ক্যামোফ্লেজিয়া
১.
হঠাৎ প্রচন্ড জোরে ল্যাবের অ্যালার্ম বেজে উঠলো!
এতক্ষণ ল্যাবরেটরির ভিতরে কোনও আওয়াজ ছিল না। অন্যদিনও বিশেষ থাকে না। শুধু মাঝেমধ্যে টেস্টটিউবের টুংটাং আর বিকারে জল গরম করার খলবল শব্দ অস্ফুট ভাবে শোনা যায়। ভিতরের মানুষগুলো ক্বচিৎ কদাচিত কথা বলে। তাদের কথা বলার সময় কোথায়? সবাই সাদা অ্যাপন পরে কাজ করতেই ব্যস্ত!
আজ সকালেও এমন শান্ত পরিবেশ ছিল। ল্যাবের মুখ্য বিজ্ঞানী ড. হিঙ্গোরানি একটি গোপন আবিষ্কার নিয়ে ব্যস্ত আছেন!ঐ ঘরে সবার প্রবেশ নিষিদ্ধ। একমাত্র ড. হিঙ্গোরানিই প্রাইভেট পাসওয়ার্ড দিয়ে ও ঘর খুলতে পারেন। ব্যাপারটার সাথে ডিফেন্স মিনিস্ট্রি ওতপ্রোতভাবে জড়িত বলেই এত কড়াকড়ি! এত গোপনীয়তা! নতুন আবিষ্কারটা নিয়ে একাই দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। এমনকি আমাকেও সাহায্য করতে দেননি।
আজও প্রায় সকাল আটটায় এসে সোজা ঢুকে গেছেন নিজের ল্যাবে। আর তার প্রধান অ্যাসিস্ট্যান্ট, ড. অনুপম সেন, তথা আমি আমার নিজস্ব কেবিনে বসে কয়েকটা প্রয়োজনীয় রিপোর্ট তৈরি করছি।
এমন সময়ই অ্যালার্মের পরিত্রাহি চিৎকার! ক্যাঁও…ক্যাঁও করে সমস্ত ল্যাবরেটরিকে চকিত করে তারস্বরে বেজে উঠল!
উপস্থিত সবাই চমকে ওঠে! অ্যালার্ম বাজছে কেন? আওয়াজটা সবচেয়ে বেশি জোরে আসছে ড. হিঙ্গোরানির ল্যাব থেকে!
বুকের ভিতরটা প্রায় লাফিয়ে উঠল! কী হল? ড. হিঙ্গোরানির কিছু হল না তো! নতুন আবিষ্কারটা ঠিক আছে…?
তখন কিছু বলার বা ভাবার মতো অবস্থা ছিল না। সবাই ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়েছে ড. হিঙ্গোরানির প্রাইভেট ল্যাবের দিকে! আমার সহযোগী গৌতম উল্টোদিক থেকে পড়িমড়ি করে ছুটে এলো। বেচারা অ্যালার্মের শব্দে ঘাবড়ে গেছে। হাঁপাতে হাঁপাতে এসে কোনমতে বলে– স্যার…! কী হল? অ্যালার্ম বাজছে…!
কোনমতে উত্তর দিই–জানি না।
–ড. হিঙ্গোরানি… সে ভয়ার্ত ভাবে বলে–ওনার ঘরেই তো অ্যালার্ম বাজছে মনে হয়…
প্রায় দৌড়তে দৌড়তেই জবাব দিলাম–হ্যাঁ, চলো শিগগিরি…দেখি কী হল,..
অন্যান্য দিন ডক্টরের প্রাইভেট ল্যাবের লোহার দরজা পাসওয়ার্ড সিস্টেমে বন্ধ থাকে! আজও তেমনই থাকার কথা। কিন্তু দরজায় হাত রেখেই এক নতুন ট্রেনি গবেষকের ভুরু কুঁচকে গেল।
–ড. সেন… সে একটু ভয় পেয়ে পিছিয়ে এসেছে। তার কণ্ঠস্বরে বিস্ময়–দরজাটা খোলা!
দরজা খোলা! ভাবাই যায় না! এই দরজা দিনে দুবারই খোলে। যখন ড. হিঙ্গোরানি ল্যাবে ঢোকেন তখন একবার, আর যখন বেরিয়ে যান সেফ তখন! এর মধ্যে ল্যাবের দরজা কোনমতেই খোলা সম্ভব নয়! এ দরজা শুধু পাসওয়ার্ডে খোলে।
আর পাসওয়ার্ড ডক্টর নিজে ছাড়া আর কেউ জানে না!
কিছু গোলমাল হয়েছে…কী ঘটেছে জানি না…কিন্তু সেই মুহূর্তে একটা ভীষণ অমঙ্গলের ছায়া সবার মুখেই ছাপ ফেলে সরে সরে যাচ্ছিল।
–ড, সেন…স্যার, আপনি দেখুন। গৌতম ফিসফিস করে বলে–আমি সাহস পাচ্ছি না!
সাহস তো আমিও পাচ্ছিলাম না! দরজাটা খোলা দেখেই ভয়ে ঘামছি। ভিতরে রয়েছেন ডক্টর আর তার গোপনীয় ও অমূল্য আবিষ্কার! ঘরে ঢুকে কী দেখবো সেই আশঙ্কায় কাঁটা হয়েছিলাম। তবু…কাউকে তো এগোতেই হবে…!
ভিতরে তখনও ফুলদমে এসি চলছে! চিলড এসির স্পর্শে শরীর ছ্যাঁৎ করে উঠল। চতুর্দিকে সারসার সাজানো কেমিক্যালের শিশি। কাঁচের বাক্সে রাখা স্পেসিমেন। কোনটা কেমিক্যালে ডোবানো। কোনটা আবার এমনিই রাখা!
–ড. হিঙ্গোরানি…ড-ক্ট-র…।
কোন সাড়া নেই! ল্যাবের ভিতরের টিউবটা শুধু দপদপ করে জ্বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু পুরোপুরি জ্বলছে না। থেকে থেকে জ্বলছে নিভছে।
আমরা গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেলাম ভিতরের দিকে। ডানদিকে আর বাঁদিকে বইয়ের সেলফ। বইগুলো এলোমেলো ভাবে পড়ে! যেন ওগুলোর উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে!
অথচ এমন হওয়ার কথাই নয়। ডক্টর ভীষণ গোছালো প্রকৃতির। বিশেষ করে বইয়ের যত্ন নেওয়ার ব্যাপারে তিনি ভীষণ খুঁতখুঁতে। তার ব্যক্তিগত লাইব্রেরির একটু অযত্ন হলেই আমায় পাঁচ কথা শুনিয়ে ছাড়েন। কোন বইয়ের পাতা সামান্য ছেঁড়া দেখলেই সারা অফিস মাথায় তোলেন।
সেই লোকের ঘরে বইয়ের এই অবস্থা!
–ডক্টর……ডক্টর হিঙ্গোরানি…স্যা–র…!
–অ-নু-প-ম!
এবার উত্তর এলো। কিন্তু একদম অস্বাভাবিক উত্তর! ডক্টরের কণ্ঠস্বর শুনেই বুঝেছিলাম কিছু একটা হয়েছে। আরেকটু এগিয়ে যেতেই যা চোখে পড়ল তা দেখে আঁৎকে উঠি……
ডক্টর প্রায় বেহুঁশের মতন পড়ে আছেন মাটিতে। মাথা ফেটে গলগল করে রক্ত পড়ছে।…
–স্যার…স্যার…।
ব্যাকুল হয়ে তাকে ধরে কোনমতে তোলার চেষ্টা করি। ডক্টর নির্জীবের মতো আমার বুকের উপর এলিয়ে পড়লেন। প্রায় সর্বহারার মতো আঙুল তুলে সামনের কাঁচের বাক্সটা নির্দেশ করলেন–ঐ দে–খো!
কী সর্বনাশ! বাক্সটা ফাঁকা! সেখানে ক্যামোফ্লেজিয়া নেই!
.
২.
–ক্যামোফ্লেজিয়া মিসিং? হাউ ক্যান ইটস পসিবল?
মন্ত্রীর ভুরু দুটো ঠিক শুয়োপোকার মতন দেখাচ্ছিল! মুখে চিন্তার ছাপ প্রকট।
–আমি জানি না। ক্লান্ত স্বরে বলছিলেন ড. হিঙ্গোরানি। মাথায় তিনটে স্টিচ নিয়ে তাকে আরও ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। ব্যান্ডেজ করা কপালে হাত রেখে চুপ করে বসেছিলেন।
–কীভাবে এরকম হয়? এরকম গুরুত্বপূর্ণ একটা আবিষ্কার! রেগে গিয়ে বললেন মন্ত্রী–আপনাদের সুরক্ষাপ্রণালীই কাঁচা! এবার আমি উপরমহলকে কী জবাব দেব?
অনেক যুক্তি দিয়েও কিছুতেই তাকে বোঝানো গেল না যে ক্যামোফ্লেজিয়াকে যথেষ্ট কড়া নজরেই রাখা হয়েছিল। ড. হিঙ্গোরানির সুরক্ষা ব্যবস্থা প্রায় নিশ্ছিদ্রই বলা যায়। তা সত্ত্বেও দুষ্কৃতী কোথা দিয়ে ঢুকল তা বুঝতে পারছি না কেউই।
–এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার! তিনি আরও চটে গিয়ে বলেন– ডিফেন্স মিনিস্ট্রি কয়েক কোটি টাকা ঢেলেছে এটার পিছনে। ড. হিঙ্গোরানি, আপনার কাছ থেকে এটা আশা করিনি।
–হ্যাং ইওর কয়েক কোটি টাকা! এবার ডক্টরের ধৈর্যও জবাব দিয়েছে– আপনি কয়েক কোটি টাকা দেখছেন? কয়েক কোটি মানুষের কথা ভাবছেন না? ওটা কোনও সাধারণ জিনিস নয়। দ্যাট ইজ আ মার্ডার ওয়েপন। আ ভেরি ডেঞ্জারাস ব্লাডি মার্ডার ওয়েপন…এত কোটির দেশে সেটা একবার বাইরে পড়লে কেউ বাঁচবে না। নট আ সিঙ্গল ওয়ান……বুঝেছেন?
.
মন্ত্রী কটমট করে ডক্টরের দিকে তাকাচ্ছেন–জানি। তাই তদন্ত দরকার। এভাবে ওটাকে বাইরে ছেড়ে দিতে পারি না আমরা। এ চোর জানে যে জিনিসটা কোথায় রাখা ছিল। আপনার পাসওয়ার্ড ভেঙে সে ঘরে ঢুকেছে, অথচ এখানকার কোনও স্টাফ, সিকিউরিটি গার্ড কোনও অপরিচিত ব্যক্তিকে ঢুকতে বা বেরোতে দেখেন নি।
সবাই একসঙ্গে মাথা নাড়ল।
–তাহলে সে কোন বাইরের কেউ নয়। ঘরেরই লোক। এই ল্যাবেরই কোন কর্মী। মন্ত্রীজি আমাদের সবার দিকে রক্তচক্ষু করে তাকালেন–আপনারই কোন লোক!
একেই অমন মারাত্মক জিনিসটা চুরি যাওয়ার আতঙ্ক তো ছিলই। তার উপর আবার নতুন আপদ জুটল! সন্দেহ!
ক্যামোফ্লেজিয়া জিনিসটা বারদুয়েক স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। একটা সামান্য ঘাসফুলের মতো দেখতে জিনিসটাকে। কেউ দেখলে ভাববেই না যে জিনিসটা অমন মারাত্মক!
ঘাসফুলের একটি প্রজাতির জেনেটিক কোড বেক করে বিশেষভাবে ডিএনএ তৈরি করার পর ক্যামোফ্লেজিয়া জন্মেছে। মূল ফর্মুলাটা গুপ্ত। ড. বিবেক টোডি, ড. হিঙ্গোরানি ও ড. সুকুমার বসু ছাড়া আর কেউ জানে না। জিনিসটা তৈরি হওয়ার পর একঝলক দেখেছিলাম। সাদা ধবধবে ছোট্ট একটা ফুল। ঘাসফুলই বলা যায়। কিন্তু তিন বৈজ্ঞানিক বলেছিলেন যে, যতই নিরীহ হোক না কেন–এ ফুল মারাত্মক। এ ফুলের গন্ধ এতটাই বিষাক্ত যে একটা ফুলই দশটা মানুষ মারার পক্ষে যথেষ্ট। অ্যাকোনিটামের বিষাক্ত ডিএনএ-র সাথে মিলিয়ে যেহেতু তৈরি তাই এর গন্ধে অ্যাকোনাইটের মত মারাত্মক বিষ আছে! একবার নাকে গেলে রক্ষা নেই। কোমা অবধারিত! এবং পরে মৃত্যু।
ক্যামোফ্লেজিয়ার সবচেয়ে মারাত্মক বৈশিষ্ট্য যে এটি রঙ পাল্টাতে পারে! এটা কী করে করলেন তিন বৈজ্ঞানিক তা জানা যায়নি। কিন্তু ক্যামোফ্লেজিয়ার ডেমোনস্ট্রেশনের সময়েই দেখেছি যে এই ফুলটা অদ্ভুতভাবে রঙ পাল্টায়!
প্রথমবার যখন দেখি তখনই প্রায় চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গিয়েছিল! ভাবতেই পারিনি যে এমনও হতে পারে! ডেমোনস্ট্রেশনের আগেই কনফারেন্স হলে উপস্থিত ছয় দর্শককে গ্যাস মাস্ক পরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যাতে নাকে গন্ধ না যায়! সেই ছ’জনের মধ্যে আমিও ছিলাম। বাকি পাঁচজন ডিফেন্স মিনিস্ট্রির হোমরা চোমরা।
দর্শকাসনে বসেই বিস্ফারিত চোখে দেখলাম ড. হিঙ্গোরানি একটা গিনিপিগের বাক্সে ক্যামোফ্রেজিয়া রেখে দিলেন! এক মিনিটও লাগল না! গিনিপিগগুলো পটাপট মরে গেল!
শুধু এইটুকুই নয়, ডক্টর ফুলটা হাতে তুলে নিয়ে তার পেছনে একের পর এক রঙের জিনিস রাখতে লাগলেন। কখনও ব্যাকগ্রাউন্ডে কালো, কখনও নীল, কখনও লাল!
আমরা বোকার মতো হাঁ করে দেখলাম ব্যাকগ্রাউন্ডের সাথে মিলিয়ে মিলিয়ে রঙ পাল্টাচ্ছে ক্যামোফ্লেজিয়া! একদম মিশে যাচ্ছে পেছনের জিনিসটার সাথে!
এ এক অদ্ভুত অস্ত্র। একরাশ যে কোন ফুল, গাছ বা অন্যকিছুর মধ্যে একটা রেখে দিলে সেটাকে কেউ আলাদা করে চিনতেই পারবে না। রঙ পালটিয়ে সে মিশে যাবে পিছনের বস্তুটির সাথে। এবং সেখান থেকেই বিষ মাখা সুগন্ধ দিয়ে যাবে এই অদৃশ্য ফুল। তার সামনে বসে থাকা হতভাগা জীবটি বুঝতেও পারবে না যে কখন তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ছদ্মবেশী শমন! বোঝার আগেই শেষ!
ডিফেন্স মিনিস্ট্রির লোকেরা উঠে দাঁড়িয়ে অভিনন্দন জানিয়েছিল ডক্টরকে। কিন্তু আমি ভয় পেয়েছিলাম! ভেবেছিলাম–এইরকম ভয়ঙ্কর অথচ নিরীহ চেহারার মারণাস্ত্র তৈরি করে কি সর্বনাশই না করলেন ডক্টর! কত নিরীহ মানুষের প্রাণ নেবে এই সাধারণ চেহারার ছদ্মবেশী ফুল, ক্যামোফ্লেজে সিদ্ধহস্ত–ক্যামোফ্লেজিয়া!
.
কিন্তু ডিফেন্স মিনিস্ট্রির কাছে হস্তান্তরিত হওয়ার আগেই লোপাট হয়ে গেল। ক্যামোফ্লেজিয়া। সঙ্গে সঙ্গেই গোপনে চলল কড়া তদন্ত। আমাদের সবার বাড়ি তোলপাড় করে সার্চ করা হল। কিন্তু কারুর বিরুদ্ধেই কিছু পাওয়া গেল না।
তখন অন্য রাস্তা ধরল প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। প্রতিটা দূতাবাসে খোঁজ রাখল, সন্দিগ্ধ ব্যক্তিদের ফলো করল। সেখানেও কিছুই পাওয়া গেল না। শুধু একটা ব্যাপারে আশ্বস্ত হল তারা। ক্যামোফ্লেজিয়া যে চুরি করেছে, সে সেটা অন্য কোনও দেশকে বিক্রি করার জন্য চুরি করেনি। হয়তো তার অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে।
কিন্তু কী?
.
৩.
উদ্দেশ্যটা বুঝতে অবশ্য একসপ্তাহও সময় লাগল না!
প্রথমেই মারাত্মক কার্ডিয়াক অ্যাটাকে মারা গেলেন ড. বিবেক টেডি!
তখনও ব্যাপারটাকে অস্বাভাবিক কিছু মনে হয়নি। হৃদযন্ত্রের সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। বয়েসও হয়েছিল। তার উপর ডাক্তারদের বারবার বারণ করা সত্ত্বেও অ্যালকোহলের নেশাকে অতিক্রম করতে পারছিলেন না। তাই তার মৃতযুটা খুব আশ্চর্যজনক কিছু নয়। দুঃসংবাদটা শুনে আঘাত পেয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু বিস্মিত হইনি।
কিন্তু ড. সুকুমার বসুও যখন হঠাৎ একদিন তার বাড়িতেই পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন, তখন ব্যাপারটা চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়াল। ড. বসুকে নার্সিংহোমে ভর্তি করা হলে ডাক্তাররা বলল যে তিনি কোমায় আছেন। সাইনাস ট্যাকিকার্ডিয়া এবং সঙ্গে ভয়ানক ভেন্ট্রিকলার অ্যারিদমিয়াস।
এই সবগুলো লক্ষণ শুনেই বুকের ভিতরটা কেমন কেমন করতে লাগল। এর সবকটাই অ্যাকোনিটামের লক্ষণ! মন বলতে লাগল–এ ঠিক সমাপতন নয়! এর পিছনে গুরুতর কোন চক্রান্ত আছে। ক্যামোফ্লেজিয়ায় অ্যাকোনিটামের পার্সেন্টেজ যথেষ্ট!
প্রথম মৃত্যুটাকেও তখন আর স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছিল না আমাদের। ড. বিবেক টোডি ও ড. বসু–দুজনেই এমন মারাত্মকভাবে হৃদযন্ত্রের অসুখে আক্রান্ত হলেন! তাও মাত্র তিনদিনের ব্যবধানে! কী করে হতে পারে? এ কি নিতান্তই কাকতালীয়? না অন্য কিছু? দুজনেই ক্যামোফ্লেজিয়ার আবিষ্কারে যুক্ত ছিলেন। এই দুজন আর ড. হিঙ্গোরানি–এই তিনজনই তার জন্মদাতা। মূল ফর্মুলাটা এরাই জানেন। তারপর আর কেউ যদি সামান্য কিছুও জেনে থাকে, সে আমি! প্রথম তিনজনকে সরিয়ে দিতে পারলে এই মারাত্মক অস্ত্রটি দ্বিতীয়বার আর আবিষ্কৃত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। সেক্ষেত্রে যে চুরি করেছে, তার কাছে ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যাবে না ক্যামোফ্লেজিয়ার নমুনা! সমস্ত বৈদেশিক শক্তি, তার সাথে ভারতও টাকার থলে নিয়ে তার পেছনে অসহায়ের মত ছুটবে।
বেশ বুঝতে পারছি যে এ আমাদের মধ্যেই কারুর কীর্তি। কিন্তু কে? কে হতে পারে? এখানে প্রথম তিনজনের পরই আমার স্থান। আমি নই। তবে? গৌতম…?
কয়েকদিন গৌতমকে খুব চোখে চোখে রাখলাম। কিন্তু তেমন কিছুই চোখে পড়ল না। সে স্বাভাবিকভাবেই কাজ করছে। এবং যতদূর জানি এতবড় দুঃসাহসিক কাজ করার সাধ্যও তার নেই। সত্যি বলতে, এ অফিসের কারুর আদৌ আছে কিনা সন্দেহ!
তবু কেন জানি না কাউকেই বিশ্বাস করতে পারছি না। যাকেই দেখছি, মনে হচ্ছে, এই সে নয় তো!
থাকতে না পেরে একদিন ড. হিঙ্গোরানিকে কথাটা বলেই ফেললাম। মনে হচ্ছিল স্যারকে সতর্ক করাটা সত্যিই দরকার।
ড. হিঙ্গোরানির টেবিলের উপর একটা ফুলের বোকে রাখা ছিল। সম্ভবত গোলাপ ফুলের। তিনি আমায় একটা গ্যাস মাস্ক এগিয়ে দিয়ে বলেন–পরে নাও অনুপম, গোলাপের গন্ধে তো তোমার আবার মারাত্মক অ্যালার্জি হয়। এইমুহূর্তে তুমিই আমার ডানহাত। তুমি অসুস্থ হয়ে পড়লে মুশকিল।
গোলাপের গন্ধে সত্যিই আমার ভয়াবহ অ্যালার্জি। তাই বিনাবাক্যব্যয়ে গ্যাস মাস্ক পরে নিই।
–হ্যাঁ, বলো কি বলছিলে?
নিজের থিওরি ও সন্দেহের কথা স্পষ্ট করেই বললাম। শুনতে শুনতে ভুরু কুঁচকে গেলো তাঁর। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেমে থেকে বললেন–তোমার সন্দেহ সঠিক কিনা জানি না। ড. বসু এখনও কোমায়। কিন্তু দুজনের ক্ষেত্রেই অ্যাসফিক্সিয়া বা অক্সিজেন ডেফিশিয়েনসির লক্ষণ দেখা গেছে। তোমার কথা। উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
–সেক্ষেত্রে স্যার, আপনার সাবধান হওয়া উচিৎ।
তিনি সরু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকান–শুধু আমারই নয়, তোমারও সাবধানে থাকা উচিৎ অনুপম।
–আমি! অবাক হয়ে বলি–কিন্তু আমি তো খুব অল্পই জানি এ সম্বন্ধে!
–সে তো তুমি আর আমি জানি। ডক্টর শান্তভাবেই বললেন–কিন্তু যার মাথায় একাই ঐ আবিষ্কারের পেটেন্ট নেওয়ার দুর্বুদ্ধি ঘুরছে সে তো জানে না। তুমি আমার মেইন অ্যাসিস্ট্যান্ট। ডানহাত যাকে বলে। আমার পরে তোমারই তো সব জানার কথা। পুরোটা না জানলেও অল্পবিস্তর তো জানোই। তোমায় ছেড়ে দেওয়ার ঝুঁকি কি সে নেবে?
এ কথাটা আগে মাথায় আসেনি। ড. হিঙ্গোরানি বলার পর মেরুদণ্ড বেয়ে যেন একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। সত্যিই তো!
–এসব নিয়ে মাথা ঘামিও না অনুপম। তিনি সহজভাবেই বলেন– এটা সেফ একটা কো-ইনসিডেন্স, আই হোপ।
আই হোপ–শব্দটার মধ্যে তেমন জোর পাওয়া গেল না!
উনি যত সহজে ব্যাপারটা উড়িয়ে দিলেন,আমি কিন্তু তা পারলাম না।
ওনার বলা শেষ কথাগুলো বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল। সত্যিই তো! আমাকেও কি ছাড়বে ঐ অজানা আততায়ী? ড. টোডি, ড. বসু ও ড. হিঙ্গোরানির পর তো আমিই একমাত্র মানুষ যে ক্যামোফ্লেজিয়া সম্পর্কে সামান্য হলেও খবর রাখে। অন্তত ক্যামোফ্লেজিয়াটা আমি স্বচক্ষে দেখেছি। দেখেছি সেটা কীভাবে কাজ করে। তার সাথে এ ও জানি যে জিনিসটার এফেক্ট মানব শরীরে কী হয়, সিম্পটমগুলো ও মিক্সড ভেনামের নামটাও জানি।
গাড়িতে যেতে যেতেই বারবার কথাগুলো মাথার মধ্যে ঘুরছিল। বাড়িতে পৌঁছেও দুশ্চিন্তাটা মাথা থেকে গেল না।
আমার বাড়িটা বেশ বাংলোবাড়ির মত করে সাজিয়েছি। ছোট্ট সুন্দর লালটালি বসানো দোতলা বাড়ি। লাল টালিগুলো আমারই পছন্দ করে কেনা। সামনে ছোট্ট একটা বাগান। মালির যত্নে বেশ ঝকঝকে চকচকে হয়ে উঠেছে। বোগেনভিলিয়ার ঝাড়ে, নানান বিদেশী ফুল, লতায়, মশে রঙিন হয়ে উঠেছে! ভেলভেটের মতো ঘাসের সবুজ রঙে পান্নার ঔজ্জ্বল্য! দুদিকে দুটো ঝাউগাছ মালির যত্নে একদম নিখুঁত আকারে রাজার মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে।
রোজ বাড়িতে ঢোকার সময়ে এই বাগানটার দিকে তাকালেই মন ভালো হয়ে যায় আমার। কিন্তু আজ…
আজ ভয় হল!
.
কে বলতে পারে, এই বাগানেই কেউ একটা ক্যামোফ্রেজিয়া রেখে যায় নি। ডক্টর হিঙ্গোরানির কাছে এ ও শুনেছি যে এই স্পেশিজটা খুব তাড়াতাড়ি বংশবৃদ্ধি করে। মাত্র একসপ্তাহের মধ্যেই সে প্রায় একটা গোটা ব্যাটেলিয়ন তৈরি করে ফেলতে পারে। অসম্ভব শক্তিধর এই আবিষ্কার!
কোনওদিন এত খুঁটিয়ে বাগানটাকে দেখিনি। আজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলাম। নাগ কেশরের ঝাড় রীতিমতো ফুলেফেঁপে উঠেছে। পাশে স্পাইনি অ্যাকান্থাস আর ফায়ারস্পাইক ফুটে রয়েছে। ইচ্ছে ছিল অ্যান্থোনিয়ামও রাখবো গ্লাসহাউস করে। কিন্তু ফুলগুলো বাঁচেনি।
আমার গোলাপের গন্ধে অ্যালার্জি। তাই গোলাপের কোনও প্রজাতিকেও রাখিনি। এছাড়া আরও বিভিন্ন ফুলে, গোলাপি, হলুদে, লালে জমকালো হয়ে উঠেছে আমার বাগান।
আজ ফুলের সৌন্দর্য দেখার মানসিকতা ছিল না। আমার সন্ধানী চোখ। আঁতিপাতি করে খুঁজছিল রঙীন ফুলের মধ্যে একটা ছোট্ট বিশেষ ফুলকে। রঙের বিষয়ে সঠিক ভাবে বলা মুস্কিল। হয়তো সে পুরোপুরি বেগুনী হয়ে মিশে গেছে। ডেজার্ট পিটুনিয়ার ভিড়ে। অথবা গোলাপি হয়ে আইসপ্ল্যান্টের মধ্যে চুপ করে লুকিয়ে বসে আছে। কিছু বলা যায় না…কিচ্ছু বলা যায় না……! ক্যামোফ্লেজিয়ার পক্ষে সবই সম্ভব!
প্রায় গরুখোঁজা খুঁজতে খুঁজতেই হঠাৎ চোখে পড়ল ঘাসের ফাঁকে ছোট ছোট সাদা ফুল!
ঘাসফুল! না…..
টের পেলাম হঠাৎ করেই বুকের ভিতরটা কেমন শুকিয়ে যাচ্ছে। এতগুলো ঘাসফুল কবে আমার বাগানে ফুটল? আগেই ফুটেছিল? না এখন……? আজকেই…?
–প্রতাপ…প্র-তা-প!
নিজের কণ্ঠস্বরকেই আর তখন চিনতে পারছি না। গলা দিয়ে প্রায় আওয়াজ বেরোচ্ছিল না। তাই চেঁচিয়ে ডাকতে গিয়ে নিজের কানেই নিজের গলা ভীষণ কর্কশ শোনালো!
আমার তারস্বরে চিৎকার শুনে প্রতাপ প্রায় দৌড়তে দৌড়তে আসে। আমায় এইভাবে চেঁচাতে ও আগে কখনও দেখেনি। রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়েই সে ছুটে এসেছে।
— স্যার,… সে আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। এত ফুলের ভিড়ে দাঁড়িয়ে তার স্যার কেন অমন আর্তনাদ করছেন তা বোধহয় বুঝে উঠতে পারেনি।
–এগুলো কী? আমি তখন ঘামছি। কোনমতে আঙুল তুলে ছোট ছোট সাদা ফুলগুলোকে দেখাই।
সে অবাক–ঘাসফুল স্যার!
–ঘাসফুল! কী করবো ঠিক করতে না পেরে ওর উপরই রেগে যাই–এ বাগানে ঘাসফুল কেন?
–স্যার… প্রতাপ থতমত খেয়ে কিছু বলতে যায়। কিন্তু তার আগেই ওকে থামিয়ে দিয়েছি–এখুনি কেটে ফেলো। এক্ষুনি… ইমিডিয়েটলি… এখানে আর একটাও ঘাসফুল দেখতে চাই না আমি।
ভ্যাবলার মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সে মাথা নাড়ল।
–আর…হ্যাঁ…ও গুলো হেঁটে ফেলার আগে মুখে মাস্ক পরে নেবে। নাকে যেন গন্ধ না যায়। বুঝেছ?
আমি আর ওখানে দাঁড়াই না। মোরাম বিছানো পথ দিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে দেখি, প্রতাপ কিছুক্ষণের জন্য হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর এককোণের স্টোররুম থেকে কাটারি নিয়ে এলো। আমার কথা অবজ্ঞা করেনি। গামছা দিয়ে নাক মুখ পেঁচিয়ে বেঁধেছে।
স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল। প্রতাপ কী ভাবল কে জানে। হয়তো ভাবল স্যারের মাথায় ছিট! যাই ভাবুক। ঐ ফুলগুলো তো আর ওখানে থাকবে না!
.
ঘরের তালা খুলে ভিতরে ঢুকতেই একটা ভ্যাপসা গন্ধ! সবসময় বন্ধ থাকলে যা হয় আর কি! সকালে চাউমিন খেয়ে বেরিয়েছিলাম। তার সসের গন্ধ এখনও নাকে ঝাপ্টা মারছে।
ভীষণ বিরক্ত লাগল। আমার কাজের লোক–মদন, এক নম্বরের ফাঁকিবাজ! আমিও বেরিয়েছি, অমনি সেও জানলা দরজা বন্ধ করে পাড়া ঘুরতে বেরিয়েছে। দিনভর খালি এখানে-ওখানে টো টো করে ঘুরে বেড়ায়। অবশ্য আমার ফেরার আগেই সচরাচর ফিরে আসে।
আজ তাড়াতাড়ি চলে এসেছি। ফলস্বরূপ মদনের দেখা নেই!
অগত্যা আপনা হাত-জগন্নাথ! প্রথমেই জানলাগুলো সব খুলে দিলাম। তাকের উপর রুমফ্রেশনারটা ছিল। স্প্রে করতে গিয়ে দেখি ফসফস আওয়াজ হচ্ছে! ওটা শেষ!
এমন সময়ই শেষ হতে হল! বাধ্য হয়েই আমার দামী পারফিউমটা স্প্রে করে দিলাম। অন্তত এই অসহ্য ভ্যাপসা গন্ধটা তো যাবে! মনে মনে তখন মদনের পূর্বপুরুষের শ্রদ্ধ করে চলেছি। আশ্চর্য! রুমফ্রেশনারটা যে শেষ হয়ে গেছে, সেটাও তার খেয়াল নেই। নতুন কিনে আনা তো দূর! এত টাকা দিয়ে ওকে রেখেছি কেন আমি? পরের বাড়ির ঝিয়ের সাথে গল্পগুজব করার জন্য?
মনে মনে গরম হয়ে উঠি। একবার ফিরুক হতভাগা–তারপর ওর হচ্ছে!
ভীষণ খিদে পেয়েছিল। তাড়াতাড়ি কোনমতে গায়ে দু মগ জল ঢেলে এলাম। শরীর আর মাথা তো ঠাণ্ডা হল। কিন্তু পেটের ভিতরে ইঁদুরের রেস চলছে! মদন কখন ফিরবে তার ঠিক নেই। তাই নিজের হাত পুড়িয়েই কিছু বানিয়ে নিতে হবে। ফ্রিজে হয়তো এক দু টুকরো বেড এখনও আছে। তার সাথে ডিমের একটা ওমলেট আর চা যথেষ্ট!
রান্নাঘরে ঢুকে বুঝলাম যে কাজটা যতটা সহজ মনে হচ্ছিল, ঠিক ততটা নয়। ফ্রিজ থেকে পাঁউরুটি আর ডিম উদ্ধার করা গেলেও চায়ের পাতা, চিনি কোথায় রাখা থাকে কিছুই জানি না! তাকের উপর সারিসারি শিশি। তার কোনটায় চিনি, কোনটায় নুন, কোনটায় কি, সেসব সম্পর্কে কোন জ্ঞানই নেই। নিজের কিচেনের চেয়ে বরং ল্যাবরেটরিটা আমার কাছে অনেক বেশি চেনা!
প্রায় অসহায়ের মতই তন্ন তন্ন করে খুঁজছি সব উপকরণ। খুঁজতে খুঁজতেই রান্নাঘরের ঠিক জানলাটার সামনে এলাম।
ঠিক তখনই…
.
…একটা অদ্ভুত মিষ্টি গন্ধ নাকে এলো!
অদ্ভুত মিষ্টি একটা গন্ধ!…এমন গন্ধ তো আগে কখনও পাইনি! কেমন যেন নেশা ধরানো সুবাস…।
আমার ইন্দ্রিয়গুলো সব সতর্ক হয়ে উঠল। এটা কিসের গন্ধ?…রান্নাঘরের জানলা দিয়ে ফুরফুর করে হাওয়া আসছে। তার সাথে সাথেই গন্ধটা ঝাপ্টা মেরে ঢুকে পড়ছে। খুব তীব্র নয়…কিন্তু…
ক্যামোফ্লেজিয়ার গন্ধ কেমন তা জানি না। ডেমোনস্ট্রেশনের সময়ে নাকে মাস্ক পরেছিলাম। কিন্তু শুনেছি গন্ধটা মিষ্টি।…
গন্ধটা কি এইরকম?…কিসের গন্ধ এটা…?…ক্যামোফ্লেজিয়া…?
–প্রতাপ..প্র–তা–প!
প্রায় মৃত্যুভয়েই আর্তচিৎকার করে উঠেছি। বুকের ভিতরটা কেমন কেমন করছে। একটা বিরাট টারবাইনের মতো ধপ ধপ করে চলছে! ভীষণ রকমের আকুলি বিকুলি! বোধহয় এখনই হার্টফেল করবো…আর সময় নেই…সেই মারাত্মক মারণাস্ত্র আজ আমায় শেষ করেই ছাড়বে!
–স্যার…স্যার…
প্রতাপ বোধহয় ঘাসফুল পরিষ্কার করতেই ব্যস্ত ছিল। চিৎকার শুনে কাটারি হাতেই ব্যস্তসমস্ত হয়ে ছুটে এসেছে।
–কী হয়েছে স্যার…?
ভয়ে গলা কাঁপছে। কোনমতে বললাম–ওটা কীসের গন্ধ?
প্রতাপ জোরে জোরে বেশ কয়েকবার নিঃশ্বাস নিয়ে গন্ধটা শুকল। আমি প্রায় দমবন্ধ করে রেখেছি। কিছুতেই ওই বিষ নিঃশ্বাস নেবো না আমি…কিছুতেই না!
–ওঃ… সে গন্ধটা অনুধাবন করেই হেসে ফেলেছে–এটা তো জুঁইফুলের গন্ধ।
–জুঁইফুল! আমি নিঃসন্দেহ হতে পারি না। কে বলতে পারে– ক্যামোফ্রেজিয়ার ডিএনএ গঠনে হয়তো উঁইফুলের অবদানও আছে! হয়তো তার গন্ধটা উঁইফুলের মতোই!
–জুঁইফুলের গন্ধ! এখানে সুঁইফুলের গন্ধ কোথা থেকে আসবে?
প্রতাপ আমার অবস্থা দেখে অবাক হয়। আস্তে আস্তে বলে–আপনার মনে নেই স্যার? আপনিই তো চারাগাছটা নিয়ে এসেছিলেন। বাগানে জায়গা ছিল না বলে রান্নাঘরের পিছনেই লাগিয়েছিলাম আমি…
–কেটে ফেলো।
সে বোধহয় আমার কথার মাথামুণ্ডু বুঝতে পারল না। কেমন বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে আছে। বোধহয় বুঝতে পারছে না যে কি করবে।
–একদম গোড়া থেকে কেটে ফেল। আমি জোরালো গলায় বলি– ছুঁইফুলের গাছ চাই না আমার। একদম উপড়ে ফেল। এই গন্ধ যেন আর আমি না পাই।
সে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে।
–ঘাসফুলগুলো সব ঘেঁটে দিয়েছ?
–হ্যাঁ।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি–ঠিক আছে…এটাকেও…
–ঠিক আছে স্যার।
প্রতাপের মুখ বিষণ্ণ। বাগানের প্রত্যেকটা ফুল, গাছ তার বড় প্রিয়। বড় যত্নে, প্রায় সন্তানের মতো করেই সে বড় করে তুলেছে প্রত্যেকটা গাছ। আর আজ তাকেই আমি সেগুলো কেটে ফেলার নির্দেশ দিচ্ছি!
মনে হল ওকে কষাই এর কাজ দিয়েছি। একবার মনে হল ডেকে বারণ করে দিই। পরক্ষণেই মনকে বোঝাই…।…কেউ বলতে পারে না…কেউ বলতে পারে না…হয়তো এই নিরীহ ফুলের মধ্যেই নিরীহতর মুখ করে বসে আছে ক্যামোফ্লেজিয়া! আমায় শেষ করার মতলবে বিষ সৌরভ ছড়াচ্ছে!
.
তখনও হাত পা কাঁপছিল। কোনমতে আবার বসার ঘরে ফিরে আসি। আজ আর রান্না করার মতো অবস্থা নেই। কোনমতে শুকনো পাঁউরুটি আর জল খেয়েই চালাতে হবে।
কিছুক্ষণ বসে থাকার পর মনে হল একটু ধাতস্থ হয়েছি। আস্তে আস্তে উঠে ল্যাপটপটাকে নিয়ে এলাম। অনেক কাজ পড়ে আছে। ড. হিঙ্গোরানির জন্য কিছু প্রোজেক্ট রিপোর্ট তৈরি করতে হবে। ডক্টর কাজে গাফিলতি একদম বরদাস্ত করেন না।
ফ্রিজে নতুন একটা হুইস্কির বোতল ছিল। আমি সচরাচর খুব টেনস না হলে ড্রিঙ্ক করি না। কিন্তু আজ একটা ড্রিঙ্ক নিজেই বানিয়ে নিয়েছি। যে অবস্থায় আছি তাতে একটু অ্যালকোহল পেটে না পড়লে কাজ হবে না।
ল্যাপটপে একমনে কাজ করতে করতে মগ্ন হয়ে গিয়েছিলাম। কখন যে বাইরে ঘন অন্ধকার নেমে এসেছে তা খেয়াল নেই। হুইস্কির প্রভাবে হোক, বা অন্য যে কোনও কারণে, ক্যামোফ্লেজিয়ার কথা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। হুঁশ ফিরল মদনের ডাকে–
–বাবু!
আগে ভেবেছিলাম ও এলে একচোট বকাবকি করব। কিন্তু এখন সে ইচ্ছেটা আর টের পেলাম না।
–আপনি আজ তাড়াতাড়ি ফিরেছেন! সে একহাত জিভ কাটে– কিচু খান নি নিশ্চই!
আমি শান্ত গলায় বলি–খেয়েছি।
সে আবার জিভ কাটল। কার উদ্দেশ্যে কে জানে–রাত্তরে কী খাবেন বাবু?
–রুটি কর। একটু ভেবে জবাব দিই–আর ডিম কষা হলেই চলে যাবে।
–আচ্চা। ও চলে যাচ্ছিল। আমি পিছন থেকে ডাকি– শোন…
–হ্যাঁ বাবু।
–রুম ফ্রেশনারটা শেষ হয়ে গেছে। দোকান থেকে একটা নিয়ে আসিস্।
–অকে…।
‘অকে’ টা ‘ওকে’ এর মদনীয় সংস্করণ। আমাকে প্রায়ই ‘ওকে’ বলতে শোনে। সেখান থেকেই রপ্ত করেছে।
মদন চলে গেল রান্নাঘরে। আমি আবার কাজে মন দিলাম। প্রোজেক্ট রিপোর্ট শেষ করতে করতেই রাত দশটা বাজল। তারপর কয়েকটা ই-মেল পাঠালেই আজকের মতো কাজ শেষ!
ঘড়িতে ঢং ঢং করে দশটার ঘন্টা পড়ছে। আমি প্রায় ল্যাপটপের মধ্যে মাথা খুঁজে ই-মেল টাইপ করছি, ঠিক তখনই মোবাইল ফোনটা তীব স্বরে বেজে উঠল।
.
একটু বিরক্ত হলাম। কাজের সময়ে ফোন বাজলে ভীষণ বিরক্ত লাগে। এখনও সাতটা ই-মেল পাঠাতে হবে আমায় দেশ-বিদেশের নানা বিজ্ঞানীকে। লম্বা লম্বা বয়ানের চিঠি। সময় লাগবে। তার উপর একটাও স্পেলিং মিস্টেক হওয়া চলবে না। একটা বানান ভুল হলেও ডক্টর আমায় বকাবকি করে রাখবেন না। যথাসম্ভব সতর্ক হয়ে কাজ করছি।
এমন সময় কে আবার জ্বালাতে ফোন করল?
প্রথমে ভেবেছিলাম ফোন ধরবো না। কিন্তু আড়চোখে তাকিয়ে দেখি ফোনের ডিস প্লে তে জ্বলছে নিভছে–কলিং গৌতম!
আমার মনে একটা তীব্র আশঙ্কা উন্মত্তের মত নাচতে শুরু করল। গৌতম এখন ফোন করছে কেন? সচরাচর সে খুব একটা ফোন করে না। যা কথা হওয়ার তা ল্যাবেই হয়। আজও বেরিয়ে আসার আগে ওকে সমস্ত কাজকর্ম বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি। ড. হিঙ্গোরানি ল্যাবে আছেন। আমি আজ একটু তাড়াতাড়ি চলে এসেছি বলে ওকে ডিউটিতে থাকতে হয়েছে।
কিন্তু সে ফোন করছে কেন? আবার কী হল?
তাড়াতাড়ি ফোনটা ধরি—
–হ্যালো।
ওপ্রান্ত থেকে ভেসে এলো গৌতমের ভাঙা ভাঙা উত্তেজিত স্বর–স্যার?
–বলছি, বলো।
ঠিক হাহাকারের মতো শোনালো তার কথাগুলো–
–ড. হিঙ্গোরানি ল্যাবে কাজ করতে করতেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। অসম্ভব ব্রিদিং ট্রাবল। নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না। আমি ওনাকে লাইফকেয়ার নার্সিংহোমে নিয়ে যাচ্ছি। আপনি ইমিডিয়েটলি চলে আসুন।
আমার ব্রহ্মতালু থেকে পায়ের নখ অবধি যেন বরফ হয়ে গেল! হাতটা ভীষণ অবশ লাগছে। ফোনটা ঠক করে হাত থেকে পড়ে গেল মেঝেতে!
ব্রিদিংট্রাবল……না…আবার ক্যামোফ্লেজিয়া!!!
.
৪.
লাইফকেয়ারের আইসিইউতে গভীর কোমায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন ড. হিঙ্গোরানি। ভেন্টিলেশন চলছে। ডাক্তারবাবু প্রথমে ভিতরে কাউকে অ্যালাউ করছিলেন না। অনেক কাকুতি মিনতির পর আমাকে কয়েক মুহূর্তের জন্য কাছে যাওয়ার অনুমতি দিলেন।
ড. হিঙ্গোরানির পাশের বেডটাতেই ড. সুকুমার বসু শুয়ে আছেন। তিনিও কোমায় আছেন। মুখটা বিবর্ণ। কেউ যেন ব্লটিং পেপার দিয়ে সমস্ত রঙ শুষে নিয়েছে। চোখদুটো আঠা দিয়ে যেন আটকানো। অসম্ভব তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল ড. বসুর। ভারি কাঁচের চশমার ফাঁক দিয়ে যখন তাকাতেন, তখন মনে হত একেবারে ভিতর অবধি দেখে নিচ্ছেন……
অথচ এই চোখদুটো হয়তো আর কখনও খুলবে না।
আর তার পাশেই ড. হিঙ্গোরানি…
অমন দাপুটে মানুষটাকে এত অসহায় আগে আর কখনও মনে হয়নি। কী শীতল নিরাপত্তাহীনতায় পড়ে আছেন বিছানায়। মুখে মৃত্যুর পাণ্ডুর ছায়া!
কেন জানি না…যদিও আমি…খুব শক্ত…খুব শক্ত মানুষ…আমি আমার বাবার মৃত্যুতেও কাঁদিনি…কিছুতেই আমার চোখে জল আসে না……।
কিন্তু আজ কেঁদে ফেললাম! ড. হিঙ্গোরানির দিকে তাকিয়ে চোখ জলে ভরে এলো। আর নিজেকে সামলাতে পারি না। কোনমতে আইসিইউ থেকে টলতে টলতে বেরিয়ে এসেছি।
গৌতম বাইরেই দাঁড়িয়েছিল। আমার অবস্থা দেখে সে ভুলে গেল যে আমি ওর স্যার। সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরেছে আমাকে।
–স্যার…
ওইটুকু বলারই অপেক্ষা ছিল। ওর বুকে মাথা রেখে ছোট শিশুর মতো হাউ হাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়লাম। ওর চোখেও জল। ড. হিঙ্গোরানিকে ভালোবাসে না, এমন লোক বোধহয় নেই। ভীষণ মেজাজী লোক ঠিকই, কিন্তু দয়ামায়া কাকে বলে তা বোধহয় ওঁর কাছ থেকেই শিখতে হয়। কী ছিলাম আমি? কতটুকু ছিলাম? বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন ছিল চোখে। কিন্তু সংস্থান ছিল না। বাবার সামান্য রোজগারে স্বপ্ন সফল হওয়ার সম্ভাবনাই ছিল না। সেইসময় ড. হিঙ্গোরানিই আমার হাত ধরেছিলেন। ঈশ্বর সকলের জীবনেই একজন না একজন দেবদূত পাঠান।
আমার সেই দেবদূত এখন আইসিইউতে গভীর কোমায় আচ্ছন্ন হয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে!
.
অথচ আমার কিছু করার নেই! কী অসহায় আমি!
গৌতম বিড়বিড় করে যেন আপনমনেই বলে– ফুলের বোকেটার জন্যই এ সর্বনাশ!
আমি ওর কথাটা ঠিক ধরতে পারি না। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি দেখে সে আবার বলল–আপনি চলে যাওয়ার প্রায় তিনঘন্টা পরে একটা ফুলের বোকে। এসেছিল স্যার।
আমার চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। বুঝতে অসুবিধে হল না যে গৌতমের সন্দিগ্ধ ইঙ্গিত কোনদিকে।
–ক্যামোফ্লেজিয়া?
ও আমার দিকে তাকিয়ে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে।
–আপনি বুঝতে পারছেন না স্যার? ফিসফিস করে বলল গৌতম–পরপর ইনসিডেন্টগুলো দেখুন। সবকটা সিম্পটম দেখুন। যখন আমি ড, হিঙ্গোরানির চিৎকার শুনে ছুটে যাই তখন ওনার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। এবং সবচেয়ে বড় কথা যে উনি কনফিউজড হয়ে গিয়েছিলেন। নার্সিংহোম শব্দটাও ঠিক মতো বলতে পারছিলেন না। একবার জল খেতে চাইছিলেন, কিন্তু যখন জল দিতে গেলাম তখন জলের দিকে এমন করে তাকালেন যেন জিনিসটা কী বুঝতে পারছেন না। এখানে আসার পর ডক্টর বললেন– মেজর কেস অব অ্যাসিস্টল। কোনও কার্ডিয়াক ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যাকটিভিটি ছিল না তখন।
ও চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। বলাই বাহুল্য যে এই হার্ট অ্যাটাক, সাইনাস ট্যাকিকার্ডিয়া, ভেকিলার অ্যারিদমিয়া, কনফিউশন এবং অ্যাসিস্টল–এগুলো সব অ্যাকোনিটামের লক্ষণ! ক্যামোফ্লেজিয়াই যে সব কিছুর মূলে তা বুঝতে আর বাকি রইল না!
–বোকেটা কে পাঠিয়েছিল জানো?
–নাঃ। সে বলে–বোকেটার উপর কোনও নাম ছিল কি না মনে নেই। একগুচ্ছ নানা রঙের ফুলের বোকে ছিল শুধু এইটুকু মনে আছে। আর যখন ড. হিঙ্গোরানি পড়ে গিয়ে ছটফট করছিলেন তখন তার পাশেই পড়েছিল বোকেটা।
–ফাইন। আমি তড়াক করে উঠে দাঁড়াই–চলো গৌতম।
–কোথায়?
–অফিসে। অজান্তেই নিজের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে–বোকেটা কে পাঠিয়েছে দেখা দরকার। লেটস গো।
.
গৌতম প্রথমে একটু কিন্তু কিন্তু করলেও পরে রাজি হয়ে গেল। ওর গাড়িতেই ফের আমরা ফিরে গেলাম ল্যাবে। ল্যাবরেটরির একটা চাবি সবসময় আমার সাথেই থাকে। সুতরাং ভেতরে ঢুকতে কোনও অসুবিধে হয়নি।
কিন্তু অবাক কাণ্ড! পুরো ল্যাবরেটরি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাওয়া গেলো না বোকেটা! সেটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে! যে ঘরে ডক্টর পড়েছিলেন সে ঘর থেকে শুরু করে ডাস্টবিন পর্যন্ত আমরা সব খুঁজে–ঘেঁটে দেখলাম। কিন্তু ফুলের তোড়াটা অধরাই থেকে গেল!
অনেকক্ষণ খোঁজার পর যখন আমরা হতক্লান্ত হয়ে রণেভঙ্গ দিলাম ততক্ষণে প্রায় ভোর হয়ে এসেছে। গৌতম রীতিমতো হাঁপাচ্ছে। কোনমতে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল–
–কেউ সরিয়ে নিয়েছে। আমি শিওর বোকেটা এখানেই পড়েছিল…কিন্তু কেউ…
–কে?
সে খানিকক্ষন চুপ করে থাকে। কী যেন ভাবছে। একটু সময় নিয়ে আবার বলল–
–একটা কথা মনে হচ্ছিল স্যার।
আমি ল্যাবরেটরির টেবিলে রাখা বোতল থেকে জল খেতে খেতে জানতে চাই– কী?
–ড. টোডি, ড. বসু ও ড. হিঙ্গোরানির মত লোক এতবড় একটা কাঁচা কাজ করলেন কী করে?
–মানে?
–মানে কোনও অ্যান্টিডোটের বন্দোবস্ত করেই ক্যামোফ্লেজিয়ার মতো বিষধর জিনিস আবিষ্কার করবেন, এত বড় মূর্খ কি তাঁরা ছিলেন?
আমি গৌতমের দিকে অপলকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকি। এই কথাটা এতক্ষণ আমার মাথায় আসেনি কেন?
কিন্তু অ্যান্টিডোট যদি থাকে তবে সেটা তারা নিজেরা ব্যবহার করেননি। কেন?
গৌতমকে কথাটা বলতেই ওর উত্তর– হয়তো সুযোগ পাননি। বোঝার আগেই বিষ কাজ করতে শুরু করেছে।
–হতে পারে। আমি উত্তেজিত–তাহলে সেক্ষেত্রে তার অ্যান্টিডোট এখানেই থাকবে। হয় অ্যান্টিডোট, কিম্বা তার ফর্মুলা। যতদূর জানি অ্যাকোনিটামের অ্যান্টিডোট হিসাবে নাক্স ভম কিম্বা ক্যাম্ফর ইউজ হয়। একবার গোটা ফমূলাটা পেয়ে গেলে বানিয়ে নিতেও অসুবিধে হবে না।…চিয়ার আপ… খোঁজো গৌতম…খোঁজো…।
.
শুরু হল খোঁজাখুঁজি। গৌতম আর আমি দুজনেই বুঝতে পারছিলাম যে ক্যামোফ্লেজিয়ার প্রকোপ এরপর আমাদের উপরই পড়বে। আমাদের অবস্থাও ড. টোডি, ড. বসু বা ড. হিঙ্গোরানির মত হবে। তাই অ্যান্টিডোট বা তার ফর্মুলাটা পাওয়া আমাদের কাছে জীবন-মরণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুজনেই মরিয়া হয়ে খুঁজছি! যে কোন মূল্যেই হোক জিনিসটা পেতেই হবে। নয়তো আমাদেরও শেষ করে ছাড়বে ঐ ছদ্মবেশী ঘাতক!
ড. হিঙ্গোরানির প্রাইভেট ল্যাব আজ খোলা ছিল। উনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় এই দরজা বন্ধ হয়নি। আর কেউ পাসওয়ার্ড জানতো না।
মনে হল, হয়তো ডক্টর অ্যান্টিডোটটাও ঐ ঘরেই রেখেছেন।
–গৌতম, তুমি বাইরেটা খোঁজো। আমি প্রাইভেট ল্যাবের দিকে পা বাড়াই–আমি ভিতরটা দেখছি।
ল্যাবের ভিতরে সারি সারি শিশিতে নানারকম কেমিক্যাল। কোনটা সবুজ, আবার কোনটা বা গোলাপী। ছোট ছোট কাঁচের শিশিতে নানারকম তরল। এত শিশি আর বোতলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হচ্ছিল। এর কোনটায় আমাদের ইঙ্গিত বস্তু লুকিয়ে আছে? অ্যান্টিডোট ছাড়া ফুলটা তৈরি হল কী করে? যখন এটা তৈরি হচ্ছিল তখন থেকেই নিশ্চয়ই বিজ্ঞানীরা গ্যাস মাস্ক পরে ছিলেন না। ক্যামোফ্লেজিয়ার গন্ধ কখনও না কখনও তাদের নাকে গিয়েই থাকবে। মনে আছে ড. হিঙ্গোরানি বলেছিলেন–গন্ধটা মিষ্টি। যদি গন্ধ তাদের নাকেই না যায় তবে বুঝলেন কি করে যে গন্ধটা মিষ্টি!
দৃঢ় বিশ্বাস হল–তার মানে অ্যান্টিডোট আছে। গবেষণা চলাকালীন বিজ্ঞানীরা ফুলের গন্ধ ও পেয়েছিলেন। কিন্তু তখন তাদের কিছু হয়নি। অ্যাকোনাইট কাজ করতে বেশি সময় নেয় না। একঘন্টা দু ঘন্টার মধ্যেই কাম তামাম করে ফেলে।
সুতরাং তখন তারা নিশ্চয়ই অ্যান্টিডোট নিয়েছিলেন। ওটা এখানেই কোথাও আছে।
কিন্তু কোথায়?
ল্যাবের ভিতরে একটা মস্তবড় ফ্রিজার। মাইনাস সিক্স ডিগ্রিতে সেট করা আছে। এটাকে মাইনাস ফরটি ডিগ্রি অবধি সেট করা যায়। গ্লাভস পরে ফ্রিজারের দরজা খুলতেই হাড় হিম করা ধোঁয়া বেরিয়ে এলো। সেই ধোঁয়ার। ভিতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে আরও কিছু ছোট ছোট শিশি। গায়ে লেবেল সাঁটা।
সামনের ব্লকে বড় বড় করে লেখা–অ্যান্টিডোটস।
এগুলোই অ্যান্টিডোট! নানান বিষ নিয়ে কাজ করেন ডক্টর। তাই প্রত্যেকটা বিষের ওষুধও তৈরি করা থাকে। সারসার শিশির মধ্যে আর্সেনিক অ্যান্টিডোট, থ্যালিয়াম অ্যান্টিডোট, সায়ানাইড অ্যান্টিডোট, নিউরোটক্সিন এলডি ফিফটির অ্যান্টিডোট–সবই চোখে পড়ল।
কিন্তু ক্যামোফ্রেজিয়া নেই!
.
আশ্চর্য ব্যাপার! ক্যামোফ্লেজিয়ার অ্যান্টিডোট এখানে নেই কেন? তবে কি অন্যকোথাও…?
প্রথমে সবকটা শিশি নামিয়ে নামিয়ে দেখলাম।… নেই! ল্যাবরেটরি প্রায় তছনছ করে খুঁজছি…।…নেই!……কাগজপত্র, ফাইল ঘেঁটে দরকারি-অদরকারি কাগজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে একসা করলাম। আমারই তৈরি করা প্রোজেক্ট রিপোর্ট, ডিফেন্স মিনিস্ট্রির চিঠি, ক্যামোফ্লেজিয়ার ইনশিওরেন্স পেপার–সব বেরোলো…
কিন্তু ফর্মুলা?
…নেই!
হতক্লান্ত হয়ে মেঝের উপরই বসে পড়েছি। আবার ভীষণ কান্না পেয়ে গেল। ড. হিঙ্গোরানির জন্য নয়। নিজের কথা ভেবে! শেষ পর্যন্ত আমাকেও বিষ নিশ্বাস নিয়ে অসহায় গিনিপিগের মতো মরতে হবে! চোখের সামনে দেখলাম–ক্যামোফ্লেজিয়া আমার পিছনে ধাওয়া করছে। নীল বিষাক্ত শরীরে আমি……
…নাঃ। এভাবে, এত সহজে মরবো? আমিও বিজ্ঞানী। এই কাগজপত্রের মধ্যে আর কিছু না হোক–কোথাও না কোথাও ক্যামোফ্লেজিয়ার ডি এন এ কোড রয়েছে। যদি একবারও সেটা পাই, তবে নিজেই তার অ্যান্টিডোট তৈরি করতে পারি। শুধু একবার ঠাণ্ডা মাথায় আমায় কাগজটা দেখতে হবে।
ফাইলের মধ্যে সমস্ত কাগজপত্র নিয়ে বেরিয়ে এলাম প্রাইভেট ল্যাব থেকে। গৌতম ততক্ষণে সমস্ত ডিভিডি, সিডি চালিয়ে দেখে নিয়েছে। কম্পিউটার তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখেছে। ড. টোডি, ড, বসু আর ড. হিঙ্গোরানির নিজস্ব কম্পিউটার তাদের কেবিনেই থাকে। সবকটা দেখেছে, এমনকি আমার কম্পিউটারও ছাড়েনি। যদি কোন সিডি তে বা কম্পিউটারে ক্যামোফ্লেজিয়ার প্রেজেন্টেশন থাকে। কিম্বা তার অ্যান্টিডোটের প্রেজেন্টেশন। আজকাল বিজ্ঞানীরা কম্পিউটারেই তাদের রেকর্ড বেশি রাখেন। তাই সে তাও দেখতে বাকি রাখেনি।
কিন্তু ড. হিঙ্গোরানিকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। তিনি কম্পিউটারে কিছু রাখার লোক নন।
দেখা গেল আমার চেনাটাই সঠিক। গৌতম সব কম্পিউটার ঘেঁটেও কিছু পায়নি। হয় সেগুলো কেউ সরিয়ে দিয়েছে। নয়তো ডক্টররা কম্পিউটারে জিনিসটা রাখেননি।
–এখন কী করবো স্যার?
তার কণ্ঠস্বরে হতাশা–কিছুই তো পেলাম না।
–পাওয়া যাবে গৌতম, নিশ্চয়ই পাবো আমরা। ওকে সান্ত্বনা দিই– আমি বাড়িতে বসে ঠাণ্ডা মাথায় এই কাগজপত্র দেখবো। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এর মধ্যেই কিছু আছে। যদি ক্যামোফ্লেজিয়ার ডিএনএ কোডও পেয়ে যাই তবে তা থেকে অ্যান্টিডোট বানিয়ে নিতে পারি। শুধু এইমুহূর্তে মাথা ঠাণ্ডা রাখা দরকার।
সে ক্লান্তভাবে মাথা নাড়ে।
–এখন তুমি বাড়ি যাও। আমি আস্তে আস্তে বললাম–সকাল দশটার আগে তো ভিসিট করতে দেবে না। আমিও আসবো।
গৌতম সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল– চলুন স্যার, আপনাকে বাড়িতে ড্রপ করে দিই।
–চলো।
.
বাড়ি ফিরতে ফিরতে সকাল সাতটা বাজল। সারারাত জেগে, খোঁজাখুঁজি করে দুজনেই ভীষন অবসন্ন হয়ে পড়েছি। বিশাম দরকার।
আসার পথে আমাদের দুজনের কোনও কথা হয়নি। কোনও এক ভয় আমাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছিল। আমি অন্যমনস্কভাবে ফাইলের কাগজ উল্টেপাল্টে দেখছিলাম। গৌতম ড্রাইভ করছিল। কোন কথা বলেনি। আমাদের অমোঘ আশঙ্কা একটা ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
আমাকে ড্রপ করার সময়ে গৌতমই প্রথম মুখ খুলল–আমার মনে হয় স্যার, কেউ সব রেকর্ড মুছে দিয়েছে। আমাদের মধ্যেই কেউ…আর বোধহয় বাঁচার উপায় নেই।
দেখলাম ওর উদ্ভ্রান্ত চোখে জল চিকচিক করছে।
আমারও মনে এই সন্দেহটা ঘুরছিল। কেউ ইচ্ছাকৃতভাবেই সরিয়ে ফেলেছে। অ্যান্টিডোট। হয়তো কাগজপত্রও গায়েব করে দিয়েছে!
বুঝতে পারছিলাম না ওকে কি বলব। কিছু বলার আগেই সে আবার বলল–
–আসছি স্যার, সাবধানে থাকবেন।
গৌতম চলে গেল। আমি নিজের বাড়ির দিকে পা বাড়াই। একটু বিশাম দরকার। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে। একটু ঘুম……
কিন্তু …এ কি!
বাগানের পাশ দিয়ে যেতে যেতেই চমকে উঠলাম! কাল প্রতাপকে বলেছিলাম ঘাসফুলগুলো হেঁটে ফেলতে! ওকে কাটারি দিয়ে ঘাসফুল ছাঁটতেও দেখেছি,
তবে ওগুলো কি!…
বাগান আলো করে ঘাসের মধ্যে ছোট ছোট সাদা ফুল শিশির মেখে ঝলমল করছে! কাল সংখ্যায় কম ছিল। কিন্তু আজ প্রায় গোটা বাগান জুড়েই…!
মনে হল ফুলগুলো বোধহয় আমার দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গের হাসি হাসছে! এত তাড়াতাড়ি এত ঘাসফুল কোথা দিয়ে এলো! সংখ্যায় প্রচুর! আর সারা বাগানই প্রায় ছেয়ে ফেলেছে! এগুলো কালও ছিল না…।
ঘাসফুল নয়…এ ঘাসফুল হতেই পারে না!
মুহূর্তের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিলাম। পুরো বাগানের ঘাসই উপড়ে ফেলবো। ঘাস কাটার মেশিনটা আছে স্টোররুমে। ওটা দিয়েই নিকেশ করবো রক্তবীজের বংশধরদের। ঘাসও থাকবে না…ঘাসফুলও নয়!
আজ আর প্রতাপকে ডাকলাম না। এ কাজ নিজের হাতেই করা ফেলা ভালো। ওকেও বিশ্বাস করতে পারছি না। আমিই দেখে নেবো…!
.
গ্রাস কাটার চলতে শুরু করল।
চোখের সামনে দেখলাম ঘাসের গোড়া থেকে উপড়ে যাচ্ছে। সাদা ছোট ছোট ফুলগুলো নেতিয়ে পড়ছে ছিন্নমূল হয়ে। নাক আগেই ঢেকে নিয়েছিলাম। তাই গন্ধ পাওয়ার সম্ভাবনাই ছিল না। ঘাস কাটতে কাটতেই একটা পৈশাচিক আনন্দ টের পাই। যেন আমার মাথায় দানব ভর করেছে। সব কেটে ফেলব…সব শেষ করব…সবকটাকে যমের দোরে পাঠাবো।
দেখতে দেখতে গোটা বাগান সাফ হয়ে গেল। ঘাসগুলো বিধ্বস্ত হয়ে উপড়ে পড়ে আছে! তার সাথে ঘাসফুলও!
হিংস্র আনন্দে তাকিয়ে দেখলাম আমার বাগান ন্যাড়া হয়ে গেছে! বিবর্ণ হয়ে গেছে।প্রতাপ ঘুম থেকে উঠে বাইরে বেরিয়ে এসে দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠেছে! বাগানে কোনও ঘাস নেই! সে পাগলের মতো ছুটে আসে। প্রায় হাহাকার করে ওঠে–
–স্যার…একি করছেন?
আমি রক্তচোখে ওর দিকে তাকাই। নিধুম এক রাত কাটিয়ে, দুশ্চিন্তায় চেহারাটা উন্মাদের মতো লাগছিল। লাল চোখ, উস্কোখুস্কো চুল, মুখে না। কামানো দাড়ি! ও বোধহয় এই রূপ দেখে ঘাবড়ে গেল। কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়।
আশেপাশে তাকিয়ে দেখি, ছোট ছোট ফুলের ঝাড় জ্বল জ্বল করছে। এত ছোট ছোট নানা রঙের ফুল কবে এলো আমার বাগানে! একেবারে গাছ আলো করে থোকায় থোকায় ফুটে আছে।
মনের ভিতরের সন্দেহ আর আশঙ্কা একসাথে দানবের মতো দাপাতে শুরু করে।
ওগুলো কী? কী?…কী?
বলা যায় না…কিছু বলা যায় না…ও ফুল যেকোন জায়গায়, যে কোন রঙে ছদ্মবেশে ফুটে থাকতে পারে।
নাঃ, ফুল চাই না আমি…এ বাগানে কোন ফুল থাকবে না…কোন ফুল…কোন গাছ নয়! বরং বাগানটাই দরকার নেই! বাগানটাই থাকবে …ওড়াও…সব উড়িয়ে দাও…কিছু দরকার নেই!…নিজের প্রাণের চেয়ে বেশি কিছু না…কোন সৌন্দর্য, কোন সৌরভ–কিছু না!
ধ্বংস হোক…ধ্বংস হোক সব…
প্রতাপকে দিয়ে কাজটা করালাম না। বলা যায় না, হয়তো মায়ায় পড়ে একটা দুটো গাছ রেখে দেবে। তাই নিজের হাতেই এক এক করে সব ধ্বংস করলাম। আমার বাগান নিমেষের মধ্যে ধ্বংসপ্রাপ্ত হিরোশিমা-নাগাসাকির মতো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হল। যে গাছগুলোকে নিজুেই এনেছিলাম, সাজিয়ে তুলেছিলাম বাগান, সেই গাছগুলোকে নির্মম হাতে তুলে ফেলে দিলাম!
ফুল বড় ভালবাসতাম আমি…
আজ সবচেয়ে বেশি ভয় পাই এই ফুলকেই…ঘেন্না করি…ঘেন্না করি…
.
৫.
বিকেলের দিকে ভিজিটিং আওয়ারে আরেকবার দেখে এলাম দুই বৈজ্ঞানিককে।
অবস্থার উন্নতি কিছুই হয়নি। বরং ইনটেনসিভ কেয়ারে ডাক্তারদের ব্যস্ততা দেখে মনে হল আজ বোধহয় দুজনেরই অবস্থা খারাপ।
আমরা আজ আর ভিতরে ঢোকার অনুমতি পেলাম না। বাইরে দাঁড়িয়েই জানলার কাঁচ দিয়ে দেখলাম মৃত্যুশয্যায় শায়িত দুই বৈজ্ঞানিক কে।
ড. হিঙ্গোরানির ছেলে বিদেশে থাকে। খবর পেয়েছে, কিন্তু এসে পৌঁছতে পারেনি। ড. বসুর স্ত্রী আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন। কতরাত ঘুমোননি কে জানে। চোখের তলায় কালি পড়েছে। তার দিকে তাকাতেও পারছিলাম না! কথা বলার সাহসও হল না।
ডিফেন্স মিনিস্ট্রির একজন হোমরা চোমরা এসেছিলেন আজ। গম্ভীর মুখ করে বাইরে থেকেই ব্যাপারটা দেখে গেলেন। তার মুখে একটা নিরাশার ছাপ লক্ষ করছিলাম। সেটা আবিষ্কারটা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার জন্য না দুই বিজ্ঞানীর অবস্থা দেখে, কে জানে!
গোটা ভিজিটিং আওয়ারটাই বাইরে দাঁড়িয়ে কেটে গেল। বিকেলবেলা ফিরে এলাম বাড়িতে। বাগানের জায়গায় এখন মরুভূমির মত নিষ্ফলা একটুকরো জমি খাঁ খাঁ করছে। অন্য সময় হলে বুকের ভিতরটা হু হু করে উঠল। কিন্তু আজ আমি নিষ্ঠুর! ভীষণ নিষ্ঠুর!
স্নায়ুর উপর দিয়ে ভীষণ চাপ যাচ্ছিল। এক পেগ হুইস্কি তৈরি করতে করতেই অনুভব করলাম…
গোলাপের গন্ধ! সারা ঘরে হাল্কা গোলাপের গন্ধ ছড়িয়ে আছে!…
কিছুক্ষণের জন্য যেন হৃৎপিণ্ডটা স্তব্ধ হয়ে গেল…। গোলাপের গন্ধ কোথা দিয়ে আসছে? বাগানের ত্রিসীমানায় আগেই কোনও গোলাপ ছিল না। এখন তো বাগানটাই নেই! তবে গোলাপ কোথা দিয়ে এলো?
হঠাৎই বুঝতে পারলাম শরীরটা খারাপ লাগছে। হার্টবিট বেড়ে গেছে! আমার গোলাপের গন্ধে অ্যালার্জি।
আমার ড্রয়ারে সবসময়ই নেস্ট্রোমিফিন রাখা থাকে। অ্যালার্জির ওষুধ। ফয়েল থেকে বের করে একটা খেয়ে নিলাম। গোলাপের গন্ধটা তাড়ানো দরকার। কোথা থেকে আসছে কে জানে। জানলা দরজা বন্ধ করে রুমফ্রেশনার ছড়িয়ে দিই চতুর্দিকে। মদন আজ সকালেই এই নতুন রুম ফ্রেশনারটা দোকান থেকে নিয়ে এসেছে বোধহয়।
সবকাজ শেষ করে নিশ্চিন্ত হয়ে ফের কাজে লেগে যাই। ল্যাব থেকে আনা কাগজ গুলো খুব মন দিয়ে পড়তে শুরু করেছি। অদরকারি কাগজপত্রই বেশি। ক্যামোফ্লেজিয়ার কয়েক কোটি টাকার ইনশিওরেন্স আছে। তার কাগজপত্র, ডিফেন্সের চিঠি, কিছু কেমিক্যাল কেনার রশিদের কপি, অ্যাকোনিটাম কেনার রশিদ……
দেখতে দেখতেই চোখে পড়ল একটা কাগজে কি যেন হিজিবিজি লেখা…
.
কোনও সন্দেহ নেই যে এটা ডক্টর হিঙ্গোরানির হাতের লেখা। তার মতো দুর্বোধ্য হিবুর মতো হাতের লেখা আর কারুর নেই।
কিন্তু এসব কি হিজিবিজি এঁকেছেন! দেখে মনে হচ্ছে একটা প্ল্যানিং। ডি এন এ কোডের প্ল্যানিং?
উত্তেজনায় শরীর টানটান হয়ে উঠল। এই তবে ক্যামোফ্লেজিয়ার ডি এন এ কোডের ছবি। এত খোঁজাখুঁজির পর শেষপর্যন্ত পাওয়া গেল!
কিন্তু একি! এর মধ্যে অ্যাকোনিটামের ডিএনএ তো দেখছি না। বরং কিছু সাপের বিষের সাইকেন দেখা যাচ্ছে! ক্যামোফ্লেজিয়া সাপের বিষে তৈরি! ডক্টর হিঙ্গোরানি কি তবে ভুল বলেছিলেন? বা চেপে গিয়েছিলেন আমাদের কাছে আসল সত্যিটা?
আমি ভালো করে কাগজটা দেখতে চাইছিলাম। কিন্তু ক্রমশই শরীরটা কেমন যেন অবসন্ন হয়ে আসছে। গোলাপের গন্ধটা আরও তীব। ভীষন অসুস্থ মনে হচ্ছে নিজেকে। চোখে ঝাপ্সা দেখছি, বুক ধড়ফড় করছে…
সব দরজা জানলা বন্ধ! তবে গোলাপের গন্ধ আসছে কোথা দিয়ে!মদন কি ঘরে কোথাও গোলাপ এনে রেখেছে নাকি? আমি হুইস্কির গ্লাসে কয়েকটা উত্তেজিত চুমুক লাগাই, তারপর ফয়েল থেকে আরও কয়েকটা নেস্ট্রোমিফিন বের করে টপাটপ খেয়ে ফেলি। অ্যালার্জিটা ক্রমশই বাড়ছে। দেখতে হবে গোলাপ কোথায় রাখা আছে।
অদ্ভুত ব্যাপার–সমস্ত ঘর খুঁজেও কোথাও গোলাপের একটা পাপড়ি তো দূরের কথা, একটা কাঁটাও নজরে এল না! কোথাও গোলাপ নেই এ বাড়িতে। তবে?
আবার একটা আশঙ্কা মনের মধ্যে চেপে বসল! ক্যামোফ্লেজিয়ার গন্ধ কি তবে গোলাপের মত! ক্রমশই মনে হচ্ছে বুকের উপর কিসের যেন একটা ভয়ানক চাপ। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে…। চোখের সামনে সব ঝাপ্সা হয়ে আসছে।
আমি জোরে জোরে শ্বাস নিতে শুরু করি…। কিন্তু পারছি না! দেহ অবশ হয়ে আসছে। প্রচন্ড বমি পাচ্ছে, দরদর করে ঘামছি।
বুঝতে পারছি এ যাত্রা বোধহয় আর বাঁচবো না! নার্ভগুলো কাজ করা ছেড়ে দিয়েছে, বুকে ভীষণ কষ্ট! এ ক্যামোফ্লেজিয়ার সিম্পটম! নির্ঘাৎ ক্যামোফ্লেজিয়া…! কিন্তু কোথায়? আমার বাগানে আর কোনও ফুল নেই। আশেপাশে কোনও ফুল চোখে পড়ে নি। ভেবেছিলাম ক্যামোফ্লেজিয়াকে আমি অনেক দূরে ফেলে আসতে পেরেছি…….
আঃ…অক্সিজেন…একটু অক্সিজেন…আমি ধড়ফড় করছিলাম একটু অক্সিজেনের জন্য…চোখে আস্তে আস্তে অন্ধকার নেমে আসছে…মৃত্যুযন্ত্রণা কাকে বলে বুঝতে পারছি…বুঝতে পারছি ক্যামোফ্লেজিয়া আমার খুব কাছেই আছে…..
জ্ঞান হারাবার আগে শুনতে পেলাম আমার মোবাইল ফোন বাজছে। বাজছে। আমার খুব প্রিয় রিংটোন…কারেন কার্পেন্টারের গলা–
–জাস্ট লাইক মি…দে ওয়ান্ট টু বি…ক্লোজ টু ইউ……
তারপরই সব অন্ধকার!
.
৬.
মনে হচ্ছিল কোথাও একটা ভেসে বেড়াচ্ছি!
না এই জবরজং শরীরটা নিয়ে নয়। বরং বেশ সূক্ষ্ম একটা অস্তিত্ব টের পাচ্ছিলাম। এত হাল্কা নিজেকে কখনও মনে হয়নি। এত মুক্ত ও নয়। অনাবিল অন্ধকারের মধ্যে যেন সাঁতরে বেড়াচ্ছি!
সাঁতরাতে সাঁতরাতেই টের পেলাম যে শরীরটা হঠাৎ করে বড় ভারি হয়ে যাচ্ছে। আঃ…অন্ধকারের মধ্যে কে আলো জ্বেলে দিল দুম করে? শান্ত নিস্তব্ধতা ভেঙে নানারকম আওয়াজ কানে আসছে।
দপ করে যেন চোখের সামনে লক্ষ হ্যালোজেন জ্বলে উঠল। জন্মযন্ত্রণা যেন দ্বিতীয় বার অনুভব করলাম। মনে হচ্ছিল আমি কোন গহ্বর থেকে বেরিয়ে আসছি–চতুর্দিকে অনেক আওয়াজ, অনেক আলো আমায় কষ্ট দিচ্ছে। অনুভূতিগুলো যেন একটা অদ্ভুত পীড়নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল।
কোনমতে চোখ মেলে তাকাই…কে আমায় এমনভাবে বিরক্ত করছে? কেনই বা করছে? দিব্যি তো ছিলাম একা একা! কে…?
আলোর তীব্রতায় কিছুক্ষণের জন্য চোখ বুজে ফেলেছিলাম। আবার তাকানোর চেষ্টা করি…এত আলো!…আমি কোথায়?…
–অ-নু-প-ম!
কেউ আমার নাম ধরে ডাকছে! আমার মুখের সামনে দুটো ঝুঁকে পড়া উদ্বিগ্ন মুখ!
….কে?… চিনতে পারলাম না…সব ঝান্সা…! শরীরটাকে ভীষন ভারি মনে হচ্ছিল। কোনমতে উত্তর দিই–।
–থ্যাঙ্ক গড! জ্ঞান ফিরেছে! কে যেন সোল্লাসে চেঁচিয়ে ওঠে–ওঃ ঈশ্বর…হি ইজ ওকে…হি ইজ গেইনিং সেন্স… উঁ।
ভীষণ ঘুম পাচ্ছিল। আস্তে আস্তে ঘুমটা যেন আমায় চেপে ধরল।
আবার অন্ধকার!
কতক্ষণ মড়ার মত ঘুমিয়েছি জানি না। অনেকক্ষন একটানা ঘুমোনোর পর আস্তে আস্তে হুঁশ ফিরে পেলাম। এবার বুঝতে পারি নার্সিংহোমে আছি। এটা আই সি ইউ। আমার নাক থেকে বোধহয় সদ্যই অক্সিজেন মাস্ক খোলা হয়েছে।
–অনুপম, কেমন লাগছে এখন?
পরিচিত গলার স্বর শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকাই। যা দেখি তাতেই চক্ষু চড়কগাছ! আমাকে রাখা হয়েছে ড. হিঙ্গোরানি ও ড, বসুর নার্সিংহোমেই। ইনফ্যাক্ট তাদের পাশেই!
বিস্ময়ের কথা এটা নয়। যা দেখে চমকে উঠলাম, তা হল–………
উপরোক্ত দুজনই আমার বিছানার পাশে বসে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে!
বিস্ময়ের পরই অদ্ভুত আনন্দে মন ভরে গেল। পারেনি…ক্যামোফ্লেজিয়া এই দুজনকে নিয়ে যেতে পারেনি…ক্যামোফ্লেজিয়া হেরে গেছে…হেরে গেছে…সৃষ্টি স্রষ্টাকে ধ্বংস করতে পারেনি…
আমি প্রায় লাফ মেরে উঠে বসতেই যাচ্ছিলাম, তার আগেই ড. হিঙ্গোরানি আমায় ধরে ফেলেছেন। সস্নেহে টেনে নিলেন বুকে–ওয়েলকাম ব্যাক অনুপম!যা ভয় দেখিয়েছিলে!সাতদিন ধরে তোমার সেন্স ছিল না। এমন কাণ্ড একজন বিজ্ঞানী হয়ে করলে কি করে?
আমি বলতে গেলাম ক্যামোফ্লেজিয়া……
আমাকে, থামিয়ে দিয়েই ড. বসু বললেন–ক্যামোফ্লেজিয়া নয়। তোমার রোজ এসেন্সে অ্যালার্জি। তার সাথে প্রচুর নেস্ট্রোমিফিন খাওয়া, এবং লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট সাথে অ্যালকোহল! তুমি একটা বিজ্ঞানী অনুপম! তোমার মনে ছিল না যে নেস্ট্রোমিফিন যতই নিরীহ অ্যালাজির ওষুধ হোক না কেন, অ্যালকোহলের সাথে মিষলে মারাত্মক বিষ হয়ে দাঁড়ায়? কটা খেয়েছিলে ট্যাবলেট?
মনে করার চেষ্টা করি– চার পাঁচটা হবেই…।
ড. হিঙ্গোরানি শাসনের ভঙ্গিতে বলেন–তোমার লজ্জা করে না? উপরে যাওয়ার বন্দোবস্ত তো প্রায় পাকাই করে ফেলেছিলে। তোমার কাজের লোক মদন ঠিক সময়ে উদ্ধার না করলে কোথায় থাকতে তুমি?
এরপর তাঁদের মুখ থেকেই শুনি মদন আমায় ঐ অবস্থায় দেখে সঙ্গে সঙ্গে ল্যান্ডফোন থেকে ফোন করে গৌতমকে। মদন মোটামুটি এসব কাজ করতে পারে। প্রতাপও পারে। গৌতমের কথা মত ওরা দুজনেই আমাকে ঐ অবস্থায় এই নার্সিংহোমে নিয়ে আসে। এই সাতদিন রোজ দুবেলা গৌতম এসেছে। মদন আমায় দেখতে না পেলেও, আই সি ইউর সামনে থেকে একমুহূর্তও নড়েনি। আজ আমার হুঁশ ফিরেছে শুনে মন্দিরে ছুটেছে পুজো দিতে।
আবেগে চোখে জল এল। এরা সবাই আমায় কত ভালোবাসে! অথচ এ কদিন আমি শুধু স্বার্থপরের মত নিজের কথাই ভেবে গেছি…কি স্বার্থপর আমি…!
মনে একটা প্রশ্ন বারবার ফিরে আসছিল। থাকতে না পেরে প্রশ্নটা করেই ফেলি–
–ডক্টর?
–বলো।
–গোলাপের গন্ধটা কোথা থেকে এলো? আমার ঘরে কোথাও গোলাপ ছিল না। বাগান তো আমি নিজেই উড়িয়েছি। তবে…?
–সেটার উত্তরও মদন তোমার ডাক্তারকে দিয়েছে। ড. হিঙ্গোরানি হাসলেন–তুমি ওকে রুম ফ্রেশনার আনতে দিয়েছিলে। ও জানতো না যে তোমার রোজ এসেন্সে মারাত্মক অ্যালার্জি। বেচারা একটা রোজ এসেন্সের রুম ফ্রেশনার এনেছিল।
.
এইবার ব্যাপারটা পরিষ্কার হল। ক্যামোফ্রেজিয়া নয়। আসল ভিলেন ঐ রুমফ্রেশনার। আমি ঘরে ঢোকার আগেই সম্ভবত মদন স্প্রে করে রেখেছিল। ঘরে ঢোকামাত্রই ঐ গন্ধটা পেয়েছি। গন্ধটা কাটাবার জন্য দরজা জানলা বন্ধ করে দিয়ে বোকার মতো ঐ রুমফ্রেশনারটাই বারবার স্প্রে করেছিলাম। যার জন্য গোলাপের গন্ধ ক্রমশই বাড়ছিল!
আর তার সাথে বাড়ছিল আমার অ্যালার্জি।
–অ্যান্ড দেন ফাইভ নেস্ট্রোমিফিনস উইদ অ্যালকোহল। ড. হিঙ্গোরানি বললেন–আরেকটু হলেই চ্যাপ্টার ক্লোজড হচ্ছিল তোমার। বেঁচে যে আছ এই অনেক।
আমি আনন্দে গদগদ হয়ে বলি– স্যার, আপনাদের দেখে যে কি আনন্দ হল কি বলি…। আমাদের যে কি অবস্থা হয়েছিল……।
–হ্যাঁ জানি। ড. বসু বললেন–তুমি তো একেবারে ভেউভেউ করে কাঁদছিলে।
ওঁর কথা শুনে চমকে উঠলাম! উনি জানলেন কি করে? দুজনেই তো কোমায় ছিলেন!
কথাটা বলতেই উত্তর এলো–ঘোড়ার ডিম ছিলাম! কিস হয়নি আমাদের। সেফ অসুস্থতার অ্যাকটিং করে কয়েকটা দিন ছুটিতে কাটাচ্ছিলাম।
আমি পুরো হাঁ! তবে? ক্যামোফ্লেজিয়া………? যা ভাবছিলাম…তার সবটাই কি…!
–ক্যামোফ্লেজিয়া। হেসে ফেললেন ড. হিঙ্গোরানি–ক্যামোফ্লেজিয়ার ফমূলা শুনবে? বেশ, শোন তাহলে…।
এরপর ডক্টর যা বললেন তাতে আমার আরেকবার হার্টফেল করার মতো দশা হল…
.
ডক্টর হিঙ্গোরানি, ড. বসু ও ড. টোডি–তিনজনে মিলে গোপনে ক্যান্সারের উপর রিসার্চ করছিলেন। ক্যান্সারের ওষুধ বের করার চেষ্টা চলছিল। কাজ অনেকটাই গুটিয়ে এসেছে। অথচ এক্সপেরিমেন্ট এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য মূলধন অপর্যাপ্ত। সরকারি সাহায্য চাইলেন। প্রত্যাখ্যাত হল তাদের আবেদন।
এদিকে কাজ এগোনোর জন্য টাকা চাই। কী করণীয়?
এই সময়ে ডক্টর টোডির মাথায় এক অদ্ভুত বুদ্ধি জোগাল। তিনি বললেন যে, সরকার জীবনদায়ী ওষুধের পিছনে টাকা খরচ করে না। কিন্তু মারণাস্ত্রের পেছনে করবে। তাই তিনজনে মিলে তৈরি করলেন এই সাইলেন্ট কিলারের পরিকল্পনা! নতুন আবিষ্কারের উদ্দেশ্য নিয়ে নয়, সরকারের কাছ থেকে কিছু টাকা হাতানোর জন্য–যাতে তাদের গোপন আবিষ্কারের কাজ ঠিকঠাক চলতে পারে।
.
–তাহলে…আমরা যে দেখলাম…! ক্যামোফ্লেজিয়া এঁকে গিনিপিগগুলো মরল ……?
ড. বসুর সহাস্য উত্তর–ওগুলো রোগেভোগে কষ্ট পাচ্ছিল। তাই ভাবলাম মার্সিডেথ দিয়ে দিই। ত্রিশ মিলিগ্রাম অ্যাকোনাইট আগেই ওদের শরীরে পুশ করা ছিল। একদম সঠিক মাত্রায়, সঠিক টেম্পারেচারে। যাতে ঠিক একঘন্টা পরেই মারা যায়। আর ঠিক একঘন্টা পরেই তোমরা ডেমো দেখেছিলে।
আমি হাঁ। কী বলব বুঝতে পারছিলাম না।–তবে…তবে রঙ পাল্টানোর ব্যাপারটা…?
–ওটাও প্রযুক্তিবিদ্যার কারিকুরি ডিয়ার। ড. হিঙ্গোরানি হাসছেন–যে ডায়াসের উপরে আমি দাঁড়িয়েছিলাম তার ঠিক মাথার উপরই একটা ন্যানো প্রোজেক্টর ছিল। সেটা কন্ট্রোল করছিলেন ড. বসু। আমি সারফেসে যে রঙ রাখছিলাম উনি ঠিক সেইরকম আলোই প্রোজেক্টরের মাধ্যমে ফুলটার উপরে ফেলছিলেন। ওটার অরিজিনাল রঙ সাদা বলে মনে হচ্ছিল রঙ পালটে পালটে যাচ্ছে।
–আর ডক্টর টোডি?
ড. হিঙ্গোরানি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন–ওনার মৃত্যটা ওরিজিনাল। বড্ড ড্রিঙ্ক করছিলেন আজকাল। ওটা আমাদের প্ল্যানের মধ্যে ছিল না। কথা ছিল আমি কাঁচের মধ্যে যে ফুলটা ছিল সেটা একদম নষ্ট করে ফেলব, এবং মাথা ফাটিয়ে ক্যামোফ্লেজিয়া চুরি যাওয়ার নাটক করবো। আর সেটা করতে হবে কয়েকদিনের মধ্যেই। কারণ কয়েকদিন পরেই ডিফেন্স ক্যামোফ্লেজিয়া নিয়ে যাবে। তার আগেই…
–তাহলে ওটাও নাটক!
–হ্যাঁ। ড. হিঙ্গোরানি বললেন–ভেবেছিলাম যে ডিফেন্স মিনিস্ট্রি হতাশ হয়ে এমন জিনিস দ্বিতীয়বার আর তৈরি করার কথা বলবে না। কিন্তু তারা আমাদের উপর চাপ দিতে লাগল দ্বিতীয়বার ক্যামোফ্লেজিয়া তৈরি করার জন্য। কি করে এড়ানো যায় তাই ভাবছিলাম। এর মধ্যেই ড. টোডি হার্টফেল করলেন। ওঁর হাটের অবস্থা খারাপ ছিল। মৃতযুটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু ওঁর মৃতটাই আমাদের রাস্তা দেখিয়ে গেল। ঠিক তখনই দুজনে মিলে ঠিক করলাম এইরকম একটা নাটক করব। যাতে ডিফেন্স মিনিস্ট্রি হাড়ে হাড়ে টের পায় যে এইজাতীয় অস্ত্র কি মারাত্মক হতে পারে। তিনি হাসতে হাসতে বলেন–আশা করি এতদিন কোমায় থাকার পর ওরা আর আমাদের নতুন করে ফের জিনিসটা আবিষ্কার করতে বলবে না। যথেষ্টই ভয় পেয়েছে।
বিস্ময়ের প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছিলাম। ব্যাপারটা যত পরিষ্কার হচ্ছিল ততই নিজের গালে চড় মারার ইচ্ছেটা প্রবল হয়ে উঠছিল।
তা সত্ত্বেও আমার মনে একটা কিন্তু ছিল।
–ডিফেন্স মিনিস্ট্রির টাকাটার কি হবে?
–কী আর হবে? ডক্টর সুন্দর হাসলেন–ক্যামোফ্লেজিয়ার একটা মোটা টাকার ইনশিওরেন্স ঐ কথা ভেবেই করিয়ে রাখা হয়েছে। সেই টাকা থেকেই ওদের টাকা ফেরৎ যাবে। বাকি টাকাটা লাগবে আমাদের ক্যান্সার রিসার্চ প্রোজেক্টে।
–তার মানে ক্যামোফ্লেজিয়া…?
–ঐ নামে কিছু কোনওদিন ছিল না, এখনও নেই, আগামীতেও হবে না। তিনি দুষ্টু বাচ্চার মতো হেসে উঠলেন–তোমরা যা দেখেছো সেটা নেহাৎই একটা ঘাসফুল। আর বাদবাকি সব মায়া! একথা আগে আমরা তিনজন আর পরে এই নার্সিংহোমের ডক্টর জানতেন।তিনিও চমৎকার অ্যাকটিং করেছেন। আর এখন জানলে তুমি…।
আমি হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম! তাহলে এতদিন কিসের ভয় পেয়ে এসেছি……!
হঠাৎ করে প্রতাপের মুখটা মনে পড়ল। বড় কষ্ট হল ওর জন্য। বাড়িতে ফিরে ওকে বোঝানোর চেষ্টা করবো নিশ্চয়ই…
কিন্তু ও কি বুঝবে……?