চাঁদের অমাবস্যা – ৬

ছয় 

প্রধান শিক্ষকের কামরার পাশে শিক্ষকদের বিশ্রামঘর। অসমতল মেঝের মধ্যখানে একটি সাধারণ কাঠের টেবিল। তার চারপাশে বিভিন্ন ধরনের কয়েকটা কুর্সি। তবে একটি কুর্সির ওপর সর্বদা সকলের নজর। বুনটের ফাঁকে-ফাঁকে সংখ্যাতীত পুষ্টাঙ্গ ছারপোকা, তবু সেটি বেতের তৈরি বলে আরামদায়ক। পিঠটা একটু হেলানো, দু-পাশে হাতলও আছে। আরামের বিনিময়ে রক্ত দিতে কেউ দ্বিধা করে না। আজ সে কুর্সিতে আরবির শিক্ষক মোহাম্মদ আফাজউদ্দীন এক হাঁটু তুলে আসনাধীন। মুখে সচেতন আয়েশী ভাব। 

টিফিনের সময় শিক্ষকরা গাম্ভীর্য-কর্তৃত্বের মুখোশ খুলে প্রায় ছাত্রদের মতোই হট্টগোল করে। খবরাখবরের আদান-প্রদান করে, নানা বিষয়ে ব্যক্তিগত মতামতের ঢাকঢোল বাজায়, শ্রোতা না পেলেও কেউ-না-কেউ শুনবে এ আশায় একতরফা বকে যায়। না শুনলেও পরওয়া নাই যেন। বিশ্রামঘরে শ্রোতারা সব সময়ে সংখ্যালঘিষ্ঠ। 

অভ্যাসমতো যুবক শিক্ষক এককোণে নির্বাক হয়ে বসে। সামনে একটি পুরোনো মাসিক পত্রিকা। সেটি পড়ার ভান করে। সহযোগীদের কথা কখনো কখনো কানে লাগে, কিন্তু তাও ভাসা-ভাসা ভাবে। তার কানের সীমানায় ধরবার কিছু না পেয়ে তাদের কথা পিছলে খসে যায়। কিছুক্ষণ সময় কাটে। যুবক শিক্ষক পাতা ওল্টায় না। 

এক সময়ে কোলাহলের মধ্য থেকে একটি শব্দ ছিটকে বেরিয়ে আসে। তারপর, অব্যর্থলক্ষ্য শব্দটি সরাসরি চাঁদমারি বিদ্ধ করে। নিমেষে সমস্ত কোলাহল, তাল-বেতাল দুর্বোধ্যপ্রায় বাক্যস্রোত স্তব্ধ হয়। সচকিত হয়ে যুবক শিক্ষক কান খাড়া করে। 

‘শুনেছেন?’ 

প্রশ্নকারের উচ্চকণ্ঠে গুরুত্বভাব। একটি শব্দের প্রশ্নই বিশেষ জরুরি ঘোষণার ভূমিকার মতো শোনায়। 

‘শুনেছেন?’ 

দ্বিতীয় বার কথাটি জিজ্ঞাসা করে প্রশ্নকার তৃপ্ত না হয়ে পারে না। তারই কণ্ঠ বিশৃঙ্খল কোলাহলের মধ্যে জয়লাভ করেছে। কারো মুখে টু শব্দ নাই। সে মনস্থ করে, তার জয় সম্পূর্ণভাবে উপভোগ করবে সে। 

‘বলতে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। স্মরণশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ছে।’ 

আকস্মিক বিনয়ের সঙ্গে এমন অসম্ভব বিস্মৃতিশীলতার দোষ স্বীকার করে প্রশ্নকার সাড়ম্বরে নিশীথরাতে নদীপথ-স্টিমারের পটভূমিকায় তার বক্তব্য শুরু করে। অবনতমুখে যুবক শিক্ষক তার কথা শোনে। যা শোনে তার চেয়ে বেশি মনশ্চক্ষুতে দেখে, কারণ তার মনে হয় ঘটনাটি তার অজানা নয়। সে দেখে শীতকালের নিস্তেজ শান্ত নদী, তার বুকে স্টিমারের অত্যুজ্জ্বল সাদা সন্ধানী-আলো। জনমানবশূন্য নদীপাড়, গাছপালাঘেরা ঘুমন্ত গ্রাম। নদী কোথাও চওড়া, কোথাও সরু; কোথাও তার বুকে উলঙ্গ চর চাঁদের আলোয় ধবধব করে। কোথাও প্রাচীন দুর্গ-দেয়ালের মতো পাড় খাড়া, কোথাও স্থলের সঙ্গে প্রায় সমতল। বাঁক কোথাও ক্রমিক, কোথাও আকস্মিক। রাতের গভীর নীরবতায় জলযানের যান্ত্রিক হৃৎপিণ্ড উচ্চস্বরে আওয়াজ করে। ওপরে, লম্বা সাদা কোর্তার ওপর আলোয়ান জড়িয়ে সারেঙ্গ দূরগামী চোখে, সন্ধানী-আলোর মতোই অহরহ এধার-ওধার তাকায়। মাথায় কিস্তি টুপি, মুখে ধার্মিক ব্যক্তির সৌম্যশুদ্ধভাব। সেখানে তাকে বড়ই একা এবং কিছুটা বেমানানও মনে হয়। যেন তারই পরিচালিত যান্ত্রিক জলযানের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নাই। তার দৃষ্টি যেন নদীতে নয়, দূরদিগন্তে, তারাতে বা ছায়াপথে নিবদ্ধ। 

নদীপথ-স্টিমারের এ-নিরীহ বিবরণেই যুবক শিক্ষকের বুক কাঁপতে শুরু করে। সে বোঝে, বক্তা এখনো আসল কথা পাড়ে নাই। সে নদীরই মতো এঁকে-বেঁকে সর্পিল গতিতে অগ্রসর হচ্ছে কেমন উদ্দেশ্যহীনভাবে, কিন্তু উপযুক্ত মুহূর্তে গন্তব্যস্থলে পৌঁছুবে। তার গন্তব্যস্থল যুবক শিক্ষক জানে। তবু তা শোনবার বাসনা এমন তীব্র হয়ে ওঠে যে সে শীঘ্র শ্রান্তিবোধ করতে শুরু করে। 

নিঃসন্দেহে ভণিতায় বক্তা মাত্রাতিরিক্ত সময় নিচ্ছে। একজন শ্রোতা বলে ওঠে, ‘ঠিকই বলেছেন। সারেঙ্গ নয়, মোল্লা যেন। ভুল করে মসজিদের মিম্বর ছেড়ে জাহাজের পুলে দাঁড়িয়েছে।’ হঠাৎ সে গলা উঁচু করে এধার-ওধার তাকায়। বলে, ‘ভালো কথা। এক চোখ কানা মুয়াজ্জিন কী করেছে শুনেছেন?’ তার বিবেচনায়, বক্তার সময় পেরিয়ে গেছে। আশান্বিতভাবে উৎসাহের জন্যে আবার এধার-ওধার তাকায় সে। উৎসাহ পেলে নিঃসন্দেহে কথার স্রোত অন্যপথে চালু করে দেবে। বলা বাহুল্য, দাঁড়ে থাকবে সে-ই। আলোচনার গতি-পরিবর্তনের ব্যাপারে সবারই মতো সে বিশারদ। 

দুঃখের বিষয়, এ-সময়ে আরামদায়ক কুর্সিটির পাশে দু-একজন শিক্ষক হঠাৎ সজোরে নাকে শব্দ করে ওঠে, মুখে তাদের বিষম বিরক্তির ভাব। একটা বদগন্ধ উঠেছে। খোলাখুলিভাবে তারা আরবির মৌলবীর দিকে তাকায়। মৌলবীর চোখ নিমীলিত। মুখে আয়েশী ভাবের ওপর এবার একটা আধ্যাত্মিক ভাবের অস্পষ্ট আভাস যেন। 

বক্তার বুঝতে দেরি হয় না, বিজয়ের উল্লাসে সে অসাবধান হয়ে পড়েছে, হাতের লাগাম ঢিলে করে দিয়েছে, প্রধান নদীপথ ছেড়ে খালে-বিলে কালক্ষেপ করেছে। শীঘ্র সে স্টিমারের সারেঙ্গের মতোই দক্ষতার সঙ্গে তার বক্তব্য সঠিকপথে চালিত করে। 

হঠাৎ মোল্লাসদৃশ সারেঙ্গ দেখতে পায়, নদীতে কিছু একটা ভাসছে। যুবক শিক্ষকও দেখতে পায় এবং বিবরণ শোনবার আগেই ভাসমান বস্তুটিকে চিনতে পারে। নিশ্বাস বন্ধ করে তবু সে শোনে। 

স্টিমার তখন বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তির মতো থরথর করে কেঁপে পূর্ণবেগে চলছে। সারেঙ্গের নির্দেশে এখানে-সেখানে নানারকম ঘণ্টা বাজে, স্টিমারের পার্শ্বদেশ থেকে প্রভূত বাষ্প নির্গত হয়, রাত্রির নীরবতার মধ্যে লস্করদের গলার আওয়াজ জেগে ওঠে। বিশাল তেলেপোকা যেন পথে-পড়ে-থাকা একটি বিন্দুবৎ ক্ষুদ্র দ্রব্য পরীক্ষা করে দেখবার জন্যে থামে। 

নদীর বুকে ভেসে যাওয়া বস্তুটি একটি নারীর মৃতদেহ। ফেঁপে-ফুলে কলাগাছ। দেহটি যে একটি যুবতী নারীর তা কেবল ডাক্তারই বলতে পারে। গলায় একটি রূপার হার আঁট হয়ে আছে। তাছাড়া সম্পূর্ণ বিবস্ত্র। 

‘বিবস্ত্র?’ একটি শিক্ষক সশঙ্ক নীতিবিদের কণ্ঠে উক্তি করে। কলাগাছের মতো ফাঁপা-ফোলা ভাসমান প্রাণহীন নারীদেহের পক্ষেও বিবস্ত্র হওয়া যেন দূষণীয়। 

তখন যুবক শিক্ষকের হাতও কাঁপতে শুরু করেছে। সে-বিষয়ে সচেতন হয়ে মাসিক পত্রিকাটি আস্তে টেবিলের ওপর রেখে সে কম্পমান হাত লুকিয়ে ফেলে। 

‘একেবারে বিবস্ত্র। রূপার হারটা ছাড়া গায়ে কিছুই নাই।’ 

সে-বিষয়ে যুবক শিক্ষকও যেন চিন্তিত হয়। মনে-মনে বলে, পাছাপেড়ে সাদা শাড়িটার কী হল? পরক্ষণে সে স্বীকার করে, শাড়ির রঙ সে জানে না। 

‘বয়স বেশি না। বড়জোর, বিশ একুশ। ডাক্তার তাই বলে। ফেঁপে-ফুলে কলাগাছ হলেও ডাক্তাররা ঠিক ধরতে পারে।’ 

‘পানির কলাগাছ না স্থলের কলাগাছ?’ কেমন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে একটি শিক্ষক রসিকতা করার চেষ্টা করে। তার কাছে কলাগাছের সঠিক বিবরণ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। 

নীতিবিদের মুখ লাল হয়ে ওঠে। হয়তো তার কল্পনায় বাধা পড়েছে। সে হয়তো দেখছিল, একটি বিবস্ত্র সুন্দরী নারী কলাগাছের ভেলায় চড়ে নদীতে ভেসে যাচ্ছে, এমন সময় স্টিমারের অত্যুজ্জ্বল আলো তার ওপর পড়ে। হীরার ওপর যেন আলো পড়ে, কারণ সে-আলোতে তার রূপ বিচ্ছুরিত হয়। তার দেহ যদি কিছু স্ফীত হয়ে থাকে, তার কারণ দুর্দমনীয় যৌবনভার। 

তারই কল্পনা-অগ্নিতে ইন্ধন যুগিয়ে বক্তা আবার বলে, ‘এমন অবস্থা, তবু বোঝা যায়, জীবিতকালে দেখতে-শুনতে মন্দ ছিল না।’

আরবির মৌলবী নিমীলিত চোখে এতক্ষণ নীরব হয়ে ছিল। এবার উচ্চস্বরে মন্তব্য করে, ‘তওবা তওবা! নীচজাতীয় মেয়েমানুষ হবে।’

এ-সব মন্তব্য যুবক শিক্ষকের কানে প্রবেশ করে না। সে অনুভব করে, একটি গভীর বিষাদে তার মন ভরে উঠেছে। দুঃখের সঙ্গে সে ভাবে, –যুবতী নারী অদৃশ্য হয়ে স্বপ্নাকাশের অম্লানকুসুমে পরিণত হতে পারল না। তবে কিছু বিস্ময়ের সঙ্গে এ-কথাও উপলব্ধি করে, তার দুঃখটা যুবতী নারীর জন্যে নয়, কাদেরের জন্যেই যেন। কাদেরের পরিকল্পনা সাফল্যমণ্ডিত হল না, তার সমস্ত শ্রম ব্যর্থ হল। খবরটা জানতে পেলে হয়তো তার দুঃখের সীমা থাকবে না। 

‘আরো শুনুন।’ বক্তা উচ্চ নাটকীয় স্বরে বলে। 

সবাই উদগ্রীব হয়ে তার দিকে তাকায়। 

‘মেয়েলোকটি আমাদেরই গ্রামের মানুষ।’

না, বিবস্ত্র হয়েও দেহ বিপুলাকার এবং মুখমণ্ডল কদাকার করেও যুবতী নারী তার পরিচয় ঢাকতে পারে নাই। শনাক্তকারের দৃষ্টির সামনে কোনো ছদ্মবেশই নিখুঁত নয়। 

‘মাঝির বউ!’ গ্রাম থেকে নিরুদ্দিষ্ট যুবতী নারীর কথা স্মরণ করে একজন শিক্ষক আবিষ্কারকের উল্লাসে ঘোষণা করে। 

গ্রামের করিম মাঝির বউ। স্বামীর নাম কী? নামটা ছমিরুদ্দীন, ছলিমউদ্দীন না করিমউদ্দীন, সে-বিষয়ে কিছু তর্ক হয়। 

নাম যা-ই হোক, সে লম্বা পাড়িতে ঘরছাড়া। ঘরে বিধবা মা, চোখে কম দেখে, বাতের ব্যথায় সব সময়ে গোঙায়। তার অবিবাহিতা মেয়েও ঘরে। কানা, বিয়ে হবে না। বাড়ির পেছনে পুকুর, নদীটাও কাছে। দুটি গরু, একটি ছাগল, উঠানের কোণে মোরগ-মুরগির খাঁচা। মাঝি বড় গতর খেটে কাজ করে। 

‘নদীতে পড়ল কী করে?’ 

প্রশ্নটি সকলকে বুদ্ধির যুদ্ধে যোগদান দিতে আহ্বান করে। অবিলম্বে নানারকম মতামতে বিশ্রামঘরটি মুখরিত হয়ে ওঠে। 

নীতিবিদ অবশেষে নিশ্চিত কণ্ঠে রায় দেয়, ‘এর মধ্যে নিশ্চয় কোনো কথা আছে। বলে দিলাম, মেয়েলোকটির ক্ষেতখামারে যাবার অভ্যাস ছিল।’ 

‘নিশ্চয়ই কথা আছে। এমনি পানিতে ডুবে কেউ মরে না।’ 

‘বললেন না বাজা মেয়েলোক? সে-ই হচ্ছে আসল কথা। বিয়ে-থার পর মেয়েমানুষের ছেলেপুলে না হলে পুরুষ-মরদের জন্যে মন খামখাম করে। জানা কথা।’ 

‘না, নিশ্চয়ই এর মধ্যে কোনো কথা আছে।’ 

যুবক শিক্ষক কোলাহলে সচেতন হয়ে বিহ্বলভাবে এধার-ওধার তাকায়। এত হট্টগোল কেন? তারপর সে লক্ষ করে, ভয়ানকভাবে তার হাত কাঁপছে। সভয়ে সে হাতদুটি টেবিলের তলে ঢাকে। তারপর কখন বিশ্রামঘরে একটি অস্বাভাবিক নিঃশব্দতা নেবে ক্রমশ তা গাঢ় হয়ে ওঠে। যুবক শিক্ষকের শিরদাঁড়া টনটন করতে শুরু করে। এ-নিঃশব্দতা তার পছন্দ হয় না। ইচ্ছা করে চোখ তুলে তাকায় একবার কিন্তু সাহস হয় না। 

অবশেষে দূর থেকে একটি গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে ওঠে। 

‘আরেফ মিঞা?’ 

এবার যুবক শিক্ষক চমকিত হয়ে চোখ তোলে কিন্তু কারো চেহারা স্পষ্টভাবে দেখতে পায় না। আবার কয়েক মুহূর্তব্যাপী অপ্রীতিকর নিঃশব্দতা। 

‘শরীর ভালো নয়?’ 

সাপের মতো ক্ষিপ্রভঙ্গিতে জিহ্বাগ্র দিয়ে সে ঠোঁট ভেজায়, কিন্তু শুষ্ক জিহ্বার তালু কাঠ-কাঠ মনে হয়। শরীরে অসীম দুর্বলতা। অসুস্থতারই লক্ষণ। অস্পষ্টকণ্ঠে সে উত্তর দেয়, ‘শরীরটি ভালো বোধ হচ্ছে না।’ তারপর পেটে হাত বুলিয়ে বলে, ‘হয়তো হজমটা ঠিক হয় নাই।’ 

তার একজন সহযোগী তাড়াকণ্ঠে হেসে ওঠে। 

‘বড়বাড়ির উত্তম খাবার হজম হয় নাই? তাজ্জব কথা!’ শিক্ষকদের মধ্যে যুবক শিক্ষকই বিনাখরচে বড়বাড়িতে থাকে খায়দায় বলে তার প্রতি সকলের মনে একটু লুকানো ঈর্ষা। সুযোগ পেলেই সে—ঈর্ষা প্রকাশ পায়। 

‘ঠিক জানি না। জ্বরটর আসছে বোধহয়।’

অন্য এক সহযোগী চোখ টিপে বলে, ‘অবিবাহিত যুবক মানুষ। জ্বর-ব্যাধি ছাড়াও নানা রোগ ঘাড়ে চাপে।’

যুবক শিক্ষকের রক্তহীন মুখে এক ঝলক রক্ত দেখা দেয় তা লক্ষ্য করে উক্তিটি যথাস্থানে বিদ্ধ হয়েছে ভেবে সহযোগীটি ইঙ্গিতে অন্যান্য শিক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সেদিকে। 

রক্তঝলকের কারণ লজ্জা নয়, সহযোগীদের প্রতি তীব্র ঘৃণাবোধ। সে-ঘৃণা ক্রমশ এত প্রচণ্ড রূপ ধারণ করে যে তার দম প্রায় বন্ধ হয়ে আসে। সে-পীড়াদায়ক ভাব থেকে রেহাই পাবার জন্যেই হয়তো সে বিপরীত চরিত্রের সন্ধান করে—এমন চরিত্র যার দয়ামায়া উদারতার শেষ নাই। বেশি সন্ধান করতে হয় না। তার মনশ্চক্ষুতে কাদের এসে দাঁড়ায়। সঙ্গে-সঙ্গে সারা অন্তর অতি স্নিগ্ধ মধুর শীতল হাওয়ায় জুড়িয়ে যায়, চারপাশে দেয়াল ধসে পড়ে বলে উন্মুক্ত দিগন্তের দিকে তাকাতে আর বাধা থাকে না। তার মনে হয়, উন্নতচরিত্র দয়াশীল স্নেহশীল কাদেরের তুলনায় তার সহযোগীরা সব অতি নীচমনা কলুষজর্জরিত মানুষ। এখন এই ভেবে তার পরম দুঃখ হয়, কাদের যাকে গভীর অপমান হতে বাঁচাতে চেয়েছিল, সে তাদেরই হাতে ধরা পড়েছে। এবার তারা তাকে নির্দয়ভাবে টুকরো-টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলবে। 

যুবক শিক্ষকের আর সন্দেহ থাকে না, কাদেরের অভিপ্রায় সে সম্পূর্ণভাবে বুঝতে পেরেছে। কিন্তু সে-কথা তাদের মধ্যেই লুকানো থাকবে, কারণ অন্যেরা তার মর্ম বুঝবে না। তাদের দয়ামায়াশূন্য কুণ্ডলিত বিকৃত মনে যুবতী নারীর দেহটি নিশ্চিহ্ন করে দেবার চেষ্টাই অতি বিচিত্র ঠেকবে। প্রতিশোধ নেবার শক্তি যার নাই, এমন দুর্বল অসহায় মানুষের মৃত্যুর মধ্যে যে-চরম অপমান সে-অপমানের তাৎপর্য কি তাদের কূপের মতো অন্ধকার বায়ুহীন মস্তিষ্কে প্রবেশ করবে? পরিত্যক্ত হতভাগিনী যুবতী নারীর প্রতি যে গভীর স্নেহ-মমতা জেগেছিল কাদেরের মনে, তার মূল্য কি তারা বুঝবে? দীপ্ত উজ্জ্বল সূর্যের সঙ্কেত, কনকপ্রভা চন্দ্রালোকের আহ্বান, ঘূর্ণাবর্তের অস্থিরতার অর্থ তারা যেমন বুঝবে না, তেমনি এ-সব কথাও বুঝবে না। বোঝানোর চেষ্টা পণ্ডশ্রম হবে। কুণ্ডলীকৃত মনের পক্ষে সরল হওয়া বা দূরগামী হওয়া দুষ্কর। 

যুবক শিক্ষকের মনে কাদেরের প্রতি শ্রদ্ধাভক্তি আরো গাঢ় হয়। একটু অবাক হয়ে সে আরেকটা ব্যাপার লক্ষ করে। সে যেন স্বচ্ছ, শঙ্কাভীতিশূন্যদৃষ্টিতে যুবতী নারীর দিকে তাকাতে পারছে। শুধু তাই নয়। যাকে সে জীবিতকালে কখনো দেখে নাই, মৃত্যুর পরও যার দিকে চোখ খুলে তাকাতে পারে নাই, তারই প্রতি কেমন একটু মমতাও বোধ করতে শুরু করেছে। অবশ্য সে বোঝে, কাদেরের মনের মমতার তুলনায় তা নগণ্য অংশ মাত্র। তবু তা দু-জনের মধ্যে বন্ধন করে যেন। 

‘যান, ছুটি নিয়ে নেন আজ। হেডমাস্টারকে বলুন গিয়ে।’ 

এ-উপদেশটা আসে আরবির মৌলবীর কাছ থেকে। যুবক শিক্ষক দেখে, উপদেশদাতা তারই দিকে তাকিয়ে আছে। অন্যান্য শিক্ষকের দৃষ্টিও তার ওপর। 

‘পেটের ব্যথাটা একটু কমেছে যেন।’ গলায় সুস্থতার আভাস জাগাবার চেষ্টা করে সে উত্তর দেয়। 

সে-বিষয়ে তর্কের কোনো অবকাশ থাকে না। ইস্কুলের ঘণ্টা বেজে ওঠে। টিফিনের সময় উত্তীর্ণ হয়েছে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *