খুনির আঙুল

খুনির আঙুল

‘চুষুন দাদা, চুষুন৷ যত চুষবেন তত রস৷ যত খাবেন তত মিষ্টি৷ একবারটি খেয়ে দেখুন দাদা৷ মনে হবে প্রাণ ঠান্ডা হচ্ছে৷ স্বর্গসুখ পাচ্ছেন…৷’

না, তেমন বিশেষ কিছু নয়৷ লেবুলজেন্স! প্রতিটা লোক্যাল ট্রেনেই লাল, কমলা, হলুদ কিংবা কালো রঙের লজেন্সের বয়ম হাতে এই লেবুলজেন্সের হকারদের দেখতে পাওয়া যায়৷ ওদের পেশা একই৷ পার্থক্য শুধু বক্তৃতায়৷ কতরকম সুরে, কতরকম অদ্ভুত টোনে, বিচিত্র ভাষার আবেদনে ট্রেনের যাত্রীদের চমকে দেয় ওরা৷ যে যত চমকাতে পারবে, যাত্রীদের মনোরঞ্জন করতে পারবে, তার তত বিক্রি৷

‘চুষুন দাদা, চুষুন৷ খেয়ে দেখুন দাদা৷ মুখে একেবারে মাখনের মতো গলে যাবে৷ একবারটি শুধু খেয়ে দেখুন…!’

ওপ্রান্ত থেকে হঠাৎ ভেসে এল গম্ভীর স্বর, ‘খেলেই ম-রে যা-বে-এ-এ৷ চুষলেই ম-রে যা-বে-এ-এ-এ!’

বিপুলবাবু সবে একটা লেবুলজেন্সের প্যাকেট খুলে মুখে দিতে যাচ্ছিলেন৷ আচমকাই যেন অমোঘ দৈববাণীর মতো কানে এসে ঢুকল একটা আর্তচিৎকার!

‘খে-লে-ই মরবে-এ-এ! চুষলেই মরবে-এ-এ!’

বিপুলবাবুর হাত কেঁপে গেল! আচমকা এই ডায়লগ শুনে হতভম্ব হয়ে গেছেন! হাতের কমলা রঙের লেবুলজেন্স পপাত ধরণীতলে! চশমার পিছনের বিস্মিত ভয়ার্ত চোখদুটো শব্দের উৎস খুঁজতেই যাচ্ছিল৷ কিন্তু তার আগেই পাশে বসা তরুণ সহযাত্রীটি হেসে ফেলে জানায়, ‘ইঁদুর, আরশোলার বিষ৷’

তাই তো৷ রোজই তো এই শব্দগুলোই শুনে চলেছেন লোক্যাল ট্রেনে৷ এ প্রান্তে লেবু-লজেন্স৷ ও প্রান্তে ইঁদুর-আরশোলা মারার বিষ৷ একটু পরেই আসবে ইমিটেশনের গয়না এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার চূরণ! তারপর বাত-বেদনার তেল৷ এ তো রোজই হয়ে চলেছে! নিজের নির্বুদ্ধিতায় একটু অপ্রস্তুত হয়ে লেবুলজেন্স মুখে পুরে ফেলেছেন তিনি৷ ইঁদুর-আরশোলার বিষের হকারটি কয়েক মুহূর্তের জন্য ইতিউতি তাকিয়ে ফের হাঁকডাক শুরু করে, ‘খেলেই মরবে-এ-এ-এ! চুষলেই মরবে-এ-এ!’

বিপুলবাবু একটি সরকারি স্কুলের কেমিস্ট্রি টিচার৷ নামে বিপুল হলে কী হবে! আগাপাশতলা ক্ষীণকায় মানুষটি যখন রাস্তা দিয়ে ছাতা মাথায় হাঁটেন, তখন মনে হয়, কোথাও কিছু নেই—শুধু একটা পেল্লায় ছাতা রাস্তা দিয়ে গড়গড়িয়ে চলে যাচ্ছে! নাকের ওপর একখানা প্যাঁচা মার্কা আদ্যিকালের গোলগোল ফ্রেমের চশমা না থাকলে ভদ্রলোককে হয়তো দেখাই যেত না! সবসময়ই একটা কুণ্ঠিত ভাব৷ যেন অজান্তেই কোনও অপরাধ করে ফেলেছেন৷ এ জাতীয় ভীতু ভীতু প্রকৃতির মানুষের জীবনে বিড়ম্বনাদেবী সবসময়ই দক্ষিণহস্ত উপুড় করে রাখেন! চন্দননগর থেকে কলকাতায় ডেইলি প্যাসেঞ্জারি সেই বিড়ম্বনাগুলোর মধ্যে একটা৷ রোজ সাতসকালে দু-মুঠো ফেনাভাত আর ডিম-আলুসেদ্ধ নমো নমো করে পেটে দিয়েই দৌড়তে হয়! তার মধ্যেও আবার বিড়ম্বনা! এই বিড়ম্বনার নাম কোষ্ঠকাঠিন্য! এই তাড়ার মধ্যে কোথায় সুবোধছেলের মতো সহজবোধ্য হয়ে বর্জ্যপদার্থ সহজে নিষ্কাশিত হবে, তা নয়! বরং তার মেজাজমর্জি বোঝাই দায়! কখন যে তিনি দয়া করে দেখা দেবেন তা বোঝা অসম্ভব! ফলস্বরূপ বোতল-বোতল জল ও সিগারেট সেবনের পিছনে সময় যায়! এবং অবধারিত ভাবে ট্রেন মিস! স্কুলের হাজিরাখাতায় তাঁর নামের পাশে লালদাগ! এবং যথারীতি আরেক ভয়ংকর বিড়ম্বনার আগমন! রাশভারী হেডমিস্ট্রেসের মিছরির ছুরির মতো তীক্ষ্ণ কথা!

বিড়ম্বনার গল্প এখানেই শেষ নয়৷ অসম্ভব নিরীহ, শান্তস্বভাবের দরুন দুষ্টু ছাত্রছাত্রীরা সহজে বাগ মানতে চায় না! বিপুল রঞ্জন আচার্য; তথা বি আর এ, নামটির ইনিশিয়াল নিয়েও তাঁর বিপত্তি! এই গোটা পিতৃপ্রদত্ত নামটি এখন ছাত্র-ছাত্রীদের মুখে সংক্ষিপ্তসারে ‘ব্রা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে! এমনকি সহকর্মীরাও নাকি পিছনে তাঁকে ‘ব্রা’ বলেই ডাকেন৷ সেদিন স্বয়ং হেডমিস্ট্রেসও অন্যমনস্ক হয়ে দুম করে মুখ ফসকে বলে ফেললেন, ‘একটু ব্রাকে ডেকে দাও তো!’

‘আজ্ঞে?’ পিওন থতমত! হেডমিস্ট্রেস অপ্রস্তুত৷ কোনওমতে বললেন, ‘ওই যে বি আর এ…মানে বিপুলবাবুকে ডেকে দাও৷’

হেডমিস্ট্রেস মুখ লুকোনোর জায়গা পাচ্ছেন না! পিওন গম্ভীর মুখে বাইরে এল! তারপর তার কী দমফাটা হাসি! যেন ‘ব্রা’ যে বিপুলও হতে পারে, তা স্বপ্নেও কোনওদিন ভাবেনি৷

ভাবতে ভাবতেই একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন বিপুল৷ আজকাল আর এসব ছোটখাটো জিনিস মনে দাগ কাটে না৷ এর থেকেও বড় বিড়ম্বনা তাঁর বাড়িতে বসে আছে৷ একমাত্র মেয়ে সোমদত্তা৷ বিয়ের বয়েস হয়েছে৷ তার জন্য তিনি নিজেও চিন্তিত কম না৷ রীতিমতো পেপারে বিজ্ঞাপন দিয়ে পাত্র খুঁজছেন৷ কিন্তু মেয়ে বেঁকে বসে আছে৷ সে এখনই বিয়ে করতে চায় না৷ বিয়ে না করতে চাইলেও প্রেমে অরুচি নেই৷ রোজই এর সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছে, ওর সঙ্গে ডিনার খাচ্ছে! প্রতিবেশীরাও মেয়ের চরিত্র নিয়ে ফিসফিস করে৷ তবু বিপুলবাবু মুখ ফুটে তাকে শাসন করতে পারেন না! হাজার হোক, মা-মরা মেয়ে! এক বছরও হয়নি মাকে হারিয়েছে৷ এখনও সে শক কাটিয়ে উঠতে পারেনি৷ মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে আজও কেঁদে ফেলে মেয়েটা! এই পরিস্থিতিতে তাকে কড়া কথা বলেন কী করে!

‘অলখ নি-র-ঞ্জ-ন!’

বাজখাঁই কণ্ঠস্বরে চিন্তাসূত্র ছিঁড়ে গেল তাঁর! রোজই এই সময়ে এক সাধুবাবার আগমন ঘটে! গায়ে লাল রঙের গেরুয়া! ইয়াব্বড় এক জটা! দেখলেই মনে হয়, না জানি কত পশুপাখি ওর মধ্যে ঢুকে বসে আছে৷ অগোছালো দাড়ির জ্বালায় আসল মুখ বোঝা দায়৷ হাতে একটা চিমটে, অন্যহাতে কমণ্ডলু! রোজই এই কম্পার্টমেন্টে এসে বসেন৷ অবিশ্বাসীদের সঙ্গে তর্ক করেন না! বিশ্বাসীদের হাত দেখে দেন৷ সমস্যা থাকলে সমাধানের উপায়ও বলে দেন৷ উল্টোদিকের সিটে বসে থাকা রঞ্জনবাবু এই সাধুবাবাকে দিয়ে কী যেন একটা যজ্ঞ-টজ্ঞও করিয়েছেন৷

‘ক্যায়া হাল হ্যায় বেটা?’ কথা নেই বার্তা নেই বাবাজি আজ একেবারে বিপুলের ঘাড়ে এসে পড়েছেন! যেন কতদিনের পরমাত্মীয়!

বিরক্ত হয়ে বিপুলবাবু উত্তর দিলেন না৷ তাঁর অস্বস্তি হচ্ছিল৷ লোকটার দাড়িগুলো হাওয়ায় উড়ছে৷ মাঝেমধ্যে বিনা অনুমতিতে বিপুলের নাকের ওপর ঝাপটাও মারছে! তার ওপর বাবাজির গায়ের বিটকেল গন্ধ! নস্যি আর গাঁজার সম্মিলিত সৌরভ! লোকটা হাত চুলকাতে চুলকাতে বিপুলবাবুর হাতের দিকে স্থির দৃষ্টিতে দেখছে৷ তিনি সভয়ে তাকান৷ সর্বনাশ, লোকটার চর্মরোগ আছে না কি? এসব বিষয়ে বিপুলবাবু আবার ভীষণ সাবধানি৷ রোজ ডেটল সাবান দিয়ে বার তিনেক স্নান করেন৷

‘ইয়ে ক্যায়া! ক্যায়া হ্যায় ইয়ে?’

তিনি বাবাজির থেকে যথাসম্ভব ছোঁয়াচ সামলে বসছিলেন! বাবা তাঁর বুড়ো আঙুলের দিকে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ! তারপরই বিদ্যুৎগতিতে তাঁর হাত চেপে ধরেছেন৷ তাঁর দৃষ্টি বুড়ো আঙুলের দিকে নিবদ্ধ! ভয়ার্ত কণ্ঠে বললেন, ‘ইয়ে ক্যায়া হ্যায়! ইতনা বড়া অঙ্গুঠা! সত্যনাশ! সত্যনাশ!’

বিপুলবাবু কী বলবেন ভেবে পেলেন না! ছোটবেলা থেকেই ওঁর বুড়ো আঙুলটা অস্বাভাবিক স্ফীত৷ লোকে ক্ষেপাত, ‘বুড়ো আঙুল ফুলে কলাগাছ!’ কিন্তু তার জন্য কখনই কোনও ক্ষোভ ছিল না! কারণ বুড়ো আঙুলের স্ফীতিটা তার নিজের হাতে নেই৷ ওটা ঈশ্বরের বদমায়েশি বা অনিচ্ছাকৃত ভুল! এই ‘বুড়ো আঙুল’ নিয়েই তো এতবছর পার করে এলেন৷ এখন হঠাৎ নতুন করে ‘সত্যনাশে’র কী হল!

‘সত্যনাশ! ইতনা বড়া অঙ্গুঠা!’ বাবাজি ওঁর দিকে নিষ্পলকে তাকিয়ে বলেন, ‘তু তো খুনি বনেগা রে! জরুর খুনি বনেগা! তেরে হাথ মে খুন লিখা হ্যায়!’

মাথায় বাজ পড়লেও বোধহয় এত বিস্মিত হতেন না বিপুলবাবু! তিনি হতভম্ব হয়ে বাবাজির দিকে তাকিয়ে আছেন৷ কোনও কথা মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে না! গোটা কম্পার্টমেন্টের শোরগোল যেন সেই ভবিষ্যদ্বাণীতে মুহূর্তে থমকে যায়৷ সবাই কৌতূহলী সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে দেখছে এদিকে! কোনওমতে ঢোঁক গিলে স্খলিত স্বরে বিপুলবাবু বললেন, ‘আ-মি! খু-ন!’

ঠিক তখনই উদ্যত ছুরি হাতে একটা লোক এগিয়ে এল তাঁর দিকে৷ যেন এখনই ঘ্যাচাং করে কেটে দেবে তাঁর গলার নলি! রাগতস্বরে বলল, ‘দেব নাকি ছাল ছাড়িয়ে?’

‘অ্যাঁ!’ প্রচণ্ড ভয়ে আঁতকে উঠলেন তিনি৷ অবশ্য ভয় পাওয়ার কিছু ছিল না! লোকটা নেহাতই একজন শশাওয়ালা!

‘কিরো-বেনসন থাম্ব থিওরির নাম শুনেছেন?’

অঙ্কের টিচার গিরীশ গুপ্ত ভুরু কুঁচকে তাকালেন বিপুলবাবুর দিকে, ‘এসব জিনিস নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন কখনও?’

বিপুলবাবু অসহায় ভাবে মাথা নাড়েন, ‘নাঃ৷’

‘তাহলে এখন খামোখা ঘামাচ্ছেন কেন?’ তিনি একটা সিগারেট ধরিয়ে আয়েশ করে টান মারলেন, ‘কেমিস্ট্রির লোক কেমিস্ট্রি নিয়েই থাকুন না৷ খামোখা জ্যোতিষের রাজ্যে ঢুকছেন কেন?’

বিপুলবাবু বিরক্ত হলেন৷ ঢুকছেন কি সাধে? কেমিস্ট্রি নিয়েই তো খুশি ছিলেন! কিন্তু জ্যোতিষ নিজেই এখন তাঁর রাজ্যে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়েছে৷ বিজ্ঞানের যুক্তিবাদী রাজ্যের সীমানার বাইরে যে সে আর থাকতে চাইছে না!

‘শুনুন, সহজ করে বুঝিয়ে বলি৷’ একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন গিরীশ, ‘কিরো-বেনসন থাম্ব থিওরি অনুযায়ী যে কোনও মানুষের চরিত্র তার বুড়ো আঙুল দেখে বোঝা যায়৷ বুড়ো আঙুল দেখে বলা যায় ওই আঙুলের মালিক শিল্পী, না কসাই৷’

বিপুলের মুখ বিষণ্ণ হয়ে ওঠে৷ তবে কি তিনি কসাইয়ের দলে পড়লেন!

‘আপনার বুড়ো আঙুল একটু প্রয়োজনের বেশিই মোটা, গোদা আঙুল৷’ গিরীশ হাসছেন, ‘থিওরি অনুযায়ী আপনার মধ্যে খুনের প্রবণতা থাকা স্বাভাবিক৷ কিন্তু তাই বলে আপনাকে গ্যাংস্টার হতে হবে, এমন কোনও কথা নেই! রকেট লঞ্চার, মিসাইল বা গ্রেনেড তো দূর, আপনি একটা নিরীহ মশা-মাছি মারার ব্যাট নিয়ে বেরিয়েছেন ভাবলেই…!’ কথাটা শেষ না করেই ফিচিক করে হেসে ফেললেন ভদ্রলোক৷ দৃশ্যটা কল্পনা করে পিছন পিছন একটা অট্টহাসিও আসছিল৷ কিন্তু অঙ্কের বইটার ওপর উপুড় হয়ে কোনওমতে সামলে নেন৷

বিপুল দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন৷ এই প্রতিক্রিয়া এই প্রথম দেখছেন না! তাঁর ঘনিষ্ঠতম ও বয়সে কনিষ্ঠতম কলিগ কাম বন্ধু জয়দীপকেও গোটা ঘটনাটা জানিয়েছেন৷ সে তো প্রথমেই কিছুক্ষণ ‘খ্যাঁ খ্যাঁ খোঁ খোঁ’ করে হেসে গড়াগড়ি দিল৷ সে হাসি আর থামেই না! কোনওমতে নিজেকে সামলাতে সামলাতে বলল, ‘অ্যাঁ? কী খুন করেছেন আপনি? মশা, মাছি? না ইঁদুর-বাদুড়?’

অদ্ভুত একটা রাগ নিজের মধ্যে টের পেলেন বিপুল! ট্রেনের লোকটা ভবিষ্যদ্বাণী করেছে প্রায় এক সপ্তাহ হতে চলল! এই এক সপ্তাহে তাঁর মধ্যে কিছু অদ্ভুত অদ্ভুত পরিবর্তন হয়েছে৷ না, ঠিক পরিবর্তন নয়৷ হয়তো এই স্বভাব বা অভ্যাসগুলো তাঁর আগেই ছিল৷ কোনওদিন বিশেষ করে খেয়াল করেননি৷ কিন্তু এখন টের পাচ্ছেন! যেমন মাঝেমধ্যেই তাঁর ভেতরে একটা অদ্ভুত রাগ দাপাদাপি শুরু করে৷ রাগটা হয়তো আগেও ছিল৷ তবে এমন নগ্নভাবে প্রকাশিত হয়নি কখনও৷ তিনি চাপা গলায় হিসহিস করে ধমকে উঠলেন, ‘জয়দীপ, আমি ফাজলামি করছি না!’

জয়দীপ একটু থমকে গিয়েছিল৷ তারপর স্বভাবসিদ্ধ হাল্কা ভঙ্গিতে বলে, ‘তা গুরুদেব যখন সমস্যাটা বলেছেন, তখন সমস্যা নিরসনেরও নিদান দিয়েছেন নিশ্চয়ই৷’

‘হ্যাঁ৷’ তিনি জানালেন, ‘একটা হোম-যজ্ঞ করা দরকার! বলেছেন, হাজার পাঁচেক টাকা লাগবে৷ তাহলেই সব দোষ কেটে যাবে৷’

‘ইয়েহি তো মার খা গয়া ইন্ডিয়া!’ জয়দীপ টেবিলে চাপড় মারল, ‘ওটাই হচ্ছে আসল কথা৷ বিপুলদা, আপনি এই সব ভণ্ড, প্রতারকদের কথা বিশ্বাস করেন? কিস্যু না! স্রেফ আপনাকে মুরগি করে কিছু টাকা খসানোর ধান্দা! ছাড়ুন তো! যত্তসব৷’

সে ‘ছাড়ুন তো’ বলে গেল বটে; কিন্তু বিপুল ছাড়তে পারেননি৷ এই সাতদিনে পাল্টেছে অনেক কিছু! আচমকাই আবিষ্কার করেছেন, তাঁর খুন-জখমের ঘটনা দেখতে বেশি ভালো লাগে! ডেইলি সোপ তিনি কখনই দেখেন না৷ কিন্তু ভূতের সিনেমা, হলিউড অ্যাকশন ফিল্ম, খুনোখুনি, ক্রাইম-থ্রিলার দেখতে বসলে নাওয়া-খাওয়ার হুঁশ থাকে না! এ অভ্যেস আজকের নয়৷ বহুদিন এ নিয়ে করুণা আর মেয়ে সোমদত্তার অভিযোগ শুনতে হয়েছে তাঁকে৷ বিরক্ত হয়ে সোমদত্তা বলত, ‘কী যে দেখ ছাইপাঁশ! একটা লোক মুখোশ পরে রামদা হাতে একটার পর একটা লোককে মেরে কেটে চলেছে! অথবা দুটো ডাইনোসোর একটা লোককে দু-টুকরো করে ছিঁড়ে খাচ্ছে! এসব কি দেখার জিনিস হল! খালি রক্ত…আর রক্ত!’

সেসব কথায় কোনওদিন পাত্তা দেননি তিনি৷ বরং উলটে আরও ডুবে গেছেন সিনেমার পর্দায়৷ কিন্তু আচমকা সেদিন একটা ইংরেজি থ্রিলার দেখতে দেখতে হঠাৎ মনে হল, ‘কী দেখছি আমি! কেন দেখছি!’ বিপন্ন বিস্ময়ে আবিষ্কার করলেন; তাঁর খুন-জখম, বীভৎস রস দেখতে ভালো লাগে!

খুন-জখম দেখতে ভালো লাগা মোটেই দোষের কথা নয়৷ ইন্ডিয়ান পিনাল কোড অনুযায়ী কোনও অপরাধ তো নয়ই! কিন্তু ভিতরে ভিতরে বিপুল একটা অজানা ভয়ে, অযৌক্তিক অপরাধবোধে সিঁটিয়ে গেলেন৷ ঠিক করেছেন, এখন থেকে আর খুন-জখম নয়৷ রোজ রাতে ধর্মীয় কিংবা কার্টুন চ্যানেলগুলো দেখবেন৷ সন্তোষী মাতা, সাঁইবাবার ওপর আধারিত ফিল্ম ছাড়া আর কিছু নয়! মাঝখানে কয়েকদিন মহাভারত দেখেছিলেন৷ কিন্তু যেই না কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শুরু হয়েছে, অমনি দুম করে পালটে গেল চ্যানেল! না, যুদ্ধ নয়! কিছুতেই নয়! মহাভারত মাথায় থাক, বরং বেঁচে থাকুক পোগো, হাঙ্গামা চ্যানেল৷

শুধু চ্যানেল নয়, সঙ্গে সঙ্গে পালটে গেল মেনুও৷ সপ্তাহে তিনবার মাংস না খেলে চলত না তাঁর৷ নিজে দাঁড়িয়ে থেকে মাংসওয়ালাকে নির্দেশ দিয়ে পছন্দমতন পিস বেছে নিতেন৷ বাকিরা বাজারের ব্যাগ রেখে সবজিবাজারের দিকে হাঁটা দেয়৷ কিন্তু তিনি ওখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন৷ মাংসওয়ালার বিরক্তিকে উপেক্ষা করে রীতিমতো সরেজমিনে তদন্ত করে মাংসের টুকরো নিজের হাতে বেছে নেন৷ সেদিনও নিচ্ছিলেন৷ কসাইয়ের হাতে জীবন্ত ছালছাড়ানো মুরগি ছটফট করছে৷ একদম সামনে দাঁড়িয়ে বিপুল তাকে নির্দেশ দিয়ে চলেছেন, ‘আমার গোটা ঠ্যাংটাই চাই কিন্তু৷ একদম দু-টুকরো করবে না! আর মেটেটা অবশ্যই দেবে…!’

পিছন থেকে পাঁশুটে ইঁদুরের মতো একটা ভীত মুখ মাঝেমধ্যেই উঁকিঝুঁকি মারছিল৷ আচমকা খুনখুনে স্বরে বলল, ‘ওঃ মশাই! কী করে সামনে দাঁড়িয়ে আছেন? মুরগিগুলোর এই প্রাণান্তকর ঝটপটানি চোখে দেখা যায় না! বীভৎস! জীবনে এই প্রথমবার নিজে মাংস কিনতে এসেছি! নেহাত চাকরটা ছুটি নিয়েছে৷ আর ছেলে-মেয়ে-গিন্নির রবিবার মাংস না হলে চলে না তাই…!’

বিপুলবাবু ঝুঁকে পড়ে সদ্যছিন্ন মুরগির ঠ্যাংটা জরিপ করছিলেন৷ আচমকা কথাটা শুনে সটান উঠে দাঁড়ালেন! হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, তাজা রক্তে লাল হয়ে আছে তাঁর বুড়ো আঙুল আর তর্জনী! মাথার মধ্যে কে যেন ফিসফিসিয়ে বলল, ‘খুনি! খুনি!’

সেদিন থেকে মাংস খাওয়াই ছেড়ে দিয়েছেন তিনি৷ শাক-সবজি, তরি-তরকারি দিয়েই পেট ভরান৷ এমনকি মাছও স্পর্শ করেন না! সোমদত্তা মাছ পছন্দ করে না৷ সকালে দুজনেই একপেট ফেনাভাত, ডিম-আলুসেদ্ধ খেয়ে নেন৷ বিপুল স্কুলের পথে রওনা দেন, আর সোমদত্তা কলেজের দিকে৷ বিপুলের লাঞ্চ স্কুলের ক্যান্টিনে লুচি-আলুর দম৷ আর সোমদত্তা চাউমিন বা দোসা৷ আরামের খাওয়া জোটে একবারই; রাতে! করুণা চলে যাওয়ার পর বিপুল রান্নাবান্না নিজেই করতেন৷ নিজেই মাছ কেটেকুটে নিপুণহাতে পরিষ্কার করে রাঁধেন-বাড়েন! সেদিন মাছ কাটতে বসে তাঁর গা শিরশিরিয়ে ওঠে৷ তরতাজা জিওল মাছ দিয়েছিল মাছওয়ালা! মাছগুলো তখনও বালতির জলে খলাৎ খলাৎ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ একটাকে বঁটির এক পোঁচ দিয়েই কেঁপে উঠলেন! জীবন্ত প্রাণীটা থরথরিয়ে এলিয়ে পড়তেই তার রক্তে স্নান করে বুড়ো আঙুলটা যেন চেঁচিয়ে উঠল, ‘খু-উ-ন…খু-উ-ন…!’

‘কী ভাবছেন?’ অঙ্কশিক্ষক গিরীশ গুপ্তর কণ্ঠস্বরে চিন্তাসূত্র ছিন্ন হয়ে যায়৷ বিপুল সংবিৎ ফিরে পান৷ গিরীশ বিরক্ত সুরে বলেন, ‘তখন থেকে দেখছি, ভেবেই চলেছেন! ওদিকে ইলেভেনের থার্ড পিরিয়ডের ঘণ্টা যে অনেকক্ষণ পড়ে গেছে৷ ক্লাসটা অ্যাটেন্ড করবেন না?’

সর্বনাশ! থার্ড পিরিয়ডের ঘণ্টা পড়ে গেছে মিনিট পনেরো আগে! অথচ তিনি এখনও স্টাফরুমে! হেডমিস্ট্রেস জানতে পারলে তাঁর গুষ্টির তুষ্টি করতে ছাড়বেন না৷ কোনওমতে কেমিস্ট্রির জগদ্দল বইটা এবং নিজেকে যুগপৎ সামলে হাঁফাতে হাঁফাতে পৌঁছলেন তিনতলায়৷ ইলেভেনের ক্লাসরুমের সামনে! কিন্তু ততক্ষণে কলির সন্ধে হয়ে গেছে, এবং ক্লাসের সুমুখেই বাঘিনির অলৌকিক আবির্ভাব!

হেডমিস্ট্রেস তখন সবে লাঞ্চের পর পান খেয়ে ঠোঁট রাঙা করে দাঁড়িয়েছিলেন৷ চোখও যথেষ্ট লাল৷ তাঁর হাবভাব দেখলেই করুণাকে মনে পড়ে যায় বিপুলের৷ করুণার নামই করুণা, কিন্তু বেঁচে থাকতে বিপুলকে কখনও করুণা করেননি৷ কিছু কিছু মহিলা থাকেন যাঁদের ভালোবাসার শক্তি কম, বরং দাপটের চোটে সবাইকে ভয়ে জড়োসড়ো করে রাখার ক্ষমতা বেশি৷ এঁরা মিনতি করেন না, অনুরোধ করেন না৷ বরং আদেশ করেন৷ এবং সে আদেশ অমান্য করলেই অনর্থ!

‘এতক্ষণে আপনার সময় হল?’ রূঢ়, কর্কশ স্বর তরল সিসার মতোন কানে এসে ঢুকল, ‘আমি তো ভাবছিলাম স্টপ-গ্যাপে কাউকে পাঠাব৷ কী রাজকার্য করছিলেন এতক্ষণ?’

কণ্ঠস্বরে কোনও নারীসুলভ কোমলতা নেই৷ ক্ষমা নেই! অসহ্য রাগটা হঠাৎ মাথার রগ বেয়ে চিড়বিড়িয়ে উঠল৷ তিনি উত্তর দিলেন না৷

‘কী হল? অজুহাত খুঁজে পাচ্ছেন না?’ সুর সপ্তমে চড়ল, ‘এমনিতে তো রোজই প্রায় লেটে ঢোকেন৷ হয় ট্রেন লেট, নয় রেল রোকো, ভূমিকম্প, বন্যা, খরা; সবই তো আছে! এখন দেখছি ক্লাসেও লেট! আপনার সমস্যাটা কী বলবেন? পড়াতে ভালো না লাগলে পড়াবেন না৷ দরজা খোলাই আছে৷ বেরিয়ে যান! ওয়ার্থলেস!’

শব্দগুলো তাঁর মাথায় ঢুকছিল না৷ অপমানিত মুখে, মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আরও একটা কণ্ঠস্বর মনে পড়ে গেল!

‘অপদার্থ! এক নম্বরের অপদার্থ তুমি!’ করুণার গলা ঝমঝমিয়ে ওঠে, ‘মা-বাবা ঠিক বলতেন৷ তোমার দ্বারা কিস্যু হবে না৷ মাস্টারিও না! কত মাস্টার দিব্যি হাজার হাজার টাকা ইনকাম করছে! বাড়ি, গাড়ি করছে৷ আর তুমি এখনও ভাড়ার বাড়ির টাকা গুনছ৷ এতদিনে নিজের মাথা গোঁজার একটা জায়গাও দিতে পারলে না! অপদার্থ!’

তিনি অপরাধীর মতো মৃদুস্বরে বলেন, ‘ওরা সবাই প্রচুর টিউশনি করে৷ ব্যাচ বাই ব্যাচ ছেলে-মেয়ে পড়ায়৷’

‘তুমিও পড়াও৷’

‘না!’ তাঁর শান্ত কণ্ঠে দৃঢ়তা, ‘প্রাইভেট টিউশনি করব না আমি৷ অমন গোরু-ছাগলের মতো ছাত্র-ছাত্রীদের ট্রিট করতে পারব না!’

‘তা করবে কেন?’ করুণা গনগনে দৃষ্টিতে প্রায় জ্বালিয়ে দিলেন তাঁকে, ‘বরং নিজেই গোরু-ছাগলের খোঁয়াড়ে গিয়ে ঢোকো৷ ওটাই তোমার আসল জায়গা! কোথাকার কোন ধর্মাত্মার পো এলেন রে!’

করুণা কোনওদিন করুণা করেননি৷ একমুহূর্তের জন্যও জীবনে শান্তি দেননি৷ তিনি উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন৷ সাধারণ মাস্টারের রোজগারে তাঁর পোষাত না৷ সকাল থেকেই শুরু হয়ে যেত অভিযোগ৷ মাঝখানে কিছুক্ষণের বিরতি৷ রাতে ঘেমে নেয়ে স্কুল থেকে ফেরার পর আরও একপ্রস্থ অভিযোগ! এমনকি নিজের বিছানাও আলাদা করে নিয়েছিলেন৷ বলতেন, ‘কাপুরুষ কোথাকার! তোমার পাশে শুয়ে কী পেয়েছি আমি? একটা মেয়েছেলের কলজের জোরও নেই! এই নাকি পুরুষ! থুঃ, ঘেন্না…ঘেন্না!’

তিনি শুধু চুপ করে শুনে গেছেন৷ শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়েছেন৷ ক্লান্ততর হয়েছেন! ক্লান্তির চরম সীমায় পৌঁছনোর আগেই অবশ্য করুণা প্রথম ও শেষবারের মতো করুণা করলেন৷ লাৎস ক্যান্সারে দেহত্যাগ করলেন!

‘কী হল? মৌনব্রত নিয়েছেন নাকি?’ ফের ধমকে ওঠেন হেডমিস্ট্রেস, ‘কী ভেবেছেন? চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলেই হবে?’

ক্লাস ইলেভেনের ছাত্র-ছাত্রীরা উঁকি মেরে রঙ্গটা দেখছিল! ওদের ফিসফিসানি কানে এল, ‘ব্রায়ের স্ট্র্যাপ আজ ঢিলে করেই ছাড়বে হেডু!’

অসম্ভব রাগটা চড়াৎ করে পৌঁছে গেল মস্তিষ্কের কেন্দ্রে৷ কী ভাবেন এই মহিলা! কী ভাবে ওরা সবাই? তিনি জোকার? ক্লাউন? পাগল? তাঁর চোখে রক্ত জমল৷ আড়চোখে দেখলেন, মহিলা অসাবধানে দাঁড়িয়ে আছেন করিডোরের রেলিঙের গা ঘেঁষে৷ রেলিংগুলো বহু পুরোনো, ক্ষয়াটে৷ খুব বেশি কিছু করতে হবে না! সামান্য একটু ধাক্কা৷ তাহলেই মুক্তি! সোজা তিনতলা থেকে…

তিনি নির্ভয়ে দৃঢ়পায়ে রেলিঙের দিকে এগিয়ে গেলেন! তখনই মনে হল, বুড়ো আঙুলটায় যেন কাঁচা রক্তের দাগ৷ বিপুলবাবু চিৎকার করে উঠলেন, ‘সরে যা-ন! রেলিঙগুলো পুরোনো! আমার বুড়ো আঙুল…বুড়ো আঙুল…!’

বলতে বলতেই পিছন ঘুরে উন্মত্তের মতো সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করলেন৷

রাতে বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছিলেন বিপুল৷ গুমোট গরমে ঘুম আসছে না! আগে এই ঘরে করুণা শুতেন মেয়েকে নিয়ে৷ এখন সোমদত্তা এ ঘরে শুতে ভয় পায়৷ তাই এখন এই ঘরেই তাঁর রাত্রিবাস৷ এখনও এ ঘরে ঢুকলেই ওষুধের গন্ধ পান বিপুল৷ আর মনে পড়ে যায় প্রেতিনীর মতো খলখল করে হেসে উঠে বলা করুণার বিষবাক্যগুলো : ‘এবার? এবার কী করবে? সারাজীবন জ্বালিয়ে মেরেছ৷ এবার আমার পালা৷ প্রতিশোধ নেব…প্রতিশোধ! রাস্তায় বসিয়ে ছাড়ব তোমায়৷ জলের মতো টাকা খসাব! বীরপুরুষ লোন নিতে ভয় পান! প্রাইভেট টিউশনি করে দুটো এক্সট্রা ইনকাম করতে ভয় করে ওঁর! এবার? এবার কী করবে? বিনা চিকিৎসায় ফেলে মারবে?’

তিনি তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা করেন, ‘কিচ্ছু হবে না তোমার! দেখো, সব ঠিক হয়ে যাবে৷’

‘হবে না মানে?’ ফুঁসে উঠলেন করুণা৷ উত্তেজনার চোটে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল তাঁর৷ তবু সাপের মতো হিসহিসিয়ে ক্রুর ও শীতল শব্দগুলো বললেন; ‘নিশ্চয়ই হবে৷ আমি মরব৷ কিন্তু তোমাকেও মেরে যাব৷’

‘কিচ্ছু হবে না রুনা৷’ করুণার দাদা এগিয়ে এসেছিলেন, ‘নামজাদা নার্সিং হোমে রাখব তোকে৷ বড় বড় ডাক্তার দেখাব…!’

‘না!’ রুগ্ন করুণাকে অবিকল ডাইনির মতো লাগছিল, ‘আমি কোত্থাও যাব না! এখানে, এই বিছানায় শুয়েই মরব৷ তোমাদের কোনও হেল্প দরকার নেই৷ তোমরা হেল্প করলে এই লোকটা বেঁচে যাবে৷ আমি ওকে ধ্বংস করে তবেই শান্তিতে মরতে পারব! এক পয়সাও দেবে না ওকে৷ দেখি ওর দৌড় কত!’

শেষ পর্যন্ত করুণার স্বপ্ন অনেকটাই সাফল্যের পথে এগিয়েছিল৷ করুণাকে কিছুতেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যায়নি৷ ফলস্বরূপ বাড়িটাই হয়ে উঠল হাসপাতাল! দামি এসি লাগাতে হল৷ অক্সিজেন সরবরাহের বন্দোবস্ত করতে হল৷ মোটা টাকার বিনিময়ে দুজন নার্সের ব্যবস্থাও হল! কেমোথেরাপির পিছনে, অপারেশনের পেছনে জলের মতো টাকা গেছে! যদিও অপারেশন শেষ পর্যন্ত সাকসেসফুল হয়নি৷ স্বামী, সন্তান এমনকি নার্স দুজনকেও ছ’মাস ধরে যথেষ্ট পরিমাণে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে, শেষ পর্যন্ত অপারেশন টেবিলেই মারা গিয়েছিলেন তিনি! তবু করুণা বিপুলকে প্রায় পথে বসতে দেখে গেছেন! দেনায় দেনায় জর্জরিত হতে দেখেছেন৷ ওঁর আত্মার শান্তি হয়েছে হয়তো!

কী শত্রুতা ছিল তাঁর বিপুলের সঙ্গে? কী অন্যায় করেছিলেন তিনি? বিয়ের পর থেকেই করুণার টাকাসর্বস্ব রূপ ছাড়া আর কিছুই দেখেননি! এখন মনে হয়, করুণা হয়তো মানসিক রোগী ছিলেন৷ জীবনে কিছুতেই সন্তুষ্ট হননি তিনি৷ গয়না গড়িয়ে দিলেও অশান্তি! গয়নাটা কেন হিরের নয়? কেন দার্জিলিং? কেন লাদাখ নয়? ট্রেনের থার্ড এসি? ফ্লাইট নয় কেন? জীবনের ছোট ছোট সুখগুলোকে কখনও দেখতে শেখেননি করুণা! বড় সুখ জুটল না কপালে, তাই হয়তো শেষ পর্যন্ত বড় অসুখই বাধালেন!

কখন যেন এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বিপুল৷ ক্লান্তিতে দু-চোখ বুঁজে এসেছিল৷ কিন্তু আচমকা চটকা ভেঙে গেল! আশ্চর্য! ওষুধের গন্ধটা এমন বেড়ে গেল কী করে? তাঁর নাকে ডেটল মিশ্রিত একটা উগ্র গন্ধ এসে ঝাপ্টা মারছে৷ পাশের শুয়ে থাকা অন্ধকারটা কখন এমন ভয়ানক আকার ধারণ করল? বিপুল সচকিত হয়ে ওঠেন৷ বিছানার পাশে আরও একটা অস্তিত্ব যেন টেনে টেনে শ্বাস ফেলছে! হিমশীতল একটা হাওয়া…

‘শেষমেশ খুনই করতে হল তোমাকে?’

বিপুল ধড়মড়িয়ে উঠে বসেন৷ কে?

‘একটা মেয়েমানুষের হাত থেকে রক্ষা পেতে শেষ পর্যন্ত খুনই করতে হল? কাপুরুষ!’ শেষ শব্দের ‘ষ’টা যেন হুইসলের মতো কানে বাজল, ‘কে-উ জানে না! সোমাও নয়৷ শুধু তুমি আর আমি…!’

বিপুলের কানে একটা কথোপকথন ভেসে আসে৷ দুটো লোক নীচু গলায় কথা বলছে! চিলড এসির ঠান্ডা আমেজে দুটো কণ্ঠস্বর খুব আস্তে অথচ স্পষ্ট ভেসে এল৷

‘আপনি বুঝতে পারছেন না!’ ডাক্তারবাবুর শান্ত কণ্ঠস্বর, ‘কিছু করার নেই৷ পেশেন্ট একদম অ্যাডভান্সড স্টেজে! ফুসফুস পুরোপুরি অ্যাফেক্টেড! কেমো নিয়ে শরীর পুরো ঝাঁঝরা! পেশেন্ট ‘এসোফেগাসে’ পৌঁছে গেছে৷ ফুড পাইপ অ্যাফেক্টেড৷ এ পরিস্থিতিতে অপারেশন করা রিস্কি! অপারেশন টেবিলেই মারা যাবেন৷ তার চেয়ে ওঁকে বাড়িতেই রাখুন! যে ক’টা দিন আছেন, শান্তিতে কাটুক৷’

পেশেন্টের স্বামী ইতস্তত করছে, ‘কিন্তু এমন করে ক’দিন ডক্টর?’

‘বড়জোর মাস তিনেক৷’ ডাক্তারবাবু মাথা নাড়ছেন, ‘তার বেশি কোনওভাবেই নয়৷’

স্বামী অদ্ভুত একটা বিপন্নতায় ডুবে যাচ্ছে! আরও তিনমাস! একেই ধার-দেনা নাক অবধি ঠেকেছে৷ আরও তিনমাস টানতে যে দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম৷ তার চেয়ে আশু সমাধানটাই গ্রহণযোগ্য নয় কি? অপারেশন টেবিলেই যদি মুক্তি পাওয়া যায়…!

সে একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘রিস্ক ফ্যাক্টর কোথায় নেই ডক্টর? তবু আমি অপারেশন করাতেই চাই৷’

‘কী বলছেন!’ ডাক্তারবাবু আকাশ থেকে পড়লেন, ‘আপনি কি আদৌ সমস্যাটা বুঝতে পেরেছেন? ওঁর পারফরম্যান্স ভীষণ পুওর! তার ওপর ইন-অ্যাডিকুয়েট পালমোনারি রিসার্ভ! এ পেশেন্ট ওটি থেকে ফিরবেই না!’

‘তবু চান্স নিতে ক্ষতি কি ডক্টর?’ স্বামীটি নাছোড়বান্দা, ‘সুস্থ হয়ে ফিরেও তো আসতে পারে৷’

ডাক্তারবাবুর মুখ গম্ভীর৷ বারবার বারণ করা সত্ত্বেও পেশেন্টের স্বামী কথা শুনছে না৷ তিনি জানেন এসব কেসে অপারেশন, আসলে কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা৷ অথচ স্বামী ভদ্রলোক নাছোড়বান্দা!

‘আমি সাইন করে দেব৷ যে বন্ডে সাইন করতে বলবেন, করব৷ আপনি শুধু অপারেশনটা করুন৷’

শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছিল৷ এই বুড়ো আঙুল আর তর্জনীর ফাঁকে কলমটাকে শক্ত করে ধরে খসখস করে মৃত্যুর পরোয়ানায় সই করে দিয়েছিল রোগিণীর স্বামী৷ তার হাত একবারের জন্যও কাঁপেনি! ওটিতে যাওয়ার আগে ডাক্তারবাবুর কথাগুলো এখনও কানে বাজে, ‘পরিণতি যাই হোক, দায় কিন্তু আমার নয়৷ এখনও সময় আছে৷ ভেবে দেখুন…!’

‘আমার লাইফ ইনশিওরেন্সের টাকা দিয়ে সব দেনা মিটিয়েছ! বাঃ! একবারও লজ্জা করল না মরা বৌয়ের পয়সায় হাত দিতে?’ কণ্ঠস্বরটা ঝাঁঝিয়ে ওঠে, ‘সবাই তোমাকে বেচারি, সাধুপুরুষ ভাবে! কিন্তু তুমি কী করেছ তা কেউ জানে না! একমাত্র আমি জানি…!’

প্রচণ্ড আক্রোশে অন্ধকারটার গলা টিপে ধরলেন বিপুল৷ চিৎকার করে বললেন, ‘বলতে দেব না৷ কিছুতেই তোকে মুখ খুলতে দেব না!…কী ভেবেছিস…অ্যাঁ?’

অন্ধকারটা খলখল করে হেসে ওঠে! তিনি পাকা খুনির মতো প্রাণপণে তার গলা টিপে ধরেছেন! বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ক্রমাগতই চেপে বসছে মানুষটার গলায়৷ অসহ্য রাগটা জন্তুর মতো দাপাচ্ছে৷ এর শেষ দেখেই ছাড়বেন৷ অনেক সহ্য করেছেন! আজ এস্পার কী ওস্পার!

‘বাবা! কী করছ!…’ ও ঘর থেকে চিৎকার শুনে সোমদত্তা দৌড়ে এসেছে! সে সবিস্ময়ে আলো জ্বেলে দেখল, বিপুল করুণার পাশবালিশটার গলা টিপে ধরেছেন! যেন ওটা পাশবালিশ নয়! যেন ওটা একটা মানুষ!

‘কী করছ? বাবা!’

‘তোর মাকে খুন করছি৷’ বিপুলের চোখদুটো বনবন করে ঘুরছে৷ মুখে গ্যাঁজলা ভাঙছে৷ উন্মত্তের মতো চিৎকার করে বললেন, ‘হ্যাঁ, আগেও করেছি৷ এখনও করছি৷ যতবার পারব খুন করব! আমি খুনী…আমি খুনী…ওই লোকটা ঠিক বলেছিল…আমি খুনী-ই-ই!’

পরের দিন লোক্যাল ট্রেনে বিপুলবাবুকে দেখা গেল না৷

তাঁর বাঁধাধরা সিটে এসে বসলেন আরেক ভদ্রলোক৷ নিপাট ভালোমানুষ! সর্বাঙ্গে তাবিজ-কবচ ভূষিত! মাথার তেলা চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো৷

‘ক্যায়া হাল হ্যায় বেটা?’ ভদ্রলোক চমকে তাকালেন৷ কখন যেন এক সাধুবাবা তাঁর ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছেন৷ ঢুলুঢুলু দৃষ্টিতে কতটা আধ্যাত্মিকতা আছে, আর কতটা ভণ্ডামি, বোঝা মুশকিল৷

‘চুষুন দাদা, চুষুন৷ যত চুষবেন তত রস৷ যত খাবেন তত মিষ্টি৷ একবারটি খেয়ে দেখুন দাদা৷ মনে হবে প্রাণ ঠান্ডা হচ্ছে৷ স্বর্গসুখ পাচ্ছেন…৷’

এপ্রান্ত থেকে আওয়াজ আসা মাত্রই, ওপ্রান্তে কে যেন বলে উঠল…

‘খেলেই ম-র-বে-এ-এ-এ! চুষলেই মরবে-এ-এ-এ!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *