চাঁদের অমাবস্যা – ১১

এগার 

কাদের তার জন্য অপেক্ষা করেছিল। যুবক শিক্ষক ঘরে প্রবেশ করলে সে এক পলকের জন্যে তার দিকে চোখ তুলে তাকায়, কিন্তু কিছু বলে না। জানালাটি বন্ধ বলে ঘরে আবছা অন্ধকার। সে-জন্যে তার চেহারা ভালো করে দেখা না গেলেও যুবক শিক্ষক তাতে কেমন স্তব্ধতা অনুভব করে। 

একটু ইতস্তত করে যুবক শিক্ষক টেবিলের পাশের ছোট নড়বড়ে চেয়ারটি টেনে নিঃশব্দে সোজা হয়ে বসে। কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে আপনা থেকেই খোশ মেজাজে ঘোষণা করে, ‘একটু বেড়িয়ে এলাম।’

কাদের এবারও কিছু বলে না। একটু পরে যুবক শিক্ষক সংগোপনে তার দিকে তাকায়। কাদেরের মুখটা সামান্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তাতে নিঃসন্দেহে স্তব্ধভাব। তারপর সে তার অর্ধনিমীলিত চোখের দিকে তাকায়। সে-চোখের দিকে তাকিয়ে যুবক শিক্ষক হঠাৎ যেন তার অর্থ বুঝতে পারে। সে- চোখ এ-দুনিয়া সে-দুনিয়া, এপার-ওপার দু-দুনিয়া দু-পারই দেখে। জেগে থেকেও কাদের ঘুমিয়ে, ঘুমিয়েও সে জেগে। তার রাতে সূর্য অস্ত যায় না, আবার প্রখর সূর্যলোকে রাতের অবসান হয় না। তার দৃষ্টি অস্তিত্বের এমনই একটি ক্ষেত্রে নিবন্ধ যেখানে জীবনমৃত্যুর মধ্যে কোনো ব্যবধান নাই, যেখানে দুটিই যুগপৎ সত্য, দুটিই একত্রে বিরাজ করে। বিস্ময় কি যে কাদেরকে বুঝবার চেষ্টা করতে গিয়ে নিজেই অবাস্তব জগতে প্রবেশ করেছিল। 

যুবক শিক্ষক কাদেরকে দেখে খুশিই হয়েছিল। তাকে তার শেষ প্রশ্নটি করা বাকি। কিন্তু এবার তার চোখ-মুখের দিকে তাকিয়ে তার মনে হয়, আর প্রশ্নের কী দরকার? মনের অশান্তি কেটেছে। তার জীবনে যে-ফাটল ধরেছিল, সে-ফাটলে আবার জোড়া লেগেছে। কেন সে তাকে ব্যক্ত করবে? 

আবার সে অনেকটা অকারণে বলে, নদীর ধারে একটু বেড়িয়ে এলাম।’ 

কাদের পূর্ববৎ নির্বাক থাকে। কিন্তু নদীর কথায় তার চোখে যেন ঈষৎ কম্পন দেখা যায়।

না, তবু তাকে প্রশ্নটি করতে হবে। তার শেষ প্রশ্ন। সে-প্রশ্নের পরেই কাদের খালাস পাবে। সন্তোষজনক উত্তর পাবে তাতে সন্দেহ নাই, কিন্তু কথাটি মুখ থেকে না শোনা পর্যন্ত সে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত হতে পারে না। সে কি একটা বিরাট দায়িত্বের বোঝা ঘাড়ে নেয় নাই? মায়ামমতার কারণেই সে তাকে নির্দোষ বলে গ্রহণ করবে—এ-সিদ্ধান্তের অর্থ কি এই নয় যে, সে নিজেকে নিজেই বিচারকের পদে নিযুক্ত করেছে? কে সে? একজন দরিদ্র শিক্ষক মাত্র, শিক্ষকতা করলেও যার জ্ঞানবুদ্ধি-অভিজ্ঞতা নেহাৎই সীমাবদ্ধ। তাছাড়া, অন্যদিক থেকে কথাটা ভেবে দেখলে এই মনে হয় না কি যে, দায়িত্বটি গ্রহণ করে খোদার চেয়ে বান্দাকেই সে বড় করে দেখছে? স্রষ্টার চোখে তাঁরই সৃষ্ট মানুষের প্রাণহরণ অতীব জঘন্য অপরাধ। সে- অপরাধের গুরুত্ব তিনিই সম্যকভাবে নির্ণয় করতে পারেন, তিনিই কেবল বলতে পারেন কোনো মানুষের অন্তরে কতখানি দয়ামায়া, কতখানি নির্দয়তা। যে-কথা যুবক শিক্ষক কাদেরের বিবৃতিতে এবং আচরণে সাব্যস্ত করবে, সে-কথা তার কাছে বিনা চেষ্টায় সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ পাবে। যুবক শিক্ষক কি বিশ্বাসী নয়? 

শেষোক্ত প্রশ্নটি তাকে বিচলিত করে। ক্ষণকালের জন্যে তার মনে হয়, এ-প্রশ্নের জবাব সে দিতে পারবে না। 

নিশ্চিত জয়ের সামনে দাঁড়াবার পর আকস্মিকভাবে এবং অপ্রত্যাশিত কোণ থেকে একটি দুর্লঙ্ঘনীয় বাধা এসে হাজির হলে মনে ক্ষোভদুঃখের সৃষ্টি হয়। সে-ক্ষোভদুঃখ সাময়িক বিহ্বলতা আনলেও পরে আবার যে-কোনো প্রকারে বাধাটি অতিক্রম করার জন্যে একটি অন্ধ জিদ চাপে, মানুষ মরিয়া হয়ে ওঠে। যুবক শিক্ষকের মনে সন্ত্রাস সৃষ্টি হয় এই ভেবে যে, দুর্বহপ্রায় যে-দায়িত্বটি সে গ্রহণ করেছে এবং যে-দায়িত্ব সে কৃতকার্যতার সঙ্গে প্রতিপালন করতে পারবে বলে তার বিশ্বাস, সে-দায়িত্বটি যেন হাত থেকে শেষ মুহূর্তে খসে যাবে। কিন্তু এখন দায়িত্বটি ছাড়তে সে রাজি নয়। 

না, সে অবিশ্বাসী নয়, কারণ বিশ্বাসী হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে সে এ-বিষয়ে সজ্ঞান যে, তার বিশ্বাসটি প্রশ্নহীন। যেখানে বিশ্বাসটি থামে তার ওধারে কী আছে সে জানে না। সে-কথা তার জানবার ক্ষমতা নাই, জানবার চেষ্টাও সে করে না। কেন করবে? অন্ধবিশ্বাস দাবি করে দৃষ্টিশক্তি আশা করা অনুচিত। কিন্তু যে-ক্ষুদ্র জগতে মানুষ বিচরণ করে সে- জগতের কোথায় ভালো কোথায় খারাপ সে-কথা বিচার করার ক্ষমতা মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া উচিত নয়। সে-ক্ষমতাটুকু হারালে মানুষ অতিশয় সীমাবদ্ধ প্রাণীতে পরিণত হবে। যুবক শিক্ষক কী চায়? সে চায় একটি কথা বিচার করতে : কাদের মানুষ কি অমানুষ, তার হৃদয়ে ভালবাসা- দয়ামায়ামমতা আছে, না তাতে কেবল নির্দয়তা। মানুষের কর্তব্য মানুষকে ভালবাসা, তার সঙ্গে স্নেহের নীড় বাঁধা, তাকে বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করা। সে- বিষয়ে কে সফল হয়েছে কে হয় নাই, সে-কথা মানুষই বিচার করবে, কারণ মানুষের ভালোমন্দে মানুষেরই লাভ-লোকসান। যুবক শিক্ষক এ-কথা জিজ্ঞাসা করছে না সৃষ্টিকর্তা কেন কাউকে ভালো করেন কাউকে খারাপ করেন : তাঁর গূঢ় উদ্দেশ্য সে বোঝে না। শুধু মানুষের ভালোমন্দ বিচারের অধিকার চায়। 

হঠাৎ সভয়ে যুবক শিক্ষক ভাবে, এমন সব কথা সে কখনো ভাবে নাই। সে কি পাগল হয়েছে? বাঁশঝাড়ের ঘটনাটি কি তার মস্তিষ্কবিভ্রান্তি ঘটিয়েছে? 

কিন্তু অপরপক্ষকে শান্ত করবার জন্যেই যেন প্রশ্নটি তোলে। তার যুক্তির জন্যে সে মনে কোনো অনুশোচনা বোধ করে না। 

আর ভাববার সময়ও পায় না। হঠাৎ কাদের সম্বন্ধে সচেতন হয়ে তার দিকে তাকায়। কাদেরের দৃষ্টি তার ওপর নিবদ্ধ। সে-দৃষ্টিতে কেমন যেন সন্দেহ। চোখাচোখি হতেই সে চাপা, খখনে গলায় প্রশ্ন করে, ‘কী অত চিন্তা করেন?’ 

উত্তর না দিয়ে যুবক শিক্ষক একটু হাসবার চেষ্টা করে, কিন্তু সামান্য মুখব্যাদান করে নিরস্ত হয়। তারপর তার দিকে না তাকিয়ে আস্তে বলে, ‘এসেছেন, ভালোই হয়েছে। আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই।’ 

সূর্যাস্তের দেরি নাই। উঠানে যে-অংশটি দৃষ্টিগত হয় সেখানে কয়েক মুহূর্তের জন্যে দুটি গরু, তারপর একটি রাখালমানুষকে দেখা যায়। হঠাৎ যুবক শিক্ষকের সন্দেহ হয়, প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করার জন্যে সময়টি কি উপযুক্ত? কিন্তু তার সময় নাই। দাদাসাহেবকে একটা উত্তর দিতে হবে। তাছাড়া, উত্তরটি জানবার জন্যে তার মনেও ঔৎসুক্য কম নয়। তবু মনে দ্বিধা হয়। উত্তরটি যে সুখবর হবে তা জেনেও প্রশ্নটি করতে তার ভয় হয়। কয়েক মুহূর্ত সে নিশ্বাস বন্ধ করে রাখে। তারপর সে ভাবে, তার বিশ্বাসটি যদি অসত্য প্রমাণিত হয়, তবে বাইরের পৃথিবীই ধূলিসাৎ হবে, তার কোনো ক্ষতি হবে না; সে-ধ্বংসলীলা তার চুল পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারবে না। তারপর তার চিকন নাসারন্ধ্র যেন সতর্কিতভাবে কেঁপে ওঠে। নিঃশব্দে সে নিশ্বাস নেয়, শূন্য বুক ভরে ওঠে। 

‘একটা কথা জানা বড় প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।’ 

কাদের নীরব হয়ে থাকে। তার নীরবতায় যুবক শিক্ষক কিছুটা দমিত হয়। কাদের যদি একবার জিজ্ঞাসা করত কী সে-কথা যা যুবক শিক্ষকের জানা বড় প্রয়োজন, তবে আপনা থেকেই প্রশ্নটি বেরিয়ে আসত। জিহ্বার ডগায় সে-প্রশ্ন, সামান্য পালকস্পর্শই যথেষ্ট। 

কাদেরের দিকে চেয়ে সে প্রশ্ন করে, ‘আপনি কেন এসেছেন?’ 

কাদের অর্ধনিমীলিত চোখে প্রশ্নটা ভেবে দেখে। তারপর চোখ বন্ধ করে বলে, ‘আপনার কথাই বলেন।’ 

তার কণ্ঠের আওয়াজে কেমন প্রশ্রয়ের আভাস। কিন্তু মনে হয়, চোখ বন্ধ করেও সে যেন স্থির নির্নিমেষ দৃষ্টিতে যুবক শিক্ষকের দিকে তাকিয়ে আছে, তার কথা শোনবার জন্যে কানও খাড়া করে রেখেছে। সে যেন আজ দু-জগতের বাসিন্দা আর নয়। মুহূর্তের জন্যে যুবক শিক্ষকের মনে ভয়ের আবির্ভাব হয়। সে ভাবে, তার মাথায় এ কী অদ্ভুত খেয়াল জন্মেছে? কেন সে কাদেরকে প্রশ্ন করতে চায়? অকস্মাৎ আগাগোড়া সমস্ত ব্যাপারটিই যেন অর্থহীন মূল্যহীন মনে হয়, তার সত্যাসত্য বিচার করার কথাও নিতান্ত অহেতুক মনে হয়। তবু একটা হদিস পাবার আশায় সে কাদেরের দিকে তাকায়। তার চোখ পূর্ববৎ নিমীলিত, সারা শরীরে পাথরের মতো নিশ্চলতা। এবার যুবক শিক্ষকের মনে হয়, সে নিশ্চলতার সামনে বেশিক্ষণ সে স্থির হয়ে থাকতে পারবে না, হঠাৎ একটা দুর্বার স্রোত এসে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। কাদের কিছু বলে না কেন? তার মনেও কি একটি নিদারুণ ভয় উপস্থিত হয়েছে? প্রশ্ন করতে যুবক শিক্ষকের মনে যেমন ভয়, প্রশ্ন শুনতেও তার মনে কি তেমনি ভয়? দু-জনের মনেই ভয়। তবে একই ভয় : দু-ভয়ে কোনো তারতম্য নাই। তাদের পক্ষে পরস্পরকে সাহায্য করা সম্ভব নয় কি? 

একটা গভীর নিঃসঙ্গতাবোধে নিঃসাড় হয়ে থেকে কাদেরের মতো সেও চোখ নিমীলিত করে। এবার চারধারে ঘন-কালো অন্ধকার জাগে, নীরবতাও যেন নিবিড় হয়ে ওঠে। সে ভাবে, তারা আক্রমণ-উদ্যত শত্রু নয়, বন্ধু। তবে দু-জনেই নিঃসঙ্গ, কী একটা প্রশ্নের জন্যে ঘনতমসার মধ্যে হাতড়িয়ে ফিরছে। যা খুঁজছে তা না পেলেও তারা যদি পরস্পরের হাত ধরতে পারে, শুধু একটু সময়ের জন্যে, একটি মুহূর্তের জন্যে, তবে ক্ষীণতম হলেও তবু তারা একটা আলো দেখতে পেত। 

যুবক শিক্ষকের ঠোঁটটা একটু কেঁপে ওঠে। কেন কথা বলছে সে-কথা বুঝতে না পারলেও ঘন অন্ধকারের মধ্যে সে এবার বলে, ‘আপনি সব কথাই বলেছেন কিন্তু একটা কথা বলেন নাই।’ 

কাদের উত্তর দেয় না। কিন্তু যুবক শিক্ষক কোনো উত্তর বা উক্তির জন্যে অপেক্ষা করে না। আবার বলে, ‘কথাটা কী করে বলি?’ মুখটা তার সামান্য লাল হয়ে ওঠে। তারপর সে বলেই ফেলে, ‘যুবতী নারীর প্রতি আপনার মায়ামমতার কথা বলেন নাই।’

কথাটা সে অবশেষে বলেছে। কেমন অসংলগ্ন শোনায়, কিন্তু ঘনতমসার মধ্যে কোন কথা অসংলগ্ন শোনায় না? যুবক শিক্ষক স্থির হয়ে থাকে। তারপর সে অপেক্ষা করে। অন্ধকারটা হাল্কা হয়ে উঠেছে, শীঘ্র সে যেন আলোতে ভেসে উঠবে, আবার চাঁদ-তারা আকাশ দেখতে পাবে। কোনো উত্তর না পেলে সে এবার চোখ খুলে তাকায়। অদূরে ছায়াটি এখনো নিশ্চল হয়ে আছে। 

কাদেরের চোখ উন্মুক্ত। সে তারই দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে। সে এমনভাবে তাকিয়ে আছে কেন? হয়তো তার দৃষ্টি এড়াবার জন্যেই সে এবার তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায়। ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলে, ‘দাঁড়ান, আলো জ্বালাই।’ তারপর লণ্ঠন জ্বালানোর কাজে মনোনিবেশ করে সে বলে, ‘বুঝলেন আমার কথাটা?’ কাদেরের দিকে তাকাতে তার আর সাহস হয় না, একটা গভীর লজ্জা এসে তাকে গ্রাস করে। লণ্ঠনটি জ্বালিয়ে সেটি দরজার এক পাশে ঠেলে দেয়, কাদেরের সঙ্গে চোখাচোখি হবার ভয়ে তা টেবিলে রাখতে পারে না। তারপর সে চেয়ারে ফিরে এসে কাদেরের দিকে পাশ দিয়ে বসে। 

অবশেষে কাদেরের কণ্ঠ শোনা যায়। সে-কণ্ঠে গভীর বিস্ময় না সন্দেহ তা যুবক শিক্ষক ধরতে পারে না। সে আস্তে প্রশ্ন করে, ‘আপনার মতলব কী?’ 

এ-প্রশ্নটি কাদের সকালেও তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল এবং তখন প্রশ্নটি তাকে আঘাত দিয়েছিল। এখন সে তাতে আঘাত পায় না। বরঞ্চ সে ভাবে, সকালে কাদেরের সামনে যে- ভাবে সে আচরণ করেছিল, তারপর তার মনে এ-বিশ্বাসই হওয়া স্বাভাবিক যে তার প্রতি যুবক শিক্ষকের কোনো সহৃদয়তা নাই। যুবক শিক্ষকের মনে যে একটা পরিবর্তন এসেছে তা সে কী করে বুঝবে? 

‘না, আমার কোনো কু-মতলব নাই।’ আবার সে একবার হাসবার ব্যর্থ চেষ্টা করে। ‘আমার কথাটি বুঝতে পারছেন না কেন?’ 

‘কথাটা কী?’ 

‘একটা দুর্ঘটনার কথাই আপনি শুধু বলেছেন। আর কিছু বলেন নাই।’ 

কাদের তার কথা এখনো বুঝতে পারে নাই। একটু থেমে আবার প্রশ্ন করে, ‘আর কী বলব?’ 

‘বললাম না?’ 

‘কী বললেন?’ 

যুবক শিক্ষকের মনে হয় আবার সে একটি ফাঁদে পড়েছে : এ-ফাঁদ অতীব বাস্তব, অতীব সত্য। তার মুখ ঝাঁ-ঝাঁ করতে শুরু করে। 

‘বললাম তো! মেয়েলোকটির জন্যে আপনার মায়ামহব্বত ছিল সে-কথা একবারও বলেন নাই।’

এবার কথাটা বোধগম্য হয়েছে কিনা তাই দেখবার জন্যে ক্ষিপ্রদৃষ্টিতে সে একবার কাদেরের দিকে তাকায়। যা দেখে তাতে প্রথমে তার বিস্ময় হয়, তারপর ভয়। কাদেরের চোখ সম্পূর্ণভাবে খোলা : সে যেন কী একটা কথা বুঝবার আপ্রাণ চেষ্টা করে। তারপর সে চোখ ঘোলাটে হয়ে ওঠে, তাতে শেষে রক্তাভা দেখা দেয়। 

শুষ্ককণ্ঠে যুবক শিক্ষক প্রশ্ন করে, ‘কী ব্যাপার?’ 

কাদের উত্তর দেয় না। সে দৃষ্টি সরিয়ে নেয় কিন্তু তার চোখে রক্তাভা ক্রমশ আরো গাঢ় হয়। তিল-তিল করে তাতে যেন রক্তবিন্দু জমছে। অবশেষে তার দৃষ্টি ঘরময় ঘুরতে থাকে। সে যেন কী সন্ধান করে, কী যেন বুঝতে চায়। এখানে-সেখানে সে-দৃষ্টি থামে, কিন্তু ক্ষণকালের জন্যে, তারপর এক সময় আলগোছে যুবক শিক্ষকের ওপর দিয়ে বয়ে যায়। একবার, দু-বার। তাকে দেখেও দেখে না, তবু তার ওপর দিয়ে যখন বয়ে যায়, তখন তার দৃষ্টি এক মুহূর্তের জন্যে কেমন তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। যুবক শিক্ষক বোধ করে, তার ভেতরটা হঠাৎ শীতল হয়ে উঠছে। অধীর হয়ে সে বলে, ‘সত্যি কিনা বলেন। হাঁ-না কিছু বলেন।’ 

কোনো উত্তরই আসে না। তারপর যুবক শিক্ষকের মনে হয়, ক্ষুদ্র ঘরটা যেন চক্রাকারে ঘুরতে শুরু করেছে। সঙ্গে-সঙ্গে সেও ঘুরতে শুরু করে। তার মাথাটা শূন্য হয়ে ওঠে, তারপর দপদপ করে। একটা অকথ্য জ্বালায় সারা শরীরে যন্ত্রণাও জাগে। লোমশ বিষাক্ত বিচ্ছু গায়ে কিলবিল করে বেড়াচ্ছে; হাতে, পায়ে। তারপর সমগ্র দেহে। কিন্তু সে কিছু পরওয়া করে না। তার দৃষ্টি কাদেরের ওপর নিবদ্ধ। চতুর্দিকে ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে কাদেরই যেন কেবল স্থির হয়ে আছে। না, তার রক্তাক্ত স্ফীতমস্ত চোখ দুটি ঘোরে, কেবল ঘোরে, চক্রাকারে এবং অন্তহীনভাবে। 

তারপর যুবক শিক্ষকের মনে হয়, সে যেন দ্রুতভাবে কথা বলতে শুরু করেছে। গলা অনুচ্চ হলেও নিজেরই কানে তার স্বর অস্বাভাবিক ঠেকে, বিষয়বস্তুও ঠিক বোধগম্য হয় না। কেবল ক্ষিপ্রগতিতে অস্পষ্ট শব্দগুলি মুখ থেকে বেরিয়ে চতুর্দিকে ছিটকে পড়ে, একটার পর একটা, কোথাও জোড়া লাগে না, কোথাও বিদ্ধ হয় না। তাতে সে দমে না। শব্দগুলি সে ছুঁড়তেই থাকে, পাগল মানুষ যেমন ঢিল–পাথরের স্তূপ পেয়ে অশ্রান্তভাবে লক্ষ্যহীনভাবে তা ছুঁড়তে থাকে চতুর্দিকে। তারপর এক সময় হয়তো তার কথার উৎস শুকিয়ে আসে। কারণ তার মনে হয় সে একটি কথাই বারবার বলছে, একটি ঢিলই ছুঁড়ছে। কিন্তু ছুঁড়তেই আবার সেটা হাতে ফিরে আসে বা হাত থেকে বেরিয়েও হাতেই থেকে যায়। 

‘বুঝলেন কথাটা কেন দরকারি? বুঝলেন, বুঝলেন?’ 

সে কোনোই উত্তর পায় না। তারপর ঘূর্ণমান ঘরটি ধীর স্থির হয়, একটা নিঃস্ব তবু প্রীতিকর নীরবতা ফিরে আসে। 

অবশেষে কাদেরের কণ্ঠ শোনা যায়। সে কণ্ঠে ঘৃণা, বিস্ময়। শুধু তাই নয়। সে একটি অদ্ভুত কথা বলে। প্রথমে কথাটি বুঝতে পারে না যুবক শিক্ষক। কিন্তু কাদেরের কণ্ঠ যখন নীরব হয় তখন নীরবতার মধ্যেও তার কথাটি শুনতে পায় বার বার। অতি বিস্ময়ে সে নিজেকে প্রশ্ন করে, সে পাগল? কাদের যেন তাই বলল। 

তারপর কাদের তাকে ভয়-প্রদর্শন করে। যুবক শিক্ষক সুস্থমস্তিষ্ক নয় কথাটি আবিষ্কার করেছে বলেই সে যেন ভয়-প্রদর্শন করার প্রয়োজন বোধ করে। কিন্তু কাদেরের উক্তিটি তাকে স্পর্শ করে না। তার মন অন্যত্র। কেবল সে একাধিকবার বলা কথাটি আবার বলবার জন্যে তীব্র ইচ্ছা বোধ করে বলে সেটি শেষবারের মতো শূন্যতায় নিক্ষেপ করে, নিরাশভাবে, পূর্ববৎ লক্ষ্যহীনভাবে। 

‘আমার কথাটা এখনো বুঝলেন না?’ 

কাদের কোনো উত্তর দেয় না। যুবক শিক্ষকের প্রশ্নটি নিস্তব্ধ ঘরে কতক্ষণ বিসদৃশভাবে ঝুলে থাকে, তারপর প্রশ্নকারীকেই তা নির্মমভাবে লজ্জা দিতে শুরু করে। সেটি যেন তার প্রশ্ন নয়, তারই উলঙ্গ দেহ। সে-দেহ কড়িকাঠ থেকে ঝুলছে। 

একটি কথা তার কাছে অত্যাশ্চর্য মনে হয়। অনতিদূরে হত্যাকারী সম্পূর্ণভাবে বস্ত্রাচ্ছাদিত হয়ে সুস্থির হয়ে বসে, কোথাও একটু অসংলগ্নতা নাই। 

যুবক শিক্ষক অবশেষে বোঝে, কাদেরের পক্ষে দরিদ্র মাঝির বউ-এর প্রতি কোনো ভাবাবেগ বোধ করা সম্ভব নয়। 

তারপর যুবক শিক্ষকের চোখের সামনে একটি ধু-ধু প্রান্তর জেগে ওঠে। সে-প্রান্তর শুধু ধু-ধুই করে, তাতে কোনো মরীচিকা নাই। যে-মরীচিকার পেছনে সে এ-ক’দিন ছুটেছিল, সে-মরীচিকার কোনো আভাস নাই সেখানে। 

 একটু পরে আপন মনেই শান্তভাবে যুবক শিক্ষক বলে, ‘তবে আর কী? সব শেষ হল।’

মরীচিকা যদি অদৃশ্য হয়ে গিয়ে থাকে তবে কাকে দোষ দিতে পারে? 

অবশেষে সে কাদেরের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আমার আর কোনো উপায় থাকল না।’

কাদেরের চোখটা দপ করে জ্বলে ওঠে, ঠোঁটের পাশটা বিকৃত হয়ে ওঠে। কিছু না বলে হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে ক্রুদ্ধভঙ্গিতে সে চলে যায়। তার ঘাড়ের একটা দিক অতিশয় উঁচু মনে হয়। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *