চাঁদের অমাবস্যা – ১০

দশ 

অপরাহ্ণে সামনের উঠানে ছেলেমেয়েরা শোরগোল করে খেলা করে। দাদাসাহেব বাড়িতে নেই। সম্ভবত তাঁর পীরের সঙ্গে দেখা করতে শহরে গেছেন। 

চৌকিতে লম্বা হয়ে শুয়ে থেকে যুবক শিক্ষক এক সময়ে হঠাৎ উঠে বসে। শোরগোলটা যেন মাত্রাতিরিক্ত হয়ে উঠেছে। পাম্প-সু পায়ে দিয়ে সবুজ আলোয়ানটা গায়ে জড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে সে দ্রুতপদে নদীর দিকে হাঁটতে শুরু করে। মেঘহীন আকাশে নিরুত্তপ্ত সূর্যের মধুবর্ষী সোনালি আলো। হাওয়া নেই বলে নিশ্চলতা, তবু চতুর্দিকে আলো আর রঙের নিঃশব্দ ঘূর্ণিঝড়। সেদিকে যুবক শিক্ষকের দৃষ্টি নাই। তারপর নদীর তীরে পৌঁছে সে অনিশ্চিতভাবে থামে। নদীর নিস্তেজ মসৃণ ধারায় এবং ওপারে কাশবনের শুভ্র বিন্যাসেও সোনালি আভা। এ- সবও সে দেখে না। তার নিদ্রা-তৃষ্ণার্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি একটি তীব্র আশায় জ্বলজ্বল করে। কোথায় সে যেন আলো দেখতে পায় : তার প্রশ্নের একটি উত্তর যেন আলিঝালি চোখে পড়ে। তার সম্পূর্ণ রূপ দেখবার জন্যে সে অধীর হয়ে ওঠে। অনিশ্চিতভাবে থেমে পড়ে সে দাঁড়িয়েই থাকে। 

সারা দুপুর একটি কথাই তার মনে বারেবারে ঘোরে : কী কারণে কাদের দেহটি নদীতে ফেলবে ঠিক করে? সে এ-কথার কোনো সন্তোষজনক উত্তর এখনো পায় নাই। আসল সত্য জেনেও যা সে জানতে পারে নাই, তা সে-উত্তরের মধ্যেই পাবে তাতে তার সন্দেহ নাই। সে-উত্তরটা হাতের নাগালে এসেছে। কেন কাদের বিপজ্জনক কাজটি করতে তৈরি হয়? হাতুড়ি দিয়ে প্রশ্নটিকে সে যেন বার বার পেটায়। তাতে যে স্ফুলিঙ্গ জাগে, সে-স্ফুলিঙ্গ তার চোখেও প্রতিফলিত হয়। 

যুবক শিক্ষক অনেক কথাই নির্বিবাদে মেনে নিয়েছে। অকস্মাৎ অন্ধ ভয় হলে বুদ্ধি-বিবেচনাশক্তি হারিয়ে একটি মানুষ অন্য একটি মানুষের জীবন নিতে পারে। যত বীভৎস হোক, তবু সেটা দুর্ঘটনা বলে মেনে নেয়া যেতে পারে। সে-কথা যুবক শিক্ষক সম্পূর্ণভাবে মেনে নিয়েছে। এ-কথাও সে স্বীকার করে, জীবন অতি ভঙ্গুর! জীবন দুর্বল সুতায় বাঁধা। সামান্য অসাবধানতায় জীবনাবসান হতে পারে। কিন্তু কাদের কী কারণে দ্বিতীয় রাতে বাঁশঝাড়ে আবার ফিরে গিয়েছিল? 

যুক্তিতে কোথাও একটা অসম্পূর্ণতা সে দেখতে পায়। জীবন ভঙ্গুর সে-কথা সে মানে, কিন্তু জীবনের মূল্য নাই সে-কথা সে মানে না। অন্ততপক্ষে যারা জীবনের মূল্য বোঝে, তারা যখন সে-কথা বলে তখন সে মানতে রাজি নয়। তার মনে হয়, সে-কথা মানলে জীবনের ভিত্তিই ধূলিসাৎ হবে, বেঁচে থাকার পশ্চাতে কোনো যুক্তিসঙ্গত অর্থ থাকবে না। না, জীবন মূল্যহীন নয়। অতএব কাদেরের উক্তিটি সম্পূর্ণভাবে সত্য নয়; তার স্বয়ংসম্পূর্ণ রূপটি ধোঁকা মাত্র। 

ভয়জাত আকস্মিক দুর্বলতার কথাও গ্রহণযোগ্য। নিদারুণ ভয়ে কাদের একটি জঘন্য কাজ করেছে। কিন্তু সে-দুর্বলতা সাময়িক মানসিক অবস্থা মাত্র : বিশেষ একটি মুহূর্তে মনের একটি বিশেষ অবস্থা। কিন্তু সে সাময়িক মানসিক অবস্থা সময়– কালনিরপেক্ষ চরম সত্য বলে মেনে নিলে একটি অতীব শোচনীয় সিদ্ধান্তেই পৌঁছতে হয় : মানুষ পশুর চেয়েও অধম। কিন্তু তা সম্ভব নয়। সে-নিদারুণ অন্ধভীতির মুহূর্তটিই একমাত্র সত্য এবং তার পশ্চাতে বা সম্মুখে কিছু নাই, সে-কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। পূর্বের উক্তির মতো এ-উক্তিটিও সম্পূর্ণ সত্য নয়। অতএব, জীবনের ভঙ্গুরতা এবং সাময়িক মানসিক দুর্বলতা —যার অকস্মাৎ গোলযোগের ফলে একটি যুবতী নারীর জীবনাবসান ঘটে—সে দুটির একটিও নিরালম্ব সম্পূর্ণ সত্য বলে গ্রহণ করা যায় না। 

যুবক শিক্ষকের চোখ ছুরির মতো ধারালো হয়ে ওঠে। তার শীর্ণ মুখেও প্রত্যাশার তীক্ষ্ণতা। 

সে দৃঢ়ভাবে আপন মনে বলে, একটি মুহূর্তের কথা বলে কাদের তার চোখে ধুলা দিয়েছে। তাই সে-মুহূর্তের পেছনে সে তাকাতে পারে নাই; সে-নিদারুণ মুহূর্তে চোখ এমন ঝলসে যায় যে আর কিছু দেখা তার পক্ষে সম্ভব হয় নাই। পেছনে সে তাকাতে পারে নাই বলেই কাদেরের দ্বিতীয় রাতের ব্যবহারের কারণও সে বুঝতে পারে নাই। 

তারপর এক সময়ে যুবক শিক্ষকের শিরা-শিরায় আঁট হয়ে থাকা মুখে হয়তো বহুদিন পরে একটা ক্ষীণ হাসির আভাস দেখা দেয়। সে বুঝতে পারে, তার সন্ধান সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে, সে তার উত্তর পেয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে কাদেরের যে-চেহারা আজ প্রত্যুষে ঘৃণ্য মানুষের চেহারায় রূপান্তরিত হয়েছিল, সে চেহারাটি একটি নূতন রূপে তার মনশ্চক্ষুতে উদয় হয়। চেহারাটি একটি স্বল্পভাষী, গোপন স্বভাবের প্রেমিক মানুষের। সে জন্যেই যুবক শিক্ষকের মুখে ঈষৎ হাসির আভাস দেখা দেয়। 

কাদের তার দুষ্কীর্তির চিহ্ন ধ্বংস করবার জন্যে যুবতী নারীর দেহটি নদীতে ফেলে নাই। একটি কারণেই মানুষ মানুষের অন্তিম ব্যবস্থা না করে পারে না। সে কারণ, প্রেম-ভালবাসা। যুবতী নারীর দেহটি পরিত্যক্ত জঞ্জালের মতো বাঁশঝাড়ে পড়ে থাকবে সে-কথা তার অসহ্য বোধ হয়েছে। না, প্রথম রাতের সে-নিদারুণ মুহূর্তের পেছনের ইতিহাস না জানলে দ্বিতীয় রাতের ঘটনা বোঝার উপায় নাই। যে-ব্যাপারটি দুর্বোধ্য মনে হয়েছিল, সে ব্যাপারটি এবার ছকে-ছকে মিলে যাচ্ছে : চিত্রটিতে আর ফাঁক নাই। এবার যুবক শিক্ষক শুধু যে দেহটি নদীতে ফেলার সিদ্ধান্তের কারণ বোঝে তা নয়, কাদের কেন তার সাহায্যপ্রার্থী হয়েছিল সে-কথাও সে পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারে। একজন মানুষের সাহায্যের তার বিশেষ প্রয়োজন হয়েছিল বইকি। যুবতী নারী মৃত হলেও তার দেহটি অতি প্রিয়। একাকী তা বহন করার চেষ্টা করলে তার অযত্ন-অসম্মান হত, দেহটি টানা—হ্যাঁচড়া করতে হত, প্রতি মুহূর্তে এ-কথাও স্মরণ হত যে সে আর জীবিত নাই। কাদেরকে সাহায্য করার সময় যুবক শিক্ষক যেন দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু এখন ঘোর অন্ধকার থেকে কাদেরের উৎকণ্ঠিত কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। বারে বারে সে কি তাকে সাবধান হতে বলে নাই? এত সাবধানতার অর্থ কি এই নয় যে, যুবতী নারীর মৃতদেহেও একটু আঁচড় লাগবে তা তার সহ্য হয় নাই? তারপর, নদীর পাড় বেয়ে নাবতে গিয়ে যুবক শিক্ষক হুমড়ি খেয়ে পড়লে, এবং শেষ মুহূর্তে কাদেরকে সাহায্য করতে সক্ষম না হলে, কাদেরের মনে তার প্রতি যে তীব্র ঘৃণা জেগেছিল সে ঘৃণাও কি যুক্তিটিকে সম্পূর্ণভাবে সমর্থন করে না? না, দেহটি তার কাছে অতি প্রিয় মনে না হলে পরের সাহায্য দরকার সে বোধ করত না। শুধু দুষ্কীর্তির প্রমাণ ধ্বংস করতে চাইলে কোনোপ্রকারে নিজেই অপ্রীতিকর কাজটি সম্পন্ন করত। 

একটি গভীর স্বস্তিবোধে আপ্লুত হয়ে যুবক শিক্ষক ভাবে, বাঁশঝাড়ের দুর্ঘটনাটি নিঃসন্দেহে অতিশয় মর্মান্তিক কিন্তু তাতে এ-কথা প্রমাণিত হয় না যে, জীবন মায়ামমতাশূন্য নিঃসাড় প্রান্তর। দুর্ঘটনাটি অতিশয় শোচনীয়, কিন্তু সেটি মনুষ্যত্ববিবর্জিত নয়। তার বিশ্বাস প্রমাণিত হয়েছে; সে যে একটি অর্থহীন গোয়ার্তুমির জন্যেই কাদেরকে নিষ্ঠুর দুর্বৃত্ত বলে গ্রহণ করতে চায় নাই তা নয়। অবশ্য আজ সকালে ক্ষণকালের জন্যে কাদের সম্বন্ধে সে-অসত্য চিত্রটি সে গ্রহণ করেছিল বটে কিন্তু তার কারণ আকস্মিক আঘাত। আঘাতটি কাটলে কথাটি প্রত্যাখ্যান করতে তার দেরি হয় নাই। 

একটি কথা ভেবে যুবক শিক্ষক কিছুটা ক্ষুণ্নই হয়। হত্যার মতো ভীষণ কথাটি কাদের দ্বিধা না করে স্বীকার করেছে, কিন্তু যুবতী নারীর প্রতি তার ভাবাবেগের কথা ইশারা-ইঙ্গিতেও ব্যক্ত করে নাই। কেন? যে-ভাবাবেগের জন্যে যুবক শিক্ষক তাকে এখন ক্ষমা করতে প্রস্তুত, সে-ভাবাবেগ কি এতই লজ্জাকর যে তার ক্ষীণতম উল্লেখও তার পক্ষে সম্ভব হয় নাই? 

একটু ভেবে সে-বিষয়ে কাদেরের নীরবতার কারণ সে বুঝতে পারে। খাঁটি মানুষ অসঙ্কোচে দোষঘাট স্বীকার করে, কিন্তু হৃদয়ের সৌন্দর্য সহজে উন্মুক্ত করে না। তাছাড়া, সে- কথা যুবক শিক্ষককে বলবে কেন সে? ধরতে গেলে তাকে সে চেনেই না। 

অপরাহ্ণ গড়িয়ে গেছে বলে সূর্যের সোনালি আভা অনুজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তবু এবার সেদিকে উন্মুক্তদৃষ্টিতে তাকালে যুবক শিক্ষক বিস্মিত হয়। যেন সে ভেবেছিল মেঘাচ্ছাদিত কালো আকাশ দেখবে, কিন্তু দেখে নির্মল আলোর বিচ্ছুরণ। তার মনের তমসা সত্যিই কেটেছে! 

সে-আলোর দিকে তাকিয়ে শীঘ্র যুবক শিক্ষক একটি মিষ্টি-মধুর চিত্র দেখে। 

কাদের বলেছিল, আশ্বিন মাস। হয়তো আশ্বিনের প্রথমাংশ, ভাপসা গরমটা তখনো কাটে নাই। নদীতে ভরা যৌবন, খাল-বিল-পুকুরও কানায় কানায় ভরা। ছায়াশীতল পুকুরটির একটি পাড় কেমন উঁচু, যেন উদ্ধতভাবে ঘাড় তুলে দাঁড়িয়ে। সেখানে বসে কাদের। সামনে তেল-চকচকে মসৃণ ছিপ, অদূরে শান্ত পানিতে ফাত্রাটি স্থির হয়ে আছে। হয়তো পুকুরের অন্যধারে পানিতে ঝুলে থাকা বৃক্ষশাখায় একটি মাছরাঙাও নিশ্চল হয়ে বসে। রৌদ্রতপ্ত আকাশে চিল ওড়ে। 

ফানার মতো আর মাছরাঙার মতো কাদেরও নিশ্চল হয়ে বসে। তার চোখ অর্ধনিমীলিত। কিন্তু তাতে কোনো নিদ্রালস ভাব নাই। থেকে থেকে কেমন একদৃষ্টিতে পুকুরের অন্যদিকে সে তাকায়। সেখানে একটি যুবতী নারী দেহ-নিমজ্জিত করে অলসভাবে পানির শীতলতা উপভোগ করে। তার সিক্ত কালো চুলে প্রখর সূর্যের প্রতিফলন, পাশে একটা লাল রঙের আঁচল ভাসে। কাদেরের দিকে সে পেছন দিয়ে থাকে বলে তার মুখটা দেখা যায় না। কিন্তু কখনো কখনো সে ক্ষিপ্রদৃষ্টিতে কাদেরের দিকে তাকায়। চকিতে-দেখা তার মুখের পাশটা আর তার নীরব কটাক্ষ কাদেরকে প্রতিবার গভীরভাবে বিচলিত করে। যুবতী নারীর যৌবনদীপ্ত মুখে এখনো কৈশোরের সজীবতা, আকর্ষণময় চেহারায় নির্মল সরলতা। 

তারপর যুবতী নারী অনেকক্ষণ মুখ ফেরায় না। পানির তলে ধীরে ধীরে সে চক্রাকারে হাত নাড়ে, তাতে অতি সামান্য ঢেউ ওঠে। তাছাড়া সে স্থির হয়ে থাকে, ফাত্রার মতো, শাখায় মাছরাঙার মতো, কাদেরের মতো। তারপর যুবতী নারীর মুখটি দেখবার জন্যে কাদেরের মনে একটি বাসনা জাগে। সে-বাসনা ক্রমশ এত প্রবল হয়ে ওঠে যে মনে হয় উত্তপ্ত আকাশে রঙ-পরিবর্তন হয়, দিগন্তরেখায় স্বপ্নের কুয়াশা জাগে। কাদেরের অর্ধনিমীলিত চোখে ভাবাবেশ। এক সময়ে ভীষণভাবে ফাত্না নড়ে, কিন্তু সেদিকে তার দৃষ্টি যায় না। যুবতী নারী আর তাকায় না কেন? মাছরাঙাও নিঝুম হয়ে বসে অপেক্ষা করে। 

যুবক শিক্ষক থামে। চিত্রটি তার মনঃপূত হয় না। যুবতী নারীর বাড়ির পেছনে পুকুরটা সে দেখে নাই। কিন্তু সেখানে কাদের মাছ ধরতে বসতে পারে তা সম্ভব মনে হয় না। সে- চিত্রে খুঁত। 

কিন্তু তাদের প্রথম সাক্ষাতের চিত্র কল্পনা করার চেষ্টা করছে কেন সে? তাতে তার লাভ কী? আশ্বিন মাসে একদিন কোনোপ্রকারে তাদের মধ্যে দেখা হয়, তারপর তাদের মধ্যে ভাবাবেগ অনুরাগের সৃষ্টি হয় : তার পক্ষে তা-ই যথেষ্ট। নিজেকে সংযত করে প্লুতগতি কল্পনার রাশ ধরে। 

কিন্তু বেশিক্ষণের জন্যে নয়। নিজেরই অজান্তে আশ্বিনের একটি রৌদ্র-দগ্ধ অপরাহ্ণের চিত্র আবার তার মনে ভেসে ওঠে। না, কাদের পুকুরপাড়ে বসে নাই। ছিপ হাতে সে তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। হঠাৎ পুকুরের বিপরীত অংশে স্নানরতা একটি যুবতী নারীকে দেখতে পায়। তার কালো চুলে রোদ ঝিকমিক করে, মুখটা বাষ্পাবৃত বলে তাতে বিচিত্র আকর্ষণ। থমকে দাঁড়িয়ে সে তার দিকে তাকায়। যুবতী নারীও তার দিকে তাকায়; সরল দৃষ্টিতে হয়তো একটু বিস্ময় কিন্তু কোনো নির্লজ্জতার আভাস নাই। তারপর হঠাৎ সে চঞ্চল হয়ে ওঠে, মুখে তার রঙ ধরে। কী বিষয়ে নিশ্চিত হবার জন্যে দু-একবার কাদেরের দিকে তাকায়, তারপর তাড়াতাড়ি পুকর থেকে উঠে সে ঘরে ফিরে যায়। চিকন শরীর, পিঠভরা কালো চুল, পরনে লাল শাড়ি। পদক্ষেপ দ্রুত হলেও জড়ানো। অদৃশ্য হবার আগে সে আরেকবার কাদেরের দিকে তাকায়। এবার দৃষ্টিতে কেমন সলজ্জিত আকাঙ্ক্ষার আভাস। 

কিন্তু যুবক শিক্ষক নিজেই কি এমন একটি দৃশ্য কোথাও দেখে নাই? মনের অতল গহ্বর থেকে হঠাৎ একটি চেহারা ভেসে ওঠে। তেমনি চুল, তেমনি বাষ্পাবৃত মুখ, চোখে একটা অস্পষ্ট আকাঙ্ক্ষা। তেমনি শরীর, পরনে তেমনি লালপেড়ে শাড়িও। মনে পড়ে, সেদিন যুবক শিক্ষকের অন্তরে যে-বিচিত্র ভাবাবেগের সৃষ্টি হয় তাতে সে প্রথমে অভিভূত হয়ে পড়ে। তারপর একটি অজানা ভয় এসে তাকে গ্রাস করে। মেঘশূন্য আকাশে যেন অদৃশ্য ঝড় উঠেছে : ভয়েরই কথা। কিন্তু যে ঝড়ের নাম জানা নাই, যে ঝড়কে দেখা যায় না, সে-ঝড়কে চেপে রাখতে হয়। সে ঝড় তার মনে আর প্রত্যাবর্তন করে নাই। 

কাদের হয়তো সে-ঝড়ে ভীত হয় নাই, তাকে থামাবার চেষ্টাও করে নাই। হয়তো যুবক শিক্ষকের মতোই তার অর্থ সে বোঝে নাই, কিন্তু তার মতো সে ঝড় দমাবার চেষ্টা না করে বরঞ্চ তার মর্মার্থ বুঝতে চেষ্টা করে। যুবতী নারীকে কী একটা কথা বলার তীব্র ব্যাকুলতা বোধ করে যার অর্থ সে নিজেই বোঝে না। সে-কথা যেন ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। 

ব্যক্ত করতে পারলেও কথাটি বলা নিষেধ। যে-কথা আকাশের সূর্যচন্দ্রতারা, ধরণীর ফুললতাপাতা–দূর্বাদল বা স্রোতস্বিনী নদী নির্বিঘ্নে বলতে পারে সে-কথা বলা নিষেধ। যে- কথা হয়তো জীবন সম্বন্ধে একটি সরল কৌতূহল মাত্র, যার উৎস অজানার প্রতি মানুষের ভীতির মধ্যে, সে-কথা বলা নিষেধ। বললে ভীষণ পরিণাম নিশ্চিত : নদী নির্ধারিত ধারা পরিত্যাগ করে হয়তো মহাপ্লাবন সৃষ্টি করবে, নক্ষত্রপুঞ্জ কক্ষচ্যুত হয়ে প্রলয়ঙ্কর বিশৃঙ্খলতা বিস্তার করবে, সূর্য আর উদয় হবে না। সে-ভয়াবহ সম্ভাবনায় কে না ভীত হয়? তবু ভীত না হয়ে কাদের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করতে চেয়েছিল। 

কিন্তু তার দুঃসাহসের ফল তাকে ভোগ করতে হয়েছে। সে নিষেধাজ্ঞা খণ্ডনীয় নয়; একবার খণ্ডন করলে ক্ষমা নাই। পরিণামের কথা যখন বিদ্যুৎ-ঝলকের মতো তার স্মরণ হয় তখন দিশেহারা হয়ে যাকে সে একটি দুর্বোধ্য কথা বলবার জন্যে এত ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল, তাকেই আপন হাতে সে হত্যা করে। তার কঠোর শাস্তি : আমৃত্যু শোকাকুল অনুতাপ সে–অনুতাপের অসহনীয় জ্বালা কখনো প্রশমিত হবে না। 

যুবতী নারীর প্রতি তার ভাবাবেগ ন্যায়সঙ্গত নয় সে-কথা যুবক শিক্ষক উপলব্ধি করে। কিন্তু তার জন্যে সে চূড়ান্ত শাস্তি লাভ করে নাই কি? এরপর আর কোনো শাস্তির কথা উঠতে পারে না। অন্যায়ের তুলনায় শাস্তিটি অতি কঠোর বলে তার প্রতি মানুষের সমবেদনা হওয়াই স্বাভাবিক। 

একটি বিষয়ে যুবক শিক্ষকের মনে কোনো সন্দেহ নাই। সে যে-উত্তর পেয়েছে সে-উত্তরে সে সন্তুষ্ট। অন্যায় হোক, তবু যুবতী নারীর প্রতি কাদেরের মনে মায়ামমতা ভাবাবেগ ছিল। বাঁশঝাড়ের দুর্ঘটনাটি তাই নির্দয় নির্মম হত্যাকাণ্ড নয়। 

বাড়ি ফেরবার পথে যুবক শিক্ষকের তৃপ্ত মনে হঠাৎ অপ্রীতিকর একটি সন্দেহের ছায়া উপস্থিত হয়। যুবতী নারীর হত্যাকারী কে, সে নিজেই নয়? সে যদি কাদেরকে অনুসরণ না করত, অপ্রত্যাশিতভাবে এবং অকারণে বাঁশঝাড়ের সামনে উপস্থিত না হত, তবে দুর্ঘটনাটি ঘটত না। 

একটু ভেবে সে নিজেকে দোষমুক্ত করে। এ-কথা সত্য যে বাঁশঝাড়ে সে উপস্থিত না হলে মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি ঘটত না, কিন্তু অন্যদিন অন্যখানে অন্য কোনোপ্রকারে হয়তো এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি হত। আসল হত্যাকারী সে নয়, কাদেরের মনের গভীর ভীতি! সে-ভীতির মূলে সিন্দুকে লুকানো তোস্তারী কিংখাব হতে শুরু করে নানাবিধ নিষেধাজ্ঞা। সে-সব নিষেধাজ্ঞার যথার্থতা বিচার করার ক্ষমতা তার নাই, তা বিচার করে দেখতেও সে চায় না। তার প্রশ্ন কাদেরের হৃদয় সম্বন্ধে। কাদের তার চোখে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। 

বাড়ি পৌঁছবার আগে যুবক শিক্ষক একটি বিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়। তার চোখে কাদের যখন দোষমুক্ত হয়েছে তখন বাঁশঝাড়ের কথাটি আর প্রকাশ করার কথা ওঠে না। তার মুখ থেকে কথাটি কেউ জানতে পারবে না। অবশ্য দাদাসাহেবকে একটি কথা বলবে বলে সে ওয়াদা দিয়েছে। তাঁকে কী বলবে? সে কিছু ভাবিত হয়। সে বুঝতে পারে, তাঁকে আজেবাজে কোনো কথা বলে সে নিস্তার পাবে না। কী বলবে তাঁকে? 

তার বর্তমান স্বস্তিভরা মনের পক্ষে বেশি চিন্তা করা সম্ভব হয় না। তাই হয়তো সহসা সে ভাবে, তাঁকে বলবে কাদের দরবেশ। তিনি খুশি হবেন, কারো কোনো ক্ষতিও হবে না। 

তাছাড়া, কে দরবেশ কে দরবেশ নয়, সে-কথা কি কেউ কখনো সঠিকভাবে বলতে পারে? 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *