রিঙ্গা রিঙ্গা রোজেস

রিঙ্গা রিঙ্গা রোজেস

বাচ্চা মেয়েটা অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে বসেছিল৷

আজ বড় ভয় করছে তার৷ কচি কচি নিষ্পাপ চোখদুটো কেঁদে কেঁদে ফুলে গিয়েছে৷ এই মুহূর্তে হিমালয়ান্তিক পাপের ভার তার ছোট্ট মাথায়৷ অথচ ‘পাপ’ শব্দটা আসলে ঠিক কী, তা ওর বোঝার কথা নয়৷ এখনও সে আট বছরের শিশু৷ পাপ-পুণ্যের হিসাব করার সময় আসেনি৷ আপাতত তার খেলা-ধুলো করে, নেচে-কুঁদে-গেয়ে বেড়ানোর কথা৷ এমনভাবে বাড়ির এককোণে, দেওয়ালের সঙ্গে মিশে যাওয়ার কথা নয়! তবুও সে কোনও এক অজ্ঞাত লজ্জায়, ভীষণ গ্লানিতে নিজের নিষ্পাপ মুখখানা অন্ধকারের কোলে গুঁজে বসেছিল৷

ছোট্ট মানুষটা হাতের পিঠ দিয়ে মুছে নেয় অশ্রুস্নাত ভিজে মুখ৷ কোথায় যেন আরশোলা কিংবা অন্য কোনও পতঙ্গ খড়খড় করে উঠল৷ শিশু চমকে ওঠে! ভয় পায়৷ গলা চিরে বেরিয়ে আসে অস্ফুট কান্না! বেচারির সারা শরীর কান্নার দমকে কাঁপছে৷ সে জানে, আজ চিৎকার করে আকাশ ফাটালেও কেউ তাকে বাঁচাতে আসবে না৷ পেটের মধ্যে হিংস্র খিদে থাবা বসিয়ে চলেছে৷ কিন্তু আট বছরের শৈশবকে আজ ক্ষুধার্ত থাকতেই হবে৷ বাবা তাকে এই অন্ধকার স্টোররুমে আটকে রেখেছে৷ মাকে চিৎকার করে বলেছে, ‘এই পাপের এমন শাস্তিই হওয়া উচিত! কেউ খেতে দেবে না ওকে! একগ্লাস জলও না! যদি দাও, তবে তোমার একদিন কি আমার একদিন! বাড়ি থেকে মা-মেয়েকে স্রেফ লাথি মেরে বের করে দেব৷’

শাস্তি! শব্দটা মাথায় আসতেই বাচ্চা মেয়েটি শুকনো ঠোঁট চেটে নেয়৷ ঠোঁটের ওপর জিভ বোলাতেই একটা কাতর ধ্বনি ফের উঠে আসতে চাইল কণ্ঠনালি বেয়ে৷ বাবার রুক্ষ হাতের শক্তিশালী চড়ে নরম ঠোঁটটা কেটে গিয়েছে৷ সামান্য রক্তের কষাটে স্বাদও পেল সে৷ ডান গালটা এখনও ব্যথা! বোধহয় কালশিটেই পড়ে গেল৷

চোখ থেকে অবিরল ধারায় জল পড়তে পড়তে এখন শুকিয়ে গিয়েছে৷ অবশিষ্ট আছে শুধু শুকনো জলের ক্ষীণ দাগ৷ মেয়েটা কাতরদৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকায়৷ এ দরজা কি আর খুলবে না? মা খাবারের থালা আর জলের বোতল নিয়ে একবারও আসবে না? সারারাত কি এমনভাবেই কাটবে!

ভাবতেই আবার ভীষণ কান্না পেয়ে গেল তার৷ এখনও কানের কাছে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বাবার কঠিন গর্জন—

‘অসভ্য মেয়ে! ছেনালিপনার শখ হয়েছে? মুখে রং মেখে পোজ মেরে ছবি তুলছিস! সর্বক্ষণ মায়ের মোবাইলটা নিয়ে ঘোরা হচ্ছে! সেলফি; তাই না? খুব রংঢং! আজ তোর সমস্ত রং ঘোচাচ্ছি৷’

আট বছরের শিশু স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়েছিল বাবার দিকে৷ আজ সে এমন কী করেছে যাতে বাবা এমন রাগ করল! বাবার এমন ভয়ংকর রাগ সে আগেও অনেকবার দেখেছে৷ মারও কম খায়নি৷ পরীক্ষায় কম নম্বর পেলে মার! স্কুল থেকে রিপোর্ট এলে মার! আট বছরের মেয়েটা সারাদিন স্কুল, টিউশন, সুইমিং ক্লাস, মিউজিক ক্লাস নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে থাকে৷ সন্ধেবেলা পড়তে বসে ক্লান্তিতে চোখ বুঁজে এলেও মার! গান গাইতে তার ভালো লাগে না৷ বরং নাচ শেখার খুব শখ ছিল৷ সে কথা বলতেই ফের সেই আদি ও অকৃত্রিম মার! বাবা চিৎকার করে বলল, ‘অঙ্গভঙ্গি করতে তো ভালোই লাগবে! যা! রেডলাইট এরিয়ায় গিয়ে মুখে রং মেখে হাত-পা বেঁকিয়ে নাচ! মা-মেয়ে মিলে আমার সর্বনাশ না করলে তো শান্তি হচ্ছে না৷ দেব ঠিক একদিন লাথি মেরে বের করে!’

নাচের সঙ্গে বাবার কী শত্রুতা তা আজও বোঝেনি সে৷ ‘রেডলাইট এরিয়া’ কী জিনিস তা ভগবানই জানেন৷ কিন্তু ‘লাথি মেরে বের করে দেব’ বাক্যটা তার অতি পরিচিত৷ বাবা রেগে গেলেই এই কথাটা বলে৷ তখন মাকে খুব অসহায় লাগে৷ মা যেন ভয়ে কুঁকড়ে এতটুকু হয়ে যায়৷ ও জানে যে বাবা বাড়ি থেকে বের করে দিলে ওদের আর কোথাও থাকার জায়গা নেই৷ মা বলে, বাবা তাড়িয়ে দিলে গাছতলায় যেতে হবে৷ গাছতলায় যাওয়ার কোনও ইচ্ছে নেই ওর৷ সবার কাছে শুনেছে, গাছতলা খুব খারাপ জায়গা৷

মেয়েটা হতাশ দৃষ্টিতে ফের বন্ধ দরজার দিকে তাকায়৷ এখন অদ্ভুত ক্লান্তিতে তার দেহ ভেঙে আসছে৷ ঘুম পাচ্ছে৷ ভীষণ ঘুম৷ তার ক্লান্ত দু-চোখ তখনও সেই কালিঝুলিমাখা অন্ধকার স্টোররুমে একটা প্রশ্নের উত্তরই খুঁজে বেড়ায়৷

আজ ঠিক কী অন্যায় করেছিল সে? শুধু একটা ছবিই তো তুলেছে! আর সেই ছবিটা ‘রিঙ্গা রিঙ্গা রোজেস’ নামের সাইটটায় পোস্ট করেছে৷ ওটা তো খুব সুন্দর একটা জায়গা৷ কত সুন্দর সুন্দর ছেলেমেয়েরা সেজেগুজে ছবি তুলে পোস্ট করে ওখানে৷ তারও তো সাজতে ইচ্ছে করে৷ তাই চুপিচুপি মায়ের লাল লিপস্টিকটা একটু ঠোঁটে ঘষে, নাচের ভঙ্গিতে একটা সুন্দর সেলফি তুলে দিয়ে দিয়েছে ওখানে৷

সেলফি তোলা কি পাপ? পাপ কাকে বলে?

‘চাবকে দুটোরই পিঠের ছাল তুলে নেওয়া উচিত! সব গব্ভের দোষ! মা যদি বদরক্তের হয়; তবে ছা-ও তাই হবে!’

ঐশানী রক্তজবার মতো রক্তিম চোখ দুটো তুলে একবার শাশুড়ির দিকে তাকায়৷ তিনি এমনভাবে বিশেষজ্ঞের মতামত পেশ করলেন যেন তাঁর কথাই আই পি সি সেকশনের ধারাবিশেষ৷ অপরাধীরা কিছু বলার আগেই বিচারক মৃত্যুদণ্ড দিয়ে বসে আছেন! মহিলা চিরকালই পুত্রবধূর ‘গর্ভের দোষ’ দেখে গেলেন! ওদিকে ‘গর্ভ’ শব্দটাও সঠিকভাবে বেরোয় না মুখ থেকে! অথচ নিজের গর্ভের অহঙ্কারেই বাঁচেন না৷ সে দম্ভের বাস্তবিক কোনও ভিত্তি নেই৷ না তিনি রূপে লক্ষ্মী, না গুণে সরস্বতী, না রন্ধনে দ্রৌপদী৷ বিদ্যে নেই, বুদ্ধি নেই তবু কীসের যে এত অহঙ্কার কে জানে!

ঐশানীর শ্বশুর তখন বাচ্চাদের নাচের রিয়্যালিটি শো দেখছিলেন৷ এটা তাঁর অত্যন্ত প্রিয় প্রোগ্রাম৷ টিভির পর্দায় একটি দশ বছরের মেয়ে তখন পিঠখোলা জামা পরে, কচি পিঠ, নিতম্ব এবং সদ্য উন্নত বক্ষদেশ কাঁপিয়ে মাধুরী দীক্ষিতের ‘ধক ধক করনে লগা’ নাচছে৷ এতক্ষণ সেদিকেই মন ছিল৷ এবার একটু রাগতদৃষ্টিতেই এদিকে তাকিয়েছেন৷ ভাশুর অনির্বাণ বাবার পাশে বসে একখানা ফিল্ম ম্যাগাজিনের মধ্যে ডুবে ছিল৷ মায়ের কথা শুনে ঈষৎ মাথা নেড়ে তাঁকে সমর্থন করে বলল, ‘ঠিক—ঠিক!’

এই সংসারে অনির্বাণের ভূমিকা এই পর্যন্তই৷ উঠতে বসতে মায়ের কথায় সায় দেওয়া ছাড়া তার আর বিশেষ কোনও কাজ নেই৷ মা যদি বলেন, সূর্যটা আজ পশ্চিমদিক থেকে উঠেছে, তবে সেও এই একটা শব্দই বলবে, ‘ঠিক—ঠিক!’ না বলেও উপায় নেই৷ কারণ সে কথায় কথায় রাজা-উজির মারা ছাড়া আর কোনও কাজই করে না৷ ঐশানী শুনেছে যে প্রথম জীবনে অনির্বাণ ফিল্ম পরিচালনা করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল৷ কিন্তু যে কোনও সৃষ্টিশীল কাজ করতে গেলে প্রথমেই যেটা দরকার, তা হল বিনম্রতা৷ এই বিনম্রতা নামক শব্দটি এই পরিবারের রক্তেই নেই! এককথায় বলতে গেলে, প্রত্যেকেই একেকটি মেগালোম্যানিয়াক! তাই অনির্বাণের আর ফিল্মের দুনিয়ায় সোনার অক্ষরে নিজের নাম লেখা হল না! অগত্যা তাকে বাপের হোটেলেই থাকতে হয়৷ বিয়েটা অবশ্য ঠিকসময়েই করেছিল৷ তবে বিয়ের একবছরের মাথাতেই ডিভোর্স! আপাতত বাপ-মায়ের ফাই-ফরমাশ খাটা এবং কথায় কথায় মাকে তোয়াজ করে ঠান্ডা রাখাই তার প্রধান কাজ৷ ঐশানী আড়চোখে দেখল, কথাটা বলেই অনির্বাণ ফের ফিল্ম ম্যাগাজিনের খবরে মগ্ন হয়ে গেল৷ অর্থাৎ তার ভূমিকা ওখানেই শেষ৷ এখন নতুন কোনও চরিত্রের ডায়লগবাজি শুরু হবে!

‘দেখছি কত দেখব আর, চিকার গলায় চন্দ্রহার!’ ঐশানীর শাশুড়ি এবার পদকর্তার দায়িত্ব নিলেন৷ মিটিয়ে মিটিয়ে নাকি সুরে বললেন, ‘আগেই বলেছিলাম যে এ মেয়েছেলের জাত ভালো নয়! এমন নিখুঁত ছেলের জন্য খুঁতো মেয়ে ঘরে আনা ঠিক নয়৷ তখন কেউ কথাই শোনেনি! গরিবের কথা বাসি হলে ফলে কি না! সব হুন্দুরী দেখে মজেই মোলো! আগেই বলেছিলাম, যে নিজের বাপ-মাকেও খেয়েছে, সে সোয়ামিকেও খাবে!’

অনির্বাণ ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতেই ফের বলল, ‘ঠিক—ঠিক!’

ঐশানী স্থির দৃষ্টিতে শাশুড়ি মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে৷ এ পরিবারে তিনিই মূল গায়েন৷ বাকিরা তাঁর পোঁ ধরার জন্যই আছে৷ একঝলক শ্বশুরের দিকেও দেখল সে৷ তাঁর মুখ ইস্পাতকঠিন৷ সে মুখে কোনও দয়া, মায়া, মমতা নেই৷ ‘খুঁতো’ অর্থাৎ ঐশানী মাঙ্গলিক৷ তার জন্মলগ্নের ওপরে নিজের কোনও হাত ছিল না৷ তার ওপর আবার অনাথ! তাতেও তার কোনও দোষ নেই৷ তা সত্ত্বেও সেই খুঁতের খোঁটা শুনতে শুনতে প্রাণ ওষ্ঠাগত৷

অনিমেষ, অর্থাৎ তার স্বামী এতক্ষণ ঘরের মধ্যে ক্রুদ্ধ আত্মার মতো প্রায় ‘হা রে রে রে’ করতে করতে পায়চারি করছিল৷ এবার ভ্রূকুটি করে গর্জন করে উঠল; ‘শুধু মেয়েই কি ব্যবসায় নামছে? না সঙ্গে সঙ্গে তুমিও?’

কথাটা যেন গরম তরল সিসার মতো তার সর্বাঙ্গ জ্বালাতে জ্বালাতে গেল! ঐশানী দুর্বলস্বরে কিছু বলার আগেই শ্বশুরের ব্যঙ্গতীক্ষ্ণ কথা ভেসে এল, ‘দুজনেই নামলে ক্ষতি কী! খুঁজে দ্যাখ অনি, ওই সব সাইটে হয়তো মেয়ের মায়ের ছবিও আছে৷ ভিডিও থাকাও আশ্চর্যের নয়৷ কে বলতে পারে!’

‘ওই সব সাইট’ অর্থাৎ পর্ণসাইট৷ যেখানে সোনার দরে বিকোয় নারীত্বের লজ্জা৷ বেচারি তিতলি আর কী করে জানবে যে ‘রিঙ্গা রিঙ্গা রোজেস’ নামক সাইটটি আসলে চাইল্ড পর্নোসাইট! সে দেখেছিল যে অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়েদের সুন্দর সুন্দর ছবি, ভিডিও আছে ওখানে৷ তার কী মনে হয়েছিল কে জানে৷ নিজের একখানা সেলফি তুলে পোস্ট করে দিয়েছিল সবার অজান্তেই!

আর তারপর থেকেই বাড়িতে চূড়ান্ত মারমার কাটকাট চলছে৷ কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তিতলির ছবিটা ভাইরাল হয়ে গেল! প্রথম জানিয়েছিলেন পাশের ফ্ল্যাটের মিসেস উমা দত্ত৷ আচমকা সন্ধ্যাবেলায় এসে একগঙ্গা কথা শুনিয়ে দিয়ে বললেন; ‘নিজেদের মেয়েকে যারা ব্যবসায় নামায়, তাদের সঙ্গে এক ফ্লোরে থাকাও পাপ! আমি এখনই আপনাদের নামে কমপ্লেন করব৷’

তারপর আরও অনেকেই দায়িত্ব নিয়ে ‘ছি ছি’ করে গেলেন৷ হাউজিঙের সবাই একযোগে কমপ্লেন করবেন ওদের বিরুদ্ধে৷ এরকম বিকৃতমনস্ক প্রতিবেশীর সঙ্গে থাকা অসম্ভব! অনিমেষ, ঐশানী এবং ওদের পরিবারের লোকজন সেই ক্ষিপ্ত মানুষগুলোকে কিছুতেই বোঝাতে পারল না যে এটা নিতান্তই একটা অ্যাক্সিডেন্ট৷ একটি আট বছরের বাচ্চা মেয়ে ভুল করে পোস্টটা করে ফেলেছে৷ তার পক্ষে বোঝা সম্ভবই ছিল না যে ওটা পর্নোসাইট! কিন্তু কেউ এটাকে একটি শিশুর অনিচ্ছাকৃত ভুল বলে মানতে রাজিই নয়! এ ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ! শাস্তি তো পেতেই হবে!

শাস্তি বলে শাস্তি! ওই একরত্তি মেয়েটাকে কী মারই না মারল অনিমেষ৷ এমনিতেই কথায় কথায় মেয়ে-বৌয়ের গায়ে হাত তুলতে সে অভ্যস্ত৷ আজ তার মাথায় এমনিতেই আগুন জ্বলছিল৷ তার ওপর শ্বশুর আর শাশুড়ির একনিষ্ঠ ঘৃতাহুতি৷ বাচ্চা মেয়েটা বেদম মার খেতে খেতে হাউ হাউ করে কেঁদে বলেছিল, ‘আমি আর কখনও এমন করব না….প্লিজ বাবা! ….আমি আর করব না!’

‘তুই জানিস না যে ওটা একটা চাইল্ড পর্নোসাইট!’ পাগলের মতো মারতে মারতে বলেছিল তার বাবা, ‘ফেসবুক বুঝিস, সেলফি বুঝিস; আর পর্নোসাইট বুঝিস না? বেশি পেকেছিস তাই না? নিজে উচ্ছন্নে যাচ্ছিস, আমাদেরও বরবাদ করে ছাড়বি—৷’

ঐশানী তাকে থামানোর চেষ্টা করে, ‘ওকে আর মেরো না! ও বুঝতে পারেনি—!’

‘কী বুঝতে পারেনি?’ তিতলির নরম ঠোঁট কেটে রক্ত পড়ছিল৷ লোকটা যেন রক্ত দেখে আরও হিংস্র, আরও উন্মত্ত হয়ে যায়, ‘তুমি জানো? এখন চাইল্ড পর্নোসাইটের চাহিদা সবচেয়ে বেশি! মেয়েকে আদর দিয়ে দিয়ে সর্বনাশ করা হচ্ছে! এই শিক্ষা দিয়েছ? এরপর রেপড হলে শান্তি হবে তোমার!’

ঐশানীর মনে হয়েছিল, এই মুহূর্তে মরে যেতে পারলে হয়তো ভালো হত! বাবা হয়ে কেউ মেয়ের সম্পর্কে এমন কথা বলতে পারে! তিতলি দুই চোখে কাতর প্রার্থনা আর বিভীষিকা নিয়ে তাকিয়েছিল তার বাবার দিকে৷ পর্নোসাইট কী জিনিস তা এখনও ধরতে পারেনি আট বছরের মস্তিষ্ক৷ শুধু গড়াগড়ি খেতে খেতে পায়ে পড়ছিল, ‘বা-বা! আর করব না, মে-রো না!’

তবুও থামেনি অনিমেষ! পাশ থেকে শাশুড়ি চেঁচিয়ে বলছিলেন, ‘মার! আরও মার! মেরে ফ্যাল ওই গব্ভের পাপকে!’

এখন ছোট্ট মেয়েটার শাস্তি হয়েছে৷ পুরোপুরি প্রাণে না মারলেও প্রায় আধমরা করে ছেড়েছে তাকে৷ কিন্তু প্রধান আসামি এখনও বাকি!

ঐশানীর মোবাইলটা আঁতিপাতি করে খুঁজে দেখেছে অনিমেষ৷ যে করেই হোক, ডিলিট করতে হবে তিতলির ছবিটাকে৷ কিন্তু ‘রিঙ্গা রিঙ্গা রোজেস’-এর কোনও অস্তিত্ব তার মোবাইলে নেই! ফেসবুক, আর কিছু মোবাইল গেম, অ্যাপস আছে ঠিকই৷ কিন্তু কোনও পর্নোসাইটের দেখা মিলল না৷ ওই সাইটটা ঐশানীর মোবাইলে অনেক ঘেঁটেঘুঁটেও খুঁজে না পেয়ে রাগে চিৎকার করে উঠল সে, ‘মুছে দিয়েছ? সব মুছে দিয়েছ তাই না? কী ভেবেছ? সমস্ত রেকর্ড মুছলেই পার পাবে? দেখাচ্ছি মজা!’

বলতে না বলতেই জবরদস্ত একটা লাথি এসে পড়ল তলপেটে! ঐশানী প্রায় কঁকিয়ে ওঠে, ‘মা-গো!’

‘মায়ের নাম নিবি না!’ সে দাঁত খিঁচিয়ে বলে, ‘তোর মা-ও নির্ঘাৎ একটা বেশ্যা ছিল৷ জন্মের আগেই তোর বাপ মরে রক্ষা পেয়েছে! তুই কার মেয়ে কে জানে! এখন মেয়েটাকেও লাইনে নামাচ্ছিস!’

রেগে গেলে অনিমেষের হিতাহিতজ্ঞান থাকে না৷ এই সময় তাকে দেখলে ঠিক মানুষ বলে মনে হয় না৷ বরং যেন কোনও প্রাগৈতিহাসিক দানব! চোখদুটো করমচার মতো লাল টকটকে, মুখে ফেনা ভাঙছে, কথার সঙ্গে থুতু ছিটছে—সব মিলিয়ে বড় কদর্য মূর্তি তার! ঐশানী প্রথম আঘাতটা সামলে নিয়ে ক্ষীণ প্রতিবাদ করে, ‘মা তুলে কথা বলবে না!’

‘আলবাৎ বলব৷’ এবার তার চুলের মুঠি ধরে ঠাসঠাস করে পরপর কয়েকটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল অনিমেষ, ‘সা-লি! সবসময় দেখি মা আর মেয়ে মোবাইল ফোন নিয়ে খুটুর খুটুর লাগিয়েই রেখেছে! কী করিস মোবাইলে? শালা, সারারাত ধরে মোবাইল বাজছে তো বাজছেই৷ মেয়ে পর্নোসাইটে রং মেখে ছবি দেয়! আর তুই কী করিস? ফেসবুকে সারারাত ধরে কোন নাগরের সঙ্গে চ্যাট করিস?—হ্যাঁ? শুধু চ্যাট না সেক্স চ্যাট?’

‘মেয়েকে তো এই শিক্কেই দিচ্ছে!’ শাশুড়ি ফের চিড়বিড়িয়ে ওঠেন, ‘মোমের মতো বন্ন দেখলে হাবাতে পুরুষগুলো গলে যায়! মা-মেয়ের ওই সাদা রঙেরই গুমোর৷ আজ ওই বন্ন কালি করেই ছাড়বি—!’

শাশুড়ির কথার সঙ্গে সঙ্গেই শ্বশুর ইতিবাচক মাথা নাড়লেন৷ অনির্বাণ বলে উঠল, ‘ঠিক—ঠিক৷’

‘রিঙ্গা রিঙ্গা রোজেস/পকেট ফুল অব পোজেস/আ হুশা, আ বুশা/উই অল ফল ডাউন’—! অনেকগুলো শিশু হাত ধরাধরি করে খেলা করছে৷ তার মধ্যে তিতলিও পা মিলিয়ে মিলিয়ে চক্রাকারে ঘুরছে৷ হাসছে খিলখিল করে৷ যেন সত্যি সত্যিই একরাশ গোলাপ নরম সোনালি রোদ্দুরের আলোতে ঝলমলিয়ে উঠছে৷ তার কাচের মতো স্বচ্ছ ত্বকের ওপর রোদ পড়ে পিছলে যাচ্ছে৷ তিতলি সত্যিই যেন একটা আস্ত প্রজাপতি! ছোট্ট একটা সোনালি রঙের পরি৷ হাওয়ায় কেমন উড়ছে দেখো—!

ঐশানী তাকে হাত বাড়িয়ে ধরতেই যাচ্ছিল৷ না ধরলে ও উড়ে যাবে যে! কিন্তু তার আগেই উচ্চারিত হল ‘উই অল ফেল ডাউন’! আর অমনিই ধপাস করে পড়ে গেল তিতলি! একদম কাদার মধ্যে চিতপাত! কর্দমাক্ত, ক্লেদাক্ত ছোট্ট পরি কেঁদে উঠল, ‘মা-আ-আ-আ—!’

ধড়মড় করে উঠে বসতে গিয়েও যন্ত্রণায় কাতরে উঠল ঐশানী৷ পিঠের ওপরে জ্বলন্ত ইস্ত্রির ছ্যাঁকার জ্বালা! সঙ্গে সঙ্গেই সোনালি রোদকে মুছে দিল একরাশ গাঢ় কালো অন্ধকার! একটা জমাট ব্যথার মতো আঁধার ছড়িয়ে আছে চতুর্দিকে৷ ব্যথিত সজল দৃষ্টিতে সেই অন্ধকারের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল সে৷ ক্রমাগতই উচ্ছ্বসিত কান্না তার বুকের পাঁজর কাঁপিয়ে উঠে আসতে চাইছে৷ জীবনে কখনও কি এমন কাদায় পড়তে হয় যে শেষ পর্যন্ত রাতের অন্ধকারেই মুখ ঢাকতে হবে? তিতলি কী করে পড়ে গেল! এমনভাবে পড়ল যে তাকে তুলতে গিয়ে ঐশানীও পড়ে যাচ্ছে বারবার৷ এ কেমন পতন!

তার মুখের ব্যথিত রেখাগুলো একটু নড়েচড়ে ওঠে৷ একটু দূরেই একটা জন্তুর জোরালো নিঃশ্বাসের শব্দ! আজ তাকে ছিঁড়েখুঁড়ে খেয়েছে মাংসাশী প্রাণীটা৷ সুযোগ পেলেই এমন করে৷ দেহের প্রতিটা যন্ত্রণার অনুভূতির সঙ্গে সঙ্গে ঘৃণাও তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে তার অন্তরমহলে৷ তিতলিরা কখনও পড়ে যায় না! এই লোকগুলোই তাদের টেনে নামায় চূড়ান্ত কর্দমাক্ত পথে! ‘রিঙ্গা রিঙ্গা রোজেস’ একটা কবিতা! একটা নার্সারি রাইম৷ কিন্তু তাকেও পর্নোসাইট বানিয়ে ছেড়েছে কিছু নোংরা লোক৷ গোলাপের বুকে কাদা ছিটিয়েছে!

ভাবতে ভাবতেই একটা অসহায়তা তাকে ঘিরে ধরে৷ মায়ের মন ব্যাকুল আশঙ্কায় গুড়গুড় করে উঠল৷ তিতলির ছবিটা কি সত্যিই ভাইরাল হয়ে গিয়েছে! নিশ্চয়ই হয়েছে৷ নয়তো মিসেস উমা দত্ত দেখলেন কী করে?

কথাটা মাথায় আসতেই একটা বিবমিষার সঙ্গে প্রচণ্ড নিরাপত্তাহীনতা অনুভব করল সে৷ এ ক্ষেত্রে দুটো সম্ভাবনাই হতে পারে৷ হয় স্বয়ং মিসেস উমা দত্ত তিতলির ছবি দেখেছেন, অথবা মিঃ দত্ত তাঁকে দেখিয়েছেন! অর্থাৎ মিসেস দত্ত বা মিঃ দত্তর মোবাইলে আছে ওই বিশেষ সাইটটা! ওঁদের মধ্যে কেউ একজন শিশুদের যৌনতায় তৃপ্তি খুঁজে পান! আচমকাই তার চোখের সামনে ভেসে উঠল মিঃ দত্তর ঘোলাটে চোখদুটো৷ ঠিক পাশের ফ্ল্যাটেই থাকে লোকটা! তিতলিকে অনেকবার আদর করে চকলেটও দিয়েছে৷ যদি কখনও চকলেট দেওয়ার নাম করে ডেকে নিয়ে গিয়ে—!

মুহূর্তের মধ্যে ঐশানীর গোটা শরীর ‘রি রি’ করে ওঠে! তার মানে যে পাপকে মিসেস দত্ত এড়াতে চান, সেই পাপ তাঁর ঘরের মধ্যেই বসে আছে! শুধু কি তাই? তার চোখের সামনে একে একে ভেসে ওঠে সেই লোকগুলোর চেহারা, যারা ওদের বিরুদ্ধে নালিশ করতে চলেছে৷ ওদের চোখের চাউনিগুলোও তো স্বাভাবিক ছিল না! ওরাও কেমন কামাতুরভাবে তাকাচ্ছিল না তিতলির দিকে? যেন একটা বাচ্চা মেয়ে নয়—বেওয়ারিশ একপ্লেট মাংস৷ যখন খুশি থাবা বসালেই হল! ওদের চোখগুলো কী পরম লালসায় চেটে যাচ্ছিল না তিতলির উন্মুক্ত বাহুমূল; উরু? ওরাও কি তবে ওই সাইটটা দেখে?

ঐশানী অনুভব করল চতুর্দিকে হাজার হাজার শ্বাপদের সবুজ চোখ যেন ক্রমাগত জ্বলছে আর নিভছে৷ শ্বাপদও নয়; আসলে নরপিশাচ৷ ওরা তিতলিকে দেখেছে, দেখছে! ওত পেতে বসে আছে শিকারের জন্য৷ কখন কামড় বসাবে এই আশায় লোভাতুর দৃষ্টিতে মেপে নিচ্ছে শিকারের পুরুষ্টু দেহ৷ পরম লালসায় ঠোঁট চেটে নিচ্ছে—!

কিন্তু শুধুই কি ওরা? ঐশানী জানে যে তার নিজের মোবাইলে ‘রিঙ্গা রিঙ্গা রোজেস’ কখনই ছিল না! যদি থাকত, তবে কখনও না কখনও নজরে ঠিকই পড়ত৷ তিতলি নিজে থেকে বড়জোর শুধু গেম ডাউনলোড করে৷ এরকম একটা পর্নোসাইটের খবর তার পাওয়ার কথাই নয়! তবে? ও নিজের ছবিটা ওই সাইটে দিল কী করে? কীভাবেই বা সাইটটার খোঁজ পেল সে! বাইরের কারোর মোবাইল তিতলি কখনই ঘাঁটে না! তাহলে কি—!

এতক্ষণে সবচেয়ে মারাত্মক সম্ভাবনাটার কথা মাথায় এল ঐশানীর! ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করতেই তার সারা দেহে একটা হিমেল স্রোত বয়ে যায়! মুহূর্তের ভগ্নাংশে কেঁপে উঠল সে৷ এতক্ষণ বাইরের শ্বাপদদের কথা ভেবেই অস্থির হয়ে পড়েছিল৷ ভাবছিল, যদি কেউ শিশুর সারল্যের সুযোগ নিয়ে তিতলির ওপর অত্যাচার করে! কিন্তু এতক্ষণে যা বুঝল, তা হয়তো আরও মারাত্মক!

বাইরে যাওয়ার দরকার নেই, নরপিশাচ তার তীক্ষ্ণ নখ আর দাঁত নিয়ে ঘরের মধ্যেই বসে আছে!

তখন স্টোররুমে বন্দি হয়ে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল আট বছরের বিপন্ন শৈশব৷ তার চতুর্দিকে কীট-পতঙ্গের ডানার শব্দ! কোথাও ইঁদুরের খুটখুট৷ কোথাও বা আরশোলার ফড়ফড়৷ এতক্ষণ ধরে অন্ধকারে লুকিয়ে থেকে তাকে ক্রমাগতই ভয় দেখিয়ে যাচ্ছিল৷ কিন্তু ক্লান্তির কাছে, বেদনার কাছে হার মেনে যায় সব ভয়৷

তিতলি ঘুমোচ্ছিল৷ তার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া অশ্রুবিন্দু, দুই ভুরুর মধ্যে স্পষ্ট একটা ভাঁজ বলে দেয় যে কোনওরকম নিশ্চিন্তির মধ্যে সে নেই৷ কোনওরকম সুখস্বপ্ন তাকে আলিঙ্গন করেনি৷ একেবারে চূড়ান্ত ভয়ের মধ্যেই ওর রাত কাটছে৷

তার অজান্তেই কখন যেন খুট করে খুলে গেল স্টোররুমের দরজা! আস্তে আস্তে, অতি সন্তর্পণে একটা ছায়া ঘনিয়ে এল মেয়েটির খুব কাছে! হাঁটু গেড়ে বসল তার পাশে৷ কানের কাছে যেন দুঃস্বপ্নের মতো ফিসফিস করে গাইল সেই অস্ফুট গান :

‘রিঙ্গা রিঙ্গা রোজেস/পকেট ফুল অব পোজেস—!’

গানটা শ্রবণেন্দ্রিয়ে আঘাত করতেই তিতলি তড়িদাহতের মতো লাফিয়ে উঠল! আট বছরের বাচ্চা মেয়ে ঘুম ভাঙামাত্রই বুঝে উঠতে পারেনি যে ঠিক কোথায় আছে৷ প্রতিটি বিপন্ন ও ব্যথিত শিশুর মতোই স্বাভাবিক প্রতিবর্তক্রিয়ায় সে ডেকে উঠল;

‘মা!’

এক বিস্রস্তবসনা নারী বুকে জড়িয়ে ধরল তাকে; ‘এই তো তিতলি! এই তো আমি!’

মাকে জড়িয়ে ধরে ঝড়ে বিপর্যস্ত প্রদীপের শিখার মতো কেঁপে উঠেছে সে৷ মায়ের হৃদস্পন্দনের সঙ্গে সঙ্গে তার দেহের প্রতিটি কোষ, প্রতিটা শিরা-উপশিরা থরথরিয়ে উঠছে৷ আগ্রাসী কান্না আর কাঁপুনিকে কোনওমতে বুকের মধ্যে চেপে রেখে আর্তকণ্ঠে বলল তিতলি, ‘মা, আমার ভয় করছে!’

অন্ধকারেই হাসল ঐশানী, ‘ভয় কী মা? গান তো!’

‘বাবা শুনতে পেলে মারবে—!’

‘কেউ মারবে না!’ সে দু-হাত দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরল নিজের আত্মজাকে, ‘আয় আমরা গান গাই—রিঙ্গা রিঙ্গা রোজেস/পকেট ফুল অব পোজেস— তারপর?’

মেয়ে তখনও ভয়ে কাঁপছে, ‘ওই গানটা গেও না মা! বাবা বলেছে পাপ—!’

তিতলি বাক্যটা অসমাপ্ত রেখেই চুপ করে যায়৷ ঐশানীর বুকে একটা জোরদার ধাক্কা লাগে৷ এই আট বছরের শিশুটার মনেও তবে শেষ পর্যন্ত পাপ ঢুকল! মারের দাগ তো একসময় মিলিয়ে যাবে৷ কিন্তু পাপবোধ! শৈশবের রেশমি কমনীয়তায় একবার যে ভাঁজ পড়ে, তা তো আর কখনই মিলিয়ে যেতে চায় না৷ তিতলি কি ভুলে যেতে পারবে এই দিনগুলোর কথা? নাকি আজীবন তাকে তাড়া করে বেড়াবে সেই অনন্ত পাপবোধ!

মা মৃদু হেসে সন্তানের উশকোখুশকো চুলে হাত বুলিয়ে দেয়৷ চাপা সুরেলা স্বরে বাকিটুকু গেয়ে দেয়, ‘আ হুশা, আ বুশা/উই অল ফল ডাউন/ফিল দ্য লাভলি সানশাইন/ফ্লাওয়ারস অল অ্যারাউন্ড/জাম্প আ লিটল জাম্প রাইট অফ দ্য গ্রাউন্ড—৷’

মেয়েটা গভীর বিস্ময়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে৷ ঐশানী আদর করে তার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, ‘পড়ে তো সকলেই যায়৷ কিন্তু পড়ে গেলেও লাফিয়ে উঠতে হবে যে!’

তিতলি কী বলবে বুঝতে পারে না৷ স্বাভাবিকভাবেই ঐশানীর কথার মাথামুন্ডু বুঝতে পারছে না৷ কিন্তু তার মায়ের চোখে চকচক করছে রহস্যের আলো-আঁধারি খেলা৷ সে একে একে চারখানা মোবাইল ফোন এগিয়ে দেয় মেয়ের দিকে৷ গভীর রাতে, সবার ঘুমের সুযোগ নিয়ে, অতিকষ্টে চুরি করে আনা মোবাইলগুলোকে যেন অসীম কৌতুকে ঠেলে দিয়ে বলল, ‘এর মধ্যে কোনটা দিয়ে তুই ছবি তুলে পোস্ট করেছিলি বল তো!’

তিতলি নীরব৷ অপ্রস্তুতের মতো তাকিয়ে থাকে৷ তার বুকের ভেতর আবার সেই ‘পাপ’ নামের জীবটা আড়মোড়া ভাঙছে৷

‘কোন মোবাইলটা বল৷ তারপর আর আমরা এ বাড়িতে থাকব না৷ চুপিচুপি চলে যাব৷’ ফিসফিস করে বলে কৌতুকময়ী৷

সে বিস্ময়বিহ্বল স্বরে প্রশ্ন করে, ‘কোথায় যাব?’

ঐশানী ফিক করে হেসে ফেলল, ‘গাছতলায়৷’

পরদিন সকালবেলায় মা এবং মেয়েকে আর সে বাড়িতে পাওয়া গেল না!

কখন যে তারা নিশ্চুপে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে, তা কেউ টের পায়নি৷ আলমারির লকার থেকে টাকা-পয়সা কিংবা গয়নাগাঁটি কিছুই নিয়ে যায়নি ওরা৷ সব কিছুই যথাস্থানে আছে, শুধু মানুষ দুটোই নেই! তারা এমনভাবে অদৃশ্য হয়েছে যেন আদৌ কোনওদিনই এখানে ছিল না!

মানুষ দুটোকে অনেক খুঁজেও পাওয়া গেল না বটে, কিন্তু পাওয়া গেল একটা চিরকুট! তাতে শুধু একটাই বাক্য লেখা আছে :

‘পারলে নিজের মায়ের গর্ভে একটা লাথি মেরো!’

দুই ভাইয়ের দু-জোড়া চোখ পরস্পরের দিকে তাকায়! ওদের মধ্যে একজন অত্যন্ত বিপন্নভাবে কিছু বলতে চাইছিল৷ কিন্তু তার শব্দগুলোকে বেমালুম কেড়ে নিয়ে একটা বে-আক্কেলে টিকটিকি ডেকে ওঠে :

‘ঠিক—ঠিক!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *