঞ্চলের কথা পড়ে আর ভাবে, ‘আরে, এমন জায়গাও পৃথিবীতে আছে নাকি!’ তারপর অবশ্যম্ভাবী ভাবেই তার কথা ভুলে যায়৷

শিবনারায়ণপুর তেমনই অচেনা পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত ছোট্ট একটা গ্রাম৷ দশ বছর আগে দুর্ভাগ্যবশত খবরের কাগজে তার নাম দু-একবার এসেছিল৷ কলকাতায় যখন নানারকমের দেশি-বিদেশি খাবারের ভান্ডার উপছে পড়ছে, ঠিক তখনই শিবনারায়ণপুরে দুর্ভিক্ষ তার মরণখেলা দেখাচ্ছিল৷ না খেতে পেয়ে এ গ্রামের মানুষেরা মারা পড়ছিল৷ আঞ্চলিক অথবা ‘ম্যান মেড’ দুর্ভিক্ষে ঘর কে ঘর উজাড় হয়ে গিয়েছিল তখন৷

গুংগার কাহিনি তখনকারই৷ জ্যান্ত অবস্থায় সে এক বোবা-কালা নিরীহ মানুষ ছিল৷ তার ইতিহাস খুব সংক্ষিপ্ত৷ খিদের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে ওই বটগাছটায় গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল সে৷ বেঁচে থাকতে তাকে কেউ চিনত না৷ কিন্তু মৃত্যুর পর সে নিজেকে চেনাতে শুরু করল৷

সরকারি সাহায্য যতক্ষণে এসে পৌঁছল, ততক্ষণে না খেতে পেয়ে প্রায় অর্ধেক গ্রাম উজাড় হয়ে গিয়েছে৷ যারা বেঁচেছিল তারা অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে দিন কাটাচ্ছিল৷ সে অত্যাচারও অনেকের সহ্য হল না৷ বিষাক্ত খাবারের বিষক্রিয়ায় মারা গেল আরও অনেকেই৷ কেউ কেউ পালিয়ে প্রাণ বাঁচাল, কেউ ভিটেমাটির মায়ায় গ্রাম ছেড়ে পালাতে পারল না৷ শেষ পর্যন্ত মাত্র কয়েকঘর মানুষ দুর্ভোগ ও রোগের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে টিঁকে থাকল ওখানেই৷ আস্তে আস্তে খানিকটা স্বাভাবিক হল জনজীবন৷

কিন্তু এই ঘটনার বছরখানেক পর থেকেই শুরু হল আরেক উপদ্রব!

গুংগা, তথা বোবা লোকটার আসল নাম কেউ জানত না৷ বেশির ভাগ লোকই তাকে গুংগা নামে চিনত৷ আর যারা ওর আসল নাম জানত, তারা সকলেই দুর্ভিক্ষে ফৌত হয়ে গেছে৷ লোকটা না খেতে পেয়ে আত্মহত্যা করেছিল৷ কিন্তু মৃত্যুর পরও ওর অনির্বাণ খিদের জ্বালা শান্ত হয়নি৷ বিন্দিপিসির বুড়ো মোরগটা প্রথমে নিখোঁজ হয়েছিল, না রাসুখুড়োর কচি পাঁঠাটা; তা নিয়ে অনেক মতান্তর আছে৷ যাই হোক, দুটোকেই শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল ওই বটগাছটার নীচে৷ বলাই বাহুল্য আস্ত অবস্থায় নয়৷ মোরগটার ঝুঁটি, পালক আর কিছু হাড়গোড় এবং পাঁঠাটার স্রেফ মুন্ডু আর ল্যাজই বাকি ছিল! বাদবাকিটা যে কোথায় গেল কে জানে৷

সেই শুরু৷ তারপর ক্রমান্বয়ে একে একে লোপাট হতে শুরু করল নানারকমের খাদ্যবস্তু৷ নারায়ণ দাদুর হাঁস, পান্তজেঠুর মাচার আস্ত কুমড়ো, শিবু মহাজনের রান্নাঘর থেকে একটা আস্ত তাজা রুই হাওয়া হল! শুধু তাই নয়, সুবল চাষি সারাদিন মাঠে খেটে দুপুরবেলায় ওই বটগাছের ছায়াতেই বসে দুপুরের ভাত খাচ্ছিল৷ খাওয়া বলতে দু-মুঠো ভাত, নুন আর কাঁচালঙ্কা৷ সবে এক গরাস ভাত মুখে তুলতে যাবে, এমন সময় মাথার উপরে কী যেন অদ্ভুত একটা শব্দ! মুখ তুলে যা দেখল, তাতে তার রক্তহিম! হাতের ভাত ফেলে সেই যে দৌড় মারল, থামল গিয়ে সোজা পাঁচক্রোশ দূরে তার শ্বশুরবাড়িতে! উঠোনে দড়াম করে পড়ে শুধু একটা কথাই বলতে পেরেছিল, ‘গুংগা…গুংগা…!’ এর বেশি কিছু বলার আগেই মুখে ফেনা তুলতে তুলতে স্থির হয়ে গিয়েছিল সে৷

সুবল কী দেখেছিল তা কোনওদিনই জানা যায়নি৷ কিন্তু এসব যে গুংগার কাণ্ড তা বুঝতে কারুর বাকি রইল না! গ্রামের লোকেরা সঙ্গে সঙ্গেই ভূতের নামজাদা ওঝা সনাতন গুনিনকে ডেকে আনল৷ সনাতন রক্ষাকালীর মন্ত্রঃপূত জল ছিটিয়ে গ্রামবন্ধন করে ভৈরবকবচ সহযোগে গুংগার ক্ষুধিত প্রেতাত্মাকে লাল দড়ি দিয়ে আটকে ফেলল ওই গাছেই! তারপর থেকে সে ওই গাছে বন্দি হয়ে আছে৷ কারুর অনিষ্ট করার সুযোগ এখন তার নেই৷ তবে এখনও, বিশেষ করে অমাবস্যা বা পূর্ণিমায় তাকে গাছ থেকে ঝুলতে দেখা যায়৷ গ্রামের লোকেরা পারতপক্ষে ও রাস্তা মাড়ায় না৷ কিন্তু লোকমুখে শোনা যায় গুংগার ভীষণ প্রেতাকৃতির বর্ণনা! চোখ দুটো টকটকে লাল৷ কষ থেকে রক্ত বেয়ে পড়ছে! ভীষণ খিদেয়, অথবা শ্বাসকষ্টে তার জিভ ঝুলে আছে৷ আর সেই জিভ দিয়ে টপটপ করে চুঁইয়ে পড়ছে তাজা রক্ত!

সেই গুংগা এতদিন বাদে ছাড়া পেয়েছে৷ দশ বছর ধরে তার লালায়িত জিভ কোনও খাদ্যবস্তুর স্বাদ পায়নি৷ এখন সে তার ক্ষুধিত অন্তঃকরণ নিয়ে কী অনিষ্ট করবে কে জানে!

নারায়ণ দাদুর সমস্ত স্নায়ু শিথিল হয়ে আসে৷ তিনি বিড়বিড় করে মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র জপ করতে শুরু করেন৷

—‘সব্বোনাশ হয়ে গেছে গো দাদু!’

বিজু নাপিতের ছেলে সুখু কোনমতে হাঁফাতে হাঁফাতে এসে ভগ্নদূতের মতো সংবাদ দিল, ‘সনাতন গুণিন মরে গেছে৷’

রাসুখুড়ো বিস্মিত, ‘সেকী! কবে মরে গেল!’

—‘পরশু’৷ সুখু কোনমতে জবাব দেয়, ‘ঝড়বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়েছিল৷ মাথায় গাছ পড়ে মরে গেছে৷’

খবরটা শুনে সকলেরই মুখে ভয়ের ছাপ পড়ে৷ এ কী দুর্ভোগ! একেই ঝড়বৃষ্টির দরুন লোকগুলো সব হাঘরে-হাভাতে হয়েছে৷ কোথায় থাকবে, কী খাবে তার ঠিক নেই৷ তার উপর ভূতের ভয়! আর এরমধ্যেই সনাতনের মৃত্যুসংবাদ!

নারায়ণ দাদুর বলিরেখা কুঞ্চিত মুখে আরও কয়েকটা ভাঁজ চিড়বিড় করে উঠল৷ পুরোনো লোক হওয়ার দরুন অনেক খারাপ দিন দেখেছেন৷ সহজে বিচলিত হন না৷ কিন্তু দুঃসময় যেন এবার পিছু ছাড়তেই চাইছে না! একেই এ গ্রামে তেমন ভালো ফসল ফলে না৷ মাটি তেমন উর্বর নয়৷ তার উপর মহাজনের ধার! লোকটা একেবারে চশমখোর৷ পারলে বুকে পা দিয়ে টাকা আদায় করে৷ ওদিকে খেতে ধানের গোড়ায় জল জমে গেছে৷ বর্ষায় আশেপাশের পুকুরগুলো সব ভেসে যাওয়ার দরুন খেত থেকে জল নামছেই না৷ বাঁধ কেটেও জল নামানো যাচ্ছে না৷ পুকুর ভেঙে জল ক্রমাগতই ঢুকছে খেতের মধ্যে৷ নারায়ণ দাদু অভিজ্ঞ লোক৷ স্পষ্ট বুঝতে পারলেন খুব তাড়াতাড়িই আরেকটা দুর্ভিক্ষ আসতে চলেছে৷ ধান পচবে৷ ফসল হবে না৷ মহাজনের ধার শোধ তো দূরের কথা, নিজের ঘরে দু-মুঠো ভাতও জুটবে না৷

এর মধ্যেই মূর্তিমান কালান্তক গুংগা জিভ লকলকাচ্ছে৷ তিনি আর ভাবতে পারলেন না৷ রাসুখুড়ো তাঁর হতাশ মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তবে উপায়?’

উপায় অবশ্য করতে হল না৷ তার আগেই বিপদ এসে হাজির!

পেটে অন্নের দানা নেই৷ মাথা গোঁজবার জায়গা নেই৷ অবসন্ন, ক্ষুধার্ত মানুষগুলো ভূত তাড়ানোর আগে প্রাণধারণের কাজেই মন দিয়েছিল৷ কোনওমতে মাথার উপরে খড় দিয়ে একফালি চাল তৈরি করে মাটির উপরে খড় বিছিয়ে থাকছিল তারা৷ ছেলেমেয়েদের দু-বেলা খাওয়ানোর চিন্তা নেই৷ দশ বছরে শিবনারায়ণপুরে দুটো পরিবর্তন হয়েছে৷ প্রথমত, একটা সরকারি প্রাইমারি স্কুল৷ দ্বিতীয়ত, একটু দূরেই একটা দাতব্য হাসপাতালও তৈরি হয়েছে৷ প্রাইমারি স্কুলেই মিড ডে মিলের কৃপায় দুপুরের খাবারটা পাওয়া যায়৷ আর রাতে আলুসেদ্ধ, কলমিশাক সেদ্ধ দিয়ে কোনওমতে চালিয়ে দেওয়া যায়৷ ছোটদের একবেলা খিচুড়ি, ভাত-ডাল জুটলেও বড়দের কচু, ঘেঁচু, শাপলাই সম্বল৷ তাও না জুটলে পেয়ারাপাতা, তেঁতুলপাতা ভিজিয়ে কোনওমতে দিন গুজরান৷

ছোট্ট শিশুরা এ দুর্যোগের দিনেও বায়না করে, ‘মা, ভাত খাব৷ ভাত দে৷’

মা চোখের জল ফেলতে ফেলতে তাদের মুখে শাকসেদ্ধ তুলে দিয়ে বলে, ‘আজ এই খা বাপ৷ কাল ভাত দেব৷’

এভাবেই কেটে গেল কিছুদিন৷ দিনের পিছনে হপ্তা৷ তার পিছনে মাস৷ যতদিন যায় লোকগুলো ক্রমশ নির্জীব হয়ে পড়তে থাকে৷ এভাবে আর কতদিন? দশ বছর আগের দুর্ভিক্ষ কি তবে আবার ফিরে আসছে?

দুর্ভিক্ষ আসত কি না কে জানে৷ কিন্তু তার আগেই দশ বছর আগের আরেক আতঙ্ক ফিরে এল৷

সেদিন রাতে সুখুর ঘুম আসছিল না৷ পেটে খিদের লকলকে আগুন৷ এ-পাশ ও-পাশ করতে করতেই সে উঠে পড়ল৷

তখন মধ্যরাত্রি৷ সুখু চুপচাপ চালা থেকে বেরিয়ে গেল৷ একরকম হারা-উদ্দেশ্যেই বেরিয়েছিল৷ চতুর্দিকে ঘন অন্ধকার৷ আধফালি নীলাভ চাঁদ কেমন যেন নির্লজ্জ ক্রুর হাসি হাসছে৷ বট-পাকুড়ের পাতায় অদ্ভুত একটা খসখস শব্দ৷ ঝিঁঝিঁ পোকা কেমন যেন করুণ সুরে তান ধরেছে৷

কী মনে হতেই সে শিবু মহাজনের বাড়ির পথ ধরল৷ শিবুর পুকুরে অনেক মাছ আছে৷ তার খলবল শব্দ দূর থেকে শুনেছে৷ কিন্তু চতুর্দিকে কাঁটাতার থাকার দরুন মাছ চুরি করা অসম্ভব৷ তার উপর শিবু আবার একটা কুকুর পুষেছে৷ কুকুরটাও তার মালিকের মতোই হোঁৎকা৷ স্বভাবও তেমন৷ দেখলেই খ্যাঁকখ্যাঁক করে কামড়াতে আসে৷ সুখুর সন্দেহ হয় কুকুরটা আসলে শিবুরই যমজ ভাই৷ কুম্ভের মেলায় হারিয়ে গিয়েছিল৷ কোনও সাধু-সন্নিসির পিছনে কাঠি দিতে গিয়ে ব্রহ্ম-অভিশাপে কুকুর হয়ে গেছে৷ তাই সে কামড়াতে পারে৷ শিবু এখনও সে বিদ্যেটা রপ্ত করতে পারেনি৷

শিবুর বাড়ির কাছাকাছি আসতেই অদ্ভুত একটা খলখলাৎ শব্দ শুনতে পেল সে৷ দু-পা এগোতেই পায়ে জলের শীতল স্পর্শ! আর তার মধ্যেই যেন কী একটা আন্দোলন চলছে! হঠাৎ পায়ের কাছে মসৃণ কী যেন হুড়মুড় করে এসে পড়ল! ওরে বাবা! সাপ নাকি! সুখু তিন লাফ মেরে পিছিয়ে আসে৷ পরক্ষণেই চাঁদের আলোয় দেখতে পেয়েছে জিনিসটাকে৷ সাপ নয়, মাগুরমাছ! বেশ বড়সড়, হৃষ্টপুষ্ট৷ শিবুর পুকুর ভেসে যাওয়ায় মাছটা ডাঙায় এসে পড়েছে৷ ওঃ ভগবান!

সুখু একবারের চেষ্টাতেই খপাৎ করে ধরে ফেলল মাছটাকে৷ শক্ত করে ধরে পিছনে ফিরতে যাবে এমন সময়ই বিপদ! কে যেন তার হাত সবলে চেপে ধরল!

কী সর্বনাশ! শিবু মহাজন নাকি! সুখু ভয়ে ভয়ে সেদিকেই তাকায়৷ কিন্তু তাকিয়ে যা দেখল তাতে তার আত্মারাম খাঁচাছাড়া! শিবু নয়, একটা লম্বা কালো সিড়িঙ্গে লোক! লাল চোখদুটো অন্ধকারেও দপদপ করে জ্বলছে৷ ঘাড়টা দুমড়ে-মুচড়ে গেছে! আধহাত জিভ বের করে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার সামনে!

গুংগা!

পরদিন সকালে সুখুকে ওখানেই পাওয়া গেল৷ তখন সে অজ্ঞান! সারা গা ক্ষতবিক্ষত৷ কে যেন তাকে নিষ্ঠুরভাবে আঁচড়ে-কামড়ে দিয়েছে৷ অচেতন অবস্থায় সুখু প্রলাপ বকছিল, ‘ওই…গুংগা আসছে!…আমায় মেরে ফেলবে…খেয়ে ফেলবে…৷’

গ্রামের লোকেরা বুঝল গুংগা ফিরে এসেছে৷ শুধু ফিরেই আসেনি, কালান্তক মূর্তিতে এসেছে৷

গুংগার আতঙ্কে কয়েকদিনের মধ্যেই শিবনারায়ণপুর কাঁপতে শুরু করল৷ দশ বছর বাঁধা থেকে তার খিদে আগ্রাসী মূর্তি ধরেছে৷ প্রবৃত্তি হয়ে উঠেছে সহিংস৷

সুখুকে পাঠিয়ে দেওয়া হল দাতব্য হাসপাতালে৷ তার ক্ষত দেখে দাতব্য হাসপাতালের প্রবীণ ডাক্তার অবনীবাবু আঁতকে উঠলেন, ‘একী! এভাবে আঁচড়াল কে?’

সুখুর বাবা বিজু নাপিত হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘গুংগা৷’

বলাই বাহুল্য গুংগার তত্ত্ব অবনী ডাক্তারের মাথায় ঢুকল না৷ তিনি বারবার মাথা নেড়ে বলতে লাগলেন, ‘নাঃ, এমন ভাবে আঁচড়ানো কোনও মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়…আশ্চর্য!’

সুখুর ফ্যাকাশে মুখ দেখে তাঁর সন্দেহ হয়েছিল৷ পরীক্ষা করে নিশ্চিত হলেন ছেলেটার শরীরে রক্ত প্রায় নেই!

খবরটা শুনে গোটা শিবনারায়ণপুর কেঁপে উঠল! কী সর্বনাশ! অতবড় জোয়ান ছেলেটার শরীরে রক্ত নেই! গুংগা আঁচড়াতে কামড়াতে শিখেছে সেটা জানা কথা৷ কিন্তু সে যে রক্ত চুষতেও পারে তা জানা ছিল না! দশ বছরে তার খিদে এমন প্রলয়ংকর মূর্তি ধরেছে! এখন সে খাদ্যবস্তুতেও সন্তুষ্ট নয়৷ মানুষের রক্তও খেতে শুরু করেছে৷

সুখুর ঘটনার পর কয়েকটা দিন কেটে গেল৷ সারা গ্রাম আশঙ্কায় থমথমে৷ এবার কার পালা কে জানে! সবারই বুকের ভিতরে আতঙ্কের ঢিপঢিপ! গুংগা এবার সরাসরি আক্রমণ না করলেও চতুর্দিকে দেখা দিতে লাগল৷ বিন্দিপিসি একবার ভোর রাতে পুকুর থেকে জল আনতে গিয়ে দেখলেন একটা লম্বা সিড়িঙ্গে মূর্তি নিঃশব্দে গাছের মাথায় মাথায় লাফিয়ে বেড়াচ্ছে৷ রতন সর্দার মাটির ভিতর থেকে একটা বড়সড় রাঙা আলু টেনে তুলছিল৷ রাতে রাঙা আলু সেদ্ধ খেয়ে কয়েকটা দিন চলে যাবে তার৷ কিন্তু যেই মুহূর্তে আলুটাকে টেনেটুনে মাটির উপরে তুলেছে, তখনই চোখে পড়ল একটা বিরাটাকৃতি পাখি তার মাথার উপরে চক্কর কেটে বেড়াচ্ছে৷ পাখিটা ঠিক পাখি নয়৷ বরং একটা মানুষের মতো দেখতে তাকে! লম্বা কালো চেহারা, জিভ বের করা, ঘাড় মচকানো একটা মানুষ! তার জিভ দিয়ে টপটপ করে রক্ত পড়ছে!

‘আই বাপ’ বলে রাঙা আলু ফেলে সেই যে সে দৌড় মারল, বাড়ি না পৌঁছে থামল না৷

শিবনারায়ণপুর আতঙ্কে পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীর মতো পড়ে রইল৷ খরা, বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে লড়তে পারে৷ কিন্তু যে মানুষ নয়, অভদ্রের মতো আঁচড়ে-কামড়ে দেয়, গাছের মাথায় লাফ মেরে মেরে বেড়ায়, এমনকি উড়তেও পারে, এমন বিভীষিকার সাথে কী করে লড়বে!

এর ঠিক কয়েকদিন পরেই ঘটল তার দ্বিতীয় আক্রমণ!

আশেপাশের ডোবায় কিছু শাপলা-শালুক হয়েছিল৷ রাসুখুড়ো জলে নেমে রাতের খাবারের জন্য তাই সংগ্রহ করছিলেন৷ হঠাৎ তাঁর মনে হল ডোবার ভিতরে একটা ভীষণ কিছু কাণ্ড ঘটছে! জলের ভিতর অদ্ভুত আলোড়ন৷ খলবল খলবল করে জোরে জোরে শব্দ হচ্ছে৷ ভয় পেয়ে শাপলা সুদ্ধু তিনি জল থেকে উঠে আসতে যাচ্ছিলেন৷ তার আগেই জলের ভিতর থেকে দুটো কালো কুচকুচে হাত বিদ্যুৎবেগে বেরিয়ে এসেছে৷ কথা নেই বার্তা নেই, হাত দুটো তাঁর গলা টিপে ধরল৷ অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তে রাসুখুড়ো দেখতে পেলেন জলের তলায় একটা বীভৎস মুখ! লাল টকটকে চোখ, রক্তাক্ত জিভ৷ আর আগে যা কেউ কোনওদিন লক্ষ করেনি তাও নজরে পড়ল তাঁর৷ দেখলেন মুখটার কষ বেয়ে বেরিয়ে এসেছে দুটো তীক্ষ্ণ সুঁচলো শ্বদন্ত!

রাসুখুড়োও মরতে মরতে বেঁচে গেলেন৷ দাতব্য হাসপাতালের অবনী ডাক্তার তাঁকে দেখেও অবাক হলেন৷ আশ্চর্য! এই মানুষটির দেহেও রক্ত প্রায় নেই বললেই চলে! এইবার তাঁকে চিন্তিত লাগল৷

শিবনারায়ণপুরের লোকেরাও জানল যে গুংগার তীক্ষ্ণ দাঁতও আছে৷ সেই দাঁত দিয়ে ফুটো করে সে শরীরের রক্ত চুষে নেয়৷

এমন খবর খুব বেশিদিন চাপা থাকে না৷ গুংগার আতঙ্ক শিবনারায়ণপুর থেকে ছড়িয়ে পড়ল চতুর্দিকে৷ কলকাতা থেকে খবরের কাগজের লোক এল৷ পিছন পিছন এল টেলিভিশন চ্যানেল৷ গুংগার খবর কভার করার জন্য তারা দিনের পর দিন ওখানেই পড়ে থাকল৷ কয়েকদিনের মধ্যে এসে পড়লেন প্যারাসাইকোলজিস্ট, স্পিরিচুয়ালিস্টরা৷ তাঁরা ভূত দেখার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন৷ যুক্তিবাদী, নাস্তিকরাই বা বাদ থাকেন কেন? তারাও হাজির৷ ভূত আছে কি নেই; সেই নিয়ে লাগল জব্বর তর্ক৷ যুক্তিবাদীদের মধ্যে প্রধান ডঃ বিশ্বাস বললেন, ‘কোথায় ভূত? ওসব স্রেফ গাঁজাখুরি কথা৷’

প্যারাসাইকোলজিস্ট ডঃ দেবরায় বললেন, ‘ভূত যদি না থাকে তবে এখানে কী হচ্ছে? গুংগার কীর্তি তো নিজের কানেই শুনছেন৷’

—‘শুনতে তো অনেক কিছুই পাই৷ লোকে বলছে সে নাকি উড়ে বেড়ায়, জলে ডুবে থাকে, গাছের মাথায় লাফিয়ে বেড়ায়৷ কিন্তু এরমধ্যে একটাও তো চোখে দেখলাম না৷’

বেশ কিছুক্ষণ চাপান-উতোর চলল৷ শেষ পর্যন্ত ঠিক হল যে সামনের অমাবস্যায় প্ল্যানচেট করে গুংগাকে ডাকা হবে৷ অবিশ্বাসীদের চক্ষু-কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন হবে৷

ডঃ বিশ্বাস হেসে বললেন, ‘প্ল্যানচেট করে কোন হাতির মাথা হবে? মিডিয়াম তো হবে আপনার লোক৷ সে তো আপনার কথা মতোই চলবে৷’

ডঃ দেবরায় বাকবিতণ্ডায় না গিয়ে গ্রামের প্রাচীন বাসিন্দা নারায়ণ দাদুকেই নিরপেক্ষ মিডিয়াম হিসাবে বেছে নিলেন৷ ঠিক হল তিনদিন পরে, অমাবস্যায় প্ল্যানচেট হবে৷ দাদু প্রথমে কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না৷ শেষ পর্যন্ত নগদ পাঁচহাজার টাকার বিনিময়ে রাজি হলেন৷

অন্যদিকে টিভি চ্যানেলের লোকেরা রাত দুপুরে ক্যামেরা নিয়ে শিবনারায়ণপুর টহল দিতে শুরু করল৷ সেই পোড়া গাছটাকে দেখিয়ে বলল, ‘এই দেখুন সেই গাছ৷ এখানেই কালান্তক গুংগাকে এতদিন বেঁধে রাখা হয়েছিল৷ বেঁধেছিলেন সনাতন গুণিন৷ আজ সেই গুংগা তার অসীম খিদে নিয়ে এখানেই কোথাও ঘুরে বেড়াচ্ছে…রক্ত চুষে বেড়াচ্ছে…’

টেলিভিশনের টি আর পি ধরধর করে বাড়তে লাগল৷ রিপোর্টাররা গুংগার ইতিহাস এবং তার বর্ণনা এমনভাবে জানাতে লাগল যেন স্বচক্ষেই তাকে দেখেছে৷ আসলে গোটাটাই গ্রামের মানুষের কাছে শোনা কথা৷ যথারীতি মাগনায় নয়৷ রীতিমতো কাঞ্চনমূল্যে! ছোট্ট পাঁচুর আঁকা গুংগার ছবি, গুংগার মুখোশ দেখিয়ে তারা দর্শককে ভয় দেখাতে শুরু করল৷ আর দর্শকরা গভীর রাতে একা হলঘরে বসে ভয় পেতে পেতেও গোগ্রাসে গিলতে লাগল প্রত্যেকটা বুলেটিন!

—‘খুড়ো, কী মনে হয়?’

হাসপাতালের বেডে শুয়ে সুখু গভীর রাতে রাসুখুড়োর সাথে কথা বলছিল৷

—‘কীসে কী মনে হয়?’ হাই তুলে রাসুখুড়ো বললেন৷

—‘নারাণ দাদু ঠিকমতো গুংগার অ্যাক্টো করতে পারবে? লোকগুলোকে ভয় দেখাতে পারবে?’

—‘সে আর বলতে?’ রাসুখুড়োর নির্লিপ্ত উত্তর, ‘এ মতোলব তো তারই৷ তুই বাপের খুর দিয়ে হাত-পা কাটলি৷ আমি ডুবে ডুবে একপেট জল খেলাম তো তার কথাতেই৷ বুড়ো ঠিক উতরে দেবে৷ ভাবিস না৷’

সুখু বিড়বিড় করে বলে, ‘যখন দুর্ভিক্ষে লোক মরছিল, তখন কাকপক্ষীতেও আসেনি৷ আর এখন দেখো, ভূত দেখার জন্য কড়কড়ে নোট দিয়ে কতলোক চালা ভাড়া করছে৷ পয়সা দিয়ে মুখোশ কিনছে৷ গপ্পো শোনার জন্য টাকা দিচ্ছে৷ আরও কত কী! ডাক্তার বলে গায়ে রক্ত নেই৷ আলু, কচুসেদ্ধ, শাপলা খেয়ে কি কারও শরীরে রক্ত হয়?’

রাসুখুড়ো মৃদু হাসলেন, ‘শিবনারায়ণপুর তীত্থ হয়ে গেল; বুঝলি? এখন দু-বেলা দু-মুঠো ভাত জুটবে অন্তত৷’

—‘হয়তো৷ বুঝলে খুড়ো, কাল ডাক্তারকে বলব দু-মুঠো ভাত দিতে৷ এই লাপসি খেতে আর ভালো লাগে না৷ তার সাথে একটু ডাল কি দেবে না বলো?’

রাসুখুড়ো কোনও উত্তর না দিয়ে পাশ ফিরলেন৷ হোক লাপসি৷ তবু ঢঙের খাবার তো বটে৷ ভাতের কথা মনে পড়তেই মন হু হু করে উঠল৷ কতদিন ভাতের গন্ধ পাননি৷ নারায়ণ বলেছিলেন, ‘কটা দিন হাসপাতালে থাক৷ অন্তত দু-বেলা দু-মুঠো খেতে পাবি৷ শোওয়ার বিছানা পাবি৷’

এইটুকুর জন্যই এত নাটক!

—‘আচ্ছা খুড়ো…৷’ সুখু ফের বলল, ‘সত্যিই কি গুংগা বলে কেউ ছিল?’

—‘জানি না৷’ খুড়ো বলেন, ‘যদি থাকেও তবু তাকে ভয় নেই৷ দুনিয়ায় খিদের চেয়ে বেশি ভয়ংকর আর কিছু নেই৷ বুঝলি?’

বলতে বলতেই কপালে হাত ঠেকান তিনি৷ যে লোকটা দশ বছর আগে না খেতে পেয়ে মারা গিয়েছিল, আজ তার জন্যই হয়তো গোটা গ্রাম বাঁচবে৷ এখন ভালোয় ভালোয় নারায়ণবুড়ো শেষটুকু সামলে নিলেই হয়৷ দুগ্গা…দুগ্গা…!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *