চাঁদের অমাবস্যা – ৮

আট 

এক সময়ে দরজায় করাঘাত শুরু হয়। প্রথমে আস্তে, সন্তর্পণে; তারপর হঠাৎ সে- করাঘাত কেমন দ্রুত এবং জোরালো হয়ে ওঠে। নিঃসন্দেহে বাইরে-দাঁড়ানো মানুষটি ধৈর্যহারা হয়ে পড়েছে। 

যুবক শিক্ষকের ঘুমটা আলগোছে ভাঙে বলে তার মনে হয় সে জেগেই ছিল। করাঘাতে সে বিচলিত হয় না : সে-করাঘাত বিরক্তিকর কিন্তু তার দরজায় নয় যেন। অন্ধকারের মধ্যে চোখ খুলে পাশের দেয়ালের দিকে সে তাকিয়ে থাকে। সেখানে সূক্ষ্ম কারুকার্যের নক্শা কখন অদৃশ্য হয়ে গেছে। 

তারপর কাদেরের কণ্ঠস্বর এবং করাঘাত যুগপৎ শোনা যায়। এবার যুবক শিক্ষক বুঝতে পারে, কোনটা সত্য কোনটা অসত্য, কোনটা বাস্তব কোনটা অবাস্তব সে-বিষয়ে একটা সিদ্ধান্তে আসা প্রয়োজন। কিন্তু সিদ্ধান্তে পৌঁছুবার আগেই তার দেহ একটি গভীর অবসাদে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, মনে একটা অস্পষ্ট আশঙ্কার উপস্থিতি সম্বন্ধেও সে সচেতন হয়। 

দরজা খুললে বাইরে কাদেরের ছোটখাটো কিন্তু প্রশস্ত দেহটির ছায়া জেগে ওঠে। তাকে উপেক্ষা করেই যেন যুবক শিক্ষক একবার আকাশের দিকে তাকায়। রঙটা ঠিক ধরতে পারে না। না কালো না ধূসর; না আলো না অন্ধকার। সময় নির্ধারণ করা যেন সম্ভব নয়। তারপর শীতটা লাগে বলে দরজাটা ভেজিয়ে দেয়। 

ঘরের অন্ধকারের মধ্যে কাদের অনুচ্চ কিন্তু কেমন হুকুমের কণ্ঠে বলে ওঠে, ‘বাতি জ্বালান।’ 

যুবক শিক্ষক নীরবে বাতি জ্বালানোর কাজে মনোনিবেশ করে। প্রথমে দেশলাই খুঁজে পায় না; এখানে- সেখানে হাতড়ায়। অবশেষে দেশলাইটি যখন খুঁজে পায় তখন সে বুঝতে পারে, তার হাত একটু কাঁপতে শুরু করেছে। কিন্তু কেন? সে নিজেই বিস্মিত হয়। এতক্ষণে তার মনে আর কোনো সন্দেহ নাই যে, সে ডাকিয়ে পাঠিয়েছে বলেই কাদের এসেছে। সময়টা হয়তো একটু বেখাপ্পা, কিন্তু তার এ-আবির্ভাবের আর কোনো কারণ নাই। 

লণ্ঠনের মৃদু আলোয় ঘরের অন্ধকারটা অবশেষে কাটে। মশারি সরিয়ে কাদের বিছানার কোণে বসে। একবার তাদের চোখাচোখি হয়। তারপর কাদের কতক্ষণ নিশ্চল হয়ে বসে থেকে অকস্মাৎ আঙ্গুল মট্‌কাতে শুরু করে। দশ আঙ্গুল থেকে দশাধিক আওয়াজ বের করে সে পকেট থেকে সিগারেটের বাক্স বের করে একটি সিগারেট ধরায়। মুহূর্তের মধ্যে তার গন্ধে ছোট ঘরটি ভরে ওঠে। 

যুবক শিক্ষকের মুখে এখনো কথা সরে না। একবার সে ভাবে কাদেরকে জিজ্ঞাসা করে, কত রাত হয়েছে, কিন্তু কথাটি জানা নিষ্প্রয়োজনীয় মনে হয়। তবু তার কেমন সন্দেহ হয়, কাদের অন্য কোনো সময়ে এলেই ভালো হত। তাকে ডেকে পাঠাবার কারণটি সে যেন নিজেই এখন বুঝতে পারে না। তাই হয়তো মনে কেমন ভয়। তার হাত দুটিতে ঈষৎ কম্পন এখনো থামে নাই। 

অসংযত মনকে সংযত করবার চেষ্টা করে সে ভাবে, ভয়ের কিছু নাই। কাদেরকে ডেকে পাঠিয়েছিল, সে এসেছে। সেটাই বড় কথা। যার সঙ্গে দেখা করবার জন্যে এ ক’দিন সে এমন ব্যাকুল হয়ে ছিল, সে এখন দু-হাত দূরে বসে। ভয়ের কারণ কী? 

যে-বিশ্বাসটি নিয়ে সে শুয়ে পড়েছিল, তার কথা একবারও মনে হয় না। সেটি যেন সব-ভুলানো রূপকথা, যার মধ্যে তার বিহ্বল মন একটু শান্তির জন্যে আশ্রয় নিয়েছিল। এখন যে-কঠিন সত্যের সামনে সে দাঁড়িয়ে, সেখানে তার স্থান নাই। 

তবু সত্য কী? যাকে সে ডেকে পাঠিয়েছে সে তাকে ডেকে পাঠানোর কারণ জিজ্ঞাসা করলে কী উত্তর দেবে? ক-দিনব্যাপী মনের গভীর বিপর্যস্ততা সত্যে পরিণত করা কি সম্ভব? 

কাদের কোনো কথা না বললে যুবক শিক্ষক অবশেষে স্বস্তিই বোধ করে। আড়চোখে তার দিকে একবার তাকায়। অভ্যাসমতো লণ্ঠনের দিকে তাকিয়ে সে’ নিশ্চল হয়ে বসে, ভুবনভুবর্লোকে তার যেন কিছুই বলবার নাই। হয়তো কিছুক্ষণ এমনি বসে থেকে এক সময়ে হঠাৎ উঠে চলে যাবে। যুবক শিক্ষক ভাবে, সেটাই ভালো হবে। ব্যাখ্যা-কৈফিয়তের, প্রশ্ন-উত্তরের প্রয়োজন উঠবে না। না, সে কিছুই জানতে চায় না। যে-অন্ধকারাচ্ছন্ন গোলকধাঁধাঁয় সে প্রবেশ করেছে, সে-গোলকধাঁধা হতে সে বের হতে চায় না। অন্ধকারই শ্রেয়, কারণ অন্ততপক্ষে অন্ধকারে সে কিছুই দেখতে পায় না। 

নীরবতার মধ্যে হঠাৎ যেন একটা আওয়াজ হয়। চমকিত হয়ে যুবক শিক্ষক কাদেরের দিকে তাকায়। সে তারই দিকে তাকিয়ে। হাতে খোলা সিগারেটের বাক্স। 

‘সিগারেট খাবেন?’ 

যুবক শিক্ষকের সিগারেটের অভ্যাস নাই। একটু পরে ক্ষুদ্রকণ্ঠে সে উত্তর দেয়, ‘না।’ 

কাদের আরেকটি সিগারেট ধরায়। হয়তো কল্পনা, কিন্তু যুবক শিক্ষকের মনে হয়, কাদের কেমন অস্থির অস্থির বোধ করে। কিন্তু তার অর্ধনিমীলিত চোখের দিকে তাকিয়ে অস্থিরতার কোনো আভাস দেখতে পায় না। বরঞ্চ সেখানে যেন গভীর বিষাদের ছায়া। তারপর যুবক শিক্ষক অকস্মাৎ স্বচ্ছন্দ বোধ করতে শুরু করে। না, ভয়ের কোনোই কারণ নাই। বাস্তবজগতে যদি ভীতির কারণ থাকে তা এখন অতি দূরে, দিগন্তরালে কোথাও হবে। তবু দূরগত সে-ভীতি যদি তার মনে বন্ধুত্ব – সান্ত্বনার জন্যে ক্ষুধা সৃষ্টি করে থাকে, তবে কাদেরই তা মেটাতে পারে। হয়তো কাদেরের মনেও বন্ধুত্ব-সান্ত্বনার জন্যে তেমনি ক্ষুধা। সেও কি এ-ক’দিন মানসিক কষ্ট-যন্ত্রণা ভোগ করে নাই? দু-জনেরই বন্ধুত্বের বিশেষ প্রয়োজন। তারা একটি গুপ্তকথার মালিক। সে-গুপ্তকথা একাকী বহন করা যদি কষ্টসাধ্য হয়, তবে বন্ধুত্বের সাহায্যেই তারা তা অনায়াসে বহন করবে, মনের বিহ্বলতাও জয় করতে পারবে। 

লণ্ঠনের পতেটা বাঁকা বলে কাচের একপাশ ক্রমশ কালো হয়ে ওঠে, শীঘ্র তার অনুজ্জ্বল আলো আরো অনুজ্জ্বল হয়ে উঠবে। তারা কি অন্ধকারের জন্যে অপেক্ষা করছে? 

না, সত্যিই সে কিছুই জানতে চায় না। কাদেরের উপস্থিতিতেই সে সন্তুষ্ট। মনে যদি কোনো ইচ্ছা বোধ করে সে-ইচ্ছা কাদেরকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে, তাকে তার বন্ধুত্ব সম্বন্ধে নিশ্চিত করবার জন্যে। জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস মানুষের সহানুভূতি, সহৃদয়তা, স্নেহমমতা। সে-বিষয়ে নিশ্চিত হলেই মানুষ বিভীষিকা-নিষ্ঠুরতার দিকে নির্ভয়ে তাকাতে পারে। 

একটু হেসে দুঃসাহসীর কণ্ঠে যুবক শিক্ষক সজোরে বলে, ‘দিন্ একটা সিগারেট।’

সিগারেট হাতে নিয়ে কৌতুকভরে কিছুক্ষণ সেটি নেড়েচেড়ে দেখে, মুখে হাসি-মাখা দুষ্টু ছেলের কৃত্রিম ভাব। 

‘একবার বিড়িতে দু-একটা টান দিয়েছিলাম।’ 

ধূমপানের ব্যাপারে সে যে একেবারে অজ্ঞমূর্খ মানুষ নয়, সে কথা প্রকাশ করে সে আনাড়ির মতো সিগারেটটি জ্বালায়। প্রথম টানেই তার শ্বাসরোধ হবার উপক্রম হয়, তবু সে পিছপা হয় না। মনে হয়, অন্তরটা যেন আরো স্বচ্ছন্দ হয়ে ওঠে। তাছাড়া এ-কথাও সে অনুভব করে যে, দুজনের মধ্যে যেন বন্ধুত্বের পুল পড়ছে। 

‘মাথা ঘুরছে।’ সে-টি যে অতিশয় আনন্দেরই বিষয় তা কণ্ঠভঙ্গিতে পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিয়ে এবং তাতে বিন্দুমাত্র না দমে, সে ঘন ঘন ফুঁকতে থাকে : দৃষ্টি সিগারেটের জ্বলন্ত অংশ থেকে নড়ে না। কাদের নীরব হয়েই থাকে। সে-নীরবতা সম্বন্ধে সে সচেতন না হয়ে পারে না। 

‘ইস, সত্যিই চরকির মতো মাথাটা ঘুরছে।’ আবার মহা-উল্লাসে তার মস্তিষ্কের অবস্থার কথা ঘোষণা করে সে এবার একগাল ধোঁয়া ছাড়ে। মনে-মনে ভাবে, কী করে কাদেরকে এ-কথা বলে যে সত্যিই সে কিছু জানতে চায় না? সত্য হলেও সব স্বপ্ন বলে মেনে নিতে সে রাজি। যা ঘটেছে তা ঘটেছে—তা বিস্মৃতির মধ্যে বিলীন হয়ে গেলে ক্ষতি কী? অন্ততপক্ষে আজ কোনো কথাই সে তুলতে চায় না। 

‘কী করে রোজ এত সিগারেট খান?’ কৃত্রিম শ্রদ্ধা- বিস্ময়ে যুবক শিক্ষক মন্তব্য করে। কাদের জবাব দেয় না। 

হঠাৎ যুবক শিক্ষক বোঝে, এ ভাঁড়ামিপনা অর্থহীন, তাতে কাদের বিন্দুমাত্র আমোদ বোধ করছে না। আড়চোখে সে আবার তাকায় তার দিকে। তার চোখ প্রায় নিমীলিত। তবে তার কারণ যে নিদ্রা নয়, তা বুঝতে তার দেরি হয় না। কাদেরের মুখে একটি অস্বাভাবিক কাঠিন্য। 

কাদের কি তার উৎফুল্লতা এবং ভাঁড়ামিতে বিরক্ত হয়েছে? নিঃসন্দেহে সে একটু ভাঁড়ামি করেছে বটে কিন্তু সে ভাঁড়ামির কারণ আকস্মিক সুখবোধ। তার উৎফুল্লতায় কিছুটা কৃত্রিমতা যদি দেখা দিয়ে থাকে তার কারণ উৎফুল্লতা তার চরিত্রের স্বাভাবিক অঙ্গ নয় : সে জানে না তা কী করে প্রকাশ করতে হয়। অবশ্য সে কাদেরের বিরক্তির কারণ বোঝে। তার বিষাদাচ্ছন্ন মনে এ-মাত্রাহীন ভাঁড়ামি ও উৎফুল্লতা নিশ্চয়ই অত্যন্ত বিসদৃশ ঠেকেছে। উৎফুল্ল হবার কোনোই কারণ নাই। নদীর বুকে যুবতী নারীর দেহটি আবিষ্কার করে তারা কি তার সব পরিকল্পনা পণ্ড করে নাই? 

সিগারেটের কথা ভুলে গিয়ে যুবক শিক্ষক কতক্ষণ নিশ্চল হয়ে বসে থাকে। ঘরে প্রগাঢ় নীরবতা। সে-নীরবতার মধ্যে এবার যুবক শিক্ষকের মনে হয়, বিভীষিকাময় যে-অবাস্তব জগৎ থেকে সে মুক্তি পেয়েছে বলে কল্পনা করেছিল, সে- অবাস্তব জগৎ‍ই তার চারধারে পূর্বের মতোই তাকে ঘিরে আছে। গভীর হতাশার সঙ্গে সে ভাবে, সত্যিই সে কিছুই জানতে চায় নাই। এখনো সে জানতে চায় না। কাদের যদি তাকে তার বন্ধুত্বের সামান্য প্রমাণ দিত তবে ভাঁড়ামির কোনো প্রয়োজন বোধ সে করত না। কাদের কি বুঝতে পারে না বন্ধুত্বের জন্যে তার মনের এ তীব্র আকাঙ্ক্ষা? পরিকল্পনাটি নিঃসন্দেহে কাদেরেরই, তবু তার সংসাধনকার্যে পরম-বিশ্বাসীর মতো দ্বিরুক্তি না করে তাকে কি সে সাহায্য করে নাই? কিন্তু শুধু বিশ্বাসেই দিন কাটানো যায় না। কিছু পরিষ্কারভাবে না জেনে একাকী সে-ভার কী করে সে বহন করে? সে-ভার ক্রমশ আরো দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। 

কেমন কঠিন গলায় কাদের হঠাৎ ডাকে, ‘মাস্টার!’ 

এ-নামে সে যুবক শিক্ষককে কখনো ডাকে নাই। বস্তুত আজ পর্যন্ত কোনো নামেই সে তাকে সম্বোধন করে নাই। চমকিত হয়ে সে কাদেরের দিকে তাকায়। তবে সেখানে বন্ধুত্বের ক্ষীণতম আভাস সে দেখতে পায় না। 

তারপর এক মুহূর্তের জন্যে কাদেরের চোখ যেন ঝলকে ওঠে। পূর্ববৎকণ্ঠে সে আবার বলে, ‘আপনার মতলব কী?’ 

প্রশ্নটি যেন আকাশ থেকে পড়ে, বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো। তার মতলব? বিস্ময়ের ধমকটা কাটলে সে অনুচ্চস্বরে বলে, ‘আমার মতলব?’ 

কাদের তার প্রশ্নের কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন বোধ করে না বলে নীরব হয়ে থাকে। কিন্তু তার ভাব দেখে মনে হয়, সে যুবক শিক্ষকের কাছে এটি অর্থপূর্ণ উত্তর আশা করে। 

যুবক শিক্ষক কোনো উত্তরই খুঁজে পায় না। কাদেরের অপ্রত্যাশিত প্রশ্নটি তাকে যে ব্যথা দিয়েছে, কেবল সে ব্যথাই সে অনুভব করে। অনেক ভেবেও প্রশ্নটির যথার্থ কোনো কারণ দেখতে পায় না। 

কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে কাদের একবার এক পলকের জন্যে চোখ খুলে যুবক শিক্ষকের দিকে তাকায়। তারপর আবার প্রশ্ন করে, ‘ডাকাডাকি করতে শুরু করছেন কেন?’ 

নুতন প্রশ্নটিও যুবক শিক্ষক নীরবে শোনে। অতি সহজবোধ্য প্রশ্ন, তবু তারও অর্থ সে বুঝতে পারে না। তবে পূর্বের প্রশ্নের মতো এ-প্রশ্নটিও তাকে আঘাত দেয়। না, তাদের মধ্যে বন্ধুত্বের পুল তো পড়েই নাই, বরঞ্চ তারা প্রশস্ত নদীর দু-পাড়ে দাঁড়িয়ে। পাশে বসে থাকা কাদেরের চেহারাটা হঠাৎ অস্পষ্ট হয়ে ওঠে। না, এ-লোকটিকে সে চেনে না। 

একটু পরে দুর্বলকণ্ঠে সে উত্তর দেয়, ‘ডেকেছি এ কারণে যে আমি কিছুই বুঝতে পারি না।’

একটু ভেবে কাদের প্রশ্ন করে, ‘কী বুঝতে পারেন না?’ 

যুবক শিক্ষকের দুর্বলকণ্ঠের ওপর দিয়ে হঠাৎ দমকা হাওয়া বয়ে যায়। সজোরে মাথা নেড়ে সে উচ্চস্বরে বলে, ‘কিছুই বুঝতে পারি না।’ 

এই কথার পুনরাবৃত্তিতে কাদের সন্তুষ্ট হয় না। তার মুখে বিরক্তির ভাব দেখা দেয়। কণ্ঠেও সে বিরক্তি প্রকাশ পায়। 

‘কী বুঝতে পারেন না?’ 

যুবক শিক্ষক এবার বিহ্বল হয়ে পড়ে। সে যেন শক্ত ফাঁদে পড়েছে, যে-ফাঁদ থেকে সে অক্ষতদেহে বের হতে পারবে না। কিছুক্ষণ আগে যার সঙ্গে সে একটা বন্ধুত্বের সম্ভাবনা কল্পনা করে কেবল তার উপস্থিতিতেই সুখবোধ অনুভব করতে শুরু করেছিল, সে-ই তাকে এ-ফাঁদে ফেলেছে। সে বন্ধু না হোক, শত্রু হবে কেন? না, তাকে কিছুই বলা যায় না। যা সে বুঝতে পারে না তা যেন অতি মূল্যবান। তা ব্যক্ত করা যায় না। একটু হাওয়া লাগলেই তা ভেঙে যাবে। 

‘কথা বলছেন না কেন?’ 

আবার কাদেরের কঠিন গলা তার কর্ণগোচর হয়। এবার তার গলায় সে বিচলিত হয় না। কাদেরের প্রশ্নের উত্তর দেবার কোনোই প্রয়োজন সে বোধ করে না। কাদের তার সঙ্গে যেন বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তার অন্তরটা অভিমান- ক্রোধে জমে যায়। 

নাকে বিরক্তি-ক্রোধের আওয়াজ করে কাদের এবার চুপ হয়ে যায়। তাকে ডেকে পাঠিয়ে যুবক শিক্ষকের এ অদ্ভুত ব্যবহার তার কাছে অর্থহীন মনে হয়। 

কিছুক্ষণ নীরবতার পর কাদেরের মনোভাবে হয়তো কিছু পরিবর্তন হয়। যুবক শিক্ষকের দিকে তাকিয়ে সে আস্তে বলে, ‘শোনেন।’ 

যুবক শিক্ষক যে শোনবার জন্যে তৈরি তার কোনো প্রমাণ না পেলেও একটু থেমে আবার বলে, ‘মানুষের জীবনটা অতি ভঙ্গুর। একটুতেও মটকে যায়।’ 

এ-গভীর দার্শনিকোচিত উক্তিটি যুবক শিক্ষকের কানে গেল কি গেল না, তা বোঝা যায় না। সে তেমনি স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। একটু থেমে কাদের আবার বলে, ‘একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে, কী আর করা যায়? ডাকাডাকি করে আর লাভ কী?’ 

এবারও যুবক শিক্ষক নির্বাক হয়ে বসে থাকে। কিন্তু ক্রমশ তার বসে থাকার ভঙ্গিতে পূর্বের অভিমান-ক্রোধের কঠিনতা যেন মিলিয়ে যায়। মনে হয়, সে যেন গভীরভাবে ভাবছে। এমন একটা নিগূঢ় কথা যার রহস্য ভেদ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়, তারই রহস্য ভেদ করবার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। না, ঠিক তা নয়। একটি কথা তার মাথায় ঢোকবার চেষ্টা করছে, তাকে ঠেকিয়ে রাখবার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু সে-কথাটি তার চেয়েও বেশি শক্তিবান। তাকে ঠেকাবার চেষ্টায় সে কেবল গলদঘর্ম হয়ে ওঠে। 

সে-কথাকে ঠেকানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। যে-টুকু শক্তি ছিল সে-শক্তিও নির্বিবাদে অন্তর্ধান করেছে। কী দিয়ে সে তার সঙ্গে লড়াই করবে? লড়াইর ছলনা পরিত্যাগ করতেই গভীর অবসাদে তার দেহমন ভরে ওঠে। 

বাইরে উঠানে মৃদু আলোর আভাস দেখা দিয়েছে। ভেজানো দরজার ফাঁক দিয়ে সেদিকে একবার অকারণে তাকিয়ে কাদের কেমন হৃদ্যতার সঙ্গে বলে, ‘বুঝলেন?’ 

যুবক শিক্ষক সবই বোঝে। প্রথম থেকেই সে সব কথা বুঝেছিল, কিন্তু মন স্বীকার করতে চায় নাই। ঘটনার নৈকট্যে তা না বুঝে উপায় ছিল না, কিন্তু কিছু সময় পেরিয়ে গেলে কথাটা মন আর মানতে চায় নাই। তারপর থেকে সে সত্যকে এড়াবার জন্যে বাঁদরের মতো কল্পনার গাছের এক শাখা থেকে অন্য শাখায় ঝুলে ঝুলে বেড়াচ্ছে। সত্যটি গ্রহণ করা কি এত সহজ? একবার গ্রহণ করলে চিরকালের জন্যে জীবনে একটা ফাটল ধরবে না? তারপর কি পৃথিবী সে-ই পৃথিবী থাকবে? 

‘বুঝেছি।’ অকস্মাৎ ঘন-ঘন মাথা নেড়ে যুবক শিক্ষক বলে। 

বোঝা কি অতই শক্ত ব্যাপার? বোঝা-না-বোঝার মধ্যে ব্যবধান অতি সামান্য। চুলের মতো সরু সীমারেখার ওপারেই সত্য। এধারে আশা-ভরসা, ওধারে হতাশা-নিরাশা। পা বাড়ালেই ওধারে চলে যাওয়া যায়, তবু সে সীমারেখা সে অতিক্রম করতে চায় নাই। সীমারেখাটি যাতে অতিক্রম করতে না হয় তার জন্যে সে কাদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করার চেষ্টা করেছে, তাকে অশেষ গুণাগুণেও আবৃত করেছে যাতে সে-প্রয়াসে সে সফল হয়। 

আবার ঘন-ঘন মাথা নেড়ে যুবক শিক্ষক আপন মনে বলে, ‘কেন বুঝব না? আপনি আমার আত্মীয়-কুটুম্ব বা দোস্ত মানুষও নন, বুঝতে বাধা কী?’ শুধু তা-ই নয়, তার সঙ্গে যুবক শিক্ষকের পরিচয়ও ছিল না। মুখ দেখাদেখি হয়েছে বটে, কিন্তু কখনো কথার আদান-প্রদান হয় নাই। তবু কথাটা সে বিশ্বাস করতে চায় নাই। আত্মীয়স্বজন বা বন্ধ মানুষ না হোক, পরিচয়ও না থাক, একটি মানুষের সম্বন্ধে এমন কথা বিশ্বাস করা কি সোজা? 

যুবক শিক্ষকের আচরণে কাদেরের স্থৈর্য একটু টলে ওঠে যেন। ইতস্তত করে সে বলে, ‘কী বুঝেছেন!’ 

‘বুঝেছি, বুঝেছি।’ আবার যুবক শিক্ষক দ্রুতভাবে মাথা নেড়ে বলে, কণ্ঠে এবার কোনো দুর্বলতার চিহ্ন নাই। সে এ-কথা বুঝে তৃপ্তি পায় যে, বঞ্চনার আঘাতের ফলে মনে যে একটি অসহনীয় তিক্ততার ভাব এসেছিল, সে ভাব এখন ক্রোধে চাপা পড়েছে। এখন ক্রোধ দাউ-দাউ করে জ্বলছে, এবং সে-ক্রোধে সে গভীর তৃপ্তিই পায়। বারবার একটি কথা মনে পড়ে, বারবার সে-ক্রোধ ফুঁসে ওঠে। কী দুঃসাহস! যাকে কাদের হত্যা করেছে, তার দেহ নদীতে ফেলবার জন্যে তারই সাহায্য নিতে তার একটু দ্বিধা হয় নাই? বুকে কত সাহস! শীর্ণদেহ যুবক শিক্ষক আগুনের লেলিহান শিখায় যেন দীর্ঘকায় হয়ে ওঠে, তার রক্তহীন শুষ্ক মুখ যেন অত্যুজ্জ্বল রূপ ধারণ করে। না, শুধু দুঃসাহস নয়। অন্য মানুষের প্রতি কী অবজ্ঞা! যুবক শিক্ষক যেন তুচ্ছ কীটপতঙ্গ। এত ক্রোধ সত্ত্বেও যুবক শিক্ষক নিষ্কম্পকণ্ঠে বলে, ‘আপনার সাহসের সীমা নাই।’

কাদের কথাটি বুঝবার চেষ্টা করে। তারপর কী বুঝে উত্তর দেয়, ‘ভয় পেলে মানুষ কী না করে? মানুষের গলার আওয়াজ পেলে জ্ঞানবুদ্ধি লোপ পেয়েছিল। বললাম না দুর্ঘটনা? দুর্বল সুতায় জীবন বাঁধা। জীবন কী?’ 

যুবক শিক্ষক উত্তর দেয় না। মনে হয় কাদেরের কোনো কথা তার শ্রবণেন্দ্রিয় গ্রহণ করতে রাজি নয়। তার কথার কি আর কোনো মূল্য আছে? 

তার মানসিক অবস্থা দেখে কাদেরের মনে এবার হয়তো কিছু ভয়ের সঞ্চার হয়। তার এ বিচিত্র আচরণের কোনো অর্থই খুঁজে পায় না। কিন্তু যুবক শিক্ষককে আর কী বলবে? সে নীরব হয়ে থাকে। 

ক্রোধ অবশেষে উপশমিত হলে যুবক শিক্ষক কতক্ষণ নিঃস্ব বোধ করে। তারপর অস্ফুটকণ্ঠে বলে, ‘যান, বাড়ি যান।’ কাদেরের উপস্থিতিতে সে ভীষণ অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করেছে। 

কাদের যাবার কোনো লক্ষণ দেখায় না। তাকে একটু অন্যমনস্ক মনে হয়। তারপর হঠাৎ সে অপ্রত্যাশিতভাবে কথা বলতে শুরু করে। অনেকটা আপন মনেই। তাছাড়া, কেমন ইশারা-ইঙ্গিতেই বলে যেন। মনের কথা খুলে বলার তীব্র ইচ্ছা বোধ করলেও সব খুলে বলতে যেন বাধে। হয়তো যা বলে তার অর্থ সে নিজেই বোঝে না। প্রথমে সে আশ্বিন মাসের কথা বলে। কেন সে মাসের কথা বলে তা প্রথমে পরিষ্কার ভাবে বোঝা যায় না। কিন্তু একটু নীরব থেকে কথাটি বোধগম্য করে। আশ্বিন মাসেই যুবতী নারীর সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। 

যুবক শিক্ষক তার কথা শুনেও শোনে না। শুনে লাভ কী? যে-কথাটি সে জানতে পেরেছে তারপর আর কোনো কথা জানার প্রয়োজন সে বোধ করে না। যে-কলুষতা সে সমগ অন্তরে সমগ্র দেহে বোধ করে সে-কলুষতা কোনো কথায় কি কাটবে? তাছাড়া, কাদেরের কণ্ঠস্বর তাকে পীড়া দেয়। 

আশ্বিন মাসের কথাটার উল্লেখ করেই চার মাস ডিঙিয়ে কাদের সেদিনের বাঁশঝাড়ের ঘটনায় এসে পৌঁছায়। হয়তো সে চার মাসে উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটে নাই, ঘটলেও তার আর কোনো মূল্য নাই। বাঁশঝাড়ের কথা বলতে-বলতে তার বলার ভঙ্গিটা কিছু সাবলীল হয়ে ওঠে। 

শীঘ্র তাকে বাধা দিয়ে যুবক শিক্ষক আবার বলে, ‘যান, বাড়ি যান।’

এবার নীরব হয়ে কাদের কতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকে। তারপর কালো মুখে কিন্তু সহিষ্ণুকণ্ঠে বলে, ‘ঘটনাটা বুঝিয়ে বলছি।’

এ-উক্তিটা যুবক শিক্ষকের অসহ্য মনে হয়। কী তাকে সে বোঝাবার চেষ্টা করছে? যে-কথাটি জানতে চায় নাই বা বিশ্বাস করতে চায় নাই, সে কথা সে জানতে পেরেছে। তারপর বাকি সব কি অর্থহীন নয়? কাদের যে-কথা এখনো পরিষ্কারভাবে বোঝে নাই, সে- কথাই সে এবার তাকে বলে। 

মুহূর্তের মধ্যে কাদেরের মুখে গভীর বিস্ময়ের সঞ্চার হয়। ক্ষিপ্রগতিতে ঘুরে সে কতক্ষণ যুবক শিক্ষকের দিকে বিচিত্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। অবশেষে সে প্রশ্ন করে, ‘আপনি জানতেন না?’ 

যুবক শিক্ষক উত্তর না দিলেও শীঘ্র কাদেরের মুখ ক্রোধে বিকৃত হয়ে ওঠে, তার স্বাভাবিক গভীর স্থৈর্য ভীষণভাবে টলে ওঠে। সে যে হত্যাকারী সে-কথা যুবক শিক্ষক জানত না? এবং সে-কথা সে নিজেই তাকে বলেছে? 

যুবক শিক্ষক এবার চিৎকার করে ওঠে, ‘যান যান।’ তার মনে হয়, কাদেরের দেহ থেকে কলুষতা সমাপ্তিহীন ধারায় তার মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছে, আর তার উপস্থিতি সহ্য করা অসম্ভব। 

কাদের আপন ভাবনায় নিমজ্জিত হয়ে আরো কিছুক্ষণ বসে থাকে। এক সময়ে আর দ্বিরুক্তি না করে সে উঠে চলে যায়। সে কোনোদিকে তাকায় না। 

বাইরে উঠানে তখন সূর্যের প্রথম সোনালি রশ্মি পড়েছে, দূরে মাঠে কুয়াশাও জমতে শুরু করেছে। যুবক শিক্ষক বোধ করে তার গলা-মুখ শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। অত্যধিক তৃষ্ণায় তার ভেতরটা যেন জ্যৈষ্ঠের রোদপোড়া মাঠের মতো চড়চড় করে। 

 ঘরের কোণে সুরাহিতে শীতল পানি। কিন্তু সে নড়ে না। 

আপন মনে সে প্রশ্ন করে, অবশেষে সে কি অবাস্তব জগৎ থেকে প্রত্যাবর্তন করেছে?

বাস্তব জগতে সে যদি প্রত্যাবর্তন করে থাকে, তবে সেখানেও অতৃপ্তির জ্বালার শেষ নাই যেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *