পোশাক

পোশাক

‘তোর বর কি জীবনে কখনও প্যান্ট পরা মেয়ে দেখেনি?’

জানকীর দিকে তাকিয়ে অসম্ভব রাগে কাঁপতে কাঁপতে শব্দগুলো ছুড়ে দিল বৈদেহী৷ এই নিয়ে দ্বিতীয়বার এই কথাটা বলল সে৷ তার সুন্দর মুখ রাগে থমথম করছে৷ রেগে গেলেই ওর ঠোঁটের ওপরে আর নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে যায়৷ ঘরে এসি চললেও সে ঘামতেই থাকে! জানকী তরকারি কুটতে কুটতেই আড়চোখে দেখল বৌদি ফের ঘামছে! মনে মনে সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে মেয়েটি! সর্বনাশ! শিউশরণ আবার নতুন করে কী অসভ্যতা করল! এতবার বলেছে লোকটাকে—!

সুমন বসার ঘরে সোফার ওপর আড়কাত হয়ে চায়ে চুমুক দিতে দিতে ল্যাপটপে কাজ করছিল৷ সে রোজ বৈদেহীর আগেই বাড়ি ফেরে৷ ডিনারের আগে ক্লান্ত দেহটাকে এলিয়ে কিছু জরুরি ই-মেল পাঠাচ্ছিল৷ বৌয়ের রাগতস্বর শুনে সটান উঠে বসে বলল, ‘কী হল? শিউশরণ ফের কিছু করেছে?’

শিউশরণ ওদের সোসাইটির সিকিউরিটি গার্ড৷ জানকীর পতিদেব৷ ওরা বিহারের আদি বাসিন্দা হলেও আজন্ম কলকাতায় থেকে আপাদমস্তক বাঙালি হয়ে গিয়েছে৷ জানকী কাজেকর্মে চটপটে৷ ঘরের সমস্ত কাজে পারদর্শী৷ ফলে কাজ পেতে তার অসুবিধে হয়নি৷ কিন্তু শিউশরণের কোনও চাকরিই ছ’মাস, একবছরের বেশি টেঁকে না৷ মূল কারণ তিন ‘ম’য়ের সমাহার৷ মদ-মাংস ও মেয়ে! অবশ্য জানকী শিউশরণের চাকরির জন্য সুমন ও বৈদেহীর কাছে তদ্বির করার সময়ে তৃতীয় ‘ম’টির কথা বেমালুম চেপে গিয়েছিল৷ বৈদেহীর প্রায় পা চেপে ধরেছিল সে৷ করুণ কণ্ঠে বলেছিল, ‘বৌদি, ও কথা দিয়েছে আর নেশা করবে না৷ তোমরা একটু দেখো৷ ঘরে বেকার মরদ বসে থাকলে কোন মেয়েছেলের ভালো লাগে!’

প্রথম প্রথম একটু আপত্তি থাকলেও শেষ পর্যন্ত জানকীর কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিল ওরা৷ শিউশরণকে নিয়ে মাথাব্যথা নেই৷ কিন্তু জানকী ওদের দুজনের ছোট্ট সংসারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সদস্য৷ কাঁটায় কাঁটায় ঠিক সকাল ছ’টায় রোজ এসে হাজির হয়৷ সুমন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার৷ একটি নামী-দামি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করে৷ আর বৈদেহী ফ্যাশন ডিজাইনার৷ তার নিজস্ব একটা নামকরা বুটিক আছে৷ সকালে বেরোয়, ফেরে অনেক রাতে! দুজনের কারোরই মরার সময় নেই! সুতরাং জানকীই সংসারের সমস্ত ঝক্কি-ঝামেলা সামলায়৷ সে একা হাতেই রান্না-বান্না, ঝাড়-পোঁছ, বাজার-হাট সব করে৷ একদিন যদি কামাই করে তবে কর্তা-গিন্নি, দুজনেই চোখে সর্ষেফুল দেখবে! তার ওপর অত্যন্ত বিশ্বস্তও৷ যা দিনকাল পড়েছে, তাতে এমন কাজের লোক পাওয়া রীতিমতো ভাগ্যের বিষয়!

অগত্যা তার মুখের দিকে তাকিয়েই শিউশরণকে কাজে রাখা৷ সুমন এই সোসাইটির প্রেসিডেন্ট৷ তার সুপারিশেই সিকিউরিটি গার্ডের চাকরিটা পেয়েছিল শিউশরণ৷ যেদিন সুসংবাদটা পেল, সেদিন আবেগে, কৃতজ্ঞতায় প্রায় কেঁদে ফেলেছিল মেয়েটা৷ বৈদেহীর হাত ধরে বলেছিল৷ ‘তোমরা আমায় বাঁচালে বৌদি!’

কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে বাঁচলেও পুরোপুরি রক্ষা পেল না জানকী! কারণ সেই এক ও অদ্বিতীয় শিউশরণ!

কয়েকদিন পর থেকেই নতুন সিকিউরিটি গার্ডের নামে নালিশ আসতে শুরু করল! সে নাকি পারভার্টেড! মেয়ে দেখলেই যেন ওর নোলা সকসকিয়ে ওঠে৷ অশ্লীল ইঙ্গিত করে, ছোট ছোট জামা পরা মেয়েদের দিকে কুৎসিত দৃষ্টিতে তাকায়, নোংরা কমেন্ট ছুড়ে দেয়৷ বৈদেহী নিজেও লক্ষ করেছে ওর চোখে অবিকল মেছো বেড়ালের দৃষ্টি! চাউনিটা একদম ভালো লাগে না তার৷ এমন লোভাতুরভাবে আপাদমস্তক দেখে যে মনে হয়, তার গায়ে বোধহয় কোনও পোশাক নেই!

সুমন অবশ্য সেসব কথায় বিশেষ পাত্তাই দেয়নি৷ বরং উলটে বলেছে; ‘ওসব তোমাদের মনের ভুল৷ লোকটার চোখটাই ওরকম৷ শুধু তোমার দিকে নয়, ও আমার দিকেও ঠিক ওভাবেই তাকায়৷ শুধুমাত্র তাকিয়ে থাকার জন্য কি কাউকে দোষ দেওয়া যায়? তুমিও না! বড় অল্পেই উত্তেজিত হও!’

ব্যাপারটা কিন্তু আদৌ অল্পেই থেমে থাকল না৷ শিউশরণের সাহসও ক্রমাগত বাড়তে থাকল, যার পরিণাম আজকের ঘটনা!

এমনিতে কোনওদিনই শাড়ি-টাড়ি পরার অভ্যেস ছিল না বৈদেহীর৷ বিয়ের পর পোশাক নিয়ে আপত্তি করার জন্য কোনও জাঁদরেল শ্বশুর ছিলেন না৷ শাশুড়ি ছিলেন ঠিকই, কিন্তু সুমনের মা এ বিষয়ে অত্যন্ত আধুনিকমনস্কা৷ যতদিন বেঁচেছিলেন, ততদিন বৈদেহীর স্বাধীনতায় কোনওরকম হস্তক্ষেপ করেননি৷ তিনি অন্যান্য শাশুড়িদের মতো পুত্রবধূকে কখনই শাড়ি প্যাঁচানো কলা-বৌও বানিয়ে রাখতে চাননি৷ অতএব সে বিয়ের পরও মনের আনন্দে কুর্তি-লেঙ্গিস, বা টপ-জিন্সের সদ্ব্যবহার করেছে৷ এখনও করে৷ বাড়িতে অবশ্য হাউসকোট পরে থাকতেই ভালোবাসে৷ আর বুটিকে, শপিঙে বা পার্টিতে গেলে নানাবিধ আধুনিক পোশাক৷ তার যৌবনোদ্দীপ্ত যুগল জয়স্তম্ভ সেই পোশাকে প্রকট হচ্ছে কি না, টাইট জিন্স বা ট্রাউজারে উরু বা নিতম্ব কতখানি আবেদনময় কিংবা ব্যাকলেস টপে পেলব পিঠের খাঁজ কতটা দৃশ্যমান তা নিয়ে সে একটুও চিন্তিত ছিল না৷

কিন্তু শিউশরণের কল্যাণে চিন্তা করতে হল!

এমনিতে লোকটা সম্পর্কে একটা বিতৃষ্ণা ছিলই ওর৷ জানকীর কাছে শুনেছে যে শিউশরণ মধ্যরাতে মদ গিলে এসে তার ওপর অত্যাচার করে৷ ‘বাঁজা’ বলে বৌকে খিস্তি করে৷ অথচ জানকীর শরীরে কোনও ত্রুটি নেই৷ সমস্যাটা শিউশরণেরই৷ কোনওদিন সন্তানের জনক হতে পারবে না এই চরম সত্যটি জানার পরেও তার গালাগালি বা মারধোর তো কমেইনি, উলটে আরও বেড়েছে৷ আর সেই চিহ্ন সারা দেহে বয়ে নিয়ে বেড়ায় জানকী! বৈদেহী যতবার মেয়েটার মুখে, গায়ে কালশিটে দেখেছে, ততই গভীরভাবে ঘৃণা করেছে শিউশরণকে৷ ওকে পরামর্শ দিয়েছে, ‘পুলিশের কাছে যাস না কেন! জানিস, এভাবে বৌয়ের গায়ে হাত তোলা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ৷ তুই আমার সঙ্গে এখনই থানায় চল৷’

জানকী ম্লান হেসে সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয়, ‘ও আমার ঘরওয়ালা!’

বৈদেহীর রাগ হয়৷ স্বামী হয়েছে বলে কি মাথা কিনে নিয়েছে? এভাবে মারবে! লোকটার মধ্যে কি আদৌ মনুষ্যত্ব বলে কিছু নেই?

এ হেন লোককে যে সে আন্তরিক ঘৃণা করবে সেটাই স্বাভাবিক৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও জানকীর জন্য মেনে নিতে হয়েছে৷ প্রথম প্রথম শিউশরণকে একদম এড়িয়ে যেত৷ সিকিউরিটি গার্ডের উর্দি পরা একটা লোক যে উপস্থিত রয়েছে, তা যেন ও লক্ষই করত না! বুটিকে যাওয়ার সময় শিউশরণ যখন গেট খুলে দেওয়ার জন্য ব্যস্তসমস্ত ভাবে এগিয়ে আসত, কিংবা সসম্ভ্রমে গাড়ির দরজা খুলে দিত, তখন বিতৃষ্ণায় তার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিত বৈদেহী৷

কিন্তু এমনই কপাল যে অনিচ্ছাসত্ত্বেও একদিন লোকটার অসভ্যতা চোখে পড়ে গেল! ড্রাইভিং সিটে বসে সেদিনই স্পষ্ট আয়নায় দেখল সে, লোকটার কামাতুর দৃষ্টি ওর টাইট টপের বুকে ঘুরে বেড়াচ্ছে! দুটো ঘোলাটে চোখ নির্লজ্জভাবে আমেজ নিচ্ছে এক কুৎসিত কামনার৷ ঠোঁটে ঘোর লাগা হাসি! মেয়েদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় এই অশ্লীল হাসি খুব ভালোভাবেই চেনে!

মুহূর্তের মধ্যে গা ঘিনঘিন করে উঠল তার৷ প্রচণ্ড রাগে চেঁচিয়ে বলল; ‘অ্যাই! হাঁ করে কী দেখছিস তুই? হ্যাঁ?’

একজন মেয়ে তার সঙ্গে এরকম প্রবল ঔদ্ধত্যে তুই-তোকারি করে কথা বলবে, তা বোধহয় স্বপ্নেও ভাবেনি শিউশরণ৷ তার হিসেবমতো নারী স্রেফ অত্যাচার করার সামগ্রী! তার ওপর যত খুশি জোর ফলিয়ে যাও, টুঁ শব্দটিও করবে না৷ অথচ এই মুহূর্তে তার সামনে এক সামান্য মহিলা রীতিমতো চেঁচিয়ে কথা বলছে! বিস্ময়ে সে হতবাক হয়ে যায়! কী বলবে ভেবে পায় না৷

ততক্ষণে রাগে জ্বলতে জ্বলতে গাড়ি থেকে নেমে এসেছে বৈদেহী৷ শিউশরণের নাকের সামনে তর্জনী উঁচিয়ে বলল, ‘স্কাউন্ড্রেল! সবাইকে নিজের বৌ পেয়েছিস? মেয়েরা তোর বাপের মাল! অসভ্যতার একটা লিমিট আছে! জানোয়ার কোথাকার—!’

লোকটা পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে আছে৷ ক্রুদ্ধ বৈদেহী টের পেল ওর দৃষ্টি এখন তার স্লিভলেস টপের বাইরে থাকা উন্মুক্ত কোমল বাহু চেটে বেড়াচ্ছে! যুগটা প্রস্তরযুগ হলে বোধহয় তৎক্ষণাৎ শিউশরণের মাথা পাথর দিয়ে থেঁতো করে দিত সে! ওর ওই অশ্লীল চোখদুটো উপড়ে ফেলত৷ কিন্তু এখন আবার আইন-কানুনের যুগ৷ তবু হয়তো শিউশরণের কপালে দুঃখ ছিল৷ কারণ বৈদেহীর চিৎকার-চেঁচামেচিতে সচকিত হয়ে সোসাইটির কিছু লোকজন দৌড়ে আসে তার দিকে৷

‘কী হয়েছে ম্যাডাম?’ একটি চেনা মুখ প্রশ্ন করে, ‘অসভ্যতা করছে নাকি?’

সে আড়চোখে তাকিয়ে দেখে, অনেক পুরুষই রণং দেহী মূর্তিতে হাতা গোটাতে শুরু করেছে৷ এখন যদি একটুও উস্কানিমূলক কিছু বলে, তবে শিউশরণকে আড়ং ধোলাইয়ের হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না৷

বৈদেহীর চোখের সামনে ভেসে উঠল জানকীর অসহায় মুখ! সে সজোরে শ্বাস টানে৷ তা ছাড়া শহরের একটি বড়সড় ফ্যাশন শো উপলক্ষ্যে তার বেশ কিছু জরুরি মিটিং আছে৷ তার ওপর গোটা রাস্তাটা ড্রাইভ করে যেতে হবে ওকে৷ তাই মাথা গরম করে কোনওরকম সিনক্রিয়েট করতে চায় না৷ সে ব্যাপারটাকে হাল্কা করেই মিটিয়ে দিয়েছিল৷ বলেছিল, ‘না—না! তেমন কিছু নয়৷’

তখনকার মতো ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়লেও গায়ের জ্বালা মেটেনি বৈদেহীর৷ একটা গোটা কর্মক্লান্ত দিন কাটানোর পর রাত্রে বাড়ি ফিরে এসেই সে সটান হাজির হল কিচেনে৷ জানকীকে বলেছিল ওই কথাটাই, ‘‘তোর বর কি জীবনে কখনও প্যান্ট পরা মেয়ে দেখেনি?’

মেয়েটা তখন রুটি বেলছিল৷ আটা মাখা হাতে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে৷ অসহায় চোখদুটো জলে ভরে আসে৷ ঠোঁটদুটো থির্থিরিয়ে কেঁপেও উঠেছিল হয়তো কিছু বলার জন্য৷ ক্রুদ্ধ বৈদেহী তার দিকে একটা অগ্নিদৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে চলে যায়৷

সেদিনও সুমন জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘কী হল!’

সেদিন তার প্রশ্নের কোনও উত্তর দেয়নি সে৷ কিন্তু আজ—!

‘কী হয়েছে বলবে তো!’

রাগে তখন থরথর করে কাঁপছে বৈদেহী! এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে শিউশরণ এমন করতে পারে! ক্ষিপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো তার ভেতরে জ্বলন্ত লাভা উথালপাথাল করছে৷ সে দাঁতে দাঁত চেপে কোনওমতে বলল, ‘ফিল্দি অ্যানিমল! ছোটলোক কোথাকার!’

‘আরে!’ সুমন তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে, ‘কাম ডাউন হানি! এমনিতেই হাইপারটেনশনের রোগী! তার ওপর—!’ বলতে বলতেই জানকীর দিকে ফিরল সে, ‘এখনই একগ্লাস ঠান্ডা জল নিয়ে আয়৷ কুইক!’

জানকী তটস্থ হয়ে বৈদেহীর দিকে তাকিয়েছিল৷ বেশ কিছুদিন ধরেই তার শরীরটা খুব জুতের নেই৷ খাবার খেতে ইচ্ছে করে না, বমি পায়৷ মাথাটাও কেমন টলমল করে৷ মাঝখানে বেশ কয়েকদিন কাজে আসেনি৷ ওর চেহারাটাও কেমন রক্তশূন্য লাগে৷ এই মুহূর্তে সে অসহায়ভাবে তার বৌদির মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবছিল, শিউশরণের এ চাকরিটাও গেলে কী হবে! সংসার চলবে কী করে?…

সুমন আবার ঝাঁঝিয়ে ওঠে, ‘কী রে! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী দেখছিস? জল আনতে বললাম না—!’

‘না!’ সুমনকে থামিয়ে দিয়ে ফুঁসে উঠল বৈদেহী, ‘তুই শোন, তোর বর ঠিক কী করেছে! ওর এত বড় সাহস যে—!’

আজ রাতে অফিস থেকে ফিরে গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে হঠাৎই জুতোর হিলটা ভেঙে গেল৷

ঘটনার আকস্মিকতায় টাল সামলাতে পারেনি বৈদেহী৷ সোসাইটির গ্যারাজেই মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়েছিল সে৷ হাতের ফাইলগুলো নিমেষে ছড়িয়ে পড়ল চতুর্দিকে৷ যতটা না ব্যথায়, তার চেয়েও বেশি বিস্ময়ের অভিঘাতে কেমন যেন স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল৷ যে পায়ের হিলটা ভেঙেছে সে পা-টা ভালোই মচকেছে৷ তার ওপর পড়েছে বেকায়দায়৷ সে পায়ের ওপর জোর দিয়ে একবার ওঠার চেষ্টা করেই কাতরে ওঠে!…

শুনশান গ্যারাজে তখন কোনও লোক ছিল না৷ শুধু শিউশরণ সম্ভবত কাছে-পিঠেই ছিল৷ নিয়মমতো রাউন্ড দিয়ে বেড়াচ্ছিল৷ সে বৈদেহীকে পড়ে যেতে দেখে তাড়াতাড়ি ছুটে আসে৷

‘ম্যাডাম—ঠিক আছেন?’

কথাটা বলার সময়ই ওর মুখ থেকে ভক করে মদের গন্ধ নাকে এসে ঝাপ্টা মারল৷ বৈদেহী বিরক্ত হয়! ডিউটির সময়েও মদ খেয়ে বসে আছে লোকটা! আজই সুমনকে বলতে হবে৷

‘আসুন, উঠে আসুন ম্যাডাম৷’

হাত বাড়িয়ে দেয় শিউশরণ৷ বৈদেহী ওর সহায়তার বাড়িয়ে দেওয়া হাত সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করে নিজেই ফের ওঠার চেষ্টা করল৷ কিন্তু গোড়ালিটা যেন শক্ত হয়ে আছে! সে কঁকিয়ে উঠল, ‘ওঃ! মা-গো!’

‘কোথায় লাগল আপনার? পায়ে নাকি? কই! দেখি—দেখি—!’

বলতে বলতেই বৈদেহীর প্রবল আপত্তিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে সে তার পা স্পর্শ করেছে৷ সাবধানে নেড়েচেড়ে দেখল গোলাপি পা দুটোকে৷ তার চোখদুটোয় অদ্ভুত জান্তব উল্লাস৷ বৈদেহী টের পেল, একটা ঘৃণ্য সরীসৃপ তার পায়ের ওপর কিলবিল করে বেড়াচ্ছে! ঠিক যেন একটা কালসাপ! আস্তে আস্তে উঠে আসছে হাঁটুতে, তারপর উরুর ওপরে, তারপর—!

বিপন্ন, ভয়ার্ত নারী টের পায় সেই সাপটা হিসহিস করে বলছে, ‘আপনার পা দুটো কী সুন্দর ম্যাডাম! কী সেক্সি—!’

আর সহ্য করতে পারেনি সে৷ সপাটে এক চড় বসিয়ে দিয়েছে শিউশরণের গালে৷ তারপর ওই ব্যথা পা নিয়ে কী করে যে ওপরে উঠে এসেছে—!

‘কী!’

তড়িদাহত মানুষের মতো তড়াক করে লাফিয়ে উঠল সুমন৷ দাঁতে দাঁত পিষে উচ্চারণ করল একটাই শব্দ, ‘শুয়োরের বাচ্চা!’ তারপরই বিদ্যুৎবেগে ছুটে গেল বাইরে!

কয়েক মুহূর্ত নিস্তব্ধতা৷ পরক্ষণেই নীচের কম্পাউন্ডে শোনা যায় সুমনের উন্মত্ত চিৎকার, ‘আমার বৌকে সেক্সি লাগে তোর! হা-রা-ম-জা-দা!’

তার সঙ্গেই ভেসে এল ক্ষিপ্ত জনতার উত্তেজিত কোলাহল! একজন নয়, বহুজন চেঁচিয়ে বলছে, ‘মার শালাকে! ঘরের বৌ-মেয়ের গায়ে হাত দেওয়া—!’

নিজের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখছে বৈদেহী৷ শিউশরণ মার খাচ্ছে! অজস্র লাথি, ঘুসি খেয়ে যাচ্ছে মুখ বুঁজে৷ উন্মত্ত জনগণ পাগলের মতো পেটাচ্ছে তাকে৷ গণধোলাইয়ের ফলে ঠোঁট, কপাল চুঁইয়ে রক্ত পড়ছে! মাথাও ফেটে গিয়েছে বোধহয়৷ সুমন তার পেটে একের পর এক লাথি কষাতে কষাতে বলছে, ‘আমার পা-টা এখন সেক্সি লাগছে না তোর! বাঞ্চোত শা-লা!’

বৈদেহীর চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে৷ ও লোকটার মারই খাওয়া উচিত! জানকীকে সুযোগ পেলেই মেরে পাট পাট করে৷ আজ অন্তত জানুক, মার খেতে কেমন লাগে৷

আচমকা পিছন থেকে একটা জোরালো শব্দ ভেসে এল৷ সে সচকিতে তাকিয়ে দেখে, জানকী মেঝের ওপর জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়েছে!

‘কিচ্ছু হয়নি৷ ন্যাচারাল ফেনোমেনা৷’

ডাক্তারবাবু সহাস্যদৃষ্টিতে একবার জানকীকে, আরেকবার বৈদেহীকে মেপে নিয়ে বললেন, ‘সুখবর আসছে! বাচ্চার বাবাকে বলুন মিষ্টি খাওয়াতে৷’

বৈদেহী স্তম্ভিতের মতো ডাক্তারবাবুর দিকে তাকায়৷ অস্ফুটে বিস্ময়াভিভূত কণ্ঠে বলে, ‘আপনি বলছেন ও—৷’

তার অসম্পূর্ণ কথাটাকে সম্পূর্ণ করে দিলেন ডাঃ সিনহা, ‘প্রেগন্যান্ট৷ সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই৷ আমি নিজের হাতেই আলট্রাসাউন্ড করে দেখে নিয়েছি৷ তবু একবার ইউরিন টেস্ট করিয়ে নিতে পারেন৷’

সে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায় জানকীর দিকে৷ মাতৃত্বের আনন্দে তার মুখে যে অপার্থিব আলো থাকার কথা, সেই লজ্জারুণ আভার বিন্দুমাত্র লেশও নেই! বরং অপরাধীর মতো মাথা হেঁট করে আছে সে৷ রক্তহীন পাণ্ডুর মুখ বুঝি আরও ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে৷ যেন গর্ভে সন্তান নয়, পাপের বোঝা বাড়ছে৷

ওই মুহূর্তে আর কোনও কথা বাড়ায়নি বৈদেহী৷ একটা অস্বাভাবিক নীরবতায় গুম মেরে গিয়েছিল৷ ডাঃ সিনহার ক্লিনিক থেকে শুধু বেরোনোর অপেক্ষা করছিল৷ তার টাকা-পয়সা মিটিয়ে দিয়ে ক্লিনিকের বাইরে পা দিয়েই ফেটে পড়ল সে৷

‘তুই যে বলেছিলি, শিউশরণ কখনও বাপ হতে পারবে না! তার নাকি ক্ষমতা নেই! তবে এই বাচ্চাটা কোথা থেকে এল?’

জানকী মাথা নত করে নিরুত্তর হয়েই থাকে৷ তার চিবুক বুকে ঠেকেছে৷ দৃষ্টি নিজের হাতের আঙুলগুলোর দিকে নিবদ্ধ! তার নিস্তব্ধতার পেছনে যেন কোনও কলঙ্কিত ইতিহাস আছে যা বলার নয়!

জবাব না পেয়ে স্বাভাবিকভাবেই বৈদেহীর ক্ষোভ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়৷ সে প্রায় হিতাহিতজ্ঞান হারিয়েই চেঁচিয়ে ওঠে, ‘তোদের মিয়াঁ-বিবির চরিত্র তো দেখছি সোনায় বাঁধানো! একজন মেয়েদের গায়ে হাত দেয়, অন্যজন কার সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করে পেটে বাচ্চা নিয়ে ঘুরছে কে জানে! এসব আমি কিছুতেই সহ্য করব না৷ সব কিছু সহ্য করা যায়; কিন্তু দুশ্চরিত্র মানুষ নয়! তুই আজকেই সব টাকাপয়সা বুঝে বেরিয়ে যাবি! আর আসার দরকার নেই৷ তোর ওই পোড়া মুখ আমি আর দেখতে চাই না—!’

জানকীর চোখে জল আর রক্ত, দুই-ই জমল৷ যে নারী শিউশরণের শত অত্যাচার মুখ বুঁজে সহ্য করেছে, বৈদেহীর তীব্র অপমানের কোনও জবাব দেয়নি, আজ তারই চোখে যেন জ্বলে উঠল আগুন!

সে একটু চুপ করে থেকে নীচু অথচ রুক্ষ স্বরে, রাগে ও তীব্র ঘৃণায় বলে, ‘কী করে জানব যে দাদা কখনও শাড়ি পরা মেয়েছেলে দেখেনি!’

শীতালি পাখির মতো আবার নিস্তব্ধতা নেমে এল! কিন্তু তা ‘নিস্তব্ধতা হিরণ্ময়’ ছিল না! হয়তো বা প্রলয়ের আগের অখণ্ড নৈঃশব্দ্য!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *