চাঁদের অমাবস্যা – ৫

পাঁচ 

একচোখ-কানা মুয়াজ্জিনের তীক্ষ্ণ-কর্কশ কণ্ঠে অভ্যস্ত হওয়া কঠিন, প্রতিবার একটু চমকে উঠতেই হয়। দাদাসাহেব অবশ্য তাতে অনেক ফায়দা দেখেন। কেউ একবার নালিশ করলে তার লম্বা ফর্দ দিয়েছিলেন। লোকটির জাঁদরেল কণ্ঠ আজানের আসল উদ্দেশ্য তো জোরদারভাবে হাসিল করেই, তাছাড়া শয়তান বিতাড়িত করে, অলস মনকে ধর্মতত্ত্বে সক্রিয় করে। কণ্ঠে মাধুর্যের অভাব আছে বৈকি কিন্তু কর্তব্যের আহ্বানে মাধুর্যের কোনো প্রয়োজনীয়তা নাই। হৃৎপিণ্ডদুর্বল মানুষের ক্ষতি হতে পারে? অতিশয় গম্ভীর হয়ে দাদাসাহেব উত্তর দেন, অন্তিম মুহূর্তে খোদার নাম কানে পাওয়া পরম সৌভাগ্যের কথা। অবশ্য মুয়াজ্জিনটি যে তাঁর বিশেষ স্নেহের পাত্র সে-কথা তিনি বলেন না। সে-কথা মুখে বলা যায় না। কারো নিঃস্ব দারিদ্র্য স্নেহের কারণ সে-কথা বলতে মুখে বাধে। তবে তাঁর একটা বিশ্বাস একটু বাড়াবাড়ি মনে হয়। এ-দরিদ্র দেশেও দারিদ্র্যের ব্যাপারে তার সমকক্ষ কেউ নাকি নাই। কথাটা মনে পড়তেই যুবক শিক্ষকের একটু হাসি পায়। তারপর খোলা দরজা দিয়ে সূর্যাস্তের কত বাকি তা একবার লক্ষ্য করে দেখে সে স্থির হয়ে বসে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠস্বরের জন্যে অপেক্ষা করে। আজানের জন্যে মনে অধীরতা বোধ করলেও সবকিছু তার কাছে স্বাভাবিক মনে হয়। পৃথিবী আবার স্বরূপ ধারণ করেছে। 

সমস্ত দিন যুবক শিক্ষকের গতানুগতিক জীবনযাত্রার কোনো ব্যতিক্রম ঘটে নাই, সকালে বড়বাড়িতে বা ইস্কুলে শিক্ষকতার কাজেও কোথাও ত্রুটি হয় নাই। কিন্তু অভ্যাসবশতই সে যে নিত্যকার কর্তব্যপালন করেছে তা নয়। বরঞ্চ তার গতানুগতিক জীবনযাত্রা সে রক্ষাবরণ হিসাবেই ব্যবহার করেছে। বিপদ আশঙ্কা করলে শামুক যেমন খোসার মধ্যে নিরাপদ বোধ করে তেমনি সে তার জীবনযাত্রার মধ্যেই নিরাপদ বোধ করেছে। কর্তব্যপালন কষ্টসাধ্য মনে হয়েছে কিন্তু তাতে কোথাও যাতে স্খলন না হয় তার জন্যে তার সাবধানতার শেষ থাকে নাই। প্রথম রাতে অতিশয় ভয়-বিহ্বল হয়ে পড়লেও সে চিন্তাশক্তি হারায় নাই। কিন্তু গতরাতে নদী থেকে ফিরবার সময় তার মনে হয়, তার চিন্তাশক্তি সত্যিই যেন লোপ পেয়েছে। কেবল সে বোঝে, তার কিছুই করার নাই, শুধু অপেক্ষাই করতে পারে। হয়তো কোথাও কিছু ঘটবে, কোথাও একটা আলো দেখতে পাবে, তার বিচিত্র অভিজ্ঞতার মর্মার্থ বুঝতে পারবে। কিন্তু কিছুই ঘটে নাই। 

তারপর এক সময়ে ক্ষুধার্ত শামুকের মতো পরিণামভয়শূন্য হয়ে খোসা ছেড়ে সে ধীরে-ধীরে বেরিয়ে আসে। তখন অপরাহ্ণ। ইস্কুল থেকে ফিরে সে বড়বাড়ির ছাতাপড়া বিবর্ণ সম্মুখভাগের দিকে তাকিয়ে দেখে, কোথাও কোনো পরিবর্তন ঘটে নাই। দাদাসাহেবকে দেখতে না পেলেও সে যেন তাঁর শান্ত-সৌম্য চেহারা দেখতে পায়। তাঁর চেহারা মনে পড়তে সে কেমন সাহস পায়। বড়বাড়ির সামনে সুপরিচিত উঠানটি শীতের শুষ্কতায় খটখট করে। সে-উঠানও তাকে আশ্বস্ত করে। 

হঠাৎ সে বুঝতে পারে, তার ভয়ের কারণ নাই। যে-বিচিত্র অভিজ্ঞতার অর্থ সে জানে না, সে অভিজ্ঞতার সঙ্গে সে জড়িত বোধ হলেও আসলে সে জড়িত নয়। শুধু সে নয়, কাদেরও তার সঙ্গে জড়িত নয়। তারপর অকস্মাৎ তার মনে নানাপ্রকার প্রশ্ন জাগতে শুরু করে। খই ফোটার মতো, একটির পর একটি। সারাদিন যেমন স্তব্ধ হয়েছিল, সে মনে প্রশ্নের এ-বিস্ফোরণে সে কেমন বিহ্বল হয়ে পড়ে। তবে নৈর্ব্যক্তিক দর্শকের যে-পরম স্বস্তিভাব সে বোধ করে, সে-স্বস্তিভাব আরো গাঢ় হতে থাকে। 

মনে আর ভয় নাই কিন্তু অন্ধকার আছে। সে-অন্ধকার কাটাবার জন্যে যুবক শিক্ষক তীব্র ব্যাকুলতা বোধ করে। সে বুঝতে পারে, কাদেরই সে-অন্ধকার দূর করতে পারবে। 

মনে ভয় নাই কিন্তু অশান্তি এবং বিশৃঙ্খলতা। সে-অশান্তি এবং বিশৃঙ্খলতাও কাদের দূর করতে পারে। কাদেরের সঙ্গে শীঘ্র দেখা করা তার অতি প্রয়োজন। 

বড়বাড়ির লম্বা বারান্দায় প্রতিদিন পারিবারিক জমায়েতে মগরেবের নামাজ হয়। তাতে যুবক শিক্ষক নিত্য যোগদান করে। মতিগতি ভালো হলে কাদেরও আসে। যুবক শিক্ষকের মনে আশা হয়, আজ হয়তো কাদের সান্ধ্যনামাজে আসবে। সূর্যাস্তের সন্নিধানে তার সঙ্গে দেখা করার বাসনাটি কেমন সহ্যাতীতভাবে তীব্র হয়ে ওঠে। 

কী সে তাকে জিজ্ঞাসা করবে? মনে প্রশ্নের যেন শেষ নাই। তার কোনটা সে জিজ্ঞাসা করবে, কোনটার উত্তর পেলে সে শান্তি পাবে? অস্থিরভাবে সে প্রশ্নগুলি ছাঁটাই-বাছাই করে, যে-গুলো অতি প্রয়োজনীয় মনে হয় সে-গুলো পরিপাটিভাবে সাজাবার চেষ্টা করে। 

যুবক শিক্ষকের মনে সন্দেহ থাকে না যে, প্রথম রাতে কাদের কেন মাঠে-ঘাটে একাকী ঘুরে বেড়াচ্ছিল, সে-কথাই তাকে প্রথম জিজ্ঞাসা করতে হবে। প্রত্যুত্তরে কাদেরও তাকে জিজ্ঞাসা করতে পারে, সে-ই বা কেন শীতের গভীর রাতে বাইরে ঘোরাঘুরি করছিল। কিন্ত প্রশ্নটির উত্তর দিতে সে প্রস্তুত। সে দ্বিধা না করে স্বীকার করবে, কাদেরকেই সে অনুসরণ করছিল। তাকে হারিয়ে ফেলার পর সে ঘরে ফিরে যায় নাই কেন সে-কথা কাদের জিজ্ঞাসা করলে সে বলবে সত্য কথা, কাদের বিশ্বাস না করলেও বলবে কী কারণে সে ঘরে ফিরে যায় নাই। জ্যোৎস্না-উদ্ভাসিত রাতের প্রতি তার গোপন নেশার কথা বলতে হয়তো কিছু লজ্জা হবে, কিন্তু সে-কথা ঢেকে রাখা সম্ভব হবে না। সে যদি নিজেই সত্য কথা না বলে তবে কাদেরকে কোনো প্রশ্ন করার বা তার কাছ থেকে সত্য উত্তর দাবি করার অধিকার তার থাকবে না। তাছাড়া, সত্যই সত্যকে আকর্ষণ করে। 

একটা কথায় যুবক শিক্ষকের মনে শীঘ্র খটকা লাগে। কেন সে কাদেরকে তার ভ্রমণের কথাটি প্রথম জিজ্ঞাসা করতে চায়? একটি বিষয়ে সে নিঃসন্দেহ : যুবতী নারীর মৃত্যুর সঙ্গে কাদেরের কোনো সম্বন্ধ নাই। সে-বিষয়ে নিঃসন্দেহ না হলে তার সঙ্গে সাক্ষাতের কোনো প্রয়োজনীয়তা সে বোধ করত না, তার মনে হঠাৎ মেঘ কেটে আলোও প্রকাশ পেত না। বস্তুত, তাকে কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজনও সে দেখত না। তবে কেন সে প্রশ্নটি তার প্রশ্নতালিকার শীর্ষে বসিয়েছে? অবিশ্বাস সত্ত্বেও সে কি বিশ্বাস করে কাদের দরবেশ? সে-কথাই কি সে প্রথম যাচাই করে নিতে চায়? 

খট্‌কাটা যায় না। সে যে কাদেরকে তার বাল-সুলভ বাতিকটির কথা বলতে প্রস্তুত তাতেও সে নিজেই নিজের মনে একটা গূঢ় অভিসন্ধি দেখতে পায়। হয়তো তার গোপন বাসনা এই যে, হোক তাদের রাতভ্রমণের উদ্দেশ্য ভিন্ন, তবু সে তার মনের গোপন বাতিকটির কথা প্রকাশ করলে পরস্পরের মধ্যে একটি মানসিক যোগাযোগ স্থাপিত হবে। সে যেন তার অভিজ্ঞতার অর্থ বোঝার চেয়ে কাদেরের সঙ্গে একটা সম্পর্ক স্থাপন করার জন্যেই ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। অনেক ভেবেও যুবক শিক্ষকের মনের খটকা যায় না। কেবল এ-কথা সে বোঝে, প্রশ্নটি বিশেষ প্রয়োজনীয়। যেন তার উত্তরের ওপরেই অন্যান্য প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করবে। যেন সে প্রশ্নের উত্তরের পরেই সে বুঝতে পারবে কাদের তার মনের অশান্তি বিশৃঙ্খলতা এবং তার মনের অন্ধকার দূর করতে পারবে কি পারবে না। শুধু অন্যান্য প্রশ্নের উত্তর নয়, সে- প্রশ্নের উত্তর কাদেরের মনের পরিচয়ও দেবে। কাদেরকে না বুঝতে পারলে বিচিত্র অভিজ্ঞতাটির রহস্য মোচন হবে না। 

দ্বিতীয় প্রশ্ন : কাদের কি যুবক শিক্ষককে হত্যাকারী বলে সন্দেহ করেছিল? 

ঘটনাটি সে কাদেরের দৃষ্টিতে ভেবে দেখে। প্রথম রাতে কাদের তাকে বাঁশঝাড় থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে। দু-জনে মুখামুখি হলে যুবক শিক্ষক হঠাৎ উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালিয়ে যায়। তখন কৌতূহলী হয়ে কাদের বাঁশঝাড়ে প্রবেশ করলে মৃতদেহটি দেখতে পায়। তারপর যুবক শিক্ষককে হত্যাকারী বলে সন্দেহ করাই তার জন্যে স্বাভাবিক নয় কি? 

এখানে যুবক শিক্ষক একটু ইতস্তত করে। সে বুঝতে পারে না, ভূমিকা না দিয়েই প্রশ্নটি করা সমীচীন হবে কিনা। একটি সন্দেহের কথা বলে অন্য একটি সন্দেহের কথা চাপা দিয়ে রাখলে হয়তো প্রশ্নটি কাদেরের কাছে অসম্পূর্ণ মনে হবে। হয়তো তখন তার মনে এই সন্দেহের সৃষ্টি হবে যে, যুবক শিক্ষকের মনে কোনো দুরভিসন্ধি আছে বলেই সব কথা সে খুলে বলছে না। তখন কাদেরও মন খুলে সব কথা বলবে না বা তাকে সাহায্য করতে চাইবে না। 

একটু ভেবে যুবক শিক্ষক স্থির করে, ভূমিকাটি না বলে প্রশ্নটি সে করতে পারবে না। এক হাতে সত্য দিয়ে অন্য হাতে সত্য নেবে। 

কাদের সম্বন্ধে তার সন্দেহই সে-ভূমিকার বিষয়বস্তু। বাঁশঝাড়ে বীভৎস দৃশ্যটি দেখে বেরিয়ে আসার পর কাদেরের সঙ্গে মুখামুখি হলে হঠাৎ তার মস্তিষ্কবিভ্রান্তি ঘটে : তার চোখে কাদেরই নিষ্ঠুর-নির্মম হত্যাকারীর রূপে আবির্ভূত হয়। তাই সে হঠাৎ একটি নিদারুণ ভয়ে দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে পালিয়ে গিয়েছিল। কাদেরই যে হত্যাকারী, সে-ধারণা পরদিন দুপুরবেলা পর্যন্ত তার মনে বদ্ধমূল হয়ে থাকে। 

এখানে যে-একটা প্রশ্ন উঠতে পারে সে-কথা যুবক শিক্ষক বুঝতে পারে। তেমন ধারণাই যদি থাকে তবে পুলিশকে সে খবর দেয় নাই কেন, কাউকে কিছু বলে নাই কেন? প্রশ্নটি মনে জাগতেই যুবক শিক্ষক অবিলম্বে তার যথার্থতা স্বীকার করে। সে-প্রশ্ন কাদের না করলে অন্য কেউ করবে। 

একটা উত্তর ঝট্ করে মাথায় আসে। কী করে সে পুলিশকে খবর দেয়? সে বড়বাড়ির আশ্রিত মানুষ, এবং কাদের বড়বাড়িরই লোক। তার পক্ষে কথাটা প্রকাশ করা কি সহজ? উত্তরটা কিন্তু তার পছন্দ হয় না। তাতে কেমন দুর্বলচিত্ত স্বার্থপরতার ছাপ। না, বড়বাড়ির আশ্রয়টি অত্যন্ত লৈাভজনক বটে কিন্তু সেটাই একমাত্র কারণ নয়। আসল কারণ বড়বাড়ির প্রধান মুরুব্বি দাদাসাহেবের প্রতি তার গভীর ভক্তিশ্রদ্ধা। কাদের যে তাঁর বিশেষ প্রিয়পাত্র সে-কথা সে জানে। দাদাসাহেবের প্রতি তার যখন এত ভক্তিশ্রদ্ধা তখন কী করে তাঁরই প্রিয়পাত্রের ক্ষতি করতে সে ছুটে যায়? 

এ-উত্তরেও যুবক শিক্ষক সন্তুষ্ট হয় না। তারপর হঠাৎ একটি কথা উপলব্ধি করে সে সামান্য বিহ্বল হয়েই পড়ে। প্রশ্নকার যেন উত্তরদাতায় পরিণত হয়েছে। আকস্মিক স্থান পরিবর্তনের ফলে মনে গোলযোগ দেখা দিয়েছে এবং তার ফলে সে ঘটনার অনুক্রম মিশিয়ে ফেলছে, যে-কথা ভাবে নাই সে-কথা ভেবেছে বলে কল্পনা করছে, সম্ভাব্য কিন্তু ঘটে নাই এমন সব কথা তুলছে। আসল সত্য কী? আসল সত্য এই যে, মস্তিষ্কবিভ্রান্তির জন্যে কথাটা কাউকে বলার খেয়াল তার মাথায় আসে নাই। 

সেটাই কি সত্য, সম্পূর্ণ সত্য? 

না, আরেকটি কথা আছে যা হয়তো সে কাদেরকে কেন, কাউকে বলতে পারবে না। তার মনে হয়েছিল, বাঁশঝাড়ের কথাটি প্রকাশ করা যায় না। সে-টি কাদের আর তার মনের গোপন কথা। শরীরের গোপন স্থানে গুপ্তক্ষতের মতো। এমন কথা কাউকে বলা যায় না। 

ক্ষণকালের জন্যে একটি অজানা অন্তর্বেগে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে যুবক শিক্ষক। সে-ভাবাবেগ কাটলে সে গভীর নিঃসহায়তার সঙ্গে ভাবে, সে অল্পবয়সী দরিদ্র শিক্ষক, বাঁশঝাড়ে নিহত মানুষের মৃতদেহ কখনো দেখে নাই। তার যে মস্তিষ্কবিভ্রান্তি ঘটবে তাতে বিস্ময় কী? সে কিছুই বোঝে না, কিছুই জানে না। চতুর্দিকে যে-অন্তহীন রহস্য সে অনুভব করে তার কতটা সে বোঝে? সূর্যোদয় সূর্যাস্ত, উদ্ভিদ-তরুলতা, নদীপ্রবাহ, মানুষের হাসিকান্না-দুঃখকষ্ট, তার জন্মমৃত্যু : এ-সবের অর্থ কি সে বোঝে? সে জন্যেই সে একটি মানুষের সাহায্যের প্রয়োজন এমন তীব্রভাবে বোধ করছে। 

কাদের যে হত্যাকারী সে-ধারণা কী করে যায়? যে-ধারণা পরদিন দুপুরবেলা পর্যন্ত তাকে ভীত-নিপীড়িত করেছে, সে-ধারণা থেকে কোন যুক্তি সাক্ষ্য-প্রমাণের সাহায্যে সে মুক্তিলাভ করে? 

এ-প্রশ্নেও যুবক শিক্ষক ঠক্কর খায়। কিন্তু এ-প্রশ্নের কি কোনো বোধগম্য উত্তর আছে? সবই বিশ্বাস। দোষী, সেটাও বিশ্বাস; নির্দোষ, সেটাও বিশ্বাস। বিশ্বাসের ওপরই কি সমগ্র মানবজীবন নির্ভর করে নাই? বিশ্বাস যে, কাল সূর্যোদয় হবে, পাখিরা আবার গান করবে। বিশ্বাস যে আজকার পাড়-অবরুদ্ধ নদী কাল প্লাবিত হবে না। বিশ্বাস যে এবার ফসল হল না, বৃক্ষে ফল ধরল না, আগামী বছর ফসল হবে ফল ধরবে। বিশ্বাস যে অলব্ধ সুখও কোথাও সীমাহীন এবং নিশ্চিত, অনলবর্ষী দুঃখ-যন্ত্রণার সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ পাওয়া যাবে একদিন, এ-জীবনে না হলেও পরবর্তী জীবনে। বিশ্বাস যে, মনের গভীর অস্থিরতার উত্তর না পেলেও ভাবনা কী, কারণ কেউ কোথাও সে-মনের রক্ষক-অভিভাবক। সবই বিশ্বাস, জীবনের একমাত্র সম্বল। কাদেরের ক্ষেত্রে তার মনে কেবল এক বিশ্বাস ভাঙে, অন্য বিশ্বাস গড়ে 

এ-উত্তরই কি যথেষ্ট? সব বিশ্বাসেরই কোনো-না-কোনো হেতু থাকে। জীবনের একমাত্র অবলম্বন হোক, তবু তার মধ্যে একটা যুক্তির কাঠামো থাকে। 

না, তার এ-বিশ্বাসের কোনোই যুক্তি নাই। সে কেবল জানে, এমন কথা কিছুতেই সত্য হতে পারে না। পরদিন দুপুরে অন্ধ ভয় কাটলে সে পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারে, তা অসম্ভব। দুনিয়াতে নিষ্ঠুরতা পাপ-কলুষতা আছে সে জানে এবং তার প্রমাণ বাঁশঝাড়ের মৃতদেহটি। কিন্তু তা সর্বত্র ছড়িয়ে নাই, আগাছার মতো সর্বত্র জন্মায়ও না তা। তা যদি হত তবে মানুষে-মানুষে বিশ্বাস সম্ভব হত না, জীবন দুর্বিষহ হত। বস্তুতপক্ষে, তাহলে জীবনের কোনোই অর্থ থাকত না। 

তারপর তৃতীয় প্রশ্ন : সে-রাতে কাদের তার ঘরে কেন এসেছিল? যুবক শিক্ষকই হত্যাকারী কিনা সে কথা নিশ্চয় করে দেখার উদ্দেশ্যে কি? বা গভীর রাতে একটি অসহায় মৃতদেহ দেখে মনে পরম নিঃসঙ্গতা বোধ করলে সঙ্গলিপ্সা সান্ত্বনা-আশ্বাসের জন্যে? 

যুবক শিক্ষকের বিশ্বাস, সে হত্যাকারী কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হবার জন্যে কাদের আসে নাই। যুবক শিক্ষকের মতোই তারও মনে মানুষের উপর আস্থা না থাকার কারণ নাই। তাছাড়া সে যে যুবক শিক্ষককে সন্দেহ করে নাই তার প্রমাণ সে-ও পুলিশকে বা কাউকে কিছু বলে নাই। 

দ্বিতীয় রাতের ঘটনার বিষয়ে একটি প্রশ্ন যুবক শিক্ষকের কাছে জরুরি মনে হয়। যুবতী নারীর মৃতদেহটিকে গুম করে দেবার অত্যাশ্চর্য সিদ্ধান্তের কারণ কী? 

উত্তরটি যুবক শিক্ষক ভাসা-ভাসা দেখতে পায়। 

বাঁশঝাড়ে মৃতদেহটি আবিষ্কার করার পরদিন নির্বাক-নিদ্রালস কাদেরও সমস্তক্ষণ কান খাড়া করে রাখে। রাত হলে সে বোঝে, বাঁশঝাড়ের গুপ্তকথা কেউ জানতে পারে নাই। হয়তো তার অন্তর্ধানে তার আত্মীয়-স্বজনের বিস্ময়ের অবধি থাকে নাই। হয়তো নানাবিধ কারণ তাদের মাথায় আসে। কিন্তু সে যে গ্রামের প্রান্তেই বাঁশঝাড়ের মধ্যে চিরনিদ্রায় শায়িত সে-কথা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারে না। 

কাদের সাব্যস্ত করে, যুবতী নারীর মৃতদেহটি গুম করে দেবে। কেন? হয়তো সে ভাবে, হতভাগা নারীর পক্ষে বাঁশঝাড়ে অর্ধনগ্ন অবস্থায় আবিষ্কৃত হবার চেয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়াই শ্রেয় হবে। হয়তো তার জীবনে সুখশান্তি অর্থ-সম্পদ স্নেহ-ভালোবাসার মান-মর্যাদার সৌভাগ্য হয় নাই। তার মৃত্যুও কি এমন কুৎসিতভাবে ঘটবে? সে যদি তাকে এই গভীর অপমান থেকে বাঁচাতে পারে তবে অন্ততপক্ষে প্রাণান্তের পর তার একটু সাহায্য হবে। তাতে তার আত্মীয়-স্বজনের কোনো ক্ষতি হবে না। যাকে তারা হারিয়েছে তাকে আর ফিরে পাবে না। বরঞ্চ তার অন্তর্ধানে তাদের মনে রহস্যের সৃষ্টি হবে। সে-রহস্যে অনুপ্রাণিত হয়ে তারা হয়তো তার মৃত্যু সম্বন্ধে সুন্দর রূপকথা সৃষ্টি করতেও সক্ষম হবে। হতভাগা যুবতী নারী অবশেষে স্বপ্নাকাশের অম্লানকুসুমে পরিণত হবে। 

এখানে একটি কথা যুবক শিক্ষক ভালো করে বোঝে না। যুবতী নারীর যে প্রাণ নিয়েছে তার শাস্তির কথা কি কাদের ভাবে নাই? দেহ গুম করে দিয়ে সে খুনীর অপরাধও নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। তার শাস্তির চেয়ে যুবতী নারীর মান-মর্যাদাই কি তার কাছে বড় ঠেকেছে? অথবা তার মত এই কি যে, মানুষের অপরাধ মানুষের পক্ষে বিচার করা সম্ভব নয়, তাই তার অপরাধের প্রমাণ—–যা কেবল অর্থহীন আবর্জনা মাত্র—তা অদৃশ্য হয়ে গেলে ক্ষতি কী? যুবক শিক্ষক ঠিক করে, এ-বিষয়েও কাদেরকে প্রশ্ন করতে হবে। 

একা মানুষের পক্ষে একটি মৃতদেহ নদীতে বহন করে নিয়ে যাওয়া শুধু যে বিপজ্জনক তা নয়, অতি কষ্টসাধ্যও। কাদের সাহায্যের প্রয়োজন বোধ করে। কার সাহায্য চাইবে সে? 

অতএব পঞ্চম প্রশ্ন : সাহায্যের জন্যে কাদের তারই কাছে কেন আসে? প্রথম রাতে সে কি তার দুর্বল নির্বোধ চরিত্রের যথেষ্ট প্রমাণ স্বচক্ষে দেখে নাই? তারপর মানুষের ওপর নির্ভর করার কথা কী করে সে ভাবতে পারে? 

হয়তো ওসব কিছু নয়। কাদেরের মনে কোনো সন্দেহ থাকে না যে যুবক শিক্ষকই হত্যাকারী। অতএব সে স্থির করে যে, যে মানুষ যুবতী নারীকে হত্যা করেছে তাকে বাধ্য করবে যুবতী নারীকে শেষ অপমান থেকে রক্ষা করার জন্যে। 

অথবা বিচিত্র অবস্থার মধ্যে দু-জনের মধ্যে সাক্ষাৎ হলে কাদেরের মনে যুবক শিক্ষকের প্রতি কেমন একটা বন্ধুত্বের ভাব জাগে। তাই দ্বিতীয় রাতে স্বাভাবিকভাবে সে তারই দরজায় এসে হাজির হয়। 

শ্রান্তভাবে যুবক শিক্ষক আপন মনে স্বীকার করে, তার চারধারে ঘোর অন্ধকার, যে-অন্ধকারের মধ্যে অন্ধের মতোই সে প্রশ্নগুলি তৈরি করেছে। তবে তার সন্দেহ থাকে না যে, একবার কাদেরের সঙ্গে মন খুলে কথা বলবার সুযোগ পেলে সব অন্ধকার দূর হবে। এমন অন্ধকার জীবনে কখনো সে দেখে নাই, অন্ধকার থেকে মুক্তিলাভের জন্যে এমন তীব্র ব্যাকুলতাও কখনো বোধ করে নাই। 

অবশেষে মুয়াজ্জিনের তীক্ষ্ণ-কর্কশ কণ্ঠ সন্ধ্যাকাশ খণ্ডবিখণ্ড করে ফেটে পড়ে। একটু পরে যুবক শিক্ষক ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়। নিত্যকার মতো তার শীর্ণমুখ গম্ভীর। তবে আজ তার পদক্ষেপে লঘু চঞ্চলতা। 

নামাজের সময় কাদের দেখা দেয় নাই। বারান্দার কোণে ছেলেমেয়েদের পড়াতে বসে যুবক শিক্ষক কতক্ষণ শ্বসনক্রিয়ারহিত অবস্থায় থেকে হঠাৎ সজোরে নিশ্বাস নেয়। তারপর এক সময়ে তার মনে হয় অতি ক্ষুদ্র কণ্ঠে আনিশা কিছু বলছে। 

‘কী?’ 

কিন্তু সে ভাবে, কাদেরের বিবেকে দোষ জ্ঞান নাই। হয়তো ইতিমধ্যে দুই রাতের বিচিত্র নাটকের কথা সে ভুলে গেছে। যুবক শিক্ষকের বিবেকও পরিচ্ছন্ন। সে ভোলে না কেন? 

বইতে এক জায়গায় আনিশা আঙ্গুল দেয়। সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট উল্টায়। যুবক শিক্ষক আবার বলে, ‘কী?’ 

তারপর নীরব বারান্দায় মত্ত দেয়ালঘড়ির টক্টক্ আওয়াজ শোনা যায়। ওপর থেকে দাদাসাহেবের খড়মের আওয়াজ আসে। অবশেষে যুবক শিক্ষক বলে, ‘শক্ত কেন হবে? পশ্চাদাভিমুখে।’ 

আনিশা ঠোঁট উল্টায় আবার। অকারণে যুবক শিক্ষক এধারে-ওধারে তাকায়। বড়বাড়িতে এখন গভীর নীরবতা। বাইরে শীতের রাত ঝিম্ ধরে আছে। কেশে যুবক শিক্ষক আবার বলে, ‘পশ্চাদাভিমুখে।’ 

হয়তো কাদেরের মতে কর্তব্য শেষ হয়েছে। নদীর বুকে যে আশ্রয় নিয়েছে সে আর দেখা দেবে না। তার আর কিছুই করবার নাই। 

কাদেরের সঙ্গে তার যদি আর দেখা না-ই হয়? দু-বছর একই বাড়িতে বাস করেও যার সঙ্গে কথার আদান-প্রদান হয় নাই, তার সঙ্গে আবার কথা বলার সুযোগ না হওয়াই স্বাভাবিক। 

শীঘ্র আনিশা বসে-বসে ঝিমুতে শুরু করে। পাশে আমজাদ লাইনকাটা খাতায় সযত্নে কতগুলি অঙ্কের সংখ্যা সাজায়। যুবক শিক্ষক তাদের আর দেখে না। একনাগাড়ে একই ভঙ্গিতে বসে থাকার ফলে তার পায়ের গাঁটে কেমন কাঠ-কাঠ ভাব জাগে বলে সে নড়ে বসে। তারপর কুদ্দুসের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ প্রশ্ন করে, ‘তোমাদের কাদের দাদা কোথায়?’ 

তিনটি ছেলে মুখ তুলে তাকায়। তাদের চোখে ঘুম-ঘুম ভাব। অকারণে তারা এধার-ওধার দৃষ্টি দেয়। অবশেষে ভারি গলায় কুদ্দুস উত্তর দেয়, ‘কী জানি।’ 

‘ঘরে হবে।’ আরেকজন বলে। 

এই সুযোগে তৃতীয় ছেলেটি অদূরে আধা খোলা জানলার দিকে তাকায়। এখনো চাঁদ ওঠে নাই বলে বাইরে অন্ধকার। অন্ধকারকে তার ভয়। 

আবার নীরবতা নাবলে যুবক শিক্ষকের কাছে এবার হঠাৎ সবকিছু এমন অসত্য এবং অবাস্তব মনে হতে শুরু করে। সে ভাবটি কাটাবার জন্যেই হয়তো সে সজোরে নিশ্বাস নেয়, তার নাসারন্ধ্র কেঁপে ওঠে। তারপর তার ভয় হয়, দিনের মানসিক অবস্থাটি ফিরে আসছে যেন। সে আবার এমন একটি গুহায় প্রবেশ করছে যেখানে জন-মানব পশু-পক্ষীর আওয়াজ পৌঁছায় না। তখন বাইরে যেন জীবনের অবসান ঘটে, সারা পৃথিবী নির্জনতায় খাঁখাঁ করে। 

অবশেষে সেদিন শেষবারের মতো একচোখ-কানা মুয়াজ্জিনের উচ্চ কণ্ঠস্বর শোনা যায়। চমকিত হয়ে যুবক শিক্ষক সামনের বইখাতা বন্ধ করে, কর্কশ কণ্ঠস্বরে কেমন আশ্বস্ত বোধ করে। মানুষের কর্কশ কণ্ঠও সান্ত্বনাদায়ক। তাছাড়া, যা সে শোনে তা যেন মানুষের আদিম সতর্কবাণী। অন্ধকারাচ্ছন্ন বিপদসঙ্কুল পৃথিবীতে প্রহরী জেগে আছে জানলে ভীতির উপশম হয়। 

উঠবার আগে যুবক শিক্ষক কুদ্দুসের দিকে একবার তাকায়। কাদেরকে ডেকে পাঠাবে কি?

কিন্তু কিচ্ছু না বলে সে নীরবে বারান্দা ত্যাগ করে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *