চাঁদের অমাবস্যা – ৩

তিন 

শীতের মিষ্টিরোদ ইস্কুলের নেড়ে প্রাঙ্গণেও স্নিগ্ধ সোনালি আলো ফেলেছে। এক কোণে পাতাবাহারের গাছে সে আলো ঝলমল করে। 

চুনবালিতে লেপা বাঁশের দেয়াল, কাঠের ঠাট, ওপরে তরঙ্গায়িত টিনের ছাদ। ছাত্রদের সামনের বার্নিশশূন্য বেঞ্চিতে কালির দাগ, অনেক গ্রীষ্মের ঘামের ছাপ, এখানে-সেখানে ছুরির নির্দয় আঁচড়। অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার টেবিলের পেছনে বসে যুবক শিক্ষক আরেফ আলী। গায়ে নিত্যকার মতো সামান্য ছাতাপড়া, জীর্ণ সবুজ আলোয়ান, পরনে আধা-ময়লা সাদা পায়জামা, পায়ে ধুলায় আবৃত অপেক্ষাকৃত নোতুন পাম্প-সু। অভ্যাসমতো টেবিলের তলে সে অবিরাম ডান পা নাড়ে। পা-টি যেন কলযন্ত্রে চালিত হয়। 

আরেফ আলীর বয়স বাইশ-তেইশ। কিন্তু তার শীর্ণ মুখে, অনুজ্জ্বল চোয়ালে বয়োতীতভাব : যৌবনভার সে যেন বেশিদিন সহ্য করতে পারে নি। সে-মুখে হয়তো যৌবনকণ্টক জন্মেছিল, কখনো যৌবনসুলভ পুষ্পোদগম হয় নাই। কয়েক বছর আগে মাদ্রাসা- হাদিসের প্রভাবে দাড়ি রেখেছিল, আজ সে-দাড়ি নাই। কিন্তু এখনো মনে হয় থুতনির নিচে কেমন উলঙ্গতার ভাব। খাড়া নাক চিকন, কপাল ঈষৎ সমুন্নত, চোখে একটু কাঠিন্যভাব। তবে রসশূন্যস্বাস্থ্যের জন্যেই তার চোখ কঠিন মনে হয়। লক্ষ্য করে দেখলে সে-চোখের সরলতা, সময়ে সময়ে অসহায়তাও নজরে পড়ে। কখনো-কখনো তার মধ্যে উদ্ধতভাব ও দম্ভ দেখা যায়, কিন্তু সেটা শিক্ষকতা করে বলে চড়ানো ব্যাপার। তবু একটু অহঙ্কার নাই যে তা নয়। দম্ভ-ঔদ্ধত্য না হোক, শিক্ষক হলে অহঙ্কার না হয়ে পারে না। তবে সেটা কৃত্রিম নয় বলে সযত্নে ঢেকে রাখে, শুধু ক্বচিৎ-কখনোই তার আভাস পাওয়া যায়। 

আরেফ আলী অনেকক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে থাকে। এক সময়ে হঠাৎ সচেতন হয়ে সে লক্ষ্য করে, ছাত্রদের কোলাহল ঝড়ের বেগ ধারণ করেছে। শিক্ষকের অন্যমনস্কতা লক্ষ্য করে তারা সংযমের লাগাম ছেড়ে শোরগোল শুরু করেছে এবং সে- শোরগোল এমন এক উচ্চ খাদে উঠেছে যে সেখানে ব্যক্তিগত কন্ঠের কোনো চিহ্ন নাই। সে জন্যেই মনে হয় ঝড় বইছে। 

অন্যদিন তীক্ষ্ণগলায় তবু হৃদ্যতার সঙ্গে শিক্ষক আরেফ আলী আঙ্গুল নেড়ে শাসন করত। আজ কেমন শ্রান্তগলায় বলে, ‘না না, গোলমাল করো না।’ 

ছাত্রদের কোলাহল দু-এক খাদ নিচে নেমে একটু অপেক্ষা করে, তারপর আবার সে উচ্চপদে আরোহণ করে। কিছুক্ষণ সময় কাটে। অবশেষে আরেফ আলী এধার-ওধার তাকায়। আওয়াজটা কোত্থেকে যে আসছে তা যেন বুঝতে পারে না। পূর্ববৎ শ্রান্তগলায় বলে, ‘কী? বললাম না গোলমাল করো না?’ 

শিক্ষকের দৃষ্টি ছাত্রদের উপর নিবদ্ধ থাকে বলে এবং তার মন অন্যত্র ফিরে যায় না দেখে কোলাহল হঠাৎ থামে। যেন ঝড় থামে। একটু দম নিয়ে যুবক শিক্ষক আবার এধার-ওধার তাকায়। কেন তাকায়, নিজেই তা বোঝে না। তারপর অভ্যাসবশত অন্যদিনের মতো আমজাদকেই প্রশ্ন করে, ‘বলো, তিনটি পর্বতমালার নাম বলো।’ 

শান্তচিত্ত হয়ে যেন যুবক শিক্ষক শিক্ষকতার কাজ শুরু করে, ছাত্ররাও হঠাৎ পাঠানুরাগী হয়ে ওঠে। আমজাদ দ্বিধা না করে বলে, 

‘হিমালয়।’ 

‘তারপর?’ 

‘আরাবল্লী।’ 

‘তারপর?’ 

‘বিন্ধ্যাচল।’ 

‘বেশ। মনে রেখো, হিমালয় দুনিয়ার সবচেয়ে বড় পর্বতমালা। দৈর্ঘ্যে, উচ্চতায়, ঘনত্বে তার সেরা নাই।’ 

সামনের বেঞ্চি থেকে একটি ছেলে ডাকে ‘স্যার?’ 

‘বলো।’ 

‘হিমালয় দেখেছেন?’ 

দরিদ্র যুবক শিক্ষক, কোপন নদীর ধারে ক্ষুদ্র চাঁদপারা গ্রামে তার জন্ম। কষ্টেসৃষ্টে নিকটে জেলা শহরে গিয়ে আই.এ. পাস করেছে, সুপরিচিত নদী-খাল-বিল ডোবা-মাঠ-ঘাট সুদূরপ্রসারী ধান ফসলের ক্ষেতের বাইরে কখনো যায় নাই। সমতল বাংলাদেশের অধিবাসী, পর্বতমালা কখনো দেখে নাই। বই-পুস্তকে, সাময়িক পত্রিকা- সংবাদপত্রে কোনো কোনো পর্বতের ছবি দেখেছে, কিন্তু অনেক পর্বতের শুধু নামই শুনেছে। এণ্ডিজ, উরাল, ককেসিয়ান আলতাই পর্বতমালা। কত নাম। সব স্বপ্নের মতো শোনায়। 

‘না। হিমালয় দেখি নাই। হিমালয় দেখার সৌভাগ্য হয় নাই।’ কিছুটা ক্ষুণ্ণ কিন্তু পরিষ্কারকণ্ঠে যুবক শিক্ষক জবাব দেয়। 

যুবক শিক্ষকের মনে ইস্কুল ঘরের পারিপার্শ্বিকতা এবং শিক্ষকতার কাজ সাধারণ রূপ ধারণ করেছিল। হয়তো দেখা না-দেখার কথাতেই হঠাৎ নিমেষের মধ্যে সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। বিদ্যুৎ-ঝলকের মতো একটি ভয়াবহ দৃশ্য আবার তার চোখের সামনে এসে উপস্থিত হয়। তারপর কেউ যেন তার শরীরের রক্তপানি শুষে নেয়, শূন্য শরীর অপরিসীম শ্রান্তিতে অবশ হয়ে আসে। দমটা কাটলে সে আপন মনে বলে, হিমালয় সে দেখে নাই। বস্তুত, সে কিছুই দেখে নাই। দরিদ্র শিক্ষক, কিছুই তার দেখার সৌভাগ্য হয় নাই। 

সজোরে নিশ্বাস নিয়ে যুবক শিক্ষক তারপর জানালা দিয়ে স্বর্ণোজ্জ্বল সূর্যালোকের দিকে তাকায় কিন্তু সে-আলো সে দেখতে পায় না। একটি দৃশ্যই কেবল তার চোখে ভাসে। সে-দৃশ্য থেকে তার নিস্তার নাই, তার মনে-প্রাণে ও দেহের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তার বিভীষিকাময় ছায়া। 

কিছুক্ষণ পর যুবক শিক্ষক অস্পষ্টভাবে শুনতে পায়, ক্লাসঘরে আবার কলরব জেগেছে। কিন্তু তাদের শাসন না করে সে সর্বাঙ্গে নিশ্চল হয়ে বসে থাকে। সে যে কেবল দৃশ্যটিই দেখে তা নয়, একটি মানুষের মুখও বার বার দেখতে পায়। আসলে সে-মুখই যেন ভয়াবহ দৃশ্যটিকে ঢেকে দেয়, এবং সে-মুখ ভয়াবহ মনে না হলেও প্রতিবার তার জন্যেই তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, শরীরেও কাঁপুনি ধরে। তবু বারেবারে মনশ্চক্ষুতে মুখটিকে সে চেয়ে চেয়ে দেখে। 

তারপর হয়তো ছাত্রদের কোলাহল অসহনীয় হয়ে ওঠে। অথবা অতি বিচিত্র মানসিক অবস্থার মধ্যেও কর্তব্যের কথা তার স্মরণ হয়। আবার সজোরে নিশ্বাস নিয়ে সে ছাত্রদের দিকে তাকায়। তাদের মুখ কেমন অস্পষ্ট মনে হয়। দুর্বলকণ্ঠে সে প্রশ্ন করে, ‘কে বলবে এবার?’ 

সে শাসন না করলেও গোলযোগ সহসা শান্ত হয়। যুবক শিক্ষক অবশেষে মতিনকে দেখতে পায়। ঘোর-কালো ছেলে, কিন্তু বড় বড় চোখ টলটল করে। 

‘তুমি বলো। তিনটে উপদ্বীপের নাম বলো।’ 

যুবক শিক্ষক মতিনের দিকে তাকিয়ে থাকে বটে কিন্তু তার উত্তর তার কানে পৌঁছায় না। কেবল শোনবার ভঙ্গি করে ঘন ঘন মাথা নাড়ে। তার ডান পাও আবার অভ্যাসমতো নড়তে শুরু করেছে। 

মতিনের গলার স্বর থামলে অজান্তেই সাধুতার পরিচয় দিয়ে যুবক শিক্ষক প্রশ্ন করে, ‘বলেছ তিনটি উপদ্বীপের নাম?’ 

‘বললাম তো।’ 

‘বেশ বেশ।’ যুবক শিক্ষক আবার সজোরে নিশ্বাস নেয়। ছেলেদের মুখ যেন পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। এবার তাদের কচি মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ অকারণে কেমন বেদনা বোধ করে। ‘বেশ। তাহলে এবার তিনটে দীর্ঘতম নদীর নাম বলো।’ এধার-ওধার চেয়ে আবার আমজাদের ওপরই আঙ্গুল নিবদ্ধ করে। 

‘তুমিই বলো।’ 

.

দু-বছর আগে আরেফ আলী শিক্ষক হয়ে এ গ্রামে আসে। থাকার আশ্রয় পায় বড়বাড়িতে। খাওয়াদাওয়াও সেখানেই হয়। তার বদলে বড়বাড়ির ছেলেদের দুই বেলা ঘরে পড়ায়। তার বিশ্বাস এই যে, যত নেয় তত সে দেয় না, কিন্তু সেটা দয়াশীল দাদাসাহেবেরই ব্যবস্থা। দাদাসাহেবের প্রতি তাই তার ভক্তিশ্রদ্ধার অন্ত নাই। 

দক্ষিণে তিন মাইল দূরে তার নিজের গ্রাম। দরিদ্র সংসার, হাতের তালুর মতো এক টুকরো জমিতে জীবনধারণ চলে না। টেনে-হিঁচড়ে আই.এ. পাস করে সে দেশে ফিরে আসে। পড়তে পারলে আরো পাস করত, কিন্তু কলেজের ফি, বইখাতা কেনার পয়সা আর যোগাড় হয় না। তাছাড়া, জেলাশহরে ঘুসি-আস্তানায় থাকলেও খরচ হয়। এক রত্তি শাকসবজির জমিটাও বিক্রি করে উচ্চশিক্ষার পশ্চাতে ছোটার অর্থ হয় না। 

বর্তমান চাকুরিতে আরেফ আলীর অসন্তোষের কারণ নাই। বরঞ্চ তার বিশ্বাস, ভাগ্য দয়াবান না হলে এমন চাকুরি সহজে মিলত না। ইস্কুলটি এখনো উচ্চ ইস্কুলে পরিণত হয় নাই বটে তবু নবম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ-অধ্যয়নের দরজা খোলা হয়েছে। আশা এই যে, দু-এক বছরের মধ্যে সর্বশেষ শ্রেণীও খোলা সম্ভব হবে। সরকারি অর্থ সাহায্যের জন্যে যথাযথ আর্জি পেশ করা হয়েছে। শীঘ্র সে সাহায্যও পাওয়া যাবে সকলের ভরসা। বড়বাড়ির উদ্যম ও আর্থিক সাহায্যে এ ইস্কুলের পত্তন পড়ে। কিন্তু এখন সেদিনের ক্ষুদ্র ইস্কুলটি আর নাই; এ-কে পোষা বড়বাড়ির সামর্থ্যের বাইরে। সরকারি সাহায্য ছাড়া ইস্কুলটির উন্নতি সম্ভব নয়। অবশ্য নিরাশাবাদীদের মতে সরকারি অর্থ সাহায্য পাওয়ার পথে অনেক বাধাবিঘ্ন আছে। নিকটবর্তী জেলাশহরের দুটি উচ্চ ইস্কুলের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা কেবলই বাগাড়ম্বর নয়। এ-ইস্কুল ক্রমশ তাদের আয়ে হস্তক্ষেপ করছে সেটা সহনীয় ব্যাপার নয়। সুতরাং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা থামাবার জন্যে তারা আপ্রাণ চেষ্টা করবে। আরেফ আলী কিন্তু নিরাশ বোধ করে না। ইস্কুলের এবং সাথে সাথে নিজেরও আর্থিক এবং পদোন্নতির বিষয়ে সে নিঃসন্দেহ। তাছাড়া, বর্তমান অবস্থাই-বা তেমন বিশেষ খারাপ কী? দাদাসাহেবের অভিভাবকত্ব শুধু যে লাভজনক তা নয়, পিতৃহীন যুবকের জন্যে একটা নিরাপদ স্নেহশীল ছাতার মতো। 

হাতে যে সামান্য টাকা আসে মায়না বাবদ, তা প্রায় না ছুঁয়ে বৃদ্ধা মায়ের হাতে দিয়ে আসে। মাকে টাকা দেবার সময় প্রতিবার তার অন্তরে কী একটা ভাব উদ্বেলিত হয়ে ওঠে, চোখে প্রায় পানি আসে। কিন্তু সে-আবেগ অপ্রীতিকর ঠেকে না। অন্তর শান্ত হলে একটা সুখবোধ আসে। তখন তার মনে হয়, জীবনে যেন এই সর্বপ্রথম সে সুখবোধ অনুভব করছে। তবে নবজাত এই সুখবোধকে সরাসরি আলিঙ্গন করতে সাহস হয় না, লাজুক মানুষের মতো অজ্ঞাত আগন্তুকটিকে এড়িয়ে-এড়িয়ে চলে। তবু তার সহবাস ভালোই লাগে। একটি হাসিখুশি প্রফুল্লচিত্ত সঙ্গী জুটেছে যেন। 

.

হঠাৎ সচেতন হয়ে যুবক শিক্ষক লক্ষ করে, ক্লাসঘরে অখণ্ড নীরবতা। কপালে হাত রগড়ে ভ্রূ উঠিয়ে সে নির্বাক ছাত্রদের পানে তাকায়। দেখে, সবাই নিষ্পলকদৃষ্টিতে তারই দিকে তাকিয়ে আছে। অপ্রস্তুত হয়ে সে ছাত্রদের শাসন করতে গিয়ে থেমে যায়। ছাত্ররা গোলমাল করছে না, জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বাঁদরনাচও দেখছে না। এধার-ওধার তাকিয়ে অবশেষে আমজাদকে জিজ্ঞাসা করে, ‘কী? বলেছ উপদ্বীপের নাম?’ আমজাদ প্রতিবাদ করার আগেই সজোরে মাথা নেড়ে বলে, ‘কী বলছি! উপদ্বীপ নয়, নদীর নাম।’

আমজাদ নিরুত্তর হয়ে থাকলে পেন্সিল দিয়ে টেবিলে আওয়াজ করে কৃত্রিম বিস্ময়ের সঙ্গে আরেফ আলী বলে, ‘কী? ভুলে গেছ সব?’ 

কয়েক মুহূর্ত নীরবতার পর আমজাদ শিক্ষকের দিকে সোজা তাকিয়ে গম্ভীরভাবে প্রশ্ন করে, ‘স্যার, আপনার আজ শরীর ভালো নয়?’ 

হঠাৎ এমন প্রশ্নের জবাবটা ঝট্ করে আসে না। যুবক শিক্ষক কোনো উত্তর খুঁজে পায় না। নিদ্রাহীন রাত্রি বিচরণের ছাপ নিশ্চয় তার চোখে-মুখে স্পষ্টভাবে লেখা। তার আচরণ ও কি ছাত্রদের কাছে অস্বাভাবিক ঠেকে? 

অবশেষে নিরাশমুখে পেটে হাত বুলিয়ে সে বলে, ‘বোধহয় একটু বদহজম হয়েছে।’ পরমুহূর্তেই সে-কথা উড়িয়ে দিয়ে উচ্চকণ্ঠে আদেশ দেয়, ‘উপদ্বীপের নাম বলেছ, এবার তিনটি দীর্ঘতম নদীর নাম বলো, আমজাদ।’ 

আমজাদ বলে না যে ইতিপূর্বে সে তিনটি নদীর নাম একবার বলেছে। নত মাথায় শুষ্ককণ্ঠে সে পুনর্বার বলে। অন্য ছাত্ররা একটি কথা বলে না। 

দাহজ্বরাগ্রস্ত মানুষ যেমন স্নেহস্পর্শ অনুভব করে কিন্তু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারে না, তেমনি যুবক ছাত্রদের স্নেহজাত উদ্বেগ সে নীরবেই গ্রহণ করে। সে বোঝে তার মানসিক কষ্ট-যন্ত্রণা বিভাজ্য নয়, কারো সাথে তার ভাগাভাগি সম্ভব নয়। কারণ তার জন্মকথা প্ৰকাশ করা যায় না। 

অপরিসীম দুঃখের সঙ্গে সে ভাবে, এ কী হল তার? কিন্তু কী যে তার হয়েছে তা সে পুরোপুরিভাবে বুঝতে পারে না। সে একটি গোলকধাঁধায় ঢুকেছে, যার আকৃতি-পরিধি কিছুই জানে না, যার অর্থ সে বোঝে না। সে-গোলকধাঁধায় পরিচিত জগতের কোনো চিহ্নও নাই। 

ঘণ্টা বাজার একটু আগে হঠাৎ যেন তার জ্বর ছাড়ে। চিন্তাধারা সংযত হলে সে এবার সামান্য লজ্জাও বোধ করতে শুরু করে, কারণ তার মানসিক অবস্থার কোনো যুক্তিসঙ্গত হেতু সে খুঁজে পায় না। গোলকধাঁধায় যেন সূর্যরশ্মি প্রবেশ করেছে। সে বুঝতে পারে, বাঁশঝাড়ের দৃশ্যটির সঙ্গে তার কোনো ব্যক্তিগত যোগাযোগ নাই। দৃশ্যটি অতি বীভৎস তাতে সন্দেহ নাই কিন্তু সে শুধু তার ক্ষণকালের দর্শকমাত্র। একবার দেখেছে, আর দেখবে না। দেখে মনে যে আঘাত পেয়েছে, সে আঘাতও স্থায়ী হবে না। তাছাড়া, সে-দৃশ্যটির সঙ্গে কোনো পাপ-নৃশংসতা জড়িত, সে-পাপ-নৃশংসতা তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। 

মনে সামান্য শক্তির সঞ্চার হলে যুবক শিক্ষক ছাত্রদের বলে, ‘বলো, কে আমাজন আবিষ্কার করেছিল?’ তারপর হঠাৎ একটি কথা স্মরণ হলে বলে, ‘না, তোমাদের বইতে তার নাম নাই। পনের শ শতাব্দীতে ভিনসেন্ট পিনজোন সর্বপ্রথম আমাজন নদীটি আবিষ্কার করে। তবু বহুদিন সে-নদী রহস্যময় ছিল। কিন্তু আজ সে-নদী সম্বন্ধে কিছুই মানুষের অজানা নাই।’ একটু থেমে যুবক শিক্ষক আবার বলে, ‘সে-রহস্যও নাই, নদীটির সম্বন্ধে সে-রূপকথাও নাই। অজ্ঞানতায় রহস্য-রূপকথার জন্ম হয়।’ 

হঠাৎ শিক্ষকের কানে ঝাঁঝ ধরে। মনে হয় কান দুটি জ্বলে যাচ্ছে। সজোরে সে প্রশ্ন করে, ‘আমাজন নদীর আবিষ্কারকের নামটি বল।’ 

ছাত্ররা চুপ করে থাকে। নতুন বিদেশী নামটি তারা ধরতে পারে নাই। কোনো উত্তর না পেলে যুবক শিক্ষক কিন্তু আবিষ্কারকের নামটি দ্বিতীয় বার বলে না। তার মনে হয়, কানের ঝাঁঝটা আরো বেড়েছে যেন। সে ভাবে : তাই, কেন সে পালিয়ে গিয়েছিল? কেমন করে সে এ-কথা ভাবতে পেরেছিল যে বীভৎস দৃশ্যটির সঙ্গে কাদের জড়িত থাকতে পারে? 

অবশেষে ক্লাস বদলের ঘণ্টা বেজে ওঠে। ভূগোলের বই বন্ধ করে যুবক শিক্ষক উঠে দাঁড়ায়। পায়ে অসীম দুর্বলতা, তবে মাথাটা পরিষ্কার মনে হয়। লজ্জাভাবের রেশটা এখনো কাটে নাই, কিন্তু সে একটা গভীর স্বস্তি বোধ করে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *