মেগালোম্যানিয়াক

মেগালোম্যানিয়াক

‘উই ক্যান ইজিলি ফরগিভ আ চাইল্ড, হু ইজ অ্যাফরেইড অফ দ্য ডার্ক; দ্য রিয়েল ট্র্যাজেডি অব লাইফ ইজ হোয়েন মেন আর অ্যাফরেইড অফ দ্য লাইট৷’

দার্শনিক প্লেটোর বিখ্যাত উক্তিটি হঠাৎ করে মনে পড়ে গেল মানুষটার৷ এক চিলতে আলো ঘুলঘুলির ফাঁক দিয়ে সরলরেখায় এসে পড়ছে তাঁর চোখের ওপরে৷ তিনি একটু বিরক্ত দৃষ্টিতেই আলোর উৎসের দিকে তাকালেন৷ এই মুহূর্তে কোনওরকম আলো অভিপ্রেত নয়৷ একটু অন্ধকার প্রয়োজন ওঁর৷ অথচ এই সামান্য নরম রশ্মিটুকু তাঁকে বড়ই বিরক্ত করছে৷

অন্ধকারের একটা অদ্ভুত নেশা আছে৷ আলোর তীব্রতার পাশে অন্ধকারের পেলব যৌন আবেদন যেন আরও বেশি আকর্ষণীয়৷ এমন মায়াবী আবেশে জড়িয়ে ধরে, যেন রহস্যময়ী প্রেমিকা! তার প্রেমে চাপল্য নেই, তীব্রতা নেই৷ বরং রয়েছে এক অবিচ্ছেদ্য প্রশান্তি৷

অর্ধ-নিমীলিত চোখে নিজের আশপাশটা অন্ধকারের মধ্যেই দেখে নেওয়ার চেষ্টা করলেন তিনি৷ অন্ধকারে সব কিছুই কেমন যেন অদ্ভুত দেখায়! এই বহু পরিচিত ঘরটাও আজ অচেনা লাগছে! দেওয়ালের ঝকঝকে ব্লকবাস্টার ফিল্মের বাঁধানো পোস্টারগুলোও অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে আছে৷ তার উল্টোদিকের কাচের আলমারিতে থরে থরে ট্রফি সাজানো! কিন্তু এই আঁধার তাদের সমস্ত গৌরব কালো রং দিয়ে লেপে পুঁছে দিয়েছে৷ এই মুহূর্তে অন্ধকার আর বিস্মৃতি ছাড়া আর বিশেষ কিছুই নেই৷ আর নিতান্তই যদি কিছু থেকে থাকে; তবে সে নৈঃশব্দ্য!

ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ মনে পড়ে গেল, এমন নৈঃশব্দ্য আর অন্ধকার বিগত দু-দশক ধরে তাঁর বড়ই গা সওয়া হয়ে গিয়েছে! এসেছিলেন এই নীরবতার হাত ধরেই৷ কিন্তু তারপর চতুর্দিকে আলো, আর শব্দের বাহুল্যে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন৷ প্রথম যখন ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এসেছিলেন তখনও তৎকালীন তারকাদের আর তথাকথিত বিখ্যাত প্রযোজকদের নীরব উপেক্ষা পেতে পেতে একসময় নিজেকে বেমানান ও পরিত্যক্ত বলেই মনে হয়েছিল৷ কিন্তু থেমে থাকেননি তিনি৷ সাধারণ সেট ডেকোরেটরের কাজ থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে এক বিখ্যাত পরিচালকের এ ডি, তথা অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর পর্যন্ত হয়েছেন৷ স্বপ্ন দেখতেন, নিজের ফিল্ম বানানোর৷ শুধু সুযোগের অপেক্ষায় দিন গুনতে গুনতে ভেবেছিলেন, ‘একদিন এরাই আমার দরজায় লাইন দেবে!’

বাস্তবেও তাই ঘটেছিল৷ সুযোগ যখন এল, তখন তার সদ্ব্যবহার করতে বিন্দুমাত্রও পিছ-পা হননি তিনি৷ বড় হতে গেলে যেমন অনেক ভালো কাজ করতে হয়, তেমন অনেক খারাপ কাজও করা আবশ্যিক৷ তিনি দুটোই সমান তালে করেছিলেন৷ ফলস্বরূপ ভাগ্যলক্ষ্মী একেবারে বরমালা নিয়ে এসে তাঁর বাড়ির দোরগোড়ায় হাজির! একের পর এক হিট! বক্স অফিসের রেকর্ড ভেঙেচুরে একশা! লাইমলাইটের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল! চতুর্দিকে হই হই রব! সমালোচকদের প্রশস্তি, ভক্তদের চিৎকার, সিনেমাহলের বিরাট দালানে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হওয়া করতালির প্রচণ্ড আওয়াজ! গোটা অডিটোরিয়াম কাঁপছে কয়েক হাজার পায়রার ডানা ঝাপ্টে উড়ে বেড়ানোর শব্দে! ব্লকবাস্টার! ব্লকবাস্টার! ব্লকবাস্টার!

আচমকা তাঁর কপালে অসন্তোষের ভাঁজ পড়ল৷ কুড়ি বছর হয়ে গেল, সেই পায়রা ওড়ার আওয়াজ আর শোনেননি তো! ‘ব্লকবাস্টার’ থেকে কবে যে ‘ফ্লপমাস্টার’ হয়ে গেলেন, তা নিজেও বুঝতে পারেননি৷ পরপর কয়েকটা ছবি বক্স-অফিস কাঁপানোর পরেই দুনিয়াটা বড় বেশি রঙিন মনে হয়েছিল তাঁর৷ মনে হয়েছিল, এই গোটা পৃথিবীটাই তাঁর করায়ত্ত! গোটা মানবজাতি তাঁর গুণগান গাইতে বাধ্য, তাঁর সৃষ্টির স্তুতি করতে বাধ্য! তখন ব্যারিটোন কণ্ঠস্বরের ধমকের চোটে কাঁপত গোটা স্টুডিও৷ তাঁর ফ্ল্যাটে অভিসারে আসত সুন্দরীরা! তাদের মধ্যে কয়েকজনকে জীবনের সবচেয়ে বড় ব্রেকটা তিনিই দিয়েছেন৷ তারপর ‘স্ট্রাগলিং অ্যাকট্রেসের’ তকমা ছাড়িয়ে তারা ‘স্টারের’ পর্যায়ে চলে গিয়েছে৷ তৃতীয়তম জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার পরে নেশাজড়িত কণ্ঠস্বরে মিডিয়ার সামনে বলেছিলেন, ‘হোয়াট টু সে! আই অ্যাম দ্য গড!’

আই অ্যাম দ্য গড!…আই অ্যাম দ্য গড!…বাক্যগুলো শূন্য অন্ধকার ঘরে যেন ব্যঙ্গ করতে করতে ফিরে এল! একটা সময় পর্যন্ত তিনি যত ফিল্ম বানিয়েছেন, জনতা হই হই করে দেখেছে৷ আড়ালে-আবডালে অবশ্য নিন্দুকেরা ‘মেগালোম্যানিয়াক’ বলতে ছাড়েনি, এমনকি তার নিজের স্ত্রী সোমদত্তাও বলেছিলেন, ‘তুমি আসলে রাংতায় মোড়া একটা জোকার! একটা দুশ্চরিত্র, স্কামবাগ!’ কিন্তু নিজের ঈশ্বরত্বে এতটাই বিশ্বাস ছিল যে কারোর কোনও কথা শোনেননি তিনি৷ সোমদত্তাকে প্রায় ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন৷ প্রবল দম্ভের সামনে হেরে গিয়েছিল প্রেম, বন্ধুত্ব, মমতা, ভালোবাসা; জীবনের ছোট ছোট সুখের মুহূর্তগুলো!

কিন্তু তারপরেই ফ্লপ! একটা নয়, দুটো নয়; পরপর ফ্লপ! একের পর এক শোচনীয় পরাজয়! বক্স অফিসে বারবার মুখ থুবড়ে পড়ল তাঁর বিগ বাজেট ও বহু নক্ষত্র খচিত ফিল্মগুলো৷ বন্ধু প্রোডিউসার বোঝানোর চেষ্টা করলেন, ‘ফিল্মের ধারা এখন পাল্টাচ্ছে৷ মানুষ এখন আর সম্পর্কের জটিলতা আর কেমিস্ট্রি সর্বস্ব ফিল্ম নিচ্ছে না৷ দেখছেন না, সবাই এখন অন্যধরনের ফিল্ম বানাচ্ছে!’

তিনি নেশাজড়িত বড় বড় লাল চোখে তাকিয়ে ভ্রূকুটি করে বলেছিলেন, ‘সবার সঙ্গে আমার তুলনা করছেন?’

প্রোডিউসার একটু বিব্রত, ‘তা নয়৷ কিন্তু বাস্তবটা তো মেনে নিতে হবে৷ মানুষ এখন ফিল্মে পুরোপুরি এন্টারটেইনমেন্ট খুঁজছে৷ সামথিং থ্রিলিং! সামথিং ডিফারেন্ট—!’

কথাটা শুনেই প্রায় গর্জন করে উঠেছিলেন তিনি, ‘হো-য়া-ট! আমাকে এখন শিং ভেঙে বাছুরদের দলে ঢুকতে হবে? আমি আধুনিক হিট বাংলা সিনেমার জনক! আমিই প্রথম ফিল্মের ধারা চেঞ্জ করেছি! আই অ্যাম দ্য ওয়ান অ্যান্ড ওনলি! এখন আমায় ভাবতে হবে যে কতগুলো ‘ডাম্ব-হেড’ পাব্লিক কী চায়! ওসব বস্তা-পচা থ্রিলারের পেছনে দৌড়তে পারব না৷ আমি শিল্পী, আপনাদের মতো বেনে নই৷ আই অ্যাম দ্য গড! হু আর ইউ? আ মেয়ার ফাকিং বিজনেসম্যান!’

বলাই বাহুল্য, সেই প্রোডিউসারের সঙ্গে আর বন্ধুত্ব ছিল না তাঁর৷ কিন্তু তাতেও অহঙ্কার ও মেজাজ কমেনি৷ ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন নতুন হিট পরিচালকদের আগমনে আস্তে আস্তে প্রযোজকরাও সরে গিয়েছেন তাঁর পাশ থেকে৷ হাতে যত কাজের সংখ্যা কমেছে, ততই মদ্যপানের মাত্রা বেড়েছে৷ আর বেড়েছে স্ক্যান্ডালের বহর! নিজের গার্লফ্রেন্ড, মডেল-কাম-অ্যাকট্রেস, মধুপর্ণার জন্মদিনের পার্টিতে আচমকা রেগে গিয়ে সর্বসমক্ষে একটা গোটা হুইস্কির বোতল ঢেলে দিয়েছিলেন তাঁর মাথায় ও মুখে৷ অভিযোগ, মধুপর্ণা নাকি তাঁকে যথেষ্ট মনোযোগ দেননি! মধুপর্ণা অপমানিত ও ক্রুদ্ধ হয়ে ফুঁসে উঠে বলেছিলেন, ‘ইউ আর সিক! তুমি একটা আস্ত মেগালোম্যানিয়াক সাইকো! নিজেকে কী ভাবো? গড? তুমি একটা ফসিল! স্রেফ ফসিল; আর কিচ্ছু নও! ইউ আর ফিনিশড!…জাস্ট ফিনিশড!’

‘অ্যাম আই?’

অন্ধকারের মধ্যে বসে নিজেকেই নিজে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন তিনি৷ সত্যিই কি তাই? সত্যিই কি আর তাঁর কোনও অস্তিত্ব নেই এ পৃথিবীতে?

তাহলে অন্ধকারই কি তাঁর শেষ আশ্রয়! নাঃ, হতে পারে না৷ কারণ তিনি এখনও অমিত শক্তিশালী৷ চাইলে ছিঁড়ে দিতে পারেন সমস্ত অন্ধকার! চাইলেই আলোকিত করে দিতে পারেন গোটা পৃথিবীটাকে৷ তাঁর মুখ থেকেই স্টুডিও বারবার শুনে এসেছে সেই শব্দ! লা-ই-ট!

টানটান ঋজু লম্বা দেহটা উঠে দাঁড়াল৷ অন্ধকারের মধ্যেই হাসলেন তিনি৷ পরক্ষণেই তাঁর গমগমে কণ্ঠস্বর ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হল অন্ধকার ঘরে!

‘লেট দেয়ার বি লাইট!’

স্টুডিওর সমস্ত আলো একসঙ্গে দপ করে জ্বলে উঠল৷ মুহূর্তের মধ্যে সোনালি আলোর বন্যায় ভেসে গেল গোটা ফ্লোর! সুসজ্জিত সেট ঝলমলিয়ে উঠেছে৷ এখন কোথাও কোনও অন্ধকার নেই৷ বরং চতুর্দিকে শুধু আলোর বিচ্ছুরণ!

লাইটম্যান গিরীশ আপনমনেই আলো ঠিক করতে করতে বিড়বিড় করে, ‘শা-লা, কার মুখ দেখে আজ সকালে উঠেছি! গোটা দিন ওই পাগলটার সাথে কাজ করতে হবে!’

ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম শ্রেষ্ঠ ডিওপি বা সিনেমাটোগ্রাফার, সহদেব মালি ডিজিটাল মুভি ক্যামেরাগুলো চেক করছিল৷ হোয়াইট ব্যালান্সিং, ফ্রেম আর ফোকাস রেডি করতে করতে রুক্ষ চোখে গিরীশের দিকে তাকায় সে৷ মেজাজ তারও তিরিক্ষি হয়ে আছে৷ বিরক্তস্বরে বলে, ‘আ-স্তে! রাগের মাথায় ক্যামেরাটা বরবাদ করিস না! যেটার মাথার ওপরে উঠে তুই লাফাচ্ছিস, সেটার দাম জানিস! ভাঙলে কি তোর বাপ দাম দিতে আসবে?’

গিরীশ মুখভঙ্গি করেছে, ‘যত দামি ক্যামেরা দিয়েই ছবি তোল না কেন; শেষ পর্যন্ত ও মাল যাবে ওই গাধার গাঁ…!’

‘আঃ!’

সে বলতে যাচ্ছিল যে ‘শেষ পর্যন্ত ফিল্মটা ফ্লপই হবে’ কিন্তু তার আগেই সহদেব বিরক্তিসূচক শব্দে তাকে থামিয়ে দিল৷ তারপর ড্রোন-অপারেটর নিখিলের দিকে তাকিয়ে একটু কৌতূহলী ভাবেই জানতে চায়, ‘আজকে ড্রোন-শট আছে নাকি?’

‘রাম জানে!’ ড্রোন-অপারেটরের নির্লিপ্ত জবাব, ‘তুমি মামা ডিওপি—ডাইরেক্টর অব ফোটোগ্রাফি৷ তুমি যদি না জানো, তবে কে জানবে?’

‘মানে!’ সহদেব বিস্মিত, ‘ড্রোন শট না থাকলে তুই এখানে কী করছিস?’

নিখিল জব্বর হাই তুলে জানায়, ‘হাপু গাইছি! সাহেব বলেছেন, উনি নাকি লাস্ট মিনিটে স্ক্রিপ্ট চেঞ্জ করতে পারেন৷ তাই এসেছি৷ শট থাকলে ভালো৷ না থাকলে আরও ভালো৷ আমার ভাড়াটা ঠিকঠাক পেলেই হল৷’

‘হ্যাত্তেরি!’ ডিওপি বিরক্তিসূচক শব্দ করে বলে, ‘আসলে শুটিংটা হচ্ছে কীসের? স্ক্রিপ্ট-রাইটার কোথায়? অভিনেতা-অভিনেত্রীরা কারা? এ ডি?’

নিখিল চুপ করে থাকে৷ এ ব্যাপারে সেও কিছু জানে না৷ শুধু তাকে বলা হয়েছে মাত্র তিনদিনের জন্য ফ্লোরে উপস্থিত থাকতে৷ তার জন্য যত টাকা দরকার, তার কিছুটা অগ্রিমও পেয়ে গিয়েছে৷ সেইজন্য সকাল থেকেই এসে বসে আছে৷ কিন্তু কেন, কী বৃত্তান্ত; কিছুই তার জানা নেই৷

সহদেব নিখিলের অবস্থা কিছুটা বুঝতে পারে৷ কারণ তারও দশা খানিকটা একই৷ তার ক্যামেরার দাম সে তিনদিনের জন্য পেয়ে গিয়েছে৷ বাকিটা শুটিঙের শেষে দিয়ে দেওয়া হবে৷ কিন্তু কাস্টিং বা স্টোরির ব্যাপারে সে কিছুই জানে না৷ সচরাচর ফিল্ম শুট হওয়ার আগে ডিওপিকে স্ক্রিন-প্লের একটা কপি দিয়ে দেওয়া হয়৷ যাতে সে বুঝতে পারে ক’টা ক্যামেরা লাগবে, কোথায় ট্রলি লাগবে কিংবা কোথায় ড্রোন৷ ক্যামেরা প্যান করবে, টিল্ট হবে; সবই মোটামুটি বোঝা যায়৷ কিন্তু এক্ষেত্রে এসব কিছুই হয়নি! বেচারির পুরো নিধিরাম সর্দারের দশা! ক্রু’-দের ডাকা দরকার কি না তাও বুঝতে পারছে না! তাই তাদের ‘স্ট্যান্ড বাই’-এ রেখেছে৷ ফোন করলেই আধঘণ্টার মধ্যে এসে যাবে তারা৷

‘এই বিলুপ্ত ডাইনোসোরের পাল্লায় পড়াই শালা পনৌতি!’ গিরীশ লাইট সেট করা শেষ করে এবার লাইট রিফ্লেক্টর বা বাউন্সারগুলোকে নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করেছে, ‘এক ছোকরা এসে আমায় মোটামুটি লাইট কীরকম হবে বুঝিয়ে দিয়ে গেল৷ কিন্তু ওখানেই শেষ৷ সে অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর না স্ক্রিন-প্লে রাইটার, কিছুই বুঝলাম না’৷

‘ওটা অসিত৷’ সহদেব একটু আস্তে আস্তে বলে, ‘সাহেবের ল্যাংবোট কাম সাউন্ড রেকর্ডিস্ট! কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক কী হচ্ছে বল তো? এরকম শুটিং আগে কখনও দেখিনি৷ এখানে আমরা শুধু তিনজন আছি৷ তুই, আমি আর নিখিল৷ এখন শুনলাম অসিতও আছে৷ সব মিলিয়ে চারজন! আর কেউ নেই! অ্যাকটর-অ্যাকট্রেস, অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর, এডিটর, রাইটার, মেক-আপ ম্যান; কেউ না! তাহলে বেসিক্যালি এখানে হচ্ছেটা কী? প্রোডিউসই বা কে করছে?’

গিরীশ নির্লিপ্ত মুখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে৷ তার যত উৎসাহ, সবটাই পেমেন্টের ব্যাপারে৷ বাকি কোনও বিষয়ে তার কোনও কৌতূহল নেই৷ এমনকি যে মানুষটিকে সে ‘ডাইনোসোর’ বলে গালাগালি দিচ্ছে, তিনি যে কোনও একসময়ে ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম নামকরা পরিচালক ছিলেন, সে বিষয়েও তার বিশেষ মাথাব্যথা নেই৷ এই ইন্ডাস্ট্রির এমনই নিয়ম৷ যতক্ষণ ব্যাগে হিট আর টাকা উপচে পড়ছে, ততক্ষণই সম্মান! ব্যাগ খালি হয়ে গেলে এখানে কেউ কাউকে চেনে না! পাত্তাও দেয় না৷

কিন্তু সহদেব চাইলেও মানুষটাকে অগ্রাহ্য করতে পারে না৷ তার বাবা একসময়ে এই মানুষটির সঙ্গে প্রচুর কাজ করেছেন৷ ওঁর বেশির ভাগ ব্লকবাস্টার ফিল্মেরই সিনেমাটোগ্রাফার ছিলেন সহদেবের বাবা সুধীর মালি৷ তাঁর মুখেই শুনেছে, মানুষটা একটু মেজাজি আর অহংকারি বটে, কিন্তু জিনিয়াস৷ ক্যামেরা, লাইট, সাউন্ড এমনকি এডিটিঙেও মাস্টার লোক৷ সুধীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন, ‘কিন্তু এই ইন্ডাস্ট্রির চড়া আলোয় অনেকেরই মাথা ঘুরে যায়৷ সাহেবেরও গেল! নয়তো তাঁর এত তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যাওয়ার কথা নয়!’

সহদেব একটু আত্মমগ্নদৃষ্টিতে আলোয় উদ্ভাসিত সেটের দিকে তাকায়৷ মাত্র চার মাস আগেই বাবা মারা গিয়েছেন৷ বেঁচে থাকলে জানতে পারতেন যে তাঁর ‘সাহেব’ ফের ফ্লোরে আসতে চলেছেন৷ এ খবরে নিশ্চয়ই খুশি হতেন সুধীর৷ তিনি ওই মানুষটার প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ ছিলেন৷ সহদেব একরকম বাবার কথা ভেবেই কাজটা করতে রাজি হয়ে গিয়েছিল৷ কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ভুল করেছে৷ এখানে আদৌ কোনও শুটিং হবে কি না, সে বিষয়ে যথেষ্টই সন্দেহ আছে তার৷

সে ঘড়ির দিকে আড়চোখে তাকায়৷ কলটাইম দশটায় ছিল৷ সাড়ে বারোটা এর মধ্যেই বেজে গিয়েছে৷ অথচ ফ্লোর এখনও শুনশান! সহদেব মনে মনে অস্থির হয়ে ওঠে৷ আর বড়জোর আধঘণ্টা দেখবে৷ তার মধ্যে যদি আর কেউ না এসে পৌঁছয়, তবে ধরে নিতে হবে এটা ওই আধপাগল ‘মেগালোম্যানিয়াকের’ খামখেয়ালিপনা! আর অপেক্ষা করবে না ও৷ পাততাড়ি গুটিয়ে সোজা কেটে পড়াই ভালো৷ গিরীশ ঠিকই বলেছে৷ ও লোকটার মাথার কোনও ঠিক নেই!

আই অ্যাম দ্য গড! হুঃ!

‘স্যার—স্যার! ওয়ান মোর কোয়েশ্চেন—!’

অনেকক্ষণ ধরেই একটা সিগারেট খাওয়ার ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছিল সহদেবের৷ ও ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে গেলেই একটু নিকোটিনের ধোঁয়া চায়৷ এখন অবসর পেয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে বাইরের দিকে গেল৷ প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে ক্যামেরা নিয়ে শুধু জাগলিংই করে চলেছে বেচারি৷ অথচ কী করতে হবে, কেমন করে করতে হবে, ড্রোনটা কোন ভূতের বাপের শ্রাদ্ধে লাগবে, কিছুই জানা নেই! এভাবে শুটিং করা যায়! বিরক্তিকর!

কিন্তু বাইরে আসতেই তার চক্ষু চড়কগাছ! এ কী! এখানে তো রিপোর্টাররা এসে হাজির! সহদেব সবে ঠোটে সিগারেটটা গুঁজেছিল৷ কিন্তু হতবিহ্বল হয়ে তাতে অগ্নিসংযোগ করতে ভুলে গেল সে! বিস্ময় বিস্ফারিত দৃষ্টিতে দেখল, বাইরে প্রেসের লোকেরা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে! তাদের কারোর হাতে ‘বুম’, কারোর কাঁধে ক্যামেরা! কেউ বা রেকর্ডারে বাইট নিতে ব্যস্ত৷ আর তাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছেন—

সেই এক ও অদ্বিতীয় তিনি! সহদেবের চিনতে ভুল হল না৷ ওনাকে সে বহুবার টিভিতে বা কাগজে দেখেছে৷ সেই লম্বা ঋজু দেহ, খড়গের মতো নাক, দু-চোখের শানিত দৃষ্টিতে যেন মূর্তিমান দম্ভ এবং তীব্র অসন্তোষের ছোঁয়া৷ কণ্ঠস্বর এখনও গম্ভীর ও কম্যান্ডিং৷ পার্থক্য একটাই৷ মাথার চুলগুলো এখন সব সাদা হয়ে গিয়েছে৷ এ ছাড়া বিশেষ কোনও পরিবর্তন নেই৷ কিন্তু ব্যাপারটা কী? উনি প্রেসকে ডেকেছেন!

‘দীর্ঘ কুড়ি বছর পরে আবার ফ্লোরে ফিরলেন৷ কেমন লাগছে?’

এক মহিলা সাংবাদিকের প্রশ্নে ডানদিকের ভুরুটা সামান্য তুলে তাকালেন তিনি, ‘কেমন লাগার কথা? ব্রাইট অ্যাজ আ নিউ পেনি৷’

‘তাহলে স্বীকার করছেন যে কুড়ি বছর ধরে আপনি ‘ওল্ড পেনি’ ছিলেন?’

সহদেব প্রমাদ গুনল! সর্বনাশ! প্রেসের লোকেরা এবার একটা ডেডলি বাউন্সার ছুড়ে দিয়েছে! সোজাসুজি ভীমরুলের চাকে ঢিল! একবার এক প্রেস কনফারেন্সে এমনই একটি প্রশ্ন করার জন্য এক সাংবাদিককে সপাট এক ঘুসিতে ফ্ল্যাট করে দিয়েছিলেন ভদ্রলোক৷ এবার না জানি কী করবেন!

‘নো৷ গোল্ড পেনি ছিলাম৷’ এবার কিন্তু আর ‘আপারকাট’ ধেয়ে এল না৷ বরং স্মিত হাসলেন তিনি, ‘ওল্ড ইজ গোল্ড; জানেন তো?’

‘এতদিন ধরে আপনি মানুষের সম্পর্কের জটিলতা, ভালোবাসা, রিরংসা নিয়েই ফিল্ম করেছেন৷’ অন্য একজন সাংবাদিক জানতে চাইল, ‘এবার আপনার ফিল্মের সাবজেক্ট কী?’

‘সামথিং ডিফারেন্ট…সামথিং থ্রিলিং…অ্যান্ড অফকোর্স আ ব্লকবাস্টার৷’ সপাটে উত্তর এল, ‘এবারের সাবজেক্ট আমি স্বয়ং!’

সহদেব স্পষ্ট দেখতে পেল, সাংবাদিকদের চোয়াল প্রায় আস্ত প্রাকৃতিক গুহার মতো হাঁ হয়ে ঝুলে পড়ল৷ লোকটা বলে কী! এবারের ফিল্মের সাবজেক্ট স্বয়ং উনিই! মানে?

সে লক্ষ করেনি, তার পেছন পেছন কখন যেন গিরীশও এসে দাঁড়িয়েছে৷ এতক্ষণ সব চুপচাপ দেখছিল৷ এবার সহদেবের কানের কাছে ফিসফিস করে মন্তব্য করল, ‘লাও ঠ্যালা! এবারের সাবজেক্ট ডাইনোসোর! উনি জুরাসিক পার্ক বানাতে চলেছেন৷’

সাংবাদিকেরা আর কিছু বলার আগেই ব্যাপারটা পরিষ্কার করে দিলেন তিনি, ‘এবার ফুল লেংথ ফিল্ম নয়, একটা ডকুমেন্টারি বানাচ্ছি৷ সেটা অবশ্য আমার ওপরই৷ অর্থাৎ আমারই ডকুমেন্টারি৷ আমার জীবনের ওপর বেস করে৷ আ ব্লকবাস্টার ইনডিড৷’

‘অ্যাঁ!’ এবার সাংবাদিকরাও নিজেদের বিস্ময় চেপে রাখতে পারল না৷ একজন পরিচালক নিজের ওপরই ডকুমেন্টারি বানাচ্ছেন! এ আবার কী কথা! একজন ফিল্ম ডিরেক্টর অন্য আরেকজন সিনিয়র ফিল্ম ডিরেক্টরের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তাঁদের ডকুমেন্টারি বানিয়েছেন, এমন নিদর্শন প্রচুর রয়েছে৷ কিন্তু কেউ নিজেই নিজের ওপর তথ্যচিত্র বানাচ্ছেন; এমন ঘটনা বোধহয় তারা জীবনেও শোনেনি! একজন কোনওমতে ঢোঁক গিলে প্রশ্ন করল, ‘আপনি নিজের ওপরে তথ্যচিত্র নিজেই বানাচ্ছেন স্যার! এমন কাজ তো স্বয়ং সত্যজিৎ রায়ও করেননি!’

‘তিনি করেননি, কিন্তু আমি করছি৷’ মানুষটি জবাব দিলেন, ‘সবাইকে সব কিছু করতে হবে এমন কোনও মানে নেই৷ আমি এই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম মাইলস্টোন৷ অতএব একটা ডকুমেন্টারি আমি অবশ্যই ডিজার্ভ করি৷ তা ছাড়া স্বয়ং কবিগুরু যদি নিজেই নিজের জন্মদিনের ও মৃত্যুদিনের গান এবং কবিতা লিখে যেতে পারেন, তবে আমি কি নিজের ওপর একটা ডকুমেন্টারি বানাতে পারি না?’

মহান পরিচালকের এই বিবৃতির সামনে আর কী বলার থাকে! সাংবাদিকরা ঘাবড়ে গিয়ে পরস্পরের মুখ দেখছে৷ সম্ভবত এটা ‘মেগালোম্যানিয়ার’ চূড়ান্ত নিদর্শন! ‘নার্সিসিজমের’, ও বটে৷ সহদেবের মনে হল, শুটিং ফ্লোর নয়, এই লোকটির রাঁচিতে থাকা উচিত৷

‘এখানে আপনার সহ-অভিনেতারা কারা?’ একজন সংবিৎ ফিরে পেয়ে প্রশ্ন করল, ‘মানে আপনার ইন্টারভিউ কে নেবে? কিংবা আপনার রোলে কে—!’

প্রশ্নটা শেষ হওয়ার আগেই উত্তর এল, ‘কেউ নেই৷ গোটা ফিল্মে আমি একাই অভিনয় করব! নিজেই নিজের ইন্টারভিউ নেব৷ সবক’টি চরিত্রে আমিই অভিনয় করছি৷’

‘আপনার এ তথ্যচিত্রের প্রোডিউসার কে?’

এমনিতেই সাংবাদিকদের আক্কেল গুড়ুম হয়ে গিয়েছিল৷ তার মধ্যেই সাহস করে একজন প্রশ্নটা করেই ফেলেছে৷ তিনি মৃদু হেসে বললেন, ‘প্রোডিউসারও নিঃসন্দেহে আমিই!’

‘আপনি! আপনিই ডিরেক্টর, আপনিই অ্যাক্টর, আপনিই প্রোডিউসার!’

‘শুধু তাই নয়, আমিই সেট ডেকোরেটর-প্রপমাস্টার, আমিই আমার মেক-আপম্যান, আমিই স্ক্রিপ্ট-স্ক্রিন প্লে লিখেছি এবং আমিই আমার এডিটর৷ ইনফ্যাক্ট বলতে পারেন, আমিই হচ্ছি সর্বময়কর্তা! অল ইন অল!’ এবার ভদ্রলোক সজোরে হেসে উঠলেন, ‘হোয়াট টু সে! ইয়েস! আই অ্যাম দ্য গড!’

বলতে বলতেই স্তম্ভিত বিমূঢ় সাংবাদিকদের ওখানেই ছেড়ে তিনি এগিয়ে এলেন সহদেবের দিকে৷ তার ঠোঁটে তখনও ঝুলছে সিগারেটের স্টিক৷ মানুষটা ফস করে নিজের লাইটার জ্বালিয়ে অগ্নিসংযোগ করলেন তার সিগারেটে৷ তারপর ফিসফিস করে বললেন,

‘লেট দেয়ার বি লাইট!’

‘ভাই, এটা ব্লকবাস্টার নয়, ডিজাস্টার হতে চলেছে!’

ড্রোন-অপারেটর নিখিল প্রায় মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে, ‘কুড়ি বছর আগে যে লোকটাকে ইন্ডাস্ট্রি ডাম্প করে দিয়েছে, তার জীবনের একঘেয়ে কাঁদুনি কে শুনবে বলো তো! আর লোকটা সত্যিই পাগল! কিছুতেই সন্তুষ্ট হয় না! এক একটা ড্রোন শট নিতে প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে আমার!’

সহদেব তার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে৷ তারও মনের প্রায় একই অবস্থা৷ স্বঘোষিত মহান ও তালেবর পরিচালকের ডকু-ফিচারের ঠ্যালায় তাদের সবারই নাভিশ্বাস উঠছে৷ মাঝে মাঝে মনে হয়, উনি কী চান, তা নিজেই জানেন না! শুরুতেই ঘোষণা করেছেন ক্যামেরা ক্রুয়ের দরকার নেই৷ অথচ মুহূর্তে মুহূর্তে তাঁর স্ক্রিপ্ট পালটে যাচ্ছে৷ কাজ শুরু হওয়ার আগে ওরা জানত শুটিংটা ইনডোরেই হবে৷ এখন দেখছে আউটডোরের শেষ নেই! কখনও তাঁর মনে হচ্ছে, ছোটবেলায় যে পুকুরের জলে সাঁতার কাটতেন সেটাকেও দেখাতে হবে! আবার কখনও বা মনে হচ্ছে, বটানিক্যাল গার্ডেনে যে বিরাট গাছটার তলায় বসে তিনি আর সোমদত্তা প্রেম করতেন সেটা এই তথ্যচিত্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট! কারণ সোমদত্তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে না উঠলে তিনি নাকি জানতেই পারতেন না যে ‘সম্পর্ক’ জিনিসটা অত্যন্ত জটিল৷ পুকুর তাঁকে গভীর হতে শিখিয়েছিল, সোমদত্তা জটিলতা শিখিয়েছিলেন, আর তৎকালীন প্রখ্যাত অভিনেত্রী অধীরা তাঁকে পরকীয়া প্রেমের অর্থ শিখিয়েছিলেন৷ এরকম বহু খুঁটিনাটি শিক্ষা তাঁর ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়ে যাচ্ছে, আর স্ক্রিপ্ট, লোকেশন সঙ্গে সঙ্গেই বদলে যাচ্ছে৷ তার ওপর অজস্র বায়নাক্কা! কথা নেই বার্তা নেই, আচমকা বলে বসলেন, ‘আঃ সহদেব! এখানে ট্রলি নয়, ক্রেন শট লাগবে৷’ বেচারি সহদেব হাঁই হাঁই করে দৌড়ল ক্রেনের খোঁজে৷ একরকম প্রায় তাকে বাঁদর নাচ নাচিয়েই ছাড়ছেন পরিচালক৷

একবার-দুবার তারা একটু ক্ষীণ প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছিল৷ কিন্তু মহান পরিচালক বিরক্ত হয়ে প্রায় গর্জনই করে উঠেছেন, ‘ইমপ্রোভাইজেশন বোঝো? ক্রিয়েটিভিটি বোঝো? এসব প্ল্যান্ড ওয়েতে আসে না; অন দ্য স্পট হয়! একজন মজুর বড়জোর সাজিয়ে-গুছিয়ে ইঁট, পাথর বয়ে আনতে পারে, কিন্তু তাজমহল তৈরি করার জন্য একখানা অনবদ্য ব্রেইন লাগে; যে মস্তিষ্কটি একজন শিল্পীর৷ আমি শিল্পী, লেম্যান নই; বুঝেছ?’

‘বুঝলাম!’ গিরীশ গগর করে ওঠে, ‘আপনি তাজমহল তৈরি করছেন!’

গত আটচল্লিশ ঘণ্টা ধরে ওরা ভদ্রলোকের সঙ্গে কাজ করছে৷ আর এই আটচল্লিশ ঘণ্টায় যতখানি হতাশ হওয়া সম্ভব, ঠিক ততটাই হয়ে বসে আছে৷ কিছুতেই বুঝতে পারছে না যে আসলে ডকুমেন্টারিটা ঠিক কীসের ওপর হচ্ছে! পরিচালক একেবারে তাঁর জন্মবৃত্তান্ত থেকে শুরু করেছেন! সব ক্ষেত্রেই তাঁর নাকি ডিটেলিং চাই! সব মিলিয়ে ব্যাপারটা প্রায় সাত কাণ্ড রামায়ণই হতে চলেছে সম্ভবত৷ কিন্তু এই ফিল্ম দেখবে কে? তিনি গোটা স্ক্রিপ্টেই খালি ‘আমি এই….আমি সেই’ করে চলেছেন! এত ‘আমি আমি’র ঠ্যালায় পাব্লিক বিরক্ত তো হবেই, উপরন্তু যে পরিচালককে নতুন প্রজন্ম চেনেই না, যাকে দর্শক প্রায় ভুলতেই বসেছে, তিনি মেলায় গিয়ে সাবুর পাঁপড় খেতে ভালোবাসতেন না চিনেবাদামভাজা, তা নিয়ে কার মাথাব্যথা আছে! অথচ সে কথা বলার উপায় নেই৷ তাহলেই তিনি বলবেন, ‘বুঝবে না! সবটাই মোটিভেশন! যে মানুষটার কাছে একসময় মেলায় যাওয়াটাই প্রায় বিদেশ ভ্রমণের মতো ছিল, সে-ই যখন বিদেশি চলচ্চিত্রোৎসবে নিজের ফিল্ম নিয়ে পাড়ি দিল; তখন তার মনের অবস্থাটা বোঝো! সে মানুষটা তখন যে বিশালত্ব নিজের মধ্যে অনুভব করেছিল, সেটাই তো আগামী প্রজন্মকে মোটিভেট করবে৷’

তবে একটা কথা মানতেই হবে৷ লোকটা অসাধারণ অভিনেতা৷ গোটা স্ক্রিপ্টটাকে অনেকটা একাঙ্ক নাটকের মতো করে সাজিয়েছেন৷ একাই সবক’টা চরিত্রের কথা এমন অবলীলায় বলে চলেছেন, যেন এই স্ক্রিপ্ট বহু বছর ধরে, বহু রাত জেগে জেগে প্র্যাকটিস করেছেন৷ বিশেষ করে সোমদত্তা আর তাঁর প্রেম ও দাম্পত্যজীবনের সমাপ্তির অংশটা এমন ফাটিয়ে অভিনয় করলেন, যে তিনি ‘কাট’ বলার পরেও সহদেব নির্বাক হয়ে তাকিয়েছিল ওঁর দিকে৷ তার খেয়ালই ছিল না যে ক্যামেরা তখনও চলছে! কী দুরন্ত অভিনয়, কী অদ্ভুত এক্সপ্রেশন! সহদেব অবাক হয়ে দেখছিল আর ভাবছিল, উনি পরিচালক না হয়ে অভিনেতা হলে এতদিনে অনেকের ভাত মারতেন৷ মনে পড়ে গেল বাবার বলা শব্দটা৷ ‘জিনিয়াস!’

শটটা দিয়ে যখন তিনি এডিটিঙে বসলেন, তখন সহদেব গুটিগুটি পায়ে তাঁর কাছে গেল৷ মনিটরে তখন তাঁরই আবেগময় মুখের বেদনার্ত অভিব্যক্তি স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ছে৷ পরিচালক আলগোছে সেদিকে দেখতে দেখতেই বলে উঠলেন; ‘ব্রিলিয়ান্ট! পারফেক্ট টাইমিঙে জুম ইন, জুম আউট করেছ৷ একদম ফ্ল’লেস; কোনও জার্ক নেই৷’

প্রশংসা পেয়ে এই প্রথম একটু হাসল সহদেব৷ সে কী বলবে বুঝতে পারে না৷ একটু ইতস্তত করে বলল, ‘ডলি শটটা আমার বাবা নিজের হাতে শিখিয়েছিলেন!’

‘হুঁ! ডলি শট সবার হাতে সমান মসৃণ হয় না৷ গুড!’ তাঁর কঠিন মুখ যেন একটু নরম হল, ‘সুধীরদা আমার দেখা সেরা সিনেমাটোগ্রাফার ছিলেন! তবে এরপর থেকে যখন টিল্ট করবে তখন আরও একটু স্লোয়ার আপ অ্যান্ড ডাউন মুভ করবে৷ ওটা দেখতে বেশি ভালো লাগে৷’

সহদেব অন্যমনস্কভাবেই সম্মতিসূচক মাথা ঝাঁকায়৷ সে তখনও একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে মনিটরের দিকে৷ যেখানে ভদ্রলোক সোমদত্তার কথা থরথর আবেগে বলে চলেছেন৷ দুরন্ত প্রেমিক না হলে এমনভাবে কেউ নিজের স্ত্রীয়ের কথা বলতে পারে! উনি কি তবে এখনও ম্যাডামকে—?

তার অনুচ্চারিত প্রশ্নটা যেন ধরে ফেললেন পরিচালক৷ এক ঝটকায় চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়েছেন তিনি৷ তাঁর দৃষ্টিতে শীতল ঔদাসীন্য ফিরে এল৷ সেই দুর্বিনীত কণ্ঠে বললেন, ‘নো ওয়ে! এটা স্রেফ অ্যাকটিং! আই ডোন্ট মিস হা! আর তার জন্য অনুতাপও নেই৷’

কথাটা ছুড়ে দিয়েই গটগট করে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি৷ আচমকা থমকে দাঁড়িয়ে তাকালেন সহদেবের দিকে৷ তর্জনী তুলে বললেন, ‘ইয়েস ইউ! তুমি কাল একটা ক্যামেরা নিয়ে আমার বাড়ি আসবে৷ কালকেই শুটিং শেষ৷ লোকেশন, আমার বাড়ি৷ লাইট, সাউন্ড বা ড্রোনের দরকার নেই৷ ওকে?’

বলেই উদ্ধত ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেলেন৷ নিখিল একটা শ্বাস ছেড়ে বলল, ‘ওঃ! বাঁচা গেছে! পুরো মূর্তিমান ডিজাস্টার মাইরি!’

‘চা খাবে?’

গলফ গ্রিনে তাঁর বিলাসব্যহুল ফ্ল্যাটে ঢুকতে না ঢুকতেই প্রথম প্রশ্নটা ধেয়ে এল সহদেবের দিকে৷ সে তখনও ঠিকমতো পরিবেশটা বুঝে উঠতে পারেনি৷ দিনের বেলাতেও ভদ্রলোক ঘরটাকে আশ্চর্যরকমের আলো-আঁধারি করে রেখেছেন! ঘরে কোনও আলো জ্বলছে না এবং জানলাগুলোও বন্ধ৷ কিন্তু কোনও একটা উৎস থেকে নম্র আলো চুঁইয়ে আসছে এই ঘরে৷ তাই সম্পূর্ণ অন্ধকারও নয়৷ খানিকটা দেখা যায়, খানিকটা যায় না৷

এই আলো-ছায়াময় পরিবেশে অদ্ভুত রহস্যময় লাগছিল লোকটাকে৷ তার মুখের আদল কিছুটা বোঝা যায়, কিছুটা অন্ধকারেই ডুবে আছে৷ যেন মানুষটাকে দেখেও দেখা যায় না! রক্তমাংসের দেহ; তবু যেন অধরা সিল্যুয়েট! পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি৷ কিন্তু রংটা কী? কালো?

‘লাইটিংটা মজাদার; নয়?’

এই প্রথম সম্ভবত একটু আন্তরিক সুরে কথা বললেন ভদ্রলোক৷ তাঁর গমগমে কণ্ঠস্বর অনুরণিত হল দেওয়ালে দেওয়ালে৷

‘মজাদার কি না জানি না৷ তবে মিস্টিরিয়াস!’

সহদেবও এবার একটু সহজ স্বরে কথা বলার চেষ্টা করে, ‘এমন লাইট পেলে শুট করার ইচ্ছেটা আরও বেড়ে যায়৷’

‘জানতাম তোমার পছন্দ হবে৷’ অবিকল অন্তর্যামীর মতোই বললেন তিনি, ‘সেজন্যই ওপাশের ঘরে আয়নার মাধ্যমে সেকেন্ডারি লাইট সোর্স বানিয়ে আর বাউন্সার দিয়ে এমন পরিবেশ তৈরি করেছি৷ ইউ নো, ইজিপশিয়ান মিরট্রিক৷ ব্যাটারা পিরামিডের অন্ধকার চেম্বারেও হাল্কা আলো আনত, আর আমি তো স্রেফ ওঘর থেকে এঘরে এনেছি! বাই দ্য ওয়ে, চা খাবে না কফি?’

এই নিয়ে প্রশ্নটা দ্বিতীয়বার করলেন পরিচালক৷ সহদেব একটু ইতস্তত করে বলল, ‘আমি চা খাই না৷’

‘মদ খাও?’

প্রশ্নটা এবার বিপজ্জনক ভঙ্গিতে আছড়ে পড়ল৷ সে একটু সামলে খেলল, ‘খাই৷ তবে দিনের বেলায় আর কাজের সময়ে নয়৷’

তিনি উত্তরটা শুনে একটু ভুরু কুঁচকে তাকালেন৷ যদিও সেই সন্দিগ্ধ দৃষ্টি স্পষ্ট দেখা যায় না৷ তবে কপালের সামান্য কুঞ্চনে হাল্কা আলো পিছলে পড়ে স্পষ্ট বলে দিল ভদ্রলোক যথারীতি তাঁর পেটেন্ট ভ্রূকুটিটি করেছেন৷ সহদেব প্রায় ভয়ে কাঠ হয়ে ছিল যে এরপর দুধের অফার আসে কি না! কিন্তু উনি আর কথাই বাড়ালেন না৷ বরং উলটে বললেন, ‘ফাইন, অ্যাজ ইউ উইশ৷ তুমি ক্যামেরা রেডি করো৷ আমি আসছি!’

বলেই হনহনিয়ে কোথায় যেন চলে গেলেন৷ সহদেব যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল৷ পরিচালকের উপস্থিতিটাই বড় অস্বস্তিদায়ক৷ ওঁর প্রোফাইলটা খুব নিষ্ঠুর বলে মনে হয়৷ ইমেজে দম্ভ আর পাগলামি দুয়েরই প্রাবল্য৷ কোনটা বেশি বলা মুশকিল৷ হয়তো বা সমানে সমানে৷

সে ক্যামেরা সেট করতে শুরু করল৷ ক্যামেরায় গোটা ঘর দেখতে দেখতে মানুষটার আলো বিষয়ক জ্ঞানের মনে মনে প্রশংসা না করে পারল না! সত্যিই হলিউড ফিল্মে ইজিপশিয়ান পিরামিডের নীচে ঠিক যে আলো-আঁধারি খেলা দেখা যায়, অবিকল সেই এফেক্ট এনেছেন! ক্যামেরায় দেখতে দারুণ লাগছে৷

‘আজ তোমার কাছে ট্রলি নেই, বাট—’৷ সম্ভবত পাশের ঘর থেকেই ভেসে এল ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বর, ‘হয়তো তোমায় ক্যামেরা মুভ করাতে হবে৷ আমি ব্যাপারটা যথাসম্ভব ন্যাচারাল করতে চাই৷ তোমার বাবার কাঁধে ক্যামেরা নিয়ে দৌড়বার অভ্যেস ছিল৷ তোমার আছে কি?’

কাঁধে ক্যামেরা নিয়ে দৌড়তে হবে! প্রায় আকাশ থেকে পড়ল সহদেব৷ এতদিন পুকুরপাড়ে, বাগানে ছোটাছুটি করেও শান্তি হয়নি ওনার! এখন নিজের ফ্ল্যাটেও দৌড়োদৌড়ি করবেন! এ কী অদ্ভুত সিন!

‘কী হল?’

এবার কণ্ঠস্বরে বিরক্তি প্রকট৷ সঙ্গে একটা ধাতব শব্দও শোনা গেল৷ বোধহয় আলমারি জাতীয় কিছু খুললেন তিনি, ‘পারবে? না পারবে না?’

যথারীতি সেই কম্যান্ডিং টোনে ফিরে গিয়েছেন ভদ্রলোক৷ একটু আগের আন্তরিক সুরটা আর নেই৷

‘কোনও অসুবিধে হবে না৷’ সে আমতা আমতা করে বলে, ‘কাঁধে ক্যামেরা নিয়ে আমিও শুট করতে পারি৷ কিন্তু ইন্ডোরে কোথায় দৌড়ব?’

‘কোথায় দৌড়বে সেটা পরের কথা৷’ এবার ওনার পায়ের আওয়াজ শোনা গেল৷ কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই এ ঘরে এসে বললেন, ‘যদি কোনওক্রমে দৌড়নোর প্রয়োজন পড়ে, পারবে তো?’

আজও আউটডোরের প্ল্যানিং আছে! এবার আর অবাক হল না সহদেব৷ গত কয়েকদিন ধরে এত অবাক হয়েছে যে বিস্ময়সূচক চিহ্নেরও কোটা শেষ হতে চলল৷ আড়চোখে একবার দেখে নিল, তিনি একটা ‘ল্যাপেল’ পরে এসেছেন৷ অর্থাৎ রেকর্ডিঙের বন্দোবস্ত করেই এসেছেন! এই লোকটার কখন কী বাই ওঠে তার ঠিক নেই৷ নির্ঘাৎ ফের মাথায় লাস্ট মিনিট ইম্প্রোভাইজেশন এসে ঘাঁই মেরেছে! তাই এখন ঘাড়ে ক্যামেরা নিয়ে দৌড়তে হবে সহদেবকে৷

‘ওকে স্যার৷’

সে আর কথা বাড়াল না৷ ওনার সঙ্গে তর্ক করা আর বেড়ালকে বর্ণপরিচয় পড়ানো; দুটোই সমান! উনিও হয়তো আর দেরি করতে চাইছিলেন না৷ তাই একটা মোটা খাম তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘শুরু করা যাক? এটা একটা বিপজ্জনক টুইস্ট৷ আশা করি, তুমি যথেষ্ট প্রোফেশনাল?’

প্রথম প্রশ্নটার উত্তর দেওয়া বাহুল্য৷ কিন্তু দ্বিতীয় প্রশ্নের অর্থ ঠিক বুঝল না সহদেব৷ তবে এ লোকের সব প্রশ্নের অর্থ খুঁজতে যাওয়াই বৃথা৷ শুধু এটুকু বুঝেছে যে ওই মোটা খামের মধ্যে তার সম্পূর্ণ পেমেন্ট আছে৷ এই একটা দিকে এই পরিচালকের চিরকালই সুনাম রয়েছে৷ তিনি সমস্ত কলা-কুশলীদের যথাযোগ্য মূল্য দেন ও যথাসময়ে দেন৷ কুড়ি বছর আগেও তাঁর কোনও প্রোডিউসারের সাহস ছিল না পেমেন্ট পেন্ডিং রাখার৷ গিরীশ এবং নিখিলও গতকালই সম্পূর্ণ পারিশ্রমিক পেয়েছে৷ পেশাদারি দিক দিয়ে অভিযোগের কোনও জায়গা নেই৷ ওনার যে কোনওরকম টার্ন আর টুইস্টই বিপজ্জনক! টাকাটা পকেটে এলেই হল৷ এরপর ফিল্ম ব্লকবাস্টার হোক কী ডিজাস্টার; কী এসে যায়!

‘রেডি?’

‘রেডি’৷

‘লাইট ওকে, ক্যামেরা?’

সহদেব বলল, ‘রোলিং’৷

আলতো করে মাথা ঝাঁকালেন তিনি৷ তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলেন তাঁর মিনিবারের দিকে৷ ক্যামেরা প্যান করল সহদেব৷ ক্যামেরায় চোখ রেখেই বিস্মিত দৃষ্টিতে দেখল, পরিচালক হাতে একটি পানীয়ের বোতল তুলে নিয়েছেন!

‘কুড়ি বছর! কুড়ি বছর ধরে এই অন্ধকারে আছি আমি!’ সেই অদ্ভুত রহস্যময় রশ্মি পড়ে সামান্য চিকচিকিয়ে উঠল পরিচালকের চোখ৷ মুখ আবছা অন্ধকারে ঢাকা৷ অভিব্যক্তি বোঝা দায়৷ খুব ধীরেসুস্থে ফের এদিকেই হেঁটে আসতে আসতে বললেন, ‘বাইরের দুনিয়া বার বার বলেছে, আমি বিলুপ্তপ্রায়! আমি ডাইনোসোর! আই অ্যাম ফিনিশড! আই অ্যাম ডেড!…অ্যাম আই?’

এই মুহূর্তে তাঁর কণ্ঠস্বর অদ্ভুত রকমের অলৌকিক লাগছিল! একেবারেই লাউড নয়৷ অতিনাটকীয় নয়৷ আবেগে কাঁপছে না৷ বরং বরফের মতো শীতল ও কঠিন৷ সহদেব চূড়ান্ত পেশাদারিত্বের সঙ্গে ক্যামেরায় ধরছে তাঁর রহস্যমাখা মূর্তিকে৷ তিনি অদ্ভুতভাবে এগিয়ে আসতে আসতেই একটি বিশেষ জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়লেন! যেখানে নরম আলোর আভাস এসে ঠিক মুখের ওপরে পড়ছে৷ দেহ অন্ধকারে ঢাকা৷ কিন্তু মুখটা আবছা আলোয় দেখা যাচ্ছে৷

‘আজ পর্যন্ত কেউ ঠিক করে বলতে পারেনি, আসলে আমি কে! আমি কী! কেউ বলেছে, পাগল! মেগালোম্যানিয়াক, স্কামবাগ; আরও কত কী! কিন্তু আমি জানি আমি কে! সবাই বলে আমি অন্ধকারে হারিয়ে গিয়েছি৷ কিন্তু তারা ভুল বলে—!’

বলতে বলতেই তাঁর মুখের প্রতিটা ভাঁজ পালটে গেল! এবার যেন ভীষণ অপ্রকৃতিস্থ লাগছে তাঁকে! চোখদুটো আরও নিষ্ঠুর! হাতের অ্যালকোহলের বোতলটার মুখ সশব্দে খুলে দিয়ে সমস্ত পানীয় বিদ্যুৎগতিতে নিজের গায়ে ঢেলে দিলেন তিনি! সহদেব কিছু বুঝে ওঠার আগেই ফস করে জ্বলে উঠল লাইটার! সেই লাইটারের নীলাভ লকলকে শিখায় ঝিকিয়ে উঠল মানুষটার শ্বদন্ত৷ হিংস্র হেসে বললেন তিনি :

‘হোয়াট টু সে! আই অ্যাম দ্য গড! লেট দেয়ার বি লাইট!’

সত্যিই ব্লকবাস্টার!

যখন এই বিস্মৃতপ্রায় চিত্রপরিচালকের ডকুমেন্টারি ফিল্ম একটি ভিডিও শেয়ারিং সাইটে প্রকাশিত হল, তার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল এই ভিডিওটি৷ মাত্র আধঘণ্টার মধ্যেই প্রায় টোয়েন্টি মিলিয়ন ভিউ পেয়ে গিয়েছিল এই তথ্যচিত্র৷ আর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই ওয়ান বিলিয়ন ভিউ ছুঁয়ে ফেলেছিল৷ আরেকটু হলেই হয়তো সবচেয়ে বেশি ভিউ পেত এই ভিডিও! কিন্তু মারাত্মক ভায়োলেন্সের জন্য ভিডিও শেয়ারিং সাইটটি তথ্যচিত্রটিকে সরিয়ে দিতে বাধ্য হল!

তবে যতক্ষণ সেটি অ্যাভেইলেবল ছিল, ততক্ষণ লোকে বিস্ময়ে, আতঙ্কে, উৎসাহভরে দেখেছে একজন মেগালোম্যানিয়াকের শুরু থেকে শেষ মুহূর্তটুকু! জীবনের শেষ মুহূর্তেও পাগলের মতো আছাড়ি-পিছাড়ি খেতে খেতে, এদিক-ওদিক দৌড়তে দৌড়তে, জ্বলতে জ্বলতে, পুড়তে পুড়তে লোকটা একটা কথাই বারবার বলে গিয়েছে—!

‘লেট দেয়ার বি লাইট!…লেট দেয়ার বি লাইট!…লেট দেয়ার বি—!’

আর ক্যামেরা নিখুঁতভাবে ফলো করে চলেছে সেই জ্বলন্ত মানুষটাকে! আদ্যোপান্ত প্রোফেশনালভাবে ধরেছে মুহূর্তগুলোকে৷

শুধু সহদেব এখন অন্ধকার কারাগারের মধ্যে বন্দি! যতবার তার মনে পড়ে মুহূর্তগুলো ততবারই আফসোসে মাথা ঠোকে দেওয়ালে! ওই জ্বলন্ত মানুষটা যতক্ষণ না প্রায় নিঃশেষ হয়ে পড়ে গিয়েছিল মাটিতে, ততক্ষণ সে মূর্খের মতো ভেবেছিল, এটা নির্ঘাৎ একটা বিপজ্জনক স্টান্ট! ভেবেছিল—এই কারণেই সতর্কবাণী দিয়ে তিনি জানতে চেয়েছিলেন, ও পেশাদার কি না! সহদেব ক্যামেরার মাধ্যমে নানারকম স্টান্ট দেখেই অভ্যস্ত! স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি ঘটনাটা বাস্তবেই ঘটছে! ভেবেছিল, এটাও তাঁর দুরন্ত অ্যাক্টিঙের অন্যতম!

যখন বুঝল, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে৷ এক ঘণ্টায় ওয়ান পয়েন্ট থ্রি বিলিয়ন ভিউ! তথ্যচিত্র নিঃসন্দেহে ব্লকবাস্টার, কিন্তু সহদেবকে এখন পুলিশ ইন্টারোগেট করছে৷ একটা জলজ্যান্ত মানুষ পুড়তে পুড়তে শেষ হয়ে গেল আর সে বিনা দ্বিধায় প্রথম থেকে শেষ অবধি ক্যামেরাবন্দি করল, এমনকি ভিডিও শেয়ারিং সাইটে সেটা প্রকাশিতও হল! যতই সহদেব বলুক না কেন যে সে শেষ অবধি এটা ওই পরিচালকের বিপজ্জনক স্টান্টই ভেবেছিল; পুলিশ তা মানতে রাজি নয়৷ তারা এখন তদন্ত চালাবে৷ জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করার জন্য সে আফসোসে মাথা ঠোকে, কাঁদে৷

আজ সহদেব আলোকেও ভয় পায়!

‘উই ক্যান ইজিলি ফরগিভ আ চাইল্ড, হু ইজ অ্যাফরেইড অফ দ্য ডার্ক; দ্য রিয়েল ট্র্যাজেডি অব লাইফ ইজ হোয়েন মেন আর অ্যাফরেইড অফ দ্য লাইট৷’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *