চৌদ্দ
দুপুরবেলায় ইস্কুলের বিশ্রামঘরে আত্মপ্রবঞ্চনার কথাটি যুবক শিক্ষক সর্বপ্রথম আপন-মনে স্বীকার করে। বস্তুত, স্বীকার করতে সে বাধ্য হয়। সর্বপ্রকার চেষ্টার শেষ হয়েছে, কি করে তার ক’দিনব্যাপী মানসিক বিহ্বলতার সত্য কারণ নিজের কাছে আর ঢেকে রাখে? সঙ্গে সঙ্গে যে- ন্যায়বানের শ্বেতসৌধ সে সৃষ্টি করেছিল তা নিমেষে ধূলিসাৎ হয়। নিজের কাছেই সে নিজে ধরা পড়েছে অবশেষে : কোথাও আর একটি প্রাচীর দাঁড়িয়ে নাই যার পশ্চাতে সে আত্মগোপন করতে পারে।
সত্যি, সন্দেহের আর অবকাশ নাই। জটিল এবং পরিশ্রমসিদ্ধ আত্মপ্রবঞ্চনাটি শুরু হয় তখন যখন আত্মরক্ষার প্রবল বাসনার জন্য তার বিবেকের নির্দেশ শুনতে সে অক্ষম হয়। তারপর তার লজ্জাকর ভীতি-দুর্বলতা সে নিজের কাছেই লুকাবার চেষ্টা করে।
কাদের একটি গুরুতর অপরাধ করেছে তা জানতে পারলে একটি কঠিন সমস্যাও সে অনতিবিলম্বে দেখতে পায়। লোকটি সম্ভ্রান্তশালী অভিভাবক আশ্রয়দাতার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। অন্যদিকে, যুবতী নারী শুধু যে তার সম্পূর্ণ অপরিচিতা তা নয়, সে আর জীবিতদের মধ্যে কখনো প্রত্যাবর্তন করবে না। আজ সকালে কাদেরের উক্তির পরেই সে তা বুঝতে পারে। কাদের তাকে প্রশ্ন করেছিল, সে যুবতী নারীকে চিনত কিনা। হত্যাকাণ্ডটি প্রকাশ করলে তার কী শাস্তি হবে তা-ও সে স্পষ্টভাবে বলেছিল। বস্তুত, আত্মপ্রবঞ্চনার কথাটি বুঝবার ব্যাপারে কাদেরই তাকে সাহায্য করেছে।
যুবক শিক্ষক লজ্জাই বোধ করে, তার কানে কেমন ঝাঁঝ ধরে। কিন্তু স্বীকার না করে উপায় নাই, সে ভাবেই মানসিক দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়। বিবেক বলে, কথাটি প্রকাশ করা তার কর্তব্য, কিন্তু কাজটি তার কাছে দুষ্কর মনে হয়। সে দুর্বল মানুষ। মানসিক দ্বন্দ্বটি অসহ্য হয়ে উঠলে সে একটি পলায়নপথ আবিষ্কার করে : স্বপ্নরাজ্যে সে আশ্রয় গ্রহণ করে। তার দুর্বলতার সমর্থনে যদি কোনো যুক্তি থাকে তবে তা হয়তো এই যে, যুবতী নারী তার অপরিচিতা বলেই তার প্রতি নির্মম অবিচারটি সে সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে পারে নাই, কাদেরের অপরাধটিও হৃদয় দিয়ে অনুভব করে নাই। কিন্তু সে-যুক্তিতে জোর আছে কি নাই তার বিবেচনা এখন তার কাছে অহেতুক মনে হয়।
কর্তব্যটি যাতে পালন না করতে হয় সে জন্যে স্বপ্নরাজ্যে প্রবেশ করে সেখানেই সে এ ক’দিন বাস করছে। যুবতী নারীর মৃতদেহটি বহনের ব্যাপারে কাদের যখন তার সাহায্যপ্রার্থী হয় তখন সে ইতিমধ্যে স্বপ্নরাজ্যে পৌঁচেছে। বাস্তবজগৎ তখন মূল্যহীন বলে কাদেরকে সে-ব্যাপারে সাহায্য করতে তার বিন্দুমাত্র দ্বিধা হয় নাই। তবে স্বপ্নরাজ্যে সে নিরাপদ বোধ করে নাই : সব প্রবঞ্চনার মধ্যে আত্মপ্রবঞ্চনাই অধিকতম শক্ত। তাই সেখানে সে অলস হয়ে বসে থাকে নাই। তার বাহ্যিক আচরণ বিহ্বল মানুষের মতো হলেও সে অতি দক্ষতা এবং ব্যগ্রতার সঙ্গে কাদেরকে দোষমুক্ত করবার জন্যে একটির পর একটি বিচিত্র অবিশ্বাস্য যুক্তি-অজুহাত আবিষ্কার করেছে। কেন? কারণ কাদের নির্দোষ প্রমাণিত হলেই তার রক্ষা। তাহলে বিবেকের নির্দেশটি তাকে আর শুনতে হবে না, বিপজ্জনক কর্তব্যটিও পালন করতে হবে না। আত্মরক্ষার জন্যে সে কী সব যুক্তি-অজুহাতই না আবিষ্কার করেছে এবং তাতে নিজেই বিশ্বাস করেছে? যেমন, কাদের কেন মৃতদেহটি নদীতে ফেলবে ঠিক করে। হঠাৎ যুবক শিক্ষকের কাছে কাদের একটি দয়াশীল মহৎ মানুষ হিসেবে উদয় হয় এবং সে যুবতী নারীকে একটি নিদারুণ অপমান থেকে উদ্ধার করতে চায়।
তবে গোড়াতে আত্মপ্রবঞ্চনা শক্ত বলেই নয়, অন্য একটি কারণেও সে-সব যুক্তির পশ্চাতে আশ্রয় গ্রহণ করা তার পক্ষে তত সহজ হয় নাই : তখন বাঁশঝাড়ের সত্য কথাটি সে নিশ্চিতভাবে জানত না। দুঃখের বিষয়, কাদের নিজের মুখেই কথাটি স্বীকার করে বসে। তারপর যুবক শিক্ষকের পক্ষে স্বপ্নরাজ্যে বাস করা যেন অসম্ভব হয়ে পড়ে, পালাবারও কোনো পথ থাকে না। কিন্তু হাল ছাড়তে সে রাজি হয় না। তার ভীত-নিপীড়িত মস্তিষ্ক শীঘ্র একটি নূতন যুক্তি দেখতে পায়। যুক্তিটি এই যে, যুবতী নারীর প্রতি প্রেম ছিল বলেই কাদের তার অন্তিম ব্যবস্থা না করে পারে নাই। এবং, যেহেতু নারীর প্রতি কাদেরের প্রেম ছিল সেহেতু হত্যাকাণ্ডটি শুধুমাত্র একটি শোচনীয় দুর্ঘটনা নয় কি? আর সে যুক্তি অনুসারে তার অপরাধও কি ক্ষমাই নয়?
কাদেরের হাতেই যুবক শিক্ষকের স্বপ্নরাজ্যের দুর্বল প্রাচীর দ্বিতীয় বার ভাঙে। প্রেমের কথাটি সে স্বীকার করে না। বরঞ্চ সেটি যে অচিন্তনীয় সে-কথা সে পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দেয়। এবার যুবক শিক্ষক বুঝতে পারে, তার পালাবার সত্যিই কোনো পথ নাই : তার কর্তব্যটি যতই ভীতিজনক হোক না কেন, সেটি এড়াবার আর কোনো উপায় নাই।
সম্পূর্ণভাবে নিরাশ হয়ে সে যখন ঘটনাটি প্রকাশ করবার জন্যে সাহস যোগাড় করার চেষ্টা করছে তখন কাদের তাকে প্রথম বার একটু সাহায্য করে স্বপ্নরাজ্যে প্রত্যাবর্তন করার একটি পথ দেখায় তাকে। সে বলে, ঘটনাটি প্রকাশ করলে তার চূড়ান্ত শাস্তি হবে এবং তার জন্যে যুবক শিক্ষক একাই দায়ী হবে। কাদের যে-বীভৎস শব্দটির উচ্চারণ করে সে–শব্দটিই ঘোর তমসার মধ্যে একটু আলোর সৃষ্টি করে। নতুন উদ্যমে যুবক শিক্ষক তার যুক্তির তলোয়ারে শান দেয় এবং তার এই বিশ্বাস হয় যে, সে অস্ত্রটির সাহায্যে সে যে শুধু বিবেকের সামনাসামনি হতে পারবে তা নয়, বিবেককে কাবু পর্যন্ত করতে পারবে। এবার তার নিজের সর্বনাশের প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন হচ্ছে অন্য একটি মানুষের জীবন-মৃত্যু নিয়ে। সে নিজের প্রাণের জন্যে ভীত নয়, অন্য মানুষের প্রাণের জন্যে ভীত। সে-মানুষের জীবন-মৃত্যু সম্বন্ধে একটি ভীষণ দায়িত্ব গ্রহণ করার যথার্থ সব কারণ কি তার জানা আছে?
যুক্তিটি অব্যর্থ মনে হয় কেবল অল্প সময়ের জন্যেই। শীঘ্র সে বুঝতে পারে, সেটি অতিশয় দুর্বল। আত্মপ্রবঞ্চনার জন্যে যথেষ্ট তো নয়ই, তা দিয়ে বিবেককেও মানানো যায় না। আর কোনো উপায় যখন নাই তখন সত্য কথাটি স্বীকার করতে অসীম লজ্জা হলেও তা স্বীকার করাই কি বাঞ্ছনীয় নয়? তাছাড়া, আপন-মনে বিবেকের মূল্য কী?
সত্য কথা হল এই, বাঁশঝাড়ের হত্যাকাণ্ডটি প্রকাশ করার সাহস তার নাই। প্রথম দিন ছিল না, আজও নাই। সে ভীত, দুর্বলচিত্ত অসহায় মানুষ। কাদেরের ভয়-প্রদর্শন কার্যকরী হয়েছে। নিজেকে ফাঁকি দেওয়া আর যখন সম্ভব নয় তখন ফাঁকি দেবার চেষ্টা ছেড়ে কেন সে ভীত সে-কথা খোলাখুলিভাবে বুঝবার চেষ্টা করাটাই কি সাধু কাজ হবে না? তাছাড়া, বিবেকের মুখ বন্ধ করবার জন্যে ছলনার চেয়ে এ পন্থাটাই অধিকতর কার্যকরী। বস্তুত তার মনে হয়, ভীতির নগ্ন চেহারা দেখে বিবেকের কণ্ঠস্বর ইতিমধ্যে সম্পূর্ণভাবে স্তব্ধ হয়েছে।
ঘটনাটি প্রকাশ না করার পক্ষে যে-সব যুক্তি সে পরিষ্কারভাবে ভাবতে সাহস পায় নাই, এবার সে-সব যুক্তি বিশ্লেষণ করে দেখতে তার আর বাধে না। চারপাশে খোলা মাঠ, আর বাধা কোথায়? প্রথমত, সে নিজের কথাই ভাবে। কে সে? একজন দরিদ্র শিক্ষক মাত্র। বর্তমানে জনৈক সম্ভ্রান্ত ধনী কিন্তু দয়াশীল মানুষের অভিভাবকত্বে জীবনে সর্বপ্রথম বেদনাদায়ক অভাব-অভিযোগটা যেন ভুলেছে, সুখের একটু আস্বাদ পেতে শুরু করেছে। তার ব্যক্তিগত দারিদ্র্যই যে শুধু ঘুচেছে তা নয়। সে তার বিধবা মা এবং তার মুখাপেক্ষী দুটি ভাই-বোনকেও খাওয়াতে পরাতে পারছে। তার যদি কোনো ক্ষতি হয় তবে কে তাদের দেখাশোনা করবে? কাদের যে তাকে মিছামিছি ভয় দেখিয়েছে সে-কথা ভাবা অন্যায়।
তাছাড়া, কার জন্যেই-বা সে নিজের সর্বনাশ করবে? যুবতী নারী তার আত্মীয়-বন্ধু নয়, তার মৃত্যুতে সে ব্যক্তিগতভাবে কোনোপ্রকারে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নাই। এ হতভাগা দেশে কত যুবতী নারীর জীবন অর্থহীনভাবে এবং অকারণে শেষ হয়, কে প্রতিবাদ করে, কে একবার ফিরে তাকায়? যেখানে জীবন মূল্যহীন সেখানে আরেকটি জীবন শেষ হয়েছে। কীভাবে হয়েছে, তাতে কোনো অন্যায়-অবিচার হয়েছে কিনা, সে বিষয়ে মাথা ঘামিয়ে সে নিজের ওপর বিপদ ডেকে আনবে কেন?
তারপর, কাদেরের কথা। হোক তার অপরাধ অতি গুরুতর বা যুবতী নারীর সঙ্গে তার সম্পর্কের কারণ পশুবৎ বাসনা, হোক সে নির্মম-নির্দয় মানুষ, তবু সে যুবক শিক্ষকের কোনো ক্ষতি করে নাই। তাছাড়া, কাদের তার বন্ধু না হোক, সে তার শত্রুও নয় : তার প্রতি সে হিংসাদ্বেষ বা প্রতিহিংসার ভাব বোধ করে না। কাদেরের সঙ্গে লড়াই করে তার কী লাভ হবে, কারই-বা সে মঙ্গল করবে?
যুবক শিক্ষকের মনে কোনো সন্দেহ থাকে না যে, যুবতী নারীর মৃত্যুর সুবিচার হোক, তার চেষ্টা করলে কেউ তাকে সমর্থন করবে না, কেউ তাকে সাধু-সত্যবান বলে তার গলায় মালা দেবে না। সত্যবাদিতার মূল্য অবশ্য কেউ খোলাখুলিভাবে অস্বীকার করে না। এ-কথাও কেউ অস্বীকার করে না যে, সাক্ষ্য দেবার সমন পড়লে মিথ্যা বলা অন্যায়—বিশেষ করে মিথ্যাবিবৃতি যখন ধরা পড়ে। কিন্তু যুবক শিক্ষককে কেউ সমন পাঠায় নাই। স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে সত্যকথা বললে, এবং তার জন্যে শাস্তি লাভ করলে, তাকে তারা নির্বোধই বলবে।
যুবক শিক্ষক সহসা তার সহযোগীদের কণ্ঠস্বর শুনতে পায়।
‘মানুষটি আরামে ছিল। খাসা চাকুরি, বড়বাড়িতে জামাই-আদর। বোকা না হলে খামাখা নিজের ওপর এমন সর্বনাশ ডেকে আনবে কেন?’
‘তাই। কত অন্যায়-দুর্নীতির কথা মানুষ জানতে পায়। কিন্তু নিজের ভাত মারা না পড়লে নিজের ক্ষতি করে কেউ সে-সব কথা প্রকাশ করে নাকি?’
আদর্শ চরিত্র শুধু রূপকথায় বিরাজ করে, বাস্তবজগতে তার অস্তিত্ব নাই।
যুবক শিক্ষকের কোনো ক্ষতি না হলেও, এবং কাদেরের যথাযথ শাস্তি হলেও তারা যুবক শিক্ষককে উচ্চাসনে বসাবে না। তার কার্যে তারা গূঢ় অভিসন্ধি খুঁজে বের করবে।
‘নিশ্চয়ই এর মধ্যে কোনো কথা আছে।’ (উক্তিটি যুবক শিক্ষক বারবার শোনে নাই কি?) ‘তার নিরীহ গোবেচারা চেহারায় ভুলবেন না।’
‘কী কথা?
‘বলে দিলাম, মেয়েলোকটির সঙ্গে আমাদের মাস্টারটিরও যোগাযোগ ছিল।’
ন্যায়বানের প্রতি ক্রূরহিংসায় তাদের হৃদয়ে অশান্তির সৃষ্টি হবে। অন্য কেউ আরেকটি সম্ভাবনার কথা বলবে।
‘কোনো কারণে বড়বাড়িতে জামাইর আদর শেষ হয়ে আসছিল। প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে যাদের নিমক খেয়েছে তাদেরই ক্ষতি করবার জন্যে কথাটা সে প্রকাশ করেছে।’
অকারণে কেউ ন্যায়বানের মুখাচ্ছাদন পরে না।
যুবক শিক্ষকের বিরুদ্ধে কাদেরের পাল্টা অভিযোগটা প্রমাণিত হলে কারো মনে কি একবার কাদেরের দেরি করে কথাটা প্রকাশ করার বিষয়ে একটু প্রশ্ন জাগবে না? হয়তো জাগবে। কিন্তু যুবক শিক্ষক তারও একটা উত্তর শুনতে পায়।
‘আহা, দরবেশ মানুষ। অতশত কী বোঝে?’
যুবক শিক্ষক তার সমর্থনে একটি কণ্ঠস্বরও শুনতে পায় না। কিন্তু জয় বা পরাজয়ের পরে তারা কী বলবে, সে-ভয়েই যে সে ভীত তা নয় : তাদের সম্ভাব্য মতামতের জন্যেও সে আত্মপ্রবঞ্চনার প্রয়োজন বোধ করে নাই। তবু সে-সব কি ঘটনাটি প্রকাশ না করার পক্ষে গণ্য করা যায় না?
যুবক শিক্ষক কিছুক্ষণ আপন মনে স্তব্ধ হয়ে থাকে। তার অনুসন্ধান যেন শেষ হয়েছে। পূর্বের সিদ্ধান্তটি ত্যাগ করে নূতন সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে আর কোনো বাধা নাই। ভেতরটা কেমন হাল্কা হাল্কাই মনে হয়, কষ্টকর আত্মপ্রবঞ্চনার প্রয়োজন থেকে মুক্ত হয়ে সে হয়তো স্বস্তিই বোধ করে।
তবু সে নিজের মনেই শেষবারের মতো দুটি প্রশ্ন না করে পারে না। যুবতী নারীর সঙ্গে কাদেরের সম্পর্কটি যখন নিন্দনীয় এবং হত্যাকাণ্ডটি যখন অতিশয় গুরুতর অপরাধ, তখন তা প্রকাশ না করে কেউ চুপচাপ বসে থাকতে পারে কি?
যুবক শিক্ষক আবার তার সহযোগীদের চেহারা দেখতে পায়। তারা যেন কেমন গোপনভাবে হাসছে। তারপর তাদের উত্তরটা সে শুনতে পায়।
‘পুরুষের ওসব দুর্বলতা একটু থাকেই। দোষটা আসলে মেয়েলোকটির। দুশ্চরিত্রা হলে এমন অপঘাত মৃত্যু অবধারিত।’
বিশ্রামঘরটা শীতল হলেও কেমন ভ্যাপসা গরম বোধ করে যুবক শিক্ষক। চারপাশটা কেমন সঙ্কুচিত হয়ে উঠেছে যেন। হয়তো ভালো করে শ্বাস নেবার জন্যেই সে সোজা হয়ে উঠে বসলে আরবির মৌলবীর ওপর তার দৃষ্টি পড়ে। আজ সে বিপরীত দিকে বসে চোখ বুজে হয়তো ঝিমুচ্ছে। যুবক শিক্ষক অকারণে তার চিন্তাশূন্য শান্ত মুখমণ্ডলের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে। তারপর সে বুঝতে পারে, নিজের মনে যে-সব সহযোগীদের চেহারা সে দেখেছিল তার মধ্যে মৌলবীর শাশ্রুমণ্ডিত চেহারাটি নাই। তাকে কি একবার জিজ্ঞাসা করে দেখবে? হয়তো সে তাকে সমর্থন করবে। মনের ভীতির জন্যে যে-ব্যাপারটি তার কাছে অতীব গুরুতর সমস্যায় পরিণত হয়েছে, হয়তো সেটি তার কাছে কোনো সমস্যাই মনে হবে না। সমস্যা কোথায়? একটি খুনের কথা সে জানতে পেরেছে। সে-কথা সে প্রকাশ করবে। তাতে কোনো জটিলতা বা ভীতির প্রশ্ন নাই।
মৌলবী চোখ বুজে থাকলেও চোখের অন্তরালে তার দৃষ্টি অবিশ্রান্তভাবে এধার-ওধার নড়ে : যেন চোখ বুজেই সে সব কিছু দেখতে পায়। তারপর তার চোখের পাতা নিমীলিত থেকেই প্রজাপতির পাখার মতো ফড়ফড় করতে শুরু করে, মনে হয় চোখ খুলবে। কিন্তু এবার মৌলবীর জিহ্বাগ্র ধীরে-সুস্থে এবং নিপুণতার সঙ্গে দাঁতপাটির গুহাগহ্বরে খাদ্যকণার সন্ধানে নিযুক্ত হয়। অনতিবিলম্বেই সে তার সন্ধানকার্যে সাফল্যমণ্ডিত হয়। তারপর কয়েক মুহূর্তের জন্যে তার চোখমুখ নিশ্চল হয়ে পড়ে। সে কি তুচ্ছ খাদ্যকণাটির জন্যে মহান অন্নদাতার কাছে শোকর আদায় করছে?
হয়তো সেটি তার খেয়াল, তবু যুবক শিক্ষক ক্ষিপ্রগতিতে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়, সঙ্গে সঙ্গে একটা গভীর নিরাশায় সে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। না, মৌলবীর মতো অসহায় ব্যক্তির কাছ থেকে কোনো উপদেশ আশা করা বৃথা।
কিন্তু উপদেশের আর প্রয়োজনই-বা কী? ইতিমধ্যে তার সমস্যার সমাধান কি হয় নাই? ঘটনাটি প্রকাশ করার বিরুদ্ধে নানাবিধ যুক্তিতর্কে সে কি সন্তুষ্ট নয়?
না, সে সন্তুষ্ট। সমস্যার সমাধান হয়েছে, আর ভাবনার কারণ নাই। কাউকে কোনো কথা জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন আর নাই।
বিশ্রামঘরে আজ প্রগাঢ় নীরবতা, তর্কবিতর্ক এখনো শুরু হয় নাই। সে নীরবতার মধ্যে যুবক শিক্ষক একটি অস্পষ্ট শ্রান্তিতে চোখ বোজে। তার কি ঘুম পাচ্ছে? জোয়ারের সময় চর যেমন আস্তে, অলক্ষিতে ডুবে যায়, তেমনি তার সমগ্র অস্তিত্ব শ্রান্তির কালো জোয়ারে নিমজ্জিত হয়। না, তার আর কোনো প্রশ্ন নাই, বলবারও কিছু নাই। নিঃশব্দে সময় কাটে। কখনো কখনো কেউ কথা বললে মনে হয় তার কণ্ঠ যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসে। বাইরে মাঠে খেলারত ছেলেদের চিৎকারধ্বনি অর্থহীন কোলাহলে পরিণত হয়।
তারপর একসময় যুবক শিক্ষক আস্তে চোখ খুলে তাকায়। তার দৃষ্টি ছায়াচ্ছন্ন; কী যেন তার স্মরণ হয়েছে। একটু পর সে কারো সন্ধান করে, ধীরে ধীরে এধার-ওধার তাকায়। অবশেষে তারই বাম পাশে উপবিষ্ট সেদিনের বিজয়ী বক্তার ওপর তার দৃষ্টি থামে। সে আজ নির্বাক। নত মাথায় আঙুল দিয়ে নাক খুঁটতে খুঁটতে গভীর মনোযোগসহকারে সে একটি সংবাদপত্র পড়ে।
শীঘ্র সে পাতা উল্টাতে খস্থস আওয়াজে ঘরের নীরবতা ভঙ্গ হয়। যুবক শিক্ষক আর দ্বিধা করে না। বক্তাকে প্রশ্ন করে, ‘মেয়েলোকটার সম্বন্ধে কিছু জানা গেছে কি?’
তার আকস্মিক প্রশ্নে বিশ্রামঘরে অতি ক্ষীণ একটা আলোড়নের সৃষ্টি হয়, যেন শান্ত পানির বুকের ওপর দিয়ে একটা পাখি উড়ে গেল। তারপর কয়েক জোড়া দৃষ্টি তার ওপর নিবদ্ধ হয়।
সেদিনের খবরবিশারদ প্রথমে যুবক শিক্ষকের প্রশ্নটির অর্থোদ্ধার করতে যেন সক্ষম হয় না। সে কি এর মধ্যে এমন মুখরোচক কথাটি ভুলে গেছে?
না, তার স্মরণ হয়। বিপরীত দেয়ালের দিকে চোখ মিট্মিট্ করে তাকিয়ে নাকে একবার উচ্চ আওয়াজ করে, ডান ঊরুটা চুলকে নেয় বার কয়েক। তারপর সে পাল্টা প্রশ্ন করে, ‘কী জানা যাবে?’
যুবক শিক্ষকের গলায় ঈষৎ কাঁপন ধরবার উপক্রম করে। সরাসরি প্রশ্নটা করতে তার দ্বিধা হয়। অবশেষে অস্ফুটভাবে কেশে সে বলে, ‘কে তাকে খুন করেছে?’
‘ও।’ এবার বক্তার চোখ ক্ষিপ্রগতিতেই মিট্মিট্ করতে শুরু করে। তারপর তাতে সামান্য হাসির আভাস জাগে। যুবতী নারীর মৃত্যু সম্বন্ধে সে একটি বিচিত্র খবর দেয়।
যুবতী নারীর বৃদ্ধা মায়ের বিশ্বাস যে, হতভাগিনীর ওপর জিন-পরীর আছর পড়েছিল। একদিন দুপুরবেলায় উঠানে বসে সে শালীর চুলে উকুন দেখছিল, এমন সময় দীর্ঘকায় সাদা কিছু তার সামনে এসে দাঁড়ায়। মেঘহীন আকাশে সাদা মেঘের মতো, স্তব্ধদিনে দমকা হাওয়ার মতো। কানা শালী কিছু দেখতে না পেলেও তার গায়ে হাওয়া লাগে। তবে কেমন ধরনের হাওয়া যেন। বৃদ্ধা নারী ঘরে ছিল। অকারণে তার বুকটাও কেঁপে ওঠে।
সেদিন থেকে যুবতী নারীর দশা উপস্থিত হয়। যার একবার দশা হয় সে কি আর বাঁচতে পারে?
শীঘ্র হাসির ভাবটা মিলিয়ে যায় বক্তার চোখ থেকে।
‘কেন?’
কয়েক জোড়া দৃষ্টি যুবক শিক্ষকের উপর পূর্ববৎ নিবদ্ধ হয়ে থাকে।
প্রশ্নটি সে শুনতে পায় না। এবার তার মনে পরম স্বস্তির ভাব এলে সে ভাবে, শেষ বাধাটিও অবশেষে দূর হয়েছে। চাষাভূষা মানুষেরাও কথাটা গোপন রাখার প্রয়োজন বোধ করে। এ-বিষয়ে হন্তা-নিহতের মধ্যে কোনো প্রভেদ নাই।
সন্দিগ্ধ চোখে বক্তা সহযোগীদের সঙ্গে একবার দৃষ্টি বিনিময় করে আবার বলে, কেন?’
‘এমনি।’ যুবক শিক্ষক কোনোপ্রকারে উত্তর দেয়। তারপর সে মাথা নত করে। মুখে ভারি কিছু নেবেছে যেন, ঠোঁটের পাশটাও কেমন বিকৃত হয়ে উঠেছে। স্বস্তির ভাবটা হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেছে।
তারপর হঠাৎ ঝড়ের মতো তর্কবিতর্ক শুরু হয়। হাসিভরা চোখে বক্তা যে-কথাটি বলেছিল, সে-বিষয়ে অনেকের মৌলিক কিছু বলবার আছে।
তারপর যুবক শিক্ষক তার হাত দুটি টেবিলের তলায় লুকায়। তার ভয় হয়, হয়তো তার হাত কাঁপতে শুরু করবে।