যে ফিরে এসেছিল

যে ফিরে এসেছিল

‘আপনি কখনও মৃত্যুকে দেখেছেন?’

নাতালিয়ার এই আকস্মিক প্রশ্নে একটু হতভম্ব হয়ে গেলেন জর্জ উইলিয়ামস৷ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালেন নাতালিয়ার দিকে৷ বিকেলের পড়ন্ত রোদ নাতালিয়ার সাদা আইভরির মতো মুখে একচিলতে রক্তিম আলো এঁকে দিয়েছে৷ বাদামি চুল সমুদ্রের হাওয়ায় ফুরফুর করে উড়ছে৷ উজ্জ্বল সবুজাভ চোখদুটোয় সন্ধ্যাকালীন ছায়ামাখা রহস্য৷ গোলাপি ঠোঁটদুটো স্মিত হাস্যে ভরপুর৷ যেন ভারী কৌতুকময় এক প্রশ্ন করেছেন তিনি!

‘মৃত্যু!’ জর্জ একটু ইতস্তত করে বলেন, ‘শুধু আমি কেন, এ দুনিয়ার কোনও জীবিত মানুষ তাকে দেখেছে বলে মনে হয় না!’

‘যদি বলি আপনার ধারণা ভুল?’ হাসিটা এবার নাতালিয়ার চোখ উপচে পড়ে, ‘যদি বলি আমি তাকে দেখেছি এবং একাধিকবার দেখেছি, তবে কি আপনি আমায় পাগল ভাববেন?’

‘ওঃ!’ তিনি একটু দুঃখিত স্বরে বলেন, ‘আই অ্যাম সরি৷ হ্যাঁ, আমি শুনেছি যে আপনি জীবনে অনেকগুলো মৃত্যুই প্রত্যক্ষ করেছেন৷ আপনার মা শৈশবেই মারা যান৷ আপনার বাবাও একটা অ্যাক্সিডেন্টে মারা গিয়েছিলেন…তারপর আপনার স্বামী…!’

‘না না! তেমনভাবে নয়!’ নাতালিয়া মাথা নাড়েন, ‘সেরকম মৃত্যু সবাই দেখেছে৷ কিন্তু স্বয়ং মৃত্যুকে কেউ দেখেছে কি? আমি কিন্তু তাকে দেখেছি৷ একদম সেইভাবে যেমন এখন আপনাকে দেখছি৷’

এ কী অসম্ভব কথা! নাতালিয়া গোমসকে আর যাই হোক, পাগল ভাবা অসম্ভব! বরং এমন ধীর, স্থির, অসম্ভব বুদ্ধিমতী নারী খুব কমই দেখা যায়৷ তাঁর স্বামী রবার্ট গোমস গোয়ার নামকরা বিত্তবানদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন৷ রবার্টের প্রয়াণের পর এই নারী একাই সামলেছেন গোটা ব্যবসা৷ তিলে তিলে প্রায় দ্বিগুণ করেছেন স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তির পরিমাণ৷ যাঁর ব্যবসায়িক বুদ্ধি এমন তীক্ষ্ণ, তাঁকে কিছুতেই পাগল বলা চলে না! অথচ তিনি যা দাবি করছেন, এককথায় তা অসম্ভব!

জর্জ কী বলবেন ভেবে পেলেন না৷ তিনি নাতালিয়া গোমসের একটি সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য কিছুদিন ধরেই চেষ্টা করছিলেন৷ কিন্তু গোয়ার ‘হোটেল বিজনেসের’ মুকুটহীন সম্রাজ্ঞীর কাছে পৌঁছনো খুব সহজ ছিল না৷ অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর শেষ পর্যন্ত একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেয়েছেন৷ কিন্তু নাতালিয়া সম্পর্কে তাঁর যে ধ্যান-ধারণা ছিল, প্রথম সাক্ষাতেই তা আমূল পালটে গেল৷ ভেবেছিলেন, অত্যন্ত উন্নাসিক, আপাদমস্তক অলঙ্কারে সজ্জিতা কোনও জটিল চরিত্রের মহিলাকে দেখবেন৷ অথচ নাতালিয়া তার একদম বিপরীত! তাঁর বয়েস ষাটের কাছাকাছি, কিন্তু মুখে এখনও কোনও বলিরেখা পড়েনি৷ কানে দুটি বড় বড় হিরের দুল এবং গলায় একটি মিনে করা ক্রুশের লকেট যুক্ত সোনার চেন ছাড়া আর কোনও অলঙ্কার পরেননি তিনি৷ তাঁর বিরাট প্রাসাদের সামনের লনেই বসার ব্যবস্থা হয়েছিল৷ একটি সাদা রঙের গাউন পরে, মুখে শিশুর মতো সরল হাসি নিয়ে যখন নাতালিয়া দেখা দিলেন, তখন রীতিমতো বিস্মিত হয়েছিলেন জর্জ৷ কারণ তথাকথিত ‘সম্রাজ্ঞী’র হাতে একটি চায়ের ট্রে! কোনও চাকর বা দাস-দাসী বৈকালিক চায়ের ট্রে-টা বয়ে নিয়ে আসছে না! টেবিলের ওপরে কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে ট্রে নামিয়ে রেখে নাতালিয়া হেসে বললেন, ‘স্যান্ডুইচ আর কেকটা কিন্তু আমিই বানিয়েছি৷ আশা করি খারাপ লাগবে না৷’

ব্যস, তারপর থেকেই জর্জ অনেকটাই সহজ হয়ে গিয়েছিলেন৷ নাতালিয়ার সঙ্গে কথোপকথনও চলছিল পুরোদমে৷ নাতালিয়া অত্যন্ত স্বচ্ছন্দ৷ জর্জ এই প্রৌঢ়ার ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে পড়ছিলেন৷ শেষমেশ সাহস করে বলেই ফেললেন, ‘আচ্ছা নাতালিয়া, আপনার জীবনে এমন কোনও ঘটনা আছে কি, যা আজ পর্যন্ত আপনি কাউকে কখনও বলেননি?’

কথাটা শুনতেই নাতালিয়ার মুখে অদ্ভুত একটা রহস্যময় হাসি ভেসে উঠল৷ তিনি মৃদু হেসে বললেন, ‘এক্সক্লুসিভ কিছু খুঁজছেন?’

এবার একটু বিব্রত বোধ করলেন জর্জ৷ অপ্রস্তুত হেসে কিছু একটা বলতেই যাচ্ছিলেন, তার আগেই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো মাথায় এসে পড়ল সেই অদ্ভুত প্রশ্ন, ‘আপনি কখনও মৃত্যুকে দেখেছেন?…’

জর্জ পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেবেন বুঝতে পারছিলেন না৷ নাতালিয়া দাবি করছেন যে তিনি স্বয়ং মৃত্যুকে দেখেছেন! যা একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার! অথচ মুখের ওপর কিছু বলার সাহসও নেই৷ ভদ্রমহিলা কি সামান্য ছিটগ্রস্তা! অথচ এতক্ষণের কথোপকথনে তো তেমন কিছুই মনে হল না! বরং তাঁর স্বভাবটি বড়ই মধুর৷ একবারের জন্যও মনে হয়নি যে তাঁর মধ্যে কোনওরকম অস্বাভাবিকতা আছে! অথচ…!

‘জানি, আপনার বিশ্বাস হবে না৷’ নাতালিয়া দূরের সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক স্বরে বললেন, ‘আপনি কেন, কেউই একথা বিশ্বাস করবে না৷ আপনি কী ভাবছেন তাও বুঝতে পারছি৷ ভাবছেন, আমার মাথায় কোনও গোলমাল আছে৷ তাই না?’

জর্জ আমতা আমতা করেন, ‘না…না! কী বলছেন…!’

‘আপনার দোষ নেই মিঃ উইলিয়ামস৷ যে কোনও মানুষই তাই ভাববে৷’ তাঁর কণ্ঠস্বরে অদ্ভুত একটা রহস্য ঘনিয়ে এসেছে, ‘কিন্তু এটাই ফ্যাক্ট৷ স্বয়ং মৃত্যুকে আমি দেখেছি৷ আজ পর্যন্ত কাউকে বলিনি সেকথা৷ রবার্টকে বলিনি৷ ছেলে ফ্রান্সিসকেও না৷ আপনি এক্সক্লুসিভ স্টোরি চাইছিলেন না? এই হল সেই এক্সক্লুসিভ স্টোরি যা হয়তো একদিন আমার কবরের সঙ্গেই মাটিচাপা পড়ে যাবে৷ আমার জীবনের গোপনতম সত্য, যা আর কেউ জানে না৷ আপনি যদি শুনতে চান, তবে বলতে পারি৷ ছাপবেন কি ছাপবেন না, সেটা আপনার ব্যাপার৷’

জর্জের মনেও একটা অদ্ভুত কৌতূহল একটু একটু করে শিকড় ছড়াচ্ছিল৷ ঠিক কী বলতে চাইছেন ভদ্রমহিলা! আর যা-ই হোক, গল্পটা শুনতে তো বাধা নেই৷ তিনি দৃঢ় স্বরে বললেন, ‘অবশ্যই শুনব৷ বলুন৷’

‘এক মিনিট৷’ নাতালিয়া তাঁকে আরও অবাক করে দিয়ে আকস্মিকভাবে উঠে চলে গেলেন৷ মিনিটখানেক পরেই অবশ্য ফিরে এসেছেন৷ তাঁর হাতে একটা বহু পুরোনো অ্যালবাম৷

‘এটা দেখুন৷ এর মধ্যে আমার বাবার ছবি আছে৷’ তিনি জর্জের হাতে অ্যালবামটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমার বাবার নাম স্টিভ গঞ্জালভেস! সারা গোয়ায় তাঁর মতো আর্টিস্ট খুব কমই ছিল৷ আর তাঁর মতো বাবা গোটা বিশ্বেও ছিল না, নেই, থাকবেও না! হি ওয়াজ দ্য বেস্ট ফাদার অফ দ্য ইউনিভার্স!’

বলতে বলতেই নাতালিয়ার কণ্ঠস্বর ভিজে এল৷ তিনি কোনওমতে নিজের আবেগকে সংবরণ করলেন৷ জর্জ তখন অ্যালবামের ছবিগুলো মন দিয়ে দেখছিলেন৷ ছবিতে শিশু নাতালিয়াকে চিনতে একটুও অসুবিধে হল না৷ তাঁকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন যে হাস্যমুখ যুবক, সম্ভবত তিনিই নাতালিয়ার বাবা স্টিভ গঞ্জালভেস৷ হাসলে গালে চমৎকার একটি টোল পড়ে৷ লম্বা ছিপছিপে সুন্দর চেহারা, কাটাকাটা মুখ! প্রশস্ত কপালের নীচে শান্ত অথচ বুদ্ধিদীপ্ত চোখ৷ থুতনিতে একটা কাটা দাগ৷ আর ডানহাতের কব্জিতে কালো রঙের ট্যাটুতে লেখা আছে, ‘নাতালিয়া’৷

জর্জ পরম কৌতূহলে এবার নাতালিয়ার দিকে তাকান৷ নাতালিয়া একটু সময় নিলেন৷ যেন নিজেকে প্রস্তুত করছেন গল্পটা বলার জন্য৷

সন্ধ্যার রহস্যময় আলো তখন চতুর্দিকে আলোছায়া মাখা পরিবেশ সৃষ্টি করেছে৷ সেই আলো-আঁধারিতেই শুরু হল এক অদ্ভুত গল্প!

মৃত্যুর গল্প!

‘যখন আমার বয়েস প্রায় দু-বছর, তখনই আমার মা মারা গেলেন৷ মৃত্যু কী জিনিস তা বোঝার মতো জ্ঞান তখন ছিল না৷ শোক অনুভব করার মতো বিচার-বুদ্ধি তখনও ঈশ্বর আমায় দেননি৷ তাই মায়ের চলে যাওয়াটা আমার জীবনে তেমন দাগ কাটেনি৷ দাগ কাটার উপায়ও ছিল না! একটি মানুষ চলে গেলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয় তা আমার বাবা নিজের সবটুকু দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছিলেন৷ মাতৃহীন শিশুটিকে সেই যে তিনি বুকে আগলে নিলেন, দুনিয়ার কোনও শোক-তাপ সেই স্নেহের বন্ধনকে ভেঙে আঁচড়টুকুও কাটতে পারেনি তাঁর সন্তানের গায়ে৷ স্নেহে-মমতায় একাধারে তিনিই আমার মায়ের জায়গা দখল করলেন, অন্যদিকে দায়িত্ব-কর্তব্যে একজন আদর্শ পিতার ভূমিকাও নিঃশব্দে পালন করে গেলেন৷

আমরা গরিব ছিলাম৷ কিন্তু আমি নিজে কখনও দারিদ্রকে অনুভব করতে পারিনি৷ আমার বাবা চিত্রকর ছিলেন৷ অপূর্ব ছবি আঁকতেন৷ সেইসব ছবি বিদেশি টুরিস্টরা ‘আহা…আহা’ করে কিনে নিয়েও যেত৷ কিন্তু সে উপার্জন একটি পরিবার চালানোর পক্ষে যথেষ্ট ছিল না৷ অথচ কী যেন এক অদ্ভুত ম্যাজিকে বাবা আমাকে রাজকুমারীর মতো আদরে বড় করতে লাগলেন৷ আমাকে ডাকতেন, ‘প্রিন্সেস’ বলে৷ অভাবের ছায়াও কোনওদিন আমার গায়ে পড়েনি৷ দামি দামি জামা, পুতুল কিনে দিতেন৷ আমি যা যা খেতে ভালোবাসতাম নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াতেন৷ আমি নাচতাম, উনি পিয়ানো বাজাতেন৷ রাত্রে যখন ঘুম আসত না তখন গান গেয়ে ঘুম পাড়াতেন, ‘ফর ইওর গ্রেস ইজ এনাফ!’ লোকে প্রিয় মানুষের নাম হাতে খোদাই করে! বাবা নিজের ‘প্রিন্সেসে’র নাম হাতে খোদাই করেছিলেন৷ আমরা দুজন ছাড়া দুনিয়ায় আমাদের আর কেউ ছিল না!

আমি গোয়ার সবচেয়ে বড় মিশনারি স্কুলে ভর্তি হলাম যেখানে পড়াশোনা চালানো যথেষ্ট ব্যয়সাধ্য! একজন দরিদ্র শিল্পীর পক্ষে সে ব্যয়ভার বহন করা সহজ নয়৷ কিন্তু মজার ব্যাপার হল, কোনওদিন আমার স্কুলের ফিজ বাকি পড়েনি৷ স্কুলড্রেস, বই, খাতা-পত্র সবই সময়মতন চলে আসত৷

আমি দেখতাম, তাঁর পায়ের শতচ্ছিন্ন জুতোজোড়ার একপাশ দিয়ে বেরিয়ে আসছে বুড়ো আঙুল! কিন্তু নতুন জুতো কিছুতেই কিনবেন না! ক্রিসমাসে, বার্থডেতে কেক আনতে কোনওদিন ভোলেননি৷ বাবা সে কেক নিজে কোনওদিন খাননি৷ ওই ছোট্ট কেকটা শুধু আমার জন্যই আসত৷ তিনি তাঁর যথাসর্বস্ব বিক্রি করে আমাকে পড়িয়েছিলেন৷ মাঝেমধ্যেই আমাদের বাড়িতে কিছু লোক এসে হল্লা করত৷ তারা কারা সে কথা বাবা কোনওদিন বলেননি৷ এখন বুঝি, ওরা পাওনাদার ছিল৷’

বলতে বলতেই নাতালিয়ার কণ্ঠস্বর বুঁজে আসছিল৷ জর্জ নীরব শ্রোতা৷ নাতালিয়ার মুখের দিকে গভীর কৌতূহলে তাকিয়ে রয়েছেন৷ একটু বিরতি দিয়েই ফের বলতে শুরু করলেন তিনি :

‘আস্তে আস্তে বড় হলাম৷ কলেজের পড়া শেষ হল৷ দুর্দান্ত রেজাল্ট করলাম৷ কিন্তু আমার আনন্দের থেকেও বাবার গর্ব ছিল অনেক বেশি৷ তিনি পাড়ার সবাইকে ডেকে ডেকে বললেন, ‘দেখো, আমার মেয়ে কত মেধাবী!’ তাতেও তাঁর শান্তি হল না৷ তিনি ফের ধারদেনা করে এক জোড়া বড় বড় মুক্তোর দামি দুল কিনলেন আমাকে গিফট দেবেন বলে৷ মুক্তোর দুল পরার যে আমার খুব সাধ ছিল তা বাবা জানতেন৷ কীভাবে আমাকে চমকে দেবেন, দুলদুটো দেখে আমি কতটা খুশি হব; সেই কল্পনা করতে করতেই তিনি প্রায় হাওয়ায় উড়তে উড়তে বাড়িতে ফিরছিলেন৷ আর এই উত্তেজনা ও আনন্দের ফল হল মর্মান্তিক! বাবা অন্যমনস্ক ছিলেন৷ দুর্দান্ত বেগে ছুটে আসা গাড়ির হর্ন শুনতেই পাননি! যখন টের পেলেন তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে৷ গাড়িটা তাঁকে প্রায় পিষে দিয়ে চলে গেল!

জীবনে এই প্রথম বুঝলাম, শোক কাকে বলে! শূন্যতার জ্বালা কী! অ্যাক্সিডেন্ট কেস বলে বাবার দেহটার পোস্টমর্টেম হয়েছিল৷ সেই কাটাছেঁড়া করা শরীরটাকে যখন সমাধিস্থ করে ফিরে এলাম, তখন শূন্য ঘর যেন আমায় তেড়ে গিলতে এল! তিনদিন, তিনরাত বাইরে বেরোইনি৷ রাতের বেলা সারা ঘরে খুঁজে খুঁজে ফিরতাম বাবাকে৷ কান্নাজড়ানো স্বরে ডাকতাম! বিশ্বাস ছিল, আমার কান্না শুনে যে মানুষটা অস্থির হয়ে পড়ত, সে নিশ্চয়ই সাড়া দেবে৷ নিজের প্রিন্সেসের চোখের জল কোনওদিন বাবার সহ্য হয়নি৷ কিন্তু জীবনে এই প্রথম ব্যথিত সন্তানের কান্নায় বাবা সাড়া দিলেন না৷ বুঝতে পারলাম, বাবা ফিরবেন না৷ এবং তাঁকে ছাড়া আমি বাঁচব না৷ তিনি ছাড়া আমার কেউ ছিল না, কেউ নেই! তবে এই শূন্য জীবনের মানে কী! তাই একরাতে ছুরি দিয়ে নিজের কবজি কেটে ফেললাম! আর ঠিক তখনই দেখলাম ওকে…!’

‘কাকে?’ জর্জ ঝুঁকে পড়েন নাতালিয়ার দিকে৷

‘মৃত্যুকে! হ্যাঁ, সে মৃত্যু ছাড়া আর কেউ নয়! হতেই পারে না! যখন আমার শরীর থেকে সমস্ত রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে আমি আস্তে আস্তে হাল্কা হয়ে যাচ্ছি,…দেহটা যেন শূন্যে তুলোর মতো ভাসছে; একটা ভীষণ আরামের ঘুম এসে আমায় গ্রাস করছে; ঠিক তখনই সে সামনে এসে দাঁড়াল! ধবধবে সাদা গায়ের রং, অপূর্ব মুখশ্রী, দেখলে তাকে তরুণ বলেই মনে হয়—অথচ উজ্জ্বল নীল চোখদুটোয় যেন কয়েক হাজার বছরের প্রজ্ঞা! পরনে সাদা রেশমি পোশাক, উজ্জ্বল জ্যোতির্বলয় তাকে ঘিরে আছে৷ কী শান্ত! কী সৌম্য! সে আমায় হাত তুলে বারণ করল৷ তার ঠোঁট নড়ল না, কিন্তু আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম সে বলছে, ‘না! না! ফিরে যাও! এখনও তোমার সময় হয়নি! শিগগিরই ফিরে যাও৷’

আমি বললাম, ‘না৷ বাবাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না৷ ওই একটি মানুষ ছাড়া আমার আর কেউ নেই! তুমি তাকে কেড়ে নিয়েছ৷ এখন আমাকেও নাও৷’

সে মাথা নাড়ল৷ উজ্জ্বল চোখদুটো যেন নীলাভ বরফের মতো শীতল৷ তার মোলায়েম কণ্ঠস্বর আবার শুনতে পেলাম, ‘আমি কাউকে কেড়ে নিইনি৷ তোমার বাবার যতটুকু আয়ু ছিল, তিনি ঠিক ততটুকুই বেঁচেছেন৷ এটাই প্রকৃতির নিয়ম৷ নিয়তির ওপর কারোর হাত নেই৷’

‘আমি অত বুঝি না!’ আমি এবার কেঁদে ফেললাম, ‘আমি মরতে চাই৷ বাবা না থাকলে আমার কাছে এ জীবন অর্থহীন! তুমি তো মৃত্যু! তুমি আমাকে বাবার কাছে নিয়ে চলো৷’

‘তা হয় না৷’ সে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করে, ‘তোমার আয়ুষ্কাল এখনও অনেক বাকি৷ আমি নিয়মবিরুদ্ধ কাজ করতে পারি না৷’

আমিও নাছোড়বান্দা৷ বললাম, ‘যদি তাই হয়, তবে আমার বাবাকেও ফিরিয়ে দাও৷ তুমি সব পারো৷’

‘অসম্ভব!’ সে জানায়, ‘তা হয় না৷ বোঝার চেষ্টা করো! ওঁর নিয়তিতে যা লেখা ছিল, তা হয়েছে৷ যার জীবন শেষ হয়ে গিয়েছে, তাকে ফিরিয়ে দেওয়া যায় না৷ কথা শোনো, তুমি ফিরে যাও৷ বাবার মায়া কোর না৷ তিনি যেখানে আছেন, শান্তিতেই আছেন৷’

বলাই বাহুল্য যে আমি তার কথা শোনার পাত্রী ছিলাম না৷ সে যতবার আমায় ফিরে যেতে বলে, আমি ততবার বাবাকে ফেরত চাই৷ তার পায়ে পড়ি, কাকুতি-মিনতি করি, তর্ক করে যাই৷ সে আমায় বোঝায়, বারবার বলে, ‘মৃত্যুর কাছ থেকে কেউ কোনওদিন ফেরেনি৷ তুমি যা চাইছ, আসলে সত্যিই তুমি তা চাও না৷ আমায় বিশ্বাস করো৷ আবেগপ্রবণ হয়ে নিজের ভবিষ্যৎ নষ্ট কোর না৷ ফিরে যাও৷’

আমিও নিজের সিদ্ধান্তে অটল, ‘হয় তুমি আমাকেও বাবার কাছে নিয়ে চলো৷ নয়তো তাঁকে ফেরত দাও৷’

মৃত্যু কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল৷ তারপর আস্তে আস্তে বলল, ‘এই তোমার শেষ কথা? বাবাকে না নিয়ে তুমি যাবে না?’

‘হ্যাঁ৷’

‘ভালো করে ভেবে বলছ তো?’

তার ঠোঁটে রহস্যময় হাসি৷ চোখদুটো যেন ঝিলিক মেরে উঠল৷ আমি নিদ্বিধায় জানালাম, ‘ইয়েস৷’

সে একটু হাসল, ‘ঠিক আছে৷ তবে তাই হবে৷ আগামী শুক্রবার রাত এগারোটায় তুমি তোমার বাবাকে ফেরত পাবে৷’ তারপর একটু থেমেই যোগ করল, ‘মনে রেখো, মৃত্যু কখনও কথার খেলাপ করে না৷ জীবন বিশ্বাসঘাতকতা করে৷ মৃত্যু করে না৷ তাই আমার কথা সত্যি হবেই৷ কিন্তু তুমি কাজটা ঠিক করলে না, পুয়োর চাইল্ড!’

বলতে বলতেই সে মিলিয়ে গেল৷ এতক্ষণ আমার শরীরটা খুব হাল্কা মনে হচ্ছিল৷ এবার সেই তুলোর মতো দেহই যেন লোহার মতো ভারী ঠেকল৷ আমি আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকালাম! প্রথমেই একটা প্রচণ্ড চোখ ধাঁধানো আলো! পরক্ষণেই চোখে পড়ল স্থানীয় হাসপাতালের ডাক্তার ডঃ হ্যারল্ড ডি’মেলোর মুখ! তিনি আমার হাতের ক্ষত সেলাই করে দিয়েছিলেন৷ কয়েক বোতল ব্লাডও দিতে হয়েছিল৷ আমার প্রতিবেশী রোজি আন্টি যখন আমাকে ওই অবস্থায় আবিষ্কার করেন, ততক্ষণে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়ে গিয়েছিল৷ বাঁচার আশা কম ছিল৷ কিন্তু মৃত্যুর কথা মেনে নিয়ে শেষ পর্যন্ত আমি জীবনে ফিরলাম…৷’

এই অবধি বলেই নাতালিয়া থামলেন৷ গভীর কৌতূহলে জর্জ তখনও তাঁর দিকে তাকিয়ে আছেন৷ আগ্রহের সঙ্গে জানতে চাইলেন, ‘কিন্তু আপনার বাবা? তিনি কি ফিরেছিলেন?’

নাতালিয়া মৃদু হাসলেন, ‘আগেই তো বলেছি, মৃত্যু কখনও কথার খেলাপ করে না!’

সেদিনটার কথা আমি কোনওদিন ভুলব না৷

সদ্য হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছি৷ কিন্তু সেদিন একটুও ক্লান্তি বোধ করিনি৷ বরং আনন্দে, উৎসাহে টগবগ করে ফুটছিলাম৷ কারণ দিনটা ছিল শুক্রবার৷ সেদিনই বাবার ফিরে আসার কথা৷ বাবা ফিরবেন ভেবেই মনের মধ্যে জলতরঙ্গ বাজছিল৷ বাবা তাঁর প্রিন্সেসের কাছে ফিরে আসবেন! আবার আমরা একসঙ্গে আনন্দে জীবন কাটাব৷ বাবা পিয়ানো বাজাবেন, আমি নাচব৷ সুখে, দুঃখে ফের তাঁর সস্নেহ স্পর্শ অনুভব করব৷ তিনিই আমার জীবন, আমার পৃথিবী৷ আমরা দুজনে মিলে গাইব, ‘ফর ইওর গ্রেস ইজ এনাফ…!’

সকাল থেকেই তাঁকে স্বাগত জানানোর জন্য নানা তোড়জোড়ে মেতে ছিলাম৷ তিনি অর্কিড পছন্দ করতেন বলে তাঁর ঘরটা অর্কিড দিয়ে সাজিয়েছি৷ ফুলদানিতে লাল গোলাপ ঝলমল করছে৷ তাঁর ইজেল, তুলি, রং; সব গুছিয়ে রাখা আছে৷ আমি সারাদিন ধরে তাঁর ফেভারিট ডিশ বানিয়েছি৷ চিকেন ক্যাফ্রিল, প্রন কারি আর তাঁর পছন্দের ফ্রুট কাস্টার্ড! যেন বাবা মারা যাননি! কোনও দূর বিদেশে চলে গিয়েছিলেন৷ আজ ফিরবেন৷

আস্তে আস্তে ঘড়ির কাঁটা রাত এগারোটার দিকে চলল৷ ততক্ষণে গোয়ার পল্লি নির্জন হয়ে গিয়েছে৷ এখানে সবাই আটটা-সাড়ে আটটার মধ্যেই ডিনারের পাট চুকিয়ে ফেলে৷ রাত ন’টা নাগাদ সব বাড়ির আলো নিভে যায়৷ সেদিনও তাই হয়েছিল৷ চতুর্দিকে তখন শুধু অন্ধকার৷ শুধু আমি ঘরে আলো জ্বেলে নিজের ঈপ্সিত মানুষটির প্রতীক্ষা করছি৷ বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করছে৷ সত্যিই বাবা ফিরবেন তো! নাকি পুরোটাই মৃত্যুর মিথ্যে আশ্বাস! কিন্তু সে যে বলেছিল, তার কথার খেলাপ হয় না!…

‘ঠক ঠক ঠক!’

ঘড়িতে ঠিক এগারোটার ঘণ্টা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই দরজায় করাঘাতের শব্দ! পরক্ষণেই রাস্তার কুকুরগুলো যেন প্রবল আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠেছে! এমন পরিত্রাহি চিৎকার করছে যেন তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে কোনও বিভীষিকা! আমি লাফ মেরে উঠে দরজার দিকে ছুটে যাই৷ বাবা এসেছেন…! বাবা ফিরে এসেছেন! মৃত্যু তার কথা রেখেছে!

কিন্তু দরজা খুলে যা দেখলাম তাতে ভয়ে রক্ত হিম হয়ে গেল!

হ্যাঁ, কোনও সন্দেহই নেই যে বাইরে যে লোকটি দাঁড়িয়ে রয়েছে, সে আমার বাবাই৷ কিন্তু এ কোন বাবা! এখন তো তাঁর বুকে আমার ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা! অথচ আমি এক পাও এগোতে পারছি না! পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে ভয়ে সাদা হয়ে গিয়েছি! এই কি আমি চেয়েছিলাম!

বাবার সমস্ত দেহ কাদায় আর রক্তে মাখামাখি! সদ্য কবর থেকে বেরিয়ে এসেছেন! চোখদুটো যেন হিংস্র জন্তুর মতো জ্বলছে! তাঁর দৃষ্টিতে কোনও স্নেহ, কোনও মায়া-মমতা নেই৷ মাথার একদিকটা গাড়ির তলায় পিষে গিয়েছিল৷ সেই দিকটা থেঁতলানো! মুখের কষ বেয়ে রক্ত পড়ছে৷ ডান হাতটা ঝুলঝুল করছে৷ সে হাতের একটিও হাড় অবশিষ্ট নেই৷ পোস্টমর্টেমের ফলে যে সেলাই পড়েছিল, সেই সেলাইগুলো থেকেও টপটপ করে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে! একটা অস্ফুট গোঙানির শব্দ বেরিয়ে আসছে তাঁর মুখ থেকে৷ যেন তাঁর সারা দেহে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে!

আমি কোনওমতে বললাম, ‘বা-বা!’

‘কেন ডেকেছিস!’ বাবা উন্মত্ত আক্রোশে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন৷ বাঁ হাতে আমার গলা টিপে ধরে বললেন, ‘কেন ফিরিয়ে এনেছিস আমায়? এতদিন আমি শান্তিতে ঘুমিয়ে ছিলাম! কোনও যন্ত্রণা ছিল না, কোনও কষ্ট ছিল না! আর এখন যন্ত্রণায় আমার প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে! সারা গায়ে সেলাই! একটা হাত অকেজো! মাথায় অসহ্য ব্যথা! ওঃ ঈশ্বর! আমি মরে যাচ্ছি…!’

আমার দমবন্ধ হয়ে আসছিল৷ তবু কোনওমতে বললাম, ‘তোমার সমস্ত ব্যথা ডাক্তারেরা নিশ্চয়ই কমিয়ে দেবেন বাবা…৷’

বাবা দাঁতে দাঁত পিষে গর্জন করে উঠলেন, ‘কে কমাবে? ডাক্তারেরা আমার এই রূপ দেখলেই ভয়ে পালিয়ে যাবে! একদিকের মাথাটা থেঁতলে গিয়েছে৷ দুনিয়ার কোন ডাক্তার এটা ঠিক করবে? একটা হাতের সব হাড় ভেঙে গিয়েছে, আমি আর কখনও রং, তুলি ধরতে পারব না! যারা এতদিন আমায় ভালোবাসত, শ্রদ্ধা করত; তারা আমার ধারে-কাছে ঘেঁষবে না! সারাজীবন এই বীভৎস দেহ নিয়ে আমায় ঘরবন্দি হয়ে থাকতে হবে৷ সারাজীবন এই নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে হবে৷ সবাই আমায় পিশাচ ভাববে; সেই পিশাচ, যে নারকীয় রূপ নিয়ে কবর থেকে উঠে এসেছে! ওঃ…ওঃ…কী অসহ্য যন্ত্রণা! আর এসব হয়েছে তোর জন্য! হোয়াই! হোয়াই…!’

বাবা কিছুক্ষণ কথা বলেই যন্ত্রণায় গোঙাতে লাগলেন! বাঁ হাতে তখনও চেপে ধরে রেখেছেন আমার গলা৷ নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে! স্পষ্ট বুঝতে পারছি এই মানুষটি আর যাই হোক, আমার পরিচিত বাবা নয়৷ তাঁর দেহটা ফিরে এসেছে ঠিকই; কিন্তু তিনি ফেরেননি! আমি যাঁকে চেয়েছিলাম, এ মানুষ সে নয়!

‘কিন্তু বাবা…!’ তবু কোনওমতে অতিকষ্টে বলি, ‘আমি যে তোমায় ছাড়া বাঁচব না! তুমি ছাড়া এই দুনিয়ায় আমার কেউ নেই৷’

‘নিজের স্বার্থে তুই আমার শান্তিভঙ্গ করলি!’ বাবার চোখদুটো তখন রক্তপিপাসু বাঘের মতো ক্রুর! তিনি প্রচণ্ড শক্তিতে আমার গলা পিষতে পিষতে বললেন৷ ‘তুই আমায় ছাড়া বাঁচবি না? তবে মর…!’

বাবার হাতে তখন কী প্রচণ্ড শক্তি! যিনি কখনও আমাকে একটা কড়া কথাও বলেননি, আজ তিনিই পাশবিক শক্তিতে আমার টুঁটি টিপে ধরেছেন৷ আমি আস্তে আস্তে শিথিল হয়ে যাচ্ছিলাম৷ দম নিতে না পারার যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে ক্রমশ নেতিয়ে পড়ছি৷ চোখদুটো বুঁজে আসছে৷ আর পারছি না…আর পারছি না…!

তখনই ফের দেখা দিল সে! সেই অপূর্ব মুখ, সেই নীল চোখদুটোয় অপার শান্তিময়তা, সেই প্রাজ্ঞ দৃষ্টি! তার আলোকিত মূর্তি আমার বন্ধ চোখের ভেতরে ভেসে উঠল৷ সে ফের বলল, ‘তুমি আবার এসেছ! বললাম যে তোমার সময় হয়নি৷ তোমাকে দেওয়া কথা তো রেখেছি আমি৷ তবে আবার এলে কেন?’

আমি অতিকষ্টে বললাম, ‘আমার ভুল হয়ে গিয়েছে৷ ক্ষমা করো৷ নিজের স্বার্থপরতায় আমি বাবার কথা একবারও ভাবিনি৷’

তার দু-চোখে রহস্যময় হাসির ঝিলিক, ‘আমি তো তোমাকে আগেই বারণ করেছিলাম৷ বলেছিলাম যে তিনি যেখানে আছেন, শান্তিতেই আছেন৷ তুমি আমার কথা শুনলে না!’

আমি দু-হাত জোড় করে বলি, ‘আমি নিজের মূর্খামির জন্য আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাইছি৷ তুমি বাবাকে ফিরিয়ে নাও৷ তাঁকে সমস্ত যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দাও৷’

‘কিন্তু আগেই তো তোমায় বলেছি, মৃত্যু কথার খেলাপ করে না৷ একবার কথা যখন দিয়ে ফেলেছি, তখন প্রতিশ্রুতিভঙ্গ করি কী করে?’

তার ঠোঁটে সুমধুর হাসি৷ নীল চোখদুটো যেন ক্রমাগত আমায় আবিষ্ট করে ফেলছে৷ আমার সারা দেহ, সারা মন আকস্মিকভাবে শান্ত হয়ে গেল৷ একটা নিশ্ছিদ্র অন্ধকার নেমে আসছে চোখের সামনে৷ তবে কি আমি মারা যাচ্ছি…?

কথাটা ভাবতেই কানের কাছে শুনলাম তার কণ্ঠস্বর, ‘না৷ তুমি মারা যাচ্ছ না৷ তুমি ফিরে যাচ্ছ৷ আমি আমার কথা রেখেছি; আজ পর্যন্ত কখনও বিশ্বাসঘাতকতা করিনি৷ তোমার সঙ্গেও করব না৷ এখন তুমি জীবনের দিকে যাও৷ নির্দিষ্ট আয়ু সানন্দে অতিবাহিত করো…৷ যাও…ফিরে যাও…ফিরে যাও…!’

আমি সেই কণ্ঠস্বর শুনতে শুনতেই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লাম৷

‘তারপর?’

জর্জ শুনতে শুনতে তন্ময় হয়ে গিয়েছিলেন৷ নাতালিয়া থেমে যেতেই প্রশ্ন করলেন, ‘তারপর কী হল?’

নাতালিয়া ঠোঁট টিপে হাসলেন, ‘সেই তার সঙ্গে শেষ দেখা৷ তারপর যখন ঘুম ভাঙল তখন দেখলাম আমি নিজের ঘরের বিছানায় শুয়ে আছি৷ সম্পূর্ণ একা! চারিদিকে কেউ নেই! বিশ্বাস করুন জর্জ, আমি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম! বুঝলাম, মৃত্যু বাবাকে সমস্ত কষ্ট, সমস্ত যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়েছে৷ তাঁকে ফিরিয়ে নিয়েছে৷’

‘কিন্তু তাহলে তো মৃত্যুর দেওয়া প্রতিশ্রুতি আর রইল না৷’ জর্জ অধীর কণ্ঠে বললেন, ‘কথার খেলাপ হয়ে গেল যে!’

‘নাঃ!’ নাতালিয়া মৃদু অথচ আত্মমগ্ন স্বরে জানান, ‘সে নিজের কথা রেখেছিল৷ শুধু যেমনভাবে আমি চেয়েছিলাম, তেমনভাবে নয়৷’

‘তবে?…’ তিনি আরও কিছু বলার আগেই পেছন থেকে আওয়াজ এল :

‘হাই প্রিন্সেস!’

জর্জ অবাক হয়ে পেছনের দিকে তাকিয়েই চমকে উঠলেন৷ এ কী! এ কে! কে হাসতে হাসতে নাতালিয়ার দিকে হেঁটে আসছে! তাঁর হাতের অ্যালবামের ছবি থেকে যেন উঠে এসেছে এই যুবক! সেই লম্বা ছিপছিপে সুন্দর চেহারা, কাটাকাটা মুখ! প্রশস্ত কপালের নীচে শান্ত অথচ বুদ্ধিদীপ্ত চোখ৷ থুতনিতে একটা কাটা দাগ৷ অবিকল ছবির মতোই! এ কি তবে নাতালিয়ার বাবা! স্টিভ গঞ্জালভেস! অসম্ভব…!

যুবকটি নাতালিয়াকে সস্নেহ ধমক দিয়ে বললেন, ‘তুমি আজকে আবার ওষুধ স্কিপ করেছ প্রিন্সেস! এ কীরকম কথা! আমি গুনে না দেখলে তো বুঝতেই পারতাম না যে ওষুধটা তুমি খাওনি! আমি না থাকলে যে তোমার কী হবে…!’

নাতালিয়া একেবারে বাধ্য মেয়ের মতো মুখ কাঁচুমাচু করে বললেন, ‘সরি বাবা! এক্সট্রিমলি সরি!’ বলতে বলতেই তিনি যুবকটির সঙ্গে জর্জের আলাপ করিয়ে দিলেন, ‘মিঃ জর্জ উইলিয়ামস, ইনি আমার সেকেন্ড ফাদার ফ্রান্সিস গোমস!’

জর্জ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন! ফ্রান্সিস নাতালিয়া ও রবার্টের সুপুত্র! তাকে দেখে আঁতকে উঠেছিলেন ভেবে এখন হাসিই পেল! তাই তো! নাতি কি দাদুর মতো দেখতে হতে পারে না! তিনিও সত্যি! নাতালিয়ার অলৌকিক গল্প শুনে নিজেই ভুলভাল কল্পনা করছিলেন৷

ফ্রান্সিস মৃদু হেসে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়৷ সন্ধ্যার স্তিমিত আলোতেও তার হাতের দিকে তাকিয়েই ফের চমকে উঠলেন জর্জ! ও কী! ওর হাতে এমন সাদা সাদা আঁচড়ের দাগ কীসের? দেখলে মনে হয় যেন কোনও সময়ে হাতে ট্যাটু করা হয়েছিল! এখন ঘষে কালিটা শুধু মুছে দেওয়া হয়েছে! কিন্তু অক্ষরগুলো এখনও পড়া যায়৷

নাতালিয়া বোধহয় তাঁর বিস্ময় বুঝতে পেরে হেসে বললেন, ‘ওটা ওর জন্মদাগ৷ বার্থ সাইন! ওই দাগ নিয়েই ও জন্মেছে৷’

জর্জ বিস্ময়বিস্ফারিত দৃষ্টিতে দেখলেন আঁচড়ের দাগগুলো যেন কিছু ইংরেজি হরফের অস্পষ্ট রূপ৷ পড়তে বেশি কষ্ট হয় না৷ তিনি স্পষ্ট দেখলেন ফ্রান্সিসের জন্মদাগে লেখা আছে, ‘নাতালিয়া’!

মৃত্যু সত্যিই কথার খেলাপ করেনি৷ সে কথা রেখেছিল! শুধু যেমনভাবে নাতালিয়া ভেবেছিলেন, তেমনভাবে নয়! জর্জ শুনলেন ফ্রান্সিস আর নাতালিয়া একসঙ্গে গেয়ে উঠলেন :

‘ফর ইওর গ্রেস ইজ এনাফ…’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *