চাঁদের অমাবস্যা – ৭

সাত 

সে-রাতে পড়ানোর অধিবেশন শেষ হলে যুবক শিক্ষক কুদ্দুসকে বলে, ‘কাদের মিঞাকে ডেকে দেবে?’ 

তারপর বারান্দার কালো-সাদা বরফি – ছককাটা মার্বেলের মেঝের দিকে তাকিয়ে সে নিশ্চলভাবে দাঁড়ায়। সে বুঝতে পারে, ছেলেমেয়েরা কৌতূহলভরে তার দিকে চেয়ে আছে, কিন্তু তার শীর্ণমুখে কোনো ভাবান্তর ঘটে না। তার আচরণ-ব্যবহার আর তার ক্ষমতাধীন নয় যেন। কেবল কুদ্দুসের যেতে দেরি হচ্ছে দেখে তার চোখে অস্থিরতার ঈষৎ আভাস জাগে। 

বারান্দা অবশেষে খালি হলে সে পূর্ববৎ নিশ্চলভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। দরজার ওপর দেয়ালঘড়িটা সশব্দে বাজে, ওপরতলা থেকে দাদাসাহেবের খড়মের আওয়াজ আসে। তারপর সে পদধ্বনিও থামে। প্রগাঢ় নীরবতায় তার বুকের স্পন্দন ঘড়ির আওয়াজের মতো জোরালো হয়ে ওঠে। 

গতরাতেই সে বুঝতে পারে, দেখার চেষ্টা না করলে হয়তো কাদেরের সঙ্গে বহুদিন দেখা হবে না। এমনিতে দেখা হবার সুযোগ-সুবিধা কম। যুবক শিক্ষক নিজে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শিক্ষকতার কাজে ব্যস্ত থাকে। দীর্ঘ দিনব্যাপী ইস্কুল আছে, দু-বেলা ছেলেমেয়েদের পড়াতেও হয়। অতএব সে স্ব-ইচ্ছায় দর্শন না দিলে তার সঙ্গে সাক্ষাতের সম্ভাবনা দৈবাৎ ঘটনার মতোই অনিশ্চিত। এ ক-দিন সে অপেক্ষায় থেকেছে, কিন্তু তার দেখা পায় নাই। স্পষ্ট বোঝা যায়, কাদেরের মনে তার সঙ্গে দেখা করার কোনো ইচ্ছা নাই। থাকলে সে আসত। কাদেরের এ-নিস্পৃহতার কোনো অর্থ সে বোঝে না। তার রহস্যময় ব্যবহারের ফলে যুবক শিক্ষকের মনে তার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্যে যে- তীব্র ব্যাকুলতার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে সযত্নে সাজানো নানা প্রশ্ন বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েছে। প্রশ্নগুলি আর দরকারিও মনে হয় না। তার সঙ্গে একবার দেখা হলেই সে যেন তার উত্তর পাবে, মনেরও নিদারুণ বিহ্বলতা কাটবে। 

আজ মগরেবের নামাজের সময় দাদাসাহেবের দিকে তাকিয়েই সাক্ষাতের আশায় বসে থাকার নিষ্ফলতা পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারে সে। বড়বাড়িতে কেবল দাদাসাহেবই কাদের সম্বন্ধে সচেতন। নামাজের আগে তাঁর ঈষৎ অনুসন্ধানী দৃষ্টি চোখে পড়লে যুবক শিক্ষক বোঝে, তিনি তারই সন্ধান করছেন। প্রায় দু-সপ্তাহ সে নামাজে যোগদান করে নাই। তার অনিশ্চিত মতিগতি তিনি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন বটে তবু সে এলে তিনি খুশিই হন। আজ সে আসে নি দেখে তিনি ক্ষুণ্ণ হন। সে ক্ষুণ্ণতা লক্ষ করে যুবক শিক্ষক তাঁর সঙ্গে একটা আন্তরিক যোগাযোগ বোধ করে। ফলে, মনে কেমন সবলতা আসে। সে-মুহূর্তেই সে স্থির করে, আজ রাতেই কাদেরকে ডেকে পাঠাবে। দাদাসাহেব নীরবে দিনের পর দিন তার জন্যে অপেক্ষা করতে পারেন, কিন্তু সে পারে না। আকণ্ঠ নিমজ্জিত মানুষের পক্ষে কারো জন্যে অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ভাঙন ধরেছে, কাদেরের সঙ্গে দেখা না হলে সে ভাঙন জোড়া লাগবে না। তারই নির্দেশে একটি অতিশয় অস্বাভাবিক কাজে সে তাকে সাহায্য করেছে, গভীর রাতে একটি নারীর মৃতদেহ বহন করেছে। বাক্স-পেটরা নয়, মেজ-কুর্সি নয় : মানুষের মৃতদেহ। তাকে কি কাদেরের কিছুই বলার নাই? সে হয়তো ব্যাপারটির অর্থ জানে, কিন্তু যুবক শিক্ষক জানে না। হয়তো তার পক্ষে সে ব্যাপারে বিস্তৃত হয়ে আবার গতানুগতিক জীবনযাত্রায় নির্বিঘ্নে মনোনিবেশ করা সম্ভব, যুবক শিক্ষকের পক্ষে সম্ভব নয়। 

অবশেষে কুদ্দুসের চটির আওয়াজ কানে আসে। এবারও যুবক শিক্ষকের মুখে কোনো ভাবান্তর ঘটে না; কিন্তু উত্তরের তীব্র প্রত্যাশায় তার সমস্ত দেহ পাথরের মতো শক্ত হয়ে ওঠে। তারপর সে-শক্ত আবরণের মধ্যে একটি দুর্বল হৃৎপিণ্ড থরথর করে কাঁপতে শুরু করে। কুদ্দুস যখন সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন সে তার দিকে তাকায় না। কেবল প্রশ্ন করে, ‘কী?’ 

‘কিছু বললেন না।’ 

যুবক শিক্ষক উত্তরটির অর্থ যেন বোঝে না। ক্ষিপ্র দৃষ্টিতে কুদ্দুসের দিকে তাকায়। সেখানে কোনো ব্যাখ্যা দেখতে না পেলে অকারণে খোলা দরজা দিয়ে বাইরের দিকে তাকায়। বারান্দায় অখণ্ড নীরবতা। 

‘শুধু বললেন, কেন। বললাম, জানি না।’ একটু ইতস্তত করে কুদ্দুস বলে। একটু থেমে সে আবার বলে, ‘যাই?’ 

যুবক শিক্ষক কোনো উত্তর দেয় না। প্রশ্নটি হয়তো শোনে না। তারপর সে নিজেই বারান্দা অতিক্রম করে বেরিয়ে যায়। 

ঘণ্টাখানেকের মধ্যে যুবক শিক্ষকের মনে এ বিশ্বাস জন্মায় যে, কিছু না বলার অর্থ সে আসবে না তা নয়। সাক্ষাতের জন্যে অনুরোধটি তার কানে পৌঁছেছে, এবার সময় করে সে আসবে। হয়তো একটু রাত হলে আসবে। লণ্ঠনের আলোটা কিছু কমিয়ে দরজাটি সামান্য খোলা রেখে চৌকির ওপর বসে যুবক শিক্ষক অপেক্ষা করতে শুরু করে। রাত তখন ইতিমধ্যে গভীর হয়ে উঠেছে। 

মধ্যরাত গড়িয়ে গেলেও কাদেরের কোনো চিহ্ন দেখতে না পেলে সে দরজা খুলে একবার বড়বাড়ির দিকে তাকায়। চাঁদ তখন উঠেছে, তবে আজ তার আলো নিস্তেজ। সে-আলোয় অন্ধকারাচ্ছন্ন বড়বাড়ি ফ্যাকাসে দেখায়। সেখানে কেউ জেগে নেই। কতক্ষণ সে বড়বাড়ির দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল জানে না, অকস্মাৎ এক সময় সামনের দৃশ্য মুছে গিয়ে তার চোখের সামনে আগুনের নৃত্য শুরু হয়েছে। সে বুঝতে পারে, হঠাৎ একটি দুর্দান্ত ক্রোধ তাকে গ্রাস করেছে। যে-মানুষের প্রতি দু-বছরব্যাপী অস্পষ্ট কৌতূহল, অবিশ্রাম উদাসীনতার পর হঠাৎ শ্রদ্ধা-ভক্তি, এমনকি কেমন একটা বন্ধুত্বের ভাব জেগেছে, সে-ই এ ক্রোধের কারণ। কিছুক্ষণ পর দরজায় খিল দিয়ে সে বিছানায় ফিরে আসে। ক্রোধ তখনো পড়ে নাই। নিষ্ফল ক্রোধ সহজে মিটতে চায় না। 

এক সময়ে সে হয়তো ঘুমিয়ে পড়ে। যখন আবার জেগে ওঠে, তখন সে কান পেতে কিছু শোনবার চেষ্টা করে, কিন্তু রাত্রির গভীরতায় কোনো আওয়াজ শুনতে পায় না। নীরবতা শূন্যতার মতো অন্তহীন মনে হয়। এ-নীরবতা কখনো যেন ভাঙে নাই, ভাঙবেও না। ক্রমশ একটি অবাস্তব ভাব এসে তার সময়-কালের চেতনাবোধ লুপ্ত করে দেয়। সে না ঘুমিয়ে অন্ধকারে চোখ খুলে নিঃসাড় হয়ে শুয়ে থাকে। 

অবশেষে সে-চেতনাহীনতা থেকে ক্ষীণভাবে তার মনে একটি প্রশ্ন জাগে। সমস্ত ঘটনাটি কি একটি বিচিত্র দুঃস্বপ্ন? চমকিত হয়ে প্রশ্নটি সে ভেবে দেখে। যত ভাবে ততই তার সত্যাসত্য সম্পর্কে সন্দেহ থাকে না। তাই ঘটনাটি আগাগোড়া একটি অত্যাশ্চর্য স্বপ্ন। কাদেরকে ডেকে পাঠালে সে কুদ্দুসকে জিজ্ঞাসা করেছিল কেন সে দেখা করতে চায়। তার প্রশ্নের অর্থ এবার সে বুঝতে পারে। 

এ নোতুন জ্ঞান লাভে প্রথমে সে অস্থির হয়ে উঠে বসে। তার কি মস্তিষ্ক সুস্থ নয়? ঘরের কোণে সুরাহি থেকে পানি ঢেলে সে গলা সিক্ত করে, দু-চারবার পায়চারি করে, তারপর আবার চৌকিতে ফিরে এসে বসে। না, ঘটনাটি দুঃস্বপ্ন, দু-রাতব্যাপী দীর্ঘ দুঃস্বপ্ন। সে-দুঃস্বপ্নের কথা সে ছাড়া দ্বিতীয় ব্যক্তি জানে না। জানা সম্ভব নয়। সে জন্যেই কাদের জিজ্ঞাসা করেছিল, কেন 

দুঃস্বপ্ন বাস্তবরূপ ধারণ করলেও তাতে কিছু অবাস্তবতা, কিছু যুক্তিহীনতার ছাপ না থেকে পারে না। ঘটনাটিতে এবার সে যে শুধু অবাস্তবতার সুস্পষ্ট ছাপ দেখতে পারে তা নয়, স্থানে স্থানে অযৌক্তিকতা তার কাছে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। 

প্রথমত, হত্যাকারীর আচরণ। হত্যাকারী বাঁশঝাড়ে বসে যুবক শিক্ষকের জন্যই অপেক্ষা করে। সে যখন জানতে পারে, বাঁশঝাড়ের বাইরে সে এসে দাঁড়িয়েছে, তখন সে যুবতী নারীর জীবনাবসান করে। তারপর সে চাঁদের আলোয় হাওয়ার মতো মিলিয়ে যায়। বাইরে কে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে? বড়বাড়ির আত্মভোলা দরবেশ ধরনের মানুষ, কাদের। সে-ও তারই জন্যে অপেক্ষা করে যেন। স্বপ্নে ছাড়া এমন ঘটনা কি সম্ভব? স্বপ্নে কাদেরের আবির্ভাবের কারণও সে বুঝতে পারে! কাদের নাকি দরবেশ। বিস্ময় কী, সে-ই সে স্বপ্নের একটি বিশিষ্ট চরিত্র হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে? 

‘সবটাই দুঃস্বপ্ন। অত্যাশ্চর্য দুঃস্বপ্ন।’ যুবক শিক্ষক আপন মনে ঘোষণা করে। স্বপ্নে যে সে প্রায় সারারাত ছুটোছুটি করেছে পাগলের মতো, সে কথা স্মরণ হলে তার একটু হাসিও পায়। না, সে নয়, যুক্তি বিচার-বুদ্ধি থেকে স্বপ্নই পালিয়ে বেড়াচ্ছিল। 

‘আষাঢ়ের গল্পের মতো স্বপ্ন।’ এবার সে অস্ফুট কণ্ঠে বলে ওঠে। তারপর সে কৌতুকভরে স্বপ্নটির বিশ্লেষণকার্য নিয়ে অগ্রসর হয়। 

দুঃস্বপ্নের সেখানেই কি শেষ! আষাঢ়ে গল্পের শেষ নাই : যার যুক্তি নাই, তার সমাপ্তিও নাই। 

বড়বাড়ির কাদের যে নিষ্কর্মা হলেও কারো সাতে পাঁচে নাই, দরবেশ না হোক তব আপন খেয়ালেই থাকে—সে-ই পরদিন রাতে তার ঘরে এসে হাজির হয়। সামাজিকতা বা প্রতিবেশীর সঙ্গে একটু গল্পগুজবের তাগিদে নয়, একটি ব্যাপারে সাহায্যের প্রয়োজন বোধ করে বলে। নিষ্কর্মা হলেও যে-মানুষ সম্ভ্রান্ত বংশজাত এবং ভদ্রলোক, সে বলে, দয়া করে চলুন, বাঁশঝাড়ের মৃতদেহটি নদীতে ফেলে দিয়ে আসি। দু-বছরে তার সঙ্গে কখনো আলাপ-সালাপ হয় নাই, প্রস্তাবটাও অতি বিস্ময়কর, তবু বড়বাড়ির মানুষ তারই সাহায্যপ্রার্থী হয়ে এসেছে, কী করে না করে? দ্বিরুক্তি না করে গায়ে আলোয়ান জড়িয়ে সে কাদেরের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে। অবশ্য কার্যান্তে কাদের চন্দ্রালোকের মধ্যে মিলিয়ে যায়। স্বপ্নটি হয়তো তাকে বেশিক্ষণ ধরে রাখা সমীচীন মনে করে না। ধরে রাখলে যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন উঠতে পারে, সে ভয় আছে। 

‘অদ্ভুত স্বপ্ন।’ যুবক শিক্ষকের বিস্ময় কাটে না। 

সেখানেই স্বপ্নের জের শেষ হয় না। স্বপ্নের ফেনিয়ে গল্প বলার আত্যন্তিক নেশা কাটে না। যুবক শিক্ষকের মতো উর্বরমস্তিষ্ক কল্পনাপ্রবণ খদ্দের পেয়ে সহজে কি তাকে হাতছাড়া করে? 

নদীতে দেহটি নিক্ষেপ করার ব্যাপারে সাহায্য-সহায়তার আদর্শ উদাহরণের পর দিন-দুপুরে ইস্কুল পর্যন্ত ছুটে যেতে স্বপ্নটি দ্বিধা করে না। যখন তার সহযোগীর টিফিনের সময় গল্পগুজব করে, তখন বিশ্রাম ঘরের এক কোণে বসে নিদ্রাভিভূত হয়ে সে স্বপ্নে দেখে নদীপথ, স্টিমারের সন্ধানী-আলো, পুলের ওপর দাঁড়িয়ে সারেঙ্গ মোল্লার মতো সারেঙ্গ, এক সহযোগী যার দীর্ঘ বিবরণ দেয়। কিন্তু স্বপ্নের পক্ষে পথভ্রষ্ট হওয়া অতি স্বাভাবিক। একটু ঘুরে-ফিরে আসল কথায় ফিরে আসে নদীবক্ষে যুবতী নারীর দেহটির আবিষ্কার 

একটি কথা ভেবে যুবক শিক্ষক কিছু ভাবিত হয়। তার মনে পড়ে, স্বপ্নের শেষভাগে সহযোগীদের প্রতি সে নিদারুণ ঘৃণা বোধ করেছিল। সে জানত না, তার মনের অন্তরালে মানুষের প্রতি এমন ঘৃণা লুক্কায়িত। এ-গোপন ঘৃণার পরিচয় পেয়ে সে ক্ষণকালের জন্যে শঙ্কাই বোধ করে। এ-ঘৃণার উৎপত্তি কোথায়? 

প্রশ্নটির উত্তর না পেলে সে স্বপ্ন-বিশ্লেষণকার্যে প্রত্যাবর্তন করে। যুবক শিক্ষক স্বীকার করে, এখানে- সেখানে অযৌক্তিকতা থাকলেও ঘটনার অনুক্রম বিন্যাসের ব্যাপারে এবং বিষয়বস্তুর কাঠামোতে আপাতদৃষ্টিতে স্বপ্নটির মধ্যে কোনো দোষঘাট নজরে পড়ে না। সে জন্যে তার কালোস্রোতে সে ভেসে যেতে পেরেছে, তাকে বাস্তব ঘটনা বলে গ্রহণ করতে তার দ্বিধা হয় নাই। না, সে-সব অযৌক্তিকতা স্বপ্নটির প্রধান দুর্বলতা নয়; তার প্রধান দুর্বলতা অন্যত্র। সে-দুর্বলতাটি এখন সে বুঝতে পারে বলেই স্বপ্নটির অসত্যতা তার চোখে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। 

স্বপ্নটির সে চরম দুর্বলতা তার আসল উদ্দেশ্যের মধ্যেই নিহিত। একটি অপঘাত মৃত্যুর কথা বলে দর্শকের মনের ভীতি-আঘাত জাগানোই তার আসল উদ্দেশ্য নয়, কারণ অপরিচিতা একটি নারীর এমন দুর্ভাগ্যের কথায় মনে যতই ভীতি-আঘাতের সঞ্চার হোক না কেন, তা তেমন গভীর বা স্থায়ী হওয়া সম্ভব নয়। অপঘাত-মৃত্যুটি উদাহরণ মাত্র, একটি সাংঘাতিক উপসংহারে পৌঁছাবার উপাদান। উপসংহারটি হল, মানুষের জীবনের প্রতি মানুষের নির্দয় নিষ্ঠুর উদাসীনতা। সেটাই স্বপ্নের মর্মকথা। স্বপ্নটির আসল উদ্দেশ্য যে সফল হয়েছে তার প্রমাণ যুবক শিক্ষকের বিপর্যস্ত মন। যুবতী নারীর মৃত্যুর সঙ্গে যে-নৃশংসতা জড়িত সে-নৃশংসতা নয়, মনুষ্যত্বহীন ভয়াবহ সে-মর্মকথাই তাকে এমন গভীরভাবে বিচলিত করেছে। 

যুবক শিক্ষক এখন বুঝতে পারে, সে-মর্মকথাই স্বপ্নটির প্রধান দোষ, প্রধান দুর্বলতা। নানাবিধ গাল্পিক কারুকার্যের মধ্যে কৌশলে লুকানো যে-অসত্যের ওপর স্বপ্নটি স্থাপিত, সেদিকে একবার দৃষ্টি পড়লে স্বপ্নটি স্বপ্নেরই মতো ধূলিসাৎ হয়, যে-বৃক্ষটি শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে সত্যরূপ ধারণ করেছিল, মূল নেই বলে সে – বৃক্ষটি নিমেষেই ধরাশায়ী হয়। বাস্তব জীবনে মানুষ মানুষের প্রতি এমন নির্দয়-নিষ্ঠুরভাবে উদাসীন নয়। 

যুবক শিক্ষক বুঝতে পারে না কী করে স্বপ্নটি তাকে এমনভাবে সম্মোহিত করতে পেরেছিল যে সে প্রশ্ন না করে তার হাতে বন্দি হয়ে থেকেছে, দিনের আলোতেও তার হাত কবল থেকে মুক্তিলাভ করতে পারে নাই। এর অর্থ কি এই যে, তার মন অতিশয় দুর্বল? অথবা, মনের অদৃশ্য কোনো অংশে অতি গোপনে সে কি নিজেই এমন অদ্ভুত বিশ্বাস পোষণ করে? তীব্র ঘৃণার পরিচয় পেয়ে সে সামান্য শঙ্কিত হয়েছিল : এবার তার শঙ্কার অবধি থাকে না। 

কিন্তু দুঃস্বপ্ন অবশেষে দূর হয়েছে এ-জ্ঞানে তার মনে যে-গভীর স্বস্তির ভাব দেখা দেয়, তাতে সব শঙ্কা ভেসে যায়। একটি কুৎসিত সর্বধ্বংসী জন্তুর শ্বাসরোধ-করা- আলিঙ্গন থেকে অবশেষে সে মুক্তিলাভ করেছে। সে আর কিছু ভাবতে চায় না। সব উৎকণ্ঠা—উদ্বেগ কেটেছে বলে সারা দেহমন কেমন অপরিসীম ক্লান্তিতে আচ্ছন্ন হয়, তবু সে ক্লান্তি অতি মধুর, অতি সুখদায়ক মনে হয়। না, সে আর কিছুই ভাবতে চায় না। গভীর তৃপ্তির সঙ্গে সে অনুভব করে, একটি আরামদায়ক ক্লান্তি স্রোতের মতো বইছে এবং তাতে তার চিন্তাশক্তি তলিয়ে যাচ্ছে। কেবল তাতে বাষ্পের মতো হাল্কা উষ্ণ একটি কৃতজ্ঞতার ভাব ভেসে থাকে। সে-কৃতজ্ঞতা এই জন্যে যে, মানুষের ভাগ্য খামখেয়ালি এবং নির্মম হলেও মানুষ মায়ামমতাশূন্য নয়, অতি নিস্পৃহের নিকটও অন্যের জীবন মূল্যহীন নয়। 

যুবক শিক্ষকের শীর্ণ-শুল্ক দেহের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে আবার মোহময় জীবিতাশা প্রবাহিত হয়। অন্ধকার ঘরে বাঁশের দেয়ালের ছিদ্রে ছিদ্রে বাইরের চন্দ্রালোক চিকন কারুকার্য বিস্তার করেছে। সে-দিকে স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর তার মনে প্রার্থনার মতো ভাব আসে, সঙ্গে-সঙ্গে তার চোখ একটু সজল হয়ে ওঠে। মনে মনে ভাবে, স্নিগ্ধ-সুন্দর চাঁদের পৃষ্ঠদেশ মানুষ দেখতে পায় না। তার অন্ধকার অংশে যদি কদর্যতা-নিষ্ঠুরতা থাকে, তা যেন কেউ কখনো না দেখতে পায়। 

তার মাথার তলে তুলায় ঠাসা ছোট বালিশের এক কোণে রঙিন রঙের সুতায় তৈরি একটি গোলাপ ফুল। তারই পাশে এবার দু-এক ফোঁটা চোখের পানি নিঃশব্দে ঝরে পড়ে। মনে-মনে সে আবার বলে, কোনো দুঃস্বপ্নও যেন কখনো সত্য না হয়। 

অবশেষে শ্রান্ত যুবক শিক্ষক ঘুমিয়ে পড়ে। 

ঘরের কোণে দড়িতে একটি লুঙ্গি ঝোলে। তার কোণটা একটু ছেঁড়া। গতকাল লুঙ্গিটি সে ধুয়েছে কিন্তু ছেঁড়া অংশটি সেলাই করবার সময় পায় নাই। 

দ্বিতীয় রাতে বাঁশঝাড়ে অপেক্ষাকৃত নূতন লুঙ্গিটির সে-দশা ঘটে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *