বিশ্বস্ত সঙ্গী

বিশ্বস্ত সঙ্গী

২২শে সেপ্টেম্বর, ১৯৮৫

তখন সাদা বকের দীঘল ডানার ছন্দে ছন্দে সন্ধ্যা নামছে৷ সাদা রঙের ডানাগুলো সূর্যাস্তের শেষ রক্তিম আলোটুকু মেখে ছড়িয়ে দিচ্ছে গুঁড়ো গুঁড়ো সিঁদুরে অভ্র৷ অন্ধকার এখনও গাঢ় হয়ে ওঠেনি৷ আধা অস্বচ্ছ পর্দার মতো নির্লিপ্ততায় ছড়িয়ে আছে চতুর্দিকে৷ ঝিলের জল থেকে উঠে আসছে বাষ্পীয় ধোঁয়াশা৷ হঠাৎ দেখলে মনে হয় কোনও ছায়ামূর্তি বুঝি চুপিচুপি উঠে আসছে জলের বুক থেকে৷

এইমুহূর্তে কান পেতে শুনলে দুটি শব্দই শোনা যাবে৷ শিশিরের অস্ফুট টুপটাপ৷ আর একটা অত্যন্ত চাপা শিশুকণ্ঠের কান্না! শিশিরের শব্দ যতটা সন্ত্রস্ত, কান্নার শব্দটাও ততটাই সাবধানী৷ যেন বুকের ওপর এক চরম ভার নিয়ে কাঁদতে চাইছে কেউ৷ কিন্তু কান্নাটা সেই প্রচণ্ড ভারের তলায় চাপা পড়ে হারিয়ে যাচ্ছে এক অনাবিল অসহায়তায়৷

‘জ্যানেট, প্লিজ ডোন্ট ক্রাই বেবি৷’

মেয়েটা বড্ড কষ্ট পেয়েছে৷ কান্নার দমকে তার পিঠ ফুলে ফুলে উঠছে৷ দু-হাতে জড়িয়ে ধরে আছে একটি নিথর দেহকে৷ একটু পরেই কবরস্থ করা হবে মৃতদেহটিকে৷ তা সত্ত্বেও বুকে আঁকড়ে ধরে আছে৷ এমনভাবে ফুলে ফুলে কাঁদছে, যেন বুকের শিরা ছিঁড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তারই দেহের অংশকে৷ কিছুতেই বুঝি যেতে দেবে না তার একমাত্র বন্ধুকে! একমাত্র বিশ্বস্ত সঙ্গীকে৷

মেয়েটির ঠাকুমার মুখের বলিরেখায় স্পষ্ট সন্ধ্যার আলোর গাঢ় তামাটে আঁকি-বুঁকি৷ মুখখানা কিছুটা ব্রোঞ্জ মূর্তির মতো৷ মাথার কাঁচাপাকা চুলগুলো বিস্রস্ত৷ তিনি নাতনিকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘জ্যানেট৷ কেঁদো না৷ ও খুব কষ্ট পাচ্ছিল৷ গড ওর কষ্ট দূর করেছেন৷ ওকে ছেড়ে দাও৷’

জ্যানেট নামের শিশুকন্যা অতিকষ্টে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল ঠাকুমার দিকে৷ শিশুর সরল দৃষ্টি সন্ধ্যার নরম আলোয় আরও মায়াবী দেখাচ্ছিল৷ চোখদুটোয় একরাশ অশ্রু নিয়ে ভীষণ সরলতায় বলল, ‘তবে আমার সঙ্গে কে খেলা করবে গ্র্যানি?’

ঠাকুমা, অর্থাৎ গ্র্যানি স্মিত হাসলেন, ‘কেন? আমি খেলব তোমার সঙ্গে৷’

জ্যানেট বিষণ্ণ মুখে চোখ মুছল৷ গ্র্যানি কী করে খেলবে ওর সঙ্গে! গ্র্যানির তো পায়ে, কোমরে ব্যথা! সংসারের কাজেই সবসময় ব্যস্ত৷ তার খেলা করার সময় কই? একমাত্র ও-ই তো ছিল যে সবসময়ই ওর সঙ্গে খেলা করত৷ এক শিশুর অন্যতম বিশ্বস্ত সঙ্গী!

গ্র্যানি মৃদুকণ্ঠে আবার বললেন; ‘জ্যানেট, প্লিজ৷’

অবুঝ শিশু মৃতদেহটিকে আরও সজোরে আঁকড়ে ধরে৷ যারা দেহটিকে কবরস্থ করবে তারাও অধৈর্য হয়ে উঠেছে৷ আর কাঁহাতক অপেক্ষা করা যায়! ক্রমাগতই অন্ধকার নেমে আসছে৷ আর কিছুক্ষণ পরে নিজের হাত-পাও ঠিকমতো দেখা যাবে না৷ অথচ মেয়েটি কিছুতেই মরদেহটিকে ছাড়তে চাইছে না৷ আর পাঁচটা সাধারণ বাচ্চার মতো হলে ধমকধামক দিয়ে হয়তো জোর করে ছাড়ানোও যেত৷ কিন্তু একেই বাপ-মা মরা শিশু, তার ওপর জন্ম থেকেই পঙ্গু৷ তার দুনিয়া শুধু হুইলচেয়ারেই সীমাবদ্ধ৷ হয়তো সেজন্যই একটু বেশি জেদি৷ লাশটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ক্রমাগতই কেঁদে চলেছে৷

বেগতিক বুঝে গ্র্যানিই এবার এগিয়ে এলেন৷ মেয়েটার মন বড় নরম৷ ভীষণ মায়াবী মনের শিশু জ্যানেট৷ মৃত্যুর কঠিন বাস্তবতাকে ঠিকমতো বোঝার বয়েস এখনও ওর হয়নি৷ তিনি আলতো করে জ্যানেটের কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘বেবি, ডোন্ট ক্রাই৷ ও তোমার আশেপাশেই আছে৷ কোথাও যায়নি৷ কখনও যাবে ও না৷’

জ্যানেট ভেজা চোখের পাতা তুলে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায়, ‘ও যায়নি?’

‘না!’ গ্র্যানি তার রেশমের মতো চুলে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘ওর শুধু জায়গা বদল হয়েছে৷ এখন তো ও আমাদের বাড়ির পেছনে, এই বাগানেই শুয়ে থাকবে৷ আগে তো ছুটে ছুটে এদিকে-ওদিকে চলে যেত৷ দুষ্টুমি করত৷ তোমাকে ফেলে দিয়ে নেবারদের সঙ্গে খেলা করত৷ তুমি ওকে ধরতে পারতে না, কাঁদতে! খুঁজে খুঁজে বেড়াতে৷ এখন ও পুরোপুরি তোমার ওবিডিয়েন্ট হয়ে এখানেই শুয়ে থাকবে৷ তোমায় ফেলে ও কোথাও যেতেই পারবে না৷ তাই না?’

জ্যানেট ফোলা ফোলা রক্তাভ চোখদুটো মুছে নিয়ে বলল, ‘ও আর কখনও আমাকে ফেলে এমিলিদের সঙ্গে খেলা করবে না? কখনও আমাকে একা ফেলে রেখে যাবে না?’

গ্র্যানির মুখের হাসিটা যেন সন্ধ্যার আতুর রশ্মির চেয়েও বেশি রহস্যময় ঠেকল, ‘না৷ কোথাও যাবে না৷ যেতেই পারবে না৷ এখন শুধু ও এখানেই শুয়ে থাকবে৷ তুমি যা বলবে সব চুপ করে শুনবে৷ আর কারোর কথা শুনবে না৷’

জ্যানেট কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মৃতদেহটিকে ছেড়ে দিল৷ গর্ত আগেই খোঁড়া হয়ে গিয়েছিল৷ সকলে মিলে ধরাধরি করে শবটিকে কবরস্থ করে দিল৷ যখন সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি সমাপ্ত হল, তখন গ্র্যানি একটা সাদা গোলাপের তোড়া রেখে এল সমাধির বুকে৷ অন্ধকার গুঁড়ি মেরে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ধরছিল কবরটিকে৷ জ্যানেট দেখল গ্র্যানি একটা ধবধবে সাদা মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়েছে৷ সেই মোমবাতির ভীরু শিখার স্তিমিত আলো এসে পড়ছিল শিশুকন্যার মুখের একদিকে৷ আরেকটা দিক অন্ধকার৷ যেন ওপাশের মুখ আঁধার দিয়েই গড়া৷ সেখানে কোনওদিন কোনও আলো এসে পড়েনি৷

মাঝেমধ্যেই একটা ঠান্ডা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে৷ নিস্তব্ধ বাগানে শুধু একটা-দুটো গাছের পাতা ঝরানোর টুপটাপ শব্দ৷ আর নারকেল পাতার শিরশিরানি৷ সবুজ নারকেল পাতাগুলো জ্যোৎস্নায় নীলাভ! সেই নীলচে পাতার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে গোল রুপোর থালার মতো চাঁদ৷ আশেপাশের ছোট ছোট ফুলের গাছ, ঝোপ থেকে একটা মনকেমন করা গন্ধ ভেসে আসছে৷ টুপটুপ করে জোনাকিরা গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে নক্ষত্রের মতো জ্বলে উঠছে অদ্ভুত ইশারায়৷

জ্যানেট বিষণ্ণ চোখে একবার গ্র্যানির দিকে তাকাল৷ আরেকবার কবরের দিকে৷ ওখানেই শুয়ে আছে তার চিরসাথি৷ বিশ্বস্ত সঙ্গী৷ যে আগে কখনও কখনও ভুলবশত বিশ্বাসভঙ্গ করেছিল৷ কিন্তু আজ আর ভুল করেও তার সে উপায় নেই৷ আজ সে আর কোনও এমিলি বা প্যাট্রিকের কাছে যেতে পারবে না৷

এখন সে শুধুমাত্র জ্যানেটের৷ আর তার ওপরে অন্য কারোর দাবি নেই! এখন সে সম্পূর্ণ বিশ্বস্ত ও অনুগত!

২১শে জুলাই, ২০১৯

‘আমি বুঝতে পারছি না আর্থার, তুমি ওই জ্যানেটের মধ্যে কী দেখেছ!’

একটু অসহিষ্ণুভাবেই কথাটা বলল ক্যারোলিন৷ সে অত্যন্ত সুন্দরী ও সুতনুকা৷ কালো জর্জেটের শাড়িতে আরও বেশি আকর্ষণীয়া আর আবেদনময়ী লাগছে তাকে৷ কিন্তু মুখ দেখলেই বোঝা যায়, তার মেজাজ মোটেও ভালো নেই৷ নাকের পাটা রক্তাভ৷ নীলাভ চোখদুটি উত্তেজনায় ঈষৎ বিস্ফারিত৷ স্ফুরিত অধরে সে জানায়, ‘কী আছে ওর যে তুমি আমায় ছেড়ে ওকে বিয়ে করতে চাইছ? একটা থলথলে মোটা শরীর, গোলগোল চোখ! নিজের পায়ে হাঁটার ক্ষমতাটুকুও নেই! সর্বক্ষণ হুইলচেয়ারে ঘুরে বেড়ায়! এমনকী তোমার চেয়ে বয়েসেও বড়৷ ওই আধবুড়ি কুচ্ছিত, পঙ্গুটা তোমায় কোনওরকম সুখ দিতে পারবে না! ওর জন্য তুমি আমায় ডাম্প করছ! ড্যা-ম ই-ট!’

শেষ শব্দটা উচ্চারণ করেই সে হাতের টিস্যু পেপারটা এমন ভাবে ছুড়ে দিল, যেন অবিকল সেভাবেই আর্থার তাকে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলেছে! তার রাগের বহর দেখে আর্থার মিটিমিটি হাসছে৷ রেস্টোরেন্টের বাকি লোকেরা সামান্য কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাদের একবার দেখে নিয়ে পরক্ষণেই নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতায় ডুবে গেছে৷ সচরাচর নামী ও অভিজাত রেস্তোরাঁয় দৃশ্যটা এমনই হয়৷ এখানে কেউ কারোর ব্যাপারে কৌতূহল দেখায় না৷ প্রত্যেকেই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে৷

আর্থার অত্যন্ত সুদর্শন যুবক৷ তার ব্যাকব্রাশ করা চুল, টিকোলো নাক, ধারালো চোয়াল, সুগভীর দুটি হাসি মাখা চোখ ও টানটান পুরুষালি দেহ; সব মিলিয়ে আভিজাত্যের প্রতীক৷ পরনের গাঢ় নীল রঙের স্যুটটা সামান্য ভাঁজও খায়নি৷ হাবেভাবেই বোঝা যায় যে অত্যন্ত গোছালো স্বভাবের ঠান্ডা মাথার মানুষ৷ সে টেবিলে রাখা টিস্যু পেপারের প্যাকেট থেকে একটি টিস্যু পেপার তুলে নিয়ে এগিয়ে দেয়৷ নম্র অথচ গম্ভীর স্বরে বলে, ‘হয়েছে? না আরও সিনক্রিয়েট করতে চাও?’

ক্যারোলিন এবার প্রায় কেঁদেই ফেলে, ‘কী পেয়েছ তুমি ওই বুড়িটার কাছে যে আমায় ছাড়তে চাইছ? যখন ডিনারে ডাকলে তখন ভেবেছিলাম এবার অফিশিয়ালি প্রপোজ করবে৷ অথচ তুমি কিনা বলছ; তুমি ওই জ্যানেটকে বিয়ে করছ! এর মানে কী?’

‘বিয়ে করছি না৷ অলরেডি বিয়ে করেছি৷’ সে স্মিত হাসল, ‘আমাদের রেজিস্ট্রি ম্যারেজ হয়ে গিয়েছে৷ শুধু চার্চে গিয়ে আনুষ্ঠানিক বিয়েটাই বাকি আছে৷ তবে আইনত, আমি এখন জ্যানেটের স্বামী৷’

ক্যারোলিন বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আর্থারের দিকে৷ যেন কথাটা বিশ্বাস করতেই পারছে না৷ এ কি সেই আর্থার যার সঙ্গে এতদিন ধরে ঘনিষ্ঠতম মুহূর্তগুলোও কাটিয়েছে অবলীলায়! যাকে বিশ্বাস করে দেহ-মন সর্বস্ব দিয়েছে; সেই পুরুষই কি এই মুহূর্তে তার সামনে বসে আছে? নাকি এ অন্য কেউ!

তার চোখ বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় অশ্রুবিন্দু চুঁইয়ে পড়ছে, ‘আর্থার! তুমি বোধহয় ঠান্ডা মাথায় মানুষ খুনও করতে পারো!’

আর্থার ফের শান্ত হাসি হাসল৷ আস্তে আস্তে বলল, ‘সরি ক্যারোলিন৷ জ্যানেটকে তুমি অনেকক্ষণ ধরেই উল্টোপাল্টা বলছ৷ মানুষের বাহ্যিক রূপটাই সব নয়৷ মানছি, জ্যানেট ছোটবেলা থেকেই হাঁটতে-চলতে পারে না৷ ওর পায়ের হাড় সম্পূর্ণভাবে গড়ে না ওঠার কারণেই এই অবস্থা৷ কিন্তু এটা তো ওর দোষ নয়৷’

‘কিন্তু ও তোমার থেকে আট বছরের বড়!’ ক্যারোলিন ফের উত্তেজিত, ‘যখন ওর জন্ম হয়েছিল তখন তোমার মা-বাবার বিয়েও হয়নি!’

‘সো হোয়াট!’ সে কাঁটা-চামচ দিয়ে রোস্টেড ল্যাম্বের মাংস কাটতে ব্যস্ত, ‘এটাও ওর দোষ নয়৷ আমার থেকে আট বছরের বড় বলে সে আমার যোগ্য নয়! সাউন্ডস ইললজিক্যাল৷’

‘তাহলে তোমার কাছে লজিকটা কী?’ ক্যারোলিনের নাকের পাটা ফুলে ওঠে, ‘কেন ওই কুচ্ছিত মেয়েটাকে বিয়ে করলে? আর আমাকে জানানোর প্রয়োজনও বোধ করোনি! তোমার কাছে আমার কোনও মূল্য নেই!’

কথাটা কানে যেতেই চিবোনো বন্ধ করল আর্থার৷ টিস্যু পেপারে মুখ মুছে বলল, ‘মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গোয়েজ ক্যারল৷ যাকে তুমি বারবার কুচ্ছিত, কদাকার, বুড়ি, এইসব উল্টোপাল্টা বলে যাচ্ছ সে আমার স্ত্রী৷ সে একজন নামকরা বিজনেস-ওম্যানও বটে৷ কলকাতার ফুড বিজনেসের আনক্রাউন্ড কুইন৷ তোমার-আমার মতো একশোটা মানুষকে কলার পরিয়ে পুষতে পারে ও৷ আমরা ওর সামনে জাস্ট ভিখিরি!’

সযত্নে চোখের জল মুছতে মুছতে ক্যারোলিন বলল, ‘ও! তাহলে লজিকটা এই! তুমি সোনার কলার পরতে চাও!’

আর্থার তার দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে৷ এর একটা মারাত্মক কঠিন উত্তর দেওয়া যেত৷ কিন্তু মেয়েদের সঙ্গে নাকে নাক বাজিয়ে ঝগড়া করা তার স্বভাববিরুদ্ধ৷ আপাদমস্তক ভদ্রতায় মোড়া মানুষের পক্ষে সেটা সম্ভবও নয়৷ সে আলতো করে ওয়াইনের গ্লাসটা এগিয়ে দিল ক্যারোলিনের দিকে৷ ক্যারোলিন তখন কোনওক্রমে কান্না চাপার চেষ্টা করছে৷

মাঝে মাঝে আর্থারের মনে হয় মেয়েরা ভারী অদ্ভুত জীব! কখন কী করে বসবে তার ঠিক নেই৷ আজকাল এমনও ধারণা হচ্ছে যে নারীরা বোধহয় পুরুষদের চেয়েও কুকুরদের বেশি ভালোবাসে৷ ঠিক এই মুহূর্তেই ক্যারোলিন তাকে ঘুরিয়ে কুকুর বলে দিল! অন্যদিকে জ্যানেটের কুকুর ‘ফেইথ’-এর গল্প শুনতে শুনতে তার পাগল হওয়ার উপক্রম! জ্যানেট বোধহয় তাকেও এত ভালোবাসে না যতটা ফেইথকে ভালোবাসে৷ যতক্ষণ তারা দুজনে একসঙ্গে থাকে ততক্ষণ শুধু ফেইথেরই গল্প চলতে থাকে৷ যদিও আর্থার তাকে এখনও স্বচক্ষে দেখেনি৷ কিন্তু জ্যানেটের কাছেই শুনেছে যে ফেইথ জাতে ল্যাব্রাডর৷ সে অসম্ভব বুদ্ধিমতী৷ জ্যানেট হাঁটতে-চলতে পারে না বলে ফেইথ নাকি সবসময়ই তাকে চোখে চোখে রাখে৷ সকালবেলায় খবরের কাগজ মুখে করে নিয়ে ছুটে আসে৷ টুকিটাকি কাজও করে দেয়৷ কখনও চশমার বাক্স নিয়ে আসে, কখনও বা জলের বোতল, চিরুনি৷ তবে সবচেয়ে আশ্চর্য তার একাগ্র ভালোবাসা! দিন নেই, রাত নেই; সে শুধু জ্যানেটের দিকেই সতর্ক নজর রাখছে৷ অবসর সময়ে খেলা করে৷ কিন্তু এমন কিছু করে না যাতে চলৎশক্তিহীন মানুষটার কোনও কষ্ট হয়৷

‘এরপর তো ফেইথের ছুটি হয়ে যাবে৷’ আর্থার হেসে জ্যানেটের হাতদুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলে, ‘কারণ এরপর তো শুধু আমিই তোমার খেয়াল রাখব৷ তাই না?’

জ্যানেট স্মিত হেসেছে, ‘তুমি ফেইথের মতো পারবে না৷ ও একদম আলাদা৷ আমি কিছু বলার আগেই সব বুঝে যায়৷ তোমার ভালোবাসায় সামান্য খাদ থাকলেও থাকতে পারে৷ কিন্তু ফেইথের ভালোবাসা একদম নিখাদ৷’ বলতে বলতেই তার চোখে কৌতুক নেচে ওঠে, ‘তুমি আমায় ছেড়ে যেতেই পারো; কিন্তু ফেইথ যাবে না৷’

বোঝো! কথা নেই বার্তা নেই, শেষে কিনা কুকুরের সঙ্গে তুলনা টেনে দিল! আর্থারের এরকম উদ্ভট কথা শুনে রাগ করাই উচিত ছিল৷ মনে মনে গরগরও করেছিল৷ কিন্তু মুখে প্রকাশ করেনি৷ বরং একটু দেঁতো হাসি হেসে বলেছে, ‘কিন্তু আমি ফেইথের ভালোবাসায় ভাগ বসালে ওর হিংসে হবে না তো?’

‘একদম না৷’ জ্যানেট ওর আঙুল নিয়ে খেলছে, ‘বরং ও তোমাকে আমায় ভালোবাসতে সাহায্য করবে৷ আমি যাকে ভালোবাসি, তাকে ফেইথও খুব ভালোবাসে৷’

‘তা তোমার এই বিশ্বস্ত সঙ্গীটির দেখা পাচ্ছি কবে?’ সে হাসতে হাসতেই বলে, ‘তার গল্প শুনতে শুনতেই যে উইকেন্ডগুলো কেটে যাচ্ছে৷ এবার তো এই প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে দেখা করতেই হয়!’

‘উঁহু!’ জ্যানেট মাথা নাড়ল, ‘অপোনেন্ট নয়; শি ইজ ইওর সিস্টার ইন ল৷’

আর্থার এসব শুনে মনে মনে হেসেছিল৷ মেয়েদের যে কত রকমের অদ্ভুত অদ্ভুত ধারণা থাকে! একটি কুকুর কি না তার শ্যালিকা! এরকম উদ্ভট কথা জীবনে কেউ শুনেছে? অন্য কেউ একথা বললে হয়তো সজোরে হেসে উঠত আর্থার৷ কিন্তু যেহেতু কথাটা জ্যানেটের মুখ থেকে বেরিয়েছে, সেহেতু হেসে ওঠার সাহস পায়নি৷

এমন নয় যে আর্থার জ্যানেটকে ভয় পায়! কিন্তু জ্যানেটের মধ্যে এমন কিছু একটা রয়েছে যাকে ঠিক অবহেলা করা যায় না৷ শুধু ব্যক্তিত্ব নয়, তার মধ্যে একটা অদ্ভুত ঠান্ডা দৃঢ়তা আছে যাকে এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব৷ হাস্যকর কথাটাও এমন দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে বলে যে সেটাকেও সত্যি বলেই মনে হয়৷ তাই ফেইথের ব্যাপারটা একরকম মেনেই নিয়েছে সে৷

‘তা এই শ্যালিকার সঙ্গে দেখা কবে হচ্ছে?’ সে মৃদু হেসে জানতে চায়৷

‘তুমি আমার ফ্যামিলি মেম্বার হলেই ওকে দেখতে পাবে৷’ মুচকি হাসল জ্যানেট, ‘আফটার অল, শি ইজ মাই ফ্যামিলি৷ ওর সঙ্গে দেখা তো করতেই হবে তোমাকে৷’

এরপর আর কথা বাড়ায়নি আর্থার৷ কারণ জ্যানেট সেটা আদৌ পছন্দ করবে না৷ এমনিতেই মেয়েটা ভারী অদ্ভুত৷ কোন কথায় কীভাবে রি-অ্যাক্ট করবে তা বোঝাই দায়৷ নিজের বিষয়ে সে অত্যন্ত স্পর্শকাতর৷ একেই ছোটবেলাতেই একটি অ্যাক্সিডেন্টের দরুন মা-বাবার স্নেহচ্ছায়া হারিয়েছে৷ মূলত ঠাকুমা, তথা ‘গ্র্যানি’র কাছেই মানুষ৷ তার ওপর শারীরিক দিক দিয়েও ভগবান মেরে রেখেছেন৷ চলাফেরার ক্ষমতা না থাকার ফলে এবং খানিকটা ভোজনপ্রিয়তার দরুন অত্যন্ত পৃথুলাও বটে৷ সে বিষয়ে সে নিজেও যথেষ্টই সচেতন৷ নিজের রূপ নিয়ে ভীষণ হীনম্মুন্যতায় ভোগে৷ একমাত্র আপনজন গ্র্যানিও কয়েকবছর আগে দেহ রেখেছেন৷ তবে পৈতৃক সম্পত্তির একচ্ছত্র উত্তরাধিকারসূত্রে তার যত্ন নেওয়ার লোকের অভাব নেই৷ আর আছে ‘ফেইথ’৷ তার ক্ষুধিত হৃদয় সমস্ত স্নেহ, ভালোবাসা, মায়া, মমতা উজাড় করে দিয়েছে এই প্রাণীটিকেই৷ এখন ‘ফেইথ’ই জ্যানেটের গোটা দুনিয়া৷ তাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে ওর পৃথিবী৷

প্রায় ছ’মাস হল আর্থার আর জ্যানেটের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে৷ একটি পার্টিতে প্রথম দেখা ও প্রেম৷ কিন্তু জ্যানেট যেন এখনও কিছুতেই নিজের হৃদয় আর্থারের সামনে মেলে ধরতে চায় না৷ সে অনেকবার অনুনয় করেছে, ‘প্লিজ জ্যানেট, ওপেন ইওর হার্ট টু মি! মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমি বোধহয় এখনও তোমার কাছে স্ট্রেঞ্জার!’

জ্যানেট তার স্বয়ংক্রিয় হুইলচেয়ারে এগিয়ে যেতে যেতে বলেছে, ‘স্ট্রেঞ্জার নও, কিন্তু ফ্যামিলি মেম্বারও নও৷’

আর্থার জ্যানেটের মেদবহুল চেহারা, ড্যাবড্যাবে চোখের দিকে সস্নেহে তাকিয়েছিল৷ বুঝেছিল, এই নারী আদৌ সহজলভ্যা নয়৷ জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত তাকে এক অদ্ভুত স্বতন্ত্র সত্তা দিয়েছে৷ যা অনেকটা হিমশৈলের মতো! কিছুটা দেখা যায়, কিছুটা যায় না! শীতল অথচ কঠিন৷ তাকে জয় করা অত সহজ নয়৷ দুর্বার গতিতে তার দিকে ধেয়ে গেলে শুধু আহতই হতে হবে৷

তাই জ্যানেটকে প্রয়োজনীয় সময় দিয়েছিল সে৷ এই ছ’মাসে একবারও জ্যানেট তাকে নিজের বাড়িতে ডিনারে বা লাঞ্চে ডাকেনি৷ দুজনের দেখা কখনও চার্চে হয়েছে, কখনও রেস্টোরেন্টে, আবার কখনও বা সিনেমাহলে৷ সামনে ঈশ্বর থাকুন, সুখাদ্য থাকুক কিংবা কোনও হিরো বা হিরোইন; দুজনের মাঝখানে সবসময়ই এক অদৃশ্য মধ্যবর্তিনীর উপস্থিতি প্রকট! যার নাম ‘ফেইথ’৷ প্রথম প্রথম আর্থার অস্বস্তি বোধ করত৷ এখন খানিকটা মানিয়ে নিয়েছে৷ আর ফেইথকে মেনে নিয়েছে বলেই আজ সে জ্যানেটের আইনত জীবনসঙ্গী৷

জ্যানেটের কথা ভাবতে ভাবতেই খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল আর্থার৷ সংবিৎ ফিরল ক্যারোলিনের প্রবল কাশির শব্দে! তার গলায় কিছু একটা আটকে যাওয়ার ফলে প্রবল বিষম খেয়েছে সে৷ আর্থার তার দিকে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে চকিতে তাকায়, ‘কী হল! আর ইউ অলরাইট ক্যারল!’

বিষম খেয়ে ক্যারোলিনের ফর্সা মুখ লাল হয়ে গিয়েছে৷ সুন্দর মুখ বিকৃত৷ সে কোনওমতে সামলে নিয়ে বলে, ‘ওয়াইনের গ্লাসে কিছু একটা ছিল৷ আরেকটু হলেই গিলে ফেলছিলাম!’

বলতে বলতেই নানারকম মুখভঙ্গি করতে করতে বিষম খাওয়ার এক ও অদ্বিতীয় কারণটিকে মুখ থেকে বের করে আনল সে৷ তার গোলাপি ঠোঁট বেয়ে জিনিসটা বাইরে বেরিয়ে আসতেই অদ্ভুত এক দ্যুতিতে চোখ ধাঁধিয়ে গেল! রেস্টোরেন্টের মায়াবী আলোয় বাদশাহি জেল্লা নিয়ে ঝিকিয়ে উঠেছে একটা নিটোল হিরের আংটি! পরম উত্তাপে, প্রচণ্ড কামনায় ধিকিধিকি আগুনের মতো জ্বলছে৷

‘আ-র্থা-র!’

ক্যারোলিন স্তম্ভিত! সে যেন কথা বলতে ভুলে গিয়েছে! কেমন যেন বোকা বোকা ঠেকল তার সুন্দর মুখখানা৷ ওয়াইনের গ্লাসে হিরের আংটি! এর অর্থ বোঝার জন্য অবশ্য খুব বেশি বুদ্ধির প্রয়োজনও হয় না৷ বিস্ময়ের অভিঘাতে সে শুধু একটা শব্দই উচ্চারণ করতে পারল৷

‘ওঃ!’

শব্দটার মধ্যে তার হৃদয়ের সমস্ত প্রেম ঝরে পড়ে৷ আর্থার তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে৷

‘তুমি আমার সঙ্গে প্র্যাঙ্ক করছিলে, তাই না?’ ক্যারোলিন উচ্ছ্বসিত, ‘ওঃ মাই গড! ইউ আর ডেঞ্জারাস! সত্যি, তুমি বোধহয় হাসতে হাসতেই খুন করতে পারো! আর্থার, আই লাভ ইউ!’

আর্থারের কপালে সামান্য ভাঁজ পড়ল৷ ক্যারোলিন তো ওয়াইনের গ্লাসে হিরের আংটি পেল৷ এখন দেখা যাক, আগামীকাল জ্যানেট তার গ্লাসে কী পায়!

২২শে জুলাই, ২০১৯

রুপোর দামি কাটলারি সেটটা টেবিলের ওপরে সাজাতে সাজাতে ঘড়ির দিকে তাকাল জ্যানেট৷ ঘড়ির কাঁটা প্রায় আটটা ছুঁই ছুঁই৷ আজ বৃষ্টি আসবে বলেই মনে হয়৷ বিকেল থেকেই ঈশান কোণে একদল জলভরা কালো মেঘ থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে৷ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রুদ্ধ মহিষের পালের মতো ক্রমাগতই ভয়ংকর রূপ ধরছিল৷ এখন তো থরে থরে সাজানো কালো মেঘের স্তূপের বুকে রুপোলি চমক ঝলসে ঝলসে উঠছে৷ তার সঙ্গে ক্রুদ্ধ গর্জন! যেন মহাকালের ডমরু বাজছে৷ তাণ্ডব শুরু হল বলে৷

জ্যানেটের কপালে চিন্তার ভাঁজ৷ ঝড় আসবে বলেই মনে হয়৷ কিন্তু আর্থার কখন আসবে? আজই সে প্রথম এ বাড়িতে আসছে৷ এর আগে কখনও তাকে বাড়িতে ডাকেনি জ্যানেট৷ অনেকবারই মনে মনে আমন্ত্রণ জানিয়েছে৷ কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারেনি৷ অদ্ভুত একটা ভয়, সঙ্কোচ, একটা লজ্জা তাকে বারবার পেয়ে বসেছে৷ কিছুতেই সে বাধা অতিক্রম করা যায়নি৷ কিন্তু আজ সব অপেক্ষার অবসান৷ এখন আর লজ্জা পাওয়ার কোনও জায়গা নেই৷ এখন আইনত আর্থার শুধুমাত্র তারই!

‘ম্যাডাম?’

এতক্ষণ তার সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে টেবিল সাজাচ্ছিল তার বিশ্বস্ত ভৃত্য জর্জ৷ এবার মুখ তুলে বলল, ‘মাইকেলকে ডিনার গরম করতে বলব?’

অনেকদিনের পুরনো মানুষ জর্জ, ড্রাইভার জ্যাক, সেক্রেটারি ক্রিস্টাবেলা, সুদক্ষ বাটলার জেমস আর তুখোড় কুক মাইকেলকে নিয়েই জ্যানেটের সংসার৷ ওরা প্রত্যেকেই খুব ভালো৷ কিন্তু কখনও কখনও ওদের যন্ত্র বলে মনে হয় ওর৷ ওরা বুঝি দম দেওয়া কতগুলো রোবট, যারা এক নির্দেশেই সুসম্পন্ন করে ফেলবে সমস্ত কাজ৷ ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে ওঠে জ্যানেট৷ ওরা প্রয়োজনের বাইরে একটা কথাও বলে না! শুধু নিশ্চুপে সমস্ত নির্দেশ পালন করে যায়৷ ওদের কাজে সামান্যতমও ত্রুটি পেলে খুশি হত সে৷ অন্তত বোঝা যেত, যে ওরা যন্ত্র নয়; দোষগুণসম্পন্ন মানুষ৷ কিন্তু এতটাই নিখুঁত ওদের কাজ যে কোনও ভুল ধরাই মুশকিল৷

জ্যানেট একটা শ্বাস টেনে নেতিবাচকভাবে মাথা নাড়ে৷ ওইটুকু ইশারাতেই জর্জ বুঝে গেল যে মাইকেলকে কী বলতে হবে৷ ওরা সবাই জানে যে স্যার আজ প্রথম এ বাড়িতে আসছেন৷ ম্যাডাম যখন খাবার গরম করতে বারণ করছেন, তখন স্যার আসার পরই ও কাজটা করার নির্দেশ স্পষ্ট৷ সে মাথা ঝাঁকিয়ে নিঃশব্দে চলে যাচ্ছিল, জ্যানেট কী মনে করে যেন ডাকল, ‘শোনো, হোয়াইট মিট’৷

‘ইয়েস ম্যাডাম৷’ সে কথাটা শেষ করার আগেই জর্জ বলে উঠল, ‘মাইকেল জানে যে হোয়াইট মিট স্যার বেশি পছন্দ করেন৷ তবে ব্ল্যাকও সঙ্গে আছে৷ আর ভিন্টেজ ওয়াইনও বের করেই রেখেছি৷’

এরা তো সবাই সব কিছুই জেনে বসে আছে! মুখ খোলার আগেই হড়হড়িয়ে সব কিছু বলে গেল৷ অগত্যা মাথা নাড়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই৷ সে বিরসবদনে বলল, ‘ওকে৷ থ্যাঙ্কস৷’

জর্জ মৃদু হেসে বেরিয়ে গেল৷ জ্যানেট চুপচাপ হুইলচেয়ারটা সুদ্ধ নিজেকে টেনে নিয়ে গেল বেডরুমে৷ আজকাল বড় ক্লান্তি বোধ হয় তার৷ গ্র্যানির মৃত্যুর পর তার সঙ্গে কথা বলার একটা লোকও নেই! এমন একটা মানুষও নেই যার জ্যানেটকে কিছু বলার থাকতে পারে৷ সে পঙ্গু হলেও স্বয়ংসম্পূর্ণ৷ মাথার ওপরে অতবড় বিজনেসটা তো একাই সামলাচ্ছে৷ গ্র্যানি তাকে সুকৌশলে নিজের কাজ নিজে করতেই শিখিয়েছে৷ অথচ ক্রিস্টাবেলা তাকে পুতুপুতু করবেই৷ তাও ভালো আজ তাকে আগেভাগেই ছুটি দিয়ে দিয়েছে৷ নয়তো এখনও নির্ঘাৎ চশমা আঁটা দিদিমণির মতো ডায়লগবাজি করে বলত, ‘ম্যাডাম, আপনার ওয়াইন খাওয়া উচিত নয়! আপনি সহ্য করতে পারেন না৷’

বেডরুমের বড় আয়নাটায় নিজেকে ভালোভাবে দেখছিল সে৷ নিজেকে অত্যন্ত কুৎসিত এক প্রৌঢ়া ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না তার৷ যদিও বয়েস এমন কিছু বেশি না, তবু এই অপ্রয়োজনীয় চর্বির জন্য তাকে অনেক বেশি বয়স্ক দেখায়৷ আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বই অসহ্য লাগছিল জ্যানেটের৷ একটা সাদা ময়দার বস্তার মতো চেহারা! গালের পাশের মাংস ঝুলে পড়েছে! গোল গোল চোখদুটো অবিকল প্যাঁচার মতো৷ দাঁতের সেটিং অবশ্য চমৎকার৷ কিন্তু দাঁতের সৌন্দর্যে কী আসে যায়!

সে ফের একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল৷ এই মুখ দেখলে যে কোনও পুরুষের মনের প্রেম ও কামভাব তিরোহিত হতে বাধ্য! অথচ আর্থার যে কী দেখল! অমন সুন্দর তরুণ শেষ পর্যন্ত তার মতো একটা মেয়ের প্রেমে পড়ল! ভাবলে একদিকে আফসোস হয়, আবার অন্যদিকে রোমাঞ্চও অনুভব করে৷ তার জীবনে এমন একটা মানুষেরই তো দরকার ছিল৷ এরকম একটা বিশ্বস্ত জীবনসঙ্গীর প্রয়োজনীয়তা চিরকালই ছিল৷ ফেইথ অবশ্য আছে৷ কিন্তু সে আর কতটুকু শূন্যতা ভরাতে পারে!

জ্যানেট নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল৷ পরক্ষণেই মনে হল প্রতিবিম্বটা ভেংচি কাটছে৷ সে ফিক করে হেসে বলল, ‘তুমি যতই রাগ করো, আমি আজ জীবনের তলানি পর্যন্ত পান করব৷ ওয়াইন খাব৷ আই অ্যাম ম্যারেড৷ চিয়ার্স!’

তার পেছন থেকে একটা ছায়া যেন চকিতে সরে গেল৷ জ্যানেট অনুভব করল, একটা সদাসতর্ক দৃষ্টি তার ওপর ক্রমাগত লক্ষ রেখে চলেছে৷ সে এবার সজোরে হেসে ওঠে, ‘ওঃ ফেইথ! ইউ জেলাস গার্ল! মাম্মা ইজ কামিং টু ইউ!’

‘ফেইথকে দেখছি না তো?’

ডিনার টেবিলে বসে খুব সন্তর্পণে প্রশ্নটা করল আর্থার৷ অন্যদিনের তুলনায় আজ সে যেন একটু বেশিই সতর্ক৷ মাঝেমধ্যেই একটা হাত সবার অগোচরে ব্লেজারের পকেটে ঢুকে যাচ্ছে৷ অন্যান্য দিন সে যতটা হাসিখুশি থাকে, আজ যেন সেই হাস্যময় মুখটা একটা পিঙ্গল মুখোশের পেছনে লুকিয়ে পড়ছে বারবার৷ জ্যানেট ব্যাপারটা লক্ষ করে বেশ কয়েকবার জিজ্ঞাসাও করেছে, ‘কী হয়েছে? এনি প্রবলেম আর্থার?’ সে মৃদু হেসে প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গিয়েছে৷ উলটে মুখে একটা জোরদার আকর্ণবিস্তৃত প্লাস্টিক হাসি এনে বলেছে, ‘নো! নাথিং সিরিয়াস৷’

আর্থার সতর্ক দৃষ্টিতে ফেইথকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল৷ এই মুহূর্তে তার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী সে-ই৷ এ বাড়ির মালকিন যদি হঠাৎ করে মারা যায়, তবে চাকর-বাকররা বড়জোর কান্নাকাটি করবে৷ পৃথিবীতে শোকের আয়ু মাত্র বাহাত্তর ঘণ্টা৷ বাহাত্তর ঘণ্টা পরে ওরা জ্যানেটের শোক ভুলে অন্য চাকরি খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে৷ জ্যানেটের জন্য আর কেউ শোকপালন করবে না৷

কিন্তু ব্যতিক্রম শুধু ফেইথ৷ একেই সে মানুষের চেয়ে অনেক বেশি প্রভুভক্ত ও বিশ্বস্ত৷ তার ওপর ল্যাব্রাডর অত্যন্ত বুদ্ধিমান প্রজাতি৷ দক্ষ স্নিফার ডগও বটে৷ তার ওপর তার যেসব কীর্তিকলাপ শোনা যায়, তাতেই স্পষ্ট, সে ওয়েল ট্রেইন্ড৷ আর্থার আর কাউকে ভয় পায় না৷ কিন্তু ফেইথকেও আন্ডার এস্টিমেট করা বোকামি৷ সায়ানাইডের গন্ধ খুবই ক্ষীণ৷ কিন্তু যেখানে অপরপক্ষে দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি ঘ্রাণশক্তিসম্পন্ন প্রাণীটির উপস্থিতি রয়েছে, সেখানে একটু সমঝে চলাই বাঞ্ছনীয়৷

ফেইথের উপস্থিত থাকার সম্ভাবনা আর্থারকে এতটাই বিচলিত করছিল যে বারবার হাতটা পকেটের মধ্যে থাকা সায়ানাইডের অ্যাম্পুলটাকে অজান্তেই স্পর্শ করছে৷ ফেইথ তাকে আপাদমস্তক একবার শুঁকে দেখলেই সে ধরা পড়ে যাবে৷ এই ভয়টাই বারবার তাকে তটস্থ করে তুলছিল৷ এ বাড়িতে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই একটা অদ্ভুত অনুভূতি ঘিরে ধরেছে তাকে৷ সে অনুভব করছে যে এই বিরাট প্রাসাদের কোনও প্রান্তে, কোনও অলিন্দে একজোড়া আপাত অদৃশ্য চোখ জরিপ করছে তাকে৷ আর্থার বেশ কয়েকবার সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টির মালিককে খোঁজার চেষ্টা করেছে৷ কিন্তু এখনও তার দেখা পায়নি৷ ইতমধ্যে বাড়ির ভৃত্যদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আসল বিশ্বস্ত সঙ্গীটির দেখা মেলেনি এখনও৷ তাই শেষ পর্যন্ত লজ্জার মাথা খেয়ে প্রশ্নটা করেই বসল৷

জ্যানেট স্মিত হাসল, ‘ফেইথ নিজের মর্জির মালকিন৷ যখন সময় হবে, তখন ঠিকই দেখা দেবে৷’ বলতে বলতেই সে হেসে যোগ করল, ‘তুমি ওকে এখনও দেখোনি ঠিকই, কিন্তু ও তোমায় দেখেছে৷’

কথাটা শুনেই একটা শিরশিরে অনুভূতি আর্থারের পিঠ বেয়ে চলে গেল৷ সে একটু সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে আশেপাশে তাকায়৷ কোথায় সেই জ্বলজ্বলে অতিমানবীয় দৃষ্টি! ঠিক কোথায় লুকিয়ে থেকে লক্ষ রাখছে তার ওপর?

‘ও একটু লাজুক৷’ জ্যানেট খাওয়া শেষ করে ওয়াইনের গ্লাস তুলে নিয়েছে, ‘এমনিতে ওর সাড়াশব্দ তুমি পাবে না৷ এতক্ষণ যে এখানে আছ, একবারও ওর ডাক শুনতে পেয়েছ কি?’

সত্যিই! প্রায় দেড়ঘণ্টা হতে চলল আর্থার এ বাড়িতে ঢুকেছে৷ অথচ একবারও কোনও সারমেয় গর্জন শুনতে পায়নি৷ এমনিতেই ল্যাব্রাডররা শান্তই হয়৷ কিন্তু তা বলে এত শান্ত! অদ্ভুত কুকুর তো!

আর্থার আড়চোখে তাকায় জ্যানেটের দিকে৷ এই নারীকে সহ্য করা যে কী কঠিন, তা শুধু সে-ই জানে৷ এই কুৎসিত রমণী যখন তার বক্ষলগ্না হয়, তখন রীতিমতো বমি পায়৷ ঘেন্না করে৷ তবু মুখে মিষ্টি হাসি রেখে সহ্য করে চলেছে শুধু এই দিনটার জন্য! এখন সে আইনত জ্যানেটের স্বামী৷ স্বাভাবিকভাবেই জ্যানেটের মৃত্যুর পর এই অতুল সম্পত্তির অধিকারী হবে আর্থার৷ বিলাস-ব্যসন-আরামের কোনও অভাব থাকবে না৷ সে তো ইতিমধ্যেই ভেবে রেখেছে যে প্রথমেই জ্যানেটের সব বিশ্বস্ত চাকর-বাকরদের তাড়াবে৷ তারপর ক্যারোলিন আর ও নিজেদের সংসার পাতবে৷ জ্যানেটের মৃত্যু নিয়ে তদন্ত অবশ্য একটা হবেই৷ কিন্তু একটি একা ক্রোড়পতি নারী নতুন স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া হওয়ার দরুন অবসাদে আত্মহত্যা করতেই পারে৷ বাকিটা টাকা থাকলেই ম্যানেজ করা যায়৷ এখন শুধু একটা সুযোগ পেতে হবে ওয়াইনের গ্লাসে জিনিসটা মিশিয়ে দেওয়ার৷ তারপর অ্যাম্পুলটা সযত্নে জ্যানেটের ব্যাগে ঢুকিয়ে দিতে হবে৷ অ্যাম্পুলের গায়ে ওর ফিঙ্গারপ্রিন্ট একবার বসিয়ে দিলেই—!

‘কে—!’

পায়ের কাছে রোমশ কী যেন একটা দ্রুত সরসর করে চলে গেল! আর্থার প্রায় লাফিয়েই ওঠে, ‘ক্কে! টেবিলের নীচে কে!’

আতঙ্কে সে তখন প্রায় কাঁটা হয়ে উঠেছে৷ ফেইথ কি তবে এতক্ষণে চলে এল! সবার অগোচরে টেবিলের তলায় ঢুকে আর্থারকে শোঁকার চেষ্টা করছে নাকি! অ্যাম্পুলটা এখনও পকেটে! তার হাল্কা বাদাম তেলের মতো গন্ধ কোনও মানুষের পক্ষে পাওয়া সম্ভবই নয়৷ কিন্তু ফেইথ! তার ঘ্রাণশক্তির কাছে যে কিছুই লুকোনো থাকে না৷

‘ভয় পেও না৷’ জ্যানেট মৃদু হাসল, ‘ও হোপ৷ জর্জের পোষা বিড়াল৷ কিছু করবে না৷ জাস্ট ডিনার টেবিলে একটা রাউন্ড দিতে এসেছে৷’

একা ফেইথ কি কম ঝামেলা ছিল যে হোপও এসে জুটেছে! আর্থার প্রায় দরদর করে ঘামছে৷ এ বাড়িতে মানুষ কম, কুকুর-বিড়াল বেশি! এবং সম্ভবত তারা প্রত্যেকেই এইমুহূর্তে বিপজ্জনক৷ সে কোনওমতে সামলে নেয়, ‘সরি৷ আমার আবার বিড়ালে অ্যালার্জি আছে৷’

‘ও-হো!’

জ্যানেট একটু আফসোসজনক আওয়াজ করে৷ তারপর হুইলচেয়ারটাকে একটু পিছিয়ে নিয়ে মিষ্টি সুরে ডাকল, ‘হোপ৷ প্লিজ কাম হিয়ার বেবি৷’

সেকেন্ডের ভগ্নাংশ নীরবতা৷ পরক্ষণেই একটা সাদা ধবধবে তুলোর বল লাফিয়ে উঠে পড়ল জ্যানেটের কোলে৷ বেশ থাবা গেড়ে বসে, বিরাট মোটা লেজটা তার মুখে অবলীলায় বুলিয়ে গর্বিত ভঙ্গিতে বলল, ‘মিঁয়াও৷’

‘এক্সকিউজ মি৷’ জ্যানেট অটোম্যাটিক হুইলচেয়ারটাকে চালিয়ে নিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘মহারানিকে একটা রসালো মাছের পিস গিফট করে আসি৷ ফেইথের মতো ইনিও আবার আমার হাতে খেতেই পছন্দ করেন৷’

‘নো প্রবলেম৷’ আর্থার পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছতে মুছতে বলল, ‘টেক ইওর টাইম৷’

‘থ্যাঙ্কস৷’

জ্যানেট বিড়ালটাকে নিয়ে আস্তে আস্তে বেরিয়ে যেতেই তড়িৎগতিতে চতুর্পাশটা একবার দেখে নিল আর্থার৷ না, কোথাও কেউ নেই৷ এই প্রাসাদের চতুর্দিকে সিসিটিভি ক্যামেরা রয়েছে৷ কিন্তু ডাইনিং হলে কোনও ক্যামেরা নেই৷ সম্ভবত খাওয়ার সময় মানুষ একটু প্রাইভেসি চায়৷ সেজন্যই কোনও ক্যামেরা বসানো হয়নি৷ এই সুবর্ণ সুযোগ!

আর্থার বিদ্যুৎগতিতে উঠে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে সায়ানাইডের অ্যাম্পুলটা বের করে আনল৷ মুহূর্তের ভগ্নাংশে সায়ানাইড মিশে গেল জ্যানেটের গ্লাসে! সে এবার নিশ্চিন্ত হয়ে নিজের চেয়ারে বসতেই যাচ্ছিল, তার আগেই ফের একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি! যেন একজোড়া চোখ নিষ্পলকে দেখছে তাকে৷ সে চোখদুটো তার সমস্ত কীর্তি দেখে নিয়েছে৷ দপদপিয়ে জ্বলছে সেই চোখ৷ কিন্তু কোথায়!

আর্থার টের পেল সে প্রচণ্ড ঘামছে! পাগলের মতো একবার এদিক-ওদিক তাকাল৷ অসহ্য রাগে দাঁতে দাঁত পিষল সে! কোথায় সেই শয়তান! কোথায় বসে নিঃশব্দে ভয় দেখাচ্ছে! হাতের কাছে পেলে ওই নীরব, বিশ্বস্ত দৃষ্টি কেড়ে নিত ও৷ কিন্তু তার যে দেখাই নেই! কোথায় ফেইথ?

আচমকা একটা অস্ফুট শব্দ পেয়ে পিছনে ফিরল সে! তার হৃৎপিণ্ড তখন বেসামাল হয়ে উঠেছে৷ মনে হচ্ছে বুকে একটা অদ্ভুত যন্ত্রণা৷ উত্তেজনায় মুখ আরক্তিম৷—

‘সরি আর্থার! একটু দেরি হল৷’ জ্যানেট মিষ্টি হেসে হুইলচেয়ার নিয়ে এদিকেই এগিয়ে আসছে৷ মৃদু হেসে বলল, ‘হুইলচেয়ারে আসার একটাই সুবিধা৷ কোনও শব্দ হয় না৷ বেশ নিঃশব্দেই চলাফেরা করা যায়৷’

আর্থারের নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে৷ দরদর করে ঘামছে৷ বুকের ব্যথাটা আরও প্রবল৷ সে টের পেল, কেমন যেন অবশ হয়ে আসছে শরীর৷ চতুর্দিক যেন অন্ধকার হয়ে আসছে৷ শুধু কোনওমতে বলল, ‘ফেইথ?’

জ্যানেট ফের হাসল, ‘শিগগিরিই দেখা পাবে তার৷ তাড়া কীসের?’

আবার একটা বিষাদঘন রাত্রি৷ আবার সেই চাপা কান্নার সুর! সেই ভারাক্রান্ত কান্না! দু-হাতে আপনজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে সেই মানুষটা৷ চোখ বেয়ে ব্যথা গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে৷ সে যন্ত্রণাকাতর ক্রন্দন বাগানের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে নারকেল গাছের শিরশির শব্দের সঙ্গে৷ শিগগিরিই ঝড় আসবে৷ তারই জোরালো হাওয়ায় বাগানের গাছগুলো দুলে দুলে উঠছে৷

‘আই অ্যাম সরি আর্থার! আই অ্যাম সরি৷’ নিথর আর্থারকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরে ক্রন্দনবিকৃত স্বরে বলল জ্যানেট, ‘তুমি এত বোকা কী করে হতে পারো? বুঝতে পারলে না যে, যে পঙ্গু মানুষটা এত বড় একটা ব্যবসা চালায়; সে অন্ধ নয়! নিজের প্রেমিকের সব খবরই সে রাখবে! কেন তুমি ক্যারোলিনের কাছে গেলে? কেন সায়ানাইডের অ্যাম্পুল কিনলে? কেন বুঝলে না যে আমি ঠিকই জানতে পারব! সব বুঝতে পারব৷ কেন বিশ্বাসঘাতকতা করলে? নয়তো আমিও কি তোমার স্যুপের মধ্যে—!’

‘ম্যাডাম৷’

এক দীর্ঘ ছায়ামূর্তির মতো জর্জ এসে দাঁড়াল তার সামনে৷ ওই একটি শব্দ ছাড়া তার মুখে আর কোনও কথা নেই৷ বাগানের অন্ধকার গায়ে মেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে আরও তিনটে ছায়াদেহ৷ জেমস, জ্যাক আর মাইকেল৷ ওরা কোনও প্রশ্ন করে না৷ শুধু যন্ত্রের মতো হুকুম তামিল করে৷ কোনও কাজে কোনওরকম খুঁত পাওয়া যায় না৷ আজও যাবে না৷

কান্নামাখা গলায় বলল জ্যানেট, ‘ও আর কোনওদিন ক্যারোলিনের কাছে যাবে না জর্জ! ও এখন শুধুই আমার! আর কারোর নয়—!’

জর্জ শুধু অস্ফুটে আবার উচ্চারণ করল, ‘ম্যাডাম!’

‘ওকে ফেইথের কাছেই রাখো৷’ অশ্রুমাখা সজল চোখ তুলে তাকায় জ্যানেট, ‘ও ফেইথের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল৷ এখনই ওদের দেখা হবে৷ ফেইথ ওকে ভালোবাসতে শেখাবে, বিশ্বস্ত হতে শেখাবে! ফেইথের মতোই ও আর আমায় ছেড়ে কখনও আর কোথাও যাবে না৷’

ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরেই চারজন মানুষ চৌত্রিশ বছর আগেকার ছোট্ট কবরটা খুঁড়তে শুরু করল৷ জ্যানেট মরদেহটাকে আস্তে আস্তে ছেড়ে দিল নিজের বাহুবন্ধন থেকে৷

একটু পরেই কাজ সমাপ্ত হয়ে গেলে কবরের ওপরে মোমবাতি জ্বালিয়ে দিল জর্জ৷ তার আলো জ্যানেটের মুখের একপাশে এসে পড়েছে৷ আরেক পাশ অন্ধকার৷

যেন ওপাশের মুখ আঁধার দিয়েই গড়া৷ সেখানে কোনওদিন কোনও আলো এসে পড়েনি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *