চাঁদের অমাবস্যা – ১২

বারো 

অবশেষে যুবক শিক্ষকের পক্ষে বাঁশঝাড়ের নির্মম ঘটনাটি নিরপেক্ষ দর্শকের পরিচ্ছন্ন দৃষ্টিতে দেখা সম্ভব হয়। চন্দ্রালোক দিবালোকে পরিণত হয়েছে। সে-দিবালোকে একটি নিহত যুবতী নারীর অর্ধ-উলঙ্গ দেহ স্পষ্টভাবে সে দেখতে পায়। শুধু তাই নয়। হত্যাকারীর পক্ষেও কোথাও গা-ঢাকা দেবার উপায় নাই। 

না, ঘটনাটিতে আর কোনো জটিলতা নাই। একসময়ে ফৌজদারি আদালতে বাদীপক্ষ সেটি এ-ভাবেই পেশ করবে তাতে সন্দেহ নাই। 

বড়বাড়ির প্রধান মুরুব্বি আলফাজউদ্দীন চৌধুরী সাহেবের কনিষ্ঠভ্রাতা কাদের চৌধুরী নিষ্কর্মা মানুষ। কয়েক মাস আগে বিবাহিত এবং ভদ্রবংশীয় সে নিষ্কর্মা মানুষটি তাদের গ্রামেরই একটি দরিদ্র মাঝির সন্তানহীনা যুবতী স্ত্রীর সঙ্গে কোনো প্রকারে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন করে। কার্যোপলক্ষে স্বামীটিকে প্রায়ই গ্রামছাড়া হতে হয়। তখন ঘরে থাকে তিনজন মেয়েমানুষ : মাঝির স্ত্রী, বৃদ্ধা মা এবং কানা বোন। অবস্থা অনুকূল হলেই কাদের যুবতী নারীর সঙ্গে গোপনে দেখা-সাক্ষাৎ করে। মাঝির ঘরটা গ্রামের একপ্রান্তে। নিকটে একটু জঙ্গলের মতো। সেখানে একটা বৃহদাকার বাঁশঝাড়। সে বাঁশঝাড়ের মধ্যে ক্ষুদ্র খোলা স্থানে তাদের গোপনমিলন হয়। ধর্মনীতিবিরুদ্ধ অবৈধ এ- মিলনের কারণ কী? যুবতী নারী আজ মৃতা। তার মনে কী ছিল তা আজ জানা সম্ভব নয়। তবে তার সঙ্গে কাদেরের সম্পর্কের কারণ নিঃসন্দেহে বলা যায়। সে-কারণ ইন্দ্রিয়পরায়ণতা। 

দিন-কয়েক পূর্বে বড়বাড়ির আশ্রিত যুবক শিক্ষক আরেফ আলী গভীর রাতে কাদেরকে বাড়ি ত্যাগ করে গ্রাম-অভিমুখে যেতে দেখে। তার জ্যেষ্ঠভ্রাতার মতে সে দরবেশ। কথাটা বিশ্বাস না-হলেও কাদের সম্বন্ধে যুবক শিক্ষক কৌতূহল বোধ করে। সে ভাবে, কাদেরকে অনুসরণ করে দেখে অত রাতে কী উদ্দেশ্যে সে ঘর থেকে বেরিয়েছে। অবশ্য খারাপ কিছু সে সন্দেহ করে না। 

শীঘ্র সে কাদেরকে হারিয়ে ফেলে। তারপর উজ্জ্বল জ্যোৎস্নালোকে তার কথা ভুলে সে কিছুটা উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াতে থাকে। হয়তো কাদেরকে আবার দেখতে পাবে সে-আশাটা এখনো সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করে নাই। তারপর একসময়ে নদীর কাছে বাঁশঝাড়ের নিকটবর্তী হতেই একটি মানুষের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলে তার বিস্ময়ের অবধি থাকে না। ঠিক চিনতে না পারলেও তার সন্দেহ থাকে না যে কণ্ঠস্বরটি কাদেরেরই। দ্বিতীয় কোনো কণ্ঠস্বর শুনতে না পেলে তার মনে হয়, কাদের হয়তো অদৃশ্য কোনো আত্মার সঙ্গে কথালাপ করছে। সে কি সত্যই দরবেশ? তার কথা ভালো করে শুনবার জন্যে সে বাঁশঝাড়ের দিকে এগিয়ে যায়। তখন শুকনা পাতায় তার পা পড়লে হঠাৎ আওয়াজ হয়, হয়তো ভয় পেয়ে সে নিজেও কিছু বলে ওঠে। এবার বাঁশঝাড়ে কণ্ঠস্বরটি থেমে যায়। কিছুক্ষণ পর যুবক শিক্ষক আবার রাখালের মতো ডেকে উঠলে যুবতী নারী ভয় পেয়ে সামান্য চিৎকার করে ওঠে। 

বাঁশঝাড়ের বাইরে মানুষের আওয়াজ শুনতে পেলে কাদের ভেবেছিল হয়তো যুবতী নারীর স্বামীই তার স্ত্রীর সন্ধানে এসেছে। এবার যুবতী নারী চিৎকার করে উঠলে সে নিদারুণ ভয়ে দিশেহারা হয়ে যুবতী নারীকে চুপ করাবার জন্যে তার গলা টিপে ধরে। প্রাণের জন্যে যুবতী নারী যতই ধ্বস্তাধ্বস্তি করে ততই দিশেহারা কাদের তার হস্তবন্ধন শক্ত করে। শীঘ্র যুবতী নারীর জীবনাবসান ঘটে। কাদেরের মতে, সে-নিদারুণ ভীতির কারণ তার পরিবারের নামযশ। সে-পরিবারের মানুষ চরম ব্যভিচারে লিপ্ত তা প্রকাশ পেলে যে ভয়ানক পরিণাম হবে সে পরিণামের কথা স্মরণ হওয়াতে তার সমস্ত জ্ঞানবুদ্ধি হঠাৎ লোপ পায়। যখন সে বুঝতে পারে যুবতী নারীর দেহে প্রাণ নাই, তখন সে বাঁশঝাড়ের পেছন দিয়ে পালিয়ে যায়। 

তারপর কাদের একটু ভুল করে। কিছুদূরে গিয়ে তার সন্দেহ হয়, হয়তো সবটা কানেরই ভুল। ভুলবশত সে কি এমন গুরুতর কাণ্ড করে বসেছে? তাছাড়া, বাঁশঝাড়ের সামনে কেউ যদি এসেও থাকে, সে যে হত্যাকাণ্ডের কথা জানতে পেরেছে তার প্রমাণ কী? ভাবে, বাঁশঝাড়ের সামনের ভাগটা একবার দেখে এলে ক্ষতি কী! ফলে যুবক শিক্ষকের সঙ্গে তার দেখা হয়। সে-রাতে তার বিচিত্র আচরণ দেখে তার মনে সন্দেহ থাকে না যে, সে যে শুধু মৃত নারীর কথা জানে তা নয়, হত্যাকারী কে তাও সে জানে। যুবক শিক্ষক যে কিছু দেখে নাই, কাদের যে হত্যাকারী সেটা যে কেবল তার একটি খেয়াল, সে-কথা বোঝা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। 

পরদিন যুবক শিক্ষক ঘটনাটি প্রকাশ করবে সে-কথাই কাদেরের কাছে স্বাভাবিক মনে হয়। তবে সে বুঝতে পারে, সাক্ষীর অভাবে অভিযোগটা প্রমাণ করা তার পক্ষে সহজ হবে না। একটি মানুষের বিরুদ্ধে আরেকটি মানুষের কথা। অতএব যুবক শিক্ষকের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ আনার জন্যে সে তৈরি হয়ে থাকে। সে বোঝে, প্রথমে যে অভিযোগটি আনবে তারই অপেক্ষাকৃত বেশি লাভ থাকবে কিন্তু নিজে অপরাধী বলেই হয়তো তার পক্ষে আক্রমণটা শুরু করা সম্ভব হয় না। যুবক শিক্ষক কথাটি প্রকাশ করলে সে কী-পাল্টা জবাব দেবে তা সে ঠিক করে রাখে। সে বলবে, মৃতদেহটি সে স্বচক্ষে দেখেছে এবং যুবক শিক্ষককেও বাঁশঝাড়ের কাছাকাছি দেখেছে। অবশ্য যুবক শিক্ষকই যে হত্যাকারী সে কথা সে সরাসরি না বললেও তার ওপর সন্দেহ ফেলতে দেরি হবে না। তাছাড়া, তার দরবেশী সুনামের জন্যে সে রাতভ্রমণেরও একটা সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারবে। উপরন্তু, তার পরিবারের নামযশ প্রতিপত্তিও তাকে সাহায্য করবে। 

তাকে কিছুই করতে হয় নাই। পরদিন যুবক শিক্ষক নিয়মিতভাবে বড়বাড়িতে এবং ইস্কুলে শিক্ষকতা করে, রাত্রির ঘটনা কাউকে বলে না। তার ব্যবহারে কাদের বিস্মিতই হয়। তারপর তার নীরবতার একটি কারণই সে দেখতে পায়। যুবক শিক্ষকই তাদের আশ্রিত বলে চক্ষুলজ্জার জন্যেই হোক বা সাহসের অভাবেই হোক, সে নীরব থাকাই সমীচীন মনে করেছে। 

হত্যাকাণ্ডটি প্রকাশ পায় নাই সে-বিষয়ে নিশ্চিন্ত হলে এবার কাদেরের মন বাঁশঝাড়ে পরিত্যক্ত মৃতদেহটির প্রতি যায়। রাত্রি হলে সে বুঝতে পারে, যুবক শিক্ষক তো কথাটি বলেই নাই, মৃত দেহটিও এ-পর্যন্ত অনাবিষ্কৃত রয়েছে। সেটা তার কাছে অতি সৌভাগ্যের ব্যাপার বলেই মনে হয়। তবে সে এ-কথা উপলব্ধি করে যে, প্রথম দিন যে-কোনো কারণে তার প্রতি ভাগ্য অতি সুপ্রসন্ন থেকেছে, দ্বিতীয় দিনেও এমন সুপ্রসন্নতা আশা করা বাড়াবাড়ি হবে। নিখোঁজ নারীর সন্ধান চলছে, দেহটি আবিষ্কার করতে দেরি হবে না। স্থিরমস্তিষ্কে ব্যাপারটি বিবেচনা করে সে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, দেহটি অদৃশ্য হয়ে গেলেই সে সম্পূর্ণভাবে নিরাপদ বোধ করতে পারবে। যুবতী নারীর দশা না জানলে তার হত্যার কথা কেউ সন্দেহ করবে না, হত্যাকারীকেও সন্ধান করবে না। 

দেহটি গোর দেবার কথাটা ভেবে দেখে নদীতে ফেলাটাই সে সমীচীন মনে করে। তবে পন্থাটি মনঃপূত হলেও তা কম অপ্রীতিকর মনে হয় না। এ-সময়ে তার মাথায় খেয়াল আসে, সে-ব্যাপারে যুবক শিক্ষকের সাহায্য সে নেয় না কেন? খেয়াল হিসেবে যে-কথাটা তার মনে আসে, ভেবে দেখার পর তা তার ভালোই লাগে। দু-জন মানুষের পক্ষে কাজটি সম্পন্ন করতে দেরি হবে না, সাথী পেলে সেটি কাদেরের কাছে ততটা ন্যাক্কারজনকও মনে হবে না। তাছাড়া, কাদের এ-কথাও বুঝতে পারে যে, যে-লোকটি সব জেনেও কথাটি এ-পর্যন্ত প্ৰকাশ করে নাই, তাকে দেহ বহনের ব্যাপারে একবার জড়িত করতে পারলে চিরকালের জন্যে তার মুখ বন্ধ করা সহজ হবে। অবশ্য সে সাহায্য করতে রাজি হবে কিনা সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হতে পারে না, কিন্তু ভাবে, চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কী! তাছাড়া, যুবক শিক্ষকের চোখে নিজেকে দোষমুক্ত করার একটা ক্ষীণ আশাও মনে মনে পোষণ করে। কে জানে একটি আজগুবি কথা বলে নিরীহ-সাদাসিধে লোকটির মনকে হয়তো অন্যপথে চালু করে দিতে সক্ষম হবে। সবদিক থেকে কথাটি তার পছন্দ হয়। 

যুবক শিক্ষক বিনাতর্কে তাকে সাহায্য করতে রাজি হয়। প্রথমে সামান্য ভয় পায়, তার প্রস্তাবটিও হয়তো পরিষ্কারভাবে বোঝে না, কিন্তু দ্বিরুক্তি না করে তার সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে। পরে কাজটির সামনাসামনি হলে সে ভীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কোনো প্রকারে দেহটি বহন করলেও নদীর পাড় দিয়ে নাবতে গিয়ে সে এভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যে আর ওঠে না। বাকি কাজটি কাদের একাকীই করে। পরে ধরাশায়ী যুবক শিক্ষকের দিকে তাকাতেই একটি ব্যাপারে সে নিঃসন্দেহ হয়। যুবক শিক্ষক মেরুদগুশূন্য ব্যক্তি। প্রয়োজন হলেও তাকে বেশি ভয় দেখাতে হবে না, একটুকুতেই তাকে কাবু করা যাবে। পাড় বেয়ে উঠে কাদের নিশ্চিন্তচিত্তে বাড়ি ফিরে যায়। 

দুর্ভাগ্যবশত পরে রাতের বেলায় কোম্পানির জাহাজের সারেঙ্গ যুবতী নারীর দেহটি নদীতে ভাসতে দেখে। তার পরিকল্পনাটি কার্যকরী হল না দেখে কাদের অতিশয় নিরাশ হয় কিন্তু সে আর কী করতে পারে? অবশ্য যুবক শিক্ষকের দিক থেকে কোনো বিপদ সে আশঙ্কা করে না, তাই তাকে কোনো কথা বলার প্রয়োজনও বোধ করে না। যে-মানুষ সত্যকথা জেনেও এবং মৃতদেহটি বহনকার্যে তাকে সাহায্য করেও কাউকে কিছু বলে নাই, এখন দেহটি খুঁজে পাওয়া গেছে শুনে সে হত্যাকাণ্ডের কথাটি প্রকাশ করবে তা যুক্তিসঙ্গত মনে হয় না। 

তারপর যুবক শিক্ষক তাকে ডেকে পাঠায়। প্রথমে সে ঠিক করে যাবে না। ঘটনাটির বিষয়ে তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার বা ষড়যন্ত্রের কোনো প্রয়োজন দেখে না। না গেলে যুবক শিক্ষক এ-কথাও বুঝতে পারবে যে, ব্যাপারটি ভুলে যাওয়াই বাঞ্ছনীয়। তবু পরে কেমন অস্বস্তি এবং কৌতূহল হলে সে যুবক শিক্ষকের ঘরে হাজির হয়। যুবক শিক্ষকের ব্যবহার কিন্তু তার বোধগম্য হয় না। পরিষ্কার করে সে কিছু বলে না, যেটুকু বলে তাও অসংলগ্ন মনে হয়। কাদেরের সন্দেহ হয়, যুবক শিক্ষকের মনে যেন একটা কুমতলব। এ-সময়ে একটি কথা জানতে পেরে তার অনুশোচনার শেষ থাকে না। কথাটি এই যে, কাদের যে হত্যাকারী তা যুবক শিক্ষক নিশ্চিতভাবে জানত না। যেটুকু অনিশ্চয়তা ছিল তা কাদের নিজেই দূর করেছে। 

কথাটি জানতে পেরে যুবক শিক্ষকও কেমন বিচলিত হয়ে পড়ে, তার ব্যবহারও আরো বিচিত্র হয়ে ওঠে। সে যেন একটা বিভ্রমের ঘোরে ছিল, সে ঘোরটা কেটেছে। কিন্তু তবু তার ব্যবহার বোধগম্য না হয়ে আরো দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। কাদের একটি উপসংহারেই উপনীত হতে সক্ষম হয়। সত্যকথা জানতে পেরে যুবক শিক্ষক একটি বিকৃত আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছে। 

দ্বিতীয় বার সে নিজেই যুবক শিক্ষকের কাছে হাজির হয়। মনে অশান্তি। তাছাড়া, সেদিন সকালে দাদাসাহেব যুবক শিক্ষককে ডেকে পাঠিয়েছিলেন সে কথা সে জানে। 

যুবক শিক্ষককে এবার অপেক্ষাকৃত শান্ত মনে হয়। তাছাড়া মনে হয়, তার যেন কী একটা কথা বলার আছে। তার আচরণ-ব্যবহারে কোনোপ্রকার বিরুদ্ধতা প্রকাশ পায় না বলে কাদের ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে। সে কোনো কথা বলতে আসে নাই, জানতেই এসেছে। 

অবশেষে যুবক শিক্ষক তার মনের কথাটি কোনোপ্রকারে প্রকাশ করে। বলতে গিয়ে তার মুখ লাল হয়ে ওঠে, শব্দগুলিও ঠিকভাবে সরে না। যা বলে তা-ও অতিশয় বিচিত্র শোনায়। তার মর্মার্থ এই যে, যুবতী নারীর প্রতি প্রণয়ের কথাটা কাদের বলে নাই। সে-কথাটি বিশেষ জরুরি এই কারণে যে অপরাধটি ক্ষমার্হ কি ক্ষমার্হ নয় তা তার উত্তরের ওপরই নির্ভর করে। যুবক শিক্ষকের বক্তব্যটি এতই অপ্রত্যাশিত এবং অপ্রাসঙ্গিক মনে হয় যে কাদের স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। এ কী ধরনের কথা? কাদের কি একটি বদ্ধপাগল মানুষের হাতে পড়েছে? বাঁশঝাড়ের ঘটনাটি ভয়ানক গুরুতর কিন্তু কী করে লোকটি প্রেমের কথা ভাবতে পারছে? তাছাড়া, নারী- পুরুষের সম্পর্কের কারণ কি শুধুমাত্র প্রেম? না, লোকটি নিঃসন্দেহে উন্মাদ। তা না হলে এমন অহেতুক কথার উত্থাপন করবে কেন? কাদের হঠাৎ রাগে অন্ধ হয়ে পড়ে। সে-ক্রোধ সামলানো তার পক্ষে সহজ হয় না। তারপর যুবক শিক্ষকও অকারণে বেসামাল হয়ে পড়ে। তার মধ্যে যেন একটা বিষম মানসিক সঙ্কট উপস্থিত হয়। অবশেষে সে পরিষ্কারভাবেই ঘোষণা করে যে, তার পক্ষে কাদেরকে ক্ষমা করা আর সম্ভব নয়। 

লোকটি যে উন্মাদ সে-বিষয়ে কাদেরের এবার আর কোনো সন্দেহ থাকে না। অবস্থার গুরুত্ব বুঝতে পেরে সে এবার সত্যিই ভয় পায়। ফলে, যুবক শিক্ষককে ভয় দেখানো অত্যন্ত প্রয়োজন মনে করে। যুবক শিক্ষক একটু সুস্থির হলে সে তাকে পরিষ্কারভাবে বলে যে, কথাটা প্রকাশ করলে তার সর্বনাশই হবে। কিন্তু ভয়-প্রদর্শন বৃথা মনে হয়। কাদেরের কথা যুবক শিক্ষকের কানে পৌঁছায় না। কাদের যে প্রেমিক নয়, সে-দুঃখেই সে যেন আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। লোকটির প্রতি ক্রোধে-ঘৃণায় কাদেরের শ্বাসরোধ হবার উপক্রম হয়। 

সচকিত হয়ে যুবক শিক্ষক বুঝতে পারে, কাদেরের সঙ্গে তার শেষ সাক্ষাৎটি সে কাদেরের দৃষ্টিতেই দেখতে শুরু করেছে। কিন্তু তাতে ক্ষতি নাই। অবশেষে সব দুর্বলতা-স্বপ্ন-কল্পনা থেকে সে মুক্তি পেয়েছে, কাদেরের কুকীর্তিটি স্বচ্ছদৃষ্টিতে দেখবার পথে আর বাধা নাই। কাদের যখন তাকে কোনোপ্রকারে আর প্রভাবিত করতে পারবে না তখন তার দৃষ্টিতে ব্যাপারটি দেখতে কোনো ভয় নাই। এখন সে তার যুক্তি-অজুহাত সম্পূর্ণভাবে বুঝতে চায়। 

কাদেরের যুক্তির উপসংহার কী? শুধু এই যে, যুবক শিক্ষক একটি মতিচ্ছন্ন মানুষ। সেখানেই তার যুক্তির শেষ। অপরের বিষয়ে এ সিদ্ধান্তের পর নিজের সম্পর্কে কী তার বলার আছে? কিছু না। সেখানে তার যুক্তি শূন্যতায় খাঁ-খাঁ করে। 

না, কাদের যে প্রেমিক নয় সে-কথাই তার দুঃখের কারণ নয়। আসল কারণ এই যে, একটি যুবতী নারী নিতান্ত অর্থহীনভাবেই প্রাণ হারিয়েছে। তার মৃত্যুতে কাদেরের মনে একটু দুঃখ-বেদনা জাগে নাই। শূন্য হৃদয়ে দুঃখ-বেদনা জাগে না। কাদেরের হৃদয়ের শূন্যতার জন্যেই যুবতী নারীর মৃত্যুটা একটি নির্মম হত্যা ছাড়া কিছু নয়। 

হয়তো যুবক শিক্ষক মতিচ্ছন্ন মানুষ। সে-বিষয়ে নিজে সে নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারে না। কিন্তু তার কর্তব্য সে পরিষ্কারভাবে দেখতে পায়। কাদেরের বিচারের যে-ভার নিজের হাতে তুলে নিয়েছিল সে-ভার সে আর বহন করতে পারবে না। তাকে এবার কথাটা প্রকাশ করতে হবে। প্রথমে দাদাসাহেবকে, তারপর কর্তৃপক্ষকে। 

কর্তব্যটি পালন করা যে কষ্টসাধ্য হবে তা সে সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করে। সর্বপ্রথম দাদাসাহেবের কথাই তার মনে আসে। কথাটা তাঁকে বলা সহজ হবে না। তিনি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত কঠিন আঘাত পাবেন, যে-আঘাত বৃদ্ধবয়সে তাঁর পক্ষে সামলে ওঠা হয়তো দুষ্কর হবে। হয়তো হঠাৎ তিনি দেখতে পাবেন, যে আশা-ভরসা আশ্বাস- বিশ্বাসের জোরে এতদিন তিনি বেঁচে ছিলেন, তা সারশূন্য হয়ে উঠেছে : সমস্ত জীবনটাই এক পলকের মধ্যে নিষ্ফল হয়ে পড়েছে। তাছাড়া, যুবক শিক্ষক জানে তিনি অতিশয় দয়াবান মানুষ। তাঁর দয়াবান চরিত্রের ভিত্তি হল মানুষের প্রতি অটল বিশ্বাস! এমন মানুষের হৃদয়ে নিষ্ঠুর আঘাত দেওয়া কি সহজ? কর্তৃপক্ষকে বলাও সহজ হবে না। যে-হত্যাকাণ্ড সে নিজের চোখে দেখে নাই সে হত্যাকাণ্ডের সমর্থনে কী সাক্ষী-প্রমাণ পেশ করবে সে? বলতে বিলম্বেরও কী কারণ দেবে? তার মনের নানাপ্রকার বিচিত্র বিশ্বাস-চিন্তাধারার কথা তাদেরকে বলতে হবে। কিন্তু তখন তাদের কাছে তার অভিযোগটি বিভ্রান্তমস্তিষ্কের প্রলাপ বলে মনে হবে না কি? তাছাড়া, নদীতে যুবতী নারীর দেহটি ফেলার ব্যাপারে তার সহায়তারও কী ব্যাখ্যা দেবে? 

কথাটি প্রকাশ করলে তার সমূহ ক্ষতিরও সম্ভাবনা আছে। কাদের ইতিমধ্যে তার পরিণামের কথা বলে তাকে ভয়-প্রদর্শন করেছে। যুবক শিক্ষক শুধু যে তার অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হবে না তা নয়, কাদের তার বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ আনলে নিজেকে রক্ষা করার কোনো উপায় তার থাকবে না। এখন সে ভাবছে দাদাসাহেব কথাটি জেনে অত্যন্ত আঘাত পাবেন। হয়তো তিনি তা বিশ্বাস করতেই চাইবেন না। অকারণে তার কনিষ্ঠভ্রাতার গুরুতর ক্ষতি সে করতে চাইছে এই ধারণায় বদ্ধমূল হয়ে কর্তৃপক্ষকে প্রভাবিত করে কাদেরকে রক্ষা তো করবেনই, তার বিরুদ্ধে কাদেরের পাল্টা জবাবটি যাতে টেকে তার যথাযথ ব্যবস্থা করবেন। সত্য কথা জেনেই যে তিনি এমন অন্যায় কাজ করবেন তা নয় : কাদেরকে অপরাধী বলে গ্রহণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে না। আরেকটি কথা। ভাইকে রক্ষা করার প্রয়োজন ছাড়া আরেকটি প্রয়োজনও তিনি বোধ করবেন : তাঁর পরিবারের সুনাম রক্ষা করা 

যুবক শিক্ষকের বিরুদ্ধে কেউ কোনো অভিযোগ না আনলেও কথাটি প্রকাশ করার পর তাকে বড়বাড়ির আশ্রয় এবং ইস্কুলের শিক্ষকতার চাকুরিটি ছাড়াতে হবে, তারপর এখানে থাকতে তার বিবেকে বাধবে। তখন সে কোথায় যাবে? কোথায়ই-বা এমন লাভজনক চাকুরি বা দাদাসাহেবের মতো এমন স্নেহ-দয়াশীল অভিভাবক পাবে? 

তবু কথাটা প্রকাশ না করে তার উপায় নাই। উপায় থাকলে সে বলত না। বাঁশঝাড়ে একটি নারী অর্থহীনভাবে জীবন দিয়েছে। তার বিশ্বাস, মানুষের জীবন এত মূল্যহীন নয়। না, সত্যিই তার উপায় নাই। 

যুবক শিক্ষকের শীর্ণ মুখ শুষ্ক কাঠের মতো নীরস-কঠিন মনে হয়। সে-মুখ কখনো যেন হাসবে না কাঁদবে না। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *